বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ, ২০২২

হে আমার স্বদেশ- ৬ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস ।। Hey amar swadesh

 হে আমার স্বদেশ- ৬

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস




  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।



(ছয়)

' দেখিলা পদ্মাক্ষী ,রক্ষঃ সাজিছে চৌদিকে

ক্রোধান্ধ; রাক্ষসধ্বজ উড়িছে  আকাশে, 

জীব–কুলক্ষণ! বাজিছে গম্ভীরে

রক্ষোবাদ‍্য। শূন্যপথে চলিলা ইন্দিরা–

শরদিন্দু নিভাননা–বৈজয়ন্ত ধামে।

বাজিছে বিবিধ বাদ‍্য ত্রিদশ- আলয়ে;

নাচিছে অপ্সরাবৃন্দ; গাইছে সুতানে

কিন্নর; সুবর্ণাসনে দেবদেবীদলে

দেবরাজ, বামে শচী সুচারুহাসিনী

অনন্ত বাসন্তানিল বহিছে সুস্বনে;

বর্ষিছে মন্দার পুঞ্জ গন্ধর্ব চৌদিশে।'

মেসের রুমে বসে লক্ষ্মীনাথ পড়ছিল। তখনই দরজার মুখে একটা শব্দ হল। মাথা তুলে চন্দ্রকুমারকে দেখেই সে উৎফুল্ল হয়ে সাদরে আহবান জানাল। ইতিপূর্বে তার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের আরও কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। একদিন দুজনে ইডেন গার্ডেনে বসেছিল। তারপরে চন্দ্রকুমারের আমন্ত্রণ রক্ষা করে আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে গিয়েছিল। কুঠি  হলেও চন্দ্রকুমার লক্ষ্মীনাথকে আদর করে খাইয়েছিল। সেই দিনগুলিতে দুজনের মধ্যে কত কথা, কত আলোচনা, কত ভাবের বিনিময়। এভাবে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল এবং সম্বোধনটাও আপনি থেকে তুমিতে নেমে এল। চন্দ্রকুমারের কাছে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া হয়ে উঠল বন্ধুবর 'বেজ' এবং লক্ষীনাথের   কাছে চন্দ্র কুমার আগরওয়ালা হয়ে উঠল আদরের 'মাজিউ'।

বিছানায় বসে চন্দ্রকুমার লক্ষ্মীনাথের  হাতের বইটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,'কী পড়ছ?'

' মেঘনাদবধ কাব্য।'

' বাহ ,তুমি মাইকেল মধুসূদনের ভক্ত।'

' ভক্ত মানে ভালো লাগে। যখনই কোনো কারণে মন খারাপ হয় অথবা অস্থির হয়ে পড়ে, তখনই মাইকেলের কাব্য পড়ি।' বীরাঙ্গনা কাব্যও' আমার খুব প্রিয়। কিন্তু আমার বিবেচনায়' মেঘনাদ বধ' সর্বোৎকৃষ্ট। ইস ভাষার কী পুরুষ গম্ভীর লালিত্য! কী ব্যঞ্জনাময় ছন্দ অলংকার! রূপকের কী অপূর্ব প্রয়োগ! আর এখন যে পড়ছিলাম , এই কয়েকটি পঙক্তিতে যে ভাব, এটাই যেন আমার মনের অবস্থা।'

' কবি মাইকেল তাঁর কাব্যে তোমার মনের অবস্থার কথা বর্ণনা করলেন!'

' তার জন্যই মাইকেল এত বড় কবি।' লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বরে আবেগ,'তাঁর কাব্য পড়ে চারপাশে সমস্ত গতিশীল দেখতে পাই, সমস্ত কিছু অপূর্ব সুন্দর দেখি, ধরিত্রীর সবকিছুতেই আনন্দ মুখর হয়ে উঠতে দেখি।'

' তুমি দেখছি রোমান্টিক হয়ে পড়লে!' স্মিত হেসে চন্দ্রকুমার বলল,' এই যে 'রেইজ এণ্ড রায়েট' কাগজ, তুমি রাখ নাকি?'

' হ্যাঁ ,গত মাস থেকে কাগজটার গ্রাহক হয়েছি। এডিটর হলেন শম্ভু নাথ মুখার্জী। সঙ্গে ব্যারিস্টার প্রফেসর এন এন ঘোষের ' ইন্ডিয়ান নেশ‍্যন' কাগজটাও নিতে শুরু করেছি। সেটা অবশ্য এখানে নেই। পাশের ঘরের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বুধীন  পড়তে নিয়েছে ।'

' মানতে হবে। তুমি পড়ছ, সাহিত্য-সংস্কৃতি কলা- দর্শন সমস্ত দিকে জ্ঞান আহরণ করার জন্য চেষ্টা করে চলেছ। '

' একটা সময়ে  ঘুরে বেড়িয়ে সময় নষ্ট করেছি,মাজিউ। প্রথম থেকেই এভাবে শৃংখলার সঙ্গে পড়াশোনা করলে এতদিনে অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারতাম। যাই হোক, এই পত্রিকা দুটিতে খবর ছাড়াও  উচ্চমানের প্রবন্ধাদি প্রকাশ করে। শৈশবের বিষয়বস্তু এবং ল্যাঙ্গুয়েজটা এত ভালো, এত মনোমোহক যে বারবার পড়ি, এভাবে পড়ার জন্য কিছু রচনা মুখস্থ হয়ে যায়। আর জান, আমার এখন এই ধরনের একটি সাপ্তাহিক অসমিয়া- ইংরেজি খবরের কাগজ বের করতে ইচ্ছা করে।'

' তোমার এই ইচ্ছাটা মহৎ। এমনিতেও এখন অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের বিকাশের জন্য আধুনিককালের উপযোগী করে একটি পত্রিকা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।'

' পত্রিকা!'

' মাসিক পত্রিকা। একটি মাসিক পত্রিকা থাকলে আমাদের মতো নতুনদের কবিতা- প্রবন্ধ ছাপানো  যেত।'

চন্দ্র কুমারের প্রস্তাবটা অভিনব। লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,' আচ্ছা ,চা খেয়ে নাও। রঘু–।'

'না, এখন সে মধ্যাহ্ন  নিদ্রায় আচ্ছন্ন।' চন্দ্রকুমার বলল। 'ঘুম থেকে উঠিয়ে তাকে দিয়ে চা করালে সেই চা আর মুখে দিতে পারব না। তার চেয়ে চল, বাইরে বেরোই। ফুটপাতে বিক্রি করা মাটির ভাঁড়ে চা খাব।'

দুজনেই বের হল।

শনিবারের বিকেল। স্কুল কলেজগুলিতে অর্ধেক ছুটির দিন। ইংরেজ সরকারের অফিস কাছারির অফিসার কর্মচারী, উকিল মোক্তাররাও অর্ধ দিবসের ছুটি উপভোগ করে। তাই এখন রাস্তাঘাটে মানুষের ব্যস্ততা কম। গাড়ি মোটরে ভিড়ও কম। মেস থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোতেই এক পাশে একটা রাধাচূড়া গাছের নিচে ফুটপাতে ষোলো বছরের একটি কালো ছেলে মাটির ভাঁড়ে চা বিক্রি করছে। তারা দু'কাপ চা নিল।

' তোমার কাব্যচর্চা কেমন চলছে, মাজিউ?'

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বেজার ভাবে চভদ্রকুমার বলল,' না, বিশেষ কিছুই করতে পারছি না। সেদিন আমাদের কুঠিতে  গিয়ে নিজের চোখে দেখলে, পড়াশোনা করা বা কবিতা চর্চা করার চেয়ে ব্যবসায়ে বেশি সময় দেওয়াটা আমাদের বংশ-পরম্পরা। সেইসব করতে গিয়ে এদিকে কিছুই হয় না। তবু বিচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'

' তোমার দুটি কবিতা' আসাম বন্ধু' কাগজের সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দাও তো।'

' কী যে বল আর! আমার সেসব কবিতা সেই পত্রিকায় ছাপা হওয়ার যোগ্য কি?'

' সেটা তুমি নিজে কীভাবে বিচার করবে? সম্পাদকের বিবেচনায় কে জানে প্রকাশযোগ্য হয়ে যেতে পারে।'

' আচ্ছা, হবে। এবার চল তো।'

চায়ের পয়সা দিয়ে দুজনে ইট  বাঁধানো  পথে এগিয়ে চলল। কিছুদুর যাবার পরই চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করল,' তুমি ১৪/১ প্রতাপ চ্যাটার্জী লেনের অসমিয়া ছাত্রদের মেসে যাও কি?'

' মাঝে মধ্যে যাই। সেখানে সত্যনাথ বরা, দেবীচরণ বরুয়া, কমলাকান্ত বরকাকতী, রাধাকান্ত সন্দিকৈ, গুঞ্জানন বরুয়া, গোপীনাথ বরদলৈ আদি ভালো ভালো ঘরের ছেলেরা থাকে। মেসটা ভালোই। অসমিয়া কালচার নিয়ে প্রত্যেকেই দাদা ভাইয়ের মতো মিলেমিশে ঘরোয়া পরিবেশে থাকে।'

' কলকাতার বিভিন্ন কলেজে পড়া অসমিয়া ছাত্রের সংখ্যা কত হবে বলতো?'

' চল্লিশের কম হবে না।'

' এদেরকে নিয়ে আমরা একটা অ্যাসোসিয়েশন করতে পারি না কি?'

' প্রবাসী অসমিয়া ছাত্র সম্মেলন?'

'হ‍্যাঁ।'

আগে থেকেই এরকম একটি গোষ্ঠী আছে। তবে এখন সেটা এতটা সক্রিয় নয়। তুমি ঠিকই ভেবেছ। আমরা নতুন করে একটা সমিতি সংগঠিত করে তুলতে পারি।'

' মানে কথাটা হল, আমরা সমস্ত ছাত্র কোনো এক জায়গায় সপ্তাহে অথবা পনেরো দিনে একবার জমায়েত হয়ে আমাদের মধ্যেই যদি সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে প্রত্যেকের উপকার হবে, নাকি বল?'

' নিশ্চয় হবে। এই বিষয়ে প্রথমে আমাদের মেসের অসমিয়া কয়েকজন ছেলের সঙ্গে কথা বলে নিই। তারপর তোমাকে সঙ্গে নিয়ে ১৪/১ প্রতাপ চ্যাটার্জী লেনের মেসে যাব। তাদের মধ্যে কয়েকজন উৎসাহী যুবক আছে। আমরা যে কথাগুলি ভাবছি সেগুলি বুঝিয়ে বললে ভালো সাড়া পাওয়া যাবে মনে হয়।মাজিউ, তুমি এত চিন্তা করতে পার, আমাদের অসমিয়া সাহিত্য সম্পর্কে তুমি কি ভাব?'

' বেশ শক্ত প্রশ্ন করলে। তোমার মতো আমি এত অধ‍্যয়ন করিনি। ইচ্ছা থাকলেও ব্যবসা দেখাশোনা করতে হয় বলে পড়াশোনার সময় পাইনা। এই বিষয়ে তুমিই আমাকে বুঝিয়ে বল তো।'

লক্ষ্মীনাথ চুপ। এদিকে রাজপথ দিয়ে গাড়ি মোটর, ঘোড়ার গাড়ি, দুই একটা জুড়িগাড়ি এবং মানুষের টানা রিকশা চলছে। শনিবার বিকেল যদিও এই অঞ্চলে মানুষের ভিড় একটু বেশি। এদিক ওদিক তাকিয়ে সাবধানে পথ অতিক্রম করতে হচ্ছে। রাস্তা পার হয়ে  ফুটপাত ধরে দুজন এগিয়ে চলল। এখনও লক্ষ্মীনাথ চুপ, গম্ভীর। সামনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে চলেছে।

চন্দ্রকুমার লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে পড়ল। যতই এগিয়ে চলেছে ততই লক্ষ্মীনাথের  মুখটা ম্লান হয়ে পড়েছে।

' কী হল, বেজ? তুমি গম্ভীর হয়ে পড়লে?'

' বলছি।' গম্ভীরভাবে লক্ষ্মীনাথ বলল,' চল ঐ পার্কটাতে বসে নিই।'

পার্কটা এত বড় নয়। অবশ্য কলকাতা মহানগরের মাঝামাঝি জায়গায় এরচেয়ে বড় পার্ক আশা করা যায় না। বিকেল হতে বাকি আছে বলে বেড়াতে আসা মানুষের ভিড় কম। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পার্কের দোলনায় উঠে খেলছে। কলকাতা নগরের পৌর অধিপতির দ্বারা পার্কটার রক্ষণাবেক্ষণ মোটামুটি ভালোই বলতে হবে। ভেতরে ঢুকে দুই বন্ধু বকুল গাছটার নিচে কাঠের বেঞ্চটাতে বসল।

'মাজিউ, তুমি যে কতটা জানতে চাইছ– এই বিষয়ে আমিও এত ডিটেইলস অধ্যয়ন করিনি।' লক্ষ্মীনাথ বলতে লাগল,' তবু এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, শঙ্করদেব- মাধব দেবের পরে আমাদের সাহিত্যে সেরকম কোনো উল্লেখনীয়   কবি সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করে নি। আর করবেই বা  কীভাবে? আহোম রাজত্বের শেষের দিকে কুশাসনে অসমিয়া জাতির কোমর ভেঙ্গে পড়ল। তারপরে মানের আক্রমণে অসমিয়া জাতি শেষ হয়ে যাচ্ছিল। শেষে ইংরেজির মাধ্যমে অসময়ে বাংলা ভাষার প্রচলন করার জন্য ভাষা সাহিত্যের উপর কুঠারাঘাত করা হল। পরবর্তী সময়ে যেভাবে যা হল… মানে পুনর্জাগরণ, তার ফলে আমাদের অসমিয়া ভাষায়  কোনো মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টি হল না বলে বলাই যেতে পারে।'

চন্দ্রকুমার নীরব। শান্ত।

' কথাটা হল, শঙ্করদেব- মাধবদেবের পরে অনন্ত কন্দলী ভাগবতের মধ্য দশম এবং শেষ দশম স্কন্ধ অনুবাদ করেন। রাম সরস্বতীর মহাভারতের অসমিয়া  অনুবাদ ও একটি উল্লেখযোগ্য অবদান, ভট্টদেব অসমিয়া গদ্য সাহিত্যের জন্মদাতা, নাথন ব্রাউন,মাইলস আনন্দরাম  অসমিয়া ভাষার পুনর্জীবন দান করাটাও অসমিয়া ভাষা ধরে রাখার জন্য হেমচন্দ্র বরুয়া ব্যাকরণ রচনা করে মহত্বপূর্ণ অবদান রাখলেন এবং আমাদের গুণাভিরাম অসমিয়ার জন্য ইতিহাস রচনা করে অসমিয়াদের ঐতিহ্য সচেতন করাল। কিন্তু যে অর্থে মাইকেল মধুসূদনের 'মেঘনাদ বধ' কাব্য অভিনব, নতুন চিন্তাধারায় মহান এবং কাব্যিক অভিব‍্যঞ্জনায় ব্যঞ্জনাময়– সেই ধরনের সাহিত্য আমাদের ভাষায় কিছু সৃষ্টি হয়েছে কি? তাছাড়া বাংলা ভাষায় শুধু এই কাব্যই একমাত্র মৌলিক সৃষ্টি নয় । মাইকেলের বীরাঙ্গণা অন্য একটি উল্লেখযোগ্য এবং অভিনব পত্রকাব্য । তারপরে দীনবন্ধু মিত্র, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, প্যারীচাঁদ মিত্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রমেশচন্দ্র দত্ত…এদের  ছাড়া রোমান্টিক চেতনায় বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা, নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতিতে রচনা করা রবিবাবুর কবিতা গুলি…না,মাজিউ, এসবের তুলনায় আমাদের সাহিত্যে বিশেষ কিছুই সৃষ্টি হয়নি। আমরা পেছনে পড়ে রয়েছি। অনেক পেছনে পড়ে রয়েছি। সত্যিই অসমিয়া হয়ে আমাদের আজকের অসমিয়া সাহিত্য নিয়ে গর্ব করতে পারি না। গর্ব করার মতো আমাদের বিশেষ কিছুই নেই।'  

লক্ষ্মীনাথের কন্ঠস্বর আড়ষ্ট হয়ে এল। যেন  অপরিসীম গ্লানি আর অবসাদে তার অন্তর ভেঙ্গে পড়ছে।

চন্দ্রকুমার একদৃষ্টে লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে বিষাদ বেদনায় গভীর আবেগকে সামলে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' মাস দুয়েক আগে আমি একদিন গুণাভিরাম বরুয়ার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গেও আমার ভাষা সাহিত্যের অতীত-বর্তমান নিয়ে অনেক কথা আলোচনা হয়। শ্রী বরুয়া তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের বিকাশ না হওয়ার কারণগুলি ব্যাখ্যা করে শেষে তিনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন।'

' কী কথা?'

' আমাদের ভাষা এবং সাহিত্য এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে, বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্য এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য অধ্যয়ন করতে হবে। সঙ্গে তিনি এটাও বলে আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এই ক্ষেত্রে আমরা সংকীর্ণ বা অনুদার  হলে আমাদের বিকাশ হবে না। তার জন্যই আমি পড়তে শুরু করেছি। পড়ছি। ভবিষ্যতে আরও অনেক পড়াশোনা করতে হবে।'

' এত পড়াশোনা করছ, তার মানে তোমার সামনে নিশ্চয় কোনো পরিকল্পনা রয়েছে?'

' পরিকল্পনা– নেই, এখনও সেরকম কোনো পরিকল্পনা করিনি।'

' তবু?'

' আসলে, আমি যেন এখনও অনুসন্ধান করে চলেছি। অধ্যয়নের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করছি। জ্ঞান অভিজ্ঞতায় ধনী হতে পারলেই ভাষা সাহিত্যের জন্য কিছু একটা করার পরিকল্পনা নিতে পারব। এই সন্দর্ভে  মাইকেলের ভাষায় বলতে গেলে–

' গাথিব নতুন মালা, তুলি সযতনে

তব কাব‍্যোদানে  ফুল; ইচ্ছা সাজাইতে

বিবিধ ভূষণে ভাষা; কিন্তু কোথা পাব 

(দীন আমি) রত্নরাজি, তুমি নাহি দিলে,

রত্নাকর? কৃপা, প্রভু ,কর অকিঞ্চনে।'

গরমের ছুটিতে অনেকদিন কলেজ বন্ধ থাকে। এই সময় কলকাতায় গরমের প্রকোপটা সত্যিই অত্যধিক। বিশেষ করে দুপুরের সময়টা অসহনীয় হয়ে ওঠে। লক্ষ্মীনাথ বহুদিন বাড়িতে যায়নি। এবার কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে বেশ স্ফুর্তি করে অসমে এল। জন্মভূমি অসম মানেই সবুজ প্রকৃতির বিনন্দীয়া পরিবেশ, শান্ত সুনিবিড় অনাড়ম্বর জনজীবন। বাড়িতে বাবার কর্মোদ্যম কমেনি যদিও আগের মতো আর সমর্থ নন। মায়ের কোমর এবং হাঁটুতে বাতের ব্যথা। এখন দুই বৌদি মিলেই ঘর সংসার সামলাচ্ছে। এদিকে ভাই লক্ষ্মণ বাবার কাছ থেকে আয়ুর্বেদ শিখে নিয়েছে। সে অসুখ-বিসুখে ওষুধপত্র দিচ্ছে। বাড়ির সব কিছুই ঠিকমতো চলছে দেখে লক্ষ্মীনাথের  ভালো লাগল।

কিন্তু এক সপ্তাহ পার না হতেই লক্ষ্মীনাথ অস্থির হয়ে পড়ল। গত দেড় বছরে কলকাতার পরিবেশ, কলকাতার গতিশীল জীবন, কলকাতার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবন, কলকাতায় থেকে পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শনের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ… এইসব শিবসাগরে নেই। গত কয়েকদিন মা এবং দুই বৌদি পছন্দের নানা রকম রান্না রেঁধে খাইয়ে তার ভোজন রসনা তৃপ্ত করল, শিবসাগরের সম্মানীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের শুভেচ্ছা- ভালোবাসা পেলাম; কিন্তু কেউ মানসিক বৌদ্ধিক ভাবে তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারল না। তার জন্যই সে দ্রুত আবার কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।

মা-বাবা, দাদাভাই এবং আত্মীয়-স্বজনদের বিদায় জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসাটা সবসময়ই বেদনাদায়ক। বিশেষ করে, বিদায় মুহূর্তে মায়ের চোখের জল… এই চোখের জল অনেক সময় এরকম অব্যক্ত বেদনা সৃষ্টি করে যে সেও এক সময় নিজেকে সামলাতে না পারা হয়ে পড়ে, বুদ্ধি জ্ঞানে এগিয়েও অসহায় অনুভব করে। এবারও সেটাই হল। তারপরে জাহাজে বসে ব্রম্মপুত্রের দুই কুলের অসম মাতার উদার প্রকৃতির মধ্যে দৃষ্টি সম্প্রসারিত করে সেই কষ্ট- মন খারাপ থেকে অব্যাহতি পেতে চায়। কিন্তু এবার সেটা হল না। উল্টো তার মনটা নিদারুণ এক গ্লানিতে ভারী  হয়ে উঠল এবং এবার এই অসমে থেকেই সে অনুভব করল, অসম সত্যিই অনুন্নত। অনেক দিক থেকেই অসমিয়া জাতি পেছনে পড়ে রয়েছে।… আর এই যে কলকাতায় লেখাপড়া শিখছে, এত অধ্যয়ন করছে, সে কি স্বদেশ এবং স্বজাতির জন্য কিছু করতে পারবে? তার কি সেরকম শক্তি আছে?

অসম থেকে কলকাতায় আসার পরেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। একনাগাড়ে কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি। এভাবে বৃষ্টি পড়ার জন্য গরম কিছুটা কমল। এখনও কলেজ খুলেনি। মেসে থেকে লক্ষ্মীনাথ বইপত্র পড়তে শুরু করল। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি বই পত্র সংগ্রহ করে আনল। বই পড়ার সঙ্গে নতুন একটা নেশা তাকে ভালোভাবে পেয়ে বসল। এটা হল কলকাতার থিয়েটার হলে গিয়ে থিয়েটার দেখা।

কলকাতার স্টার, বেঙ্গল এবং ন্যাশনাল বিখ্যাত থিয়েটার গোষ্ঠী। শৈশবে লক্ষ্মীনাথ ভাওনা নাটক দেখতে ভালোবাসত। লক্ষ্মীমপুরে থাকার সময় বাবা মাজুলি থেকে মানুষ ডেকে এনে অংকীয়া ভাওনা অনুষ্ঠিত করিয়েছিল। উৎসাহের সঙ্গে সেই ভাবনা দেখে বহুদিন পর্যন্ত লক্ষ্মীনাথ ভাওনার বচন আওড়াত। ভাওনাগুলি ছিল রামায়ণ-মহাভারতের উপকথাকে ভিত্তি করে পৌরাণিক । কিন্তু কলকাতার এইসব থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হওয়া অধিকাংশ নাটকই সমকালীন সমাজ নিয়ে আধুনিক । মনোরম মঞ্চসজ্জার সঙ্গে আবহসংগীত, নৃত্য গীত, অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে উঠা নাটক উপভোগ করতে গিয়ে কীভাবে যে তিন চার ঘন্টা সময় পার হয়ে যায়, বুঝতেই পারা যায় না । শনিবার এলেই সকালের খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে ঠিক করে নেয় কোন থিয়েটার হলে যাবে। দুপুরবেলা মেস থেকে বেরিয়ে বাসে করে নির্দিষ্ট হলের সামনে নেমে টিকিট কেটে হলে ঢুকে বিকেল চারটা থেকে আরম্ভ হওয়া অভিনয় উপভোগ করে। কোনো কোনো দিন একনাগাড়ে একাধিক নাটক দেখে। একটার পর একটা নাটক দেখে পরের দিন সকাল বেলা মোরগ ডাকা ভোরে থিয়েটার হল থেকে বেরিয়ে আসে। অসমে এই ধরনের আধুনিক থিয়েটার হল নেই। এখনও অসমে চলছে সেই পুরোনো কালের ভাওনা। সঙ্গে চলছে বাংলা যাত্রা অথবা বাংলা নাটকের নকল করে অসমিয়াতে লেখা কিছু যাত্রা। তারমানে নাট্যসাহিত্য তথা পেশাদারী অভিনয়ের ক্ষেত্রে অসম অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে।… এটাও লক্ষ্মীনাথকে কষ্ট দেয়। অসমে কুলীনকুল সর্বস্ব, নীলদর্পণ, শর্মিষ্ঠা, বিয়ে পাগলা বুড়ো, জামাই বারিক, প্রণয় পরীক্ষার মতো নাটক সৃষ্টি হবে না নাকি?

যাই হোক না কেন, বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল বৃষ্টির ভাব কমে এসেছে। এদিকে তিনটা বাজে। তাই লক্ষ্মীনাথ হাতের  বইটা বন্ধ করে রেখে প্রস্তুত হয়ে নিল। নাটক দেখতে যাবে– তখনই ঘরে প্রবেশ করল হেমচন্দ্র। তার দিকে লক্ষ্মীনাথ তাকিয়ে বলল,' কী হল হেম গোঁসাই, এত বিরস বদন!'

' আমি আর ওই মেসে থাকি না, বেজ।' হেমচন্দ্র বলল,' অন্য কোন মেসে আমার জন্য একটু ব্যবস্থা কর। পারলে তোমাদের এই মেসে–।'

' আমাদের মেসে হবে না।' লক্ষ্মীনাথ বলল, আমাদের রাখাল ভৌমিকের ম্যানেজারি ভালো। অন্যান্য মেসের তুলনায় এখানে আহারের মান উন্নত। ম্যানেজারের কড়া শাসনের জন্য চাকর চাকরানীরা আমাদের প্রতি অনুগত। এখানে  থাকার জন্য আবেদন জানানো এগারোজনের নাম  ওয়েটিং লিস্টে রয়েছে।'

' কিন্তু আমি যে আর রুমমেটের অত্যাচার সহ্য করতে পারছিনা। এমনিতেই  তার কিছু খারাপ স্বভাব রয়েছে। এখন সে বোতল ধরেছে। বাইরে থেকে মদ খেয়ে এসে রুমের ভেতরে উৎপাত করতে শুরু করেছে।'

হেমচন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথের খারাপ লাগল। থিয়েটারে যাবার কথাটা চাপা পড়ে গেল।

' তুমি এখন কোথাও বেরোচ্ছ নাকি?'

মুচকি হেসে লক্ষ্মীনাথ বলল,' নাট‍্য রস পান করার জন্য স্টারের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি। তা তোমার নাটক শুনে আর কীভাবে যাই?' চল–।'

' কোথায়?'

' দেখি তোমার সমস্যার একটা সমাধান করা যায় কিনা?'

হেমচন্দ্রকে  সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ ১০  নম্বর আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে এল। বাজার এলাকা পার হয়ে এটা একটা প্রায় জনমানবহীন ঠাঁই। ইট, বালি ,লোহা লক্করে পরিবৃত্ত দীর্ঘ একটা ঘরের সামনে এসে দেখল বন্ধ দুয়ারে মস্ত তালা। হতাশ লক্ষ্মীনাথ সেখান থেকে ফিরে পুনরায় হাঁটতে লাগল। হেমচন্দ্র তাকে অনুসরণ করল। দ্রুত হেঁটে তারা এল ইডেন  গার্ডেনে। ইতিমধ্যে সূর্য পশ্চিমে অস্ত গিয়েছে। ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকার নেমে এলেও পুব আকাশে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না নিয়ে শুক্লপক্ষের চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

এটাই কলকাতার বিখ্যাত ইডেন গার্ডেন। স্বর্গ উদ্যান। মহানগরের মাঝখানে বিশাল এলাকাজুড়ে গাছপালায় সমৃদ্ধ মনোরম ঠাই । কর্মব্যস্ত দিনের ক্লান্তি, দিনযাপনের  একঘেয়েমির অবসাদ নিরাময় হয় নন্দনকাননের এই মুক্ত পরিবেশে। তাছাড়া বড় বড় গাছের নিচে থাকা বেঞ্চগুলিতে মনের মিল থাকা মানুষের সঙ্গে বসে মনের কথা বলা যায় ,বিশ্রাম নিতে নিতে  ভবিষ্যত জীবনের স্বপ্ন রচনা করতে পারা যায়। গত এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হওয়ার পরে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না  ইডেন গার্ডেনের উপরে গলে গলে পড়ছে। হিমের পরশ মাখানো মৃদুমন্দ বাতাস একঝাঁক বয়ে চলায় পরিবেশটা অধিক মনোরম, অধিক উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। তার জন্যই বিকেল থেকেই মানুষের ভিড়। এই ভিড়ের মধ্যে লক্ষ্মীনাথ তার প্রিয় বন্ধু চন্দ্রকুমারকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কুঠিতে পেল না যখন চন্দ্রকুমারকে ইডেন গার্ডেনে পাওয়া যাবে বলে তার বিশ্বাস। তবে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খুঁজেও কোথাও তাকে দেখতে পেল না। চন্দ্রকুমার তাহলে গেল কোথায়? অবশেষে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে পাশের বেঞ্চটার  দিকে এগিয়ে গেল। বেঞ্চটিতে একটিমাত্র মানুষ বসে  রয়েছে। মানুষটা বেঞ্চের উপরে পা দুটি তুলে দিয়ে তন্ময় হয়ে আকাশের পাতলা মেঘের মধ্যে দ্বাদশীর চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখছে।

বেঞ্চটাতে বসতে গিয়ে যুবকটির মুখের বাঁ দিকটা তার কেমন যেন পরিচিত মনে হল। আরেকটু হেলে দেখেই লক্ষ্মীনাথ চিৎকার করে উঠল,'মাজিউ!'

পরিচিত ডাকশুনে চন্দ্রকুমারও উৎফুল্ল হয়ে উঠল,'বেজ, তুমি! একা একা বসে তোমার কথাই ভাবছিলাম।'

' আমিও তোমাকেই খুঁজছি। তোমাদের কুঠিতে গেলাম। কুঠির দরজায় তালা দেখে ভাবলাম, আবহাওয়া ভালো এবং জ‍্যোৎস্না রাত যখন আমাদের মাজিউ নিশ্চয় লাভার্স ল্যান্ডেই থাকবে। এখানে এসে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে বেঞ্চটাতে কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিয়ে মেসে ফিরে যাব বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর কী সুন্দর আমাদের মিলিয়ে দিলেন।'

' একেই বলে আন্তরিক টান।' মুচকি হেসে চন্দ্রকুমার বলল,' তোমার সঙ্গের ওকে তো চিনতে পারলাম না?'

' হেমচন্দ্র গোস্বামী। আদরের হেম গোঁসাই। লক্ষ্মীনাথ বলল গোলাঘাটে এর বাড়ি যদিও স্কুলের পড়াশোনা নগাঁও। এন্ট্রান্স পাশ  করে আমাদের মতোই কলেজে পড়ার জন্য কলকাতা এসেছে । আর হেম গোঁসাই,এ  হল আমার মাজিউ। তেজপুরের  হরিবিলাস আগরওয়ালার মেজ ছেলে বলে আমি তাকে মাজিউ নামে ডাকি। আসলে, ওর নাম হল চন্দ্র কুমার আগরওয়ালা।'

চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্র সহাস‍্যে নমস্কার বিনিময় করল।

'মাজিউ, শুনে সুখী হবে, তোমার মতো হেম গোঁসাই ও কাব্য সরস্বতীর একজন বিনম্র উপাসক। লক্ষ্মীনাথ বলল তোমাদের মধ্যে কাব্য ভাব এবং কাব্য অনুভবের আদান-প্রদান হবে। তোমাদের দুজনের ভালো মিল হবে।' 

লজ্জা মিশ্রিত মুখে হেমচন্দ্র বলল ,না, বেজ যতটুকু বলেছে আমি ঠিক তার যোগ্য নই । কবিতা লেখাটা একটা নেশা । সামান্য চর্চা করি ।'

' অসম থেকে কলকাতায় পড়তে আসা সমস্ত ছাত্রই কম বেশি পরিমাণে কবিতা বা প্রবন্ধ লেখে, সাহিত্যচর্চা করে।' চন্দ্রকুমার মন্তব্য করল,' এখন মনে পড়ছে আপনি 'আসাম বিলাসিনী' তে একটা কবিতা লিখেছিলেন' ইংরাজ আহিছে, ভাপর নাও '।'

একটা সাধারন কবিতার কথাও এভাবে মনে রেখেছে। হেমচন্দ্র চন্দ্রকুমারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। কিন্তু তার লজ্জার ভাবটা বেড়ে গেল। সে লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখে। কাউকে জানতে   না দিয়ে সেইসব কবিতা কাগজের সম্পাদককে পাঠিয়ে দেয়। ছাপার অক্ষরে বেরোলে নীরবে বসে কাগজের পাতা উল্টে দেখে। নিজের কবিতা বারবার দেখেও তার আশ মেটেনা।

' ব্যতিক্রম কেবল এই শর্মা।' নিজের বুকে হাত রেখে লক্ষ্মীনাথ বলল,' এই শর্মা এখনও সাহিত্যের কোনো কাজে হাত দেয়নি।'

' ব্যতিক্রম বলে বললেও পরবর্তীকালে যে বড় কিছু একটা করবে, এটা কিন্তু একেবারে ধ্রুব সত্য।' জ্যোৎস্নার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠা লক্ষ্মীনাথের  দিকে তাকিয়ে চন্দ্রকুমার বলল।

' আপনি ঠিকই বলেছেন।' হেমচন্দ্র বলল,' বেজ কিছু একটা নিশ্চয় করবে। যাই হোক না কেন, আমাদের এই লেখালেখির ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের প্রভাব একটি বড় ফ্যাক্টর। তাছাড়া অসম থেকে এত দূরে রয়েছি, প্রবাসী জীবনের গৃহ কাতরতাও আমাদের কাব্যচর্চার জন্য অবদান জোগায়।'

সামনে দিয়ে বাদাম বিক্রি করা একজন ফেরিওয়ালা গেল। পেছনদিয়ে নববিবাহিত দম্পতি পার হয়ে গেল। তারা একে অপরকে নিয়ে কথাবার্তায় এতই মগ্ন যে এদিকে ওদিকে কার ও দিকে তাকায় নি। আকাশের চাঁদ একখণ্ড মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ইডেন গার্ডেনের উপরে রাতের কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়ল। তা বলে কেউ বেঞ্চ ছেড়ে উঠল না। কথাবার্তা বন্ধ করে চুপ করে রইল না।

নীরব কেবল অসম থেকে কলকাতায় পড়তে আসা তিন জন যুবক।

লক্ষ্মীনাথ, চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্র।

'মাজিউ–।'

অবশেষে লক্ষ্মীনাথ নীরবতা ভাঙল,' আমি কিন্তু হেমকে সঙ্গে নিয়ে বিশেষ এক দরকারে তোমার কুঠিতে গিয়েছিলাম।'

' বলতো কি দরকার?'

' অসম থেকে আসার পরে আমি হেম গোঁসাইকে মির্জাপুরের একটা মেসে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমারই কপাল খারাপ যে তার রুমমেটটা একটা অসভ্য। ডিব্রুগড়ের দিকের টী প্লেন্টার্সের ছেলে। কী তার ঢং। মুখ দিয়ে অসমিয়া কথা বের হয় না। অসমিয়া নাকি একটা ভাষাই নয়। চালচলনে বাঙালি ঢং। টেরি কাটা চুল। মুখে জর্দা পানের মলমলে গন্ধ। এদিকে পড়ার নামে অষ্টরম্ভা। তাছাড়া উৎপাত, এখন নাকি বোতল ও ধরেছে। বিদেশি পানীয় না হলে ছেলের নাকি ঘুম আসে না। এরকম একটি পরিবেশে নিরীহ, একেবারে সাত্বিক হেম গোঁসাই থাকতে পারে কি? এদিকে আমাদের মেসে সিট নেই। দিন চারেকের জন্য যদি তোমার সঙ্গে রাখ–।'

চন্দ্রকুমার বলল,' আমার সঙ্গে থাকতে পারবে। কিন্তু গোঁসাই মানুষ, খাওয়া-দাওয়াটা–'

' আরে, তোমরা মূলত রাজস্থানের মানুষ। নিরামিষ খাও। হেম খেতে পারবে।'

' তারপরে, একটা কথা–?'

'কী কথা?'

' সেই যে সপ্তাহে বা পনেরো দিনে একদিন অসমের সমস্ত ছাত্র একসঙ্গে বসে আলোচনা করার কথাটা–।'

' এই বিষয়ে ইতিমধ্যে আমি কথা বলেছি।১৪/১ প্রতাপ চ্যাটার্জি মেসে থাকা সবাই একমত । আমাদের মেসের অসমিয়া ছেলে কেবল আমরা তিনজন । আমাদের মধ্যে কথা হল। কলেজ স্ট্রিটে  অসমিয়া ছাত্র থাকা ‌ আর ও দুটো মেস আছে । তার একটাতে গিয়ে সত্যনাথ বরা কথা বলবে । অন‍্যটাতে  আমি নিজে যাব।'

' তাহলে সবারই সহযোগিতা পাব?'

' এখনই বলতে পারিনা। আমরা অসমিয়া। আমরা দেরি করে ভাবি, আমাদের চেতনা বোধ ও দেরি করে জাগে।'
























কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...