হে আমার স্বদেশ- ৫
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
((পাঁচ)
লৌহ কঠিন সংকল্প, অক্লান্ত শ্রম এবং দুরন্ত ইচ্ছাশক্তিতে এফ এ পরীক্ষা দিয়ে লক্ষ্মীনাথ উত্তীর্ণ হল। তারপরে কলকাতার জেনারেল অ্যাসেম্বলি কলেজের বি-এ শ্রেণিতে নাম লেখাল। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে অসমে গিয়েছিল যদিও বেশি দিন থাকল না। ঘনশ্যম বলেছিল, কলেজের পাঠ্যপুথি ছাড়া আরও অনেক কথা জানার এবং বোঝার আছে, কলকাতার সাংস্কৃতিক সমাজ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে… এইসবই সে ইতিমধ্যে উপলব্ধি করতে পারছে। তার জন্যই বাড়ি থেকে এসেই প্রথম কয়েকদিন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কলকাতার প্রধান প্রধান জায়গা গুলি দেখে নিল। চৌরঙ্গীতে গেল, গার্ডেনরিচে গেল,বিকেলে গড়ের মাঠে বেড়াতে গেল, গভীর রাত পর্যন্ত ইডেন গার্ডেনের কাঠের বেঞ্চে বন্ধুদের সঙ্গে বসে কথা বলে কাটাল বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের স্থাপত্য শিল্প দেখল, ডালহৌসি স্কোয়ারে অলিগলি ঘুরে বেড়াল, ব্রিটিশ শাসকদের ক্ষমতার উৎস কেন্দ্র বিশাল অট্টালিকা গুলি ঘুরে ঘুরে দেখল।
১৭৫৭ সনে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে ইংরেজরা ভারতবর্ষের এই বঙ্গভূমিতে প্রথম ঘাঁটি গেড়েছিল। ইংরেজরা জঙ্গল জলাভূমিতে অখ্যাত গঙ্গার পাড়ের তিনটি পরিত্যক্ত গ্রামে রাস্তাঘাট আর বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করে ,বন্দর নির্মাণের মাধ্যমে বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করে তুলে কলকাতা মহানগরকে সাজিয়ে তুলল। ইংরেজরা সত্যিই অসীম ক্ষমতাশালী । তাদের জন্যই ভারত উন্নতির পথে এগোচ্ছে। তাদের প্রচেষ্টায় দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার লাভ করেছে । ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভারতের তরুণরা চাকরি-বাকরি করার সুযোগ লাভ করেছে ।
ইতিমধ্যে কলেজে বি-এ শ্রেণীর ক্লাস আরম্ভ হয়েছে । এইবার ক্লাসে উপস্থিত থাকার কথাটা নিয়ে লক্ষ্মীনাথ ভীষণ সচেতন । প্রতিটি ক্লাসেই উপস্থিত থাকে এবং অধ্যাপকদের পাঠদান করা বিষয় সমূহ যাতে বুঝতে পারে, তার জন্য আগে থেকেই পড়াশোনা করে আসে। অধ্যাপকদের পাঠদান করা বিষয়বস্তুর সঙ্গে একাত্ম বোধ করে। এদিকে পাঠ্যপুথির সঙ্গে আরও বেশি করে বাংলা বই পড়তে শুরু করে । আগের সেই উপযাচক হয়ে কথা না বলার স্বভাবটা পরিত্যাগ করে মেসের বাঙালি সদস্যদের সঙ্গে বাংলায় ভাবের আদান-প্রদান করতে শুরু করে । স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্মীনাথ দ্রুত বাংলা বলতে শিখে গেল আর খুবই কম সময়ের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।
মেস থেকে বেরিয়ে পথে ঘনশ্যামের সঙ্গে দেখা হল। তাঁর সঙ্গেই কলেজে এল। অন্যদিন কলেজের গেটের সামনে ছাত্ররা দল বেঁধে থাকে। আজ সেখানে দুটো ঘোড়া নিয়ে দুটো সিপাহি অপেক্ষা করছে । ওদের সঙ্গে একজন গোরা পুলিশ এক হাতে একটা চাবুক নিয়ে বুট জুতোর ঠকঠক শব্দ তুলে পায়চারি করছে।
থমথমে পরিবেশ।
ভয়ে ভয়ে তাদের পাশদিয়ে কলেজের ভেতরে ঢুকে ঘনশ্যাম ফিসফিস করে বলল,' লক্ষ্মী সামথিং রং।'
' কেন? কী হল?'
'আমাদের কলেজের কিছু ছাত্র কংগ্রেসের সদস্য। ওদের কেউ কেউ ব্রিটিশবিরোধী কিছু একটা করেছে বলে মনে হচ্ছে। তাদের ধরার জন্য অথবা প্রিন্সিপাল স্যারের কাছ থেকে কোনো রিপোর্ট চাইতে এসেছে।'
তখনই দেখতে পেল, আরও দুজন সিপাহি আরও একজন সাহেব পুলিশের সঙ্গে কলেজের ছাত্র পরিষদের নেতা রথীন ঘোষাল বেরিয়ে আসছে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা উনিশ কুড়ি বছরের রথীনের মুখে কুচকুচে কালো দাড়ি, উন্নত নাক ,চোখদুটি সপ্রতিভ। হাতকড়া লাগায় নি যদিও তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে ঘনশ্যাম এবং লক্ষ্মীনাথ রুদ্ধশ্বাসে দেখছে।
' চল ক্লাসে যাই–।'
এখনও দশটার ক্লাসের ঘন্টা বাজে নি। লক্ষ্মীনাথ ক্লাসে যাবে। ঘনশ্যমের ক্লাস আরও এক পিরিয়ড পরে আরম্ভ হবে।
' ঘটনাটা আসলে কি বুঝতে পেরেছিস?' লক্ষ্মীনাথ জিজ্ঞেস করল।
কাছেই ছাত্রদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা দূরে এসে ঘনশ্যাম বলল,' ও এখন বুঝতে পারলাম, সেদিন ছাত্র পরিষদের সভায় রথীন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' ভারত সংগীত' গেয়েছিল। ডি এল রায়ের জাতীয়তাবাদের একটি গান গেয়ে উত্তেজনাময় বক্তৃতা দিয়েছিল। রথীন কিছুটা উগ্র। ইংরেজদের সে 'লুণ্ঠনকারী' বলেছিল।'
' কিন্তু কলেজের ভেতরে অনুষ্ঠিত হওয়া সভার কথাগুলি সাহেবরা জানতে পারল কীভাবে?'
' ওদে্য গুপ্তচর সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে।'
' রথীন সাহেবদের একেবারেই দেখতে পারে না কেন? সাহেবরা তো আমাদের ভালোর জন্যই কাজ করছে, আমাদের শিক্ষিত করে তুলছে।'
ঠিক সেই সময়েই কলেজের ঘন্টা পড়ল। ঘনশ্যম বলল,'যা, ক্লাসে যা– এই বিষয়ে পরে কথা বলব।'
কলেজ থেকে বেরিয়ে কলেজ স্ট্রিটে যায়। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। এখন আর আগের মতো জাতের বিচার করে না। পিতৃপুরুষ মেনে চলা সংস্কারটা না মানলেও খুব একটা অসুবিধা হয়না। তাই রেস্তুরায় বসে বিনা দ্বিধায় মিষ্টি খায়। কফি হাউসে ঢুকে কফির কাপ সামনে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারে। এই সমস্ত আড্ডায় অংশগ্রহণ করা অধিকাংশই বাঙালি বন্ধু। তবে, লক্ষ্মীনাথের অসুবিধা হয় না। বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে বাংলায় মত বিনিময় করার জন্য কোনো রকম অসুবিধা হয় না। । এই সমস্ত আড্ডায় যে কত ধরনের কথা উত্থাপিত হয়। পড়া-শোনা, কলেজের অধ্যাপকদের বক্তৃতা, ছাত্র পরিষদের কাজকর্ম, বন্ধু– বান্ধবদের প্রেম প্রণয়, কলকাতার কোন পাবলিক হলে কোন নেতা কী বক্তৃতা দিল, থিয়েটারগুলিতে মঞ্চস্থ হওয়া নাটক– নাটকের অভিনয়, তারপরে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও … কফি হাউসের এক একটি টেবিলে পাঁচ ছয় জন করে সমভাবাপন্ন তরুণ বসে সরব আলোচনায় মগ্ন হয়, কখন ও তর্কবিতর্কের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কফি হাউস মানেই নতুন নতুন চিন্তা , নতুন নতুন ভাবধারা নিয়ে জীবন গড়ার সোনালি স্বপ্ন দেখা একদল তরুণের জমজমাট পরিবেশ। আসলে কফি হাউসে নতুন প্রজন্মের উদ্দাম যৌবন বিশ্রাম নেয়। কফি হাউসের উত্তপ্ত কফি এবং প্রজ্বলিত সিগারেটের ধোঁয়ায় রচিত হয় তরুণদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কফি হাউসে প্রাত্যহিক তুচ্ছতার উর্ধে উঠে যুবসমাজ রোমান্টিক আবেগে উচ্ছল হয়ে ওঠে।
প্রথম দিন কফি হাউসে গিয়ে লক্ষ্মীনাথ অভিভূত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু শুরুতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হলে সচেতন হতে হয়, দেশ সমাজের কথা জানতে হয়, দেশ-বিদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির খবরা-খবর রাখতে হয়, প্রামাণ্য তথ্যের সঙ্গে যুক্তিপূর্ণভাবে নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে হয়। তার জন্যই লক্ষ্মীনাথ পাঠ্য বই ছাড়া বাইরের বই পড়তে শুরু করেছে। বইয়ের খুঁজে কলেজ স্ট্রিটের দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ায়। আর মনের মতো বই পেলেই পকেটের টাকা খরচ করে তা কিনে আনে।
আজ অবশ্য বইয়ের খোঁজ করল না। সকালে যে তাদের কলেজের ছাত্র নেতা রথীন ঘোষালকে গোরা সাহেব ধরে নিয়ে গেল, এই দৃশ্যটাই মনে পড়ছে। মেসে এসে বইপত্র টেবিলে রেখে ক্লান্তিতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রথীনের ইংরেজ বিদ্বেষটা লক্ষ্মীনাথ সমর্থন করতে পারছে না, তাবলে দেশের কবিদের কবিতা গেয়ে বক্তৃতা দিয়েছে বলেই ইংরেজের পুলিশ সিপাহি তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলহাজতে ভরাবে,– এটাও সে মেনে নিতে পারছে না।… এইভাবে ভাবতে ভাবতেই অবশ আচ্ছন্ন ভাবে তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এল।
' কী হল লক্ষ্মী, শুয়ে আছিস।' রুমমেট রমাকান্ত বরকাকতীর কণ্ঠস্বর,' শরীর খারাপ নাকি?'
লক্ষ্মীনাথ ধড়মড় করে উঠে বসে হাত দুটি দিয়ে চোখ কচলে বলল,' না কাকু, শরীর খারাপ নয়। কলেজ থেকে এসে ক্লান্ত লাগছিল। রেস্ট নিচ্ছি।'
' রঘুকে দু'কাপ চা দিতে বললাম।' ক্ষীণ স্বাস্থ্য, লম্বা-চেহারার রমাকান্ত হাতের শালপাতার ঠোঙাটা লক্ষ্ণীনাথের দিকে এগিয়ে ধরে বলল,' এই নে, 'গরম গরম কুচো চিংড়ির চপ!'
' কুচো চিংড়ির চপ!'
' ছোট চিংড়ি মাছের সঙ্গে ব্যসন এবং পেঁয়াজ দিয়ে ভাজা চপ। খেয়ে নে, চায়ের সঙ্গে ভালো লাগবে।'
' আগে একদিন খেয়েছিলাম।দাঁড়ান, মুখ হাত ধুয়ে আসি–।'
লক্ষ্মীনাথ গায়ের জামাটা খুলে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখল। তারপরে ভেতরের দমকলে মুখ হাত ধুয়ে এসে ঠোঙা থেকে একটা চপ তুলে নিল।
ধুতির উপরে চেক গামছা পরা আধবয়সী রঘু দু'কাপ চা দিয়ে গেল।
চায়ে চুমুক দিয়ে লক্ষ্মীনাথ চপ খেতে লাগল।
' কেমন?'
' টেস্টফুলই। তবে ঝাল–.'
' কলকাতায় থাকতে হলে বাঙ্গালীদের মতো লঙ্কা খাওয়ায় আমাদেরও অভ্যস্ত হতে হবে। আর বুঝেছ লক্ষ্মী, বাঙালিরা লঙ্কা খায় বলেইই আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান নাকি?'
' সঙ্গে আপনি এটাও বোঝাতে চাইছেন নাকি যে আমরা খার খাই বলে আমাদের মগজটা ভোঁতা?'
' না না, তা বলছি না। মজা করার জন্যই কথাটা বললাম। তবু তোমাকে মানতেই হবে, ওরা আমাদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। সমস্ত ক্ষেত্রেই বাঙালিরা আমাদের চেয়ে বেশি সফল হয়েছে, উন্নতি করছে।'
' এটা সম্ভব হয়েছে ইংরেজদের জন্য। অসমে আসার প্রায় আশি বছর আগে ইংরেজরা বেঙ্গলে এসেছিল। এই আশি বছর ইংরেজদের সঙ্গে থেকে বাঙালিরা ইংরেজি শিক্ষায় অনেকটা এগিয়ে গেছে। কিন্তু, বাঙ্গালিদের মধ্যে একদল এখন ইংরেজদের ঘৃণা করতে শুরু করেছে। বিদ্বেষ পোষণ করে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে!'
লক্ষ্মীনাথের কথায় ক্ষোভ প্রকাশ পেল। রমাকান্ত হাইকোর্টে অসমিয়া অনুবাদকের কাজ করলেও সচেতন ব্যক্তি। বইপত্র পড়েন। তিনি লক্ষ্মীনাথের ক্ষোভের কারণটা বোঝার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। লক্ষ্মীনাথ কলেজের ছাত্র নেতা রথীন ঘোষালকে সিপাহি ধরে নিয়ে যাওয়ার কথাটা বিস্তারিতভাবে বলল। সবকিছু শুনে রমাকান্ত চিন্তিত হল। স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে ধীরে ধীরে বলল,–' ইংরেজরা ভারতবাসীদের জন্য মানে আমাদের জন্য যাই করুক না কেন, আমরা যে তাদের অধীন এই কথাটা কি অস্বীকার করতে পারি? আসলে,১৮৫৭ সনে সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকেই দেশের একদল মানুষের মনে স্বরাজ পাওয়ার বাসনা তীব্রতর হয়ে উঠেছে। এখন সেটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তারপরে উমেশচন্দ্র ব্যানার্জীর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসের নেতারা সোজাসুজি ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা না করলেও তাদের মূল লক্ষ্যটা কিন্তু স্বরাজ। তাই এসব চলতেই থাকবে। তুমি এসব থেকে দূরে থেকো। আসাম থেকে কলকাতায় এসেছ, পড়াশোনা করাটাই তোমার মুখ্য উদ্দেশ্য বলে ভাববে।'
শুভার্থী রমাকান্ত ভালো উপদেশই দিয়েছে। কিন্তু অন্তরে কীসের এক ধরনের জ্বালা অনুভূত হতে লাগল। জিভে চিংড়ি মাছের চপের জ্বালার চেয়ে সেই জ্বালাটা একটু বেশি।
ছয় মাসের পরীক্ষা হয়ে যাবার পরে দুদিনের জন্য ছুটি পেল। ইতিপূর্বে বাংলা সাহিত্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের' শকুন্তলা',' সীতার বনবাস' এবং' ভ্রান্তি বিলাস' পড়েছিল। পড়েছিল দীনবন্ধু মিত্রের নাটক' নীলদর্পণ', হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহাকাব্যিক কবিতা' ,'বৃত্রসংহার', প্যারীচাঁদ মিত্রের' আলালের ঘরের দুলাল'। এই সব সাহিত্যই লক্ষ্মীনাথের মন মানসিকতাকে পরিপুষ্ট করল। সে বুঝতে পারল যে বাংলা সাহিত্য প্রাচীনত্বের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসছে। তারপরে গত কয়েকদিনের বন্ধে যখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা',' ব্রজাঙ্গনা', এবং ' মেঘনাদ বধ' কাব্য পড়ল– তখন লক্ষ্মীনাথের চেতনাবোধে অভূতপূর্ব এক আলোড়ন সৃষ্টি হল।কী ভাষা, কী ছন্দ, রূপকের দ্বারা মানব হৃদয়ের ভাব অনুভূতির কী অপূর্ব প্রকাশ! কাব্য কথাগুলি, সারি গুলি, কিছু সনেটের পঙক্তিগুলি তাঁর মনে,তাঁর অন্তরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সত্যিই মাইকেল মধুসূদন একজন অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন আধুনিক কবি। এদিকে মাইকেলের জীবনটিও নাটকীয় সংঘাতে বৈচিত্র্যময়। এই সমস্ত কবি সাহিত্যিক নিজের জীবন দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।… লক্ষ্মীনাথ ভাবে, এই ভাবনাগুলি তাঁকে বিভোর করে ফেলে ।
এরকম ভাবনা বিভোর মন নিয়েই লক্ষ্মীনাথ বিকেলে মানিকতলা স্ট্রিটের গুণাভিরাম বরুয়ার বাড়িতে এল। যোরহাটে জন্মগ্রহণ করা গুণাভিরাম এখনও সরকারি চাকরিজীবী। অসমের নগাঁও জেলার এক্সট্রা কমিশনড অফিসার।তাঁর পরিবার থাকে কলকাতার মানিকতলার ভাড়ায় নেওয়া একটি বাড়িতে। প্রথমপত্নীর মৃত্যুর পরে সামাজিক সংস্কারের প্রতি উদার গুণাভিরাম বরুয়া বিধবা বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীকে বিয়ে করেছিলেন । তারপরে হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিতে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সরকারি চাকরি করেও গুণাভিরাম বরুয়া মাতৃভাষার একজন সেবক এবং তিনি ছিলেন 'অরুণোদয়' কাগজের একজন অন্যতম প্রধান লেখক। অন্যান্য রচনা ছাড়াও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচনা করা তাঁর ' আসাম বুরঞ্জী' অসমিয়া সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ। তাছাড়া তিনিই লক্ষ্মীনাথের পিতা পছন্দ করা ' আসাম বন্ধু' কাগজটির সম্পাদক।
প্রথমবার কলকাতা আসার পরে মেজদাদা গোবিন্দচন্দ্র গুণাভিরাম বরুয়ার বাড়িতে আসতে বলেছিল। গুণাভিরাম আত্মীয় যদিও ব্রাহ্ম। তিনি ব্রাহ্ম বলেই লক্ষ্মীনাথ প্রথমে আসতে একটু দ্বিধা করেছিল। অন্যদিকে, সেই সময় তার খুব একটা মানসিক স্থিরতাও ছিল না। এতদিনে, বিশেষ করে দ্বিতীয়বার কলকাতায় এসে, কলকাতার বৃহৎ সাংস্কৃতিক পরিবেশের নিত্যনতুন কথা শিখে শিবসাগরের পারিবারিক আচার সংস্কার থেকে অনেকখানি মুক্ত হতে পেরেছে । তাছাড়া গুণাভিরামের বিষয়ে বিস্তারিত জেনে লক্ষ্মীনাথ তার প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করতে লাগল।
অবশ্য ইতিপূর্বে গুণাভিরাম কলকাতায় না থাকা অবস্থায় লক্ষ্মীনাথ একবার এই বাড়িতে এসেছিল। তখন বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মীনাথকে খুব আদর যত্ন করেছিলেন । বয়সে বড় হলেও সম্পর্কটিকে মর্যাদা দিয়ে প্রথম সাক্ষাতে মামা, মামা বলে এখানে বসুন এটা খান ওটা দেখুন ' ইত্যাদি নানাভাবে আদর যত্ন করে লক্ষ্মীনাথকে আপন করে নিয়েছে।তাদের কন্যা স্বর্ণলতা কলকাতার বেথুন কলেজের ছাত্রী, পুত্র করুণা ভিরাম, কমলাভিরাম এবং জ্ঞানদাভিরাম মেধাবী ছাত্র । এরকম একটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানোটা সত্যিই আনন্দের কথা।
লক্ষ্মীনাথকে আসতে দেখে আগেরবারের মতোই এবারও বিষ্ণুপ্রিয়া 'মামা আসুন ভেতরে এসে বসুন' বলে উষ্ণ আন্তরিকতায় আদর করে নিয়ে গিয়ে ভেতরে বসাল।এক গ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে ় লক্ষ্মীনাথের দিকে এগিয়ে দিয়ে কুশল বার্তা জিজ্ঞেস করল । জল খেয়ে সামনের নিচু টেবিলে গ্লাসটা রেখে বিষ্ণুপ্রিয়ার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে লক্ষ্মীনাথ জিজ্ঞেস করল,' নগাঁও থেকে মামা এসেছে কি?'
তখনই ঘরোয়া পোশাক পরা দীর্ঘদেহী গুণাভিরাম বরুয়া মহাশয় হাসিমুখে এগিয়ে এসে সামনের সোফায় বসলেন। বয়স ষাটের ওপরে যদিও স্বাস্থ্য এখনও ভালো। ফিতা লাগানো চশমা পরা জ্ঞানী, বুক পর্যন্ত বিস্তারিত কাঁচাপাকা দাড়িতে গভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কিন্তু কথাবার্তায় ভীষণ অমায়িক।
' বিষ্ণুপ্রিয়া তোমাকে মামা বলে ডাকে, সম্পর্কে তুমি আমার মামা শ্বশুর।' প্রাথমিক শিষ্টাচারটুকু পালন করে মুচকি হেসে বরুয়া বললেন,' তাই আমি তোমাকে মামা বলে ডাকব।'
এত বড় একজন মানুষ এভাবে বললেন। লক্ষ্মীনাথের মুখে কোনো কথা জোগাল না। লজ্জায় লক্ষ্মীনাথ মাথা নীচু করল।
' আচ্ছা বাড়ির খবর – মানে শিবসাগরের খবর কি? বাবার স্বাস্থ্য ভালো আছে তো?'
' ভালোই আছেন।'
' তিনি স্বর্গদেউ পুরন্দর সিংহ পাতা রাজবৈদ্য ছিলেন। তাই তাকে ভালো থাকতেই হবে। তিনি এখনও আয়ুর্বেদের চর্চা করেন কি?'
' করছেন। আমার ছোট ভাই লক্ষ্মণ। ইংরেজি স্কুল থেকে লক্ষণের নাম কাটিয়ে এনে বাবা তাকে আয়ুর্বেদ শেখাচ্ছেন।'
' ইংরেজি স্কুল থেকে লক্ষ্মণের নাম কাটিয়ে এনেছে!
'হ্যাঁ,মামা । বাবার একান্ত কামনা যে আমাদের বংশের কোনো একজন অন্তত আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে বংশের ঐতিহ্য পরম্পরা রক্ষা করুক ।'
' ও, তাই নাকি। আগে তিনি প্রায়ই' অসাম বন্ধু'তে প্রকাশিত প্রবন্ধাদির ভুল শুধরে চিঠি লিখতেন, আজ কাল আর লিখছেন না।'
তারপর তিনি অনেকক্ষণ' আসাম বন্ধু'তে লেখা কবি সাহিত্যিকদের বিষয়ে আলোচনা করলেন। এদিকে বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মীনাথের জন্য জলখাবারের জোগাড় করেছেন। অসমিয়া যদিও তারা ব্রাহ্ম। শিবসাগরের ঘরোয়া আচার অনুসারে লক্ষ্মীনাথের এই বাড়িতে জল স্পর্শ করাও নিষিদ্ধ । তবে সে অনেকদিন আগেই এই সংস্কারগুলি বিসর্জন দিয়েছে । মেসে রমাকান্তের বিশেষ প্রচেষ্টায় রাঁধুনি রঘু মসলা এবং ঝাল কম দিয়ে ভোজন যোগ্য আহার রাঁধলেও একই ধরনের তরকারি, ডাল ,মাছের ঝোল আর কতদিন ভালো লাগে ? মাঝে মধ্যে এই ধরনের অভিজাত বাড়িতে জলখাবার বা আহার খেলে রুচির পরিবর্তন হয় । এদিকে লেখক স্বামীর সান্নিধ্যে লেখিকা হয়ে ওঠা বিষ্ণুপ্রিয়ার রান্নার প্রণালীও উন্নত। তিনি যত্ন করে বেড়ে দেওয়া আহার লক্ষ্মীনাথ আগ্রহ এবং তৃপ্তি সহকারে খায়। খাওয়ার পদ্ধতি ও সাহেবি কায়দায়, চেয়ার-টেবিলে।
খেতে বসে কোনো ধরনের প্রসঙ্গের অবতারণা না করে লক্ষ্মীনাথ জিজ্ঞেস করল,' চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পরে আপনি নাকি অসম থেকে কলকাতায় চলে আসবেন?'
গুণাভিরাম গম্ভীর হয়ে পড়লেন।
তাঁর এই গাম্ভীর্য অস্বাভাবিক বলে মনে হল। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ বললেন,–' এভাবে জিজ্ঞেস করে আপনাকে যদি আঘাত দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন।'
প্রসন্ন হাসি হেসে গুণাভিরাম বললেন, 'না না, এভাবে জিজ্ঞেস করায় আমি আঘাত পাইনি, তোমার উপরে অসন্তুষ্ট ও হইনি। আসলে, অসম ছেড়ে কলকাতায় এসে থাকার মূল কারণটা ঘরোয়া। স্বর্ণ বেথুন কলেজে পড়ে। ছেলেদের কলেজের শিক্ষার কথা আছে। অসমে থাকলে এসব সম্ভব হবে না।'
' আমাদের ভাষা সাহিত্যের জন্য আপনি এত খানি করেছেন। চাকরির দায়- দায়িত্ব সামলে নিয়েও অসাম বন্ধু'র সম্পাদনা করেছেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে স্থায়ীভাবে অসমে থাকলে–।'
' অবশ্য আমি যে এখন নগাঁও রয়েছি, নগাঁও শহরে সাহিত্যের একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছে। নগাঁও শহরে হেমচন্দ্র, রত্নেশ্বর, পদ্মহাসের লেখাগুলি একটা নির্দিষ্ট আকার নিচ্ছে। আগে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অসমে এসে অসমিয়া ভাষা শিখে মিশনারীরা ' অরুণোদয়' এর মাধ্যমে যতটুকু করেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। অসমে বসবাস করে অসমিয়া ভাষার পুনর্জীবন দান এবং অসমিয়া জাতীয়তাবাদের প্রাণসঞ্চার করার ক্ষেত্রে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার ছাড়া অরুণোদয়ের পাতায় তাদের লেখাগুলিতে আমাদের মনের কথা খুব একটা পাওয়া যায় না।' গুনাভিরাম বললেন–,' আমার বোধে মাতৃভাষার বিকাশ করার জন্য চাই শিক্ষা, চাই আধুনিক এবং উন্নত সংস্কৃতির সান্নিধ্য। এইসব এখন ও অসমে গড়ে উঠেনি। এখন ও আমাদের অধিকাংশ মানুষই অশিক্ষিত, ধর্মীয় কুসংস্কারে জর্জরিত, কর্মবিমুখ, পরশ্রীকাতর এবং অলস। অথচ এখানে, এই কলকাতায় শিক্ষা-সংস্কৃতি সাংবাদিকতা ছাড়াও সমাজ সংস্কার এবং রাজনীতি… সমস্ত ক্ষেত্রে যে একটা জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে।'
' হ্যাঁ, মামা ।এটা সত্যি।'
' সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে এখানে পাশ্চাত্যের উদার মানবীয় চিন্তা চেতনা গুলিও প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। আমরা এখানে এসে আমাদের চেয়ে উন্নত চরিত্রের বাঙ্গালিদের সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ পেয়েছি।'
গুণাভিরাম বরুয়া থামলেন। হঠাৎ তিনি শান্ত এবং গম্ভীর হয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ এভাবে বসে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,' এখন তোমরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের ভাষা সাহিত্যের বিকাশের জন্য ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে তোমাদের পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শনের জ্ঞান আহরণ করতে হবে। সঙ্গে বাংলা সাহিত্যও তন্নতন্ন করে অধ্যয়ন করতে হবে। একসময় অসমের স্কুল কাছারিতে বাংলা ভাষা চলেছিল বলে বিদ্বেষবশত বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি অধ্যয়ন না করাটা উচিত হবে না। তারপরে, অসমে থাকার কথা বললে – অসমে অসমিয়াদের মধ্যে থাকলেই যে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের সেবা করতে পারা যায়, এটা আমি মানতে পারিনা । আমার মনে হয়, আন্তরিক ইচ্ছা থাকলে প্রবাসী হয়েও মাতৃভাষার সেবা করা যায় ।'
… এভাবে গুণাভিরাম আরও অনেক কথা বললেন। লক্ষ্মীনাথ মনোযোগের সঙ্গে শুনল। পরে কংগ্রেসের আন্দোলনের কথা আলোচনা করলেন। রায়বাহাদুর সম্মানে বিভূষিত গুণাভিরাম দীননাথ বেজবরুয়ার মতোই নরমপন্থী। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে কিছুই বললেন না। মেসের রমাকান্তের মতো তিনি কলকাতার কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের মধ্যে জেগে ওঠা উগ্রবাদী দল সংগঠন থেকে লক্ষ্মীনাথকে সাবধানে থাকতে উপদেশ দিলেন। শেষে বললেন,' এখন তোমাদের কাজ শুধু অধ্যয়ন। যত অধ্যয়ন করবে, ততই বৌদ্ধিক সাংস্কৃতিক জগতের ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে যাবে… ততই নিজেকে জানতে পারবে, নিজের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির লেভেলটা বুঝতে পারবে। যাই হোক, তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ভালো লাগল। কীভাবে যে দেড় ঘণ্টা সময় পার হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। তুমি আবার এসো কিন্তু।'
কলেজে ছাত্র নেতা রথীন ঘোষালকে সিপাহি ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দিনের শুরুতে অস্বস্তিকর হলেও এখন,গুণাভিরাম বরুয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগছে। মনটা স্থির হয়ে এসেছে। শ্রীবরুয়া প্রকৃত অর্থেই একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। আহরণ করা শিক্ষা–জ্ঞানকে তিনি নিজের মধ্যে আক্ষরিক করে রাখেননি। হিন্দু ধর্মের চিরাচরিত সংস্কারকে অতিক্রম করে বিদ্যাসাগরের প্রবর্তিত নীতি অনুসারে বিধবা বিবাহ করে সুখী গৃহস্থ। ধর্মীয় গোঁড়ামি পরিত্যাগ করে রামমোহন প্রবর্তন করা উদার ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী। তিনি স্বর্ণলতা, করুণাভিরাম, কলমাভিরাম এবং জ্ঞানদাভিরামের মত কৃতী সন্তানদের জনক। তারচেয়েও বড় কথা তিনি মাতৃভাষার সেবা করেছেন।' অসাম বন্ধু'র মত একটি কাগজের সম্পাদনা করছেন। এই পরিবারের সান্নিধ্য লাভ করে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এতক্ষণ কথাবার্তা বলে লক্ষ্মীনাথ যথেষ্ট উপকৃত হল। শ্রী বরুয়ার অমূল্য ভাব সম্পদ লাভ করল। এরকম মনে হতে লাগল যে আজকের তারিখে গুণাভিরাম বরুয়া একজন আদর্শ পুরুষ।তাঁর জীবন এবং কর্ম লক্ষ্মীনাথের কাছে অনুকরণীয় এবং প্রেরণাদায়ক। লক্ষ্মীনাথের জন্য তিনি একজন মার্গদর্শক।
… এভাবে ভাবতে ভাবতে লক্ষ্মীনাথ মানিকতলা থেকে পায়ে হেঁটে এগোতে লাগল। তারপর বাসে উঠল। বিকেলের এই সময়টায় বাসগুলিতে ভিড় থাকে। বসার জায়গা পাওয়া যায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কলেজস্ট্রিটে এসে নামল।তাঁর সঙ্গে নামল আরও একজন যুবক। বয়সে লক্ষ্মীনাথের সমবয়সী হবে। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল,' আপনি লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া, নয় কি?'
প্রবাসে এভাবে কেউ মাতৃভাষায় কথা বললে লক্ষ্মীনাথের অন্তরটা উদ্বেল হয়ে উঠে। লক্ষ্মীনাথ আগ্রহী হয়ে সায় দিয়ে বলল,' হ্যাঁ, বলুন।'
' আমার নাম চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা।১০ নম্বর আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে আমাদের বাড়ি। সেখানেই থেকে ব্যবসা দেখাশুনা করার সঙ্গে কলেজে পড়ি। আমি এখন এফ এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।'
' কিন্তু আপনি এত সুন্দর অসমিয়া বলছেন!'
' আমাদের বাড়ি অসমের তেজপুরে। সেখানেই আমার জন্ম। শৈশব তেজপুরে কেটেছে। এখন কলকাতায়–।' চন্দ্রকুমার বলল,' আমি ১৪/১ প্রতাপ চাটার্জী লেনে অসমিয়া ছাত্রদের মেসে প্রায়ই যাই। সেখানে আপনার কথা আলোচনা হয়। আপনি খুব বই পড়েন। সাহিত্যে আপনার অনুরাগ।'
' না না, সেরকম কিছু নয়।' লক্ষ্মীনাথের কন্ঠেস্বরে বিনয়।
আমি জানি । আপনি সাহিত্যরসিক ।আপনার রসবোধও সূক্ষ্ম। আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ খুঁজছিলাম ।'
আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমারও ভালো লাগল। তাহলে আসুন না ,আমাদের মেসে।'
' আজ নয়। বিকেল হয়ে গেছে । এখন মেসে ঢুকলে গল্প করে এখান থেকে আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে যাওয়াটা অসুবিধা হয়ে যাবে । কিন্তু আমরা কথাবার্তা বলব । আপনার সঙ্গে অনেক কথা বলার আছে ।'
চন্দ্রকুমার বিদায় নিল। লক্ষ্মীনাথ চন্দ্রকুমারের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল।তাঁর হাসিমুখ, মিষ্টি কথা এবং মনোহর ব্যবহার লক্ষ্মীনাথকে আকৃষ্ট করল । এরকম মনে হতে লাগল যেন ক্ষণিকের এই সাক্ষাৎ চন্দ্রকুমারের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠল।তাঁর এখন ছাত্রনেতা রথীন ঘোষালকে ইংরেজের সিপাহি গ্রেপ্তার করে কলেজ থেকে নিয়ে যাবার দৃশ্যটা আর মনে পড়ছে না। শান্ত মনে লক্ষ্মীনাথ মেসের দিকে এগিয়ে গেল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন