রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

হে আমার স্বদেশ- ২০ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, He Amar Swadesh

 হে আমার স্বদেশ- ২০

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস







  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

(কুড়ি)


কলকাতায় পড়তে আসা লখিমপুরের গরিব ঘরের কুশল দুয়ারা অসমে কলেজ স্থাপনের কথা বলল। সত্যিই ব্রিটিশ সরকার অসমে কলেজ স্থাপন করার কথাটায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকা অবলম্বন করেছে। তার চেয়েও দুর্ভাগ্যের কথা এটাই যে এই বিষয়ে অসমের সর্বসাধারণ জনগণ সচেতন নয়। অন্যদিকে, সচেতন হলেও ব্রিটিশ সরকারের অধীন হওয়ার জন্য এই বিষয়ে অসমিয়া জনগণ নিজের মতো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। লক্ষ্মীনাথের মনটা পুনরায় একবার পরাধীনতার গ্লানিতে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল।

ব্রিটিশরা এখনও ভারতীয়দের ভাগ্যবিধাতা।কলকাতায় পড়তে এসে লক্ষ্মীনাথ রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ সমাজসেবী রাণাডে এবং ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম নেতা কেশব চন্দ্রের নীতি আদর্শে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। তারপরে রাষ্ট্রনেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চিন্তাধারাও তাকে আকৃষ্ট করেছিল। ১৮৮৫ সনে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয় এবং কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে লক্ষ্মীনাথ অসমের প্রতিনিধি রূপে যোগদান করেছিল। তারপরেই ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরীর(বর্তমানে তার শালাজ) বক্তৃতায় ‘এ সাবজেক্ট ন্যাশন হেজ নো পলিটিক্স’ মতবাদটি শুনে তার রাজনৈতিক আদর্শ পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ বন্ধ করেন।কিন্তু আজ লখিমপুরের গরিব ঘরের যুবকটির কথায় তিনি কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে ভাবলেন, উচ্চশিক্ষা বিস্তারের জন্য অসমের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সুবিচার করেনি। এই বিষয়ে অসমে একটা সচেতনতা সৃষ্টি হওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এবং ১৮৩৬ সন থেকে ১৮৭৩ সন পর্যন্ত অসমের স্কুল কাছারিতে ব্রিটিশ প্রবর্তন করা বাংলা ভাষা দূরীভূত করার জন্য রেভারেণ্ড মাইলস ব্রনসন , রেভারেণ্ড নাথান ব্রাউন আদি যেভাবে একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, উচ্চশিক্ষা বিস্তারের জন্য এখন সেরকম আন্দোলন সংঘটিত করে তোলা উচিত বলে অনুভব করল। তবে কেবল অনুভবই করল। তার জন্য ফলপ্রসূ ব্যবস্থা নেবার জন্য তার চিন্তা চেতনার অগ্রগতি হল না।

অবশ্য পিতার অন্তিম অবস্থা, গর্ভবতী পত্নীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক ব্যস্ততার জন্য এখন তার পক্ষে সেই কাজটা সহজ নয়।

শিয়ালদা স্টেশনে নেমে বাড়িতে না গিয়ে লক্ষ্মীনাথ জোড়াসাঁকোতে এল। শারীরিকভাবে প্রজ্ঞাকে সুস্থ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সেখানেই দুপুরের আহার করে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে প্রজ্ঞাকে নিয়ে গোপীকৃষ্ণ লেনের বাড়িতে এল। মাঝখানে চৌদ্দ দিন অসমে ছিল। বাড়িতে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র বিশেষ কিছুই নেই। রাত্রিটা কোনোমতে কাটিয়ে পরের দিন সকাল বেলা বাজারে গিয়ে সমস্ত কিছু কিনে আনল।

এদিকে ভোলানাথ বাড়িতে নেই। তিনি বালিগঞ্জে কোনো একজন বন্ধুর বাড়িতে আছে বলে বাড়ির চাকর লক্ষ্মণের কাছ থেকে জানতে পারল । লক্ষ্মণকে সে তার কলকাতায় আসার কথা জানানোর জন্য ভোলানাথের কাছে পাঠাল । ব্যবসার কী এত বিশেষ কাজ বের হল যে টেলিগ্রাম করে তাকে ডেকে আনতে হল?

নগাঁও জেলার কলিয়াবরের চতিয়াল মৌজার অফিসার ঘনশ্যাম বরুয়ার দ্বিতীয় পুত্র ভোলানাথের জন্ম হয় ১৮৫৩ সনের পুরোনো গুদামে। মৌজা হারানোর জন্য ঘনশ্যাম বরুয়ার আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। পুরোনো গুদাম থেকে নগাঁও সরকারি হাইস্কুলে প্রতিদিন ৮ মাইল পায়ে হেঁটে ভোলানাথ থার্ড ক্লাস পর্যন্ত ( বর্তমানের অষ্টম শ্রেণি) পড়েছিল।শৈশব থেকে সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল এবং তার জন্যই সে গুয়াহাটিতে থাকা তাদের সম্পর্কীয় মানিক চন্দ্র বরুয়ার বাড়িতে এল। গুয়াহাটিতে থেকে সে এন্ট্রান্স পর্যন্ত পড়ল। তারপরে ভোলানাথ মানিকচন্দ্র বরুয়া এবং অন্নদারাম ফুকনের কাঠের ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠান 'বরুয়া ফুকন ব্রাদার্স’ এর ম্যানেজার হল। পরবর্তী সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি এম সি বরুয়া কোম্পানি হল। নানা কারণে কিছুদিন পরেই কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোলানাথ সংস্থাপনহীন হয়ে পড়ল কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভোলানাথ হতাশ না হয়ে হাতে মাত্র পাঁচশো টাকা নিয়ে ১৮৯০ সনে গুয়াহাটি ছেড়ে ভাগ্যের অন্বেষণে কলকাতা যাত্রা করল।

কলকাতায় এসে লক্ষ্মীনাথ থাকা মেসে থেকে ভোলানাথ ছোটো বড়ো ব্যবসা করতে লাগল। গারো পাহাড় থেকে অল্প অল্প করে তুলু এনে ম্যাকলিউড কোম্পানিকে বিক্রি করতে লাগল। তারপর লক্ষ্মীনাথেরও ব্যবসা করার ইচ্ছে আছে জানতে পেরে সে বি. ব্রাদার্স কোম্পানি নাম দিয়ে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলল। কলকাতার বাংলা কাগজ সঞ্জীবনীতে বিজ্ঞাপন দিল যে সস্তায় এবং দ্রুত সেগুন কাঠের চৌকাঠ আদি জোগান ধরার জন্য বি. ব্রাদার্স কোম্পানি একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান।

তবে বিজ্ঞাপনে খুব একটা সফলতা এল না। তারপরে ভোলানাথ বেঙ্গল ,নাগপুর ,গুইলেক, এবং মনোহরপুরে রেলের স্লিপারের ব্যবসা করবে বলে ঠিক করল। সরকারের বন বিভাগ থেকে রয়েলটিতে গাছের বন্দোবস্ত করে কাঠ জোগান দিতে লাগল। কাজে সাহায্য করার জন্য ভোলানাথ তাদের বংশের গোপীনাথ বরুয়াকে নিয়ে এল। গোপীনাথ তখন লক্ষ্মীনাথ থাকা শোভারাম বসাক লেনে থাকতে শুরু করল। ব্যবসার কাজ ছাড়াও লক্ষ্মীনাথ গোপীনাথকে গ্রাহকদের 'জোনাকী' কাগজ পাঠানো এবং তার হিসেব রাখার কাজে লাগিয়েছিল। ভোলানাথ গোপীনাথকে গুইলেক এবং তারপরে মনোহরপুর নিয়ে যাবার পরে লক্ষ্মীনাথ বি. ব্রাদার্স কোম্পানিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করল।

লক্ষ্মীনাথ যোগদানের পরে বি ব্রাদার্স কোম্পানির শ্রীবৃদ্ধি হতে লাগল। ব্যবসা বাড়তে দেখে ভোলানাথ গুয়াহাটি থেকে তার ভাগ্নে সম্পর্কীয় আত্মীয় মহিনারায়ণকে নিয়ে এল। ভোলানাথের কর্মকুশলতা, তৎকালে সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতা এবং কাজকর্মে লক্ষ্মীনাথের নিষ্ঠার জন্য কিছুদিনের মধ্যে কাঠের ব্যবসাটা জমে উঠল। কাজের পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোলানাথ কাজের ক্ষেত্র ভাগ করে দিল। মনোহরপুর স্টেশনে থেকে কাজ করার জন্য মহীনারায়ণকে পাঠানো হল। ভোলানাথ কলকাতার বাইরের সমস্ত জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। লক্ষ্মীনাথের কাজের পরিসর হল কলকাতা। কলকাতায় থেকে সে অফিসের কাজকর্ম দেখা, ব্যবসায়িক সংস্থাগুলির সঙ্গে চিঠি-পত্রের আদান-প্রদান, হিসেবপত্র রাখা এবং ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে লাগল।

লক্ষ্মীনাথ ঠাকুর বাড়ির জামাই। তার জন্য কলকাতার অভিজাত শ্রেণির অধিকাংশ লোকের অবারিত দ্বার। সুকৌশলী ভোলানাথ তার সুযোগ নিতে লাগল। ব্যবসার সংক্রান্ত যোগাযোগ করায় সে লক্ষ্মীনাথকে সঙ্গে রাখে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে নিজেকে লক্ষ্মীনাথের দাদা বলে পরিচয় দেয়। তার ফলে কলকাতার মানুষের সঙ্গে ভোলানাথ সহজে মিত্রতা স্থাপন করতে সক্ষম হয়। এভাবে ভোলানাথকে ব্যবসায়িক সুযোগ সুবিধা নিতে দেখে প্রথমে লক্ষ্মীনাথের মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল।সেটা বুঝতে পেরে সুচতুর ভোলানাথ হাসতে হাসতে বলেছিল বিজনেস কন্টাক্টগুলি করার সময় তুমি আমার ভাই বলে পরিচয় দিই বলে তুমি কি খারাপ পাও ?'

কলকাতা এসে কলেজ স্ট্রিটের মেসে থাকার সময় থেকে ভোলানাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের পরিচয়।খুব বেশি লম্বা নয় যদিও মজবুত স্বাস্থ্যের পুরুষ।চুলগুলি ছোটো ছোটো, মুখে কুচকুচে কালো এক গুচ্ছ দাড়ি। কপাল চওড়া। চোখ দুটি কিছুটা লাল। শীতের দিনে গলা বন্ধ কোট এবং মাথায় কালো রঙের অথবা ছাই রঙের টুপি আর হাতে একটি ছাতি। চলা-ফেরা গহীন- গম্ভীর। কথাবার্তায় এতটাই চৌকশ যে মুহূর্তের মধ্যে অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে ।

ভোলানাথ জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটার উত্তরে কী বলবে লক্ষ্মীনাথ ভাবতে ভাবতেই সে নিজেই বলেছিল,' না ,খারাপ পাবে না। খারাপ পাওয়া ঠিক নয়। ব্যবসার জন্য এসব করতেই হয়। তুমি ঠাকুরবাড়ির জামাই। কলকাতার মানুষের মধ্যে তোমার একটা গুড উইল আই মীন,সুনাম আছে।এই সুনামটা ব্যবসায় সাহায্য করে।কারণ বিজনেস করার জন্য পার্সোনাল কন্টাকটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা।পার্সোনাল কন্টাক্ট থেকে যে রিলেশন ডেভেলপ হয়, তাতে বিজনেস ডিলিং গুলি অনায়াস সাধ্য হয়ে পড়ে।'

' ঠিকই আছে। আমি আপনার ভাই বলে পরিচয় দিলে যদি আমাদের বিজনেসটা বাড়ে, তাতে খারাপ পাওয়ার কি আছে? বিজনেসের উদ্দেশ্য হল লাভ– লাভ বেশি হলে আমিও তার শেয়ার পাব।'

'এটা তুমি একজন রিয়েল বিজনেসম্যানের মতো কথা বলেছ।' ভোলানাথ বরুয়ার চোখ দুটি তিরবির করে উঠল,' তুমি যেভাবে আমার সঙ্গে রয়েছ, এভাবে লেগে থাকলে আগামী তিন চার বছরের ভেতরে আমরা কলকাতার বুকে এক নম্বর উড মার্চেন্ট হতে পারব।'

ভোলানাথের গর্ব মিশ্রিত কথা শুনে মুচকি হেসে লক্ষ্মীনাথ বলেছিল,' অসম থেকে এসে এই কলকাতা মহানগরের কাঠের ব্যবসায় আমরা বাঙালিদের ওপরে উঠতে পারব কি?'

' কেন পারব না? আমাদের কী নেই?আসলে, তোমার মনে অসম্ভব বলে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার কারণ হল তোমার আত্মবিশ্বাসের অভাব।আরে, সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিক লর্ড ক্লাইভ এই বেঙ্গলে এসেছিল। এখানে, এই বাংলায় বসতি স্থাপন করে কৌশলে বাঙালিকে হাত করেছিল । তারপরে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে এই দেশের রাজদণ্ড নিজের হাতে নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা লর্ড উপাধিতে সম্মানিত হয়েছিল। ' বাংলা যাত্রা গান দেখায় অভ্যস্ত ভোলানাথ নাটকীয় সুরে বলেছিল,' আর আমরা, অসম থেকে আসা অসমিয়া বলেই কলকাতার কাঠের ব্যবসায় নিজেদের প্রভুত্ব স্থাপন করতে পারব না। আচ্ছা বেজ, বলতো এখন কলকাতার এক নম্বর কাঠের ব্যবসায়ী কে?'

'কলকাতার নিমতলা কাঠের গোলাগুলির প্রধান জায়গা। সেখানে গিরিশচন্দ্র বসুই কলকাতার সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী।'

'সবচেয়ে বড়ো মানে গিরীশ বোস হল কাঠের ব্যবসায় কলকাতার একচ্ছত্রী সম্রাট।' জোর দিয়ে উচ্চারণ করে ভোলানাথ বলেছিল,' নিমতলার প্রতিটি গোলার মালিক তাঁর অধীনে। কোন কাঠ কী দামে বিক্রি হবে, গিরীশ বসু তা ঠিক করে দেন। কিন্তু এই গিরীশ বোস এক সময় কলকাতার সুপরিচিত তারকনাথ প্রমাণিকের ছেলে কালী কৃষ্ণ প্রামাণিকের ফার্মে একজন সাধারণ কর্মচারী হয়ে বেতন পেত। সততা,প্রখর ব্যবসায়িক বুদ্ধি এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের জোরে তিনি আজকের এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছেন। এখন তাঁর লক্ষ লক্ষ টাকার বিজনেস। এতটাই প্রতিপত্তি যে সাহেবরাও তাঁকে সমীহ করে। এমনিতেও গিরীশ বোস বাঙালির উচ্চকূলের ব্যক্তি হিসেবে ভালো, উদার মনের মানুষ। যেকোনো মানুষ তাঁর কাছে গেলে সাহায্য করেন।আন্তরিকতার সঙ্গে কথাবার্তা বলে চা মিষ্টি খাইয়ে পাঠান। আমাদেরকেও তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে হবে।' বড়োদা বড়োদা' বলে খাতির করে কথার ফাঁকে তাঁর ব্যবসায়িক কৌশলগুলি শিখে নিতে হবে।'

লক্ষ্মীনাথের পূর্বপুরুষদের কেউ ব্যবসা করেননি। ব্যবসা-বাণিজ্য তাঁর রক্তে নেই। সে সব নিয়ে কোনো কালেই তাদের বাড়িতে কোনো আলোচনা হয়নি। লক্ষ্মীনাথের চেতনা বোধে বৈষ্ণব ধর্ম অসমিয়া ভাষা সাহিত্য এবং ভারতীয় সংস্কৃতি দর্শন। সেই সবেই তাঁর মন মগ্ন হয়ে থাকতে চায়। কিন্তু বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে সে সরকার প্রস্তাবিত চাকরি করেনি। কলকাতায় এসে উকিল হওয়ার স্বপ্নও ভেঙে গেছে । এদিকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে ।তার জন্য যে কোনো একটা জীবিকা চাই।আর ভোলানাথের সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দিয়েছে যখন, ছাড়ার উপায় নেই। তাই ভোলানাথের পরামর্শ অনুসরণ করে লক্ষ্মীনাথ গিরিশচন্দ্র বসুর গোলায় যেতে শুরু করল। চেহারায় সুদর্শন, কথাবার্তা বুদ্ধিদীপ্ত, আচার-আচরণে পরিশীলিত রুচি, গড় গড় করে বাংলায় কথা বলতে পারে– লক্ষ্মীনাথ দ্রুত গিরিশচন্দ্র বসুর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হল। আর কিছুদিনের ভেতরে লক্ষ্মীনাথ তাঁর কাছ থেকে কাঠের ব্যবসার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পারল।

এভাবে বয়োজ্যেষ্ঠ কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের সঙ্গেও লক্ষ্মীনাথের আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠল। কাঠের গোলা ছাড়া হাওড়ায় কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের জাহাজ মেরামতি করার একটা 'ডক' আছে। ডকটির নাম ক্যালিডোনিয়া ডক। ডকের ম্যানেজার ইউরোপীয় কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বাঙালি।তাঁর নাম অতুল কৃষ্ণ ঘোষ।তাঁর মতো উচ্চ মনের অমায়িক এবং পরোপকারী মানুষ বিরল।সাহিত্য,বিশেষ করে বাংলা যাত্রা থিয়েটার অনুরাগী অতুলকৃষ্ণ বাবুর সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। প্রায়ই ডকে গিয়ে লক্ষ্মীনাথ ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। তারপরে প্রবীণ কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের কলকাতার কাচারি পাড়ার ঘোষ স্ট্রিটের বাড়িতেও যেতে লাগল। কালীকৃষ্ণ ও লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে স্নেহসূচক ব্যবহার এবং যত্ন করলেন। এভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠায় লক্ষ্মীনাথ এবং ভোলানাথের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন আরম্ভ করলেন।

ব্যবসায় ব্যস্ততা বাড়ল।আয়ও বাড়ল। প্রথম অবস্থায় তাদের কিছুই ছিল না। ধীরে ধীরে গাড়ি হল, একজন কেরানিকে নিযুক্ত করা হল,ঘোড়া কিনল, ঘোড়ার জন্য সহিস রাখা হল, ঘরোয়া কাজকর্মের জন্য চাকর-বাকর রাখা হল।

এত কিছুর পরেও ভোলানাথ ক্ষান্ত হল না।তাঁর লক্ষ‍্য হল গিরিশচন্দ্র বসুর ওপরে উঠে কলকাতায় এক নম্বর কাঠের ব্যবসায়ী হওয়া। তার জন্য ব্যবসার পরিসর বাড়াতে হবে।বড়ো বড়ো ঠিকা পেতে হবে। তাঁর কাঠের ব্যবসা সম্পর্কীয় সমস্ত সংস্থা-ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। কোথায় ঠিকা পাওয়া যাবে সেই খবর নিয়ে থাকে। আর চেষ্টার যে অসাধ্য কিছুই নেই, সেটা ভোলানাথ আবার প্রমাণ করে দেখাল।

বেঙ্গল টিম্বার ট্রেডিং কোম্পানির ফরেস্ট ম্যানেজার হলেন মিঃহুইফিন।তাঁর হেডকোয়ার্টার বি এন আর এর পানপোছ স্টেশনে। হুইফিন আমীরী মেজাজের মানুষ। কিছু কিনতে টাকাটা দিলে ফেরত পাওয়া খুচরো পয়সার দিকে তাকিয়েও দেখেন না, এমনকি বারো আনা হলেও না। চাকর বাকর থেকে শুরু করে অফিসের কেরানি- মুহুরিরাও তাঁর স্বভাবের এই সুযোগটা গ্রহণ করে থাকে। নিজের কোয়ার্টারে তিনি বিলিয়ার্ড খেলার সরঞ্জাম পেতে রেখেছেন।তাঁর কোয়ার্টারে প্রায়ই সুরা পান, ভোজন এমনকি নৃত‍্য গীতও চলে। এখন মানুষকে বশ করার কাজে ভোলানাথ যথেষ্ট দক্ষ। সে হুইফিন সাহেবকে সন্তুষ্ট করার জন্য উঠে-পড়ে লাগল। তার জন্যও লক্ষ্মীনাথকে লাগাল।

ব্যবসার হিসেব রাখা ছাড়া মিঃহুইফিন ,তাঁর এসিস্ট্যান্টদের এমনকি তাঁর হেড ক্লার্ক শ্যামলাল ব্যানার্জিকেও মনোরঞ্জন করার জন্য লক্ষ্মীনাথ সতত ফল এবং শাক সব্জির 'ডালি' পাঠাতে লাগল।কী খরা কী বর্ষা,ট্রামে করে নিউমার্কেট অথবা বড়ো বাজারে গিয়ে লক্ষ্মীনাথ ফল এবং সব্জি কিনে কুলির মাধ্যমে টুকরিতে ভরিয়ে, থলে সেলাই করে, তার ওপরে নাম লিখে, কুলির মাথায় তুলে দিয়ে, কুলির সঙ্গে হেঁটে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে 'বুক' করে পাঠায়। এই ধরনের ঘুষ দেওয়ার কার্য মাসে দশ-বারো বার করতে হয়।

এই কাজের জন্য সকাল সকাল বের হতে হয়। সারাদিন কাজ করে বিকেল তিনটে সাড়ে তিনটের সময় ক্লান্ত দেহে বাড়িতে ফিরে। ভোলানাথের আদেশ অনুসরণ করে লক্ষ্মীনাথ বি এন আরের মুখ্য ফিরিঙ্গি এবং ইউরোপিয়ান কর্মচারীদের জন্যও এই ধরনের 'বাস্কেট' পাঠায়। বড়দিন অথবা খ্রিস্টমাসের সময়ে নিউমার্কেটের 'কেক' ফল আর কবির বাস্কেট' দেয়। এইসব আত্মসম্মান হানিকর কাজ। কিন্তু ব্যবসায়ে সাফল্য লাভের জন্য অদম্য উৎসাহ এবং আনন্দমনে লক্ষ্মীনাথ কাজগুলি করতে লাগল।

কিন্তু প্রজ্ঞা ব্যথিত হল। মানুষটার পিতা একসময় আহোম স্বর্গদেবের বৈদ্য ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যার পিতা ব্রিটিশের মুন্সেফ হয়েছিল, যার দাদা আমেরিকায় ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত– সেই ব্যক্তি ব্যবসায় নেমে ব্যবসায়িক লাভের জন্য এই ধরনের তোষামোদীর কাজ করতে শুরু করেছে ।

এমনিতেই ভোলানাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের কাঠের ব্যবসা করাটা প্রজ্ঞা খুব একটা পছন্দ করে না। তারপরে ব্যবসার নামে স্বামী করা এই সমস্ত কাজ প্রজ্ঞার আত্মসম্মানে আঘাত হানল।মুখে কিছু না বললেও প্রজ্ঞা মনে মনে অসন্তুষ্ট হওয়াটা লক্ষ্মীনাথ বুঝতে পারল। সে তখন প্রজ্ঞাকে বোঝাল এসব আজকাল নিয়ম হয়ে পড়েছে এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য শুরুতে এই সমস্ত করতে হয়।

যাই হোক না কেন, লক্ষ্মীনাথের মাধ্যমে এভাবে ঘনঘন বাস্কেট পাঠিয়ে ভোলানাথ বেঙ্গল চেম্বারের ফরেস্ট ম্যানেজার হুইফিনের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠল। অচিরেই বেঙ্গল টিম্বার ট্রেডিং কোম্পানির অধীনে ঠিকাদার হয়ে স্লিপার জোগান ধরার ঠিকা নিতে সক্ষম হল। জঙ্গল নেওয়া এবং স্লিপার কাটানো আদির খরচ বেঙ্গল টিম্বার প্রতি সপ্তাহে বি ব্রাদার্স কে দিতে লাগল। তাই অর্থকরী এই ঠিকা পাওয়াটা বি ব্রাদার্স কোম্পানির কাছে একটি বিরাট সাফল্য।

এই কাজটা চলতে চলতেই মা ঠানেশ্বরীর চিঠি পেয়ে লক্ষ্মীনাথকে অসমে যেতে হল।কিন্তু চারদিন পরেই ভোলানাথ টেলিগ্রাম করে তাকে অসম থেকে ডেকে আনাল -মিঃহুইফিনের সঙ্গে চলতে থাকা শ্লিপার জোগান দেওয়ার ব্যবসাটিতে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হল কি?

অসম থেকে লক্ষ্মীনাথের ফিরে আসার খবর পেয়েই ভোলানাথ এল।গোপীকৃ্ষ্ণ পালের এই ঘরের বাইরের দিকের একটি ঘরে অফিস পেতে নিয়েছে।ভোলানাথ এই ঘরে থাকে।‘বেজ’বলে আওয়াজ দিয়ে সে ভেতরের বৈঠকখানা ঘরে চলে এল।ভেতরের বসার ঘরটা লক্ষ্মীনাথের পড়াশোনার ঘর।পড়ার টেবিলে বসে সে ‘অসমীয়া ভাষা’শীর্ষক প্রবন্ধটিতে চোখ বুলোচ্ছিল।ভোলানাথের কণ্ঠস্বর শুনে এপাশের ঘরে আসতেই লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে ভোলানাথ জিজ্ঞেস করল-‘এখন মেসো কেমন আছে?’

লক্ষ্মীনাথের মুখটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল।মাথা নিচু করে বলল-‘বিশেষ ভালো নয়।’

কিছুক্ষণ নীরব থেকে ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথকে সমবেদনা জানাল।

‘টেলিগ্রাম করে আমাকে ডেকে আনলে-কোনো অসুবিধা,ফরেস্টে চলতে থাকা কাজে কোনো সমস্যা,কোনো গ্ণডগোল-?’

‘সমস্যা বা গণ্ডগোল নয়,বরং বড়ো একটা সুযোগ এগিয়ে এসেছে।’ভোলানাথ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল,’এসো,বস।শুনবেই তো-।‘

লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথের সামনের চেয়ারটায় বসল।

ভোলানাথ এসেছে জানতে পেরেই প্রজ্ঞা একটা ট্রেতে করে দুকাপ চায়ের সঙ্গে মিষ্টি এবং বিস্কুট এনে ছোটো টেবিলটায় রেখে ভোলানাথেকে খেতে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ভোলানাথ মিষ্টি খেল না।বিস্কুটের সঙ্গে চা খেতে খেতে বলল, ‘আমাদের সাব-কনট্রাক্ট্রর চন্দননগরের বটকৃ্ষ্ণ পাল একটা প্রফিটেবল অফার এনেছে।তুমিতো জানই ,আমাদের ফাইনান্সেই তিনি বহুদিন ধরে কাজ করছেন।তাঁর মতো সৎ বিশ্বাসী মানুষ কমই আছে।আমরা যে এতদিন তার মাধ্যমে কাজ করালাম,তারজন্য আমাদের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ভরসা জেগেছে।’

' বটু পালের সততা-নিষ্ঠা সত্যিই প্রশ্নাতীত। কিন্তু তিনি আমাদের জন্য কী ধরনের অফার আনলেন?'

'অফার আনলেন বলে বলাটা ঠিক নয়।আসলে তিনি আমাদের বিশাল এবং অত্যন্ত লাভজনক একটা বিজনেস পাওয়ার পথ দেখিয়ে দিলেন।’ ‘ও দাদা এভাবে বলে আপনি আমার কৌতূহল বাড়িয়ে চলেছেন। কথাটা কী বলুন তো?'

'শোনো তাহলে– ।' একটু ভূমিকা করে কথা বলাটা ভোলানাথের স্বভাব । আরাম চেয়ারটায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বা পায়ের উপর ডান পা তুলে দিয়ে সে বলতে লাগল,' উড়িষ্যায় কিছু ফিউডেটেরি স্টেট আছে। এই স্টেটগুলি রাজারা চালায়।এই রাজাদের খুব একটা পড়াশোনা নেই। ইংরেজদের আমল যদিও এরা খুব একটা সভ্য হয়ে ওঠেনি।দুই চার জন যা একটু লেখাপড়া শিখেছে তারা বাঙালিদের অনুসরণ করে চলে এবং কলকাতা নগর দর্শন করার জন্য গভীর আগ্রহ অনুভব করে। উড়িষ্যার গাংপুর সেরকমই একটি ফিউডেটরি স্টেট। বাবার অসুখ শুনে তুমি যে অসমে গেলে, তুমি রওনা হওয়ার পরের দিনই বটুবাবু আমাকে গাংপুরের কথা বলল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে আমি গাংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।সেখানে গিয়ে আমি তো অবাক। বিশাল বিশাল এলাকা জুড়ে শুধু শাল গাছের জঙ্গল।বহু বছরের পুরোনো জঙ্গল। জঙ্গলের এক একটি শাল গাছের বের সাত আট ফুট।গাছগুলি দেখে আমি পাগল হয়ে গেলাম। সেদিনই বটুবাবু আর আমি গাংপুরের রাজার সঙ্গে দেখা করলাম। কলকাতা থেকে গিয়েছি– আমাদের পেয়ে রাজার বড় আনন্দ। আমিও বেশ রস লাগিয়ে কলকাতার বড়ো বড়ো অট্টালিকা গাড়ি- মোটর, ট্রাম, দোকান-পাটের কথা বললাম। কলকাতার রসগোল্লা, সন্দেশ, চমচম, রাবড়ি, মিহিদানা ,মিষ্টি দই এর কথা বললাম।সঙ্গে ইডেন গার্ডেন, গঙ্গাস্নান, কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কথাও বললাম। বুঝেছ, এইসব শুনে রাজা কলকাতায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমি ভাবলাম,তাকে কলকাতায় নিয়ে এসে সবকিছু দেখিয়ে ভালোভাবে খাইয়ে দাইয়ে বশ করতে পারলে তার কাছ থেকে কম দামে তার স্টেটের ফরেস্টের শাল গাছগুলি নিতে পারা যাবে।'

'কিন্তু তার জন্য অসম থেকে টেলিগ্রাম করে আমাকে ডেকে আনা–?'

'এই যে,এজন্যই তোমার উপরে আমার রাগ উঠে যায়।তোমার হাত দিয়ে ভালো সাহিত্য সৃষ্টি হয়, তুমি বুদ্ধিদীপ্ত রম্য রচনা লিখতে পার; কিন্তু তোমার মগজে ব্যবসায়িক বুদ্ধি খেলে না!' উষ্মা প্রকাশ করে ভোলানাথ বলল,' আমি গাংপুরের রাজাকে নিমন্ত্রণ করে এলাম।রাজকুমারদের নিয়ে রাজা কলকাতায় আসবে। ৩-৪ দিন আমাদের এই ঘরে থাকবে।কলকাতা নগর দর্শন এবং তার সঙ্গে ভূরি-ভোজনের পর্ব চলবে। তাদের জন্য একটা গাড়িও ঠিক করে রেখেছি। আমি তাদের কলকাতা নগর দর্শন করাব। বৌমা এবং তুমি তাদের নানারকম সুস্বাদু আহারে আপ্যায়ন করবে।তার জন্যই তোমাকে টেলিগ্রাম করে ডাকিয়ে এনেছি।'

ব্যবসায়িক লাভের জন্য আসাটা উচিত হলেও বিছানায় শয্যাশায়ী বাবাকে রেখে অসম থেকে কলকাতা আসার কথাটা ভেবে লক্ষ্মীনাথের খারাপ লাগল। তবে উপায় নেই। লক্ষ্মীনাথ কোনোদিন ভোলানাথের কথার বিরোধিতা করেনি,এখনও করতে পারল না ।

বৌমা ভালো ভালো ব্যঞ্জন রাঁধতে পারে। দেশি-বিদেশি আমিষ নিরামিষ রান্নায় তিনি 'সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা'।তাঁর হাতের রান্না খাইয়ে গাংপুর রাজাকে বশ করে নিয়ে তাঁর স্টেটের ফরেস্ট গুলি নিতে পারব।তারপরে বটুবাবুকে সেই ফরেস্টের কাঠ কাটানোর সাব কন্টাক্ট দেব । বটুবাবুই শ্লিপার বানানো এবং সেইসব বেঙ্গল টিম্বারকে সাপ্লাই দেওয়ার দায়িত্ব নেবে।'

লক্ষ্মীনাথ শুনে খুব একটা উৎসাহিত হল না। কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থেকে লক্ষ্মীনাথ বলল,' হবে তারা আসুক।'

বিয়ের আগে থেকেই রন্ধনে প্রজ্ঞাসুন্দরীর বিশেষ অনুরাগ এবং এই রন্ধন প্রণালীকে তিনি একটা শিল্প হিসেবে গ্রহণ করেছেন।নতুন মশলার সংযোগ-বিয়োগ করে তিনি ইতিমধ্যেই অনেক রন্ধন প্রণালী উদ্ভাবন করেছেন।গোপীকৃষ্ণ পাল লেনের বাড়িতে আসার পর থেকে রান্নায় তার উৎকর্ষ বেড়েছে।তাকে সাহায্য করার জন্য লক্ষ্মীনাথ একজন বিধবা রেখেছেন।প্রজ্ঞার কোনো অসুবিধা হলে সেই মহিলা রান্নাবান্না করেন। তবে প্রজ্ঞার হাতের নিত্য নতুন দেশি এবং বিদেশি রান্না খেয়ে বিধবা মানুষটি রান্না করা খাবার খেতে জিভ বিরোধিতা করে। ভোলানাথ প্রজ্ঞার রান্নার উচ্চ প্রশংসক। তার জন্যই এই বাড়িতে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কন্ট্রাক্টর এবং তার কর্মচারীদের ভূরিভোজনের পর্ব চলতেই থাকে। কিন্তু তার জন্য প্রজ্ঞা নির্বাচন করে দেওয়া উপকরণটুকু লক্ষ্মীনাথকে বাজার থেকে কিনে এনে দিতে হয়।

মোটের উপর কলকাতায় বি ব্রাদার্স কোম্পানির জন্য স্ত্রী প্রজ্ঞা হল সুপকার। অন্যদিকে, লক্ষ্মীনাথই একাউন্টেন্ট, লক্ষ্মীনাথই কেরানি এবং লক্ষীনাথই বিনম্র গৃহস্থ। অতিথি-অভ্যাগতকে আপ্যায়নের সময় লক্ষ্মীনাথ 'জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ' সমস্ত কিছুই করে। কিন্তু এখন প্রজ্ঞা আট মাসের গর্ভবতী। এই অবস্থায় এত জনের জন্য রান্না করা তার পক্ষে জুলুম হয়ে পড়বে। তবে যতই শারীরিক অসুবিধা হোক না কেন প্রজ্ঞা পারবে না বলে না ।

গাংপুরের উড়িয়া রাজাকে আপ্যায়ন করার জন্য প্রজ্ঞা লিখে দেওয়া তালিকাটা পকেটে ভরিয়ে নিয়ে চাকর নিতাইকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ বাজার করে আনল। বিধবা রাঁধুনি এবং নিতাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রজ্ঞা তৈরি হল।

ভোলানাথ গাংপুরের রাজা এবং রাজকুমারদের শিয়ালদা স্টেশন থেকে বাড়িতে নিয়ে এল। কয়েকজন রাজকুমার। বড় রাজকুমারের নাম টিকায়েৎ। মেজ রাজকুমারের নাম হল মাজু জুনু, তারপরের রাজকুমার ভুল কুনুনু, তারপরের কয়েকজনের অন্য কিছু নাম। তাদের মাথায় গুণার কাজ করা মখমলের টুপি, পরনে গুণার কাজ করা মখমলের জামা । পরনে চিত্রবিচিত্র ঠেঙা। এই ধরনের পোশাকে গাংপুরের রাজা তার আদরের রাজকুমারের দ্বারা পরিবৃত হয়ে গোপী কৃষ্ণ লেনের ঘরটিতে প্রবেশ করার দৃশ্যটা সত্যি অপূর্ব। লক্ষ্মীনাথ অতি কষ্টে হাসি চেপে তাঁদেরকে স্বাগত জানাল।

এদিকে আশেপাশের বয়স্ক বাঙালি প্রতিবেশীরা এই নয়নাভিরাম দৃশ্য থেকে নিজেদের বঞ্চিত করল না। তা বলে প্রকাশ্যে দেখাটা শোভন নয়। তার জন্য তারা অতি উদগ্রীব হয়ে ঘরের দরজা জানলা মেলে দিয়ে এবং বন্ধ করে, বন্ধ করে এবং মেলে দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু চ্যাংড়াদের সেই সংকোচ নেই। ওরা ছোটোদের ডেকে চিৎকার করে করে বলল,' ওরে হাবুল, ওরে পচা– ঐ বাড়িতে যাত্রার দল এসেছে। আজ রাতে ওই বাড়িতে যাত্রাপালা হবে।'

রাজা এবং রাজকুমারদের সুস্বাদু ব্যঞ্জনে খাইয়ে দাইয়ে আদর করা হল। ভোলানাথ নিজেই তাদের কলকাতা পরিদর্শন করানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। কিন্তু বিচিত্র বেশধারী রাজা রাজকুমারদের সঙ্গে নিয়ে সারাটা দিন কলকাতা দর্শন করানোর ধৈর্য্য তার নেই। ব্যবসায় ব্যস্ততার কথা বলে সে লক্ষ্মীনাথকে সেই দায়িত্ব অর্পণ করল।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...