বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল, ২০২২

হে আমার স্বদেশ- ৭ ।। সন্তোষ কুমার কর্মকার ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস ।। He Amar Swadesh

 হে আমার স্বদেশ- ৭

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস




  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।


(সাত)

' অসমের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রবাসী ছাত্রবন্ধুরা,আপনারা সবাই আমাদের আমন্ত্রণ রক্ষা করে এই মেসে সমবেত হয়েছেন,তার জন্য আপনাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ইতিপূর্বে আমরা কলকাতার বিভিন্ন মেসে আলাদা আলাদাভাবে মিলিত হয়েছি। কলকাতার অপরিচিত এবং আমাদের জন্য অনভ্যস্ত পরিবেশে থাকতে গিয়ে আমাদের মধ্যে উদ্ভব হওয়া সমস্যাগুলির সঙ্গে আমরা আমাদের মাতৃভাষার অতীত এবং বর্তমান নিয়ে আলোচনা করেছি। তাছাড়া সাম্প্রতিক কলকাতার ঘটনাক্রম, বাংলা সাহিত্য,বঙ্গ সংস্কৃতি ,ইংরেজি সাহিত্য- দর্শন ইত‍্যাদি বিষয়ে আমরা মতবিনিময় করেছি। কিন্তু বন্ধুরা, আমাদের সেই সব আলোচনা সু-সংবদ্ধ কোনো রূপ লাভ করে নি। সেইসব আলোচনার দ্বারা আমরা সৃজনমূলক কোনো কাজ করতে পারিনি। তার অন্যতম প্রধান কারণ হল, আমরা কলকাতায় পড়তে আসা ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি। আজ আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের কথা যে আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অধিকাংশ, অধিকাংশ নয়, প্রায় প্রতি জন প্রবাসী অসমিয়া ছাত্র এখানে এসে  উপস্থিত হয়েছে। সবাইকে একসঙ্গে দেখে আমরা শুধু আনন্দিতই নয়, আমরা আশান্বিত হয়েছি। সঙ্গে আমাদের মনে একটি প্রত‍্যয়  জেগেছে যে এখন আমাদের মনে চিন্তা- ভাবনা, মত আদর্শ গুলি একটা নির্দিষ্ট রূপ লাভ করবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।'

বক্তা সত্যনাথ বরা। গুয়াহাটির দয়ানাথ বরার পুত্র। লম্বা চেহারার সপ্রতিভ যুবক। বয়সে বড় না হলেও মেসে থাকা অসমিয়া ছাত্রদের মধ্যে সে সমস্ত কিছুতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। একজন সুবক্তা হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। কথাগুলি সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলতে পারে। তবু আজকের সভার গুরুত্ব উপলব্ধি করে সে একটা কাগজে কিছু কথা লিখে নিয়ে এসেছিল।

১৪/১ প্রতাপ চ্যাটার্জী মেসের বাইরের লম্বা বারান্দায় শতরঞ্চির  ওপরে চাদর পেতে নিয়ে সবাই বসেছে। এই সভার আয়োজন নিয়ে ইতিপূর্বে ছোট ছোট কয়েকটি বৈঠক হয়ে গেছে। মেসে মেসে গিয়ে ছাত্রদের সভায় ডাকার দায়িত্ব নিয়েছিল সত্যনাথ এবং লক্ষ্মীনাথ। তাছাড়া লক্ষ্মীনাথ রিপন কলেজ, সিটি কলেজে গিয়ে অসমিয়া ছাত্রদের ডেকেছিল। নিজের জেনারেল অ্যাসেম্বলি কলেজের অসমিয়া ছাত্রদের বিশেষভাবে বলেছিল। তাই সবাই এসেছে। সময়মতো এসে সভা আয়োজনের কাজে সহযোগিতা করেছে। অবশ্য সভা অনুষ্ঠিত করার স্থান নিয়ে একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। যতই হোক না কেন, অসমের বাইরে কলকাতায় অসমিয়া ছাত্রদের সভা– সমিতি অনুষ্ঠিত করার পরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, প্রতাপচন্দ্র চ্যাটার্জী লেনের মেসের ম্যানেজার হারাধন সামন্ত সভা আয়োজন করার অনুমতি দেবে কিনা কে জানে? মেসের অন্যতম সদস্য সত্যনাথ, দেবীচরণ, কালীকান্ত, ঘনশ্যাম এবং রাধাকান্ত একসঙ্গে গিয়ে ম্যানেজার হারাধন সামন্তকে শঙ্কাজড়িত  মনে কথাটা জানাল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উদারভাবে বলে উঠলেন–' আরে, তোমরা আছ বলেই তো আমার এই মেস চলছে। তোমাদের সুখ-সুবিধা সাধ আহ্লাদ আমাকে দেখতে হবে না।' তিনি শুধুমাত্র অনুমতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়ে রইলেন না। আমন্ত্রিতদের বসার সুবিধা করে দেওয়া ছাড়াও সভার শেষে রসগোল্লা সন্দেশের দ্বারা জলযোগ  করানোর দায়িত্ব ও নিজেই কাঁধ পেতে নিলেন। সেই অনুসারে তিনি তখনই মেসের প্রতিটি চাকরকে ডেকে এনে সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার দিন  কী কী করতে হবে সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন।

' বন্ধুরা, এই কলকাতার কলেজস্ট্রিটে বাঙালিরা কফি হাউসে সমবেত হয়। একটি টেবিলের চারদিকে চার পাঁচজন যুবক চেয়ার নিয়ে বসে এক কাপ এক কাপ চা নিয়ে বা কফি নিয়ে বসে  ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে কথা বলে।' কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা করে সত্যনাথ আবার বলতে শুরু করল,' কফি হাউসে আড্ডা দেওয়া বাঙ্গালিদের কথাবার্তার বিষয়বস্তু হল ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা থেকে আরম্ভ করে রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব, সাহিত্য এবং দর্শন। রং তামাশা ছাড়া তারা বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে নিজের নিজের মতামত ব্যক্ত করে, ভাবের আদান প্রদান করে। এভাবে একে অপরের কাছ থেকে শেখে। নিজের নিজের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে। আমাদের মধ্যে অসম থেকে আগত কয়েকজন প্রতিভাবান ছাত্র রয়েছে। তারা আমাদের অতীত ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে ইতিহাসের প্রভূত জ্ঞান লাভ করেছে, অনেকেই  আজকের সমাজ বিষয়ে তাত্ত্বিকভাবে বিচার করতে পারে, এমনকি আমাদের মধ্যে অনেকেই– অনেক বললে ভুল হবে, অধিকাংশ ছাত্রই সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হয়ে  মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করে তুলছে। তাই, এইসব ছাত্রদের সঙ্গে ভাব–বিনিময় করে উপকৃত হতে পারি। তাঁদের সৃষ্ট  সাহিত্য পাঠ করে বা আলোচনা করে তাঁদের উৎসাহিত করতে পারি। আমার বিবেচনায়, এটি একটি মহৎ উদ্দেশ্য এবং এই উদ্দেশ্যকে ফলবতী  করার জন্য আমাদের নিশ্চয় কিছু করণীয় আছে। এখন আমরা কি করতে পারি, কীভাবে কী করলে আমরা ব্যক্তিগতভাবে হয়েও দেশ জাতির উপকার করতে পারব সেই বিষয়ে আপনারা সবাই নিজের নিজের মত তুলে ধরে একটি ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নিতে পারব বলে আশা করছি । আর এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমরা আপনাদের সবাইকে আমাদের এখানে আমন্ত্রণ করে এনেছি।' 

এভাবে আহ্বায়ক রূপে  সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে সবাইকে পুনরায় ধন্যবাদ জানিয়ে সত্যনাথ নিজের জায়গায় বসে পড়ল।

উপস্থিত প্রতিটি সদস্যই বরার বক্তৃতা শুনে আগ্রহী হয়ে পড়ল। অসম থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য কলকাতায় আগত এইসব ছাত্রদের অধিকাংশেরই  পারিবারিক অবস্থা সর্বসাধারণ অসমিয়াদের চেয়ে উন্নত। তাদের প্রায় প্রতিটি পরিবারের অভিভাবকদের শিক্ষা সংস্কৃতিতে অনুরাগ থাকা। অভিবাবকদের বিশেষ আগ্রহে শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত হওয়ার মানসে কলকাতায় এসে কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাবে তাদের মনে নতুন কিছু একটা করার বাসনা জেগে উঠে। সেইসব বাসনা সম্মিলিত রূপে সাকার হওয়ার সম্ভাবনা দেখে প্রত্যেকেই এক নতুন প্রেরণা লাভ করল।

সভার অন্য একজন আহ্বায়ক হল লক্ষ্মীনাথ । সত‍্য নাথের পরে  সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আরও কিছু সংযোজন করে নাকি এই ভেবে সবাই লক্ষ্মীনাথের  দিকে তাকাল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ নিজের বক্তব্য বিষয় পরে জানাবে বলল।

লক্ষ্মীনাথের বা পাশে বসেছে পদ্মনাথ গোহাঞিবরুয়া।তাঁর পিতা ঘিণারাম বরুয়া একজন মৌজাদার। পদ্মনাথের জন্ম লক্ষ্মীমপুরে যদিও এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় শিবসাগরের সরকারি বিদ্যালয় থেকে । ক্ষীণ চেহারার লম্বা, শান্ত, চিন্তাশীল স্বভাবের তরুণ। পদ্মনাথও অধ্যয়নশীল। ধুতি পাঞ্জাবি পরা একজন নিখুঁত অসমিয়া। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। প্রত্যেকেই আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করলেও এই সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো একজনকে সভাপতি করা হয়নি। তাই সভাপতিকে সম্বোধন করার প্রয়োজন নেই ।

বন্ধুরা, সভায় আমার অগ্রজ কয়েকজন ছাত্র উপস্থিত রয়েছে । তাদের সাদর সম্মান জানিয়ে আমি আমার তরফ থেকে দু'একটি কথা নিবেদন করছি । আমার শিক্ষা– জ্ঞান সামান্য, তাই অধমের মুখ থেকে যদি কোনো অবান্তর কথা বের হয়, বা কোনো কিছু ভুল বলি, তাহলে আপনারা যেন আমাকে ক্ষমা করেন।' 

পদ্ম বরুয়া, ভূমিকাটা দীর্ঘ হয়ে গেল।' লক্ষ্মীনাথ মন্তব্য করল। উপস্থিত ছাত্ররা হেসে উঠল। পদ্মনাথও হাসল। তখনই নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,' আমার সম্মানীয় সত্যনাথ বরা তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে কলকাতার কফি হাউসের কথা উল্লেখ করেছে।তাঁর কথা শুনে এই ধরনের একটা ভাব হল যে  কফি হাউসে চা বা কফি খেতে খেতে সমাজনীতি- রাজনীতি, শিল্পকলা, সাহিত্য-দর্শনের আলোচনাটা  যেন বাঙালির সংস্কৃতি । আমার বোধে এটি বাঙালির সংস্কৃতি নয়। যতটুকু জানি, এই সংস্কৃতিটা বিলেত থেকে আগত। বিদগ্ধ পন্ডিত জনসন এবং এডিসনের দিনে ইউরোপের নগরে- শহরে কফি -হাউস, বার, রেস্তোরায় এই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। কফি হাউসের  আগে বাঙ্গালিদের নিজস্ব ঐতিহ্য হল' আড্ডা'। বাঙ্গালিরা আড্ডা দিতে ভালোবাসে। আগে গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে বা নাটমন্দিরে প্রবীণ বাঙ্গালিরা আড্ডা দিতে বসত। বাঙ্গালিদের কাছে আড্ডা সব সময়ই রসাল এবং আমোদজনক। আড্ডায় বসে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দেয়। আজকের শিক্ষিত এবং নাগরিক বাঙ্গালিদের কাছে আড্ডার আধুনিক রূপটিই হল কফি হাউস সংস্কৃতি। যাই হোক, এই সংস্কৃতিটির নিশ্চয় কিছু ইতিবাচক দিক আছে। আমরা তা অনুসরণ করলেও আমাদের উপকার হতে পারার মতো বিবেচনা করে নিজস্ব ধরণে  গ্রহণ করব।'

' তারপরে মাননীয় সত্যনাথ  বরা আমাদের ঐতিহ্য আমাদের ইতিহাসের কথা বলল, মাতৃভাষা এবং সাহিত্যের কথা বলল–।' ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পদ্মনাথ  পুনরায় আরম্ভ করল,' আমাদের প্রত্যেকের মনে খুব দুঃখ যে আমরা বাঙ্গালিদের তুলনায় পেছনে পড়ে রয়েছি। তার জন্য আমাদের মনে হতাশা। এই হতাশার জন্যই আমরা বাঙ্গালিদের সামনে হীনমন্যতায় জড়োসড়ো হয়ে থাকি । কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের অসমের আহোম রাজত্বের ছয়শো বছরের ইতিহাস অসমিয়া জাতির কাছে এক সোনালি অধ্যায়। সেই সময়ে আমরা প্রবল পরাক্রান্ত মোগল সেনাকে ছয়ত্রিশ বার পরাজিত  করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমাদের জাতীয় বীর লাচিত বরফুকনের গৌরবোজ্জ্বল বীরগাথা বঙ্গের ইতিহাসে নেই। আমাদের গুরু শঙ্করদেব নব বৈষ্ণব ধর্ম বঙ্গের চৈতন্যদেবের আগেই আরম্ভ করেছিলেন। তারপরে আমাদের মাতৃভাষা – স্কুল কাছারি থেকে আমাদের অসমিয়া ভাষাকে বিতাড়িত করে বাংলা ভাষার প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলা ভাষার আগেই ভট্টদেবের হাতে আমাদের অসমিয়া ভাষার গদ্য গড়ে উঠেছিল। তাই আমাদের হতাশার কোনো কারণ নেই। হীনমন্যতায় ভোগে কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই । আহোম যুগের শেষের দিকে ক্ষমতালোভী রাজা এবং উচ্চপদস্থ আমলাদের মধ্যে বিরোধিতার ফলে রাজ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে ইয়াণ্ডাবুর সন্ধির মাধ্যমে বিদেশি ব্রিটিশ শক্তি শাসন ভার গ্রহণ করার জন্যই আমরা পরাধীন হলাম। আমাদের জন্য এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। কিন্তু সেটা ইতিহাস। এখন আমরা, নতুন করে শিক্ষিত হয়ে উঠা যুবকরা ইতিহাসের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং স্বদেশের অতীত  ঐতিহ্য স্মরণ করে অসম মাতৃর উন্নতির জন্য কাজ করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হতে হবে।

তারপরে বক্তৃতার আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে পদ্মনাথ নিজের বক্তব্য শেষ করল।

সে  ভালো বক্তৃতাই দিল। শ্রোতাদের মনে স্বদেশের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হল। চন্দ্রকুমারের সঙ্গে বসা  লক্ষ্মীনাথ দুয়েক কথা বলার জন্য উঠে দাঁড়াবে বলে ভাবল। তখনই পেছন থেকে  বিনন্দ বরদলৈ উঠে দাঁড়াল। বিনন্দ জোড়হাটের প্রখ্যাত উকিল রাধানাথ বরদলৈর পুত্র। সে ইতিমধ্যেই কলকাতার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভা সমিতিতেও সে যোগদান করে। বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে।

প্রিয়  বন্ধুরা – বন্ধু পদ্মনাথ আমাদের অতীত ঐতিহ্যের কথা ব্যাখ্যা তুলে ধরে সেই ঐতিহ্য স্মরণ করে অসম মাতার  উন্নতির জন্য কাজ করার জন্য আমাদের আহ্বান জানিয়েছে । মানছি, আমাদের উন্নতির প্রয়োজন। আমাদের মাতৃভূমি অসমের উন্নতি চাই। কিন্তু আমরা কীভাবে উন্নতি করব ? ধীরে ধীরে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বিনন্দ বলল,' এটাও বলেছে যে ইয়াণ্ডাবুর  সন্ধির আগে আমাদের অসম স্বাধীন ছিল। সেই স্বাধীনতা হারানোর মূলে যে আহোম স্বর্গদেবদের ক্ষমতার লড়াই সেটাও তার বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। তারপরে সন্ধির মাধ্যমে ইংরেজরা শাসনভার নিয়ে অসমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করল। এটাও ইতিহাস।এই ইতিহাসকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তাই ভারতবর্ষের সঙ্গে অসমও  যে এখন ইংরেজদের অধীন এবং ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভবিষ‍্যতের সঙ্গে যে অসমের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ভর করছে – এটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না । দ্বিতীয়ত শাসনকার্য চালানোর সুবিধার জন্য অথবা প্রজারঞ্জনের জন্য স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশরা শিক্ষার জন্য কিছু সুবিধা করে দিল। কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা ঔপনিবেশিক, শোষণমূলক। প্রকৃতপক্ষে তারা আমাদের উন্নতি চায় না। তাই দেশ তথা জাতির উন্নতির জন্য আমাদের স্বরাজের চিন্তাভাবনা করাটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে–।'

মুহূর্তের মধ্যে শ্রোতাদের অধিকাংশের চোখে-মুখে ভয়ের রেখা ফুটে উঠল। বিনন্দ এখানে, অসমিয়া ছাত্রদের এই মেসে,স্বরাজের কথা চিন্তা ভাবনা করাটা অপরিহার্য বলে ঘোষণা করল ! এত সাহস ! লক্ষ্মীনাথের চোখের সামনে ছাত্রনেতা রথীন ঘোষালকে গোরা সিপাহি গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা ভেসে উঠল। 

' বন্ধুরা, আপনারা আমার পূর্ববর্তী বক্তাদের কাছ থেকে অসমের উন্নয়নের কথা শুনলেন– কিন্তু বিশ্ব ইতিহাসের পাতা খুললে দেখবেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি উন্নতির আগে জাতির  অর্থনৈতিক উন্নতির প্রয়োজন। আর এটা সর্বজনস্বীকৃত যে এই অর্থনৈতিক উন্নতির আধার হল জাতির জন্য রাজনৈতিক স্বাধীকার। তাই এখন আমাদের প্রধানতম  দায়িত্ব হল জাতীয় কংগ্রেসে–।'

লক্ষ্মীনাথ আর বসে থাকতে পারল না। কারও দিকে না তাকিয়ে অস্থিরভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,' ভাই বিনন্দ, আমাদের এটা রাজনৈতিক মঞ্চ নয়। এটা আসলে প্রবাসী ছাত্রদের একটি ঘরোয়া সভা। এখানে এই সমস্ত কথা প্রচার করলে আমাদের জন্য বিপদ আসতে পারে। আমরা তো বিপদে পড়বই। আমাদের উদারভাবে সাহায্য করা মেস ম্যানেজার হারাধন সামন্তও রাজশক্তির কোপ দৃষ্টিতে পড়বে।'

'কিন্তু আপনি ভাবেন নাকি আমরা এভাবে থাকলে ইংরেজ আমাদের অসমের উন্নতি করবে?' উত্তেজিত হয়ে বিনন্দ বলে উঠল,' এখনও অসমের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নত করার জন্য রেললাইন পাতা হল না। কোনো শিল্প অথবা উদ্যোগ গড়ে  তুলল না। উচ্চশিক্ষার জন্য অসমে একটিও কলেজ স্থাপন করল না। মোটকথা ইংরেজরা আমাদের উন্নতির কথা ভাবে না। ওদের কাছে আমাদের অসম হল চা পাতা উৎপাদনের একটি বৃহৎ বাগান। তার জন্য বিহার, উড়িষ্যা এবং অন্ধ্র থেকে  লক্ষ লক্ষ জনজাতি মূলের মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে অসমে নিয়ে এল। আর ওদের এনে কী ধরনের অত্যাচার–' ব্লাডি নেটিভ',' সোয়াইন',' সন অফ দি বিচ' ইত্যাদি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, লাথি মেরে, চাবুক মেরে ক্রীতদাসের মতো খাটিয়ে চা পাতার চাষ করছে। আর সেই  চা-পাতা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চালান দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যাপার —।'

' দাঁড়াও, দাঁড়াও ভাইটি– এতটা উত্তেজিত হয়ো না।' পদ্মনাথ উঠে আদর করে বিনন্দকে থামিয়ে দিয়ে বলল,' বন্ধুরা, বিনন্দ যে সমস্ত কথা বলল, সে সব মিথ্যা নয়। এই সমস্ত কথা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু আমরা এখনও ছাত্র। নিজের নিজের বাসগৃহ ছেড়ে এই কলকাতায় রয়েছি। এখানে এসব কথা এত খোলাখুলি ভাবে আলোচনা করলে আমরা যে রাজরোষে পড়তে  পারি– মাননীয় লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার এই আশঙ্কাটা অমূলক নয়। তাই উপস্থিত সকলের হয়ে এই সমস্ত বক্তব্য তুলে ধরা থেকে বিরত থাকার জন্য বিনন্দকে অনুরোধ জানালাম।'

কিন্তু বিনন্দের ক্ষোভ কমল না । সে রাগ করে 'তাহলে এভাবে সভা পেতে এই সমস্ত আলোচনা অর্থহীন' বলে সভা ত্যাগ করতে উদ্যত হল। তাকে সভায় থাকতে অনুরোধ করা হল। কিন্তু ইংরেজ বিদ্বেষটা তার মনে এত বেশি এবং তার জন্য সে ভেতরে ভেতরে এতই উত্তেজিত যে সভায়  থাকাটা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল।

অবশেষে তাকে যেতে দেওয়া হল।

সঙ্গে সঙ্গে সভাস্থলে এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। তখনই চন্দ্রকুমার লক্ষ্মীনাথের  কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল,' বেজ এখন তুমি বল। নিজেকে সংযত রেখে ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারার মতো করে বল।'

লক্ষ্মীনাথও ভেতরে ভেতরে  তৈরি হয়ে উঠেছিল। বন্ধু চন্দ্রকুমারের কথায় উৎসাহিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। প্রত‍্যেকের দিকে তাকাল। অসমিয়ার রাজনৈতিক অধিকারের কথা উল্লেখ করে বিনন্দ 'স্বরাজ' শব্দটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই সদস্যদের অধিকাংশই ভীতগ্রস্ত হয়ে পড়াটা সত্যি। সেটা লক্ষ্য করে লক্ষ্মীনাথ বলতে শুরু করল' অসমপ্রেমী ভাই বন্ধুরা– ইতিমধ্যে কয়েকজন বক্তা আমাদের জন্মভূমি অসম তথা অসমিয়া  জাতির উন্নতির সন্দর্ভে নিজের নিজের মতামত তুলে ধরেছে। আমি তাদের মতামতের আলোচনা করছি না। এমনকি, আমার ভাতৃপ্রতিম বিনন্দ উত্তপ্ত সুরে যে সমস্ত কথা বলল, সেইসবের সমালোচনাও করব না। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে এটা বলতেই হবে যে একটা সময় আমি নিজেও জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে জড়িত ছিলাম । এবং খুব সম্ভব আপনারা জানেন আমি একবার অসমের প্রতিনিধিত্ব করে জাতীয় কংগ্রেসের সর্বভারতীয় অধিবেশনে যোগদান করেছিলাম। তারপর আমি আর কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক রাখিনি। স্বাভাবিকভাবেই আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন, কেন– কেন আমি জাতীয় কংগ্রেস থেকে নিজেকে সরিয়ে আনলাম?

শেষের কথাটা জোর দিয়ে উচ্চারণ করে লক্ষ্মীনাথ সভায় উপস্থিত থাকা সদস্যদের দিকে প্রশ্নটা নিক্ষেপ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল।

প্রত্যেকে প্রশ্নটা নিয়ে নিজের মনে চিন্তা করল। তারপরে তারা উন্মুখ হয়ে লক্ষ্মীনাথের উজ্জ্বল গৌরবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

' আমাদের বিনন্দ অসমের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বলল, অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে রাজনৈতিক স্বাধীকারের কথা উল্লেখ করল– এই সন্ধর্ভে সে আমার বক্তব্যটুকু শুনলে   ভালো ছিল। কিন্তু এই অধমের দুর্ভাগ্য যে সে আমাদের কার্যসূচি শেষ হওয়ার আগেই সভা ত্যাগ করল–।' পরিহাসের সুরে বলেই লক্ষ্মীনাথ পুনরায় গম্ভীর হয়ে পড়ল,' আপনারা আমাদের অসমের অসমিয়া জাতির আজকের অবস্থাটা দেখুন,শতকরা নিরানব্বই  শতাংশ অসমিয়া অশিক্ষিত। ইংরেজদের কল্যাণে শিক্ষার যে কিছুটা প্রসার  হয়েছে, সেটাকেও  প্রকৃত শিক্ষা বলা যায় না। সেই শিক্ষা যে কী ধরনের বিজাতীয় কুশিক্ষা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমাদের নাঙলুচন্দ্র এবং ভোকেন্দ্র বরুয়ার মতো  চরিত্রই তার প্রমাণ। তার চেয়েও বড় কথা হল আমাদের জাতিটা অলস। দুইজন অসমিয়া একসঙ্গে কথা বলা মানেই পরনিন্দা পরচর্চার উত্তাল বন্যা। এই কাজটা না করলে যেন তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। আমাদের জাতির সবচেয়ে বড় ত্রুটি হল এখন, এই যুগেও তাদের আফিং সেবন করতেই হবে। যেন আফিং সেবন না করলে তাদের দিনটাই বৃথা যাবে। আফিঙের নেশায় বিশ্বভুবন ভুলে থাকার মধ্যেই আমাদের অসমিয়া স্বর্গসুখ অনুভব করে। শুনতে খারাপ লাগলেও আমাদের মানতেই হবে যে এটা আমাদের অসমিয়া জাতির একটি জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে পড়েছে। আমাদের সর্ব সাধারণ জনগনের এই অলস, পরশ্রীকাতর, আফিং এর প্রতি আসক্তির জন্যই ক্ষমতার লড়াই করতে থাকা রাজা মন্ত্রীদের একটি গোষ্ঠী লুণ্ঠনকারী মানকে ডেকে আনল, অন্য একটি গোষ্ঠী সেই মানের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ডেকে আনল। রাজপরিবারের এই দুই গোষ্ঠীর মানুষগুলো যে কাপুরুষ,দেশ জাতির কলঙ্ক… সেটা আমাদের জনগণ বুঝতে পারল না। তারপরে ইংরেজরা অসমের স্কুল কাছারিতে বাংলা ভাষা প্রচলন করল– তখন ও আমাদের অলস, আফিঙে  আসক্ত অসমিয়ারা আফিঙের নেশায় কুম্ভকর্ণের মতো গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে রইল। অসমিয়ারা  জানতেই পারল না যে এভাবে বাংলা ভাষা চাপিয়ে দিয়ে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের কতটা ক্ষতি করা হল। তাই আমাদের মূল ত্রুটি রয়েছে আমাদের জাতীয় চরিত্রে। এখন আপনারাই বলুন, এই ধরনের একটি জাতির মগজে অর্থনীতি রাজনীতির তত্ত্ব ঢুকবে কি ? তাদের কাছে এই সবের কোনো অর্থ আছে কি ? আজ বঙ্গদেশে রাজনীতির ঢেউ উঠেছে। উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আদিরা বঙ্গভূমিতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলছে। তার প্রভাব আমাদের বিনন্দের মতো কলেজের একদল ছাত্রের ওপরেও  পড়েছে । এমনকি ছাত্রনেতা রথীন ঘোষালের  মতো একজনকে স্বরাজের পক্ষে বক্তৃতা দিতে গিয়ে কারাবাস খাটতে হয়েছে। কিন্তু আপনারা জানেন কি, আমাদের মতো শিক্ষা-দীক্ষায় পেছনে পড়ে থাকা হীনবল চরিত্রের জাতির পরাধীনতার বিষয়ে সুপ্রসিদ্ধ ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী কি বলেছিলেন–?'

লক্ষ্মীনাথ নিঃশ্বাস নিল। একবার সবাইকে দেখে নিল। না, প্রত্যেকেই তার বক্তব্য আগ্রহ সহকারে শুনছে । আর সে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটির উত্তর শোনার জন্য কৌতুহলী হয়ে পড়েছে।

' ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী বলেছিলেন,'A subject nation has no politics' অর্থাৎ, পরাধীন জাতির রাজনীতি বলে কোনো কিছু নেই। পরাধীন  জাতির রাজনীতির চর্চা করাটা বিড়ম্বনা মাত্র। তার এই মন্তব্য শুনে প্রতিবাদের জোয়ার উঠেছিল । ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতারা বিশেষ করে বোম্বাইর স্যার ফিরোজ শাহ মেহতা, দীনসা য়াচা, মহামতি গোখলে এবং বাংলার সুরেন্দ্রনাথ এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই তারা ব্যারিস্টার চৌধুরীর এই মতের যথার্থতা উপলব্ধি করেছিলেন। এখন আমাদেরও সেই কথার অর্থ উপলব্ধি করতে হবে। সঙ্গে কলকাতায় থাকা আমরা অসমিয়া ছাত্রদের এটাও মনে রাখতে হবে যে রাজনীতি আমাদের রাজ্যের বাইরে। রাজনীতি বাদ দিয়ে এখন আমাদের প্রজা নীতি গ্রহণ করতে হবে। আমাদের আলোচনার বিষয় হতে হবে অসমের জাতি,অসমের সমাজ, অসমের শিক্ষা, অসমিয়া ভাষা, অসমিয়া সাহিত্য, অসমের সংস্কৃতি। এখানে একটি কথা আপনাদের জানাতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি যে মাস তিনেক আগে আমাদের ভাষার অগ্রণী সাহিত্যিক তথা 'আসাম বন্ধু'র সম্পাদক রায়বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি নগাঁও থেকে কলকাতায় এসেছেন শুনেই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন শ্রীবরুয়ার সঙ্গে এই সমস্ত কথাই বলেছিলাম‌। আলোচনার মধ্যে তিনি আমাকে বলেছিলেন, এখন আমাদের অধ্যায়ন করা উচিত। শিক্ষা লাভের জন্য কলকাতায় এসেছি– কলকাতায় বাংলা ভাষা বাংলা সংস্কৃতি কীভাবে এতটা উন্নত হল, অনুসন্ধান করে বিচার করে দেখতে হবে। সঙ্গে, পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শন অধ‍্যয়নের মাধ্যমে আমাদের চেতনাবোধকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। তা করতে পারলেই আমাদের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব এবং সেই নেতৃত্বই অসম তথা অসমিয়া জাতির উন্নতির সোনালি পথ রচনা করবে।'

তারপরে শিষ্টাচার পালন করে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে লক্ষ্মীনাথ নিজের বক্তব্য শেষ করে আসলে বসল।

সবাই শান্ত। নিজের নিজের অসনে স্থির। লক্ষ্মীনাথের বক্তব্য কম বেশি পরিমাণে সবাইকে স্পর্শ করে গেল । প্রত্যেকেই তার বক্তব্য নিয়ে ভাবছে । লক্ষ্মীনাথ কণ্ঠস্বর নামিয়ে চন্দ্রকুমারের  উদ্দেশ্যে বলল 'তুমিও কিছু একটা বল।' 

’ কী আর বলব? তুমি দেখছি আমার মনের কথাই বলে দিয়েছ।'

'তবুও–।'

অবশেষে চন্দ্রকুমার উঠে দাঁড়াল। সে বক্তৃতা দিল না । পূর্ববর্তী বক্তাদের তুলে ধরা বক্তব্যের বিশেষ বিশেষ কথাটুকু উল্লেখ করে শেষে বলল' বিনন্দের সভা ত্যাগ করা ছাড়া আমাদের আজকের এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে বলেই দাবি করতে পারি । আমাদের বিনন্দকে বোঝাতে হবে এবং আশা করছি সে আমাদের মধ্যে একজন হয়েই থাকবে। যাই হোক না কেন, আজ আমাদের শুরু হল। আমরা প্রতি সপ্তাহের শনিবার বিকেলে আমাদের কোনো একটি মেসে এভাবে মিলিত হব। এভাবে মিলিত হয়ে আমরা আমাদের সমস্যাগুলির সঙ্গে অসমের জাতি- ভাষা- সাহিত্য এবং সাম্প্রতিককালের কলকাতার ঘটনাক্রম নিয়ে মতামত বিনিময় করব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এভাবে আমাদের মানসিক উৎকর্ষ বাড়বে এবং আমাদের কর্ম সুফল দান করবে ।'














কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...