বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০২২

হে আমার স্বদেশ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস He amar swadesh

 

 হে আমার স্বদেশ

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস




  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।



(দুই)

বাবাকে প্রনাম করে মাকে প্রণাম করব, মায়ের অশ্রুসজল চোখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথের চোখদুটি ভিজে উঠল। এভাবেই মাকে প্রণাম করল, বড় এবং মেজ বৌদি দু'জনকে প্রণাম করল, বড়দাদাদের   প্রণাম করল। তারপর বিদায় জানাতে আসা প্রতিবেশীদের, গুরুজনদের প্রণাম করার সময় লক্ষ্মীনাথের মনে পড়ে গেল বড় মায়ের কথা। এখন বড়মা এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু নিজের  মায়ের অশ্রু সজল মুখটিতে বড় মায়ের মুখটা দেখতে পেল । একইসঙ্গে মনে পড়ল তার সঙ্গে যাপন করা দিনগুলির মধুর  স্মৃতি।

আত্মীয়স্বজনদের ছেড়ে যেতে চলেছে। ছেড়ে যেতে চলেছে ঠাকুর ঘর, বাবার ঔষধালয়, বৈঠকখানা ঘর, অতিথিদের থাকা ঘর, বাড়ির সামনের সাজানো বাগান, মনের আনন্দে সাঁতার কেটে স্নান করা বাড়ির পেছনদিকের পুকুর, ঘোড়াশালা, বাড়ির পশ্চিম দিকে বয়ে যাওয়া চির প্রবাহিনী দিখৌ...। লক্ষ্মীনাথের আসন্ন বিদায়ে সবার মন নিথর । মেজদাদা গোবিন্দচন্দ্রের সঙ্গে ঘোড়ায় উঠে সবাইকে পিছনে রেখে লক্ষ্মীনাথ দিসাংমুখের দিকে এগিয়ে গেল। এতদিন কলকাতা যাওয়ার উত্তেজনা তাকে উৎসাহিত করে রেখেছিল। কিন্তু সবার কাছ থেকে বিদায় নেবার পরে মনটা যে এতটা ব‍্যথিত  হয়ে পড়বে অনুমান করতে পারিনি । আমলা পট্টি পার হয়ে শিবসাগর নগরের শিবদৌল, বিষ্ণু দৌল ,দেবী দৌলের সঙ্গে যখন সাগর সদৃশ বিশাল পুকুরের পাশ দিয়েই এগিয়ে গেল... তখন আর নিজেকে সামলাতে পারল  না। লক্ষ্মীনাথের  দুচোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এল। বাড়িতে প্রতিপালিত ভুটিয়া ঘোড়াটা বুড়ো হলেও শক্তিহীন হয়নি। তাছাড়া সহিসরূপে পিঠে বসেছে গোবিন্দচন্দ্র।আধঘণ্টার মধ্যেই দিসাংমুখে পৌঁছে গেল। ইতিমধ্যে গরুর গাড়িতে আনা বিছানাপত্র, টিনের সুটকেস, বৌদিদের দেওয়া খাবার জিনিস ইত্যাদি নিয়ে ধনী ঘাটের একচালা পান দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।ঘোড়ায় চড়ে গোবিন্দচন্দ্র এবং লক্ষ্মীনাথকে আসতে দেখেই ধনী সামনে এগিয়ে এল।

ঘাটে বাষ্প চালিত কয়েকটি জাহাজ অপেক্ষা করছে।আগে থেকে কলকাতা যাওয়া আসা করার অভিজ্ঞতা থাকায় এখন এই বর্ষাকালে দীর্ঘ যাত্রার জন্য কোন জাহাজটা নিরাপদ হবে, জাহাজে শোওয়া- বসার কেমন ব্যবস্থা, পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে কিনা, ইত্যাদি খোঁজখবর নিয়ে গোবিন্দচন্দ্র জাহাজ নির্বাচন করেছে।শেষে নতুন তৈরি জাহাজ একটির ইন্টার ক্লাসের কেবিন একটা খুঁজে নিয়ে দুজনে উঠল। ঘাটের কাছে একটা খুঁটিতে ঘোড়ার রশিটা বেঁধে নিয়ে ধনী জিনিসপত্র জাহাজে তুলতে লাগল। তীর থেকে জাহাজে উঠার জন্য দুটো  শক্ত কাঠ কেটে দেওয়া হয়েছে । জিনিসগুলো নিয়ে সেই তক্তা দিয়ে সাবধানে জাহাজের কেবিনে এনে ধনী সাজিয়ে রাখতে লাগল। সঙ্গে কেবিনে বসার জায়গায় কাপড় পেতে দিল। তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধনী বাড়িমুখো হল।

তখনই জাহাজ ছেড়ে দিল না। দূরপাল্লার যাত্রীরা আগেই চলে এল। কাছের নিমাতীঘাট, মাজুলী, জখলাবন্ধে যাত্রীদের দুই-একজন আসতে শুরু করেছে । যাত্রীরা বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের। অসমিয়া  ছাড়া মাড়োয়ারি, বাঙালি, বিহারী, চা বাগানের কুলি  এবং জনজাতীয় লোক।বিচিত্র সাজ পোশাক বিচিত্র আচার-আচরণ , আলাদা আলাদা ভাষায় কথা-বার্তা। অবশেষে ভোঁ ভো়ঁ শব্দ করে জাহাজের চালক যাত্রার ক্ষণ  ঘোষণা করলেন। জাহাজের কর্মচারী দুজন লঙ্গর তুলে দিল। ধীরে ধীরে তীর এবং জাহাজের মধ্যে ব‍্যবধান বেড়ে চলল। সঙ্গে সঙ্গে বিহারী এবং মাড়োয়ারিরা সমস্বরে জয়বাবা ব্রহ্মপুত্র কি জয়' বলে চিৎকার করে উঠল। বৃদ্ধ বাঙালি দম্পতি দুটো পয়সা জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাত জোড় করে ব্রহ্মপুত্রকে প্রণাম জানাল।

লক্ষ্মীনাথের  অন্তর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। কিন্তু পরের মুহূর্তে দু চোখের সামনে ভেসে উঠল অশ্রু প্লাবিত মায়ের মুখটি।

' লক্ষ্মী চুপ করে বসে আছিস, মন খারাপ লাগছে নাকি?'

লক্ষ্মীনাথ উত্তর দিল না। সে মাথা নিচু করে বসে ছিল। মেজদার ডাক শুনে উদাসভাবে উত্তর পাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

জাহাজ পুর্ণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। জৈষ্ঠ মাস শেষ হয়ে আসছে। ইতিমধ্যেই একবার বন্যা হয়ে গেছে। বন্যার জল কিছুটা কমে এলেও দূইপার পর্যন্ত পরিপূর্ণ জলরাশি নিয়ে প্রবল গতিতে নদী সাগরের দিকে ধাবিত হয়েই চলেছে।তার  জন্য ইঞ্জিনে টানা জাহাজটির  গতিবেগ বেড়েছে। এদিকে বর্ষাকাল যদিও আজ মাঝ আকাশে সূর্য। সূর্যের প্রখর কিরণ নদীটির অসংখ্য জলরাশির ঢেউয়ে প্রতিফলিত হয়ে  ঝলমল করছে। দুই তীরে চাষের জমি, মাঠে ঘুরে বেড়ানো গরু-ছাগল, সুপারি -নারকেল আম -জাম, বাঁশ বেতের ঝাড় , মাঝে মধ্যে মানুষের ঘরবাড়ি, সজীব চিত্রময় জনপদ– সবকিছুই লক্ষ্মীনাথের  পরিচিত। শৈশবে বাবা এই শহর থেকে অন্য শহরে বদলি হয়ে নৌকায় যাওয়া-আসা করার সময় এগুলির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। এগুলির সঙ্গে সুন্দর এই প্রকৃতির সঙ্গে , ছায়াশীতল নিবিড় গ্রামের বিচিত্র জনজীবনের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের ইতিমধ্যেই একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু আজ মা বাবা , আত্মীয়-স্বজন ঘরবাড়ি ছেড়ে আসার মতো ব্রহ্মপুত্রের দুইপারের পরিচিত এই প্রকৃতিকে ছেড়ে দূর দেশের কলকাতা শহরে যাচ্ছে।

লক্ষ্মীনাথকে  উত্তর দিতে না দেখে গোবিন্দচন্দ্র নিজেই বললেন,– খারাপ তো লাগবেই। প্রথমবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতায় যাওয়ার পথে আমারও একই অবস্থা হয়েছিল। যাই হোক, তোর ক্ষুধা পেয়েছে। বৌদি তিল পিঠা দিয়ে দিয়েছে। দুটো খা।'

' খাব না।'

' কেন?'

' খেতে ইচ্ছা করছে না।'

তবু গোবিন্দচন্দ্র পিঠের পুঁটলিটা  খুলে একরকম জোর করে লক্ষ্মীনাথের হাতে গুঁজে দিল।নিজেও  খেতে খেতে হেসে উঠল।

কপাল কুঁচকে লক্ষ্মীনাথ জিজ্ঞেস করল,' হাসছ যে!'

' একটা কথা মনে পড়ে গেল।' গোবিন্দচন্দ্র বললেন-' যখনই আমি নৌকা করে কোথাও যাই, তখনই এই কথাটা মনে পড়ে। আর তখনই বেশ উপভোগ করি।'

' কথাটা কী মেজদাদা?'

' তোর জন্মের কথা। তুই যে এই ব্রহ্মপুত্রের বুকে বালুচরে জন্মেছিস। নগাঁও থেকে বদলি হয়ে বাবা আমাদের সঙ্গে নিয়ে নৌকা করে বরপেটা যাচ্ছিলেন। সেদিন ছিল লক্ষ্মী পূর্ণিমা। আহতগুরি পৌছে বালুচরে নৌকা বাঁধা হল।কাপড় দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় ছোট-মা রান্না বসিয়েছেন। তখনই তার শরীর খারাপ লাগতে লাগল। রান্না ছেড়ে তিনি নৌকার ডুলিতে ঢুকে পড়লেন। তারপর সেখানেই তোর জন্ম হল।'

নিজের  সম্পর্কে এই বিশেষ কথাটা লক্ষ্মীনাথ জানে। আসলে, গর্ভাবস্থা অবস্থায় ঠানেশ্বরীকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা যাত্রা করার সময় যে এই ধরনের ঘটনা ঘটবে তা দীননাথ  বেজবরুয়া ভাবতেও পারেন নি। কিন্তু আকস্মিকভাবে হলেও উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে নিরাপদে জন্মগ্রহণ করে শিশু লক্ষ্মীনাথ ধরিত্রীর আলো-বাতাস দেখতে পেল এটা তাদের পরিবারের মহিলা মহলে প্রায়ই আলোচিত হয়। 

তাই জন্মের পরে উলুধ্বনি দেবার  মতো মহিলা ছিল না, শঙ্খ ঘন্টা বাজানোর সুবিধা ছিল না।' তিল পিঠা চিবোতে চিবোতে গোবিন্দচন্দ্র বললেন, কিন্তু শ্রীনাথ, তোকে জন্মাতে দেখে তার কী স্ফুর্তি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে চরের  বালিতে লাফিয়ে নেচেকুদে আজ থেকে আমরা পাঁচজন হলাম' বলে সে চিৎকার করছিল। 

জাহাজ এসে নিমাতীঘাট  পৌঁছাল। বেশ কিছু যাত্রী নেমে গেল। কয়েকজন উঠল। তাদের মধ্যে স্থানীয় যাত্রীরাই বেশি। যোরহাট  থেকে আসা তারা মাজুলী যাবে। লক্ষ্মীনাথ- গোবিন্দচন্দ্র দূরের অভিজাত যাত্রী। তাই তাদের বসার ব্যবস্থা সর্বসাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে নয় । ওপরের শ্রেণির যাত্রী  বলে বসার জায়গায় খুব একটা ভিড় নেই।

নিমাতীঘাট থেকে উঠা একজন যাত্রী নিচ থেকে ওপরে উঠে এসে গোবিন্দচন্দ্রের পাশে বসলেন। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা পঞ্চাশ  বছর অতিক্রম করা, পাকা চুল দাড়ির শান্ত সৌম্য স্বভাবের ভদ্রলোক।কাঁধে বাসন্তী রঙের কাপড়ের ব‍্যাগ। হাতে মাঝারি আকারের একটা টিনের স‍্যুটকেস। কিন্তু দীর্ঘ দেহী  সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী এই মহাশয়ের খালিপা । তাঁর মুখমন্ডলে বিরাজ করা নির্বিকার উদাস ভাব বুক পর্যন্ত বিস্তৃত দাড়ি এবং বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল দেখে লক্ষ্মীনাথ অনুমান করল, মহাশয় নিশ্চয় কোনো ধর্ম প্রচারক অথবা সমাজ সংস্কারক। কিন্তু তিনি নিজে কথা বলেননি । স্বাভিমানী লক্ষ্মীনাথ কিংবা গোবিন্দচন্দ্রও নীরবতা ভঙ্গ করেনি।

ইতিমধ্যে  সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। আকাশে হালকা মেঘ। বর্ষাকাল যদিও শরৎ কালের মতো মেঘগুলি  পেঁজা  তুলোর মতো আকাশের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে । তার উপরে সূর্যের কিরণ প্রতিফলিত হয়ে, সঙ্গে সূর্যের স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে মেঘের রং পরিবর্তিত হয়ে এক মনোমোহা  দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে । বসার জায়গায় কাত হয়ে পড়ে গোবিন্দ চন্দ্র নিদ্রায় বিভোর। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ পশ্চিমাকাশে সূর্যের আলো এবং রংয়ের অপূর্ব এই যাদু খেলা তন্ময় হয়ে দেখছে।

ইতিমধ্যে কয়েকটি চর অঞ্চল অতিক্রম করে এসেছে। তারপরেই লক্ষ্মীনাথ দেখতে পেল বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপ মাজুলীর একাংশ। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের  অন্তরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল। বাবা কমলাবাড়ি সত্রের গাছপালা দেখিয়ে বালক লক্ষ্মীনাথকে সেবা যত্ন করতে বলেছিল। এটা বাবার আতার (পিতামহ) থান (বৈষ্ণবদের বাসস্থান) । বাবার কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান।সেদিনের মতো আজও হাঁটু গেড়ে বসে লক্ষ্মীনাথ থানের উদ্দেশ্যে ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানাল।

লক্ষ্মীনাথকে এভাবে প্রণাম করতে দেখে পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক আকৃষ্ট হলেন।তারপর তিনি নিজেই নীরবতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাওয়া হচ্ছে, ভাই?'

লক্ষ্মীনাথের বিদ্যা শিক্ষা আরম্ভ হয়েছিল মদনমোহন তর্কালঙ্কারের বাংলা বর্ণ পরিচয় নামে বইটির মাধ্যমে। পরবর্তীকালে অসমিয়া মাধ্যমের  স্কুলে পড়াশোনা সমাপ্ত করলেও সে বাংলা ভাষা ভালো বুঝতে পারে। বাবা, দাদাদের আনা বাংলা বই পড়েছে। তাই খুব তাড়াতাড়ি না হলেও বাংলা বলতে পারে। তাছাড়া এখন কলকাতায় যেতে চলেছে, সেখানে বাংলা বলতেই হবে। তাই বাংলাতে উত্তর দিল,' কলকাতা।'

' নিশ্চয় বিশেষ কোনো কাজ?'

' উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য–।'

'বেশ, ভালো কথা। তা ভাই, বাড়ি অসমেই?'

' হ্যাঁ, অসমের শিবসাগরে।'

এভাবে কথাবার্তা বলতে শুনে গোবিন্দচন্দ্র জেগে উঠে মানুষটার দিকে তাকালেন। মহাশয় প্রসন্ন  হাসিতে গোবিন্দচন্দ্রকে আপ্যায়ন করলেন। দুজনের মধ্যে নমস্কার বিনিময় হল। গোবিন্দচন্দ্র কথকী। তিনি পরিষ্কার বাংলা বলতে পারেন। কথা বলার জন্য একজন মানুষকে সহযাত্রীরূপে পেয়ে তিনি খুশিই হলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের কথাবার্তা জমে উঠল।

ভদ্রলোক ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারক। নাম পন্ডিত বেদভূষণ বিদ্যারত্ন। বাড়ি বঙ্গের চন্দনপুর। গৃহস্থ জীবনযাপন করে চারটি পুত্রকন্যার পিতা রূপে তাদের শিক্ষাদীক্ষা দান করেছেন । তারপরে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের আহ্বানে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন এবং বর্তমানে তিনি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগী। কলকাতার ব্রাহ্মসমাজের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অর্পণ করা দায়িত্ব অনুসরণ করে বেদভূষণ বিদ্যারত্ন মহোদয় অসমের জেলায় জেলায় বক্তৃতা দিয়ে, প্রচার পুস্তিকা বিতরণ করে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করার জন্য সর্বসাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করেন । তার পরে তিনি হিন্দু ধর্মের  গোঁড়ামি যুগ যুগ ধরে চলে আসা অন্ধ সংস্কার- কুসংস্কার অনুদান ব্রাহ্মণরা পৃষ্ঠপোষকতা করা জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, বহুবিবাহ ইত্যাদির দ্বারা জর্জরিত হিন্দু সমাজ রসাতলে যাচ্ছে... এইসমস্ত কথা ক্রোধের সঙ্গে ব্যক্ত করলেন । অবশেষে উদাত্ত ভাষায় তিনি ব্যক্ত করলেন যে এই ভারতবর্ষেকে উদ্ধার করার জন্য আবির্ভাব হয়েছে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের। আজকের ভারতের শিক্ষিত সমাজ বিশেষ করে দেশের শিক্ষিত তরুণদের রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্ম আচরণ করে সমাজ সংস্কারমূলক কর্মে আত্মনিয়োগ করে দেশমাতার উন্নতি সাধন করা উচিত। 

তিনি লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে কথাগুলি বলছিলেন। হঠাৎ লক্ষ্মীনাথ ফিক করে হেসে ফেলল।এভাবে হাসাটা  নিতান্তই অশোভনীয় বলে তৎক্ষণাৎ সে মুখটা দুই হাতে ঢেকে নিজেকে সামলে নিল।

গোবিন্দচন্দ্র ভাইয়ের এই আচরণ দেখে অবাক হল। লক্ষ্মীনাথকে কিছুই জিজ্ঞেস না করে পরিবেশের গাম্ভীর্য রক্ষা করে তিনি বললেন' কিন্তু বিদ্যারত্ন মহাশয়, আমাদের ধারণা, আমাদের এই অসমে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার কার্যসূচী খুব একটা সুবিধার হবে না।'

' কেন?'

' এখানে শংকরদেব মাধবদেব প্রবর্তন করা বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি মানুষের আস্থাটা অনেক বেশি।' গোবিন্দচন্দ্র বললেন,' আপনি বোধহয় জানেন না, এক সময় অসমের স্কুল- আদালতে বাংলা ভাষা চালু ছিল। আমেরিকান মিশনারিরা আমাদের মানুষকে খ্রিস্টান করার জন্য অসমিয়া ভাষা শিখে অসমিয়া ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। তারপর অসমিয়া ভাষায় ' অরুণোদয়' বলে একটি ম্যাগাজিন চালু করেন। ইংরেজ হয়েও ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অসমে পুনরায় অসমিয়া ভাষা চালু করার জন্য ইংরেজ সরকারকে বাধ্য করেন। ওরা যে এত উপকার করলেন, তথাপি কিন্তু ইংরেজ পাদ্রীদের কথা শুনে অসমিয়ারা খ্রিস্টান হল না।'

' সেটা আলাদা কথা। হাজার উপকার করলেও খ্রিস্টানরা  বিদেশি । ওদের খ্রিস্টান ধর্মটাও  বিদেশি  ধর্ম। কিন্তু আমাদের এই ব্রাহ্ম দেশি ধর্ম । সনাতন হিন্দু ধর্মের পরিশোধিত রূপ। ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য নতুন প্রজন্মকে এই ধর্ম গ্রহণ করতেই হবে।'

বিদ্যারত্ন মহোদয় বললেন যদিও ভালো করে বুঝতে পারলেন যে এদের সামনে এভাবে বক্তৃতা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। সেখানেই আলোচনা সমাপ্ত করে তিনি উঠলেন এবং চা পানের উদ্দেশ্যে নিচে নেমে গেলেন ।

'তুই তখন কেন হেসে উঠেছিলি?' লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে ক্রোধের সুরে গোবিন্দচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন।

অবদমিত হাসিটা প্রকাশ করে এবার ভালোভাবে হেসে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' শিবসাগরে যে রামকুমার বিদ্যারত্ন নামে ব্রাহ্ম ধর্মের একজন প্রচারক এসেছিলেন, তোমার মনে আছে কি?' 

' না, মনে করতে পারছিনা।'

'ও, তুমি হয়তো তখন কলকাতায় ছিলে। রামকুমার বিদ্যারত্মকে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার করতে দেখে বাবা হিন্দু মহাসভা ডেকে সদস্যদের তার বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলেছিল। তার জন্য বিদ্যারত্নকে নিয়ে শিবসাগরে হুলুস্থুলের সৃষ্টি হয়েছিল। ধর্মের ক্ষেত্রে উদার আমাদের চন্দ্রমোহন গোস্বামী স্যার মজা দেখার জন্য বাবার সঙ্গে বুদ্ধি করে পন্ডিত তুলসী শর্মাকে হিন্দু শাস্ত্রের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করার জন্য নিযুক্ত করলেন। স্কুলে সভা বসল। তুলসী শর্মা লিখে আনা বক্তব্য তুলে ধরার পরেই রামকুমার বিদ্যারত্ন তুলসী শর্মার ব্যাখ্যাগুলির বিরুদ্ধে দুই হাত নেড়ে, চিৎকার করে করে, একই কথার নতুন নতুন অর্থ করে ফেনিয়ে  ফেনিয়ে বক্তৃতা দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলল।'

' তাতে হাসার কী হল?'

' হাসার কারণটা হলো যে তখন বিদ্যারত্মের   এই বক্তৃতা আমাকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে পরবর্তীকালে বহুদিন পর্যন্ত আমি আমার সঙ্গীদের সামনে, কখনো কেউ না থাকলে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বটগাছটার নিচে একাই দাঁড়িয়ে হাত পা নেড়ে , চিৎকার করে করে, একই বাক্যকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পৃথক পৃথক শব্দ ব্যবহার করে অনর্গল বক্তৃতা দিয়েছিলাম।'

এইবার গোবিন্দচন্দ্রও হাসলেন।

' তবে বেঙ্গলের শিক্ষিত এবং অভিজাত শ্রেণির অনেকেই কিন্তু এখন ব্রাহ্ম।' হাসি সামলে গোবিন্দচন্দ্র বললেন,' কিছু কিছু কথায় আমাদের শঙ্করদেবের সঙ্গে এই ব্রাহ্মদের ক্রিয়াকর্মের মিল  রয়েছে। ব্রাহ্মরা  জাতের বিচার করে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে না। সমস্ত জাতির মানুষ একসঙ্গে বসে একই পরম ব্রহ্মের উপাসনা করে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন রামমোহনের সঙ্গের মানুষ। তিনি ছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা বাঙালি।তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও ব্রাহ্ম। দেশীয় শাস্ত্রের সঙ্গে বিদেশি  শিক্ষা সংস্কৃতিতে  তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ।'

লক্ষ্মীনাথ ভাব বিভোর হয়ে পড়লেন । পুনরায় তার সামনে বাংলা সাহিত্য বঙ্গ সংস্কৃতি, বঙ্গের মনীষা এবং কলকাতাকেন্দ্রিক বঙ্গের সমৃদ্ধির কল্পিত দৃশ্যগুলি ভেসে উঠল।

' এই ,আপন হারা হয়ে পড়লি যে!' গোবিন্দচন্দ্র বলে উঠলেন,' কলকাতায় থাকবি যখন ওরা কিন্তু তোকে ব্রাহ্ম করার চেষ্টা করবে। তোরও ব্রাহ্ম হতে ইচ্ছা করছে নাকি?'

উত্তর না দিয়ে লক্ষ্মীনাথ মুচকি হাসল।

' সাবধানে থাকবি। ব্রাহ্ম হলে বাবা কিন্তু তোকে বাড়িতে ঢুকতে দেবেনা।'

মাজুলী ঘাটে নৌকা বেশিক্ষনের জন্য থামল না। গাছপালায় শ্যামল, বহু জাতি জনজাতি নিয়ে গড়ে ওঠা জনপদ, সত্রিয়া সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ বৈষ্ণবদের বৈকুণ্ঠ স্বরূপ মাজুলী পার হওয়ার পরেই লইতের কোলে রঙ্গিন আবির ছড়িয়ে সূর্য অস্ত গেল। গোধূলির ছায়া দুই পারের মাঠ-ঘাট এবং গ্রামগুলিকে অস্পষ্ট করে তুলল। কিছুক্ষণের মধ্যে রাতের অন্ধকারে প্রকৃতিকে ঢেকে ফেলবে বলে ভেবে লক্ষ্মীনাথের খারাপ লাগল। তবে এখন শুক্লপক্ষ। রাতের অন্ধকারকে ঠেলে পাঠিয়ে আকাশে দ্বাদশীর চাঁদ দেখা দিল।

চাঁদটা ধীরে ধীরে মেঘ হীন আকাশের উপরে উঠল। তারপরে চাঁদের রুপালি জ‍্যোৎস্না নদীটির দুই তীর, নদীর ছন্দোময় ঢেউয়ে গলে গলে পড়ে এক মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি করল। নৌকা ভ্রমনের সময়টুকু বহিঃ প্রকৃতির এই দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। এই দৃশ্য গুলি দেখে লক্ষ্মীনাথ অপার এক আনন্দ অনুভব করে। গতিশীল নৌকা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে আজও সে রোমাঞ্চিত হয়ে পড়ল। মনে পড়ে গেল শৈশবের কথা। 

শৈশবে পরিবারের সঙ্গে নৌকায় ভ্রমণ গুলিও ছিল সত্যিই আনন্দময়। নৌকায় যেতে থাকা ব্রহ্মপুত্রের ছন্দোময় ঢেউ, শীতের দিনে কোমল সূর্যের কিরণে চকচক করতে থাকা চরের বালি, বর্ষার দিনে দুকুল প্লাবিত করে বহমান ব্রহ্মপুত্রের উত্তাল তরঙ্গ, বাতাসে হেলতে দুলতে থাকা দুই কুলের কাশ, নলখাগড়া, মাদুরি বন, বৈচিত্রময় জনপদ ইত্যাদি আজকের মতোই তার মনে আনন্দের লহর তুলেছিল। নৌকায় নিশার ভ্রমণটা ছিল রোমাঞ্চকর । শীতের দিনে কমে আসা ব্রহ্মপুত্র নদীর জল নির্মল হয়ে পড়ে।তখন ধীর-ছন্দে প্রবাহিত হওয়া জলে আকাশে ভাসমান পূর্ণিমার চাঁদ এবং ঝলমল করতে থাকা নক্ষত্রমণ্ডলী প্রতিবিম্বিত হয়। ওপরে অসীম অনন্ত আকাশ নিচে প্রশান্ত গতিতে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র । ব্রহ্মপুত্রে ভাসমান নৌকায় বসে অপার বিস্ময়ে  সে ওপরের দৃশ্যের সঙ্গে নিচে  প্রবাহমান নদীর জলরাশিতে সেই সবের প্রতিসরিত রূপ দেখছিল । আজ ও লক্ষ্মীনাথ সেইসব আরও মহিমাময় রূপে দেখছে। সঙ্গে অনুভব করছে অনিবর্চনীয় এক অপার্থিব এক আনন্দ। এযেন বিশ্ব বিধাতার এক অপরূপ মায়া খেলা । এখানে প্রকৃতি এত মনোরম, জন্মভূমি অসম  যে এত রূপসী... এই রূপ  কি কলকাতায় গিয়ে খুঁজে পাবে ?

রাতে দাদার সঙ্গে বিশেষ কথা বার্তা হল না। এদিকে ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক বিদ্যারত্ন মহোদয় নিজের জায়গায় কাত হয়ে নিশ্চিন্ত মনে  ঘুমিয়ে পড়ল। বাড়ি থেকে দেওয়া চিড়া গুড় এবং মোষের আঠালো দই খেয়ে গোবিন্দচন্দ্র এবং লক্ষ্মীনাথও বিছানায় শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দাদা ঘুমিয়ে  পড়লেও লক্ষ্মীনাথের ঘুম আসছে না । ওপরের শ্রেণিতে জায়গা পেলেও বাষ্পীয় ইঞ্জিনের শব্দ, মাঝেমধ্যে ভোঁ ভোঁ করে বেজে উঠা শব্দ। এদিকে বাড়ির কথাও মনে পড়ছে। কলকাতায় যাচ্ছে। দুদিন পরেই দাদা চলে আসবে। তারপরে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবহীন কলকাতার অপরিচিত পরিবেশে একা থেকে লক্ষ্মীনাথ কলেজে পড়তে পারবে কি? আগে তার মনে এই সমস্ত ভাব আসেনি । কিন্তু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যতই কলকাতার কাছাকাছি চলে আসছে, ততই এই ভয় আশঙ্কাটা বেড়ে চলেছে । তবে উপায় নেই। বাবার মতের বিরুদ্ধে নিজের নেওয়া সিদ্ধান্ত। এখন তাকে কলকাতা যেতেই হবে।

দেরিতে ঘুমিয়েছিল যদিও বাষ্পীয় ইঞ্জিনের শব্দে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলেই দেখল, ধরিত্রীর বুক থেকে দিনের আলো রাতের অন্ধকারকে দ্রুত অপসারিত করে চলেছে। ইঞ্জিনের শব্দ ভোরের নীরবতা ভঙ্গ করছে যদিও লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগল। বিছানা থেকে নেমে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। একটু একটু ঠান্ডা লাগছে। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে কেবিনের সামনের রেলিঙে দাঁড়াল।

জাহাজ পুর্ণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে বয়ে আসা ফুরফুরে বাতাসের ঝাপটা এসে গায়ে লাগছে। গতিশীল নদীর জল কেটে যাওয়া জাহাজ, দুই পারের ঊষার স্পর্শে সজীব বিশ্বপ্রকৃতি... লক্ষ্মীনাথ সবকিছুতে এক নতুন প্রাণের সন্ধান পেল। ব্রম্মপুত্রের বিশাল বুকে ব্রাহ্মমুহূর্ত পার হয়ে ঊষার সজীবতায় বিশ্ব প্রকৃতি প্রাণ পেয়ে উঠেছে । কিছুক্ষণ পরেই পূব দিকে রক্তিম আভা নিয়ে অনুপম অরুণাভের উদয় হল।

 ' গুয়াহাটি পার হল। এরপরে হাজো, বরপেটা, গোয়ালপাড়া, পঞ্চরত্ন, ধুবড়ি পার হওয়ার পরে অসম পার হব। বেঙ্গলে পৌঁছে আরও একদিন লাগবে গোয়ালন্দ বন্দরে পৌঁছাতে। তারপরে গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে উঠে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন। তাই অধৈর্য হলে হবে না।'

' তা বলে এত দূর!'

দূর বলেইতো ছেলেকে বিদায় দিতে গিয়ে মায়ের চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠে। বাবার এত চিন্তা হয়।

' তোমাদের সবাইকে ছেড়ে কলকাতায় একা থাকতে পারব কি ?'

'কেন পারবি না ? আমরা কি থাকিনি ? গোলাপ আজ ডাক্তার, বিলাতে থেকে সে ডাক্তারি করছে । সে ছিল  অসুস্থ, অসুখ-বিসুখ নিয়ে সে কি কম কষ্ট করেছে ! তোর স্বাস্থ্য ভালো । তোর কাছে সেই সমস্ত কষ্ট কোনো কষ্টই নয়।'

লক্ষ্মীনাথ কষ্ট সহ্য করতে পারবে। সে কষ্ট করতে ভয় করে না। ভয়টা হল কলকাতার পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে কি ?

'আর কলকাতায় একা থাকতে পারবি কিনা তা নিয়ে   চিন্তা করছিস !' গোবিন্দচন্দ্র বললেন – সমবয়সী অসমের অনেক ছাত্র কলকাতায় থাকে। একটা বড় বাড়ি ভাড়া নিয়ে রাঁধুনি এবং চাকর রেখে একসঙ্গে খায়, একসঙ্গে থাকে। যতদূর জানি– এখন সত্যনাথ বরা, দেবীচরণ বরুয়া, কালীকান্ত বরকাকতী, রাধাকান্ত সন্দিকৈ মেসে থেকেই কলেজে পড়ছে। এভাবে সমবয়সীদের  সঙ্গে থাকা, খাওয়া-দাওয়া এবং পড়াশোনার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ রয়েছে । সেটা একটা অন্য ধরনের লাইফ।'

' আমার জন্য ও সেরকম একটি ব্যবস্থা করা হলে ভালো ছিল।'

'কী আর করবি? আমরা যে বামুন। বামুনদের জাতের বিচার মানতে হয়। তাছাড়া বাবার আদেশ, মানতেই হবে।' গোবিন্দচন্দ্র বললেন,' গোলাপের কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে বাবা কি করেছিল মনে আছে? মেডিকেল পড়ার জন্য শবদেহ কাটাছেঁড়া করতে হয়। তা করলে হিন্দুর, বিশেষ করে বামুনদের জাত যায়। এইমতে দৃঢ় বাবা গোলাপকে কলকাতা থেকে ডাকিয়ে আনে। প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে শুদ্ধ করে গোলাঘাটে একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে গোলাপকে সেখানে হেডমাস্টার করে পাঠায়। আমি তখন কলকাতায় বিএ  তৃতীয় বার্ষিকের ছাত্র। তার কথা ভেবে এতই খারাপ লাগল যে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে অসমিয়া ট্রান্সলেটরের চাকরি নিলাম । তারপরে কৌশলে গোলাঘাট থেকে  ডাকিয়ে  এনে গোলাপকে পুনরায় কলকাতা মেডিকেল কলেজে ঢুকিয়ে দিলাম । আমিই তাকে বিলাতে পাঠালাম । তার জন্য আমি এতখানি কেন করলাম বলতো ? আসলে, তার ডাক্তার হওয়ার প্রবল ইচ্ছাটা আমার ভালো লেগেছিল।'

' কিন্তু গোলাপ দাদা তো আমাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখছে না।'

' এটা ও খারাপ করেছে। চরম অকৃতজ্ঞতার কাজ করেছে। না, এরকম করা উচিত নয়। মা-বাবা, দাদা-ভাই, আত্মীয়-স্বজন, স্বদেশ স্বজাতিকে এভাবে ভুলে গিয়ে সে অন্যায় করেছে।'গোবিন্দচন্দ্রের মুখটা গ্লানিতে ম্লান হয়ে পড়ল।

' কলকাতা গিয়ে আমি গোলাপ দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করব।' লক্ষ্মীনাথ বলল।

 'লাভ হবে কি?' গোবিন্দচন্দ্র বললেন,' আচ্ছা, ওর কথা বাদ দে। কথাটা হল, আমরা যে বড় হই, বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করি, এটা শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়। আমরা যত বড় হই, লেখাপড়া শিখে যত বিদ্বান হই ততই আমাদের দায়িত্ব - কর্তব্য বাড়ে । বাবার কথাই দেখ। বাবার গোঁড়ামি  আছে মানছি, নিজের মতে অবিচল থেকে অনেক সময় তিনি যে আমাদের কাজে বাধার সৃষ্টি করে, সেটাও মানছি। তবু তিনি একজন ভালো মানুষ। কলকাতায় আমার চাকরি যাওয়ার পরে আমি যখন গোলাপকে টাকা পাঠাতে অক্ষম হলাম, রাগ ভুলে বাবা কিন্তু তখন গোলাপকে টাকা পাঠাতে শুরু করেন। আর আজ তোর কথাটা, বাধা দিয়েছিলেন যদিও আমি বুঝিয়ে বলায়  বাবা তোকে কলকাতা পাঠাতে রাজি হয়েছেন। তাছাড়া এই বয়সেও সংসার  সামলে বাবা কত কাজ করছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের চর্চা করে বাবা ব্যবসা করে না। দেশের সেবা করে। স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করছেন। বাবার এইসব কাজ আমাদের বুঝতে হবে। গোলাপের এসব না বোঝাটা দুর্ভাগ্যের কথা হয়েছে। লক্ষ্মী, তুই সেরকম কোনো কাজ করবি না।'

  লক্ষ্মীনাথ দাদার দিকে তাকাল। স্নেহ ভালবাসায় গোবিন্দচন্দ্রের চোখ দুটি ভিজে উঠেছে । লক্ষ্মীনাথের   অন্তরটাও আবেগে ভারী হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন,' না দাদা, আমি সেরকম হব না ।'

তারপর লক্ষ্মীনাথ দক্ষিণপারের বিস্তীর্ণ মাঠে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চাষের জমিতে চাষিরা হাল ধরেছে। জমিতে খুব একটা জল নেই। বৃষ্টি হলেই শালি ধানের বীজ বুনতে পারবে। সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছোট নিঃশ্বাস ফেলে লক্ষ্মীনাথ মনে মনে বলে উঠল, কলকাতা আর কতদূর? 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...