রবিবার, ৫ জুন, ২০২২

হে আমার স্বদেশ- ১৩ ।। সন্তোষ কুমার কর্মকার ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, He Amar Swadesh

 হে আমার স্বদেশ- ১৩

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস




  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

(১৩)

মানুষ আশা করে, ভগবান ভাঙ্গে। তথাপি মানুষ আশা নিয়ে এগিয়ে যায়। আশা নিয়েই মানুষ ঘর বাঁধে।

শিব সাগর থেকে লক্ষ্মীনাথের পিতৃদেবের টেলিগ্রাম এল– মাতা এবং ভ্রাতা লক্ষ্ণণের সঙ্গে তিনি গঙ্গা স্নানের জন্য কলকাতা আসছেন। লক্ষ্মীনাথ মেডিকেল কলেজ স্ট্রিটে একটা ঘর ভাড়ায় নিয়ে সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা করল। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে তাদের সেই ঘরে এনে খাওয়া-দাওয়ার জোগাড় করল। দীননাথের মুক্ত পরিবেশ এবং বড়সড় ঘরে থাকার অভ্যাস। ভাড়ায় নেওয়া ঘরটাতে ঢুকে তাদের অসুবিধা হল। কিন্তু মাত্র দশ বারো দিন থাকবে, এই কয়েকটা দিন কোনোমতে কাটিয়ে দিতে পারবেন বলে মনকে সান্তনা দিলেন আর পরের দিনেই গঙ্গা স্থানে যাবেন বলে স্থির করলেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা এই যে পরের দিন সকাল থেকে লক্ষ্মীনাথের সমবয়সী ভাই লক্ষ্ণণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। শিবসাগর থেকে কলকাতা আসার সময় খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম হয়েছিল, তার মধ্যে আবার কলকাতার ভাড়া ঘরটির আবদ্ধ পরিবেশ। লক্ষ্মণের সহ্য হল না। শিবসাগরের গঙ্গা গোবিন্দ ফুকন এখন কলকাতায় অবস্থান করছেন। খবর পেয়ে ফুকন মহাশয় এলেন। সারাটা দিন লক্ষ্মণকে নিয়েই পার হয়ে গেল। লক্ষ্মণের অবস্থা ভালো হল না। বরং খারাপ হতে লাগল। বিকেল থেকে সারারাত গঙ্গাগোবিন্দ ফুকনও অসুস্থ লক্ষ্মণের দেখাশোনা করতে লাগল। অভিজ্ঞ চিকিৎসক হয়েও প্রবাসে থাকার ফলে দীননাথ ছেলের চিকিৎসার জন্য বিশেষ কিছুই করতে পারলেন না। ভোরের দিকে লক্ষ্মণের জীবন দীপ নিভে গেল ।

ভাগ্যদেবী এত নিষ্ঠুর! গঙ্গাস্নান করে পুণ্য সঞ্চয় করার জন্য কলকাতায় এসে দীননাথ-ঠানেশ্বরী পুত্রহারা হলেন। ভাড়া ঘরটিতে দুঃসহ শোক নেমে এল। শোকে ঠানেশ্বরী দেবী বিমর্ষ হয়ে পড়লেন । গঙ্গা গোবিন্দ ফুকন গম্ভীর স্বভাবের মানুষ।লক্ষ্মণের আকস্মিক বিয়োগে তিনিও অসহায় শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করলেন। এদিকে দীননাথ মহাশয় – বড় ছেলেরা আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অবহেলা করার জন্য ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তারপর ইংরেজি স্কুল থেকে লক্ষ্মণের নাম কাটিয়ে এনে এত বছর ধরে অশেষ চেষ্টায় এই বিদ্যায় তাকে পারদর্শী করে তুলেছিল। দীননাথ লক্ষ্মণের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল যে একনিষ্ঠ লক্ষ্মণ তাদের বংশের পরম্পরাটা রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু লক্ষ্মণের অকালমৃত্যুতে তার সেই আকাঙ্ক্ষা চিরতরের নির্বাপিত হল। নিজেকে সামলে এতক্ষণ দীননাথ শোকে ক্রন্দনরত সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন । শেষে বন্ধুদের নিয়ে লক্ষ্মীনাথ যখন লক্ষ্মণের প্রাণহীন নিথর দেহটা নিমতলা শ্মশানে নিয়ে যেতে উদ্যত হল, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তার দুচোখ দিয়ে অবিরল ধারায় জল পড়তে লাগল। গঙ্গা গোবিন্দের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,' আমাদের বংশে, অসমের সেই বুড়ো ভগনীয়া রাজার দিন থেকে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের চর্চাটা ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে । এই শাস্ত্রের চর্চা অক্ষুন্ন রাখার জন্য এত যত্ন করে লক্ষ্মণকে শিক্ষা দিকে গড়ে তুললাম। অথচ, আজ সে আমার সামনে চোখ বুজল। চিকিৎসক হয়েও আমি কিছুই করতে পারলাম না! আসলে জান গঙ্গা, এটা বোধহয় প্রভু পরমেশ্বরের ইচ্ছা যে আসামে আমাদের বংশে এত বছর ধরে চলে আসা আয়ুর্বেদ বিদ্যার চর্চাটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।'

পিতৃদেবের এই মর্মবেদনা লক্ষ্মীনাথের অন্তর স্পর্শ করে গেল। কিন্তু কী করবে, আজকের যুগটাই যে এরকম হয়ে পড়েছে যে সন্তান হয়েও লক্ষ্মীনাথ পিতৃদেবের এই ঐকান্তিক ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারবে না এবং এখন তার জন্য তার দিক থেকে আর কিছুই করণীয় নেই।

নিমতলায় লক্ষ্মণের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হল। শোকসন্তপ্ত মন নিয়ে দীননাথ কলকাতায় থাকার সময়ই অকাল মৃত্যু হওয়া পুত্রের শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। পরেরদিন গঙ্গাস্নান করলেন। আসাম থেকে কলকাতায় এসেছেন। কলকাতার উল্লেখযোগ্য জায়গা দর্শন করার কথা ছিল। কিন্তু পুত্রহারা হয়ে শোকজর্জর হৃদয় নিয়ে দীননাথের আর বেড়াতে ইচ্ছা করল না।

ছয় দিন পরে দীননাথ ঠানেশ্বরী অসমে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন।

কলকাতা থেকে পিতা-মাতার বিদায় নেওয়ার দিনের সকালবেলা। চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্র জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে লক্ষ্মীনাথের বিয়ের প্রস্তাবটার কথা পিতা দীননাথকে বলতে চাইল। প্রস্তাবটির বিরোধিতা করলে দীননাথকে বোঝানোর চেষ্টা করা হবে বলেও চন্দ্রকুমার মনে মনে প্রস্তুত হল। কিন্তু লক্ষ্মণের আকস্মিক বিয়োগে মর্মাহত পিতা-মাতার কাছে বিয়ের প্রস্তাবটা রাখে কীভাবে?না, আত্মজকে হারানোর এই গভীর শোকের মধ্যে বিয়ের কথা বলা যাবে না। বলাটা উচিত ও হবে না। লক্ষ্মীনাথ চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্রকে এই বিষয়ে পিতার সঙ্গে কথা বলতে বাধা দিল। তারাও এগোল না।

আপন জনের বিয়োগে সুখে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেও জীবন থেমে থাকে না।

লক্ষ্মণের অকাল মৃত্যুতে পিতার আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ায় লক্ষ্মীনাথ শোকে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। তার চোখের সামনে ভাসতে লাগল ঘরের ঔষধালয়, ঔষধালয় এর ঔষধ তৈরি করার নানাবিধ সরঞ্জাম, ওষুধ নিতে শিবসাগর তথা দূর দূরান্ত থেকে আসা অসুস্থ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। মনে পড়তে লাগল ' ভাব প্রকাশ' পুথিটা লক্ষ্মণের সামনে মেলে নিয়ে পিতৃ দেবতা শ্লোকগুলি বলে যাওয়ার সেই দৃশ্যগুলি! একসময় তিনি লক্ষ্ণীনাথকেও এই বিদ্যা শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। পিতৃদেব উচ্চারিত সেই শ্লোক গুলি এখনও তার মনে প্রতিধ্বনিত হয়,'পঞ্চাভিভূতত্বথ পঞ্চকৃত্বা পঞ্চেন্দ্রিয়ং পঞ্চ সু ভাবয়িত্বা পঞ্চত্বমায়াতি বিনাশকালে'।… তবে শোকে-দুঃখে যতই কাতর হন না কেন,লক্ষ্মণ আর ফিরে আসবে না। তবু লক্ষ্মণের স্মৃতি পীড়া দেয়। লক্ষ্মণের স্মৃতি পীড়া দেয় বলেই ঠাকুরবাড়ি থেকে আসা বিয়ের প্রস্তাবের কথাটা চাপা পড়ে গেল। অথচ বৈকুণ্ঠ দত্ত এনে দেওয়া সেই ফোটোটির প্রতি কী দুর্নিবার আকর্ষণ! নিজের অজান্তেই লক্ষ্মীনাথ মাথার দিকে বালিশের নিচে রাখা প্রজ্ঞাসুন্দরীর ফোটোটা বারবার বের করে দেখে।

রুমে যখন কেউ থাকেনা, লক্ষ্মীনাথ তখন ফোটোটা হাতে নিয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দেখে দেখে আশ মিটে না। দেখতে দেখতে ফোটোটা প্রাণ পেয়ে উঠে।

ইতিমধ্যে প্রজ্ঞাসুন্দরীর বিষয়ে লক্ষ্মীনাথ আরও কিছু জানতে পেরেছে। লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার আগে কলকাতার সম্ভ্রান্ত পরিবারের কৃতী যুবকদের অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রজ্ঞাসুন্দরীর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। প্রজ্ঞাসুন্দরী সেই সব প্রস্তাব অস্বীকার করেছিলেন। অথচ লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে বিয়ের কথা হতেই প্রজ্ঞাসুন্দরী এককথায় সম্মতি দিল। একবারও নিজের চোখে না দেখে তাকে বিয়ে করার জন্য সম্মতি দান…. এসব শোনার পরে প্রজ্ঞাসুন্দরীর প্রতি আকর্ষণটা নিবিড় হয়ে পড়ল। এরকম মনে হল যেন, বহুদিন আগে থেকেই প্রজ্ঞাসুন্দরীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়ে রয়েছে।

তাই লক্ষ্মীনাথ ঠাকুরবাড়ি থেকে আসা বিবাহের প্রস্তাবটাকে গুরুত্ব সহকারে দেখল। তারা বাঙালি, তারা জমিদারি আভিজাত্য নিয়ে চলা মানুষ, তারা বঙ্গ সংস্কৃতির ধারক বাহক পৃষ্ঠপোষক। বাঙালিরা নিজেদের ভাষা সংস্কৃতিকে নিয়ে উচ্চাত্মিকা বোধে ভোগে, তারা অন্য ভাষার লোকদের হেয় জ্ঞান করে, সর্বোপরি ঠাকুর বাড়ির সদস্যরা ব্রাহ্ম… এইসব নিয়ে প্রথমে যথেষ্ট অসুবিধা হয়েছিল। পরে চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্রের সঙ্গে সমস্ত কথা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করার পরে নিজের মনে বিচার-বিশ্লেষণ করে লক্ষ্মীনাথ সিদ্ধান্ত নিল যে প্রজ্ঞাসুন্দরীকে জীবনের সঙ্গী করে নেবে। এই সিদ্ধান্তটা বৈকুণ্ঠনাথ দত্তের মাধ্যমে ঠাকুরবাড়ির অভিভাবকদের জানিয়ে দেবে বলেও সে স্থির করল।

তখনই তার মানসপটে মায়ের মুখটা ভেসে উঠল। মনে পড়ল পিতৃদেবতার কথা, বৌদি দুজনের কথা। তারা মেয়ে দেখেছে। তারাও লক্ষ্মীনাথের জন্য ভালো বংশের রূপসী এবং সুলক্ষণা একটি মেয়েকে ঘরের বউ করে আনার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তাই ঘরের কেউ ব্রাহ্ম ধর্মের উপাসক ঠাকুরবাড়ির কন্যাকে বিয়ে করার কথাটা মেনে নেবে না। তারা সর্বতোভাবে এর বিরোধিতা করবে। অবশ্য, মেজদাদা গোবিন্দচন্দ্র বাড়ির অন্যান্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত আধুনিক এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা গতিশীল মনের মানুষ। এখন এই দাদার ওপরে লক্ষ্মীনাথ আস্থা রাখতে পারল না। বি এ পাশ করার পরে যে হাকিমের চাকরিটা গ্রহণ করল না তার জন্য গোবিন্দ্রচন্দ্র তার উপরে অসন্তুষ্ট হয়েছে। তাছাড়া তিনি ও ব্রাহ্ম ধর্মের মানুষকে খুব একটা পছন্দ করেন না। ব্রাহ্ম কন্যাকে বিয়ে করার জন্য স্থির করেছে বলে কলকাতায় এসে যদি দাদা বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়? তাই বিয়ের অনুমতি চেয়ে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করলে বিপদ ডেকে আনা হবে।

স্পষ্টত, ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাওয়াটা হবে পিতা মাতা দাদা ভাই এবং আত্মীয়-স্বজনের মতের বিরুদ্ধে গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত।

তাহলে কী করবে?

লক্ষ্মীনাথ অসহায়। ফোটোটাতে সজীব হয়ে ওঠা প্রজ্ঞাসুন্দরীর মধ্যে যে সে জীবন প্রতিমার একমূর্ত রূপ দেখতে পেয়েছে।

'ও, এ তো দেখছি আমাদের হেম গোঁসাই । এদিকে কোথায় গিয়েছিলে?'

' প্রেসে গিয়েছিলাম। এবার একটু দেরি হল, বুঝেছ। ফাইনাল প্রুফগুলি পঁচিশ তারিখের আগে দিতে না পারলে মাসের প্রথম সপ্তাহে 'জোনাকী' বের করতে অসুবিধা হবে ।'

'এখন জোনাকীর বাজার কেমন?'

'আগের চেয়ে প্রচারের সংখ্যা বেড়েছে। অসমের অ.ভা.উ.সা সভার জেলা কেন্দ্রগুলি সাহায্য করায় কাগজটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গতবার কম পড়ে গেছে। চাহিদা অনুযায়ী অনেককেই সাপ্লাই দিতে পারলাম না। এবার ছাপানোর সংখ্যা বাড়াব বলে ভাবছি।'

' সম্পাদক না হয়েও তুমি যে এত খাটছ!'

' করছি আর কী। জোনাকীর কাজ করে ভালো লাগে। এবার সম্পাদক পরিবর্তিত হবে। চন্দ্রকুমার বেজবরুয়াকে দায়িত্ব দেবে। বেজ দায়িত্ব নিলে জোনাকী আরও ভালো হয়ে উঠবে।'

'লক্ষ্মী জোনাকীর সম্পাদনা করবে! অবশ্য পারবে। ততটুকু ক্যাপাসিটি লক্ষ্মীর আছে। আচ্ছা, একটা খবর শুনলাম–।'

'কী?'

' জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কন্যার সঙ্গে লক্ষ্ণীর নাকি বিয়ে?'

'হ‍্যাঁ, গত মাসের ২২ তারিখ পাকা কথা হয়ে গেল।'

'অ্যঁ , তুমি থাকতে এটা কীভাবে সম্ভব হল?'

' কেন, খারাপ কী হয়েছে?'

  ' এসো, এদিকে এসো। কথাটা ভালোভাবে জেনে নিই।'

এ হল ভোকেন্দ্র বরুয়া। কথাবার্তায় লাগাম নেই, সবসময়ই অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায়, মদ্যপ এই ভোকেন্দ্রকে হেমচন্দ্র একদম পছন্দ করে না। এই ভোকেন্দ্র তাকে কম যন্ত্রণা দেয় নি। এর জন্যই তাকে মেস ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু হেমচন্দ্র শান্ত স্বভাবের মানুষ । ভোকেন্দ্র যখন ডেকেছে তখন কথা বলতেই হবে । তবু তাকে এড়িয়ে যাবার জন্য বলল ,' আমাকে তাড়াতাড়ি মেসে যেতে হবে।'

'যাবে ,যাবে কিছুক্ষণের জন্য এসো । এতগুলি প্রুফ দেখে ক্লান্ত হয়ে প্রেস থেকে বেরিয়েছ, চা খাও। আমিই নাহয় খাওয়াব।'

ফুটপাতের এক পাশে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছের গোড়ায় একজন বিহারী বুড়ো কয়লার চুলোতে চা বানিয়ে মাটির ভাঁড়ে চা বিক্রি করছে। বুড়ো দোকানির কাছ থেকে চা নিয়ে একটা কাপ হেচন্দ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে অন্য কাপ নিয়ে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ভোকেন্দ্র বলল,' বুঝেছ আমি লক্ষ্মীর ক্যাপাসিটিকে এডমিট করি। তোমাদের নিয়ে সে যে আমাদের অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের জন্য এতখানি করছে , নিজেও লেখালেখি করছে — এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় । কিন্তু লক্ষ্মীর এই ধরনের পতন!'

'পতন!'

' পতন মানে মহাপতন! জোর দিয়ে ভোকেন্দ্র বলল,' একবার লক্ষ্মীকে কোনো এক মুখার্জি তার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল শুনে আমি তাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলাম। লক্ষ্মী মেয়েটিকে বিয়ে করবে না বলে জানায়। আমি ভাবলাম, অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের উন্নতির কথা বলে , অসমিয়া জাতীয়তাবাদের উপর জোরদার লেকচার মারে, তাই সে বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করবে না। কিন্তু এখন কী শুনছি! অবশেষে সে বাঙালির সঙ্গেই আত্মীয়তা করতে যাচ্ছে ! আর যে সে পরিবারের সঙ্গে নয় একেবারে কলকাতার বিখ্যাত ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যার সঙ্গে বিবাহ ! এটা কী ধরনের সর্বনাশের কথা ভাবতে পারছ?'

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কন্যার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের বিয়ের খবরটা প্রচার হওয়ার পর থেকে কলকাতার অসমিয়া ছাত্রদের মেসগুলিতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ঈর্ষাবশত একদল ছাত্র তার বিরুদ্ধে কটু মন্তব্য করছে , একদল আবার নানান কথা রং চড়িয়ে প্রচার করছে। এসব কথাই হেমচন্দ্র চন্দ্রকুমারের কানে আসছে। হেম চন্দ্র -চন্দ্রকুমার এইসব আলোচনা-সমালোচনা - কটূক্তি একটা সীমা পর্যন্ত সহ্য করে। কেউ সীমা অতিক্রম করে কিছু বললে সমুচিত উত্তর দিতে বাধ্য হয়। ভোকেন্দ্রর কথাবার্তা শুনে হেমচন্দ্রের মনোভাবটাও সেরকম হয়ে পড়ল।

' কীরকম সর্বনাশ দেখছেন আপনি?'

' ঠাকুররা জাত- কুল- ধর্ম না মানা ব্রাহ্ম! বৈষ্ণব হয়ে লক্ষ্ণী বিধর্মী ম্লেচ্ছ ব্রাহ্মদের মেয়ে একজনকে বিয়ে করে আনবে!' চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে গিয়ে কণ্ঠস্বর নিচু করে ভোকেন্দ্র বলল,' এদিকে ঠাকুর পরিবার– তারা জমিদার, ওরা যে লক্ষ্মীকে মেয়ে দেবে। বিয়ের পরে লক্ষ্মী তাদের বাড়িতে ঘর জামাই হয়ে থাকতে হবে। সেটাই ওই ফ্যামিলির ট্রেডিশন। তার জন্যই তারা চাকরি না করা লক্ষ্মীর কাছে মেয়ে দিতে চাইছে। তাছাড়া জানোই তো, ঘর জামাই হলে কি অবস্থা হয়! বিয়ের পরে ঠাকুরবাড়িতে লক্ষ্মীর ব্যক্তিসত্তা একেবারে শেষ হয়ে যাবে। আমাদের সামনে যতই বিক্রম দেখাক না কেন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মী স্ত্রৈন হয়ে পড়বে।'

' তাই নাকি! হেমচন্দ্র বলল ,আপনি যদি এতই ভেবে থাকেন, বেজ বরুয়ার সঙ্গে দেখা করে কথা বলছেন না কেন ?'

' আমি একটা খারাপ মানুষ। নেশা করি, খারাপ জায়গায় যাই। লক্ষ্মী আমাকে পছন্দ করে না। তবু আপন ভেবে আমি একবার তার মেসে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কথা বোঝার চেষ্টা না করে লক্ষ্মী আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল।' ক্ষোভের সুরে ভোকেন্দ্র বলল,' বুঝেছ হেম, নিজে খারাপ হলেও প্রতিভাবান অসমিয়া যুবক একজনের ভালো হোক, উন্নতি করুক– এটাই আমি চাই। কিন্তু যা দেখতে পাচ্ছি, লক্ষ্মী কারও পরামর্শ শুনে না। কার ও উপদেশ- পরামর্শে কর্ণপাত করে না। তার মনে বাঙালিদের প্রতি যে প্রেম আছে , সেটাই তাকে গাইড করছে। যতই অসম এবং অসমিয়া ভাষার কথা বলে জাতীয়তাবাদের ঢোল বাজাক না কেন , ভেতরে-ভেতরে লক্ষ্ণী বাঙালিদের ভালোবাসে। তার জন্যই এত তাড়াতাড়ি একজন বঙ্গ ললনার মোহজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ল। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বিয়ে করার পরে ঘরজামাই হয়ে লক্ষ্মী স্থায়ীভাবে ঠাকুর বাড়িতে বসবাস শুরু করবে। তারপরে লক্ষ্মী আর অসমিয়া হয়ে থাকবে না। কিছুদিনের মধ্যেই বাঙালি হয়ে যাবে। এদিকে বিশাল ঠাকুরবাড়ির যে রকম পরিবেশ– সেখানে দেবেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তির সঙ্গে বসবাস করে লক্ষ্মী আর কোথায় অসমিয়াতে লিখবে। অসম এবং অসমিয়াকে ভুলে সে বাংলায় লিখতে শুরু করবে।'

' হবে ভোকেন্দ্র দাদা।' চায়ের ভাঁড়টা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হেমচন্দ্র বলল,' আমি এখন যাই।'

' আচ্ছা। তবে তোমরা লক্ষ্মীর সঙ্গে থেকো। তুমি আর চন্দ্র তার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তোমরা ত্রিমূর্তি বলে পরিচিতি লাভ করেছ। এই ত্রিমূর্তির একজন যদি খারাপ কাজ করে, সেটা কিন্তু বাকি দুজনের গায়েও লাগবে। ঠাকুরবাড়ির মেয়েকে বিয়ে করাটা যে কত খারাপ এবং বিপদজনক, তোমরা এই কথাটা লক্ষ্মীকে বোঝাতে পারলে না , এটা কম দুর্ভাগ্যের কথা নয়।'

হেমচন্দ্রের রাগ হল। কিন্তু ভোকেন্দ্রর সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছা হল না। সংক্ষেপে বলল,' আপনি দুর্ভাগ্যের কথা বললেন। কে কখন দুর্ভাগ্যের বলি হয়, কে আবার সৌভাগ্যশালী হয়ে ওঠে বলা যায় না।'

'ওহো তুমি আমার কথাটা ফলো করতে পার নি বলে মনে হচ্ছে ।'

'হবে, পরে কথা বলব । এখন আসছি ।'

হেমচন্দ্র ভোকেন্দ্রর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। দ্রুত হেঁটে মেসে ফিরে এল। বাইরের বারান্দায় মেসের দুজন সদস্য কথা বলছে। তাদের আওয়াজ দিয়ে রুমে প্রবেশ করল।

ঘরের পরিবেশ থমথমে। লক্ষ্মীনাথ বিছানায় শুয়ে আছে। সামনে চিন্তিতভাবে বসে রয়েছে চন্দ্রকুমার।

'কী হল, তোমরা যে এভাবে –!'

চিন্তিত কন্ঠে চন্দ্রকুমার বলল, 'শিবসাগর থেকে টেলিগ্রাম এসেছে।'

' টেলিগ্রাম!'

' বেজের মেজ দাদা গোবিন্দচন্দ্র পাঠিয়েছে।' জোর করে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলে চন্দ্রকুমার বলল,' টেলিগ্রামে লিখেছে, ইউর মেরেজ সেটেলড। কাম ইমিডিয়েটলি। এখন একজন বেজকে দুজনকে বিয়ে করতে হবে।'

তার রসিকতায় গুরুত্ব না দিয়ে হেমচন্দ্র বলল, মেসো কলকাতা থেকে বাড়িতে যাওয়ার একমাসই হয়নি। বাড়িতে গিয়েই তিনি বেজের বিয়ে ঠিক করে ফেললেন! তারা এখানে থাকা অবস্থায় ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে বেজের বিয়ের কথা চলছিল। মেসো কি কথাটা কোনো ভাবে জানতে পেরেছিলেন?'

' জেনে থাকতে পারেন। তখন আমাদের অসমিয়া ছাত্রদের অনেকেই মেসোর সঙ্গে দেখা করেছিল। আমাদের মধ্যে কয়েকজনের স্বভাবই এরকম। কেবল খারাপ কথাটা খুঁচিয়ে বের না করলে ওদের পেটের ভাত হজম হয়না।'

' তার প্রমাণ প্রেস থেকে বেরিয়ে পথেই পেলাম। আমাদের মহাপুরুষ ভোকেন্দ্র বরুয়া সে সব কথাই বলল । ঠাকুরবাড়ির কন্যার সঙ্গে বেজের বিয়ে ঠিক হওয়ায় ওরা ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে মরছে। বিয়ের পরে বেজ ঘর জামাই হয়ে থাকবে, বেজের ব্যক্তিসত্তা বলে কোনো জিনিস থাকবে না, অসম অসমিয়াকে ভুলে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে যাবে… এইসব বদনাম রটিয়ে চলেছে। ওদের কেউ শিবসাগরে চিঠি পাঠিয়ে মেসোকে এসব জানিয়েছে নাকি?'

' অসম্ভব নয়।'

শুয়ে থাকা থেকে লক্ষ্মীনাথ উঠে বসল। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর তার মুখটা কঠিন হয়ে পড়ল।

' দেখ, পরশ্রীকাতর এবং নিন্দুকরা হল আম-কাঁঠালের মাছির মতো।' লক্ষ্মীনাথ বলল, 'ওদের নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই।'

' কিন্তু এভাবে অপপ্রচার চালিয়ে, বদনাম গেয়ে তোমার অপকার করছে।'

' তাবলে ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়েটা ভেঙ্গে দেব নাকি?'

' না না। ভেঙ্গে দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। সেরকম অমঙ্গলের কথা বলবে না।' চন্দ্রকুমার বলল,' কথাটা হল, দাতার টেলিগ্রাম অনুসরণ করে এখন তোমার বাড়িতে যাওয়া কি সম্ভব?'

' কীভাবে সম্ভব?'

' তাহলে টেলিগ্রামের একটা উত্তর দিতে হবে।'

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লক্ষ্মীনাথ বলল,' আমি আজকেই বাড়িতে টেলিগ্রাম করব।'

' কী লিখবে টেলিগ্রামে?'

' মাই ম্যারেজ হেজ সেটেলড উইথ দ‍্য গ্র্যান্ড ডটার অফ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।'

কঞ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...