বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১

করঞ্জতলায় সজনেফুলের গল্প ।। শ্রীজিৎ জানা ।। বিশেষ গদ্য, Srijit Jana

করঞ্জতলায় সজনেফুলের গল্প।

শ্রীজিৎ জানা



সভ্যতার আদিরূপ হল গ্রাম। সভ্যতার উৎসভূমি। অকৃত্রিম চিরহরিৎ এক প্রাণময় সত্ত্বা। বৃক্ষ লতা গুল্মের স্নেহশীতল ছায়া,সবুজ শস্যফসলের প্রাচুর্যে ভরা ক্ষেত্রলক্ষ্মী,কাদামাটি মাখা হাড়খাটুনির বিনন্দ রাখাল কৃষক, আটফেরে শাড়ী আর শাঁখাপলা মেটে সিঁদুর পরা দশভূজা কৃষাণী, শালুকফোটা পুকুর- দিঘি,কলমিদামে ভরা খালবিল,টোপরপানা ভরা নয়ানজুলি, আঁকনবাকন নদী,মেঠো আলপথ,পাখির কলতান, মুক্ত বাতাস,থইথই রোদ্দুর,ফুলফুল জোছনা,ঝিরঝির বিষ্টি, টুপটাপ হিম,মাটির উঠোন,আলপনা আঁকা দেয়াল,তুলসীমঞ্চ,শাঁখের আওয়াজ, শ্রীখোল- খঞ্জনির মাদকতা- আরো কত কি! আরে কত কি!
লগি ঠেলে নৌকায় খেয়াপার,গরুর গাড়ির দুলুনি চাল, একাঠা বা জোড়া তালডোঙা চড়ে বর্ষার মাঠে কলম্বাসের দিকভ্রমণ,দুব্বো - বাজামুথা ঘাস মাড়িয়ে মাঠময়,পাড়াময়,বনময় হন্টনে হরষিত চিত্ত! বাগানের সিঁদুরে আম,গাছপাকা কাঁঠাল,কাঁটালি- মত্তমান-নোনাবউ কলা,কুড়ুকজাম থেকে বড়জাম,ডাঁশা পেয়ারা,জামরুল, নোনাআতা,মাদার- ফলবতী গাঁ! ঘরের গাইয়ের দুধ,চিনিপাতা দই,নেবুপাতা দিয়ে মারা ঘি,ঘোলমুথানি(ঘোলমউনি) দিয়ে মোয়া মাখন আর ঘোল-রেঁস্তোরার সুইট লস্যিকে হার মানায়। গেঁয়ো প্রবাদে আছে- দুধ দুর্বল,ঘোল মহাবল!
উনুনে কড়াই চাপিয়ে দিলেই হোলো। গাঁয়ে সব মিলবে টাটকা, তাজা। উঠোন ধারে ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা লাউশাক,ডগমগানো পুঁই,কঞ্চির বেড়া জড়ানো সিম- উচ্ছে- ঝিঙে- বরবটি,ঘড়ের চালে লতানো চালকুমড়ো,কচুর লতি,তেলাকুচোশাক,খুলেখাড়া,মাটের আল ঘেঁষে থাকা শুশনি, খলবলানো কই-শিঙি-মাগু,শাল-শোল,ট্যাংরা- পুঁটি- মুরলা প্রভৃতি সতেজ মাছ আনাজপাতি দুধ ফলমূল মিলে আমিষ- নিরামিষের সমাহারে গ্রাম 'সুস্বাস্থ্য পুষ্টি বর্ধনম্'।
শহুরে পরিসরে এমন অমূল্য প্রাপ্তি দূর কি বাত্। কিম্বা সমস্তই নাগরিক দরজায় হাজির হয়,কিন্তু সেই প্রাপ্তিযোগের ভেতর খানিক আনন্দ উঁকি দিলেও,তা পরিপূর্ণ তৃপ্তি দ্যায় না। মাটির দুয়ারে হাঁটুমুড়ে বসে অভাবের কলাপাতায় শাকভাতের পঙক্তিভোজের সন্তুষ্টি ঝাঁচকচকে ডাইনিং টেবিলে সাহেবি মেনু আর স্পুন- কাটারের যুদ্ধ হেরে ভুত হোয়ে যাবে।
শুধু সবুজের ছায়া, বুকভরা তাজা বতাসে নিঃশ্বাস,টাটকা তরিতরকারি নয়, গ্রাম এগিয়ে আছে তার হৃদয়- ঐশ্বর্যে, আদিগন্ত ছড়ানো তার হীরেমাণিক মনের প্রসারতায়,ধুলোমাটির সরসতাভরা সৌহার্দ্যে,আপন কোরে কাছে টেনে নেবার সরলতায়, সম্পর্কের গভীর প্রেমবন্ধনে,সেবায়,উদারতায়,আতিথেয়তায় আর ভক্তিভাবের পরাকাষ্ঠায়।
আদিম মানুষ তার গুহাজীবন,যাযাবর জীবন পেরিয়ে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে প্রবেশ করেছে। নদীতীরে জল,আগুন শস্যফসলের ভরসায় সবুজের ছায়াতলে গড়ে উঠেছে গ্রাম। গ্রাম্য ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল অনুশাসন। সম্পর্কের নিবিড়তা। কোনো কোন ক্ষেত্রে সেযুগে কিম্বা বর্তমানেও গ্রাম্য শৃঙ্খলা রক্ষার নামে বিরূপ চিত্র মনকে ব্যাথিত করে। তবে তা গ্রামের সার্বিক দিককে কলুষিত করে না। বৈদিক আমলে কয়েকটি গোষ্ঠী নিয়ে গ্রাম তৈরী হত। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠত বিশ বা জন। আর কয়েকটি জন নিয়ে হত দেশ বা রাষ্ট্র।গ্রামণি গ্রাম শাসন করতেন। মহাকবি ত্রিবিক্রম ভট্ট তাঁর সংস্কৃত 'নলচম্পূ ' গ্রন্থে তৎকালীন গ্রামের বর্ণনায় রিখেছেন-"যত্র চতুরগোপশোভিতাঃ সংগ্রামা ইব গ্রামাঃ"! বাংলা ভাষার আদিগ্রন্থ ' চর্যাপদ' এর পাতায় আঁকা হোয়েছে মমতামাখা নিটোল এক গ্রামের চালচিত্র।
তারপর আমার গল্প ফুরোলো,নটে গাছটি মুড়োলো।
পুরোপুরি না মুড়িয়ে গেলেও,সভ্যতার উৎসভূমি ভীষণ বিপন্নতার শিকার। তীব্র জৈবনিক চাহিদা আর অত্যুগ্র জীবনযাপনের মোহ- আবর্তে শহর এবং নগরের জন্ম। শহর- নগর যদি বৃক্ষের বহিরঙ্গ প্রকাশের পত্রপুষ্পফল হয়,তবে গ্রামগঞ্জ তার কান্ড,শাখাপ্রশাখা, শিকড়। শহর অথবা নগর তার বেঁচে থাকার রসদ আহরণ করে চলেছে গ্রামের বুক থেকে। গ্রাম অদ্যাবধি নাগরিক সভ্যতার স্তন্যদাত্রী মাতৃস্বরূপা। সাপ যেভাবে তার শাবককে খেয়ে নেয়,নাগরিক রাক্ষুসে প্রবৃত্তি ধ্বংস করতে চেয়েছে গ্রামীণ জীবনধারাকে। ছলনাময়ীর মতো প্রলুব্ধ করেছে গ্রাম্য সরলতাকে। কালাজাদুর তুকতাক বিদ্যার মতো ফুসলে নিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে গেঁয়ো রূপ। শহর সদা চক্রান্তকারী, যার কুটিল চক্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে মেঠো মন ও মানসিকতা। তাহলে কি মাটির আলপথে মোরাম, পিচ অথবা কংক্রিটের আস্তরণ পড়বে না?মাটির দেয়াল পাকা হবে না? বৈদ্যুতিক আলো জ্বলবে না ঘুটঘুটে অন্ধকার মোছাতে?সমস্তরকম পরিষেবা কি উন্নততর হবে না? নিশ্চয় হওয়া জরুরি। কিন্তু যখন উন্নয়নের মোহে নিজস্ব কৃষ্টি ভূলুণ্ঠিত হয়,আধুনিকীকরণের নাগপাশে শ্বাসরুদ্ধ হয় গ্রাম্যধর্ম, গ্রাম্য সংস্কৃতি, তখন তা মৃত্যুর নামান্তর। যখন মাটির দেয়ালে গোবর- মাটির লাতা দেওয়া বিরাট ক্যানভাসের পিটুলিগোলার আলপনা মুছে যায়, লেখা হয় রাজনৈতিক অভব্য ও উস্কানিমূলক শ্লোগান,যখন পেরেকে ঝোলানো কালীঠাকুরের পটের স্থানে জায়গা করে নেয় নগ্ন নায়িক- নায়িকা, তখন আসলে শেকড়ে পচনধরা রোগকেই সূচিত করে। মাটির সাথে শেকড়ের বন্ধন ছিন্ন হতে থাকে। সামান্য ঝোড়ো হাওয়াতেই ভয় লাগিয়ে দ্যায় বৃক্ষ পতনের। সভ্যতা নড়ে ওঠে।

একটাকার শ্যাম্পু পতায় কেশচর্চায় মাততে চেয়েছে গ্রাম্য কিশোরী। পাঁচ টাকার সাতদিনে মুখ ফর্সা করা ক্রিমের দৌলতে সাত নম্বর মুখ ফর্সা দেখিয়ে শ্যামলা বর্ণের কিশোরীর মাথা খেতে চেয়েছে। তাকে বকরবার বোঝানো হয়েছে কালো রঙ অশুভ,অপছন্দের,ঘৃণার। গৌরাঙ্গী হতে হবে।যত ফর্সা মুখ তত কদর। তত আকর্ষণীয়। কিশোরী নিজস্ব রঙ মুছতে মরিয়া হয়েছে। দশ টাকার বেবিফুডের বিজ্ঞাপনে চনমনে চকচকে শহুরে বাচ্চাদের এপাং ওপাং ঝপাং মিউজিকে নাচিয়ে বোঝাতে চেয়েছে বাচ্চাকে টল স্ট্রং শার্প করতে মাতৃদুগ্ধ অপেক্ষা ওগুলোই যেন অত্যাবশ্যক। পরোক্ষে মার্কেটিং কায়দায় সুড়সুড়ি স্তন্যদানে মায়ের বক্ষ সৌন্দর্য হানি হয়। শিশুর মা- বাব ডাকের ক্রমেই বিবর্তন ঘটেছে। পারিবারিক কাঠামোয় লেগেছে শহুরে চেকনাই। একান্নবর্তী পরিসর ছোট ছোট বৃত্তে বাঁচতে চেয়েছে। কেউবা শিকল কেটে বেঁধেছে নগরের নিয়ন আলোয় ভেজা সুখী গৃহকোণ। বিশ্বের হালহকিকত তার ঠোঁটস্থ,নামী ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে দেশদশের খবরে মন উদভ্রান্ত,শুধু যে শীতলা মন্দিরের আটচালায় গায়ে লেগে আছে শৈশবের গন্ধ তার ভগ্নদশায় মন কাঁদেনা। সামান্য সাহায্যের হাত প্রাসারিত হয় না। গ্রাম মনে মনে কষ্ট পায়।

গ্রাম দুয়োরানী। এককালে কতকিছু ছিল তার আঁচল তলায়। পাড়ায় বিশু সাপুড়ে আসতো সাপ খেলাতে। ডুগডুগি বাজিয়ে গান ধোরতো- বেহুলা ঘুমাস না গো/ লোহার বাসর ঘরে/ কালনাগিনী মারবে ছোবল লখীন্দর বরে। অম্নি পাশে বসে থাকা সাগরেদ ধুয়া ধোরতো। বিশু সাপুড়ে সাপপিড়ির ঢাকনা সাপের ফণার সামনে ঘুরিয়ে,নিজের হাঁটু দুলিয়ে, গোখরোর লেজ বাঁহাতে ধরে কতনা কারসাজি দেখাতো। গাঁয়ের ছেলে থেকে বুড়ো সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো। বিনিময়ে বিশু সাপুড়ের ঝোলায় জুটতো চাল- পয়সা। তবে মেয়েমহলে কিছু শিকড়বাকড় গতিয়ে উপরি কামাই কোরতো। আজকাল কদাচিৎ চোখে পড়ে সাপুড়েদের।
একসময় পাড়ায় আসর বসাতো পটুয়ার দল। পুরুষ- মহিলা উভয়েই পটের গান গেয়ে রামায়ণ,মহাভারত,মনসামঙ্গলের কাহিনীচিত্র আঁকা পট দেখাত। পড়ায় আজকাল একেবারেই তারা আসে না। ভানুমতীর খেলা দেখাতে আসতো যাযাবর অথবা কাগমারা জাতির মেয়েরা। 'লাগ ভেলকি লাগ' বলে চোখ থেকে মার্বেলগুটি,হাতের মুঠোর ভেতর পাখির ছানা,পেট থেকে জল বের করার মতো আশ্চর্য ভেলকিবাজি দেখিয়ে পাড়াগাঁকে তাক লগিয়ে দিত। সাথে কত সাপ, মাছ ও পশুর হাড় ঝোলা থেকে বের করে তুকতাকের ওষুধ বিক্রি কোরতো। তারাও আর আসে না।
গাঁয়ের চন্ডীতলায় বোসতো রামযাত্রা কিম্বা কিষ্টযাত্রার(কৃষ্ণযাত্রা) আসর। সে এক ভারী মজার ব্যাপার। ডে- লাইট বা বাতি লাগানো বড়ো হ্যাজাক লাইটে আলোকিত যাত্রার আসর।' সীতার বনবাস' পালায় রাম- সীতার দুঃখে কেঁদেকেটে একসা হত পাড়ার ঠাকুমা- জেঠিমা- মায়েরা। রাতে যে রাম, যার পায়ে মাথা ঠেকানোর উপক্রম ঠাকুমার,সকালে সেই রাম দর্শন দিতেন বাড়ির দরজায়। মুখে মেকাপ নেই। গৌরবর্ণ রাম এখন কালোবরণ জগেন,হাতে থলি,উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাক- মাগো,চাল,আলু,পয়সা,কেরোসিন যা পারেন দয়া করে দেবেন। ঠাকুমার তখনো রামভক্তির ঘোর কাটে না। গলায় আঁচল বেড় দিয়ে থালাভরা চাল- আলু ঢেলে দেয় রামের থলিতে।
কিষ্টযাত্রায় ছিল রোমান্টিক ব্যাপারস্যাপার! গাঁয়ের স্কুলঘরে সারাদিন রাধা লুকিয়ে থাকতো। সন্ধ্যায় সোজা আসরে। পালা যখন জমজমাট, ঠিক তখন রাধার গলার মালা নিয়ে ' মালাডাকা' শুরু হতো। কে কত দরে উঠবে! যার ডাক বেশি হবে আসরের মাঝে তার গলায় নিজ হাতে রাধা পরিয়ে দেবে মালা। এনিয়ে সেসময় গাঁয়ে কত মুখোরোচক গল্প অামোদ ছড়িয়ে দিত গাঁয়ে। কিষ্টযাত্রা প্রায় উঠে গ্যাছে গাঁ থেকে। রামায়ণ গানের আসর বসেনা বল্লেই চলে। গ্রামের শীতলা ও মনসামন্দিরে বাৎসরিক পুজোর সময় নিয়মরক্ষায় শীতলামঙ্গল ও মনসামঙ্গল গান হয়। সুদেষ্ণা কিম্বা সনকার পুত্রহারানো শোকে গাঁয়ের চোখে জল আর আসে না। ডিজে নামক শব্দদানবের তান্ডবে ও দানবীয় নৃত্যকলায় গ্রাম্যমন বিমর্ষ হোয়ে পড়ে।
মাঝেমধ্যেই গাঁয়ে কবিগানের লড়াই হতো। তরজা গান। ঢোল- কাঁসির বাজনার সাথে ছন্দময় সুরেলা বাকবিতণ্ডা। কখনো পুরাণের কথা তো কখনো লঘুরস সুরে বেঁধে শ্রোতাদের মন মাতিয়ে দিত। কত ব্যাঞ্জনার প্যাঁচ লুকিয়ে থাকতো তাদের গানে,অপর জনকে সেই জট খুলতে হত। যেমন- 'কত রঙ্গ দেখাবি মন্ডলে/ বলি,কাতলা মাছে তামুক খায়/ আম গাছেতে ঠ্যাঙ তুলে'! এখন শুধুমাত্র কোন কোন মন্দিরে নিয়মমেনে কবিগান করান মন্দির কমিটি ভক্তিতে নয়-ভয়ে।নইলে দেব- দেবীর কোপে পড়তে হবে।
আগের দিনে প্রায় গ্রামেই যাত্রার দল থাকত। ভীমপুজোতে, গাজনে যাত্রার কম্পিটিশন চলতো। মাঝরাত অব্দি লন্ঠন - লম্ফের আলোয় মহড়া চলতো কারো দলিজঘরে নতু্বা ক্লাবঘরে। পুরুষই মহিলার চরিত্রে পার্ট কোরতো কখনোকখনো। কত হাসি -মজার ব্যাপার ছিল তাতে। কখনো আবার ফিমেল চরিত্র ভাড়া করে আনা হতো।দু' তিনটা গাঁয়ের মাঝে একজন যাত্রার মাস্টার থাকতেন। তিনি ডিরেক্টর। তলাপার্টিও ভাড়ার। আজ দশটা গ্রাম ঘুরলেও একটা যাত্রাদল মিলবে কিনা সন্দেহ!

গাঁয়ে আজ আর খোলঘর খুঁজে পাবে না। রোজ সন্ধ্যায় যেখানে শ্রীখোল- মৃদঙ্গ- খঞ্জনী - হারমোনিয়াম সহযোগে হরিনামের মহড়ার আসর বোসতো। মাটির খোলঘর এখন পাকার পার্টি অফিস। চন্ডীতলার গালগল্প, বটতলার সালিশ, দালানের হাসিঠাট্টা, দাওয়ার হুল্লোড়, বৈঠকখানার মজলিশ কোনো কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এখন গ্রাম্য রাস্তার দু'ধারে,পাড়ায়- পাড়ায় ছাউনি দেওয়া বাঁশের মাচা। সেখানে তাস পিটানোর সাথে রাজনৈতিক কুটকচালি। প্রত্যেক পার্টির আলাদা আলাদা মাচা। তাতে দলের ঝাণ্ডা বাঁধা। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে আবহাওয়া গরম থাকে। কত কিছুর ছক কষা হয়!গোপন শলাপরামর্শ! গ্রাম ভয় পায়।

গাঁয়ের কিশোর- কিশোরী পুকুরে আজকাল ঝাঁপাইঝুড়ি করে না। ডুব সাঁতারে এপারওপার হয় না। তরতরিয়ে গাছে উঠতে পারে না। গাঁয়ের মাটির ঘরের দখিন দুয়ারে ঢেঁকি দেখতে পাওয়া ভাগ্যের! পানের ডাবর,হুঁকো,গড়গড়া, গুলামাথির চাঁচি, তালপাতার চাটাই,খেজুর পাতার তালই আরো কত কি খোয়া যাচ্ছে গ্রাম থেকে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা না দিতে পেরে ক্রমেই অপসৃত হচ্চে গ্রাম্যতা, লোকাচার। একসময় স্কুলের ছেলেমেয়েরা সরস্বতীপুজোর জন্য গান গেয়ে চাল- পয়সা আদায় কোরতো বাড়ি বাড়ি। দলবেঁধে কোরাসে গাইত- সরদে বরদে গো মা / জ্ঞানদে জ্ঞানদায়িনী।
ভোরে মশা তাড়ানোর লড়াই হতো পাড়ায় পাড়ায়। হাতে খড়ের আঁটির ধোঁয়া করে দলবেঁধে গান ধোরতো এক পাড়ার ছেলেমেয়েরা অন্য পাড়ার উদ্দ্যেশ্যে- ধা রে মশা ধা/ নলবনকে যা/ নলবনে তোর বাসা/ মারবো কদাল পাশা / এপাড়া থেকে ওপাড়া যা/ ওপাড়ার সবার রক্ত চুষে খা। পৌষ- সংক্রান্তির মকর পরবের দিন ভোরে গাঁয়ে বড়দের পাশাপাশি ছোটদের মধ্যে 'মকরডুব' দেওয়ার ধুম পড়ে যেত। একে কনকনে শীত,তার উপর পুকুরে ডুব! পুকুর পাড়ে খড়কুটোর আগুন আগে থেকেই রেডি রাখা থাকতো। এক কোমর জলে নেমেই দ্রুত ছড়া আউড়ানো শুরু করে দিত ছোটরা-- এক ডুবে শুচি / দু'ডুবে মুচি / তিন ডুবে মুসলমান/ চার ডুবে গঙ্গাস্নান! ছড়া শেষ হওয়া মাত্রই টপাটপ করে চারটে ডুব। তারপর ছুট্টে আগুনে হাত- পা সেঁকে নিত সব্বাই। এরপর মাঝ- সকালে মন্দিরে মন্দিরে মকর আনতে যাওয়ার হিড়িক লাগতো। গাঁয়ের ছোটরা আজ সেভাবে মকরডুব দ্যায় না।
পয়লা বৈশাখে আগে বাড়ি বাড়ি পাঁজি পড়তে আসতে আচার্য্যি ঠাকুর। বাড়ির কর্তা প্রথমে যে কোন ফল বা হরিতকি হাতে নিয়ে শুনতো পাঁজির ফল। আচার্য্যি ঠাকুর শোনাতেন-শনি রাজা কুজো মন্ত্রী জলানামধিপো সিতঃ/ শশীঃ শস্যাধিপো জ্ঞেয়ঃ সংবর্তশ্চ মেঘনায়কঃ। তার পর ছোটদের মাথায় পাঁজি বুলানো পর্ব চলতো। তাতে নাকি ছোটদের মাথা সারাবছর ঠান্ডা থাকবে। আচার্য্যি ঠাকুর পাঁজি পড়তে আর পাড়ায় আসেন না। এমনকি রাখীপূর্ণিমায় গাঁয়ের পাড়ায় পাড়ায় রাখী পরাতে আসতেন এই আচার্য্যি ঠাকুর অথবা ঠাকরুন। হাতে রাখী বাঁধতেন আর বলতেন মন্ত্র-যেন বন্ধো বলীরাজা দানেবেন্দ্রো মহাবলঃ/তেন ত্বাং প্রতিবধ্নামি রক্ষো মা চল চল।

গাঁয়ে তখন দাদু- ঠাকুমারা কথায় কথায় ছড়া কাটতেন। কত জীবনদর্শন, কত ব্যাঞ্জনা,কত আমোদ লুকিয়ে থাকতো তাতে। আজকাল সেই দাদুঠাকুমাদেরও সন্ধ্যে থেকে টিভির কাছে আটকে থাকতে দেখা যায় রাত অব্দি। তখন ছড়া কেটে ছোট- বড়োদের মধ্যে গাঁয়ে রাগানোর চল্ ছিল। কারো নাম হয়তো ভুটি।হয়তো বা সে একটু মোটা চেহারার। অম্নি সবাই তাকে ক্ষ্যাপাতো এই বলে- ভুটি ভুটভুট করে/ ভুটির ভাত কম পড়ে/ ভুটি ধুমসা গতরি/ ভুটির হবে মোটা শ্বাশুড়ি! এর মধ্যে যদিও মনে আঘাত পাবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হোতো না। সামান্য মনকষাকষি ও হাসিঠাট্টার মধ্যে মিটমাট হোয়ে যেত।
কত গ্রাম্য খেলাধুলা হারিয়ে গেছে গাঁয়ের সবুজ মাঠ থেকে। বৌবসন্ত,গাদি,চিনিবিস্কুট,আঁটুলবাটুল,পাতালুকানি,পাঁচগুটি, অষ্টা,মোগলপাঠান- এমন কত্ত খেলা জানেই না আজকের গাঁয়ের শিশুকিশোর। তার বদলে সদর্পে জায়গা করে নিয়েছে পাবজি,ফ্রিফায়ার নামক রকমারি কত ভিডিও গেম। তাদের হিরো এখন ছোটা ভীম,বেনটেন, মটু - পাতলু,অগি কিম্বা নিনজা হাতড়ি। কেনো মনে হয় যেন আজকের গ্রামীণ শিশুকিশোররা দ্রুত হারিয়ে ফেলছে তাদের ছেলেবেলা। মা- বাবারাও চাইছেন মনন নয়,মেধায় যেন উন্নত হয় তাদের সন্তানসন্ততি।
গ্রাম্য হাটগুলো বাজার হোয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। একদা হাটুরেদের মধ্যেকার কথাবার্তার আন্তরিকতা তা হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু ক্রেতা- বিক্রেতার মাঝে বিকিকিনি আর দরকষাকষি। গঞ্জের চা দোকানগুলো একএকটি রাজনৈতিক দলের ঠেকে পরিণত হয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় ঐক্যজোট বিনষ্ট। স্বর্থপরতা নামক ভয়ঙ্কর অসুখ নিঃশব্দ আততায়ীর মতো শেষ করে দিচ্ছে গ্রামীণ ঔদার্যের অস্থিমজ্জাকে।
হয়তো বিষাদগীতিকা হোয়ে হৃদয়ের পাড় ভেঙে দিচ্ছে গ্রাম্য কথার ইতিউতি। কালের অগ্রগমনের সাথে গ্রাম্য রূপ- ধর্মের এমন পটপরিবর্তন হয়তো স্বাভাবিক। অনেকক্ষেত্রে কাম্যও বটে। শুধু হাস্যকর হয় কাকের ময়ূর হোয়ে ওঠার ব্যর্থ আয়োজন ও আয়াস। শিকড়ে পচন ধরতে দিলে সমগ্র বৃক্ষের যে পতন আসন্ন - তা বুঝেও গোড়ায় ইচ্ছকৃতভাবে ঘুণ ধরতে দেওয়া একধরণের ব্যাধি। এমন ব্যাধি নিরাময় হোক। গ্রাম বেঁচে থাক। সভ্যতা বেঁচে থাকবে।











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...