হে আমার স্বদেশ- ১৪
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(১৪)
টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে ভেতরে ভেতরে সংকল্পবদ্ধ হলেও লক্ষ্মীনাথ স্বস্তি পেল না। মা বাবার কথা ভেবে অস্থির হয়ে পড়ল। খারাপ লাগতে লাগল। কিন্তু এখন আর কোনো উপায় নেই। শিবসাগরে মা-বাবা, দাদা বৌদিরা লক্ষ্মীনাথকে কিছু না জানিয়ে কোনো একজনকে বাড়ির বউ করে আনবে বলে ঠিক করল, বাড়ির প্রত্যেকেই একত্রিত হয়ে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি কথায় সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে এম এ এবং আইন পড়তে থাকা একজন যুবকের পছন্দ-অপছন্দের, মতামতে গুরুত্ব দিল না। এই মনোভাবটাই লক্ষ্মীনাথকে অভিমানী করে তুলল। এদিকে কলকাতায় পড়তে আসা একদল অসমিয়া ছাত্র যে ঠাকুরবাড়ির কন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ের বন্দোবস্থ হওয়াটা নিয়ে হুলস্থুল করতে শুরু করেছে –এটাও লক্ষ্মীনাথের সংকল্পটাকে আরও দৃঢ় করে তুলল। না,সে কোনো অন্যায় করছে না। তাই,সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হবে না। তার জন্যই ঠাকুরবাড়ির দুজন বিশ্বস্ত কর্মচারীর সঙ্গে বৈকন্ঠ নাথ দত্ত এসে চন্দ্রকুমার হেমচন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করে লক্ষ্মীনাথের কীভাবে বিয়ে হবে, কোথা থেকে কতজন বরযাত্রী যাবে, সবকিছু চূড়ান্ত করল। উভয়পক্ষের নাম-ঠিকানা শুদ্ধ করে কাগজে লিখে নিল । জোনাকী যেখানে ছাপা হয় সেই ' কলকাতা প্রিন্টিং হাউস'এ বিয়ের চিঠি ছাপানো হল। চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্রের সঙ্গে বসে কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করা হবে তার একটা তালিকা প্রস্তুত করা হল।
বিবাহ একটা শুভ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজন এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা বর কনের মঙ্গলময় জীবন কামনা করে আশীর্বাদ দেয়। কিন্তু লক্ষ্মীনাথের বিয়েতে আত্মীয়-স্বজনের অনুমতি
নেই।এদিকে তার আর্থিক প্রাচুর্যও এতটা নেই। তাই এই শুভ অনুষ্ঠানটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হবে কিনা, তা নিয়ে একটা আশঙ্কা দেখা দিল। তথাপি, তারমধ্যে সাহস এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে হেম গোঁসাই এবং মাজিউর সাহায্য নিয়ে লক্ষ্মীনাথ বিয়ের প্রস্তুতি চালাতে লাগল। কলকাতায় নিজেদের বাড়িঘর নেই। আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যাও সীমিত। তাই বিয়ে বলে বললেই যে ঘরোয়া আচার সংস্কারের কথা থাকে, সেইসব পালন করার জন্য বাড়ির মহিলা মহলে যে উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়, দশ বারো দিন আগে থেকে আত্মীয়-স্বজন কুটুমদের আগমনে বাড়িতে যে কোলাহলের সৃষ্টি হয়, সেসব হবে না।
সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও মেসের সদস্যরা সক্রিয়ভাবে লেগে দুই নম্বর ভবানীচরণ দত্ত লেন মেসটিকে বরের ঘর হিসেবে সাজিয়ে তুলল। এই মেসবাড়ি থেকেই লক্ষ্মীনাথ বন্ধুবান্ধব এবং আমন্ত্রিতদের সঙ্গে নিয়ে বররূপে প্রজ্ঞাসুন্দরীকে বিয়ে করার জন্য জোড়াসাঁকো যাত্রা করবে।এদিকে নিমন্ত্রণ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। রায়বাহাদুর গুণাভিরামকে নিমন্ত্রণ করা হল।গঙ্গা গোবিন্দফুকন এখন ও কলকাতায় রয়েছে। চন্দ্রকুমারকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ তাকেও নিমন্ত্রণ করতে এল। কিন্তু ফুকন মহাশয় অন্যান্য দিনের মতো লক্ষ্মীনাথ চন্দ্রকুমারকে আদর যত্ন করে ভেতরে নিয়ে গেল না। তার মুখটা গম্ভীর দেখে লক্ষ্মীনাথের মনে একটা সন্দেহ জাগল। ফুকন মহাশয়েরও এই বিয়েতে সমর্থন নেই নাকি?
'কী হল, কাকু? আপনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন নাকি?' বিনয়ের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ জিজ্ঞেস করল।
'না, কেন অসন্তুষ্ট হব?'
' না, মনে হচ্ছে আপনি ভেতরে ভেতরে আমার উপর রাগ করে রয়েছেন। আমি কি কোনো অন্যায় করেছি?'
' সেরকম কিছু নয়, লক্ষ্মী। গঙ্গা গোবিন্দফুকন বললেন,' তোমাকে বলতে খারাপ লাগছে। এদিকে না বললেও নয়–।'
' আপনি বলুন।'
' বললে খারাপ পাবে।'
' না খারাপ পাব না।'
' কথাটা দুর্ভাগ্যজনক। আর খারাপ পাবে না বললেও কথাগুলি শুনে তোমার খারাপ লাগবেই।'
ফুকন বললেন,' জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কন্যার সঙ্গে বন্দোবস্ত হওয়া তোমার বিয়েটা ভেঙ্গে দেবার জন্য শিবসাগর থেকে আমার কাছে কয়েকটি টেলিগ্রাম এসেছে।'
' বিয়ে ভেঙ্গে দেবার জন্য আপনার কাছে টেলিগ্রাম এসেছে!' অস্ফুট কন্ঠে চন্দ্রকুমার বলে উঠল।
লক্ষ্মীনাথ চুপ।
' কে টেলিগ্রাম করেছে?'
' দুটো করেছে দীন দাদা। একটা গোবিন্দ করেছে।
গোবিন্দেরটা আজ সাড়ে চারটার সময় পেয়েছি।
চন্দ্রকুমার নিঃশব্দ। লক্ষ্মীনাথ শান্ত। কিন্তু তার অন্তরটা জ্বলছে।
' সঙ্গে এই খবরও পেয়েছি যে দীনদাদা শিবসাগরের কালীপ্রসাদ চলিহা এবং কয়েকজন বয়স্ক মানুষকে বাড়িতে ডেকে এনে ঠাকুরদের ওপরে মামলা করে ক্ষতিপূরণের সঙ্গে তোমাকে কীভাবে দখল করতে পারবে, তার জন্য জল্পনা-কল্পনা করছে।'
এবার লক্ষ্মীনাথের সত্যিই খারাপ লাগল। অন্তরের যন্ত্রণাটা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। বিদ্যা বুদ্ধি বিচার জ্ঞানে বাবা প্রবীণ। শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিদ্যালয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তৎপর, আয়ুর্বেদিক ওষুধ দিয়ে দুঃখিদের রোগ শুশ্রূষা করে তোলার জন্য এত সেবা-যত্ন করে, প্রতিদিন বাড়িতে শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে শাস্ত্র পাঠ আলোচনা করে, উদার বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা প্রকাশ করে। অথচ নিজের পুত্রের বিয়ের কথাটা নিয়ে তিনি এতো অনুদার, এত সংকীর্ণ হয়ে পড়েছেন। লক্ষ্মীনাথের পছন্দ-অপছন্দের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে তার ভবিষ্যতের কথা না ভেবে , আক্রোশমূলক মনোভাবের সঙ্গে বাবা বন্দোবস্ত হওয়া বিয়েটা ভেঙ্গে দেবার জন্য মামলা করার চক্রান্ত করছেন ।
বাবার কথা ভেবে লক্ষ্মীনাথের লজ্জা হল। তারপরে অভিমানী হয়ে পড়ল। নিমেষের মধ্যে লজ্জা, মন খারাপ এবং অভিমান ক্রোধে রূপান্তরিত হল।
' কাকু, আপনি আমাদের ঘরের মানুষের মতো। তাই খোলাখুলিভাবে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি–।' ক্রোধ চেপে লক্ষ্মীনাথ বলল,' ইতিমধ্যে বিয়ের সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। দুই পক্ষই বিয়ের জোগাড় যন্ত্র করে ফেলেছে।এমনকি নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে বিয়েতে ডাকার কাজটাও প্রায় শেষ করে ফেলেছে। এরকম অবস্থায় আমার করণীয় কি !'
গঙ্গাগোবিন্দের চোখেমুখে বিব্রতভাব ফুটে উঠল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন ‘আমার হিসেবে ব্যাপারটা জটিল হয়ে পড়েছে ।'
হেমচন্দ্র বলল, ‘আপনি তাহলে মেসোমশাই এবং গোবিন্দ দাদা পাঠানো টেলিগ্রাম অনুসরণ করে বন্দোবস্ত হওয়া এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে বলছেন?'
' সে কথা কেন বলব? না, গোবিন্দ এবং দীনদাদা টেলিগ্রাম পাঠালেও আমি কখনও সেরকম কিছু করতে বলব না।' গঙ্গা গোবিন্দ ফুকন বললেন, কিন্তু আমি চাই, এই ব্যাপারে তোমরা একটা বোঝাবুঝি করে নাও।'
' বাবা ঠাকুরবাড়ির ওপরে মামলা করে আমাকে উদ্ধার করার জন্য উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করেছে যখন – এতে আর কিছুই বোঝাবুঝির নেই কাকু।' লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বরে উষ্মা,' এদিকে আমি কোনোমতেই এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসতে পারব না। তাই আমি আপনাকে আমার বিয়েতে ডেকেছি। বিয়ের দিন কিছুক্ষণের জন্য দেখা দিয়ে আপনি আমাকে আশীর্বাদ করবেন বলে আশা রাখছি।'
ফুকন মহাশয়কে সবিনয়ে বিয়েতে নিমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বরটা ভারী হয়ে উঠল।তারপরে ফুকনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সীমাহীন মনখারাপ নিয়ে ম্লানমুখে মেসে ফিরে এল।
পথে চন্দ্রকুমার তাকে বোঝাল। বিশেষ করে গোবিন্দদাদার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে ভালো করে
বুঝিয়ে বলার উপর গুরুত্ব আরোপ করল।খারাপ পেয়েছে, তাহলেও আধুনিক মনের গোবিন্দ দাদা লক্ষ্মীনাথের বিয়ের কথাটা বুঝতে পারবে, বুঝতে পেরে একটা ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে বাবার সঙ্গে বোঝাবুঝিতে আসার একটা পথ বের হবে বলেও চন্দ্রকুমারের মনে হল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথের মনের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়েছে যে পরামর্শটা তার কানেই ঢুকল না। মেসে এসে নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় বসল। খারাপ লাগছে,ক্লান্ত লাগছে, এরকম মনে হচ্ছে যে পিতা মাতার আশীর্বাদ না পাওয়ার জন্য তার জীবনে অভিশাপ নেমে আসবে। পুনরায় লক্ষ্মীনাথ বিচলিত হয়ে পড়ল। বিবাহটা যে মিলন,এই মিলন যে এক আনন্দময় পরিপূর্ণতা। এই মিলনের পরেই যে সাংসারিক জীবন গড়ার সোনালি স্বপ্ন দেখা… এসব অর্থহীন হয়ে পড়ল বলে মনে হল।
মনটা যেন কী রকম হয়ে গেল। যে সংকল্পের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির কন্যাকে বিয়ে করবে বলে আত্মবিশ্বাসের সুরে গঙ্গাগোবিন্দ ফুকনকে বলল তা নাই হয়ে গেল। এবার তার মনে প্রশ্ন জাগল, এভাবে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সত্যিই সে কোনো অন্যায় করেছে নাকি? ঠাকুরবাড়ির কন্যাকে বিয়ে করার প্রসঙ্গে বাবা দাদা যদি এতটাই খারাপ পেয়ে থাকেন তাহলে বিয়ে করার প্রয়োজন নেই। তাবলে, তারা যাকে পছন্দ করে রেখেছে লক্ষ্মীনাথ তাকে বিয়ে করতে পারবে না। প্রজ্ঞাসুন্দরীকে বিয়ে করতে না পারলে সে চিরকুমার হয়ে থাকবে।
এইসব যন্ত্রণাদায়ক ভাবনা লক্ষ্মীনাথকে অস্থির করে তুলল। অবশেষে বালিশের নিচ থেকে ফোটোটা বের করল। লক্ষ্মীনাথ দেখল, একান্ত মনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফটোটার মধ্যে তার মন একটা আশ্রয় খুঁজে পেল। তখনই মনে পড়ল রায়বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়ার কথা। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে বিধবা বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিয়ে করে তিনি নতুন করে জীবন শুরু করেছিলেন। ত্রিশ বছর আগে তিনি যদি যুগের প্রচলিত অন্ধ সংস্কার অতিক্রম করে এগোতে পেরেছিলেন তাহলে লক্ষ্মীনাথ কেন আজকের এই বাধা-বিপত্তি গুলিকে গুরুত্ব না দিয়ে এগোতে পারবে না? অন্যদিকে, সেদিন চন্দ্রকুমার ঠিকই বলেছে, ধর্মীয় সংস্কারের চেয়ে মানবীয় ভাব অনুভূতির মূল্য অধিক। প্রজ্ঞাসুন্দরীর সঙ্গে ইতিমধ্যেই তার হৃদয়ের আবেগ জড়িত হয়ে পড়েছে। এই আবেগ-অনুভূতিকে তাকে মর্যাদা দিতেই হবে। এইভাবে ভাবার পরে অন্তরে সৃষ্টি হওয়া বিচলিত ভাবটা দূরীভূত হল। দেহের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হল।
তখনই মেসের চাকর হরি ঘরে প্রবেশ করে খবর দিল যে বাইরে একজন ভদ্রলোক অপেক্ষা করে রয়েছেন। তিনি লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে দেখা করতে চান। ফোটোটা বালিশের নিচে রেখে লক্ষ্মীনাথ মানুষটাকে ভেতরে নিয়ে আসার জন্য হরিকে নির্দেশ দিল।
ভদ্রলোক ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন। লক্ষ্মীনাথকে নমস্কার জানিয়ে তিনি বললেন,' আমার নাম বিনোদবিহারী ভট্টাচার্য। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কর্তামশাইয়ের নির্দেশে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
' কর্তামশাই!'
' মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়। আমি ওর কাছারিতে কাজ করি।'
পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। চোখে ফিতা লাগানো চশমা। বয়সে বড় যদিও ভদ্রলোকটি লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে কথা বলছে।
লক্ষ্মীনাথ ও শিষ্টাচার সহকারে বলল,' বসুন।'
তিনি চেয়ারটাতে বসলেন।
' বলুন কর্তামশাই কেন আপনাকে আমার কাছে পাঠালেন?'
লক্ষ্মীনাথের দিকে কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়ে থেকে বিনোদবিহারী ভট্টাচার্য্য বললেন,' আপনার সঙ্গে ইতিমধ্যে কর্তামশাইয়ের তৃতীয় পুত্র পরলোকগত হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের দ্বিতীয়া কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরীর বিয়ের পাকা কথা হয়েছে। বিয়ের দিন লগ্নও ধার্য হয়েছে।'
'হ্যাঁ, মার্চ মাসের এগারো তারিখ।' লক্ষ্মীনাথ বলল।
' কিন্তু বিয়ের 'কন্ডিশন' মানে দেনা-পাওনার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি।' বিনোদবিহারী ভট্টাচার্য্য বললেন,' তাই কর্তামশাই আমাকে পাঠিয়ে আপনার দাবির বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। অনুগ্রহপূর্বক আপনি যদি আমাকে জানান–।'
লক্ষ্মীনাথ গম্ভীর হয়ে পড়ল। বঙ্গদেশে পাত্রপক্ষ কন্যার অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা চায় এবং এটা নিয়ে রীতিমতো দরদস্তুর করার পরে একটা মীমাংসাতে এলে পড়েই বিয়ে হয়। এটা যে একটি জঘন্য কুপ্রথা, বাঙালিরাও তা স্বীকার করে। কিন্তু কার্যত বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা লাভ করা বি এ এম এ পাস করাদের মধ্যেও এখন এটা চলছে। তার জন্য বহু কন্যাদায়গ্রস্ত বাঙালি পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। অনেক পরিবারে বিবাহিতা মেয়ে বাবাকে নিশিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য স্ব-ইচ্ছায় আফিং পান করে বা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
লক্ষ্মীনাথকে গম্ভীর হয়ে পড়তে দেখে ভদ্রলোকটি অবাক হলেন।
' মানে কথাটা হল– বিয়ের যৌতুক বলে কথা আর কি। আপনি বিবাহ করতে যাচ্ছেন–।' ভট্টাচার্য্য ব্যাখ্যা করতে লাগলেন, আপনি কন্যা পক্ষের কাছ থেকে কত টাকা নগদ–?'
' বুঝেছি, আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছি। লক্ষ্মীনাথ বলল,' আপনি গিয়ে কর্তামশাইকে বলবেন, অসমের অসমিয়াদের মধ্যে ধন নিয়ে বিবাহ করার প্রথা নেই। অসমিয়ারা এই প্রথাকে অন্তরের গভীর থেকে ঘৃণা করে।'
' বলছেন কি!'
' আরও শুনুন–।' লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বর এবার একটু কঠিন হয়ে এল,' কর্তামশাইকে এটাও জানাবেন যে আমি বাংলাদেশের শিক্ষিত সুমার্জিত এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধের দ্বারা আত্মীয়তা করতে চলেছি। ব্যবসায়ীদের মতো দরদাম করে সেই সম্বন্ধটাকে হেয় এবং অপমানিত করতে চাই না।'
লক্ষ্মীনাথের শেষের কথাগুলি রূঢ় হয়ে পড়ল। কর্মচারীটির মুখ কালো হয়ে গেল। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থেকে ম্লান মুখে বললেন ,' বুঝতে পেরেছি, যৌতুকের টাকার ব্যাপারটা আপনার মোটেই ভালো লাগেনি। অনুগ্রহ করে আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনার কথা কর্তামশাইকে বুঝিয়ে বলব। আচ্ছা, আমি তাহলে আসি।'
গঙ্গাগোবিন্দ ফুকনকে নিমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে বাবা এবং তাদের অবস্থান নিয়ে যে মানসিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল, এখন তা দূর হয়ে গেল।
অসমের রাজবৈদ্য দীননাথ বেজবরুয়ার পুত্র লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে বঙ্গের অভিজাত জমিদার এবং সাংস্কৃতিক চেতনাসম্পন্ন পুরুষ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্রী প্রজ্ঞাসুন্দরীর বিবাহ। এটি সাধারণ বিবাহ নয়। একজন অসমিয়া যুবকের সঙ্গে একজন বাঙালি কন্যার বিবাহ।
কিন্তু অসমিয়া বরের বিয়ের বাসর অসমে নয়। বিয়ের বাসর হল কলকাতার দুই নম্বর ভবানীচরণ দত্ত লেনের একটি মেস। এই মেস থেকে বরকে নিয়ে বরযাত্রীরা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি যাত্রা করবে। বর এবং বরের সঙ্গে শুভার্থী আত্মীয় এবং বন্ধুরা মহা উৎসাহের সঙ্গে বের হল। কলকাতায় পড়াশোনা করতে আসা অসমিয়া ছাত্রদের মধ্যে লক্ষ্মীনাথ যেরকম উজ্জ্বল রত্ন সেইভাবে বঙ্গের জমিদার এবং সম্ভ্রান্ত ঠাকুর পরিবারের কন্যা সন্তান প্রজ্ঞাসুন্দরী ও সর্বগুণসম্পন্না। গত কয়েক মাস ধরে এই বিয়ে নিয়ে অনেক আলোচনা, অনেক বিতর্ক, অনেক বাধা বিপত্তির ঢেউ উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই বিয়েটা কলকাতাবাসী অসমিয়া এবং বাঙ্গালিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
বরযাত্রীরা বরকে নিয়ে ঠাকুরবাড়ির বিশাল গেটের সামনে গাড়ি থেকে নামল। সঙ্গে সঙ্গে উর্দিপরা সিপাহি কয়েকজন সালাম জানিয়ে সেখান থেকে সরে দাঁড়াল। অদূরে মল্লিকা শোভিত ডালা নিয়ে সাজপোশাকে অভিজাত সুন্দরী মহিলা এবং যুবতিরা অপেক্ষা করছিল। বরযাত্রীদের সঙ্গে বরকে দেখেই তারা উলুধ্বনি দিয়ে উঠল। সঙ্গে বেজে উঠল ব্যান্ড পার্টি। মহিলারা বরবেশী লক্ষ্মীনাথকে বরণ করে নেবার জন্য এগিয়ে এল।
বর লক্ষ্মীনাথকে দেখে মহিলারা 'ওমা,কী সুন্দর বর গো',' বর দেখছি একেবারে রাজপুত্র', চেহারাও আমাদের জ্যোতি দাদার মতো',' প্রজ্ঞার কপাল ভালোই বলতে হবে' ইত্যাদি মন্তব্য করতে লাগল। তারমধ্যেই বর বরণের অনুষ্ঠান হয়ে গেল। এইটুকু সময়ের মধ্যে কয়েকজন রূপসী যুবতি লক্ষ্মীনাথ এবং তার দুই পাশে থাকা চন্দ্রকুমার হেমচন্দ্রের সঙ্গে লঘু হাস্যরসে অংশগ্রহণ করল। তারপরে তারা লক্ষ্মীনাথকে এগিয়ে নিয়ে ভেতরে বর এবং বরযাত্রীদের বসার জন্য বিশেষভাবে আয়োজন করা মখমলের তাকিয়া থাকা সাদা সুকোমল বিছানায় বসতে দিল।
অনেকদিন পরে ঠাকুরবাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। তার মধ্যে আবার কন্যার পিতা অকালে স্বর্গবাসী। অতিথি অভ্যাগতদের কেউ যাতে তা অনুভব না করে তার জন্য ঠাকুরবাড়ির মুকুটমণি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ সবাইকে বিশেষভাবে নজর দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। মহর্ষির পুত্র-কন্যা পুত্রবধূ- জামাই পৌত্র পৌত্রীরা… আত্মীয় কুটুম্ব বন্ধুবান্ধব , কলকাতার সাহিত্য কলা ক্ষেত্রের বিখ্যাত ব্যক্তিরা, কলকাতার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ, হাই কোর্টের জজ ব্যারিস্টাররা এমনকি উচ্চপদস্থ সাহেবরাও এই বিয়েতে সম্মানীয় অতিথি। ঝাড়বাতিতে শোভিত বিশাল বিবাহ মন্ডপে চেয়ার পেতে দিয়ে অতিথিদের বসার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আমন্ত্রিতদের গেটের সামনে ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন সুধীন্দ্রনাথ এবং বলেন্দ্রনাথ আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদের ভেতরে ডেকে এনে বসাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে সুগন্ধি শরবত। অন্যদিকে, ওদিকে চলছে আপ্যায়ন। সেখানে বয়োজ্যেষ্ঠ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তদারকি করছেন। ঠাকুর পরিবারের কর্তামশাই, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ, দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ভেতর মহলে অতি বিশিষ্ট অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। বিবাহ বাসরের দক্ষিণ দিকে কবি রবীন্দ্রনাথ তার ভক্তদের নিয়ে হাস্যালাপে মগ্ন। সবকিছু মিলিয়ে সত্যিই অভিজাত উৎসবমুখর এক বাতাবরণ।
এরকম একটি পরিবেশে এসে অসমিয়া তরুণ ছাত্রদের মনে কিছু পরিমাণে হীনমন্যতার বোধ সৃষ্টি হলেও তারা শান্ত এবং সুসংহত। প্রজ্ঞাসুন্দরীর বোন স্থানীয় যুবতিদের সঙ্গে বরযাত্রীরা সকৌতুক পরিহাসে হাসিয়ে এক আনন্দ মুখর পরিবেশ সৃষ্টি করল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথের অন্তরটা ব্যথিত হয়ে পড়ল। আজ তার শুভ পরিণয় হতে চলেছে, অথচ তার সঙ্গে বাড়ির কোনো একজন অভিভাবক নেই, নেই কোনো একজন ভাই বা বোন, নেই শিবসাগর থেকে আসা কোনো একজন আত্মীয়। লক্ষ্মীনাথের মনটা দুর্বল হয়ে পড়ল। পুনরায় তাঁর মনে সেই আশঙ্কার সৃষ্টি হল, মা-বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে চলেছে। এভাবে বিয়ে করে সে কি সুখী হতে পারবে?
ঠিক তখনই মহিলারা লক্ষ্মীনাথকে বিয়ের মূল মন্ডপে নিয়ে গেল।
এটা সর্বসাধারণ বাঙ্গালিদের বিয়ে নয়। বিয়েটা হবে ব্রাহ্মসমাজের বিধিমতে। এই বিয়েতে হোমের আয়োজন হবে না। শালগ্রাম শিলা থাকবে না। হোমের আয়োজন এবং শালগ্রাম শিলা ছাড়া হিন্দু বিয়ের সমস্ত আচার পালন করা হবে। বিয়ের মন্ডপে বসার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় উলুধ্বনি এবং ব্যান্ড পার্টির বাজনা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ল।
পুরোহিতের বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তার অনুসরণে লক্ষ্মীনাথকে মন্ত্র উচ্চারণ করতে হল। তারপরে আরও একবার উলুধ্বনি দিয়ে অন্দরমহল থেকে কয়েকজন মহিলা কনে রূপী প্রজ্ঞাসুন্দরীকে এনে বিবাহ মন্ডপের কাছে দাঁড় করাল। মূল মণ্ডপে বরের সামনে বসার আগে কনের সঙ্গে বরের 'শুভদৃষ্টি পর্ব' সম্পন্ন করা হবে। লক্ষ্মীনাথ ইতিপূর্বে কখনও স্বচক্ষে প্রজ্ঞাসুন্দরীকে দেখে নি। এই বিশেষ অনুষ্ঠানে ভাবী সহধর্মিনীর মুখ দেখতে পাবে। চার চোখের মিলন হবে। লক্ষ্মীনাথ ভেতরে ভেতরে রোমাঞ্চিত হয়ে পড়ল। স্ত্রী আচার শেষ হওয়ার পরে বর-কনের শুভদৃষ্টি হয়। লক্ষ্মীনাথ এবং প্রজ্ঞাসুন্দরীকে মুখোমুখি করে দাঁড় করান হল। লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞাসুন্দরীর দিকে তাকাল। প্রজ্ঞাসুন্দরী ধীরে ধীরে মাথা তুলে লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে প্রথমে কিছু অবাক হল, তারপরই ফিক করে হেসে ফেলল। লক্ষ্মীনাথের মনে অনির্বচনীয় এক শিহরণ খেলে গেল এবং সে ও হেসে ফেলল।
বন্ধুবর্গ এবং কন্যা পক্ষের কমবেশি মহিলাদের হাসি ঠাট্টার মধ্যে শুভ দৃষ্টি সম্পন্ন হওয়ার পরে বর কনেকে মুখোমুখি করে বসানো হল।পুনরায় কিছু মন্ত্রোচ্চারণ… মন্ত্র উচ্চারণ করে কনে সম্প্রদান, তারপরে বর-কনের চাদরের বন্ধন।সেই বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আরম্ভ হল বর-কনের পবিত্র' 'সপ্তপদী গমন' । বর লক্ষ্মীনাথ আগে আগে।তার সঙ্গে চাদরের বন্ধনে আবদ্ধ কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী পেছন পেছন। কাছে সারি পেতে দাঁড়িয়ে থাকা গুরুস্থানীয় আত্মীয়-স্বজন এবং শুভার্থীরা মঙ্গল কামনা করে সপ্তপদী গমণরত বর-কনের ওপরে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগল।
সঙ্গে বর-কনেকে পতি পত্নী রূপে বরণ করে সমবেত হওয়া বয়স্ক মহিলারা গাইলেন,
' আয়রে আয় সোনার জামাই
বরণ করি শাঁখ বাজায়ে।
দেখ যেন যেয়ো নাকো
ছাদনাতলায় মন হারিয়ে
বাসর ঘর।
মহিলারা প্রজ্ঞাকে বাসর ঘরে নিয়ে এল। তারা অনেকক্ষণ লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে হাস্যপরিহাস করল। সেই হাস্যপরিহাসে লক্ষ্মীনাথও সমান অংশগ্রহণ করল। অবশেষে 'শুভ মধুযামিনী' বলে সম্ভাষণ জানিয়ে তারা বিদায় নিল। প্রজ্ঞা দরজা বন্ধ করতেই লক্ষ্মীনাথের দেহ মন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। প্রজ্ঞার ঠোঁটদুটিতেও মোহময়ী হাসি। একে অপরকে হাসির দ্বারা সম্ভাষণ জানাল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথের মনে কেমন যেন একটা সংকোচের ভাব। প্রজ্ঞার সামনে থেকে সরে গিয়ে দক্ষিণের খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে নির্জন হয়ে পড়া রাতের জোড়াসাঁকো। ঘর দুয়ার রাস্তাঘাটের ওপরে পাতলা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ সেগুলি দেখে এক পা দু পা করে এগিয়ে গিয়ে রজনীগন্ধা চামেলি ইত্যাদি সুগন্ধি ফুলে সাজানো বিছানায় বসল।
' ক্লান্ত লাগছে বুঝি?'
' একটু লাগছে বৈকি!' একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে লক্ষ্মীনাথ বলল,' বিয়ে করাটা বড্ড ঝামেলার দেখছি । কত রকম যে নিয়ম মানতে হয়।'
' তবু বাপু ছেলেদের কমই মানতে হয়। আমাকে যে কত দিন উপোস থাকতে হল।' লক্ষ্মীনাথের খুব কাছে এসে প্রজ্ঞা বলল,' খুব খারাপ লাগছে? বাতাস করব?'
'না না ততটা ক্লান্ত হইনি।'
' তুমি যে তেমন কিছু খেলেই না। রান্নাবান্না ভালো হয়নি?'
' সারাদিন যা ধকল গেল । ক্ষুধা শুকিয়ে গেছে।'
' তোমার জন্য দুধ রাখা আছে।বিয়ের রাতে বরকে দুধ খাওয়াতে হয়, এখন খাবে? আনব?'
' এখন থাক।এসো, আমার কাছে এসে বস।'
প্রজ্ঞা লক্ষ্মীনাথের বাঁ দিকে বসল। এতোটুকু কথাবার্তা বলতেই দুজনের মধ্যে জড়তা সংকোচ নাই হয়ে গেল। দুজনের প্রতি দুজনের ভাবটা এরকম যেন আগে থেকেই একে অপরকে জানে। আগে থেকেই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা আছে।
'তোমার নাম প্রজ্ঞাসুন্দরী। কে দিল এমন একটি কঠিন নাম?'
' কেন তোমার পছন্দ হয়নি?'
' খুব পছন্দের নাম।' হাসতে হাসতে লক্ষ্মীনাথ বলল। কিন্তু উচ্চারণ করতে বেশ জোর দিতে হয়। আমি কিন্তু এই নামটা সহজ করে নেব। আমি তোমাকে'পরি' বলে ডাকব।'
'ওমা, এটাই তো আমার ডাকনাম।'
' বাহঃ ভালোই হল। আমিও যদি তোমাকে এই নামে ডাকি খারাপ পাবে?'
'কেন খারাপ পাব? ইচ্ছে করলে তুমি অন্য নামও রাখতে পার।'
'না, অন্য নাম রাখব না।পরি নামটাই বেশ ভালো। আচ্ছা শুভদৃষ্টির সময় তুমি যে ফিক করে হেসে ফেললে – ব্যাপার কী বলতো?'
প্রজ্ঞা গভীরদৃষ্টিতে লক্ষ্মীনাথের মুখের দিকে তাকাল।তাঁর আয়ত চোখ জোড়ায় ভালোবাসা, অনন্ত অনুরাগ।
' আমি যে তোমাকে স্বপ্নে দেখেছিলাম গো।' সে বলল, 'শুভদৃষ্টির সময় স্বপ্ন দেখার কথাটা মনে পড়ে গেল।'
' বিয়ের আগে আমাকে কখনও দেখনি। তথাপি যে স্বপ্নে দেখলে!'
' কেন দেখলাম জানিনে? কিন্তু স্বপ্নে দেখার মতোই তো তুমি।'
' স্বপ্নে দেখার মতোই আমি!'
'হ্যাঁগো । বিশ্বাস কর, এই তোমার গা ছুয়ে বলছি।' প্রজ্ঞার কন্ঠে আবেগ,' সেই মুখ, সেই চোখ ,সেই নাক, সেই কপাল। আর জান, এতদিন যেন আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম। তার জন্যই আমার অন্য কাউকে পছন্দ হয়নি।তোমাকে পেয়ে আমার জীবন ধন্য হল। আজ আমার সাত জন্মের তপস্যা সফল হল।'
তারপরে সে আর দূরে সরে থাকতে পারল না। নিজের অজান্তেই লক্ষ্মীনাথের কাছে চলে এল।
' এদিকে আমার কি হয়েছিল জান?' লক্ষ্মীনাথের কন্ঠে অনুরাগের আবেশ,' একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসছিল। সব প্রস্তাব অস্বীকার করে যাচ্ছিলাম। তাছাড়া এম এর সঙ্গে বি এল পাস করে নিজে স্বাধীনভাবে কিছু একটা না করা পর্যন্ত বিয়ে করব না বলে শপথ নিয়েছিলাম। কিন্তু যে মুহূর্তে তোমার ফোটোগ্রাফ হাতে পড়ল সেই মুহূর্তে সব ওলট পালট হয়ে গেল। সংকল্পের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। তুমি জীবনসঙ্গিনী হবে বলে আমার মনে এক আলোড়নের সৃষ্টি হল। প্রত্যেকদিন তিন-চারবার করে তোমার ফোটোটা দেখতে লাগলাম। তখন এমন মনে হত যেন আমার দিকে তুমি তাকিয়ে রয়েছ। আমার সঙ্গে কথা বলছ, যেন তুমি আমার পরম আত্মীয়। তোমার সঙ্গে আমার জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। কেমন করে এমনটা হল বলতো ?সম্ভব ,ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই এমনটাই হল। অস্ফুট কন্ঠে লক্ষ্মীনাথ বলল,' ঈশ্বরই আমাদের এমন করে মিলিয়ে দিলেন। প্রজ্ঞা একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে লক্ষ্মীনাথের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখজোড়া সজল হয়ে উঠল। সঙ্গে তার মাথার ঘোমটা খসে পড়ল। অপরুপা প্রজ্ঞার রূপ লক্ষীনাথকে শিহরিত করে তুলল।তাঁর স্পর্শ কাতর বাম হাত প্রজ্ঞাসুন্দরীর পিঠের দিকে এগিয়ে গেল। প্রজ্ঞার নিরাভরণ পিঠে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাতটা কেঁপে উঠল। লক্ষ্মীনাথ অনুভব করল, প্রজ্ঞা তো বাঙালি রমণী। প্রজ্ঞার কথা-বার্তা, সাজ পোশাক, চাল-চলনে বঙ্গ সংস্কৃতির ঐশ্বর্য। আর এতক্ষণ পর্যন্ত প্রজ্ঞার সঙ্গে যেভাবে ভাবের আদান প্রদান করল, সে সবও বাংলা ভাষায় করল। বাড়ির অবিভাবকরা নির্বাচন করা মেয়েটিকে বিয়ে করলে মাতৃভাষায় ভাব বিনিময় করতে পারত। এটাই লক্ষ্মীনাথের মনে একটা জড়তার সৃষ্টি করল। তবে এখন আর উপায় নেই। প্রজ্ঞা যে অসমিয়া বলতে পারে না। সে ভিন্ন ভাষা-ভাষী। তবে ভিন্ন-ভাষী হলেও দুজনের মধ্যে হৃদয়াবেগের কোনো অভাব নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন