পাখিদের পাড়া পড়শী - ৮
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
Pankaj Gobinda Medhi
(আট)
বাপুটি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে রয়েছে যে আমি চমকে উঠলাম।
তা দেখে আমার এরকম মনে হচ্ছে যে আমার বেঁচে থাকাটা সে কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
সে আমার কাছে এল এবং আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করতে লাগল।
– রাতের বেলা সত্যিই আপনার কাছে কেউ আসেনি?
আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট বাপুটি জিজ্ঞেস করল।
– আসেনি। এসে থাকলেও জানতে পারিনি।
– এসেছিল। আসতেই হবে। আপনিই জানতে পারেন নি।
আমি কথা বাড়াতে চাইলাম না। এই কথার শেষ নেই।
– আপনি রাতে কোনো শব্দও শোনেননি। কারও কান্না। কারও খিলখিল হাসি।
বাপুটির উৎকণ্ঠার শেষ নেই।
– শুনিনি তো।
আমি সংক্ষেপে বললাম। আমাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে না দেখে বাপুটি আর বেশি উৎসাহ দেখাল না।
– শুনবেন না। যেদিন শুনবেন সেদিন কাপড় চোপড় ভিজবে।
বলতে বলতে বাপুটি নাম ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। পুরোহিত শর্মার পুজো শেষ হওয়ার সময় হয়েছে।
আমি রুমে গিয়ে ক্যামেরাটা এবং বাইনোকুলারটা রেখে জুতো জোড়া খুলে ফেললাম। পেন্টটা ছেড়ে একটা হাফপ্যান্ট পরে নিলাম। বেশ হালকা হালকা লাগল। রুমে থাকা একমাত্র ছোট জানালাটা খুলে দিলাম। অনেকদিন জানালাটা খোলা হয়নি। জানালাটা খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুনে খাওয়া কিছু কাঠের গুড়ি ঝরঝর করে ঝরে পড়ল। আমি একটা ছেঁড়া কাগজ দিয়ে জানালার ফ্রেমটা মুছে দিলাম।রুমের ভেতরটাও ঝাড়ু দেওয়া উচিত ছিল।
পায়ের শব্দ এবং বাপুটির বিশেষ ধরনের ডাকটি থেকে বুঝতে পারছি পুরোহিত শর্মা আমার রুমের দিকে আসছে।
– এ আমার মাথাটা নষ্ট করবে। আপনি এখানে রাতের বেলা একা থাকার কথাটা সে কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আপনার কাছে নাকি কোনো তাবিজ-কবজ আছে।
– না,না। আমি ভূত প্রেত দেখি নি এবং সেই সবে আমার বিশ্বাসও নেই।
– এগুলি এর মস্তিষ্কপ্রসূত উদ্ভব।
বাপুটিকে মুখ ভেঙচে বলার মতো বলে শর্মা আমাকে জিজ্ঞেস করল–
– আপনার খাওয়া-দাওয়া?
আপনার বক্তব্য অনুসারে চকেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
জায়গাটা কেমন লাগছে? আপনার কাজে আসবে কি?
খুব ভালো লেগেছে। নিশ্চয় কাজে লাগবে। দুদিন পার হয়েছে।
ভালো করে থাকুন। আপনার কাজ করে যান। আমি আজ ছেড়ে দিচ্ছি। বাড়ির সামনেই সত্যনারায়ণের পুজো আছে। সেইজন্য এত দৌড়াদৌড়ি করে করতে হচ্ছে।
–ঠিক আছে। তবে আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করি।
– হ্যাঁ জিজ্ঞেস করুন।
চলে যাওয়ার ভঙ্গিমার পরিবর্তন করে পুরোহিত শর্মা জিজ্ঞেস করলেন।
– আমার মোবাইল ক্যামেরা ইত্যাদির চার্জ করার ছিল। এখানে তো কারেন্ট নেই। আপনি কাউকে বলে একটু সাহায্য করে দিলে–
– কেন করব না। আপনি একটা কাজ করুন। এই রাস্তা দিয়ে একটু দূরে গেলে আপনি বাঁধ দেখতে পাবেন– পুরোহিত শর্মা অঙ্গুলিনির্দেশে আমাকে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন– আপনি হয়তো এই রাস্তা দিয়ে জাননি।
– না। যাইনি।
–আপনি গঙ্গা পুকুরটা দেখেননি?
– দেখিনি।
– দেখার মতো পুকুর, দেখে আসবেন। পুকুরটা সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তি আছে। আজ বলব না।পরে বলব। বাঁধের ওপরে ওপরে নদীর দিকে কিছুটা গিয়ে নিচের দিকে নেমে যাওয়ার একটা রাস্তা দেখতে পাবেন।বামুন মানুষ আছে, কলিতা মানুষও আছে। মানুষগুলি ভালো।আপনি নিজের পরিচয় দিয়ে– এই সুনন্দ, সুনন্দ।
পুরোহিত শর্মা জানলা দিয়ে একটি ছেলেকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন।
– আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই দাঁড়ান। সুনন্দের বাড়িও সেদিকেই ।
পুরোহিত শর্মার ডাক শুনে সুনন্দ নামের ছেলেটি এগিয়ে এল। ত্রিশ ঊর্ধ্বের আঁটোশাটো চেহারার একটি ছেলে। দাড়ি কামিয়ে মুখটা মসৃণ করে রেখেছে। কপালে একটি তিলক। আমি জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম ছেলেটির পাশে একটি নব বিবাহিত নারী। হয়তো সুনন্দের স্ত্রী। থানে পুজো দিতে এসেছে। সুনন্দ এগিয়ে আসায় যুবতি নারীটি মাথার ঘোমটা সামনে টেনে দিয়ে একটা কলাপাতা দিয়ে ঢেকে নেওয়া প্রসাদের পাত্রটা হাতে নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি আড়চোখে নববিবাহিতা যুবতির দিকে একবার তাকালাম।
– ইনি আমাদের থানে আসার দুই দিন হয়েছে। এখানকার পাখির ওপরে গবেষণা করবেন। আমাদের এখানে তো কারেন্ট নেই। তুমি এর কী কী চার্জ করার আছে, একটু সাহায্য করে দিও।
পুরোহিত শর্মা সুনন্দকে সোজাসুজি বললেন।
সুনন্দ যেন আমাকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। সেরকম একটা ভাব দেখিয়ে সে বলল–
– দাদা ,আপনার যখনই প্রয়োজন আমাকে বলবেন। এখনই লাগবে নাকি?
– না না। এখনই লাগবে না। তোমার মোবাইল নাম্বারটা দিওতো। দাদা বলে ডাকছ বলে তোমাকে তুমি বলছি–
– তুমি বললেই হবে।
আমি সুনন্দের কাছ থেকে মোবাইল নাম্বারটা নিতে নিতেই পুরোহিত শর্মা আমাকে বলে নিজের গন্তব্য স্থানের দিকে এগিয়ে গেলেন।
– আপনি আমার মোবাইলে একটা মিসকল দিয়ে দিন। থানে আসব বলে আমি সঙ্গে মোবাইল আনিনি।
আমি সুনন্দের মোবাইলে একটা মিস কল দিয়ে দিলাম যাতে সে আমার নাম্বারটা সেভ করে রাখতে পারে। সৌজন্যের খাতিরেই হোক বা ভদ্রতার খাতিরেই হোক সুনন্দ আমাকে আমার নামটা জিজ্ঞেস করল না। জানিনা সে কী নামে মোবাইলে আমার নাম্বারটা সেভ করে রাখবে। সুনন্দ যাবার দিকে জানালা দিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম।
তার নববিবাহিত পত্নীর লাস্যময়ী পদক্ষেপে সুখের সংসার গড়ার আশা। আমি দূর থেকে দুজনকেই আন্তরিক আশীর্বাদ জানালাম।
অনেকক্ষণ হাঁটার জন্য আমার কিছুটা ক্লান্ত লাগছিল। এমনিতেই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সুনন্দের পত্নীর ঘোমটায় ঢাকা মুখটা এবং সুনন্দের সঙ্গে একসঙ্গে মনের আনন্দে হাঁটার সময় শরীরে অঙ্কিত হওয়া ভাঁজগুলি আমার দু চোখে ভেসে উঠল।
মা– চট করে আমার মাকে মনে পড়ে গেল। এই ধরনের পরিবেশে আমার প্রায়ই মায়ের কথা মনে পড়ে এবং মনে উথলে থাকা ভালো চিন্তার ঢেউগুলি নিমেষের মধ্যে মিলিয়ে যায়। প্রায়ই এরকম হয়। নারী বিষয়ক ভালোলাগা চিন্তাগুলি আমি মনের মধ্যে পর্যালোচনা করতে পারিনা।
– কেন এমন হয়?
অনেক প্রশ্নের উত্তর না থাকার মতো এই প্রশ্নটিরও উত্তর আমার হাতে নেই।
দিনের বেলা ঘুমোনোর অভ্যাস নেই যদিও আজ দুপুরের দিকে ঝিমুনির ভাব এসে গেল। ঘড়ির দিকে তাকালাম। চারটা বাজে। ভাবলাম পুরোহিত শর্মা বলা রাস্তা দিয়ে গঙ্গা পুকুরে যাই। বাইনোকুলারটা নেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে নিলাম। ক্যামেরাটা তে ৩০০ এম এম লেন্স লাগানো আছে। এই লেন্স দিয়েই আমার প্রায় সমস্ত কাজ হয়ে যায়। খুব বেশি প্রয়োজনে চারশো এম এম লেন্স লাগিয়ে নিই।
বেরিয়ে যাবার আগে আমি কয়েকটা বাঁশের খড়ি জোগাড় করে রাখলাম। উনুন তৈরি করার জন্য আমি তিনটে ইট সকালবেলাই জোগাড় করে রেখেছি। সাধারণভাবে একটি উনুনের প্রয়োজন। উনুনটা আমার কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় অভাব পূরণ করতে পারবে। অন্তত হোটেলে যাওয়ার প্রয়োজনীয় সময় থেকে কিছুটা সময় বাঁচাতে পারব। মেগি বা চাও জাতীয় খাবার করার জন্য এই উনুনটা যথেষ্ট। একটা স্টোভের ব্যবস্থা করার কথাও ভাবছি।
পুরোহিত শর্মা বলা অনুসারে বাঁশবন পার করে চাষের জমির ওপর দিয়ে আমি এগিয়ে চলেছি।
রাস্তাটা তেমন স্থায়ী রাস্তা নয়। কাদাজলের জন্য বর্ষাকালে আসা-যাওয়া করতে না পারা ধরনের।
কিছুটা দূর আসার পরে আমি বাঁধটা দেখতে পেলাম । আমি অনুমান করলাম গঙ্গাপুকুর হাই স্কুল থেকে থান পর্যন্ত যতটা দূর থান থেকে নদী পর্যন্ত ততটাই দূর। সেভাবে থান থেকে বাঁধের এই অংশটিরও প্রায় ততটাই দূরত্ব হতে লাগে। বাঁধের ওপর দিয়ে কিছুটা আসার পরে আমি বাঁধ থেকে নেমে যাওয়া সংকীর্ণ ছোট একটি পথ দেখতে পেলাম। পুরোহিত শর্মা এই পথটির কথাই বলেছিলেন এবং আমার অনুমান যদি শুদ্ধ হয় সুনন্দদের বাড়িটাও আশেপাশেই কোথাও হবে। সুনন্দের পত্নীর ওড়নায় ঢাকা অবয়ব দুই চোখে ভেসে উঠল। সুনন্দেদর বাড়িতে এখন আমি যেতে চাইছি না। প্রয়োজনে যেতে হলে যাব বলে মনে মনে ভেবে রেখেছি। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে বাঁধ থেকে দেখতে পেলাম কিছুটা আগে বাঁধের সঙ্গে মিলিত হওয়া নদীটাকে। নদীটা জায়গাটিতে একটা দীর্ঘ পাক নিয়ে সোজাসুজি গিয়ে বাঁধটিতে ধাক্কা মেরেছে এবং নিজের পথে অগ্রসর হয়েছে।জনসম্পদ এবং বান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ বাঁধটাকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পাথর দিয়ে মজবুত করে পার বাঁধিয়ে দিয়েছে। নদীর বিপরীত দিকে একটি বিশাল পুকুর।পুকুরটার পূর্ব দক্ষিণ কোন বাঁধ থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে অবস্থিত। নদীটা একটু কষ্ট করলেই পুকুরের শরীর স্পর্শ করতে পারবে। দেখলে মনে হয় কখনও কোনো বর্ষায় নদীর ক্ষয় পুকুরটাকে আপন করে নেবে ।
আমি বাঁধ থেকে ধীরে ধীরে নেমে এলাম এবং পুকুরটার পার ধরে এগোতে লাগলাম।
পুকুরটা যথেষ্ট বড়। মাপের হিসেবে আমি বলতে পারবনা কতটা বড়। কত বিঘা মাটিতে পুকুরটা কাটা হয়েছে আমি ধারণা করত পারছিনা। দিনান্তের সূর্য পুকুরের জলকে রঙ্গিণ করে তুলেছে। পুকুরের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি দেখতে পাচ্ছি একটি সংঘ। সংঘের অসম্পূর্ণভাবে তৈরি ঘরের মেঝেতে বসেই কয়েকজন ছেলে একান্তমনে দাবা খেলছে। পুকুরটার তীর ধরে একটা মোড় পার হয়ে আমি পুকুরটার দক্ষিণ পশ্চিম তীর ধরে এগিয়ে চলেছি। পুকুরের এই পারটা যেখানে আরম্ভ হয়েছে এখান থেকে কিছুটা এগিয়ে এসে পশ্চিম দিকে একটি রাস্তা দেখতে পেলাম। বস্তির মাঝখানের রাস্তা। রাস্তাটা দিয়ে কোথায় বের হওয়া যাবে জানি না। পরে এক দিন যেতে হবে, এখন সন্ধ্যে হতে চলেছে। আমি এগিয়ে গিয়ে পুকুরটার পশ্চিম উত্তর পারটা পেলাম। এই পারে দেখতে পেলাম সামনে একটি বিদ্যালয় এবং তারপর একটি মন্দির। মন্দিরের ঠিক সামনেই পুকুরের পার থেকে জলের গভীরে যেতে পারার মতো পাকা সিঁড়ি তৈরি রয়েছে। পুকুরের অগভীর জলের মধ্যে সাজিয়ে রাখা একটি ফলকের মাধ্যমে পুকুরে কাপড় ধোয়া এবং স্নান করা বারণ করা হয়েছে। আমি কিছুক্ষণ সিঁড়িতে বসব বলে ভাবলাম। অত্যন্ত সন্তর্পনে পৃথিবীতে ঠান্ডা নেমে আসছে। পুকুরের জলের মাঝখান থেকে ঝিরঝির করে বয়ে আসা বাতাস ঠান্ডার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
পুকুরের জলের মাঝখানে কিছু একটা ডুবে যাওয়ার পরে জলের মধ্যে খেলা করা ঢেউ দেখতে পেয়ে আমি সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে জলের মাঝখান থেকে একটা পাখি তার দীর্ঘ গলাটা নিয়ে ওপরে উঠে আসছে। এটা মনিয়রি পাখি, ডার্টার, আনহিংগা মেলান গেস্টার। এই পাখিরা জলে সাঁতার কাটতে থাকলে কেবল মাথাটা ভাসতে থাকে। দেখতে খুব সুন্দর লাগে। পাখিটা মাঝেমধ্যে তার দীর্ঘ গলার সঙ্গে মাথাটা এভাবে নাচাতে থাকে যে পাখিটা যেন জিমনাস্টিক করছে বলে মনে হয়। পাখিটাকে আরও একবার ডুব মারতে দেখলাম। কিছুক্ষণ পর্যন্ত জলের ঢেউয়ে তরঙ্গ তুলে নেচে কুঁদে দূরে সরে গেল। ঢেউগুলি মিশে যেতে না যেতেই পাখিটা চট করে জল থেকে উঠে এল। পাখিটাকে জলের মধ্যে বেশিক্ষণ খাদ্যের সন্ধানে থাকতে দেখা গেল না। নিজের দীর্ঘ গলা এবং কুচকুচে ডানা মেলে দিয়ে পাখিটা থানের দিকে অরণ্যের দিকে উড়ে গেল। পাখিটার জন্যই আমি পুকুরের সিঁড়িতে বসে ছিলাম। পাখিটা উড়ে যাওয়ার পরে আমিও সেখান থেকে উঠে পুনরায় এগিয়ে গেলাম।
পুকুরের পারে সন্ধ্যাবেলা বেড়াতে আসা দুই এক জন পুরুষ এবং নারীকে আমি দেখতে পেলাম। ছোট ছোট কয়েকটি ছেলেমেয়ে এদিকে ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করছে। এখানে কেউ আমাকে চেনে না এবং সুনন্দ ছাড়া আমিও কাউকে চিনি না।অপরিচিত দেখে হাঁটতে থাকা কয়েকজন মানুষের মাঝখান থেকে দুই-একজন আমার দিকে লক্ষ্য করছে। কারও কারও আমার কাছে থাকা ক্যামেরাটাও কৌতূহলের কারণ হতে পারে। মনিয়রি পাখিটার ছবি নিতে হয়তো তারা দেখতে পেয়েছিল। কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে যাওয়া ছোট মেয়েদের একজনের মাথায় আস্তে করে আদর করে আমি ক্রমশ উত্তর পূর্ব পার দিয়ে এগিয়ে চলেছি। পুকুরের পারটা থেকে বাঁধ পর্যন্ত এই অংশটা পর্যন্ত ত্রিভুজাকৃতির। ত্রিভুজটির তৃতীয় বাহুর একটি বাঁধ একটি পুকুরের পার অন্যটি আমি হেঁটে চলা রাস্তাটা। রোহিত শর্মা বাঁধ থেকে নেমে আসা যে রাস্তার কথা বলেছিলেন তা এটাই হবে। ত্রিভুজ আকৃতির জায়গাটিতে মানুষের বসতি রয়েছে। আমি দেখতে পেলাম বাঁধ থেকে যে জায়গায় আমি নেমে এসেছিলাম পুনরায় সেই জায়গায় ফিরে গিয়ে আমি দেখছি বাঁধে উঠলাম।
ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে। বাঁধে উঠার সময় আমি লক্ষ্য করলাম নদীর মাঝখানে বালির চর পড়েছে। বালির চর থেকে উঁচু উঁচু গাছ গুলির দিকে চোখ গেল। নদীর খাড়াই থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে গাছগুলি। গাছের ডালে অন্ধকার- আলোর মধ্যে দীর্ঘ ঠেঙের পাখি কয়েকটি পড়ে থাকতে দেখলাম। নিশ্চিত বক। আকৃতি এবং প্রকৃতি থেকে বককে পাখি বলেই মনে হচ্ছে । শামুকখোলা পাখি হলে আকৃতি ছোট হত। আধো আলোতে ভালোভাবে দেখতে না পেলেও আমার অনুমান শুদ্ধ হওয়া উচিত।
আমি আমার রুমে ফিরে এলাম। ল্যাম্প জ্বালিয়ে আলোকিত হয়ে ওঠা রুমটি আজ আমার মনের আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে । আমার মনের সামনে কয়েকটি উঁচু গাছ এবং তাতে পড়ে থাকা কয়েকটি পাখি ভেসে উঠছে । পাখি গুলির কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল রেডিওটির কথা।নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হবে ভেবে আমি রুকসেকটাতে রেডিও ভরে নিয়ে এসেছিলাম।আমি সাধারণত রাতে দেরি করে ঘুমোই। কাল ক্লান্ত বোধ করায় আমি শুয়ে ছিলাম, আজ এখনও ঘুমোতে ইচ্ছা করছে না । আমি রেডিওটা বের করে অন করে দিলাম । রেডিওটা অস্পষ্ট ভাবে কু কু করে বাজতে লাগল। মনে পড়ল আকাশবাণী ডিব্রুগড়ের রেডিও তরঙ্গ এখন আমার কাছে ডিব্রুগড় রেডিও স্টেশন নাগালের বাইরে। এখানে তো এফএম রেডিও সেন্টার পাওয়া উচিত। আমি রেডিওটা এফএমএ অন করে সেন্টার ধরতে লাগলাম।
– পাকা ধানের মাঝেমধ্যে ছোট ছোট আলি ওই যে ছোট ছোট আলিতে পড়ে গীত গায় ঝাকে ঝাকে খঞ্জন পাখি–
সেন্টার ঘোরানো আমি ছেড়ে দিলাম। রুদ্র বরুয়ার এই গানটা আমাকে খুব আকর্ষণ করে।খঞ্জন পাখি এবং টিপসি জাতীয় ছোট ছোট পাখিকে ডানা নাচিয়ে নাচতে দেখলে গানটির কথা আমার মনে পড়ে যায় ।রেডিওটা বিছানায় রেখে আমি তিনটে ইট দিয়ে ত্রিভুজ আকৃতির একটি ছোট উনুন তৈরি করতে লাগলাম ।একটা কাগজে আগুন লাগিয়ে ছোট বাঁশের কাঠি ভরিয়ে দিয়ে আমি আগুনটাকে সজীব করে তুললাম। তারপর বাপুটি দিয়ে যাওয়া কেটলিতে জল বসিয়ে দিলাম ।
– সাধারণত অরণ্যে থাকা সময়ে খাবারের সংক্ষিপ্ত আয়োজন করা ভালো। মেগি জাতীয় খাদ্য সেদিক থেকে উপযুক্ত ।
সৌম্যদা আমাকে শিখিয়েছিল।
সেই বুদ্ধি এখন আমি কাজে লাগিয়েছি। মেগির একটা প্যাকেট খুলে একটা মুখে ঠেলে নিয়ে তাতে গরম জল ঢেলে দেওয়ায় সহজেই আমার রাতের খাবার প্রস্তুত হয়ে গেল।
গত কিছুদিন ধরে আমি ভাত খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। সকালে দুটো রুটি এবং একটু তরকারি। দুপুর বেলা এবং রাতের বেলা এক বাটি করে তরকারি বা অন্য কিছু খাবার। প্রথম দিকে একটু অসুবিধা হত। রাতের বেলা ঘুম হত না। ক্ষুধায় ঘুম ভেঙ্গে যেত। পরে অভ্যাস হয়ে গেল। পদ্ধতির ফলে আমার পেটে জমা হওয়া চর্বি দ্রুত হ্রাস হল এবং ক্রমশ ফুলে উঠা পেটটা শূন্যে চলে এল। অন্তত এখন আমাকে কেউ ভুঁড়িওয়ালা বলবে না। অন্যদিকে রাঁধাবাড়া জাতীয় জটিলতা প্রায় নাই হয়ে গেছে। রামমলের বোঝা কমে গেছে । রামমল অবশ্য বিভিন্ন ধরনের তরকারি রান্না করে আমাকে খাওয়াতে ভালোবাসে । আমি রামমলকে বলেছি যে আমি রবিবারে ভাত খাব এবং তোমার ইচ্ছামতো যা রাঁধবে আমাকে খাওয়াতে পারবে।
রাতটা গতানুগতিকভাবে পার হয়ে গেল। বাপ বেটির সঙ্গে দেখা হলে হয়তো আজও আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করবে।
নিত্যকর্ম সম্পাদন করে আমি ক্যামেরাটা এবং বাইনোকুলারটা নিয়ে বাপুটি আসা মাঠের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে গতকাল নদীর মাঝখানে দেখতে পাওয়া চর অঞ্চলের উদ্দেশ্যে এগোলাম । হালকা করে কুয়াশা পড়েছে । নদীর জলের ওপরে শরৎ কালের মেঘের মতো রাশি রাশি কুয়াশা । পায়ের জুতো শিশিরে ভিজে উঠেছে । নদীর মাঝখানের চরে যাবার জন্য রাস্তা খুঁজতে লাগলাম । চরটা মাঝখানে রেখে এই নদীটা দুপাশ দিয়ে বয়ে গেছে । দুটো ভাগেই জলের গভীরতা বেশি। গতকাল আমি দেখতে পাওয়া উঁচু গাছ গুলি নদীর ওপারে রয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকা জায়গা থেকে গাছগুলির দূরত্ব খুব বেশি নয়, কিন্তু মাঝখানে নদীটা থাকার জন্য গাছগুলির কাছে যাওয়া অসুবিধাজনক। গাছগুলি হল ছাতিম গাছ এলস্টনিয়া স্কলারিশ। ইংরেজিতে বলা হয় শয়তানের গাছ বা ডেভিলস ট্রি । ইংরেজির শয়তান এসে অসমিয়ায় চতিয়না হয়েছে মনে হয়। শীঘ্রই শীত পড়বে মানে ছাতিম গাছে সাদা সাদা ফুল ধরবে। এত উগ্র এই ফুলের গন্ধ। আমি খুব অপছন্দ করি। এই ফুলের গন্ধ নাকে এলেই আমার মাথা ব্যথা করতে থাকে। গাছগুলির ওপরে কোনো পাখিও নেই । নিচে যেতে পারলে বিষ্ঠা দেখে বুঝতে পারা যেত সেখানে আমি কাল কী পাখি দেখেছিলাম। গাছের ওপরে আমি পাখির কোনো বাসা দেখতে পেলাম না। নদীটা পার হওয়ার জন্য আমাকে কাপড় পরিবর্তন করতে হবে। এই মুহূর্তে আমার কাছে সেই সুবিধাও নেই ।
আমি যা বুঝলাম সমগ্র পাগলাদিয়া নদীর দুই পারে অর্থাৎ বাঁধে অরণ্য অঞ্চল। নদী গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য গঙ্গাপুকুর হাই স্কুলের কাছের বাঁধ থেকে পাগলাদিয়া নদীর ওপরে থাকা সেতুর ওপারের বাঁধের দূরত্ব বেশি। মাঝখানে আছে থানটা। সেই অর্থে বলতে গেলে থানটা নদীর বুকের মাঝখানে অবস্থিত।
আমি নদীর তীর ধরে সেতুটার দিকে এগিয়ে গেলাম।সেদিন নদীটার যে ঘাটে মেয়ে এবং মহিলারা কাপড় ধোয়া আর স্নানে ব্যস্ত ছিল আমি সেই জায়গাটায় এসে উপস্থিত হলাম।তারা আসা্র এখনও সময় হয়নি।
আমি দেখতে পেলাম ঘাটে কয়েকটা পাথর। আছড়ে আছড়ে কাপড় ধোয়ার ফলে এবং পায়ের গোড়ালি ঘষার ফলে পাথরের পৃষ্ঠদেশ মসৃন হয়ে পড়েছে।শ্যাম্পুর প্যাকেট দুই-একটি এবং ব্যবহারের অযোগ্য দুই এক টুকরো সাবান বালিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
আমি খাটটা পার হয়ে দ্বিতীয় জলাশয়টিতে যাবার ইচ্ছে করলাম। সেই অনুসারে আমি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগোতে লাগলাম। বাঘ নখের মতো বন্যলতা এবং গভীর জঙ্গলের মধ্যে বেতের ঝোপ।বেতের ঝোপটা একটা চালতা গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। চালতাকে ইংরেজিতে এলিফেন্ট আপেল বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম ডাইলেনিয়া ইণ্ডিকা। চালতা গাছ এবং বেতের ঝোপটা দেখে তখনি একটা অসমিয়া প্রবচন মনে পড়ল।
বেতনিতে পড়ল ঔ বাসুদেবায় নমঃ।
বেতনির মধ্যে ঔ পড়েছে আনতে না পেরে ভদ্রলোক বলেছে এটা ভদ্রলোকের জন্য।
গভীর অরণ্যটা পার হয়ে আমি কিছুটা দূরে এগিয়ে এসে জলাশয়ের তীরে পৌছালাম। জলাশয়টির জলের রং এবং চারপাশের পরিবেশ তখনও জায়গাটিকে অন্ধকার ঘিরে রেখেছে।
জলাশয়টিতে পড়ে থাকার শুকনো গাছের আরাম চেয়ারটা, দুপাশে দুটো পা দিয়ে আমি গাছের আরাম চেয়ারে বসে নিলাম। তারপরে বাইনোকুলারটা দু চোখে লাগিয়ে আমি নিশ্চিত হতে চাইলাম শিমুল গাছের ওপরে আমি দেখতে পাওয়া বাসাগুলি আসলে বকের বাসা কিনা।
– হ্যাঁ হ্যাঁ। সেগুলি বকের বাসা। না হওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠেনা।
আমি এটা তো নিশ্চিত হলাম যে বাসাগুলি গত বছরের। তারমানে বক পাখি গত বছর এখানেই ডিম পেড়ে বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। শীতকালে বক পাখি বাসা তৈরি করে, ডিম পারে তা দেয়, বাচ্চার জন্ম দেয়।
ধীরে ধীরে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। আমার মনে আশার সঞ্চয় হল। যদি বাস্তব আমার প্রতি সুপ্রসন্ন হয় তাহলে আমি এবার বক পাখির পরিবারের সংখ্যাধিক্য হওয়া দেখতে পাব।
বক পাখি বাসা তৈরি করার জন্য উঁচু গাছ নির্বাচন করে। নিজের আকৃতি অনুসারে সেই রকম গাছেরই যে প্রয়োজন। মুক্ত মাঠ অথবা অরণ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে থাকা কদম এবং ছাতিম গাছের বক পাখির বাসা তৈরি করার বিভিন্ন কাহিনি আমি শুনতে পেয়েছি। সৌম্যদা এবং কিশোর কুমার চৌধুরী কাহিনিগুলি বলেছিল। কদমগাছ আমি অরণ্যের ভেতরে সেভাবে দেখতে পাইনি। কদম গাছকে আমার কেমন যেন গৃহপালিত গাছ বলে মনে হয়। শিমুল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম বোমবে চেইবা। এই ধরনের গাছে সাধারণত বক পাখি বাসা বাঁধে। আমার সামনের শিমুল গাছগুলিতে থাকা বাসাগুলি বক পাখির।
আমি শিমুল গাছের ডালে থাকা বাসার সংখ্যা হিসাব করতে লাগলাম। একটা- দুটো– সাতটা বাসা। তারমানে চৌদ্দটা বক পাখি। আমি এখন পর্যন্ত গাছগুলিতে কেন একটাও পাখি দেখতে পাইনি।আমি আসার আগে বোধ হয় বক পাখি গুলি গাছ ছেড়ে জলাশয় বা পাশের মাঠে শিকারের সন্ধানে চলে যায় ।
আমি গাছ কয়েকটির নিচে দিয়ে এগোতে লাগলাম। গাছ গুলির নিচে যেতে হলে আমাকে জলাশয়টির তীর ধরে এগোতে হবে। পারটা গাছ লতায় পরিপূর্ণ, কোনো নির্দিষ্ট রাস্তা বা পথ নেই। সেই তৃণ লতিকা গুলি মাড়িয়ে তার মাঝখান দিয়ে পথ বের করে আমি এগিয়ে চললাম। বিশাল আকারের তিনটি শিমুল গাছ। তার দুটো ডালে থাকা সাতটি বাসার একটিতে চারটি এবং অন্যটিতে তিনটি। বক পাখি বাসা বাঁধা শিমুল গাছ দুটির গোড়ালি বেশ বড়। চারজন মানুষ দুটো হাত মেলালে গাছের গোড়াটা নাগাল পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। মূল গাছ থেকে কামরাঙ্গার মতো বেরিয়ে আসা শিরাগুলি মাটির বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। শিমুল গাছের নিচে বন জঙ্গলের পরিমাণ কম, প্রায় মুক্ত। উঁচু গাছ নিচে সূর্যের রশ্মির অভাবে গাছপালা জন্মায় না । গাছ কয়েকটি নিচে পাখির বিষ্ঠা পড়ে রয়েছে । ভালোভাবে লক্ষ্য করে সেই সব বকের বিষ্ঠা বলে আমি নিশ্চিত হলাম। গাছ গুলির নিচ থেকে উপরের দিকে তাকালে ভালো করে কিছু দেখা যায় না । কেবল মাথার উপরে সুবিশাল আকাশ । আমার কাছে জলাশয়ের ওপারের প্রাকৃতিক চেয়ারটাই উপযুক্ত। সেই চেয়ারে বসে সারাটা দিন পাহারা দিয়ে অপেক্ষা করার সময় নিশ্চয় বক পাখির অঞ্চলে প্রবেশ করতে আমার পক্ষে সুবিধাজনক হবে।
আগামীকালের দিনটা আমি এই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকব।
,
,
•
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন