রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২২

পাখিদের পাড়া পড়শী ৫ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi

পাখিদের পাড়া পড়শী ৫

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  


Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi



দ্বিতীয় অধ্যায়, 

(পাঁচ)

অসমের পাখি পর্যবেক্ষণের হাত পুথিটা হাতে পড়ায় সুনন্দ বেশ আপ্লুত হয়ে পড়েছে।

বিদ্যালয়ে যাবার মুহূর্তে সে বইটা হাতে নিয়ে বেরিয়েছে। একটা পাখি দেখতে পেলেই বইটা খুলে নিয়ে তার মধ্যে থাকা রঙ্গিন আলোকচিত্রের সঙ্গে পাখিটাকে মিলিয়ে দেখে । পাখিটার নামটা মনে রাখার চেষ্টা করে । ফলে সুনন্দের বিদ্যালয়ের দূরত্ব বেড়ে যায়।ব্রহ্মপুত্র নদীর মাঝখানের ভাঙনামারী চরে তার বিদ্যালয়। বৃত্তিতে সাংবাদিকতা করা প্রদীপ বর্মনের সঙ্গে সে 'শেয়ার সিস্টেমে' মুকালমুয়ায় যায়। প্রদীপের চাকরি মুকালমুয়ার বিদ্যালয়ে।সেখানে দুজনেই একসঙ্গে আসা যাওয়া করে। খরচটা দুজনে পরস্পর ভাগাভাগি করে নেয়। সেখান থেকে সে নৌকায় উঠে ভাঙনামারী চরে যায়।অন্য শিক্ষকদের মতো সে মাস্টারদের নৌকায় আসা-যাওয়া করে না।

মাস্টারদের নৌকাটা আবার ব্রহ্মপুত্র নদীপথের অদ্ভুত সংযোজন। সাড়ে নটার সময় ছেড়ে দেওয়া সেই নৌকার বেশিরভাগ যাত্রী শিক্ষক হওয়ার জন্য নৌকাটিকে প্রত্যেকেই মাস্টার নৌকা বলে। নৌকা চরে পৌঁছতে প্রায় এগারোটা বেজে যায়।বেশিরভাগ শিক্ষকরাই স্কুলে পৌঁছতে পৌঁছতে এগারোটা বেজে যায় । হলে কী হবে। ছেলেমেয়েদের দুপুরের খাবার খাওয়াতে পারলেই হল। বিদ্যালয়ে পৌঁছে উপস্থিতি গণনা করতে গিয়ে যদি পঞ্চাশজন ছাত্রছাত্রী উপস্থিত থাকে দুপুরে খাবার সময় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় পঁচাত্তর জন। মাস্টার নৌকাটা ছাড়ে দুপুরবেলা দেড়টার সময়। ফেরার সময়ও অন্য যাত্রী থাকে না, থাকে কেবল শিক্ষকবৃন্দ। দুপুরের খাবারটা ভালোভাবে খাওয়াতে পারলে অভিভাবকরাও সন্তুষ্ট থাকে। মাস্টার কখন আসে কখন যায়, তাতে তাদের কী আসে যায়।

–তুই মাস্টার পড়ালে পড়ালি না পড়ালে নেই। ভাত খাওয়ানোর ক্ষেত্রে কেবল কৃপণতা করিস না।

বেশিরভাগ অভিভাবকের মত এই ধরনের। শিক্ষকরাও সেই মতকে প্রাধান‍্য দিয়ে চাকরিটা বজায় রেখেছে। কথাগুলি সুনন্দের একেবারে পছন্দ নয়। সেই জন্য সে মাস্টার নৌকাতে যায় না।সে আটটার সময় নৌকায় গিয়ে দশটার আগেই স্কুলে পৌঁছে যায়। তার জন্য প্রদীপের কিছুটা কষ্ট হয়।কষ্ট মানে সময়ের চেয়ে কিছুক্ষণ আগে সে নিজের বিদ্যালয় পৌঁছে যায়।সুনন্দের সঙ্গে থাকা বন্ধুত্বের খাতিরে প্রদীপ কিছুটা আত্মত্যাগ করে। বিদ্যালয়ে সময়ের আগেই এসে যায় বলে ছাত্রছাত্রীদের চেয়েও অভিভাবকরা প্রদীপকে বেশি ভালোবাসে। স্থানীয় মানুষরা তার বিষয়ে বলাবলি করে ।

– এ আবার কেমন মাস্টার হে।সময়ের আগেই চলে আসে।

যারা শিক্ষকতা করে এবং সাংবাদিকতাও করে সেরকম শিক্ষকদের প্রতি সাধারণত মানুষের ধারণা ভালো নয় । কর্তব্যে গাফিলত করে বলে বদনাম রটে । প্রদীপ তার থেকে বহুযোজন দূরে। আগে শিক্ষকতা, তারপরে সাংবাদিকতা মনোবৃত্তি নিয়ে প্রদীপ দুটো বৃত্তিকেই অন্তঃকরণে মূল্যবান বলে মনে করে । বিদ্যালয় ছুটির পরে প্রদীপ খবরের সন্ধানে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়ায় । মাঝেমধ্যে সুনন্দ ও প্রদীপকে সংগদান করে । এভাবে ঘুরে ফিরে সুনন্দ সমাজের বিষয়ে অনেক কথাই শিখতে পেরেছে। কিন্তু পাখির নামগুলি মুখস্থ করতে গিয়েই সে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। যতই মনে রাখার চেষ্টা করে ততই ভুলে যায়।

বইটি প্রদীপকে দেখালে প্রদীপ বইটির প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ে। পাখির বিনন্দীয়া জগতের প্রতি প্রদীপেরও খুব একটা ধারণা ছিল না। পাখির রঙ্গিন আলোক চিত্রসমূহের পৃষ্ঠা উল্টে তার মাঝখান থেকে প্রদীপ তার পরিচিত পাখিগুলি বেছে বের করার চেষ্টা করে ।

– বইটা তো দেখছি হাতে নিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। কোনো একটি পাখি দেখলে পাখিটিকে এই আলোক চিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি এবং নামটা মনে রাখতে যত্ন করি ।

সুনন্দ প্রদীপকে বলল।

–আমাকেও এরকম করতে হবে। অন্তত কয়েকটি পাখিকে ভালোভাবে চিনে নিয়ে মনে রাখতে পারলেও যথেষ্ট ।

–এই পৃথিবীতে যে কত কথা জানার এবং মনে রাখার আছে । গাছের নাম স্থানীয় মাছের নাম, পাখির নাম জীব জন্তুর নাম ইত্যাদি অনেক ।

বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হবে বলে আরও দুদিন পরে সুনন্দ আর প্রদীপ বিদ্যালয়ে যাওয়া থেকে কিছুটা অবকাশ পাবে ।

সুনন্দ উদয়শংকরকে বলেছে– আর মাত্র দুদিন। তারপরে আপনাকে সঙ্গ দিতে পারব বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হতে দুদিন বাকি পরীক্ষার খাতা দেখার কাজ থাকবে যদিও বাড়িতে বসেই দেখব যখন দিনের বেলা ব্যস্ততা থাকবে না ফলাফল দিতে অন্তত কুড়ি দিনের মতো সময় পাওয়া যাবে। এবার আমি আপনার সঙ্গে পাখির পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতে পারব।

সুনন্দের কথা শুনে উদয় শঙ্কর খুশি হল প্রায়ই সে নিঃসঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসলেও সুনন্দের মতো একজন সঙ্গী হলে কাজ করা অনেক সহজ হবে। কথা বলারও একজন সঙ্গী পাওয়া যাবে। জায়গা এবং মানুষগুলির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য উদয়শঙ্করের প্রয়োজন।

রবিবার বিকেলে উদয়শঙ্কর সুনন্দের সঙ্গে কাকাবাবুর বাড়িতে গেল। উদয়শঙ্করকে দেখে কাকাবাবু কী করবে না করবে বুঝে উঠতে পারলেন না।

– এসো, এসো। কখন এলে?

– কাকাবাবু, রাত ন'টায় এসেছি।

– তাহলে এতক্ষণে আমাদের এখানে এলে যে?

কাকাবাবু বলতে চাইছে তুমি এখানে এসেই আমাদের বাড়িতে কেন এলে না?

– কাকাবাবু, দিনের বেলা সুনন্দের সঙ্গে একটু বাইরে বেরিয়ে গেলাম।

– দুপুরের ভাত কোথায় খেলে?

– আপনি তো জানেনই, আমার খাওয়া দাওয়া একটু অন্য ধরনের।

– ও তুমি তো দুপুরবেলা ভাত খাও না।

– শুধু দুপুর বেলা নয়, রাতেও সেভাবে খাওয়া হয়না।

– কীভাবে পার?

– কাকাবাবু, অভ্যাস সমস্ত কিছু মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। প্রথম দিকে না খেয়ে শুয়ে পড়লে ঘুম আসত না। এখন বরং খেলে ঘুম আসে না।

– ভালোই করেছো, খেলেই মরণ। না খেলে কোনো ভয় নেই। তবে তোমার ডায়াবেটিস বা হাই ব্লাড প্রেসার হওয়ার বয়স হয়নি। তুমিতো বোধহয় চল্লিশের গণ্ডিই পার হওনি।

– ঠিক তাই কাকাবাবু। আপনি ভাবার মতো আমি অবশ্য একেবারে না খেয়ে থাকি না। সাধারণ কিছু একটা খাই। বেঁচে থাকতে হবে তো কাকাবাবু।

দিনের বেলা সুনন্দও তাদের বাড়িতে খাবার জন্য জোর করেছিল। আমি পরে যাব বলে ওদের কথা দিয়েছিলাম। সুনন্দ তুমি কি ভেবেছিলে জানিনা, তবে কথাটা এটাই।

– হলেও আমাদের বাড়িতে একবার খেতে হবে।

সুনন্দ দুপুর বেলা জানানোর মত পুনরায় একবার অনুরোধ করল।

– কেন খাব না। তোমার বৌ এর হাতে একবার না খেলে কীভাবে হবে।

– আর আমাদের বাড়িতে?

ছোট ছেলের মতো অভিমান করে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

– কাকাবাবু, আপনার বৌমার হাতে একবেলা না খেলে আপনি কি খারাপ পাবেন না? সময় মতো দেখা যাবে। নয় কি?

কাকাবাবু বৈঠক খানা ঘরের পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিলেন। হয়তো কাকাবাবু যাকে চেয়েছিলেন তাকে দেখতে পেলেন না। পর্দাটা ছেড়ে দিয়ে তিনি উদয়শঙ্কর এবং সুনন্দের দিকে তাকালেন। তারপর বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।

– বসুন কাকাবাবু। আপনাকে এখনই ভেতরে যেতে হবে না। প্রথমে একটু কথাবার্তা বলি।

উদয়শঙ্কর কাকাবাবুর মনোভাব বুঝতে পেরে সেভাবে বলায় কাকাবাবু পুনরায় বসলেন। কাকাবাবু স্থির থাকতে পারছেন না। তিনি আবার পর্দাটা সরিয়ে ভেতরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন– ভেতরে কে আছ?

ভেতর থেকে কোনো উত্তর এল না।

এইবার কাকাবাবু একটু জোরে চিৎকার করে বৌমাকে ডাকলেন।

– বৌমা, কে এসেছে দেখে যাও।

এবার ভেতর থেকে বৌমার উত্তর এল।

– যাচ্ছি বাবা।

কাপাসের চাদর মেখলা পড়ে থাকা কাকাবাবুর বৌমা পর্দাটা সরিয়ে ঘরের ভেতরে। উচু লম্বা মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকা এক সুদর্শনা যুবতি । সাধারণ বৌদের মতো মাথায় ঘোমটা দিয়ে আসেনি মানে বৌমা বাড়িতে নিজের মতো থাকার স্বাধীনতা লাভ করেছে। কাকাবাবু মানুষটা একটু অন্য ধরনের।

– চিনতে পেরেছ?

বৌমা সুনন্দ এবং উদয়শঙ্করের মুখের দিকে ইতস্তত করে লজ্জিতভাবে তাকাল। এভাবে তাকাতে গিয়ে বৌমার উদয়শঙ্করের চোখে চোখ পড়ল। তখনই উদয়শঙ্কর চোখ সরিয়ে নিয়ে সুনন্দের দিকে তাকাল। বৌমাও নিমেষের মধ্যে চোখ সরিয়ে আনল।

–উনাকে চিনতে পেরেছি। ইনি আমাদের এখানেরই নন কি?

‐- জ্যোতিষের প্রায় সমবয়সী।

বিয়ের পরে একবার না দুইবার আমাদের বাড়িতে এসেছে।

কাকাবাবু মাথা নেড়ে বৌমার কথায় সায় দিল।

‐-ওকে?

‐- দেখা দেখা বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু মনে করতে পারছি না।

‐‐ এর নাম উদয়শঙ্কর। উপাধি নেই। কেন নেই জানিনা। আজ পর্যন্ত জিজ্ঞেসও করিনি। ব্যাংকে চাকরি করে। এখানে পাখি দেখতে এসেছে। আগে একবার এসেছিল, তখন থেকেই আমাদের বাড়ির মানুষ।

অত্যন্ত সংক্ষেপে কাকাবাবু বৌমার কাছে উদয়শঙ্করের সঙ্গে তাদের আন্তরিক সম্পর্ক বিষয়ে বলল।

‐- মনে পড়েছে। আপনি বিয়েতে গিয়ে…

কিছু একটা বলতে গিয়ে কাকাবাবুর পুত্রবধূ থেমে গেল।

তিনজনই বৌমার দিকে তাকালো। ইটস্তত করে সে পুনরায় বলল‐-

‐- আপনার দেওয়া উপহারের কাপড় ভালো লেগেছে।

‐-ও তাই নাকি। ধন্যবাদ ।ধন্যবাদ।

মুচকি হেসে উদয়শঙ্কর বৌমাকে পাটের কাপড় নয় এবার আন্তরিক ধন্যবাদের একটি পুঁটুলি উপহার হিসেবে এগিয়ে দিল।

ভেতর থেকে অনুচ্চ স্বরে কোনো একজন ভেতরে ডাকায় বৌমা ভেতরে চলে গেল।

‐- খুব সাধারণ মেয়ে আমাদের এই বৌমা। কাউকে পর ভাবতে জানেনা। দুদিনেই বুঝতে পেরে গেছি। বাড়িতে থাকা একজন মানুষকে বোঝার জন্য ছয় মাস লাগেনা।

কাকাবাবু বৌমার গুণ গাইতে শুরু করায় উদয়শঙ্করের মনে হল কাকাবাবু এখন সুখী মানুষ। জীবনের প্রান্তবেলায় সমস্ত পিতা-মাতা ছেলে বৌমার ভালবাসা চায়। আর সেই অনুসারে ভালোবাসা পেলে তারা সুখী না হওয়ার কোনো কারণ থাকে না।

‐- তাহলে বৌমা আপনাদের….

উদয়শঙ্করের কথাটা কাকাবাবু শেষ করতে দিলেন না।

‐- ওদের সুখেই আমাদের সুখ। ছেলেটি বিয়ের জন্য দু মাসের ছুটি নিয়েছিল, ফৌজির চাকরি, ছুটি শেষ,সেও চলে গেছে।

হঠাৎ আসা দুঃখবোধের এক টুকরো কালো মেঘ কাকাবাবুর মনের আকাশে এসে জমা হল। কাকাবাবুকে প্রকৃতিস্থ করে তোলার জন্য উদয়শঙ্কর ধেমালির সুরে বলল‐‐-

‐- কাকাবাবু, বৌমাকে নিয়ে আপনারা ব্যস্ত রয়েছেন নাকি বৌমা আপনাদের নিয়ে ব্যস্ত। দেখতে কিন্তু….

ছলছলে হতে চলা দুচোখে হাসি ছড়িয়ে কাকাবাবু কিছু একটা বলার আগেই বৌমা পর্দা ঠেলে ভেতরে চলে এল। তার হাতে চা মিষ্টির একটি ট্রে।ট্রে টা টিপয়ের ওপরে রেখে বৌমা বলল‐- খান।

‐- খাওয়ার আগে, কাকাবাবুকে আমি জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটির উত্তর দিতে হবে ।

– বাবাকে কি এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন যে উত্তর দেওয়ার আগে আপনারা চা খাবেন না?

নতুন বধূর গাম্ভীর্য নিয়ে অতি ধীরে সুস্থে বধূটি বলল। সুনন্দ হাতে নিয়ে থাকা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে তাদের কথাবার্তা শুনে চলেছে।

কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‐‐ কাকাবাবু বৌমাকে নিয়ে আপনারা ব্যস্ত নাকি বৌমা আপনাদের নিয়ে ব্যস্ত?

এরকম একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে বলে বধূটি হয়তো ভাবেনি। সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কথাটা বলে উদয় শঙ্করের ভালো লাগল না।

কাকাবাবু পরিস্থিতি বদলানোর জন্য বলল‐- বাড়িতে আমরা এই তিন চারজন মানুষই থাকি।জান উদয়শঙ্কর,আমরা সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি।

‐- চা খান।

নতুন বধূটি যেন এই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিল। শ্বশুরের কথা শুনে সে উদয়শঙ্কর এবং সুনন্দকে চা খাবার জন্য পুনরায় অনুরোধ করে ভেতরে চলে গেল । বধূটি পুনরায় ফিরে এসে একটি প্লেটে দুটি বিস্কুট এবং এক কাপ লাল চা এনে কাকা বাবুর হাতে তুলে দিল ।

অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলকভাবে তিনিও কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে লাগলেন। কথার আরম্ভ হয় কোথায় আর কথার স্রোত নিয়ে ফেলে কোথায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেউ কিছু বলছে না। জীবন বোধের ওপরে যে সত্য বলে ভেবেছে তাই বলে যাচ্ছে। নিজের অভিজ্ঞতার সুবাদে কাকাবাবু কথার প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করতে চাইছেন।

মাঝখানে উদয়শঙ্করকে জিজ্ঞেস করেছে– বিয়ে করবে না?

উদয়শঙ্করের বিষন্ন হতে দেখা মুখটা দেখে কথার সুর পরিবর্তন করে কাকাবাবু পুনরায় জিজ্ঞেস করছে– তোমার পাখির পর্যবেক্ষণ কতটা এগিয়েছে?

কাকাবাবু জানে উদয়শঙ্করকে গতবার হঠাৎ চলে যেতে হয়েছিল।তাঁর মনে এই কথাও আছে যে উদয়শঙ্কর আজই পুনর্বার পাখি নিরীক্ষণের জন্য এসে পৌঁছেছে। তাই কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তিত করতে গিয়ে কাকাবাবু কিছুটা অস্বস্তিকর পরিবেশের সম্মুখীন হল।

–আগেরবার তো হল না কাকাবাবু। দৌড়াদৌড়ি করে চলে যেতে হল। আজকেই তো এসে পৌঁছেছি। আজ একটু অন্যদিকে গেলাম, এখনও পর্যন্ত সেখানে যাওয়া হয়নি।

– আজ কোথায় গিয়েছিলে?

– নদীতে মাছমারা দেখতে।

–পখীনরা নদীতে ভালো মাছ পায়।

– আমি তাদের চিনি না, কেবল পুলক এবং রাতুলের সঙ্গে সুনন্দ পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

– কী দেখলে?

– কয়েকজন জাল দিয়ে নদীর বুকে মাছ খুঁজে বেড়াচ্ছে। পুলক এবং রাতুল সকালবেলায় পেতে রেখে যাওয়া বড়শিতে তিন কেজির মতো ওজনের একটা বোয়াল মাছ ধরা পড়েছে। মাছ ধরা এবং মাছ ধরা দেখতে পাওয়া– দুটোই আনন্দের।

– পাখি দেখার চেয়েও!

– আনন্দের পার্থক্য রেখা খুঁজে বের করা কঠিন। প্রত্যেকেই নিজের রুচির ওপরে ভিত্তি করে আনন্দ লাভ করে। আনন্দ সেই জন্য রুচি নির্ভর।

– আচ্ছা উদয়, তুমি যে এবার হাড়গিলা কীভাবে ঘর সংসার পাতে দেখার সুবিধা পাবে, এসব তোমার কী কাজে আসবে?

– কাকাবাবু, সঠিকভাবে বলা কঠিন। কেবল আমি কিছু কথা জানতে চাই, কাছ থেকে দেখতে চাই। আমি লাভ করা তথ্য গুলি লিপিবদ্ধ করে রাখতে চাই। আমার পাওয়া তথ্যের সঙ্গে ভবিষ্যতে কেউ হাড়গিলার ওপরে গবেষণা করলে তুলনামূলকভাবে দেখতে পারবে । হাড়গিলা সংরক্ষণের ওপরে আমি লাভ করা অভিজ্ঞতা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়তে পারে।

– তুমি ব্যাংকের মানুষ, পাখিদের পৃথিবীতে কীভাবে এলে?

উদয়শঙ্কর গল্প বলার মতো সেই নির্দিষ্ট রেলযাত্রার কাহিনি কাকুর সামনে বর্ণনা করল। সুনন্দ মনোযোগের সঙ্গে ভ্রমণ কাহিনির মতো রসাল ভাবে উদয়শঙ্কর দেওয়া বর্ণনা গুলি শুনে চলেছে। ঠিক তখনই কাকিমা এবং তার বৌমাও ঘরে প্রবেশ করলেন এবং দুজনের দুটি চেয়ারে বসলেন।

– কখন এলে?

– আজ সকালে কাকিমা।

– বেশ রসালোভাবে বলে চলেছ যে কিসের কাহিনি? তোমার কাকাবাবু শুনে বেশ মজা পেয়েছে!

উদয়শঙ্করের কথার মাঝখানে হস্তক্ষেপ করে কাকিমা জিজ্ঞেস করলেন।

– কাকিমা, কাকাবাবু জিজ্ঞেস করছেন, আমি টাকা পয়সা নাড়াচাড়া করা ব্যাংকের মানুষ, কেন এবং কীভাবে আমি পাখির প্রতি আকৃষ্ট হলাম।

– হ্যাঁ বল বল। আমরাও শুনব।

উদয়শঙ্কর বলে গেল। বলে গেল সৌম্যদার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা, প্রকৃতি শিবিরে অংশগ্রহণ করার কথা। প্রকৃতির সংরক্ষণের জন্য কিছু বিশেষ কিছু করার ইচ্ছার কথা।

উদয়শঙ্করের কথাগুলি শুনে সুনন্দ প্রকৃতির সংরক্ষণের প্রতি আকর্ষিত হল। উদয়শঙ্কর দেওয়া পাখি বিষয়ক বইটির রঙ্গিন পাখিগুলির কথা তার মনে পড়ল। কাকাবাবু কোনো কালে না শোনা কাহিনি শোনার উৎসুক্য নিয়ে একাগ্রভাবে শুনে চলেছেন। কাকিমা এবং বৌমা অপরিচিত একটি জগতের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। সময় কীভাবে পার হয়ে যাচ্ছে কথার মাঝখানে কেউ বুঝতেই পারছে না।

কাকাবাবু মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করছেন।

– অরুণ্যের মধ্যে রাতে শিবিরে থাকলে ভয় লাগেনা? বন্য জন্তু আক্রমণ করলে কী করবে?

– আজকাল রাতে শিবিরে থাকার জন্য ইলেকট্রিক্যাল ফেন্সিং ব্যবহার করার সুবিধা আছে। এই সরঞ্জাম ব্যাটারি চালিত। মানুষের গন্ধ পেয়ে অথবা শিবিরে রাখা খাবার জিনিসের গন্ধ পেয়ে বন্য শ্বাপদ শিবিরের কাছে আসতে পারে। ব্যাটারি চালিত ইলেকট্রনিক ফেনসিং ব্যবহার করে বন্যজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তারমধ্যে কম ভল্টেজের বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা থাকে। মানুষ বা জন্তুর গায় লাগলে চর চর করে উঠে। বন্যজন্তুরা তাতেই ভয় পেয়ে দূরে চলে যায়। বিদেশে এবং আমাদের দেশেও বড় ফার্ম গুলিতে গরু চরানোর সময় এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ঘাসের চারপাশে ইলেকট্রনিক ফেনসিং দিয়ে তার মধ্যে গরুগুলি রাখলে ওরা ফেনসিং পার হয়ে বাইরে যায় না।

– বাহ সুন্দর। উচ্ছ্বসিত হয়ে কাকাবাবু বললেন।

– তোমরা তো দিনের বেলাতেও অরুণ্যের ভেতরে ঘুরে বেড়াও, তখন কি কোনো বন্য জন্তু তোমাদের আক্রমণ করে না?

– কাকাবাবু বন্যজন্তু তখন আক্রমণ করে যখন তারা মনে করে যে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অপ্রয়োজনে ওরা মানুষ থেকে দূরে সরে থাকে। চালচলন বুঝতে পারলে ওরা আমাদের জন্য শত্রু নয় ,পরম বন্ধু।

আপ্লুত হয়ে উদয়শঙ্করের কথা শুনতে থাকে কাকাবাবুর পরিবার।

– বৌমা এক এক কাপ লাল চা হলে মন্দ হত না।

– হে বাবা, আমিও ভাবছিলাম।তবে…

–তবে, কথার মাঝখানে ব্যাঘাত… নয় কি?

– হ্যাঁ বাবা।

– তুমি খুব সুন্দর কথা বলতে জান উদয় শঙ্কর।

– এভাবে বলবেন না কাকাবাবু।

কাকাবাবুর ঘরে সুনন্দ এবং উদয়শঙ্কর কথায় ব্যস্ত থাকতে কোনদিক দিয়ে সময় পার হয়ে গেল বুঝতেই পারল না । ধীরে ধীরে শীতের আবেশ পৃথিবীকে স্পর্শ করতে লাগল। দিনগুলি ছোট হয়ে আসছে কথার প্রসঙ্গে উদয় শংকররা লক্ষ্য করেছে ছয় সাত মাসের ভেতরে নতুন বধূটিও পরিবারেরই একজন সহজ সরল এবং হাস্যরসিক হয়ে পড়েছে । এসবই সম্ভব হয়েছে কাকাবাবুর জন্য । সামরিক বাহিনীতে কাজ করা মানুষ হলেও মানুষটার ব্যবহার এবং কথাবার্তায় অসামরিক সামাজিক সৌজন্যতা এবং প্রীতি ধন্যবাদ যোগ্য । নিয়মানুবর্তিতায় কাকাবাবু সামরিক এবং সামাজিক সম্পর্ক রক্ষায় অসামরিক। কাকাবাবুর কাছ থেকে খুব কম সময়ের ভেতরে বধূটি কথাগুলি শিখে নিয়েছে বোধহয় ।

কাকাবাবুর বাড়ি থেকে দুজনেই বেরিয়ে আসতে রাত নটা বেজে গেল। সুনন্দ উদয়শঙ্করকে ওদের বাড়িতে রাতের আহার গ্রহণ করার জন্য খুব কাকুতি মিনতি করল যদিও উদয়শঙ্কর রাজি হল না।

– কিছুক্ষণ আগে তো বলেছি সুনন্দ, আমার খাওয়া দাওয়ার জন্য সেরকম কোনো বিশেষ কথা নেই।

সুনন্দকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে উদয়শঙ্কর পর্যটন নিবাসের দিকে এগিয়ে গেল ।

অন্যদিকে উদয়শঙ্করকে রাজি করাতে না পারে সুনন্দ নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলল।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...