পাখিদের পাড়া পড়শী-৮
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi
দ্বিতীয় অধ্যায়,
(আট)
উদরশঙ্কর কাকাবাবুর বাড়িতে কথা প্রসঙ্গে অরণ্যের নির্জনে শিয়াল ছাগলী ভক্ষণ করার কথা উল্লেখ করেছে মাত্র, কাকাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে থাকা একজন আধবয়সী মহিলা হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল।
–ও আমার কাজলী, ও আমার অঞ্জলি, তোর কপালে এই দশা ছিল। কানা বিধাতা তোর এই অবস্থা করল। এত খুঁজলাম তোকে পেলাম না তো পেলামই না। কোথায় পাব?
উদয়শঙ্কর বুঝতে পারল যে সে না জায়গায় না বলা কথাটা বলে ফেলেছে। আধ বয়সী মহিলাকে কাঁদতে দেখে তার মনে দুঃখ হল। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য কী করবে ভেবে না পেয়ে একবার সে সুনন্দের দিকে, আরেকবার কাকাবাবুর বাড়িতে আসা বৌমার কাকাবাবুর দিকে তাকাল। বৌমার কাকাবাবু আশ্চর্য ধরনে মৌন হয়ে রয়েছেন।
–তোমার এত আদরের ছাগলী কোথায় থাকে কী করে তুমি কিছুই জান না। এখন কাঁদলে তোমার ছাগলী ফিরে আসবে না। একটু মানুষের মতো ব্যবহার কর ।
না, মহিলার কান্না থামবে থামছে না তো থামছেই না ।মহিলাটির কান্নার প্রকোপ দেখে কাকাবাবু পুনরায় মুখ ভেঙচে বলে উঠলেন– এই বন্ধ কর তোমার এই সব। আজ তিনদিন পরে তোমার এত শোক উথলে উঠা ঠিক নয়।
কাকিমা মহিলাটিকে ভেতরে ডেকে নিয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হল। কিছুক্ষণ পরে মহিলাটি ভেতর থেকে এসে পুনরায় তারা বসে থাকা ঘরে ফিরে এল। এবার তাকে কিছুটা শান্ত বলে মনে হল।
– তুমি দেখা ছাগলীটা কাজলী রঙের কি?
মহিলাটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুনরায় উদয়শঙ্করকে জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, একই কথা কেন বারবার জিজ্ঞেস করছ। কাকাবাবু মহিলাটিকে তিরস্কার করলেন।
– তুমি কী বুঝবে। ওটা ছাগলী ছিল না। আমাদের পরিবারের একজন ছিল। গরু ছাগলকে লালন পালন করলে বুঝবে ওরা মানুষকে কতটা ভালোবাসা দিতে পারে।
– হ্যাঁ বুঝতে পারছি ।তুমিই কেবল গরু ছাগল লালন-পালন করেছ।
কাকাবাবু মহিলাটিকে উপহাস করে বলায় মহিলাটি কাকাবাবুর দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল।
উদয়শঙ্কর মহিলাটিকে সান্ত্বনা দেবার উদ্দেশ্যে বলল– এখন তো আর উপায় নেই ।গেল বলেই ধরে নিন।সুনন্দ তাদের কথাবার্তা মনে মন দিয়ে শুনতে থাকার সময় তার মোবাইলটা বেজে উঠল।
– হ্যালো। কীচক বল।
– আমি এবং নবদা তোমার বাড়িতে। তুমি কোথায় আছ?
আমি কাকাবাবুর বাড়িতে। দুই মিনিট বসো। যাচ্ছি। নবদাকে বল বসতে ।
সুনন্দ ফোনটা অফ করে পকেটে ভরিয়ে নিল। –আমি একটু আসছি। কীচক এবং নবদা এসে আমার ঘরে বসে আছে। কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে সুনন্দ বলল।
–এখনই চলে যাবে। এইমাত্র তো এলে। তোমার সঙ্গে কথাই বলা হল না। বৌমার কাকাবাবু বললেন।
না কাকাবাবু। দুজন বন্ধু এসেছে। বাড়িতে অপেক্ষা করছে। তারা খারাপ পাবে ।সুনন্দের সঙ্গে উদয়শঙ্করও উঠল।
–ওদের দুজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি পথ চেয়েছিলাম। আজ যখন সুবিধা পেয়েছি ভালোই হল। চল আমিও যাব।
দুই কাকাবাবু কিছু বলার আগে সুনন্দা এবং উদয় শঙ্কর বেরিয়ে বারান্দায় পৌছে গেল।
– কোথায় যাচ্ছ ।কোথায় যাচ্ছ। দাঁড়াও ।দাঁড়াও। চা এনেছি ।
কাকিমা দুজনকেই ফিরিয়ে আনল।
– তোমরা কি ধরনের মানুষ! এতই ব্যস্ত ?
কাকিমার কথায় সায় দিয়ে কাকাবাবু বললেন– যুবক ছেলে, বুড়ো দুজনের সঙ্গে বসে কি নিয়ে আড্ডা মারবে ।
উদয়শঙ্কর প্রত্যুত্তরে বলল– কাকাবাবুকে নিয়ে আর পারা যায় না।এতটুকুতেই অভিমান হয়েছে।
–অভিমানের কথা নয় বাবা ।তোমরা বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কী কর আমাদেরও জানতে ইচ্ছে করে। সেই সমস্ত কথাই জিজ্ঞেস করতাম।
অন্য সময় হলে উদয়শঙ্কর কাকাবাবুকে ওরা কী করছে ,কোথায় যাচ্ছে ,আদ্যোপান্ত বিস্তারিতভাবে বলত, কিন্তু আজ সময় নেই ।কাকাবাবুদের চেয়ে কীচক এবং নবজিতের সঙ্গে কথা বলাটা বেশি জরুরী। উদয়শঙ্করের মনে আগ্রহের সঞ্চয় করে রাখা বিভিন্ন কার্যরূপায়নের জন্য তারা দুজন হতে পারে সার্থক সারথি।
– কাকাবাবু সেরকম কোনো কথা নয় ।ওদের সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার প্রয়োজন ছিল। কাকাবাবুর অবাঞ্ছিত আবদারকে প্রত্যাখ্যান করে দুজনে বেরিয়ে গেল।
সুনন্দের বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে নবজিত এবং কীচক বসেছিল। বিদ্যুৎ না থাকায় বিদ্যুৎ বাতির অভাব দূর করছিল একটি হারিকেন ল্যাম্প। ল্যাম্পটির অনুজ্জ্বল আলোতে দুজনে কথা বলছিল। ঠান্ডার প্রকোপ যাতে ঘরটিকে কাবু করতে না পারে তার জন্য সুনন্দের মা দরজাটা ভেতর থেকে টেনে দিয়েছিল।
সুনন্দ দরজাটা টান মেরে খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল ।পিছে পিছে উদয়শঙ্কর।
কীচক এবং নবজিতের আড্ডার গতিতে বাধা পড়ল। ওরা দুজন সোজা হয়ে বসে নিল। উদয়শঙ্কর সামনের একটা চেয়ারে এবং সুনন্দ পাশের একটি চেয়ারে বসে পড়ল।
– এ হল নবজিৎ বৈশ্য। আরিকুছির জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। আমাদের এই বৃহত্তর অঞ্চলে সামাজিক জীবনের সঙ্গে নবদা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
পরিচয় সূচকভাবে উদরশঙ্কর এবং নবজিতের মধ্যে নমস্কার এবং প্রতি নমস্কারের আদান-প্রদান হল।
–ও হল কীচক বৈশ্য। টেট শিক্ষক ।ছয়গাঁও থেকে আরও ভেতরের দিকে একটি অঞ্চলে শিক্ষকতা করে। কীচক দেখতে নবজিতের চেয়ে অনেকখানি বেঁটে এবং কিছুটা অনুজ্জ্বল বর্ণের।
মসৃণ ভাবে কামানো দাড়ি মুখটাকে সাদা দুপাটি দাঁত ফুটিয়ে তুলেছে। দুজনই শিক্ষক বলে জানতে পেরে উদয়শঙ্কর বলল আমি দেখছি শিক্ষকদের মধ্যে বসতে পারা একজন অতি গৌরবান্বিত ব্যক্তি।
নবজিতের মতো কীচক জানানো নমস্কারের উদয়শঙ্কর প্রতি নমস্কার জানাল।
নবজিৎ বৈশ্য উঁচু লম্বা ধরনের ছেলে। উচ্চতায় ছয় ফুটের মতো হবে। ক্ষীণ লাবণ্যময় দেহাবয়ব। মার্জিত কেশ। নাকের নিচে হালকা গোঁফ। কথা বললে মুখে সূঁচলো বায়বিক অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে ।বয়স পঁয়ত্রিশ।অতিরিক্ত মেদ নবজিৎ বৈশ্যকে কিছু পরিমাণে ভুঁড়িওয়ালা করে তুলেছে। মেপে কথা বলে। অপ্রয়োজনে একটিও কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করে না বলে কম কথা বলে তার সুনাম অথবা বদনাম আছে। ব্যক্তিগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার জন্য বিদ্যালয়ে সব সময়ে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরিধান করলেও অন্য সময় লংপেন্ট শার্ট পরে। লং পেন্ট শার্টের ওপরে একটি সোয়েটার পরে আসা নবজিৎ মাথা ঢাকার জন্য একটি টুপি ব্যবহার করেছে।
নবর বিপরীতে কীচক ছোটোখাটো। সামান্য কৃষ্ণ বর্ণের। কথা বললে চকচকে দাঁত দুপাটি আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে পড়ে ।সাহিত্যের ওপরে দখল আছে ছেলেটির। সমসাময়িক গ্রন্থসম্ভার ছাড়াও পুরোনো অসমিয়া সাহিত্যের সঙ্গে কীচকের পরিচিতি সমবয়সীদের মধ্যে বহুলভাবে পরিচিত। বই পড়লে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ে বলে সাহিত্যের আলোচনায় নির্দ্বিধায় অংশ নিতে পারে বলে কীচক সবার কাছে অতি পরিচিত।
– এক কাপ লাল চা?
সুনন্দ কারও উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে সোজা রান্নাঘরে প্রবেশ করল। সাতটা বেজে গেছে।
কথা প্রসঙ্গে কীচক উদয়শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করল- উদয়দা, সুনন্দ আপনার কাছ থেকে পাওয়া পাখি বিষয়ক বইটি আমাকে দেখিয়েছে ।বইটি থেকে সে পাখির অনেক কথা শিখতে পেরেছে। সে আজকাল কথা প্রসঙ্গে পাখির কথা বলতে থাকে। আমাদের এখানে প্রকৃতি বিষয়ক সজাগতা বৃদ্ধির জন্য একটি প্রকৃতি শিবিরের ব্যবস্থা করা যেতে পারা যায় না কি?
– পারা যায়। অত্যন্ত সহজ কথা। শুধু পাখি নয় –প্রজাপতি ,বিভিন্ন পোকামাকড় ,স্থানীয় উদ্ভিদ ,স্থানীয় মাছ- কাছিম, অনামী গাছপালা– এই সমস্ত কিছুর উপরে আমরা অধ্যয়ন করতে পারি। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে ।প্রশিক্ষার্থী নিজস্ব আগ্রহের উপরে নির্ভর করে তার বিষয় নির্বাচিত করতে পারে ।
–শুভ কাজ শীঘ্র করাই ভালো নয় কি! আপনি থাকতে থাকতেই অর্থাৎ দু-একদিনে– আপনিই প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করুন।
– না না, আমি প্রশিক্ষক নই। আমি পাখির বিষয়ে এতটা দক্ষ অথবা বিশেষজ্ঞ নই ।
কীচক উদয়শঙ্করকে ভাববোধে প্রশ্ন করল –তাহলে বাইরে থেকে কাউকে আনাতে হবে নাকি!
– শুদ্ধ উত্তর হল সৌম্যদা। আমি তাকে দায়িত্ব দেব। তিনি হবেন আমাদের প্রশিক্ষক ।
সুনন্দ, কীচক এবং নবজিৎ সৌম্যদার নাম শুনে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
সন্দেহের সুরে কীচক জিজ্ঞেস করল- সৌম্যদা সত্যিই আসবে কি ?
–আসবে। আসবে ।কেন আসবে না ।মানুষটা সারাটা জীবন জীবজন্তু পাখ-পাখালি নিয়ে কাটাল। তোমাদের পেলে তিনি আনন্দিত হবেন। তোমরা কীভাবে নেবে জানিনা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িত অনেক কাজ তোমরা এখানে করতে পার।
– যেমন?
- আজকেই বলতে চাইছি না। তোমাদের আগ্রহ আর ইচ্ছার উপরে নির্ভর করবে ।
–তবুও ?
নবজিৎ বৈশ্য জানার আগ্রহ প্রকাশ করল।
– পাগলাদিয়া নদীর বাঁধের ভেতরে থাকা জনশূন্য মাটিগুলিতে অরণ্য গড়ে তোলা যেতে পারে। এই মাটিগুলি কারও ম্যাদি মাটি। মাটির মালিককে পরিবেশ সচেতন করে তুলতে পারলেই সেই কাজ সম্ভব হবে। ধরে নিতে পার এই কাজ এক আন্দোলনের মতো। তোমরা এই ধরনের একটি কাজ কর যার জন্য তোমরা অসমের যুবক-যুবতীর কাছে আদর্শ স্বরূপ হয়ে পড়বে।
উদয়শঙ্কর আরও কিছু বলত হয়তো, দরজায় মৃদু টোকর দিয়ে প্রবেশ করা আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে সে থেমে গেল।
– এসো এসো জেপি। ঠিক সময় মতো এসে পড়েছ। দাদা ও জয়প্রকাশ ।আমরা জেপি বলেই ডাকি ।সুনন্দ উদয়শঙ্করকে উদ্দেশ্য করে বলল। উদয়শঙ্কর হাতের ইঙ্গিতে জয়প্রকাশকে সামনের চেয়ারটায় বসতে আহ্বান জানাল। নমস্কার জানিয়ে জেপি চেয়ারটাতে বসল।
শীর্ণদেহের ত্রিশ বছরের তরুণ জ্যোতিপ্রসাদের মুখে অনবরত একটা হাসি লেগেই থাকে। মাথার চুল পেছনদিকে আঁচড়ানো ছেলেটির গালের হনু কিছুটা এগিয়ে আসা ।হাত-পা-বুক ত্রিশ বছরের তরুণ একজনের যেমন হওয়া উচিত তেমন নয়। শীর্ণ শরীর হলেও জয়প্রকাশ দুর্বল নয়, তরতাজা। এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে না পারার মতো চঞ্চল ।চোখে রয়েছে বুদ্ধিদীপ্ততা।পরনে সাধারণ পোশাক।ঘিয়া রঙের একটি সোয়েটার ,গলায় একটি মাফলার। পাতলা জিন্সের একটি লং পেন্ট এবং পায়ে বাটার গতানুগতিক ডিজাইনের একজোড়া জুতো।
– তুমিও শিক্ষকতা কর নয় কি?
-হ্যাঁ দাদা, কলগাছিয়ার দিকে।
– জেপি আমরা পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলছিলাম। খারাপ পেয়ো না, আমিও তোমাকে জেপি বলেই ডাকব কিন্তু। জয়প্রকাশ মৌনতায় সম্মতি জানাল।
উদয়শঙ্কর পুনরায় বলতে আরম্ভ করল তোমাদের জানা উচিত যে পাগলা দিয়া প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ।বিভিন্ন প্রজাতির পাখ-পাখালি, গাছপালা, স্থানীয় মাছ ইত্যাদিতে। তাই তোমরা তোমাদের চোখের সামনে অনাদৃত হয়ে পড়ে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদগুলিকে সমাদর করতে শিখতে পার।
জয়প্রকাশ বলল–দাদা, আপনি আমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করুন ।আমরা আপনার সঙ্গে আছি ।থাকব ।
সুনন্দক বলল –জেপি আমরা তিনজনই উদয়দাকে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করার জন্য আহ্বান জানিয়েছি।
– কবে ?
-সেই সিদ্ধান্ত আজকেই নিতে হবে।
তাদের আলোচনা শুনে উদয়শঙ্কর সৌম্যদাকে ফোন করল।
–কেমন আছ উদয়শঙ্কর?
বিপরীত দিক থেকে সৌম্যদা উদয়শঙ্করকে জিজ্ঞেস করল।
– আছি সৌম্যদা।
–এবার তোমার পাখিদের পাড়া-পড়োশীর বক গুলির খবর বল। ওরা আছে কি? বাসা বাঁধতে শুরু করেছে? তারিখ অনুসারে সব কিছু নোট করে রাখতে ভুলবে না। বল ,কোনো বিশেষ কারণে ফোন করেছিলে কি?
– হ্যাঁ সৌম্যদা। এখানকার স্থানীয় ছেলেরা পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পাখি পর্যবেক্ষণ বিষয়ক একটি শিবির অনুষ্ঠিত করতে চায়। তার জন্য আপনার উপস্থিতি প্রয়োজনীয়।
– ভালো কথা। এই মাসে আমার বিশেষ কোনো জরুরী ব্যস্ততা নেই। তাই তুমি এগোতে পার।
–সৌম্যদা আমরা আলোচনা করে আপনাকে তারিখটা আজকেই জানিয়ে দেব।
–ঠিক আছে ।
সৌম্যদা ফোন রেখে দিল।
শনি এবং রবিবার নিয়ে একটি দুদিনের প্রশিক্ষণ শিবিরের তারিখ চারজন আলোচনা করে ঠিক করে ফেলল।
কীচক জিজ্ঞেস করল– প্রশিক্ষণ শিবিরে কতজন প্রশিক্ষার্থী থাকবে?
– তোমরা কতজন যোগাড় করতে পারবে ?
–সেরকম কোনো কথা নেই ।আপনারা যতজন জোগাড় করা প্রয়োজন বলে বলবেন–
–পঞ্চাশ জন ।হবে? পারবে ?
নবজিৎ বৈশ্য বলল- অনায়াসে পারব ।আপনি বললেই হল। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আমরা ছেলে মেয়ে সংগ্রহ করতে পারব ।
–সেভাবে হবে না। এবার প্রশিক্ষার্থী নির্বাচনে আমাদের কিছু 'ক্রাইটেরিয়া' থাকবে।
কীচক সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল –কী ধরনের ?
–প্রথম কথা প্রশিক্ষার্থীরা এখানকার স্থানীয় হতে হবে। দ্বিতীয়ত তারা প্রশিক্ষণের জন্য ন্যূনতম পরিমাণের হলেও মাশুল দিতে হবে। তার কারণ আছে ।স্থানীয় প্রশিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে আমরা এখানে কাজ করতে পারার মতো তাদেরকে সক্ষম করে তুলতে হবে। অন্যদিকে ভর্তি-মাসুল দিলে তাদের দায়িত্ববোধ থাকবে।
– হলেও পঞ্চাশ জন ছেলেমেয়ে হয়ে যাবে। নদীর দুই পারের গ্রাম কয়টিতে দুদিন গিয়ে প্রচার করলে তারা উৎসাহিত হয়ে শিবিরে অংশগ্রহণ করবে। আমার প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা আছে ।কেবল প্রথম শিবিরের জন্য মা পঞ্চাশ টাকা করে দিলেই হল।
নবজিতের কথা শুনে উদয় শঙ্কর উৎসাহ এবং সন্তুষ্ট বোধ করল।
-আমাদের তারিখ ঠিক হল।মাশুল পঞ্চাশ টাকা ঠিক হল। প্রশিক্ষক ঠিক হয়েছে। শিবির উন্মোচন করার জন্য একজন ব্যক্তিকে নিমন্ত্রণ করতে হবে ।কাকাবাবু হলে কেমন হয়!
উদয়শঙ্কর যে উদ্দেশ্যে কথাটা বলতে যাচ্ছিল সুনন্দই সেটার সহজে সমাধান করে দিল। উদয়শঙ্কর বলল –আমাদের উন্মোচক ও ঠিক হয়ে গেল। এখন হাতে কাজে লেগে যাওয়ার কথা।
একবার উদ্বোধকের বাড়িতে গিয়ে তাকে কথাটা জানিয়ে রেখে আসব নাকি ?
–রাত হয়ে গেছে।
–কী আর রাত হয়েছে। আটটা বাজে। কাকাবাবুর বাড়িতে যখন তখন যাওয়া যায় । তাছাড়া আমাদের কাজ যখন এতটাই এগিয়ে গেছে, আজকেই গিয়ে বলে আসি।
সনন্দ কাকাবাবুকে জানানোর জন্য তাগিদ অনুভব করল। উদয়শঙ্কর খুশি হল। জনগণের কাজে দুই চারজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিকে সংযোজিত করা মানে সমাজটিকে গুরুত্ব দেওয়া ।নবজিতে আর কীচক ও কাকাবাবুর বাড়িতে গিয়ে কথাটা জানিয়ে সামাজিকভাবে প্রক্রিয়াটা আরম্ভ করতে চাইল। কাকাবাবুর বাড়িতে দরজায় টোকা দিতে কাকাবাবু দৌড়ে এলেন ।
কী ধরনের মানুষ তোমরা ?এত রাতে !
–কাকাবাবু আপনার বাড়িতে আমাদের জন্য দিনরাত বলে কোনো কথা আছে নাকি?
-উদয়শঙ্কর, তুমি এভাবে বললে আমার একটু অসুবিধা হয়। তুমি জান তোমাদের কাজকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি ।
কাকাবাবু বাক্য শেষ না করতেই উদয়শঙ্কর কাকাবাবুর পায়ে হাত দিয়ে দু হাত মেলে দিয়ে এগিয়ে গেল।
– এই কী করছ? কী করছ? কী মানুষ হে তুমি ?
–কাকাবাবু ,অসমিয়া মানুষ ।সেই জন্যই –
–তবে এই অসময়ে চারজন কী কারণে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলে?
– কাকাবাবু, আমরা আসার জন্য আপনি কি সত্যিই খারাপ পেয়েছেন ?অসময় বলে বলছেন যে!
উদয়শঙ্কর এভাবে বল না। কেন এলে বল।
– কিছুই না, এমনি এলাম।রাতের খাবারের জন্য–
– কাকাবাবু উপহাস করার মতো বললেন– সেই দুর্ভাগ্য আমার কখনও হবে না ।
কাকাবাবুকে ওদের সঙ্গে কথা বলতে শুনে বৌমার কাকাবাবু সামনে এগিয়ে এলেন।
– আমি জানতাম তোমরা দুজন আসবেই।
উদয়শঙ্কর এবং কীচক একসঙ্গে বলে উঠল– হ্যাঁ কাকাবাবু ।
কথাগুলি অযথা দীর্ঘ হয়ে চলেছে দেখে উদয় শঙ্কর সংক্ষিপ্ত করার জন্য সোজাসুজি ওরা যে প্রকৃতি শিবির অনুষ্ঠিত করতে চলেছে সে কথা জানাল এবং কাকাবাবুকে সেই শিবিরের উন্মোচক হওয়ার জন্য অনুরোধ করল।
কাকাবাবু আপ্লুত হয়ে পড়লেন। নিজের গৃহের অনুষ্ঠানে ,কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে কাকাবাবু আজ পর্যন্ত কোনো প্রকারের বিশেষ গুরুত্ব পাননি ।প্রত্যেকেই আর্মি বলে দূরে সরিয়ে রাখে। সুনন্দ এবং উদয়শঙ্করের প্রস্তাবে শীতের রাতটা কাকাবাবুর কাছে বসন্তের সাম্য- শান্ত সন্ধ্যার মতোই মনে হতে লাগল।
– কী বলছ হে। এই সমস্ত কাজ করার আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
– কাকাবাবু, করলেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়।
এইবার দেখুন তো আপনার কেমন অভিজ্ঞতা হয়। উদয়শঙ্কর কাকাবাবুকে বিশেষ কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না ।
–তোমার সঙ্গে আর পারিনা ।যুবক ছেলে- মেয়েদের সঙ্গ পাব বলে ভালোই লাগবে। সামাজিক কাজ করার আমারও ইচ্ছে রয়েছে, নয় কি? তোমরা চাইছ যখন নিশ্চয় যাব। কাকাবাবুর কাছ থেকে সম্মতি পাওয়ার পরেরদিন থেকে সুনন্দরা অভিযান আরম্ভ করে দিল। সুনন্দ, কীচক এবং নবজিৎ নিকটবর্তী প্রায় প্রতিটি যুবক-যুবতির সঙ্গে দেখা করল। গরিষ্ঠ সংখ্যক যুবক -যুবতি ওদের প্রচেষ্টাকে খুব ভালোভাবে স্বাগত জানিয়ে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করল। ওদেরকে মাশুল দিয়ে নাম ভর্তি করার কথা বলা হয়েছিল। কেউ কেউ শিবিরেই দেবে বলে জানানোয় কতজন উপস্থিত থাকবে সেই সম্পর্কে সন্দেহ থেকে গেল। যদি সময় মতো না আসে। সেরকম হতে লাগে না কারণ নবজিৎ বৈশ্য এবং কীচকের কাছে তারা পরিচিত। প্রকৃতি শিবির অনুষ্ঠিত হবে বলে এবং তাতে যোগদান করার জন্য ছেলেমেয়েরা প্রস্তুত হচ্ছে বলে কীচকরা ইতিমধ্যে জানতে পেয়েছে। কাগজে পত্রে অসমের বিভিন্ন স্থানে প্রকৃতি শিবির অনুষ্ঠিত হওয়ার কাহিনি পড়ে জানতে পেরে ছেলেমেয়েরা ভেতরে ভেতরে শিবিরের প্রতি উৎসাহিত হয়ে উঠল।
– উদয় দা, শিবির অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে আমরা একদিন আপনার সঙ্গে সকাল থেকে দিনটা জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে পারি না?
–কেন পারবে না। ভালোই লাগবে।আমি তোমাদের আমার পাখিদের পাড়াপড়োশির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চেষ্টা করব। অরণ্যে প্রবেশ করলে অরণ্যের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। বিশেষ কাজ নেই যদি কাল ভোরবেলাতে চলে এসো। উদয়শঙ্কর কীচকদের উৎসাহিত করল। পরের দিন ভোরবেলা কীচক , নবজ্যোতি, জেপি এসে উদয়শঙ্করের বাড়ির সামনে হাজির হওয়ায় উদয়শঙ্কর বিশ্বাসই করতে পারেনি। একেই বোধহয় বলে নেশা। আলাদা সচেতনতা এবং নেশা একত্রিত হলে ফলদায়ক হয়।
– তোমরা যে এত সকালবেলা আসবে আমি ভাবতেই পারিনি। খুব ভালো কথা। চল এখন। শীতের কুয়াশা ভেদ করে চারজন এগিয়ে চলল। শিশির এবং কুয়াশার সম্মিলিত শক্তির কাছে ওদের হার মানতে হল না বলে স্বস্তি বোধ করল ।
–ভালো ঠান্ডা পড়েছে।শীতের প্রকোপে কাবু হয়ে পড়া জেপি বলল।
–শীতের এক অনন্য অনুভব আছে।মাদকতা সেই অনুভব এবং মাদকতা লাভ করার জন্য নিজেকে কেবল সচেতন এবং প্রস্তুত করা শিখতে হয়। আজ শিখতে চেষ্টা করতো! নিজেকে কঠিন করে তোলো। প্রকৃতি কর্মীরা সামরিক বাহিনীর লোকের মতো সব সময় প্রস্তুত এবং সব সময় সহনশীল, কর্মতৎপর। তাদের দরকার তৃতীয় চোখ। বন্য প্রাণীর কাছে আমরা সবসময়ই অবিশ্বাসযোগ্য। নিজেকে এবং সন্তানকে নিরাপত্তা দেওয়ার স্বার্থে বন্যপ্রাণী আক্রমণশীল।শীত, গ্রীষ্ম, জলাশয়, পাহাড় প্রকৃতি আন্দোলনের এক একটি উপাদান।আমাদের নিত্য সহচর। কীচক কিছু বলতে যাচ্ছিল,উদয়শঙ্করের কথা শুনে তার আর প্রয়োজন হলো না। উদয়শঙ্কর সব সময় আসা-যাওয়া করা পথটা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তার হাতে গাছের ডালের একটি লাঠি। লাঠিটা ভর দেবার জন্য নয়, নিরাপত্তার জন্য সে ব্যবহার করে। তার পেছন পেছন শোভাযাত্রার মতো এগিয়ে চলেছে নব, সুনন্দ, জ্যোতিপ্রসাদ এবং কীচক। উদয়শঙ্করের মন্তব্য শোনার পরে বাকিরা চুপ করে এগিয়ে চলেছে। জলাশয়টা পেতে আর একটু বাকি। সময় তখন ভোরবেলা। আশ্চর্য হওয়ার মতো নব জিৎ বৈশ্য উদয়শঙ্করকে জিজ্ঞেস করল উদয়দা ওটা কি? দৃশ্যটা দেখে নবজিত কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছে।
উদয়শঙ্কর জিজ্ঞেস করল- কোথায়? কোন দিকে?
-ঝোপটার ওদিকে। ওই যে।
নবজিৎ ঝোপটার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল। ওরা প্রত্যেকেই থেমে গেল।
-সাদা সাদা যে- কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে থাকার মত মনে হচ্ছে নাকি?
নবর আঙ্গুলের নির্দেশে উদয়শঙ্করের দিকে তাকাল এবং বলে উঠল- সর্বনাশ। ভীতিগ্রস্তভাবে জেপি চমকে উঠার মতো জিজ্ঞেস করল- কী হল?
নবজিৎ উদয়শঙ্করকে অনুরোধ জানাল-‘চলুন এগিয়ে গিয়ে দেখে আসি।
শঙ্কিত জেপি বলল- না না, আমি যাব না।
কীচকও জেপিকে সমর্থন জানিয়ে বলল- আমিও যাব না।
-সুনন্দ, তুমি যাবে কি ?
-চলুন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুনন্দ তার সঙ্গে যেতে সম্মতি প্রকাশ করল।
ওদের ততক্ষণে বুঝতে বাকি ছিল না ওদের সামনে কি দেখা যাচ্ছে।
উদয়শঙ্কর বলল- কেউ অঘটন ঘটিয়েছে! নবজিৎ বৈশ্য বলল-চলুন কে দেখে আসি। আমাদের নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
উদয়শঙ্কর নবজিৎকে উৎসাহিত করল- তোমার সাহস মানতে হবে। এটা আমাদের সামাজিক সমস্যা। আমাদের সম্মুখীন হতেই হবে।
উদয়শঙ্কর, নব এবং সুনন্দ এগিয়ে গেল। ঝোপটা থাকার জন্য ওরা ভালোভাবে কিছুই বুঝতে পারছে না বলে কিছুটা ঘুরে ওরা ঝোপটার বিপরীত দিকে উপস্থিত হল। ঝোপের বিপরীতে থাকা কেন্দু গাছের একটি ছোটোখাটো ডালে একটি যুবক ছেলের নিথর দেহ ঝুলে রয়েছে । ছেলেটির বয়স ২১ বছরের মতো হবে ।
– বেচারা গতরাতে কাজটা করেছে।
উদয়শঙ্কর ফাঁসি দেওয়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল।
- এই ধরনের অপঘাতী হওয়া মানুষকে দেখতে এমনিতেই ভালো লাগে না। তথাপি সুনন্দ দেখতো কে চিনতে পার কিনা? ভয়ে ভয়ে সুনন্দ ছেলেটির মুখের দিকে তাকাল।
এ তো দেখছি সোণ।সোণ দাস। ব’গলচ চকে তার একটি সেলুন আছে। সেলুন টা ভালো চলে। কী হল তার! কেন এই ছোটো ছেলেটি এরকম কাজ করল।
ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে সুনন্দ বলে উঠল।
- চল যাই। গ্রাম প্রধানকে খবর দিতে হবে। উদয়শঙ্কর তখনই সেখান থেকে বেরিয়ে এল। প্রথম দিন বাধা পড়ল ভেবে কীচক এবং জেপির মন বিষাদে ভরে উঠল। শিক্ষার সঙ্গে জড়িত এবং শিক্ষকতার চাকরি করলেও ওরা কিছু পরিমাণে অন্ধবিশ্বাসের বলি হয়ে রয়েছে যেন উদয়শঙ্করের মনে হল। ফলে তার দায়িত্ব বেড়ে গেল।
- তোমরা সেভাবে ভাবছ কেন? প্রথম দিন দ্বিতীয় দিন বলে কোনো কথা নেই। এইসব আমাদের সামাজিক দৈনন্দিন পরিঘটনা। আমাদেরকেই মোকাবেলা করতে হবে। এখন আমাদেরকেই কি গ্রাম প্রধানকে খবর দিতে হবে না? গ্রামবাসীদের জানাতে হবে না? আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করব। আগামীকাল সকালবেলা আমি এই পথে আবার আসব, আবার দেখব বকগুলিকে। আমি আমার কাজ করে যাব এবং সঙ্গে তোমাদের কাছ থেকেও সহযোগিতা চাইব।
-আমি আছি উদয়দা। আমি আগামীকাল আবার আপনার সঙ্গে আসব। নবজিত উদয়শঙ্করকে সমর্থন জানাল।
কীচক এবং জ্যোতিপ্রসাদের অবস্থা উদ্বিগ্নতায় পরিপূর্ণ, কী হবে কী করবে বুঝতে পারছেনা।
ওরা থানের মধ্য দিয়ে এসে বাঁধে উঠল। মানুষের সেভাবে আসা যাওয়া আরম্ভ হয়নি। তার মধ্যে যার সঙ্গে দেখা হয়েছে তাকেই ঘটনাটির কথা বলায় কিছুক্ষণের মধ্যে হাহাকার লেগে গেল।একজন দুজন করে বাঁধের উপরে লোকজন জমা হতে লাগল। তখনও কেউ গিয়ে দেখে আসার সাহস করতে পারছে না। যুবকেরা কৌতূহল নিবারণ করার জন্য কথাটা শুনে দৌড়ে গেল।উদয়শঙ্করের সন্দেহ হল এত মানুষের উপস্থিতি দেখলে বকেরা ভয় পেয়ে যাবে।
বাঁধে প্রাতঃভ্রমনে আসা কেউ একজন ঘটনাটির বিষয়ে কাকাবাবুকে জানাল।
- কী!
কাকাবাবু আশ্চর্য হলেন। এত ছোটো ছেলে একটিও এসব করতে পারে ভেবে কাকাবাবু উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করলেন। দুই একজন করে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও বাঁধের উপরে একত্রিত হল। নিমেষের মধ্যে পাখিদের পাড়া-পড়োশিতে হাহাকার লেগে গেল। সুনন্দ উদয়শঙ্করের কাছাকাছি এসে বলল- দাদা এন্ট্রিরের এই অঞ্চলের দুই চারজন ব্যক্তির সঙ্গে এই সুযোগে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেব কি?
-সুযোগ?
- সেরকম কিছু নয়। মানুষগুলি এক জায়গায় জমা হয়েছে যখন-
- অবশ্য কারও সঙ্গে পরিচিত হতে পাওয়া ভালো কথা। সুনন্দ একজন মানুষের কাছে গিয়ে তাকে সুনন্দের কাছে ডেকে এনে বলল ইনি হেমেনদা,হেমেন কলিতা। সেদিন যে জুলিয়েটের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তার ওপাশটিতে হেমেনদার বাড়ি। গঙ্গাপুখুরি হাইস্কুলের সামনের বাড়িটা।
হেমেনদা সুনন্দকে জিজ্ঞেস করলেন- আমি একে চিনতে পারছিনা।
-হেমেনদা ইনি উদয়শঙ্কর, ভাঙরা গোঁহাই খানের টুরিস্ট লজে কিছুদিন থেকে আছেন। আমাদের এই অঞ্চলের পাখ-পাখালির উপরে বিশেষ করে বকের উপরে অধ্যায়ন করতে এসেছেন।
- আপনিই নাকি? আপনার কথা শুনেছি। দেখা হয়ে ভালো লাগল। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান। কোনো অসুবিধা হলে জানাবেন। আসবেন আমাদের বাড়িতে। দেখা হলে ভালো লাগবে। কথা বলব।
উদয়শঙ্করের সঙ্গে পরিচিত হয়ে হেমেনদা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে গ্রাম প্রধানের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
হেমেনদা মানুষটা এই অঞ্চলের একেবারে সামাজিক ব্যক্তি। তিনি যা বলেন সবাই মেনে নেয়।
সুনন্দ এভাবে বলার পরে উদয়শঙ্কর হেমেনদার দিকে পুনরায় তাকাল। উঁচু লম্বা মানুষটা শরীরে বেশ শক্তি আছে। বলিষ্ঠ কন্ঠে স্পষ্ট কথা বলেন। ভিটিলিগ নামক ত্বকের পিগমেন্টের সাধারণ পরিবর্তন স্পর্শ করেছে।
নতুন করে খবর পাওয়া দুই চারজন জন মানুষ বাঁধ থেকে নেমে জায়গাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । ফাঁসি দেওয়ার দৃশ্য দেখা মানসিকভাবে কষ্টকর। সবার পক্ষে সম্ভব নয়। যারা এই দৃশ্য দেখতে অপারগ বলে মনে করে তারা বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে বিভিন্ন কথা আলোচনা করতে শুরু করেছে। গ্রাম প্রধান নলবাড়ি আরক্ষী থানায় যাবে ,খবর দিতে। তার সঙ্গে যাবে দিবাকর। সে তার মোটরসাইকেল আনতে বাড়িতে গেছে। গ্রাম প্রধান খবর দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে একজন দণ্ডাধীশের সঙ্গে আরক্ষী এসে উপস্থিত হল। সঙ্গে দুইজন সুইপার। আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করে ছেলেটির শব নিয়ে যেতে যেতে দুপুর হয়ে গেল। বাঁধের উপরে রাখা গাড়িতে শবটা ভার বেঁধে বহন করে আনতে হল। সেসব করতে গিয়ে অনেক সময় লেগে গেল।শবের পেছন পেছন আগত মানুষগুলি শবটা নিয়ে যাবার পরে নিজের নিজের কাজে ফিরে গেল। অঘটনটার শেষে পাখিদের পাড়া পড়োশি নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল ।
দূর থেকে সমস্ত কাণ্ডকারখানা ভয়ে ভয়ে দেখতে থাকা পুরোহিত শর্মার সঙ্গে বাপুটি ধীরে ধীরে উদয়শঙ্করের কাছে এগিয়ে এল। তাকে দেখলে এরকম মনে হয় সে যেন মাটির উপর দিয়ে চলছে না। অপরিচিত কিছু একটা যেন তাকে চেপে ধরেছে আর সে কোন মতে হেঁটে চলেছে।
-আজ রাতে কোথায় থাকবেন?
-কেন অন্য দিনের মতোই থাকব।
-রাতে এসে ধরলে
-কে?
উদয়শঙ্কর এরকম ভাব দেখাল যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
-যে মারা গেছে তার প্রেতাত্মা।
- দেখছি কী হয়।
- আপনি কাকাবাবুর বাড়িতে থাকবেন।
-না,সেখানে থাকব না। এখানেই থাকব এবং কাল সকালবেলা আলো-আঁধারিতে পুনরায় সেখানে যাব।
-কিছুতে ধরলে পাবেন মজাটা।
উদয়শঙ্কর বাপুটিকে গুরুত্ব দিল না। পাখিদের পাড়া-পড়োশী থেকে ঘটনাবহুল আর ও একটি দিন এভাবে পার হয়ে গেল।
কথা দেওয়া অনুসারে নবজিৎ সকালবেলা এসে উদয়শঙ্করের বাড়ি পৌঁছালো। দুজনেই একই রাস্তায় গিয়ে জলাশয়ের পারে উপস্থিত হল। গতকাল যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ আসা-যাওয়া করার জন্য পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে ঘাসগুলি এখনও নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন