রবিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০২২

পাখিদের পাড়া পড়শী ২/১ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi


পাখিদের পাড়া পড়শী ২/১

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  Pankaj Gobinda Medhi,





দ্বিতীয় অধ্যায়

(১)

রাতের রেলে এসে হরগোবিন্দ ডেকার বাড়ি পৌঁছাতে উদয়শঙ্করের সকাল দশটা বেজে গেল। এপ্রিল মাসের সকাল বেলা। পাঁচটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী এক্সপ্রেস গুয়াহাটি স্টেশনে প্রবেশ করল। সকাল বেলার আলো ইতিমধ্যে স্টেশনটাকে  ঘিরে ধরেছে। সঙ্গে থাকা সাধারণ ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে উদয়শঙ্কর আদাবাড়ি পৌঁছাল। নলবারী যাওয়ার প্রথম গাড়িটা মানুষ ভর্তি হওয়ায় গাড়িটা যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। উদয়শঙ্করের সেই গাড়িতে যাওয়ার সুবিধা হল না। পেছনের গাড়িতে যেতে হওয়ায়  তাকে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হল। গাড়িতে হিসেব মতো মানুষ হবে কিনা।

সাতটার সময়ের  গাড়িটা বগলচ রোড পেতে পুরো  দু'ঘণ্টা লাগল। চরাবরীর কালীমন্দিরটা পার হয়ে খোলা  জায়গাটায় গাড়ির চাকা ফেটে গেল। নতুন করে চাকা লাগাতে আধ ঘণ্টা সময় লেগে গেল। যাত্রীরা অপদেবতায় পাওয়া বলে অভিহিত করে জায়গাটার সরস আলোচনা করতে উদয়শঙ্কর শুনতে পেল। অনেক বছর আগে একবার নাকি পৌষ সংক্রান্তির সময় সেই জায়গায় একটা বাস সোজাসুজি জলের মধ্যে ডুবে গিয়ে কুড়ি জনেরও অধিক যাত্রী নিহত হয়েছিল। কয়েক বছর আগে বিহু দলের একটি গাড়ি, বরযাত্রীর একটি গাড়িও জায়গাটিতে দুর্ঘটনাগ্ৰস্ত  হয়েছিল। সেই সব কাহিনি এবং গুজব আলোচনা করে গাড়ির চাকা লাগানো সময়টুকু যাত্রীরা পার করছিল। উদয়শঙ্কর কেবল শুনে যাচ্ছিল কাহিনির মতো রসালো করে বলা মর্মন্তুদ ঘটনা।

বগলচ রোডে নেমে উদয়শংকর তার পরিচিত মিঠাই ঘর নামে হোটেলে প্রবেশ করল। ব‍্যাগটা একটা চেয়ারে  রেখে সে সোজাসুজি দমকলের কাছে পৌঁছাল। সবাই পুষ্কর বলে উপহাস করে ডাকা ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে রইল। ভালোভাবে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে উদয়শংকর কিছুটা স্বস্তি অনুভব করল। সমস্ত মুখমন্ডল ধুলোয় কদর্য হয়ে পড়েছে বলে মনে হল তার। হাতের তালুতে কিছুটা জল নিয়ে সে মাথাটা ভেজানোর চেষ্টা করল। দুহাতে মাথার চুলগুলি জোরে জোরে  কয়েকবার ঝাকিয়ে নেওয়ায় তার মনটা বেশ ভালো লাগল। ব‍্যাগে থাকা টাওয়েলটা দিয়ে হাত মুখ মুছে সে একটা হেলান দেওয়া চেয়ারে বসল।

পুষ্কর নামে সবাই খ্যাপানো ছেলেটি এগিয়ে এল। তার হাতে আজকের খবরের কাগজ।

উদয়শঙ্কর ভাবল ছেলেটি তার অভ্যাসের কথা ভুলে যায়নি।

কাগজটা উদয়শংকরের সামনের টেবিলে রেখে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল–' দাদা, পুরি খাবে?

– খাব, খাব। ভালো আছ তো?

ছেলেটিকে পুষ্কর বলে ডাকতে উদয়শঙ্কর আগে থেকেই ইতস্তত করছিল। উদয়শঙ্কর জানত সেটা তার প্রকৃত নাম নয়। চায়ের দোকানে কাজ করা ছেলে। খ‍্যাপানোর জন্য দুই একটা নাম থাকেই।

ভালো বলে মাথা নেড়ে ছেলেটি উদয়শঙ্করের সামনে পুরির থালাটা রেখে চায়ের গ্লাস আনতে ভেতরে গেল। উদয়শঙ্কর চোখের সামনে আজকের খবরের কাগজটা মেলে ধরল। দৈনিক খবরের কাগজগুলির প্রতি তার আজকাল বিতৃষ্ণা জন্মেছে । যা সব খবর  ছাপা হয় । ধর্ষণ, নারী হত্যা, গাড়ি অপহরণ করে চালক- পরিচালককে নির্মমভাবে হত্যা করা, পরকীয়া পালিয়ে যাওয়া প্রেম, আত্মহত্যা– এইসবের আতিশয্যে দিনটি খারাপভাবে আরম্ভ বলে মনে হয় তার।এত ঋণাত্মক  খবর গুলি। এই ধরনের খবর গুলি সমাজকে আক্রান্ত করে না কি! কলুষিত করেনি কি ? পাঠকও এই সমস্ত খবর পয়সা দিয়ে কিনে গোগ্রাসে পড়ে– খবরের কাগজের মালিক- সম্পাদক ভালোভাবেই জানে ।

দোকানে প্রবেশ করা একজন গ্রাহক সোজাসুজি উদয়শংকরের কাছে এল।

– দাদা– কিছু না মনে করেন যদি– 

আধবয়সী, চল্লিশ বছরের মতো হবে বোধহয়, একটি ছেলে তার কাছ থেকে খবরের কাগজটি  চাইছে।

– দাদা– জাস্ট রাশিফলটা দেখে দিয়ে দেব। এই কাগজটির রাশিফলটা আমার সঙ্গে একেবারে মিলে যায়।

উদয়শঙ্কর ছেলেটির দিকে কাগজটা এগিয়ে দিল। মানুষের রুচিবোধ এবং বিশ্বাসের সীমারেখা কী ধরনে অঙ্কিত হয়েছে বুঝতে রহস্যের মতো মনে হয়। কাগজ গুলির ধ্যান-ধারণা এই পাঠকদের ওপরেই নির্ভরশীল।

উদয়শঙ্কর হোটেল থেকে বেরিয়ে বিবাহ মন্ডপের দিকে এগিয়ে চলল।

হরগোবিন্দ ডেকা উদয় শংকরকে বাড়ির সামনে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরল।

– তুমি আসবে বলে আমি নিশ্চিত ছিলাম।

উদয়শঙ্কর কী বলবে ভেবে না পেয়ে মানুষটার কথায় সায় দিল।

– না আসার কোনো কথাই নেই কাকা। আপনার ছেলের বিয়ে আমি না এলে কীভাবে হবে।

–তা তো ঠিকই। আসবে নাই বা কেন। চল চল।

মানুষটা উদয়শংকরের হাত ধরে একপ্রকার টেনে নিয়ে যাবার মতো ভেতরে নিয়ে গেল।

নিজের মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে হরগোবিন্দ  একপ্রকার চিৎকার করে উঠলেন– এই দেখ কে এসেছে? বাবাকে ডাক তো। বাবাকে।

সামনে উদয় শংকরকে দেখে মানুষটা  উৎফুল্ল  হওয়ার মতো জিজ্ঞেস করল– কখন এসেছেন? ভালো আছেন তো?

মাতৃসুলভ মমতা এবং ইতঃস্তত বোধের সংমিশ্রিত রূপ দেখে উদয়শঙ্কর বলল– সোজাসুজি এখানে চলে এসেছি কাকিমা।

মহিলা এদিকে ওদিকে তাকিয়ে উদয়শঙ্করকে বলল– এদিকে এসো। বস। আমি বাবাকে ডেকে আনছি। ও তুমি আসবে কিনা জিজ্ঞেস করছিল। তোমার কাকু তোমার কথা বলে বলে ওকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে।

উদয়শংকর ভেতরের একটা ঘরে বসতে দিয়ে মানুষটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

– কীভাবে এলে? বাসে না  রেলে?

– রাতের রেলে।

– ঘুম হয়েছিল কি?

– হয়েছে কাকা।

– খাওয়া-দাওয়া?

–কাকা । সেটা  একটা কথা হল কি? কিছু একটা  পেলেই হল।

ছেলের হাত ধরে মা ঘরের ভেতর চলে এল। দীর্ঘ দেহী সুষম ছেলেটিকে দেখে উদয় শঙ্করের ভালো লেগে গেল। ছেলেটি যেন সত্যিকারের অর্থে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর লোক। ছোট করে ছাঁটা চুল। লাবণ্যময় দেহ। ঘরে ঢুকেই ছেলেটি দুই হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে উদয় শংকরের কাছে এল।

– এই আমাদের একমাত্র ছেলে জ্যোতিষ।

– হ‍্যাঁ, কাকিমা ।

– আপনি আসায় খুব ভালো লাগছে দাদা। অত্যন্ত সুখী হলাম। বাবা সুযোগ সুবিধা পেলেই আপনার কথা সব সময় বলে থাকেন। আপনি নাকি বিয়েতে আসবেনই।

উদয়শঙ্কর প্রতি নমস্কার জানিয়ে জ্যোতিষকে বলল– কাকু এত আন্তরিকতার সঙ্গে ডেকেছে যখন না আসার প্রশ্নই উঠেনা।

বরের আন্তরিকতা দেখে পুলকিত মনে উদয়শঙ্কর বলল।

– আপনি একটু বসুন। আমি এখনই আসছি।

জ্যোতিষ বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাবার পরে মা উদয় শঙ্করকে জিজ্ঞেস করল– তুমি দই চিড়া দিয়ে জলখাবার খাও তো?

– লাগবে না কাকিমা।

– কেন খাবেনা?

– এখন আমার একদমই ক্ষুধা নেই। একটু দেরিতে কাকিমা।

হরিণের দোকানে পুরি চা খেয়ে আসার কথা বলতে উদয় শঙ্করের ইচ্ছা হল না।

– বস তো বস, খাব না বললে তো হবেনা। দই চিড়া না খেলে নেই। কিছু একটা তো খেতে হবে।

কিছুক্ষণ পরে কাকিমা নিজের হাতে চা মিষ্টি এনে এবং দুটো পুরি উদয়শংকরের সামনের টেবিলে রেখে বলল– চা খাও।

উদয়শঙ্কর সায় দিয়ে প্লেটটা হাতে তুলে নিল ।

– তোমাকে চা দিয়েছে তো?

কাকু উদয়শংকরের বসে থাকা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলের উপর রেখে উদয়শঙ্কর বলল–

– হ‍্যাঁ,দিয়েছে কাকা।

বিয়ের ব্যস্ততার মধ্যে হরগোবিন্দ ডেকা দেখানো উৎসাহ দেখে উদয়শঙ্কর ভাবল– বিয়েতে না এলে কথাটা খারাপ দেখাতো।

–তোমার বিশ্রাম নেবার জন্য একটা ঘর ঠিক করে রাখা আছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পার। এটা তোমার ঘর, লজ্জা করার কিছু নেই।

– না কাকা। এখন আর বিশ্রাম নেবার অবসর নেই। আমি  একবার গিয়ে পুরোহিত শর্মা এবং বাপুটির সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে। সুনন্দকে আমি বিয়েতে আসব বলে জানিয়ে রেখেছি, তার সঙ্গে গিয়ে একবার দেখা করি। 

– যাও তাহলে, তাড়াতাড়ি এসো। তোমাকে একটু দেখাশোনা করতে হবে। মনে রাখবে।

উদয়শংকর ভাঙরা গোসাঁইর থানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেল।

উদয়শংকরকে নামঘরের বারান্দার জবা এবং ধুতরা ফুল গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাপুটি  প্রায় লাফিয়ে উঠল।

– আপনি? কখন এসেছেন? সেই যে গেলেন তো গেলেনই। এসে থাকার কোনো নামগন্ধ নেই।

– এটাই তো খারাপ লাগছে। যাবার সময় তোমাদের দুজনকে বলেও যেতে পারলাম না। তোমরা সবাই ভালো আছো তো?

–কোথায় আর ভালো। আমার বড় ছেলের অসুখ আর ছাড়ছে না।

– কী হয়েছে তার?বয়স কত?

– বয়সের  হিসেবে– বাপুটি কিছু সময় ভেবে নিয়ে বলল– এই চৈত্র মাসে দশ পার হয়ে এগারোতে পা রাখবে। তার মাঝে মধ্যেই শরীর খারাপ করে। একদিন যদি জ্বর, পরের দুদিন পেট খারাপ। ওকে নিয়ে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে।

– না, না। ধৈর্য ধরতেই হবে। চিকিৎসক কী বলেছে?

– ডাক্তার বলেছে তার কোনো অসুখ-বিসুখ নেই। পুরোহিত শর্মার বাড়ির কাছে একজন কবিরাজ আছে। বনৌষধ দেয়। মাঝেমধ্যে  ঝাড়ফুঁক ও করে। তাকে দেখিয়েছিলাম, তিনি বলেছেন মাঝেমধ্যে শক্তিশালী ভূতও ভর করে। বয়স কম হলেও শিশুও কুখ্যাত।

-- না, না সে সবকিছু নয়।

–-ইস। আপনি ওর সব কথা ফু দিয়ে উড়িয়ে দেন।

– না বাপুটি। কথাটা সেরকম নয়। আজকাল চিকিৎসাপদ্ধতি অনেক উন্নত হয়েছে। তুমি ভালো ডাক্তার দেখালে ছেলে দুদিনে সুস্থ হয়ে উঠবে। আচ্ছা, তুমি ছেলেটিকে কৃমির ঔষধ খাইয়েছ কি?

– ঔষধ খাওয়াইনি। কিন্তু কবিরাজও তিতো চিরতার জল খাওয়াতে বলেছিল। ছেলে আর কোথায় খায়।একটু  খেয়েই বমি করে দিয়েছে ।

তুমি ছেলেটিকে কৃমির ওষুধ খাওয়াও। নলবারী শহরে গিয়ে সেখানকার একটি ভালো ফার্মেসিতে একজন ফার্মাসিস্টকে বলবে কৃমির ঔষধ দেবার জন্য। আমার মনে হয় তোমার ছেলে শীঘ্রই ভালো হয়ে যাবে। শুধুমাত্র ঝাড়ফুঁক করতে থাকলে হবে না কিন্তু, অসুখ ভালো হওয়ার চেয়ে খারাপই হবে।

বাপুটি ইচ্ছাকৃতভাবে না কি অনিচ্ছাকৃতভাবে মাথা নাড়াল উদয়শঙ্কর তা বুঝতে পারল না। মাঠের পথ ধরে আসতে থাকা সুনন্দকে দেখে সে সেদিকে চোখ ঘুরিয়ে বাপুটিকে জিজ্ঞেস করল–

– পুরোহিত শর্মা?

– এসেছে এসেছে, পুজোয় বসেছে।

– তিনি ভালো আছেন তো?

– তার আবার ভালো হবে না। আজকাল অবসরই পায় না। একটি ছেড়ে আরেকটি পুজো। আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে হলেই তার বিরক্তি, জ্বর এসে যায়।

– মানুষটা  তোমাকে পছন্দ করে না নাকি?

– অপছন্দ কেন করবে।তা বলে ভালো ও বাসে না।ছেলে দুটির জন্য বুট মুগ একটু বেশি নিতে চাইলেই চেঁচামেচি করে।

ডান হাতটা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুনন্দের ডানহাতটা দুই হাতে খামচে ধরল উদয়শংকর। উদয়শঙ্কর সুনন্দের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাপুটি দূরে সরে গেল।

– সুনন্দ ভালোই আছ?

-- দাদা, কোনোমতে আছি।

– কেন এভাবে বললেন? কোনো অসুখ-বিসুখ। স্ত্রীর শরীর খারাপ নাকি।

– না,না অসুখ বিসুখ নয়। সংসার  পরীক্ষায় আমরা দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ ছাত্র। তাই, জানো তো সবকিছুতে জোড়াতালি না দিলে চলে না। 

সুনন্দের মুখের কোনো এক জায়গায় উদয়শংকর যেন  হতাশার ছাপ দেখতে পেল।

পুরোহিত  শর্মাও কি জানি মন্দিরের ভেতর থেকে ওদের কথোপকথন শুনছিল। দুই হাত মুছতে  মুছতে তিনি নামঘরের ভেতর দিয়ে ওদের কাছে এগিয়ে এলেন।

– কখন এসেছেন?

– এই কিছুক্ষণ আগে। হরগোবিন্দ ডেকার ছেলে জ্যোতিষের বিয়ে।– সেই উদ্দেশ্যেই এখানে সোজাসুজি চলে এসেছি। গতবার যাবার সময় আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যেতে পারিনি। মন খারাপ করেছিল।

– সুনন্দ বলেছে। আপনাকে নাকি অফিস থেকে তখনই ডেকে পাঠিয়েছিল।

– হ্যাঁ। সেই জন্যই কাকার ছেলের বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়ে আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হারাতে চাইলাম না।

– ভালোই করেছেন। আমারও আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই লাগল। আপনি এবার ঠান্ডা পড়লে আবার আসবেন?

– হ্যাঁ আসব। আসব।

– আপনি এই বাড়িতেই থাকবেন?

পুরোহিত শর্মাকে আমার কাছে আসতে দেখে বাপুটি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। সেও আমার কথায় অংশগ্রহণ করার জন্য পর্যটন নিবাসের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল।

– হ্যাঁ।

উদয়শঙ্কর বাপুটির মতো বলতে চেষ্টা করল।

– এই বাপুটি আমার কথা আপনাকে কিছু খারাপ ভাবে বলল নাকি?

বাপুটির মুখের দিকে তাকাল উদয়শংকর।

– আপনার সম্পর্কে  খারাপ কথা বলার জন্য আমাকে  কি কেউ মাথার দিব্যি দিয়েছে। আপনিও যে  কীসব জিজ্ঞেস করেন।

– কারো সঙ্গে দেখা হলেই যে আমার সম্পর্কে  খারাপ কথা বল সেই অভ্যাসটা একদিনেেই  ছেড়ে গেল নাকি।

– সেরকম কোনো কথা বলিনি–

দুজনেরই বাকবিতণ্ডার সমাপ্তি ঘটানোর জন্য উদয় শঙ্কর সেভাবেই কথা শেষ করল।

– আপনি বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলেন?

আলোচনার বিষয় পরিবর্তন করার জন্য সুনন্দ উদয়শঙ্কর কে জিজ্ঞেস করল।

– হ্যাঁ গিয়েছিলাম। দেখা করেই সোজাসুজি এখানে  এসেছি। আমার মন এবং মস্তিষ্ক এই জায়গায় আবিষ্ট হয়ে আছে যে সেই জন্য, তার মধ্যে আবার গতবার যাবার সময় দুজনের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি।

– আসুন।বসে কথা বলি।

পুরোহিত শর্মা দুজনকে ভোগ রান্না করার ঘরের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল।

– বাপুটি।

বাপুটি  কিছু না বলে সোজাসুজি ভোগ রান্না ঘরে গিয়ে তিনটি চেয়ার একটি পুরোনো কাপড় দিয়ে মুছে তিনজনের দিকে এগিয়ে দিল।

তিনজনই বসল। কথা শুরু করার আগে পুরোহিত শর্মা বাপুটিকে বলল–

পাত্রটাতে  প্রসাদ আছে, দুজনকে দিনতো। উপকরণ টুকু কলাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা আছে। সেখান থেকে আনবে।

বাপুটি দ্রুত মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেল।

– আপনি হাত-পা ধুবেন নাকি?

পুরোহিত শর্মার ভাবভঙ্গি বোঝার জন্য উদয় শঙ্করের তিলমাত্র সময়ও লাগল না। উদয়শঙ্কর বুঝতে পারল যে প্রসাদ খাওয়ার আগে হাত পা ধুয়ে নেওয়াটা পুরোহিত শর্মা চাইছেন।

উদয়শঙ্করের পেছন পেছন সুনন্দ ও এগিয়ে গেল।

– সুনন্দ, গাছ পাতাগুলি বেশ ভালোভাবে সবুজ হয়ে উঠেছে না কি? গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে পুকুরের জলও বেশ ভালো ভাবে বেড়ে গেছে। চারপাশে পাখপাখালির আকুল আপ্লুত কণ্ঠস্বর।

– এটা যে বসন্তকাল।

পাখপাখালির সহবাসের সময় এটা। মানুষও বোধহয় সেই জন্যই এই সময় সংসার পাতে।

মেঘলা আকাশ। বাপুটি দিয়ে যাওয়া প্রসাদের বুট দুই-একটি করে মুখে ঢুকিয়ে কথা শুরু করেছে মাত্র, পূব দিগন্ত থেকে ছুটে  আসা মেঘ চারপাশঘিরে ধরল। দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত মেঘের উথাল পাথাল। দিনের বেলাতেই দশদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে বইতে  থাকা বাতাসের তীব্রতা ক্রমশ অধিক হতে লাগল। সামনের গাছপালাগুলি সেই বাতাসে আলোড়িত হতে লাগল।

– আবহাওয়া কী রকম হয়ে গেল দেখছি!

পুরোহিত শর্মা নিজের মনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন।

– বৈশাখী আবহাওয়া। প্রকৃতির এটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। আমাদের কেবল এর আমেজ নিতে হবে। উদয়শঙ্কর বিদ্যুৎ ঝঞ্ঝা  আবহাওয়ার পুরোহিত শর্মার  মনে ভয় ভয় ভাব দেখে এভাবে বলল।

তুলা রাশির মানুষ যে, তুফান এলে একটু ভয় লাগে। লাগবেই তো।

চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া বিদ্যুৎ এবং কানে তালা ধরা গর্জনের শব্দে পুরোহিত শর্মা হেলে পড়লেন।

– হাউ, আপনি কেমন করছেন দেখছি। আপনার এই রূপ আমি আগে কখন ও দেখিনি।

– না, কিছু হবে না।

পুরোহিত শর্মাকে সান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সুনন্দ বলল।

আকাশ ফেটে যাওয়া বিদ্যুৎ এবং প্রচণ্ড গর্জনে অন্য একটি শব্দ পুনরায় চারপাশ আলোকিত করে তুলল। পুরোহিত শর্মা  দেওয়ালের কাছে চেপে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালেন।

-- আজ আর রক্ষা নেই। ভগবানের নাম নিন, ভগবানের নাম নিন।

পুরোহিত শর্মার অবস্থা দেখে বাপুটি মনের আনন্দ এভাবে প্রকাশ করল যাতে তার সেই আনন্দ পুরোহিত শর্মার কাছে তাচ্ছিল্য হয়ে পড়ে।

মনে হচ্ছে এটা কোথাও সামনেই পড়েছে। হয়তো জঙ্গলের মধ্যে। একটা পোড়া  গন্ধ ভেসে আসছে না। উদয় শংকর জঙ্গলের দিকে  আঙ্গুল দেখিয়ে বলল। তুফান বিদ্যুৎ গর্জনের সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে লাগল। মাঝেমধ্যে দুই-একটা শিলাবৃষ্টি হল। টিনের চালে শিলা বৃষ্টির শব্দ চারপাশে ছাপিয়ে গেল। পুরোহিত শর্মা চেয়ারটা বেড়ার কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে তাতেই জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়ল। বাবুটি পুরোহিত শর্মার  একান্ত বিশ্বস্ত অনুচরের মতো পাশে দাড়িয়ে রইল। সুনন্দ এবং উদয়শংকর বৃষ্টির লাস‍্যময়তার  মজা নিতে লাগল। মাঝেমধ্যে সোঁ সোঁ করে বয়ে যাওয়া বাতাসের সঙ্গে ছিটকে আসা জলের কণার জন্য দু'জনকেই পিছিয়ে আসতে হল। বৃষ্টির ঝাপটা কমে এলে আবার এগিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে আকাশে অঙ্কিত বিদ্যুতের বাগিচা দেখে দুজনেই আপ্লুত হয়। পুরোহিত শর্মা দুই হাতে কান দুটো ঢেকে মাথাটা নিচের দিকে নামিয়ে বসে যায়। উদয়শঙ্কর লক্ষ্য করেছে শর্মা  মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে কোনো মন্ত্র উচ্চারণ করছে। হয়তো– পার কর রঘুনাথ এই সংসার সাগরে। বাপুটির কোনো ঔৎসুক‍্য  নেই।

মুষলধারে বৃষ্টির দাপটটা  আস্তে আস্তে কমে এল। বৃষ্টির ঝাপটা ঘরের চালের শব্দ ছড়িয়ে দিয়ে দূর-দূরান্তে চলে গেল। রিমঝিম শব্দ উদয়শংকর এবং সুনন্দকে আপ‍্যায়িত করছে। উদয় শঙ্করের এমন মনে হচ্ছে যেন সে দুই হাত মেলে খোলা জায়গায় বেরিয়ে গিয়ে বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরবে ।

পালিয়ে যাওয়া বৃষ্টির ঝাট আকাশকে পরিস্কার হওয়ার সুযোগ করে দিল। শর্মা এখন শান্ত হয়ে পড়েছে।

– কোনমতে রক্ষা পাওয়া গেছে। পুরোহিত কৈলাস শর্মার গাল মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল।

–কী কথা বলছ হে, আমিই জানি। 

– দেবতা, এত ভয় খাবার কী আছে। এটাও ভগবানের সৃষ্টি। নয় কি?

সুনন্দের প্রশ্নের সূত্র ধরে উদয়শংকর উত্তরে বলল– না, সুনন্দ, প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি। প্রকৃতিকে তুমি কীভাবে দেখ, কীভাবে গ্রহণ কর সেটা তোমার ওপর নির্ভর করে। তুফান, গর্জনের এইরূপ মনোরম নয় কি? তুমি সহজ সুন্দর ভাবে নিলে  সহজ, ভয় পেলে ভয়,ঝোপেও বাঘ থাকে, ছায়াতেও ভূত  থাকে। প্রকৃতির সৃষ্টি রাজিকে অনিষ্ট না করে যতটা সম্ভব প্রকৃতিকে  উপভোগ করতে শিখ।

সুনন্দকে নিয়ে উদয়শংকর কয়েকটি শিমুল গাছের নিচে গিয়ে একবার দেখে আসতে চেয়েছিল। মুষলধারে বৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়াল। চারপাশ জলে উপচে পড়েছে।

পুরোহিত শর্মার যাবার সময় হয়েছে । বাপুটিও দ্রুত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে ।

–আপনাদের বিয়েতে ডেকেছে কি?

উদয়শঙ্কর বলার আগেই বাপুটি দ্রুত বলে উঠল– ডেকেছে ডেকেছে। আমাদের ডাকবে না। এই অঞ্চলে যত বিয়ে-সাদি এবং উৎসব-পার্বণ হয় আমাদের ডাকেই।ভুলে গেছে বোধহয় না হলে –

পুরোহিত শর্মা বাপুটির দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাতেই বাপুটি মাঝখানে থেমে গেল ।

সুনন্দ উদয়শংকরকে বিয়েবাড়ির পর্যন্ত এগিয়ে দিল।

– তুমি বিয়েতে আসবে কি?

আসব আসব। স্নানটান করে একটু দেরি করে ।

– সম্ভব হলে একটু তাড়াতাড়ি আসবে। একা থাকতে ভালো লাগে না যে।

– তাহলে আমি স্নান করেই চলে আসব।

বিবাহ বাসরে ঢুকেই উদয় শংকর  প্রথমে কাকিমার মুখোমুখি হল। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন–এত জোর বৃষ্টি হয়ে গেল, তুমি কোথায় ছিলে?

– আমি থানে গিয়েছিলাম। পুরোহিত শর্মার সঙ্গে দেখা করার জন্য। সঙ্গে সুনন্দ ও ছিল। বৃষ্টি আপনাদের অসুবিধায় ফেলেনিতো!ভেতরের  একটা ঘরে এগিয়ে যেতে যেতে উদয় শঙ্কর কাকিমাকে জিজ্ঞেস করল।

–সে ধরনের কোনো অসুবিধা হয়নি। বৃষ্টির ভয়ে মন্ডপ বড় করে করা হয়েছিল। তুমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে চাইলে এই ঘরে নিতে পার। কিছুক্ষণ পরে ভাত দেবে। তুমি ভাতটা খেয়ে নাও। গ্রামের মানুষ দেরি করে খায় না, তার মধ্যে আবার বৃষ্টি হয়েছে– দুটো কারণেই ভাত দিতে দেরি হল।

কাকিমার কথা শুনে উদয়শঙ্করের এরকম মনে হল যে সেই একমাত্র বিয়ের বিশিষ্ট অতিথি।

ঘরের ভেতরে বিছানাটা  দেখে উদয়শঙ্করের একবার গড়িয়ে নিতে ইচ্ছা করল। কিন্তু এখন বিছানায় পড়া মানেই ঘুমোনো। বিয়ে বাড়ি এসে ঘুমিয়ে থাকলে লোকে কী বলবে। তবু কাকিমার আগ্রহকে সম্মান জানিয়ে সে ঘরটিতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার কথা ভাবল। ঘরটা খুব বেশি বড় নয়। একটা দরজা, একটা জানালা, একটা বিছানা, একটা টেবিল এবং একটি চেয়ার। টেবিলটাতে কয়েকটি বই সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। বইয়ের তাকটাতে  হাত দিতে গিয়ে উদয় শঙ্করের কানে এল একটা পরিচিত পাখির ডাক। ডাক না বলে শিষধ্বনি বলাই যুক্তিসংগত । শিষধ্বনিটা  শোনেই পাখিটা  ঝাপটাতে থাকা ডানার কথা তার মনে পড়ল ।

হ্যাঁ । তার অনুমান ঠিকই । পাখিটাকে নাচনি পাখি বলা হয়ে থাকে । ইংরেজিতে হোয়াইট থ্রোটেড ফেনটেইল। রিপিডুরা এলবিকলিচ। অত্যন্ত চঞ্চল পাখি, একটুও সুস্থির থাকতে জানে না। পাখিটার থুতনি সাদা। চোখের উপরে একটা সাদা দাগ আছে। জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া একটা পনিয়ল গাছের ডালে লেজের দিকের ডানা গুলি পাখার মতো মেলেদিয়ে  পাখিটা অস্থিরভাবে একডাল থেকে অন্য ডালে নেচে বেড়াচ্ছে । গাছটাতে সে একটা ফেনটেইল দেখতে পেল। 

সাধারণত জোড় না ভাঙ্গা এই পাখি অন্য একটি পাখিকে উদয়শংকর খুঁজে বেড়াতে লাগল। পৃথ্বী তার কিছুটা সময় লাগল। পাখিটা শিষধ্বনির সাহায্যে তার অবস্থিতি উদয়শংকরকে জানিয়ে দিল।

সুন্দর এবং ছোট একটি বাটির আকৃতির বাসার উপরে পাখিটা বসে আছে। পাখিটা তা দিচ্ছে । উদয়শঙ্কর পলক না ফেলে পাখিটার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট্ট একটি ডালের উপরে তৈরি বাসাটা বাতাসে দুলছে । একই ধ্যানে বসে থাকা পাখিটা মাঝেমধ্যে শিস দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে পুরুষ পাখিটার সঙ্গ লাভ করার জন্য স্ত্রী পাখিটা বাসা থেকে উড়ে গিয়ে পুনরায় চঞ্চলমতি হয়ে ডালে ডালে ঘুরে বেড়াতে দেখল উদয়শংকর। পাখিটা দুই একটা পোকা ধরে খাবার চেষ্টা করছে । পুরুষ পাখিটিও নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে লেজ নেড়ে  নেড়ে আপন ভোলা হয়ে সংসার ধর্ম পালন করার চেষ্টা করছে। উদয়শঙ্কর এই চঞ্চল জোড়া পাখিকে আগে দেখে ছিল যদিও সাংসারিক অবস্থায় দেখেনি। কুমোরের সাঁচে  তৈরি মাটির ঢুপি একটার মতো বাসাটা। একটা আধ লিটার জলের বোতলের একেবারে সামনের দিকটার মতো। বাসাটা  কীভাবে তৈরি করেছে। গাছের পাতার সুতো দিয়ে । তারমধ্যে মুখের লালা দিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়েছে । গাঁথুনি এত শক্তিশালী যে  শিলা বৃষ্টির তুফান বাসাটির কোনো ধরনের ক্ষতি ঘটাতে পারেনি। 

স্ত্রী পাখিটা এসে পুনরায় বাসাটাতে বসল। পুরুষ পাখিটা উদয় শংকরের চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য  হয়ে গেল।

উদয়শঙ্কর একইভাবে ধ্যানরত অবস্থায় স্ত্রী পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইল।

পাখিটা কিছুক্ষণ পরে থেমে থেমে শিস দিতে লাগল। সম্ভবত পুরুষ পাখিটির সঙ্গে শিসের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে।

– উদয় দা, এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন?

সুনন্দ ঘরের ভেতরে এসে একান্তমনে পাখিটাকে নিরীক্ষণ করতে থাকা উদয়শঙ্করকে জিজ্ঞেস করল।

– এসো, তুমিও দেখো।

উদয়শঙ্কর বাসায় বসে তা দিতে থাকা নাচনি পাখিটাকে দেখিয়ে দেওয়ায় সুনন্দ দৌড়ে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল।

– এভাবে দৌড়ে যাচ্ছ কেন? পাখিটা ভয় পেয়ে যাবে। উদয়শঙ্করের সাবধান বাণীতে সুনন্দ  সাবধান হল।

– কী পাখি এটা?

উদয়শঙ্কর সুনন্দের এই প্রশ্নের জন্যই যেন  অপেক্ষা করছিল। পাখির ওপরে ক্লাস নেওয়া  একজন শিক্ষকের মতো উদয়শঙ্কর পাখির বিষয়ে সুনন্দকে  জ্ঞান দিতে আরম্ভ করল।

মাঝখানে কেউ একজন দু'জনকেই ভাত খেতে ডাকতে এসেছিল যদিও উদয়শঙ্কর এবং সুনন্দের বার্তালাপে যতি পড়ল  না। প্রতিদিন বিভিন্ন পাখি সুনন্দ দেখে আসছে যদিও  পাখি দেখার ও যে  মজা আছে  আজই সুনন্দ উপলব্ধি করল।

–পাখির প্রতি তোমার আগ্রহ জন্মেছে যদি সামনের বার আমি যখন আসব তোমার জন্য একটি বই নিয়ে আসব। সৌম‍্যদার লেখা' অসমের পাখি পর্যবেক্ষনের হাতপুস্তক।' সেটাতে পাখিদের রঙ্গিন আলোকচিত্র স্থানীয় নাম, ইংরেজি নাম এবং বৈজ্ঞানিক নাম সন্নিবিষ্ট করা ছাড়াও নির্দিষ্ট পাখির উপরে ন্যূনতম বর্ণনা দেওয়া আছে। তার সাহায্যে অতি সহজে একটা পাখিকে শনাক্ত করা যায়। তুমিও পারবে।

–-আনবে, আনবে। ভুলে যাবে না কিন্তু।

উদয়শংকর সুনন্দকে দিয়ে যাওয়া পাখি বিষয়ক তথ্যাদি তাকে আনন্দ দিয়েছে ।সৌম্যদার সঙ্গে দেখা হওয়ার দিন উদয়শঙ্করের মনে প্রশ্ন জেগেছিল পাখিকে আবার দেখার কি আছে, ঠিক তেমনি ভাবে হয়তো আজ সুনন্দেরও মনে ও একই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পাখি কীভাবে অধ্যায়নের বিষয় হতে পারে উদয়শঙ্কর সুনন্দকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিল। উদয়শঙ্কর কীভাবে পাখির সান্নিধ্যে এসেছে তা সুনন্দকে  জানানোর আগে বলল– চল। আমরা ভাত খেয়ে আসি। পেট সন্তুষ্ট হলে মন সন্তুষ্ট হয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা বলে নাই কি – প্রথমে ভাত কথা তারপরে হরি কথা।

ভাত খেয়ে আসার পরে সুনন্দ উৎসাহ বাড়ানোর জন্য উদয়শংকর সৌম্যদার সঙ্গে দেখা হওয়ার আদ্যোপান্ত কাহিনি বর্ণনা করল। বলল নামচাঙের অন্তেষপুরের  মনোরম অভিজ্ঞতার কথা। বলল প্রকৃতির সান্নিধ্য মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিতে পারে ।

সুনন্দ রূপকথা শোনার মতো একান্ত মনে শুনে গেল প্রকৃতির সবুজ কাহিনী। সময় কীভাবে পার হয়ে গেল সুনন্দ বুঝতেই পারল না । বিয়ের হৈচৈও তাদের টলাতে পারেনি।

– তোমার স্ত্রী তোমার সঙ্গে বিয়েতে আসার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে না কি?

– না,থাকবে না । সে ইতিমধ্যে মায়ের সঙ্গে এসে গেছে।

উদয়শঙ্কর মাথা নেড়ে সুনন্দের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল – তাহলে তোমার দায়িত্ব নেই।

– নেই উদয়দা ।

মাঝেমধ্যে দুজনেই নাচনী পাখিটার বাসার দিকে তাকিয়ে  দেখে । শিস দিতে দিতে পাখিটা বুকের উষ্ণতায় ডিমগুলিতে তা দিচ্ছে।

– কাছের মানুষ, মিলেমিশে কিছু কাজকর্ম না করে দিলে খারাপ হবে না কি উদয় দা ।

–সত্যিই ,চল চল।

উদয়শঙ্কর এবং সুনন্দ হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করে দেবার জন্য খাবারের জায়গায় উপস্থিত হল। কাকু ওদের দেখে উপদেশ দেওয়ার সুরে বলল– এখন খাবার দেবার লোকের অভাব নেই। তোমরা দুজন সন্ধ্যেবেলাটা একটু দেখে শুনে নিও।

সন্ধ্যের দিকে অতিথির ভিড় হালকা হওয়ার সময় উদয়শঙ্কর বরের সঙ্গে যাবার সঙ্গীর খোঁজে সুনন্দকে জিজ্ঞেস করল।

– তুমি ছেলের সঙ্গে কনের বাড়িতে যাবে কি?

– যেতে হবে। না হলে কাকু  খারাপ পাবে। আপনি আমাকে বারবার বলেছেন। জ্যোতিষ এবং আমি সমবয়সী। সেও বলেছে। তাই আমি যাব। আপনি?

–যাব। কনের বাড়ি থেকে আমি সোজাসুজি তিনসুকিয়া যাব। 

– রাতেরবেলা কীভাবে যাবে?

– সুনন্দ, কনের ঘর রহাতে নয়  কি?

– হ্যাঁ। কাকা আমাকে রহাতেই বলেছে‌।

– বর কনে নিয়ে আসা বাসটা  জাগীরোড এলে নেমে যাব এবং তিনসুকিয়া যাওয়া প্রথম ভলভো বাসটাতে চলে যাব। 

– লাগবে না। একদিন থেকে যাবে। কনে দেখে যাবেন আবার।

– সম্ভব হবেনা সুনন্দ। একটু দেরি হলেও আমাকে ব্যাংকে পৌঁছাতে হবে।

– আপনার ব্যস্ততা থাকলে অবশ্য সম্ভব হবে না!

বরপক্ষের যাত্রী হিসেবে সুনন্দ উদয়শংকরকে সঙ্গ দিল।

কনের বাড়িতে বিয়ের ব্যস্ততার মধ্যে উদয়শঙ্কর এবং সুনন্দ ভেতরে গিয়ে কনের সঙ্গে কথা বলে এল। উদয়শঙ্কর পাটের কাপড় উপহার দিয়ে কনেকে বলল– শুভেচ্ছা জানালাম। কুশলে থেকো।

কনে মুচকি হেসে হাতে থাকা পান-সুপারির বাটাটা ওদের দুজনের দিকে এগিয়ে দিল। তা থেকে এক টুকরো সুপারি হাতে নিয়ে উদয়শঙ্কর বলল– পরে  ভালোভাবে পরিচিত হব, আজ কেবল এতোটুকুই জানিয়ে রাখি, আমি জ্যোতিষের পরিবারের অতি আপনজন।

উদয়শঙ্কর হোমের গুড়িতে কনে বসার পরে জ্যোতিষকেও উপহার হিসেবে পাটের কাপড় দিল। তখন বিয়ের অনুষ্ঠান তুঙ্গে। হোমের ধোঁয়ার গন্ধ  চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিয়ে বাড়িতে সবার মনেই বিয়ে বাড়ির আনন্দ এবং ব্যস্ততা।

ফেরার পথে কাকু এবং অন্যান্য সবাইকে বলে উদয়শঙ্কর জাগিরোডে  নেমে পড়ল। জ্যোতিষ এবং কনে অন্য একটি গাড়িতে করে আসছে। গাড়িটা কিছুটা দূরে রয়েছে বলে উদয়শঙ্করের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বিদায় জানাল।

সুনন্দকে বিদায় জানিয়ে উদয়শঙ্করের একেবারে নিজেকে নিঃসঙ্গ বলে মনে হতে লাগল।





     















 





 








 










কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...