বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২২

বিদেহ নন্দিনী~ ৪২ ।। ডঃমালিনী ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস , Bideha Nandini 42

 বিদেহ নন্দিনী~ ৪২ ( অন্তিম পর্ব )

ডঃমালিনী 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস 


 (৪২)

এই কয়েকদিন আমি যেখানেই বসেছি সেখানেই বিমর্ষ হয়ে পড়েছি। লব কুশের রাজসভায় অপমান হবে বলে চিন্তায় জর্জরিত হয়ে পড়েছি। অবশ্য ঋষি বাল্মীকির তত্ত্বাবধানে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ  থাকবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। পুরোনো কথাগুলি রোমন্থন করে থাকার সময় হঠাৎ আত্রেয়ী  এসে উপস্থিত হল । আনন্দে চোখের জল ঝরিয়ে আত্রেয়ী বলল-‘ সীতা,আমি বলেছিলাম না রামচন্দ্র তোমার দুই পুত্রকে গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই পুত্রদ্বয়ের জননীর খোঁজে আসবে দেখ।’ আমার কথা কীভাবে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে । রাজা রামচন্দ্র আশ্রমে দূত পাঠিয়েছে। আমি তার কাছ থেকে সমস্ত খবর নিয়েছি। তুমি অযথা চিন্তা করছিলে তোমার স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করেছে বলে ভেবে। যজ্ঞের জন্য আবশ্যক পত্নীর স্থান পেয়েছে একটি সুবর্ণ সীতার মূর্তি। সুবর্ণ সীতার মূর্তি পাশে বসিয়ে রেখে রাঘবের যজ্ঞ  সম্পন্ন করার কথা জানতে পেরে আমার মন ছটফট করতে লাগল। অনুশোচনায় মনটা ভরে উঠল। মুহুর্তের মধ্যে স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। দীর্ঘ বারো  বছর পরে মনের মধ্যে স্বামীকে স্মরণ করলাম। তাঁর চেহারা মনে করতে চেষ্টা করলাম। মনে হল তিনি যেন আগের চেয়েও বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছেন। পরের মুহূর্তে আমার নিজের চেহারার কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। গত বারো বছরে আমার সৌন্দর্য সম্পূর্ন ম্লান হয়ে পড়েছে। আমার শরীরের উপরে দুঃখ-কষ্ট দরিদ্রতা ছাপ ফেলে গেছে। বর্তমানে আমার দেহ একেবারে শীর্ণ। তাই মনের মধ্যে ভয় হল কে জানে আমাকে দেখার পরে রাঘবের আমার প্রতি আগ্রহ যদি কমে যায়? আমি ভয়ে আত্রেয়ীকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম-‘ হে মাতা আমাকে সত্য কথা বল, আমি দেখতে কুরূপা হয়ে পড়েছি নাকি? স্বামী আমাকে চিনতে পারবে তো? আত্রেয়ী  আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-‘ কেন চিনতে পারবে না নিজের মনের মানুষকে? আমি তোমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে পাঠাব।

আত্রেয়ীর কথা শুনে আমার চটকরে লঙ্কা বিজয়ের পরে রঘুনন্দন আমার প্রতি করা ব্যবহারের কথা মনে পড়ল। নিমেষের মধ্যে আমি ম্লান হয়ে গেলাম। রামচন্দ্রের জীবনে ফিরে যাবার আগ্রহ নাই হয়ে গেল।পরে আত্রেয়ীর উৎসাহজনক কথা শুনে আমি মনকে পুনরায় সবল করতে চেষ্টা করলাম।

আত্রেয়ী এবং আশ্রমের অন্য মহিলারা আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রথের কাছে এগিয়ে নিয়ে এল। সেই সময় আমার মনের মধ্যে বিভিন্নভাবের আলোড়ন চলছিল। দুঃখ-কষ্ট, অভিমান, আনন্দ এবং দাম্পত্য জীবনের স্মৃতি আমাকে আবেগিক করে তুলেছিল। আত্রেয়ীকে মুখ্য করে আশ্রমের প্রতিটি মানুষের চোখের জল ফেলার কারণ হয়ে আমি বিদায় নিলাম। সুসজ্জিত রথের উপরে রঘুবংশের ধ্বজা দেখে আমার মনটা পুলকিত হয়ে উঠল। সারথি সম্মান প্রদর্শন করে রথের দরজা খুলে দিলেন।সারথি হিসেবে  সুমন্ত্র এসেছিল। দীর্ঘ বারো বছর পরে সুমন্ত্রকে দেখে আমি আবেগিক হয়ে পড়েছিলাম। তবুও শোক সম্বরণ  করে সারথিকে কুশল বার্তা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি যথাযথ উত্তর দিলেন। অযোধ্যার বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হল না। রাঘবের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল যদিও সাহস করলাম না। তাই মৌন হয়ে রইলাম। মনটা ছটফট করতে থাকায় একবার সুমন্ত্রকে রাঘবের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে সারথি বলল মহর্ষি বাল্মীকি আপনাকে যজ্ঞস্থলে নিমন্ত্রণ করার জন্য রামচন্দ্রকে অনুরোধ করেছেন যাতে তাঁর জীবিত কালে আপনারও একটা গতি হয়। রামচন্দ্র বাল্মীকির অনুরোধ রক্ষা করে আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য এই রথ পাঠিয়েছেন।’

এইরকম একটা কথাটা শুনে মুহূর্তের মধ্যে আমার রথের উপর থেকে লাফ দিতে ইচ্ছে করছিল। কোনোমতে ধৈর্য ধরে থাকতে চেষ্টা করলাম যদিও আমার শরীর কাঁপতে লাগল। মাথাটা যেন ঘুরতে লাগল। কিছুক্ষণ এভাবে যাবার পরে আমার শরীর ঘামতে শুরু করল।  তখন মাথাটা কিছুটা হালকা  বলে অনুভব হল। সম্পূর্ণ সুস্থ বলে মনে হওয়ায়  ভাবলাম সুমন্ত্রকে আমার মনের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লাভ নেই। এসেছি যখন গন্তব্য স্থানে নামতেই হবে।

তারপরে নিজের মনটাকে নিজেই এভাবে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করলাম-‘ রামচন্দ্রের বিনা অনুমতিতে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য রথ পাঠানোর কারও সাধ্য নেই।  স্বয়ং মাতা  কৌশল্যারও।  বোধ হয় রঘুনন্দন  নিজের মুখে নিমন্ত্রণ করতে লজ্জাবোধ করে  ঋষি বাল্মীকির অজুহাত নিয়ে  বাঁকা পথ অবলম্বন করেছে।  তার মধ্যে রাঘব প্রজাদের গুরুত্ব দেওয়া পুরুষ।  একবার নির্বাসন দেওয়া পরিবারকে  পুনরায় উপযাচক হয়ে নিমন্ত্রণ করলে  তাদের সামনে মান-সম্মান রাখা মুশকিল হবে বলেই হয়তো তিনি বাল্মীকির মাধ্যমে আমাকে ডেকেছেন।  এভাবে ভেবে আমি মনটাকে  প্রবোধ দিয়ে পুনরায়  আমার ছেড়ে যাওয়া দিনগুলির মধুর স্মৃতিগুলি রোমন্থন করে দেখতে চাইলাম। যাতে আমার মনে এবং অন্তরে তার প্রতি থাকা  ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা ,ভক্তি যেন ফিরে আসে।  

কথাগুলি ভেবে থাকার সময় কখন যে নৈমিষ  যজ্ঞক্ষেত্রে  পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। রথের ভেতর থেকে  সমগ্র যজ্ঞক্ষেত্রটাকে একবার ভালো করে দেখে নিলাম। লোকে লোকারণ্য। সারথি বলল-‘ সবাই আপনার আত্মশুদ্ধি ও সতীত্ব শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান দেখার জন্য সমবেত হয়েছে।’

আমি অবাক হয়ে বললাম আত্মশুদ্ধি? সতীত্বের শপথ? আমার দেহে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে বলে অনুভব হল। রথ থেকে নামব কিনা মনে মনে চিন্তা করলাম। তবে নামতে তো হবেই। না হলে কোথায় যাব? মনের শক্তি সংগ্রহ করে বললাম-‘ এসেছি যখন আরও একবার অপমানিত হতে হবে।’

আমি রথ থেকে নেমে একেবারে যজ্ঞক্ষেত্রের দিকে তাকালাম। বৃহৎ ক্ষেত্রটার ডান দিকের মাঝখানে বসেছে ব্রাহ্মণরা। পাশে একটি উচ্চ আসনে বসেছেন রাজা রামচন্দ্র। দূর থেকে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার পাশে নিচের আসনগুলিতে সারি পেতে বসেছে ভরত, লক্ষণ এবং শত্রুঘ্ন।  তাদের বাঁদিকে শাশুড়িরা এবং জা ও অন্যান্যরা। প্রত্যেকের দৃষ্টি আমার উপরে। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ঋষি বাল্মীকি রথের কাছে এগিয়ে এলেন। আমি ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে যন্ত্রমানবের মতো ঋষির পেছন পেছন যেতে লাগলাম। ইতিমধ্যে সম্ভবত জনগণের মধ্যে যথেষ্ট কোলাহলের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন জনের কথাবার্তার টুকরো আমার কানে এসে পড়ছে। দুই-একজন উচ্চস্বরে রামকে প্রশংসা করছে আমার আত্মশুদ্ধি  এবং সতীত্ব শপথ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত করার জন্য। সভাস্থলে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বাল্মীকি আমার হাত ধরে রামচন্দ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন-‘ হে রাজন এই যে তোমার পত্নী জানকী যাকে তুমি আজ থেকে বারো বছর আগে লোক অপবাদের ভয়ে অরণ্যে নির্বাসন দিয়েছিলে। কপাল ভালো ছিল যে সেই অরণ্যের কাছে আমার আশ্রম ছিল। সুদীর্ঘ বারো বছর বৈদেহী আমার তত্ত্বাবধানে। গত বারো বছর আমি তাকে প্রত্যক্ষ করে এসেছি। শুদ্ধরূপে শুদ্ধাচারী জীবনযাপন করে কাটিয়েছে কোশল বধূ জানকী। আমি তাকে কন্যার মতোই দেখে এসেছি। বর্তমানে তোমার কথামতো জানকীকে তোমার সামনে উপস্থিত করলাম।’ 

স্বামী রামচন্দ্র বোধ হয় আমার সাধারন বস্ত্র, অলংকার বিহীন দেহ, শীর্ণ শরীরের গঠন দেখে অবাক হয়েছিল। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন আমি সেই একই রূপসী সীতা হয়ে আছি। তিনি হয়তো অনুভব করছেন আমার এই চেহারা রাজপরিবারের সঙ্গে খাপ খাবে না। বিয়ের পরে আগেও আমি অনেকবার অনুভব করেছিলাম যে রাঘব আমার বাহ্যিক রূপটাকে বেশি গুরুত্ব দান করে । আমার মন এবং অন্তরকে নয়। আমার এই শীর্ণকায় অবস্থার জন্য প্রকৃতপক্ষে রাঘবই যে দোষী  একথা উপলদ্ধি করার মতো এই জগতের প্রভুর ততটুকু জ্ঞান আছে কিনা আমার সন্দেহ হয়। আমি ভিখারির বেশে হাজার হাজার লোকের সামনে প্রবেশ করায় তার হয়তো আত্মসম্মানে আঘাত লাগল। তাই সুমন্ত্রকে বললেন-‘ একে স্নান করিয়ে নববস্ত্র এবং অলংকার পরিয়ে এখানে নিয়ে আসা উচিত ছিল। আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম বলেই  দ্বিতীয়বার বিবাহের কথা একবারও ভাবিনি। আচ্ছা এখন জানকী শুদ্ধাচারী এবং সতীত্বের শপথ নিক। তারপর রাঘব ঋষির দিকে তাকিয়ে বললেন-‘ হে মহর্ষি বাল্মীকি আমি আপনার কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করছি। তবুও লোক অপবাদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সীতা পবিত্রতা এবং সতীত্বের শপথ গ্রহণ করুক।’ 

তার কথা শুনে আমার সমস্ত দেহের রক্ত যেন এক জায়গায় জমাট বেঁধে গেছে বলে মনে হল। আমি মাথার ঘোমটা খসিয়ে রামচন্দ্রের দিকে তাকালাম। আমার চোখে চোখ পড়ল। তিনি হয়তো আমার মুখে আগের লজ্জা লজ্জা ভাব, কমনীয়তা, কোমলতার পরিবর্তে দেখতে পেলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো শক্তি থাকা একটি মুখ। মুখে দৃঢ়তার ছাপ। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তার দিকে পিঠ দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। ভাবলাম কথা না বাড়িয়ে আমি আমার ব্যবহারেই দেখিয়ে দেব যে আমি সেই আগের লজ্জাবতী সীতা নই। আমি তাকে নির্বাসনে দিয়েছি অন্তর থেকে। তিনি বুঝুন যে তার করা কার্যাবলীর প্রতিবাদ করার জন্য বর্তমানে আমার যথেষ্ট সাহস আছে। 

হঠাৎ আমার পিতৃসম  মহর্ষি বাল্মীকির কথা মনে পড়ল। তিনি হয়তো আমার এই ধরনের আচরণ দেখে অপ্রস্তুত হয়েছেন। অবশ্য গত বারো বছরে তিনি আমাকে দেখে শুনে ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছিলেন যে স্বামীর দ্বারা বারবার নির্যাতিতা হয়ে আমি একজন অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়েছি। সে কথা তিনি একদিন আমাকে বলেছিলেন-‘হে জানকী, তোমাকে আমি পতি এবং দেবরের সঙ্গে বনবাসে কাটানোর সময় প্রথম দেখেছিলাম। সেই জানকী ছিল স্বামীর অবিহনে এক পাও চলতে না পারা, পতিবিনে  জগৎ অন্ধকার বলে ভাবা, ভালোবাসা,স্নেহ, দয়া, করুণায় ভরা দেবী। কিন্তু বর্তমানে আমি যে জানকীকে  দেখছি সে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে দুঃখ-কষ্ট আঘাতে কর্কশ হয়ে পড়া একজন মানুষ, যে একাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহস করে।’ 

আমার বর্তমান প্রকৃতি ঋষি ভালোভাবেই জানেন বলে হয়তো কিছু না বলা কথা তিনি রাঘবকে  বললেন-‘ হে রাজন, আমি জীবনে  যতটুকু পূণ্য অর্জন করেছি, তার নামে শপথ করে বলছি বৈদেহী  কলুষহীন, নিষ্পাপ এবং নির্মল। লব কুশ তোমার ঔরসজাত পুত্র। তুমি বিনা দ্বিধায় সীতাকে  গ্রহণ কর। তাহলে তোমার এবং দেশের মঙ্গল হবে।’

বাল্মীকির কথা শুনে সমগ্র যজ্ঞক্ষেত্র নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই রাজা কী বলেন কী করেন তা দেখার জন্য বা শোনার জন্য আগ্রহে চেয়ে রইল। কিন্তু রাঘব নীরব । বোধহয় সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হচ্ছে। কারণ তিনি সবসময় প্রজার চিন্তাচর্চায় চলা পুরুষ। নিজস্বতা বলতে কোনো জিনিস নেই বলে মনে হয়। সব সময় প্রজারা তার জয়গান এবং গুনকীর্তন করাটাই চান। বোধহয় সেই জন্যই তিনি কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলেন। রামচন্দ্রের মনের ভাব ঋষিবুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি পুনরায় বললেন-‘ তুমি সীতাকে নিষ্কলুষ জেনেও লোক অপবাদের ভয়ে নির্বাসন দিয়েছিলে। আজ আমি এই জনসমুদ্রের সামনে তোমাকে আবার বলছি সীতা একেবারেই পবিত্র, শুদ্ধাচারী। তবু যদি তোমার সন্দেহ হয় তাহলে  সীতা শুদ্ধতার শপথ নেবে।

ঋষির বাক্য শুনে আমি শিউরে উঠলাম। আমি বুঝতে পারলাম তিনি আমাকে সতী প্রমাণ করে রাজরানি করাতে চাইছেন। আমার জীবনের দুঃখের সমাধান  করতে চাইছেন ।ঋষি ইতিমধ্যে লব কুশকে পিতার দ্বারা  গ্রহণ করানোর কাজে সফল হয়েছেন। তিনি হয়তো তাই ভাবছেন আমাকে রামচন্দ্রের হাতে অর্পণ করে তিনি নিশ্চিত হবেন এবং শান্তিতে চোখ বুঝতে পারবেন। এদিকে বাল্মীকির কথায় জগতের প্রভু যেন কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলেন বলে মনে হল। তিনি সবাইকে শুনিয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন-' হে মহর্ষি, আপনার কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য। তবু লোকঅপবাদ  মোচন করার জন্য সীতা সতীত্বের শপথ গ্রহণ করুক। তার এই কার্য নারী জাতিকে শীর্ষস্থানে উপনীত করার সঙ্গে সীতা নিজে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।' 

রাঘবের চালাকি করে বলা কথাগুলি শুনে আমার ক্রোধে কানদুটি গরম হল। মনে মনে  গুমড়ে থাকা কথাগুলি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হল। কিন্তু পিতৃ সম বাল্মীকির  কথা চিন্তা করে ধৈর্য ধরে রইলাম। তারপরে চারপাশে আমার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। দেখলাম শাশুড়ি কৌশল্যা যেন অস্বস্তি বোধ করছেন। লক্ষ্মণ বসা অবস্থায় ছটফট করছে । শত্রুঘ্ন এবং ভরত কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়েছে বলে মনে হল। উর্মিলা মান্ডবী এবং শ্রুতকীর্তি নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছে। হয়তো রাজা রামচন্দ্র ঘোষণা করা কথাটা রাজ পরিবারের কেউ গ্রহণ করতে পারেনি। আমি ভালোভাবে জানি রাজপরিবার রাঘবের সব কথা সমর্থন না করতে পারে তা বলে কোনো একজন প্রতিবাদ ও করবে না। এমনকি মাতা কৌশল্যাও। আমাকে নির্বাসন দেওয়ার ক্ষেত্রে মাতা কৌশল্যার স্থিতি বড় রহস্যজনক। আমার নির্বাসন হয়ে যাবার পরে বাল্মীকির আশ্রমে আমি প্রতিদিনই ভাবতাম শাশুড়ি কৌশল্যা নিশ্চয় আমার কাছে আসবে। তার মধ্যে সেই সময় আমি গর্ভবতী ছিলাম। তার পুত্রের বীজ আমার গর্ভে সন্তান রূপে  আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আমি যেন সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারি তার জন্য শাশুড়ি কৌশল্যার আমার প্রতি যত্ন ছিল  অসীম ।আমাকে যেদিন নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল সেদিন শাশুড়ি বাড়িতে ছিলেন না। তাই আমি বাল্মীকির আশ্রমে প্রতিদিনই তিনি আমাকে  একবার দেখতে যাবেন  বলে আশা করেছিলাম। ভেবেছিলাম রাঘবকে তিরস্কার করে আমাকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করবে অথবা তিনি নিজেই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে আমার কাছে চলে আসবেন বলে ভয় দেখাবেন। কিন্তু আমি ভাবার মতো কিছুই হল না। লব কুশ জন্ম হওয়ার পরে পর্যন্ত এই নারীকে স্নেহশীলা জননী বলে ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম অনেক পুণ্য করলেই এই ধরনের একজন নারীকে শাশুড়ি হিসেবে পাওয়া যায়। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। মানুষ দীর্ঘকাল ধরে বাড়িতে কাজ করা একটি মেয়ের জন্য ও খবর করে থাকে। সেই জায়গায় রাজপরিবারের প্রত্যেকেই তাদের বড় বউকে রাঘব পরিত্যাগ করায় তারাও কীভাবে আমাকে পরিত্যাগ করতে পারল এই কথা ভেবে আমি অবাক হই। এখন শাশুড়ি কৌশল্যাকে অস্বস্তি অনুভব করতে দেখে আমার মনে তিনটি প্রশ্নের উদয় হয়েছে। প্রথমটি হল তিনি হয়তো ভেবেছেন শপথগ্রহণ হয়ে যাবার পরে সীতা পুনরায় রাজরানি হবে। গত বারোবছরে একদিনও খবর না নেওয়ার জবাব তিনি কীভাবে দেবেন। দ্বিতীয়তঃ হয়তো মাতা কৌশল্যা আমি লব কুশের মা হয়ে রাজপরিবারের ফিরে যাওয়াটা চাইছেন না অথবা দুই কুল রক্ষা করে কিছু একটা বলা উচিত হবে বলে ভাবছেন। যাতে আমি পুনরায় রাজরানি  হলেও  আমার মুখোমুখি হতে তার কোনো অসুবিধা না হয়।

কথাগুলি ভেবে হয়তো আমি অনেকক্ষণ তন্ময় হয়েছিলাম। হঠাৎ রামচন্দ্রের কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম আমার অন্য একটি অগ্নিপরীক্ষার সময় হয়েছে। রাঘব বললেন - কথাগুলিতে দেরি করা উচিত নয়।  সীতা দ্রুত শুদ্ধাচারী এবং সতীত্বের শপথ নিয়ে  পুনরায় রাজ পরিবারে ফিরে আসার ব্যবস্থা করুক ।'

ঠিক তখনই শত্রুঘ্নের  কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।  সাহস করে শত্রুঘ্ন জিজ্ঞাসা করল -' জানকীকে কেন শপথ নিতে হবে মহারাজ?  আপনি নিজেও জানেন যে তিনি একটি আয়নার মতো স্বচ্ছ এবং নিষ্কলুষ…'

  শত্রুঘ্ন আমার পক্ষ নিয়ে আরও কী সব বলেছিল।  কিছু কথা আমার কানে ঢুকল না।  কারণ আমি কিছুটা আবেগিক হয়ে পড়েছিলাম।  মনে  মনে  শত্রুঘ্নের সাহসের প্রশংসা করলাম। আমি ভালোভাবে বুঝতে পারলাম যে শত্রুঘ্ন দাদার সঙ্গ থেকে  দূরে সরে গিয়ে  মধুবনে নতুন নগর স্থাপন করে  প্রজা শাসন করতে শুরু করেছে বলেই হয়তো  সে উচিত সময়ে উচিত কথা  বলতে হয় বলে  বুঝতে পেরেছে।  কিন্তু দাদা রামচন্দ্র শত্রুঘ্নের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে  উচ্চ স্বরে বললেন -'জানকীর শুদ্ধতার  কথা  কেবল আমি ,তুমি বা  আমরা জানলেই হবে না।  লঙ্কা বিজয়ের পরে সবার সামনে সীতা সতীত্ব প্রমান করেছিল। সেই দৃশ্য দেবতারাও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এবং তারপরেই আমি সীতাকে আমাদের রাজপরিবারে স্থান দিয়েছিলাম। কিন্তু  কিছুদিন ভালো ভাবে পার হয়ে যাবার পরে লোক অপবাদ  বড় প্রবল হয়ে উঠল। উপায়হীন হয়ে আমি জানকীকে নির্বাসন দিলাম।  অবশ্য তখনও আমি জানতাম  তিনি নিষ্কলুষ বলে।  কিন্তু আমার উপায় ছিল না। আমি ভালোভাবেই জানি লব কুশ আমার সন্তান। তবুও তিনি  জনগণের সামনে আত্ম শুদ্ধতা এবং সতীত্বের শপথ   নিলেই আমি বৈদেহী নন্দিনীকে গ্রহণ করব। 

  রাঘবের প্রতিটি শব্দ  আমার বুকে শেলের মতো বিধেঁছিল।  তাঁর কথা সহ্য করতে না পেরে আমি মাথা তুলে যথেষ্ট কঠিন কন্ঠে শত্রুঘ্নের   দিকে তাকিয়ে বললাম-'  শত্রুঘ্ন ,আমি কার কাছে শপথ নেব?  সেই স্বামীর কাছে  যে স্বামী শপথের অর্থ বুঝতে পারেনা ? অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যাবার পরেও পত্নীকে সন্দেহ করতে ছাড়ে না,সেই  তার কাছে?'

আমাকে বল শত্রুঘ্ন কোন পুরুষের কাছে শপথ নেব? সেই কাপুরুষের কাছে যিনি নির্বাসনের কারণ দর্শাতে হবে বলে পালিয়ে বেরিয়েছিল? বেড়াতে নিয়ে যাবার ছলে জঙ্গলে ছেড়ে আসার জন্য ভাইকে নির্দেশ দিয়েছিল? এমন একজন কাপুরুষের কাছে?'

‘শত্রুঘ্ন, কার কাছে শপথ নেব? আমার সন্তানের সেই পিতার কাছে যে গর্ভেই সন্তানকে নির্বাসন দিলেন? যে পিতা সন্তান ভূমিষ্ঠ হল কিনা সেই খবর পর্যন্ত নিলেন না? সেই পিতার কাছে শপথ নেব কি যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলেও ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করার জন্য জঙ্গলে ফেলে এসেছিল? সেই পুরুষকে সমস্ত জগৎ ভগবান বলে ভাবতে পারে আমার কিন্তু এরকম ব্যক্তিকে মানবের সারিতে স্থান দিতে অসুবিধা হচ্ছে। আমার কথা শুনে যজ্ঞস্থলের সমবেত জনগণ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপরে গুঞ্জন এবং কোলাহলের সৃষ্টি হল। ‘এই রমণী জগৎপতিকে এভাবে বলছে।

রাঘব হয়তো আমার কথায় কিছুটা লজ্জিত হলেন। তাই তিনি বললেন-‘ লজ্জা যে নারীর ভূষণ জানকী হয়তো তা ভুলে গেছে। রাজগৃহে স্থান লাভ করতে হলে তাকে সতীত্বের শপথ নিতেই হবে ।’  ব্রাহ্মণরা রামের কথায় সায় দিয়ে বললেন-‘প্রভু রামচন্দ্রের কথা জগত মেনে চলে। তাই জনক নন্দিনীও বিনা প্রতিবাদে প্রভুর কথা মেনে চলা উচিত।’ 

আমার ব্রাহ্মণদের উপরে ক্রোধ জন্মাল। মনে মনে ভাবলাম-‘ এই ব্রাহ্মণরা সমস্ত বিদ্বেষের মূল। যত নারীবিদ্বেষী শ্লোক, নিয়মকানুন আছে সমস্ত কিছু এদেরই প্রবর্তন করা। বৃদ্ধ বয়সে বিয়ে করে যুবতীদের সামলাতে না পেরে সমস্ত নারী জাতির জন্য কঠোর নিয়ম নীতি নির্ধারণ করলেন। কেবল তাই নয়, হীনজাতির লোক অধ্যয়ন করে পন্ডিত হতে পারে বলে ক্ষত্রিয় ছাড়া বাকি কোনো নিম্ন শ্রেণির লোক ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে পারবে না বলে নিয়ম প্রবর্তন করেন। অধ্যয়ন করা তো দূরের কথা, এমনকি হীনজাতি ভগবানের আরাধনা করলে বা তপস্যা করলে দেশে দুর্ভিক্ষ এবং অমঙ্গল হবে বলে নিয়ম করেছিলেন। আর সেই নিয়মকে শিরোধার্য করে আমার সামনে থাকা এই জগৎপতি শম্বুক নামের একজন শূদ্র কে তরোয়াল দিয়ে দু'খন্ড করেছিল, তপস্যার অপরাধে। তাই এই সমস্ত ব্রাহ্মণদের উপরে আমার কোনো শ্রদ্ধা ভক্তি নেই। এরা কোনো দিন ঋষি বাল্মীকির মতো হতে পারবে না। কথাটা ভেবে থাকার সময়ে হঠাৎ লক্ষ্ণণের কন্ঠস্বর শুনলাম-‘ হে মহারাজ অতীতের অগ্নিপরীক্ষায় সীতাদেবী কীভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন আমি নিজের চোখে দেখেছি। সমস্ত দেবতারা সীতাদেবীর পবিত্রতার কথা কীভাবে বলেছিল আপনার নিশ্চয় মনে আছে। অগ্নি লেলিহান শিখায় দগ্ধ করতে না পারা জানকীকে অগ্নি দেবতা কীভাবে অগ্নিকুণ্ড থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেই দৃশ্য আজও আমার চোখের সামনে ভাসছে। তাই আপনি মহর্ষি বাল্মীকির কথায় বিশ্বাস না করে পুনরায় কেন সীতাদেবীকে সামাজিক ভাবে অপমান করতে চাইছেন?'

উত্তরে রাঘব বললেন-‘ তখনকার কথা আলাদা ছিল। গত বারো বছরে সীতার  জীবনে কী ঘটেছে সেই বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। তাই জানকী শপথ নিলে হয়তো আমার তার ওপরে বিশ্বাস এবং আস্থা ফিরে আসবে।’ 

রাঘবের কথা শুনে পুনরায় আমার শরীরটা শিউরে উঠল। এবার আমি মানুষটা এভাবে ঘুরে দাঁড়ালাম যাতে সমগ্র যজ্ঞস্থলের জনগণ আমাকে সম্পূর্ণভাবে দেখতে পায়। তারপর সমগ্র জনগণকে প্রণাম জানিয়ে বললাম-‘ হে অযোধ্যার জনগণ, এই মহারাজের কাছে শপথ নিয়ে বা কথা বলে কোনো লাভ নেই। তাই আমি আপনাদের দু'একটি কথা বলতে চাই। সত্যি কথাটা বলার সময় যদি কারও অন্তরে আঘাত লাগে তাহলে নিজ গুনে ক্ষমা করবেন। গত বারো বছর গার্হস্থ্য ধর্মের পরিবর্তে আমি সন্নাসীর মতো জীবন যাপন করছি। এখন আমার রাজরানি হওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। আপনারা জানেন যে আমি একজন রাজার সহধর্মিনী ছিলাম। তাকেই আমি সর্বস্ব সঁপে দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারেননি। বনবাসে রাবণ আমাকে হরণ করেছিল। হরণ করার জন্য একমাত্র দাদা আর ভাই দুজনের ভুলগুলিই দায়ী।দুজনেই রাবণের বিধবা বোন শূপর্ণখার নাক কান কেটে শত্রুতা বৃদ্ধি করেছিল। রাবণের হাত থেকে আমাকে সেদিনই উদ্ধার করতে পারল না। তাতে আমার  কীভাবে দোষ হতে পারে? সম্পূর্ণ এক বছর পরে রাবণকে বধ করে লঙ্কা জয় করার পরে আপনাদের এই রাজা আমার প্রতি এরকম ব্যবহার করলেন যেন আমি রাবণকে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার বুদ্ধি দিয়েছিলাম। তিনি আমার সতীত্বের প্রমাণ চাইলেন। তাই অগ্নি পরীক্ষা হল। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম বলে রাঘব আমাকে গ্রহণ করেছিল যদিও তার অন্তর পরিষ্কার ছিল না। একদিন রাজপ্রাসাদের কর্মচারীরা রাক্ষস দেখতে কীরকম বলে জিজ্ঞেস করায় আমি মেঝেতে একটা ছবি এঁকে দেখিয়েছিলাম। ছবিটা দেখে তিনি আমাকে বাক্যবাণে প্রহার করে বললেন যে আমি নাকি এখনও রাবণকে ভুলতে পারিনি। আমি গর্ভবতী হওয়ার পরে তার সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। কিন্তু আপনাদের রাজা এটাও ভেবে দেখলেন না যে বনবাস থেকে ফিরে আসার কতদিন পরে আমি সন্তানসম্ভাবা হয়েছিলাম। আরেকদিন লোক অপবাদের ভয়ে আমাকে কারণ না দেখিয়ে নির্বাসনে পাঠালেন। তখন আমার গর্ভে ছিল পাঁচ মাসের সন্তান। পিতা বাল্মীকিকে  সেই সময়ে না পেলে আমি তমসা নদীতে প্রাণ বিসর্জন দিতাম। এখন আপনাদের সম্রাট রামচন্দ্র জানতে পেরেছেন যে লব কুশ তার সন্তান। ওরা দুজন শাস্ত্রবিদ্যা, অস্ত্রবিদ্যা সমস্ত কিছুতে দক্ষ হয়ে উঠেছে। কখনও হয়তো তারা প্রাপ্য রাজ্য দাবি করতে পারে। তাই আপনাদের চতুর  সম্রাট ওদের প্রাপ্য দাবি করার আগেই ঋষি বাল্মীকির কথা বিশ্বাস করে ওদের দুজনকে গ্রহণ করে নিয়েছে। আমি ভাবি না এই কাজ তিনি অন্তর থেকে করেছেন বলে। সবই লোক দেখানো কাজ। এখন নিজেকে দূষণমুক্ত করার জন্য এবং আপনাদের সবার কাছে তিনি উদার হৃদয় বলে পরিচিতি লাভ করার জন্য আমাকে পুনরায় রাজপ্রাসাদে জায়গা দিতে চাইছেন। এগুলি সবই লোক দেখানো কাজ মাত্র। আমি তার এই ধরনের কাজের সঙ্গে পরিচিত ।কিন্তু এবার আর এসবে আমি ভুলব না। রাজভোগ রাজসুখে আর আমার প্রয়োজন নেই।'

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপরে পুনরায় শুরু করলাম-‘ হে জনগণ, বর্তমানে আমার দেহে কোনো সৌন্দর্য নেই। জীবনের বেশিরভাগ সময় আমি বনবাসে কাটালাম। ক্রোধ, দুঃখ, মনোকষ্ট অভাব-অনটন আমার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে দিয়েছে। এখন আমি তাকে কী দিয়ে ভোলাব? যৌবন ভরপুর হয়ে থাকা অবস্থায় তিনি আমাকে বাসি বস্তুর মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার পরে ভবিষ্যতে যে ফেলে দেবেন না তার কী প্রমাণ আছে? তিনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না যখন আমি তাকে কীভাবে বিশ্বাস করব? আগেও তিনি আমার মনের চেয়ে দেহকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আমাকে বনবাসে পাঠানোর আগে এবং বনবাসের সময় মাঝেমধ্যে যে সমস্ত কথার শক্তিশেল নিক্ষেপ করেছিলেন সেগুলো উল্লেখ করে আপনাদের সম্রাটকে আপনাদের সামনে লঘু করার ইচ্ছে নেই। তবুও  জনমে জনমে আমি তার পত্নী হয়ে থাকতে চাই।’ 

কথাগুলি বলে আমি রাঘবের দিকে তাকালাম। তিনি ক্রোধে, লজ্জায় এবং অপমানে লাল হয়ে পড়েছেন। তার পর তিনি  গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-‘ আমি আমার দোষ স্বীকার করছি। এখন শুধু জানকী শপথ গ্রহণ করুক।’

আমিও আর কথা না বাড়িয়ে সবাইকে প্রণাম জানিয়ে শপথ নিলাম –‘হে অযোধ্যার জনগণ যদি  লব কুশ রামের ঔরসজাত সন্তান হয় তাহলে পৃথিবী বিদীর্ণ হোক। আমার মনে যদি রামের বাইরে অন্য পুরুষের কথা জায়গা পেয়ে না থাকে তাহলে পৃথিবী বিদীর্ণ হবে।

যদি আমি শুদ্ধ, আমি পবিত্র, যদি আমি সতী তাহলে এই ভূমি বিদীর্ণ হয়ে খন্ড খন্ড হোক। মা বসুমতী আমাকে তার কোলে স্থান দিক।’

আমার শপথ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। চারপাশে প্রবল বেগে বাতাস বইতে লাগল। ভূমি কেঁপে উঠল, জায়গায় জায়গায় ফাটল দেখা গেল। মানুষ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সবাই ভগবানের নাম স্মরণ করতে লাগল। সমগ্র জনগণ সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল-' বিদেহ নন্দিনী সীতা নিষ্কলুষ এবং শুদ্ধ। এই ধরনের নারীকে অপমান করার পরিণাম ভয়াবহ হবে। চিৎকার-চেঁচামেচি হট্টগোল লেগে থাকার সময়ে হঠাৎ আমি দাঁড়িয়ে থাকা জায়গার সামনে এক বৃহৎ ফাটলের সৃষ্টি হল। সেই ফাটলের ভেতর থেকে একটা সিংহাসন বেরিয়ে এল। আমি অনুভব করলাম যেন এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে সেই সিংহাসনে বসিয়ে নিচের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। তখনই আমি রাঘবের কন্ঠস্বর শুনলাম-' সীতা, আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। আমি তোমাকে বিশ্বাস ‍‌‌‌‌‌‌‌করছি।’

তাঁর কথা শুনে আমার ঠোঁটে একটা বক্র হাসি ফুটে উঠল। রাম এখানে সেখানে ধরে কোনোভাবে আমার কাছে এসে পৌঁছাল। তিনি আমাকে ধরতে চাইলেন কিন্তু আমি তাকে স্পর্শ করতে দিলাম না। আমি তার অশ্রুভরা চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললাম –‘হে স্বামী বিদায়।’ 

আমি পৃথিবীর মায়া মোহ ত্যাগ করে পাতালে চলে এলাম।

-------














কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...