হে আমার স্বদেশ- ১২
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(১২)
এম এ এবং বি এল পড়ে কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হবে বলায় পিতা দীননাথ অন্তর থেকে লক্ষ্মীনাথকে পুনরায় কলকাতা যাবার অনুমতি দিলেন। কিন্তু বৌদিদের সঙ্গে মা ঠানেশ্বরী যে বিয়ে করার জন্য এত করে বললেন – লক্ষ্মীনাথ তা মেনে না নেওয়ায় তাঁরা দুঃখ পেলেন । তাদের অনুরোধ রক্ষা করতে না পারার জন্য লক্ষ্মীনাথেরও খুব মন খারাপ হল। বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে কলকাতা আসার পথে এই কথাটাই তাকে খুব চিন্তিত করে তুলল। বাড়ির মহিলাদের মধ্যমণি হয়ে মা তার বিয়ের কথাটাকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী? কোনো একজন নারীকে পত্নী রূপে গ্রহণ করাটা অপরিহার্য কি? তাছাড়া এই যে গত এক বছর ধরে যেখানেই যায়,সেখানেই তার বিয়ের কথাটা নিয়ে এত আলোচনা হয়, রুপসী কন্যার অভিভাবকরা তাদের কন্যার জন্য তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয়– এটা আর কতদিন পর্যন্ত প্রতিরোধ করতে পারবে?
এইভাবে ভেবে লক্ষ্মীনাথ জাহাজের কেবিনে ঘুমে ঢলে পড়েছিল। কতক্ষণ পর্যন্ত এভাবে শুয়ে রইল বলতে পারে না। একসময় ঘুমটা হালকা হয়ে এল। এরকম মনে হল যেন কলকাতার রাজপথ দিয়ে একটা জুড়িগাড়ি যাচ্ছে। সকালের জনমানবহীন প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে যাওয়া ঘোড়ার খুরের ঠকঠক এবং ঘুঙ্গুরের ঝুনঝুন শব্দে মধ্যম গতিতে যেতে থাকা একটি জুড়িগাড়ি । এই গাড়িটার জানালার পাশে বসে রয়েছে একজন অপরূপা যুবতি… তার কেবল মুখটা দেখা যাচ্ছে… এটা স্বপ্ন, একই স্বপ্ন সে আগেও একবার দেখেছিল। কিন্তু এবার যুবতিটির মুখটা আরও স্পষ্ট করে, আগের বারের চেয়ে বেশি মনোমোহা রূপে দেখতে পেল। তার মানে মুখে প্রতিরোধ করলেও তার অন্তর নিজের অজান্তে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছে নাকি ? নাকি একটা স্বপ্ন বারবার দেখার অন্য কোনো কারণ আছে?
জাহাজের ভোঁ ভোঁ শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। জেগে উঠে স্বপ্নটার কথা ভেবে ভালো লাগল। স্বপ্ন নিয়ে খুব একটা বিচার-বিশ্লেষণ করল না । থাকুক, এটা আমার মনের মধ্যেই থাকুক। স্বপ্ন দেখার কারণ বিশ্লেষণ করার চেয়ে স্বপ্ন দেখার আমেজটা সুখদায়ক।
কলকাতায় এসে একদিন বিশ্রাম নিল। পরের দিন প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়ে নাম লেখাল। রিপন কলেজের ল ক্লাসেও নাম ভর্তি করল। লক্ষ্মীনাথের উদ্দেশ্য হল, এক গুলিতে দুই পাখি মারা। এদিকে লক্ষ্য যেহেতু হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হওয়া – তার জন্য প্রথিতযশা উকিল একজনের খোঁজ করল। কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান উকিল টুইডেল সাহেব এইরকম একজন উকিল। তার সঙ্গে দেখা করে কথাটা বলায় তিনি রাজি হলেন এবং তিনি খুব আদর করে লক্ষ্মীনাথকে আইন-আদালতের কাজ শেখাতে লাগলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা এটাই যে, ছয় মাস পরেই বৃদ্ধ টুইডেল সাহেব ইহলোক ত্যাগ করলেন। তারপর হাইকোর্টের অন্য একজন বিখ্যাত উকিল দিগম্বর চ্যাটার্জির আর্টিকেল ক্লার্ক হলেন। পরে লক্ষ্মীনাথের এমনই ভাগ্য যে এডভোকেট চ্যাটার্জী হাইকোর্টের জজের পদে বহাল হলেন। তবু লক্ষ্মীনাথ হতাশ হল না। বি এন পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে লাগল এবং প্রতিদিন হাইকোর্টে গিয়ে জজের মোকদ্দমার বিচার উকিল ব্যারিস্টারদের বক্তৃতা এবং সওয়াল জবাব ইত্যাদি মনোযোগের সঙ্গে শুনতে লাগল।
এদিকে ‘জোনাকী’র কাজ পুর্ণ গতিতে চলছে । দুটো কলেজে গিয়ে ক্লাস, প্রতিদিন হাইকোর্টে যাওয়া… লক্ষ্মীনাথ জোনাকীর জন্য আগের মতো সময় দিতে পারে না। তা বলে লেখা বন্ধ হয়নি। সম্পাদনা, প্রেসে গিয়ে প্রুফ দেখা কাজে চন্দ্রকুমারকে সাহায্য করছে হেমচন্দ্র। নিজে সম্পাদক না হলেও সম্পাদনার কাজে সাহায্য করার ক্ষেত্রে পরিশ্রমী হেমচন্দ্রের কোনো তুলনা হয় না। অন্যদিকে, আরও একটি বড় খবর হল, চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে রায়বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়া ন়়গাঁও থেকে কলকাতা চলে এলেন। তিনি এখন স্থায়ীভাবে কলকাতায় থাকবেন। লক্ষ্মীনাথ তার সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবল। আগন্তুক অ.ভা.উ.সা. সভার সভায় শ্রী বরুয়াকে সভাপতি হিসেবে ডাকবে। তিনি এলে অ.ভা.উ.সা সভার সদস্যরা অনুপ্রাণিত হয়ে উঠবে এবং তাঁর লেখনীতে জোনাক ও সমৃদ্ধ হবে।
এভাবে ভাবতে ভাবতেই লক্ষ্মীনাথ দুই নম্বর ভবানীচরণ দত্ত লেনের মেসে এল। রুমে ঢোকার পরেই চন্দ্রকুমার প্রবেশ করল। তাঁর মুখে অর্থপূর্ণ হাসি। চোখজোড়া কী এক কৌতুকে তিরবির করছে। অন্যদিনের মতো সে সামনের বিছানায় বসে নি। জোনাকীর কোনো লেখক বা কবির প্রসঙ্গ তুলল না। বরঞ্চ লক্ষ্মীনাথের দিকে যতই তাকাচ্ছে ততই তার ঠোঁটের হাসিটা কৌতুক পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
'মাজিউ, তুমি যেটা করছ! অবাক হয়ে লক্ষ্মীনাথ জিজ্ঞেস করল ,' কথাটা কী বলতো?'
চন্দ্রকুমার বলল না। মেসের কোঠার ছোট মেঝেতে ঘুরে ঘুরে পায়চারি করে লক্ষ্মীনাথকে দেখতে লাগল।
' এভাবে দেখছ, যেন আমি আশ্চর্য কোনো জীব।'
' আশ্চর্য জীব নয়। তুমি অচিনপুরের অনিন্দ্যসুন্দর রাজকুমার।'
' এতটা কাব্য কর না তো। কথাটা কী, বল'
' এমনিতেই বলব নাকি? কথাটা বলতে হলে ভালো একটা পরিবেশ লাগবে। সঙ্গে আমাকে ভরপেট মিঠাই খাওয়াতে হবে।'
' আমি ভাবলাম, ব্যবসা সংক্রান্ত কথা বলার জন্য বাবা কর্মচারীটিকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। আর্জেন্ট বলায় জোনাকীর কাজ ফেলে রেখে তক্ষুনি গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু ব্যবসার কথা নয়। আমি দেখতে পেলাম, আমাদের গদিতে বাবার সঙ্গে বৈকুণ্ঠনাথ দত্ত মহাশয় বসে রয়েছেন।'
' বৈকুণ্ঠনাথ দত্ত!'
তুমি তো তাকে চেনো।'
' সেই ক্ষীণ চেহারার নিরীহ যেন মনে হওয়া বয়স্ক মানুষটি?'
'হ্যাঁ, তিনি আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই আসেন। বাবার সঙ্গে বসে সুখ-দুঃখের কথা বলেন। আসলে তিনি একজন ঘটক।'
' ঘটক!'
' মানে বিয়ে-সাদির সম্বন্ধ করে বেড়ানো মানুষ। বাংলায় যাকে ঘটকালি করা বলা হয়।' চন্দ্রকুমার বলল, এই ব্যক্তি, মানে বৈকুণ্ঠনাথ দত্ত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে ঘুরে বেড়ানো মানুষ। ঠাকুরবাড়িতে যে ব্রাহ্ম ধর্মের উপাসনা হয়, সেই উপাসনার ব্যবস্থাপনাতেও তিনি সাহায্য করে থাকেন।'
' আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু তার সঙ্গে তোমার কিসের কথা হতে পারে বলতো?'
' সেটাইতো রোমাঞ্চ!'
' মাজিউ, আমার কৌতুহল জাগিয়ে তুলে তামাশা দেখার জন্য তুমি বড় বেশি গৌরচন্দ্রিকা করছ। এখনও তুমি আসল কথাটা বলনি।'
' আসল কথাটা হল, ঠাকুরবাড়ি থেকে তোমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে।'
' ঠাকুর বাড়ি থেকে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব!'
' হ্যাঁ, বেজ। বৈকুণ্ঠনাথ দত্ত মহাশয় বিবাহের প্রস্তাব আমাদের মাধ্যমে তোমার কাছে পেশ করেছে।'
' কিন্তু ঠাকুরবাড়ির অভিভাবকরা আমার বিষয়ে কীভাবে জানতে পারল?'
' ওহো, তুমি নিরীহ সরল বলে ভাবলেও বৈকুণ্ঠনাথ দত্ত ঘটকালি কাজে একজন অভিজ্ঞ মানুষ। বাবার সঙ্গে এত বন্ধুত্ব, বাবার কাছ থেকে তোমার সম্পর্কে প্রাথমিক খবরা খবর নিয়েছে। তারপর তোমার অনুপস্থিতিতে একদিন আমার সঙ্গেও তোমাদের বংশ পরিবার, বাবা কী করতেন, এখন কী করেন, তোমরা ভাই বোন কয়জন, তোমাদের কে কী করে, বর্তমানে তোমাদের আর্থিক অবস্থা কেমন,তুমি মানুষটা কী ধরনের ইত্যাদি সমস্ত কিছু জেনে নিয়েছে।'
' তুমি যে এই বিষয়ে আমাকে কিছুই বলনি!'
' ঠাকুরবাড়ির তরফ থেকে যে তোমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব আসবে, এটা আমি ধারণা করতে পারিনি।'
' প্রস্তাবটা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমি একজন অসমিয়া যুবক। বাড়ি অসমে, তাদের কন্যাকে এতদূর দেশের একজনের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব! '
' তাদের কাছে দূর কোনো সমস্যা নয়। অসমিয়া বাঙালি কোনো সমস্যা নয়। ব্রাহ্মণ কায়স্থ বিচার্য নয়।'
' তথাপি?'
'বেজ,তাঁরা হলেন ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মরা জাতের বিচার মানে না। বিয়ে-সাদির ক্ষেত্রে তাদের মূল কথা হল– পাত্রের সুস্বাস্থ্য, সুশিক্ষা ,সুসংস্কার এবং স্বনির্ভরতা। তোমার নিশ্চয় মনে আছে, সেই যে কফি হাউসে আমাদের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির সুধীন্দ্রনাথ এবং বলেন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল, সেদিন হেম গোঁসাই এবং আমি তোমার সঙ্গে ছিলাম যদিও তাঁরা কিন্তু তোমাকেই বেশি লক্ষ্য করছিল। তাছাড়া তুমি রায়বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়ার বাড়িতে যাও–তাঁরা ব্রাহ্ম। উপাসনা সভাগুলিতে কলকাতার ব্রাহ্মরা মিলিত হয়। তাদের কাছ থেকেও নিশ্চয় তোমার খবরাখবর নিয়েছে।'
অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয় প্রস্তাবটা শুনে মনে যে বিস্ময়ের ঘোর একটা সৃষ্টি হয়েছিল লক্ষ্মীনাথ সেটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হল। কিন্তু তার কোনো উচ্ছ্বাস দেখা গেল না। উল্টে গম্ভীর হয়ে পড়ল।
ইডেন গার্ডেনের ঘাসের মধ্যে দুজনে বসেছে। আশেপাশে ভ্রমণ করতে আসা লোকজন সেভাবে নেই। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি। কলকাতার বুকে ইতিমধ্যেই শারদীয় স্নিগ্ধতা নেমে এসেছে। হাঁটু গুটিয়ে বসে লক্ষ্মীনাথ আকাশের দিকে তাকাল। মেঘহীন আকাশে অসংখ্য তারা ঝলমল করছে। অনন্ত আকাশের ছোট-বড় তারা গুলির মধ্যে একটা উজ্জ্বল তারার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে লক্ষ্মীনাথ একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপরে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,' আচ্ছা কন্যা কে?'
' মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা। অর্থাৎ মহর্ষির নাতনি।'
' নাম?'
' প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী।'
নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের অন্তরে একটা শিহরণ খেলে গেল। তারপর নিজের অজান্তে অস্ফুট কন্ঠে সেই নামটা উচ্চারণ করল।
' রূপসী, শিক্ষিতা।' চন্দ্রকুমার বলল,' রন্ধন বিদ্যায় নিপুণা। সাহিত্য-কলাতেও অনুরাগ রয়েছে ।'
লক্ষ্মীনাথ চুপ। কিছু পরিমাণে আত্মসমাহিত। আকাশের সেই তারাটির দিকে তাকিয়ে স্থির।
' তুমি যদি আগ্রহ প্রকাশ কর–।' কিছুক্ষণ পরে চন্দ্রকুমার বলল,' বৈকন্ঠ দত্ত কন্যার একটা ফটোগ্রাফ এনে দেবে। ফোটোগ্রাফটা দেখে তুমি এগোবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।'
লক্ষ্মীনাথ ভাবনা বিভোর।
'কী হল, বৈকন্ঠ দত্তকে একটা ফোটোগ্রাফ আনতে বলব কি?'
' এই মুহূর্তে আমি কিছুই স্থির করতে পারছিনা,মাজিউ।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' আমাকে ভাবার জন্য সময় দাও।'
জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুরবাড়ি বাংলা ভাষা- সাহিত্য , বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতি- দর্শনের মিলনস্থল। ঠাকুর পরিবারের মুকুট-মণি ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারক, প্রাচ্য পন্ডিত জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঋষি সুলভ আচার-আচরণ এবং ভাবগম্ভীর হওয়ার জন্য তাকে মহর্ষি বলে সম্মান জানানো হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ একজন নাট্যকার এবং দার্শনিক। দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের সর্বপ্রথম সিভিলিয়ান। তারপর উচ্চশিক্ষিত গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়ির ভেতরের কাছারিতে বসে তাদের জমিদারি দেখাশোনা করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গায়ক এবং সুঅভিনেতা । অবনীন্দ্রনাথ নতুন শৈলীতে অঙ্কন করা একজন ভারত বিখ্যাত কলাবিদ। ঠাকুরবাড়িতে সবচেয়ে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব মহর্ষির কনিষ্ঠপুত্র রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভা বঙ্গের আকাশের ভাস্বর হয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে আলো বিতরণ করতে শুরু করেছে। তারপর প্রতিদিন বিকেলে ঠাকুরবাড়িতে সমবেত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, হাইকোর্টের প্রথিতযশা জজ ব্যারিস্টার, বিভিন্ন ক্ষেত্রের কলা বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের সমাগমে ঠাকুরবাড়ির বৌদ্ধিক- সাংস্কৃতিক চর্চার সৌষ্ঠব বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল এই বাড়ির অন্দরমহল ও মহর্ষির সুযোগ্য পুত্রদের , বিদুষী পুত্রবধূদের, অধ্যায়নরত পৌত্র- পৌত্রীরা, চাকর-বাকর, কর্মচারী, দারোয়ান ইত্যাদি নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ।
মহর্ষির তৃতীয় পুত্রের নাম হেমেন্দ্রনাথ। দুর্ভাগ্যের কথা হেমেন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যু হয়। কিন্তু পারিবারিক সহমর্মিতা এবং দায়িত্বশীল অভিভাবকত্বের জন্য তাঁর বিধবা পত্নী, তিন পুত্র হিতেন্দ্র,ক্ষিতীন্দ্র,ঋতেন্দ্র এবং প্রতিভা দেবী, প্রজ্ঞাসুন্দরী নামে কন্যা দুটি সযত্নে লালিত পালিত হয়েছে ।
এই ধরনের উন্নত এবং অভিজাত সাংস্কৃতিক পরিবার একটি থেকে লক্ষ্মীনাথের বিবাহের প্রস্তাব … চন্দ্রকুমারের কাছ থেকে কথাটা শুনতে পেয়ে প্রাথমিকভাবে যে একটি বিস্ময়- বিভোরতা
সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা কাটিয়ে উঠলেও লক্ষ্মীনাথ মেনে নিতে পারেনি। এখনও তাঁর এরকম মনে হচ্ছে যেন এটা সম্ভব নয়। এটা যেন একটা অসম্ভব, অবাস্তব প্রস্তাব।
' বেজ, কিছু স্থির করেছ কি?'
লক্ষ্মীনাথ বিছানায় পড়েছিল। চন্দ্রকুমার এভাবে জিজ্ঞেস করায় ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে হাসল।
' আচ্ছা তুমি কি ঠাকুরবাড়ির দূত না ঘটক?'
' আমি ঠাকুরবাড়ির দূতও নই, ঘটকও নই।' চন্দ্রকুমার বলল,' আমি তোমার বন্ধু। তোমার শুভার্থী।'
' তার মানে এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলে, আমার মঙ্গল হবে?'
' নিশ্চয়। আর তোমার মঙ্গল হবে না বলে ভাবলে, বৈকুণ্ঠ দত্ত এগিয়ে দেওয়া প্রস্তাবটা শুনেই আমি তাকে ফেরত পাঠাতাম।'
ঠিক তখনই হেমচন্দ্র ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। হেমচন্দ্র চন্দ্রকুমারের কাছে বিছানায় বসল।
লক্ষ্মীনাথ বিছানায় উঠে বসল। হেমচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,' গোঁসাই তুমি সমস্ত কিছু শুনলে। তুমি কী বল? এখন আমার কী করা উচিত?'
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে লক্ষ্মীনাথের কাছে বিয়ের প্রস্তাব আসায় হেমচন্দ্রও অবাক হয়েছে। সেও এটা সম্ভব নয় বলে ভেবেছিল।
' বিয়ে-সাদির কথা বার্তায় আমার অভিজ্ঞতা- জ্ঞান এমনিতেই সীমিত । তবু তোমার কাছে যে এমন একটা প্রস্তাব এসেছে তার জন্য আমিও গৌরবান্বিত বোধ করছি। ঠাকুরবাড়ির অভিবাবকরা এমনিতেই তোমার কাছে এই প্রস্তাব পাঠায় নি । তাঁরা হলেন 'রতনে রতন চিনে' ধরনের মানুষ। তাদের কন্যার জন্য তুমি উপযুক্ত বলে বিচার করে তবেই তোমার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কিন্তু–।'
হঠাৎ হেমচন্দ্র থেমে যাওয়ায় ঘরের বাতাবরণটা রহস্যময় হয়ে উঠল। লক্ষ্মীনাথ এবং চন্দ্রকুমার একে অপরের দিকে তাকাল।
'বিবাহ মানেই একজন নারীর সঙ্গে একজন পুরুষের জীবন জোড়া সম্পর্ক। বিয়ের পরে পত্নী হয় সুখ দুঃখের সঙ্গী । তাঁর সঙ্গে সমগ্র জীবনকাল ঘর গৃহস্থালী সামলাতে হয় । নিজের ঘরের সঙ্গে সামাজিক দায়দায়িত্ব ও পালন করতে হয় । ধীরে ধীরে হেমচন্দ্র বলল ,' তাই একই ভাষা , একই সংস্কৃতি, একই জাতি এমন কী আর্থিক দিক দিয়েও সমতা থাকা পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হলে উভয় পক্ষের জন্য ভালো হয়। অথচ এই ক্ষেত্রে সেসব একেবারেই আলাদা। পৃথক সংস্কৃতি, পৃথক ভাষা, এমনকি ধর্মও পৃথক। ভাষা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তুমি মানিয়ে নিতে পারবে। সেই গুণটুকু তোমার মধ্যে আছে এবং তার জন্য যে মানসিক শক্তির প্রয়োজন সেটাও তোমার রয়েছে । কিন্তু তাঁরা যে ব্রাহ্ম –।'
বিশেষ এই কথাটাই লক্ষ্মীনাথকে নিরুৎসাহিত করে ফেলল। আসলে, শৈশবে পিতৃ দীননাথের অনুশাসনে পালন করা নৈষ্ঠিক আচরণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সংস্কার তাকে বাধা দিচ্ছে । সঙ্গে শৈশবের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। বঙ্গ থেকে রামকুমার বিদ্যারত্ন বলে এক ব্যক্তি ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার করার জন্য শিবসাগরে গিয়েছিলেন। তখন তাকে নিয়ে শিবসাগরে কী ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল– ব্রাহ্মরা হিন্দুর যাগ-যজ্ঞ, জাতি-ভেদ, মূর্তি- পূজা মানে না ….তাঁরা, বিধর্মী,ম্লেচ্ছ, পিতৃ দীননাথ হিন্দু মহাসভা নামঘরে সভা ডেকে শিবসাগরের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের নিয়ে ব্রাহ্ম বিরোধী প্রবল একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন । এখন সেই দীননাথের পুত্র হয়ে লক্ষ্মীনাথ ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যাকে বিবাহ করবে!
হেমচন্দ্র উল্লেখ করা প্রশ্নটি লক্ষ্মীনাথকে চিন্তায় ফেলেছে বুঝতে পেরে চন্দ্রকুমার বলল,' দেখ বেজ, তুমি অধ্যয়নশীল– তুমি হয়তো কথাগুলি জান। তথাপি হেম গোঁসাই প্রসঙ্গটা তুলল যখন আমি নিজে যতটুকু জানি, কতটুকু তোমার কাছে ব্যক্ত করছি–।'
তারপরে চন্দ্রকুমার বলল, বৈদিক কাল থেকে আদি সমাজটি অপৌত্তলিক আর্য হিন্দু সমাজের আদর্শে গঠিত। এই সমাজের ভিতটি হল বেদ এবং উপনিষদ। যুগের পরিবর্তন হল বলে নতুন যুগের জন্য উপযোগী বেদ উপনিষদের সারভাগ গ্রহণ করাটাই হল ব্রাহ্ম ধর্মের মূল কথা। তাই ব্রাহ্ম ধর্ম হিন্দু ধর্মের বিরোধী নয়। এমনিতেও রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্ম ধর্ম বলে স্বতন্ত্র একটি ধর্ম প্রবর্তন করার চেষ্টা করেননি। তিনি হিন্দু ধর্মের চার দেয়ালের ভেতরে থেকে বেদ উপনিষদের উপর ভিত্তি করে ইশ্বরের উপাসনায় গুরুত্ব দিয়েছেন । তার জন্যই রামমোহন রায়কে রিফর্মার বা সংস্কারক বলা হয়। আসলে, যুগ যুগ ধরে হিন্দু সমাজে প্রচলিত থাকা অন্ধ সংস্কার- কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে উদার মানসিকতায় মানুষের শ্বাশত মানবীয় গুণাবলী বিকাশ করার জন্য' একমেবম অদ্বিতীয়ম' ব্রহ্মার সাধনাটাই হল ব্রাহ্ম ধর্মের মূল কথা এবং এটা আমাদের হিন্দুদের গুরু শঙ্করাচার্যের বাণী।
শেষে চন্দ্রকুমার বলল,' এই বাণী আমাদের অসমের যজ্ঞরাম খারঘরীয়া ফুকন এবং তারপরে গুণাভিরাম বরুয়াকেও প্রভাবান্বিত করল। গুণাভিরাম একজন বিধবাকে বিয়ে করলেন এবং তারপরে হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিতে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেন । তাই এদেরকে তুমি অধর্মী ম্লেচ্ছ বলবে নাকি?না, সেরকম বলাটা নিশ্চয় উচিত হবে না। আসলে,এঁরা হলেন সামাজিক কুসংস্কার থেকে মুক্ত উদার মনের মানুষ এবং নিরাকার নির্বিকার 'অব্যক্ত' ব্রহ্মার একনিষ্ঠ উপাসক।'
' অব্যক্ত!' লক্ষ্মীনাথের অন্তরটা স্পন্দিত হয়ে উঠল,' এই শব্দটা দেখছি আমাদের নামঘোষায় আছে। এই পদটা আমি শৈশব থেকে বলে আসছি–' অব্যক্ত ঈশ্বর হরি কেনমতে পূজিবাহা, রাম বুলি শুদ্ধ করা মন।'
সঙ্গে সঙ্গে হেমচন্দ্র বলল,' পদটির প্রথম অংশটি ব্রাহ্মর, দ্বিতীয়টি বৈষ্ণবের।‘ তাহলে ভালোই হল। ব্রাহ্ম এবং বৈষ্ণব একই পদে আবদ্ধ হবে।' চন্দ্রকুমার বলল,' এসব শাস্ত্রের কথা। এখন শাস্ত্র কিসের জন্য? মানুষকে ধরে রাখার জন্য। তবু তোমাকে বলতেই হবে যে এই শাস্ত্রের ওপরে মানুষের মন। শাস্ত্রের চেয়ে বড় হল মানুষের হৃদয়। তাই তোমার হৃদয় মন চাইলে তবেই তুমি এগোবে।'
অবশেষে লজ্জিতভাবে লক্ষ্মীনাথ বলল,' আচ্ছা বৈকুণ্ঠ দত্তের কাছ থেকে কন্যার ফোটোটা নিয়ে এসোতো।'
পরের রবিবার।
সকালবেলা।
বৈকন্ঠ নাথ দত্ত মহাশয় নিজেই দুইনাম্বার ভবানীচরণ দত্ত লেনের অসমিয়া ছাত্রদের মেসে এসে চন্দ্রকুমারের হাতে কন্যার ফোটো দিয়ে গেলেন। দত্ত মহাশয়কে বিদায় জানিয়ে চন্দ্রকুমার লক্ষ্মীনাথের ঘরে প্রবেশ করল। ফোটোগ্রাফটা একটা নীল খামে ভরা। সে নিজে না দেখে সেটা লক্ষ্মীনাথের হাতে তুলে দিল।
লক্ষ্মীনাথের বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলতে লাগল। মনেরর মধ্যে আগ্রহ রয়েছে, কিন্তু খামটা থেকে থেকে বের করে ফোটোটা দেখতে পারছে না। চন্দ্রকুমার বলায় ফোটোটা বের করল। আর কী আশ্চর্য, এতদিন ধরে মেয়ে দেখা বা বিয়ে-সাদির কথাবার্তা নানাভাবে এড়িয়ে চলছিল, বিয়ের জন্য প্রস্তাব দেওয়া অভিভাবকদের নিরাশ করেছিল… সেসব কিছুই মনে পড়ল না । ফোটোটার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথ স্থির শান্ত । এই মেয়েটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পরলোকগত হেমেন্দ্রনাথের কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী । শিক্ষিত, সুশীলা, রন্ধন বিদ্যায় নিপুণ, সাহিত্য অনুরাগী, চিত্রকলায় পারদর্শিনী। লক্ষ্মীনাথ তাকিয়েই রয়েছে …. মেয়েটি সত্যিই রূপসী, যৌবনবতী মুখটি নারীত্বের ঐশ্বর্যৈ কমনীয়, আয়ত চোখজোড়ার চাহনি গভীর, ঘনকৃষ্ণ চুল দীর্ঘ সুবিন্যাস্ত, সাজ-পোশাকে বাঙালি আভিজাত্য… দেখতে দেখতে তার হৃদয়ে আনন্দোচ্ছল তরঙ্গ উঠল। সঙ্গে তার কানে গুঞ্জরিত হতে লাগল স্বপ্নে দেখা সেই জুড়িগাড়ির নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ । সেই জুরি গাড়ির জানালার কাছে বসা যুবতি… সেই মেয়েটির সঙ্গে ফোটোতে দেখা প্রজ্ঞাসুন্দরীর মুখের যেন একটা মিল রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সঙ্গে একটা সম্পর্ক যেন অনুভূত হল। এরকম মনে হল যেন এই সম্পর্কটি আজকের নয়। এটা যেন বহু আগে থেকে, বহু যুগ ধরে… ।
নিজেকে ফিরে পেয়ে লক্ষ্মীনাথ বিব্রত হল, লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে পড়ল, ফোটোটা চন্দ্রকুমারকে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে দেখতে পেল সে নেই, ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। ঘরে হেমচন্দ্র ও নেই। লক্ষ্মীনাথ পুনরায় ফোটোটার দিকে তাকাল। বিছানায় বসে দেখল। জানালার কাছে এসে দেখল। তারপর বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে দেখল। ভালো লেগেছে। এতই ভালো লেগেছে যে এত ভাবে দেখেও তার যেন আশ মিটছে না। কোনোদিন সামনাসামনি না দেখা, একটিও কথা না বলা প্রজ্ঞাসুন্দরী কী এক ঐশ্বরিক প্রভাবে নিমেষের মধ্যে লক্ষ্মীনাথের আপন হয়ে পড়ল। আর কী আশ্চর্যের কথা, লক্ষ্মীনাথ তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে লাগল। লক্ষ্মীনাথের হৃদয়ে তার প্রতি ভালোবাসা জাগল। তারপর অদ্ভুত এক সংবেদনশীলতার সঙ্গে ফোটোটা খামের ভিতর ভরিয়ে সযত্নে বিছানার মাথার দিকে বালিশের নিচে রেখে দিল।
রবিবার জোনাকীর সম্পাদনার কাজগুলিতে চন্দ্রকুমারকে সাহায্য করতে হয়। নিজের লেখালেখিও ঠিক করতে হয়। আজ সেই সব কাজে মনোনিবেশ করতে পারল না। অন্য দিন দেরি হলে চন্দ্রকুমার তাকে ডাকে। ফটোটা হাতে তুলে দেওয়ার পরে যে রকম অবস্থা দেখল, চন্দ্রকুমার তাকে আর বিরক্ত করে নি। কিন্তু দুপুরের আহার করার পরে তিনমূর্তি একসঙ্গে হল। দরজার খিল লাগিয়ে বসে হেমচন্দ্র হাসতে হাসতে বলল,' মনে মনে এগিয়েছ বলে মনে হচ্ছে।'
ভাবনা- বিভোরতা কাটিয়ে লক্ষ্মীনাথ ইতিমধ্যে প্রকৃতিস্থ হতে পেরেছে।
এমনিতেও ভনিতা করাটা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। সে বলল,' হ্যাঁ ফোটোটা দেখে ভালো লাগল। সঙ্গে তার যেসব গুণের কথা শুনলাম– আমার মনে হয়, জীবনের সহচরী হিসেবে তাকে পেলে আমি সুখী হতে পারব।'
' ভালো কথা।' হেমচন্দ্র বলল।
' ভালো কথা মানে!' চন্দ্রকুমার বলে উঠল,' অত্যন্ত আনন্দের কথা। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ মানে অসম এবং বঙ্গ এই দুই সংস্কৃতির মিলন ।'
' এটা তোমার অতি- উচ্ছ্বাস, মাজিউ।'
' অতি উচ্ছ্বাস বললেও আমি তো সেটাই দেখতে পাচ্ছি ।'
' কথাটা একদিক থেকে মানে ঠাকুর বাড়ির দিক থেকে সহজ হলেও আমাদের দিক থেকে সম্ভব নয় ।' লক্ষ্মীনাথ বলল , বাবা বাধা দেবেই। ব্রাহ্মদের ব্যাপারে বাবা অর্থডক্স। ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিবাহকে তিনি কোনো মতেই মেনে নেবেন না।'
' কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে, গোঁড়া হলেও বাবা বিচার-বিশ্লেষণ করতে জানেন। বিচার করে একটি বিষয়ের সত্য- অসত্য নিরূপণ করে তা অনুসরণ করে কাজ করেন। ব্রাহ্মধর্ম যে হিন্দু ধর্মেরই একটি পরিশোধিত রূপ এই বিষয়ে তাকে বুঝিয়ে বললেই হল।'
' বাবাকে ধর্ম বিষয়ে কোনো কিছু বোঝানোটা এত সহজ কাজ নয়। অন্যদিকে ,এতদিন বড় মুখ করে বলে আসছিলাম নিজের রোজগার করতে না পারা পর্যন্ত বিয়ে করব না, এখন বিয়ের কথা বললে সবাই আমাকে নিয়ে উপহাস করবে।'
' কিন্তু বেজ, 'ম্যান প্রোপোজেস গড ডিসপোজেস' বলে একটা কথা আছে।'
' তা অবশ্য ঠিক।' চন্দ্রকুমারকে সমর্থন করে হেমচন্দ্র বলল,' প্রভু ঈশ্বরের ইচ্ছার সামনে আমরা সাধারণ মানুষের ইচ্ছার গুরুত্ব আর কতটুকু ? প্রভু ঈশ্বর হয়তো এর মধ্যেই তোমার মঙ্গল দেখতে পাচ্ছেন ।'
' তাছাড়া টাকা রোজগার করে খাওয়ানোর কথা বললে, সে ক্ষমতা তোমার নেই, এমনটা নয়। চন্দ্রকুমার বলল,' বি এ পাস করার পরেই আসাম সরকার হাকিমের চাকরির জন্য দুবার তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। হাকিমের চাকরি না নিয়ে কলকাতায় এম এ পড়তে এসেছ। সঙ্গে বি এল পড়ার জন্য কলেজে নাম লিখিয়েছ। হাইকোর্টের বিখ্যাত এডভোকেট ব্যারিস্টারের অধীনে আর্টিকেল ক্লার্ক করছ। তাই অদূর ভবিষ্যতে উপার্জন কি কম হবে?'
' বাড়ির বৌদিদের, বিশেষ করে মায়ের আমার জন্য একটি অসমিয়া মেয়েকে বধূ করে নিয়ে আসার স্বপ্ন অনেক দিনের–।'
' শোন বেজ–।' বয়সে ছোট যদিও প্রবীণ ব্যক্তির মতোই হেমচন্দ্র বলল,' পূর্ব জন্মে যার হাঁড়িতে চাল রেখে এসেছ, তার সঙ্গেই তো তোমার বিয়ে হবে।'
' কিন্তু তারা ব্রাহ্ম বলে তুমি আপত্তি করেছিলে না?'
' আমি আপত্তি করি নি। আমার বক্তব্য ছিল, কন্যা স্বজাতি এবং সমগোত্রীয় হলে ভালো হত। হেমচন্দ্র বলল,' এখন মাজিউ যখন ব্রাহ্ম এবং বৈষ্ণবের মধ্যে মিল আছে বলে এত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলল, তখন নীতিগতভাবে মেনে নিতে কোনো অসুবিধা নেই।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন