শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২২

হে আমার স্বদেশ- ২৮ ।। সন্তোষ কুমার কর্মকার ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Santosh Kumar Karmakar

 হে আমার স্বদেশ- ২৮

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস





  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

(২৮)

' দাদু এক সময়ে ব্রিটিশ শাসকরা কংগ্রেসি নেতাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তখন ভারতবাসীর হয়ে জাতীয় কংগ্রেস উত্থাপন করা দাবি সমূহ তারা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করেছিল। কিন্তু ভাইসরয় রূপে লর্ড কার্জন আসার পরে তিনি কংগ্রেসের আবেদন নিবেদনের প্রতি উদাসীন। ফলে দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে। তারপরে এখন তিনি যেটা করতে চলেছেন– সমগ্র বেঙ্গলে আগুন জ্বলবে বলে আজকের হিন্দু পেট্রিয়ট এডিটোরিয়ালে লিখেছে।'

' দেখ জ্ঞান, লর্ড কার্জন দূরদর্শী ব্রিটিশ প্রশাসক। তিনি যা করতে চলেছেন, নিশ্চয় ভেবেচিন্তে করতে চাইছেন।'

' দাদু, কার্জন বেঙ্গলকে ভেঙ্গে দুই টুকরো করতে চলেছেন। দূরদর্শী দক্ষ প্রশাসক হোক না কেন, এর ফলাফল ভয়াবহ হবে।'

' ফলাফল কী রকম হবে, ব্রিটিশ সরকার সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। শোনো জ্ঞান, ভাইসরয়ের দায়িত্ব নিয়ে লর্ড কার্জন দেখলেন– বোম্বাই এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি দুটির আয়তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির চেয়ে ছোটো যদিও দুটি প্রশাসনের দায়িত্ব দুজন গভর্নরের হাতে ন‍্যস্ত হয়েছে। কিন্তু বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির লেফটেন্যান্ট গভর্নরের সাহায্য করার জন্য কোনো কাউন্সিল ছিল না। তার জন্য ১৮৭৪ সনে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে আমাদের অসমকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং অসমের প্রশাসন একজন কমিশনারের হাতে দেওয়া হয়। তখন শ্রীহট্ট, কাছার এবং গোয়ালপাড়া আদি বঙ্গভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল সমূহ অসমের সঙ্গে যোগ করা হয়। সেটাইতো পার্টিশন অফ বেঙ্গল। তখন কি ফল হয়েছিল? তখন বাঙালিরা কী করেছিল?'

' তখন জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়নি। জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হওয়ার পরে বিগত পনেরো বছরে সমগ্র ভারতবর্ষে যে ধরনের জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, এখন কার্জন যেভাবে চাইছেন সেভাবে বেঙ্গল ভাগ করায় সফল হতে পারবে না।'

' কার্জন যদি প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বেঙ্গলকে ভাগ করতে চায়, তাতে আমরা অসমিয়াদের বলার কিছু নেই। সেটা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কিন্তু তিনি যে ঢাকা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভা্‌গ, পার্বত্য ত্রিপুরা দার্জিলিং এবং রাজশাহী বিভাগকে অসমের সঙ্গে একত্রিত করে' পূর্ববঙ্গ এবং অসম' নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করে ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করতে চলেছে, এটাই আমি মেনে নিতে পারছি না।'

' কেন?'

' কী মূর্খের মতো প্রশ্ন করছ! আমি তো বললামই, আমাদের অসমের সঙ্গে যে কয়েকটি বিভাগ অথবা অঞ্চল যোগ করবে বলে ভাবছে, সেই সবের মধ্যে দার্জিলিং এবং পার্বত্য ত্রিপুরা ছাড়া বাকি কয়েকটি বঙ্গভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল। এই অঞ্চলগুলি অসমের সঙ্গে থাকলে বাঙালির প্রভুত্ব বাড়বে অসমে পুনরায় বাংলা ভাষার প্রচলন হবে।'

'তাহলে বাঙালির সঙ্গে আমাদেরও কার্জনের এই বঙ্গভঙ্গ নীতির বিরোধিতা করা প্রয়োজন।'

'বিষয়টি রাজনৈতিক। এই নীতির বিরুদ্ধে এখন অসমিয়াদের কে আন্দোলন করবে? পরিস্থিতিটা কোনদিকে বাঁক নেয় দেখতে থাক। এদিকে দেশাধিকারের বিভাজন রাজনীতির সঙ্গে আমাদের মধ্যে মানে আমাদের এই বাড়িতেও বিভাজনের এক বীভৎস রূপ প্রকাশ পেল নয় কি?

' সেসব আপনি আমাকে বলেন না। আপনি না বললেও আমি কিন্তু দিদিমনির কাছ থেকে জানতে পেরেছি। সব কিছু শুনে খুবই খারাপ লাগল। আপনার জন্য বেশি করে খারাপ লাগল। অন্তত আপনার ক্ষেত্রে বি বরুয়া এরকম করাটা উচিত হয়নি।'

' সবই আমার কপাল।'

' কপাল মানে আপনি মাত্রাধিক সরল। আপনি মানুষকে সহজে বিশ্বাস করেন। কথায় বিবশ হয়ে বিশ্বাস করে আপনি তাকে আপন করে নেবার জন্যই আজ আপনার এই পরিণতি।'

' কিন্তু বিশ্বাস করে কাউকে আপন করে নেওয়াটা অন্যায় নাকি, জ্ঞান? সেইসব কষ্টদায়ক কথা। সেসবের কাছ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যই ঘটনাটা ঘটার সাত দিনের মধ্যে ডবসন রোডের বাড়িটা ছেড়ে সল্ট গোলালেনের এই বাড়িতে চলে এলাম। আচ্ছা,তোমাদের খবরা-খবর বলতো। প্রিন্সিপাল ক্ষীরোদবাবুর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরে স্বর্ণের বোধহয় ভালোই চলছে?'

' জামাইবাবু সত্যিই একজন গুণী মানুষ। খুবই স্নেহশীল। পিতা না হয়েও জামাই বাবু যে মেয়ে দুটিকে আপন করে নিয়েছে, এটাতে দিদি খুব সুখী হয়েছে।'

' হুগলি কলেজের প্রিন্সিপাল হয়ে থাকার সময় ক্ষীরোদবাবু কটকের রেভেন্সা কলেজের প্রিন্সিপাল হলেন। তুমি কটকে গিয়েছ কি?

‘গিয়েছিলাম । কিন্তু মেয়ে দুটিকে নিয়ে দিদি তখন কলকাতায় ছিলেন। এদিকে জামাইবাবু প্রিন্সিপাল, সারাটা দিন কলেজের কাজে ব্যস্ত থাকেন। তার মধ্যে আবার চাকর রেঁধে দেওয়া ভাত খেতে হয়। সারাটা দিন বাড়িতে একা, বেশিদিন থাকতে পারলাম না। আমার মনে হয় এখন দিদির কটকে গিয়ে জামাইবাবুর সঙ্গে থাকা উচিত।'

' সেটাই হবে। কিন্তু ক্ষীরোদবাবু বা স্বর্ণকে কবে কটকে নিয়ে যায় ? তারপরে তোমার পড়াশোনা ?'

১৮৯৫ সনে বিলেত গিয়েছিলাম। অসুস্থতার জন্য তিন বছর পরে পড়াশোনা অর্ধ সমাপ্ত রেখেই ফিরে আসতে হল।কলকাতায় এসে সুস্থ হয়ে উঠতেই আড়াই বছর পার হয়ে গেল।অসুস্থতার জন্যই আমি ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় বসতে পারলাম না। আবার বিলেত যেতে হবে ।'

স্বর্গীয় গুণাভিরাম বরুয়ার সুযোগ্য পুত্র জ্ঞানদাভিরামের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের নতুন করে ভাড়া নেওয়া ১০ নম্বর সল্ট গোলা লেনের ছোটো ঘরটিতে আলোচনা চলছিল। ডবসন রোডের বাড়ি ছেড়ে লক্ষ্মীনাথ পরিবারের সঙ্গে এই বাড়িতে উঠে আসার নয় দিন হয়েছে।জ্ঞানদাভিরামের ডাক নাম জ্ঞান।বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষীনাথকে মামা বলে ডাকত বলে সম্পর্কের বিচারে লক্ষ্মীনাথ জ্ঞানদাভিরামের দাদু।তাই জ্ঞানদাভিরাম লক্ষ্মীনাথকে দাদু বলে ডাকে।আলাদা ভাড়া বাড়িতে থাকলেও জ্ঞানদাভিরাম প্রায়ই লক্ষ্মীনাথের বাড়িতে আসে।এতদিনে সে লক্ষ্মীনাথের পরিবারের একজন সদস্যের মতো হয়ে পড়েছে।জ্ঞানদাভিরাম এলেই লক্ষ্মীনাথের প্রাতঃস্মরণীয় গুণাভিরাম বরুয়া মহাশয়ের কথা মনে পড়ে।এখনও লক্ষ্মীনাথ ভাবে, আরও অন্তত দশ বছর বেঁচে থাকলে অসমিয়াদের মঙ্গলের অর্থে বিশেষ করে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের জন্য বরুয়া অনেকখানি করে যেতে পারতেন। রায়বাহাদুর বরুয়ার বাকি ছেলে দুটি কলিতে শুকিয়ে না গিয়ে বেঁচে থাকলে অসমিয়া আরও দুটি জে বরুয়া(জ্ঞানদাভিরাম) পেত।

বাইরের দিকের ঘরে বসে লক্ষ্মীনাথ বি ব্রাদার্স কোম্পানির কিছু কাগজপত্র গুছিয়ে রাখছে। এসবের মধ্যে ছেড়ে আসা কোম্পানিটার হিসাবের কথা আছে। সেইসব সম্পূর্ণ করে বি বরুয়াকে সমঝে দিতে হবে। হিসাব লিখে থাকার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ সামনের চেয়ারে বসা জ্ঞানদাভিরামের সঙ্গে কথা বলছে। সাড়ে চার বছরের অরুণা ভেতরের বারান্দায় বসে খেলছে। তার পাশে দৌড়ে বেড়ানো এক বছর চার মাসের রত্নাকে আয়া দেখা-শোনা করছে। প্রজ্ঞা এতক্ষন রান্নাঘরে রান্না-বান্নায় ব্যস্ত ছিল। জ্ঞানদাভিরাম এসেছে জানতে পেরে প্রজ্ঞা সুন্দর একটা রেকাবিতে তিন ধরনের মিষ্টি সাজিয়ে নিয়ে এল। ঘরে ঢুকতে গিয়েই জ্ঞানদাভিরামের বিলেত যাবার কথা শুনে প্রজ্ঞা বলল,' হ‍্যাঁ, দাদুভাই বিলেততো তোমাকে যেতেই হবে।'

প্রজ্ঞাকে জ্ঞানদাভিরাম বলল,' হ্যাঁ যাব, দিদিমণি।'

' হ‍্যাঁ, যাও। বিলেত গিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে এসো।' জ্ঞানদাভিরামের সামনে মিষ্টির রেকাবিটা এগিয়ে দিয়ে প্রজ্ঞা বলল, 'এদিকে বিয়ের বয়স তো হলই।'

' বিয়ের বয়স,এক্ষুনি বিয়ে!'

' এক্ষুনি নয় গো।বিয়ের পিঁড়িতে বসবে ব্যারিস্টার জ্ঞানদাভিরাম বরুয়া।' হাসতে হাসতে প্রজ্ঞা বলল,' তোমার জন্য আমরা পাত্রী ঠিক করে রেখেছি।'

' আমার জন্য পাত্রী ঠিক করে রেখেছেন! কে সেই ভাগ্যবতী, বলুনতো?'

' পাত্রীটিই শুধু ভাগ্যবতী হবে না। তাকে পেয়ে তুমিও নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে ।'

'ওহো দিদিমণি, তিনি কে বলুন না?'

' তিনি হলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র দার্শনিক পন্ডিত শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যমপুত্র শ্রীযুক্ত অরুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ কন্যা শ্রীমতী লতিকা দেবী।'

জ্ঞানদাভিরাম লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে মুচকি হেসে বলল,' লতিকাকে তো আমি দেখেছি।'

' লতিকাও তোমাকে দেখেছে।' মধুর হাসি হেসে প্রজ্ঞা বলল,' আর অরুণেন্দ্র দাদা এবং বৌদিও ভাবি জামাই হিসেবে তোমাকে মনোনীত করেছেন। কি, লতিকা তোমার পছন্দের পাত্রী তো?'

জ্ঞানদাভিরামের লজ্জা আরও বেড়ে গেল। রেকাবিটা টেনে নিয়ে হাসতে হাসতে মিষ্টি খেতে লাগল।

' হবে হবে।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' যা দেখছি ,তুমিও আমার মতো ঠাকুরবাড়ির অন‍্য একজন অসমিয়া জামাই হবে। ইচ্ছা হলে ঠাকুরবাড়ির ঘর জামাই হয়েও থাকতে পারবে।

' কী যে বল না তুমি!' লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে প্রজ্ঞা বলল,' বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে কোন দুঃখে দাদুভাই আমার ঘর জামাই হতে যাবে ,শুনি?'

দুঃখের দিনেও লক্ষ্মীনাথ মজা করার সুরে বলল,' না, বলছিলাম কি– তোমাদের ঠাকুরবাড়ির কর্তারা তো জামাইদের সেই সুযোগ দিয়ে থাকেন।'

' এখন সে রেওয়াজ উঠে গেছে।' তারপর জ্ঞানদাভিরামের দিকে তাকিয়ে প্রজ্ঞা বলল,' কিগো দাদুভাই, সত্যিই তুমি ঘর জামাই হতে চাও নাকি?'

লজ্জায় জ্ঞানদাভিরামের মুখ লাল হয়ে উঠল। সে আর সেখানে বসে থাকতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সত্যিই সেদিন রাতে লক্ষ্মীনাথের নিজেকে সামলাতে না পারা একটা অবস্থা হয়ে পড়েছিল।আসলে ভোলানাথের আচরণ তার আত্মসম্মানে আঘাত করেছিল।তাঁর আত্মমর্যাদা ভুলন্ঠিত হয়েছিল।তার জন্যই অপরিসীম ক্ষোভ-অভিমান এবং প্রচন্ড ক্রোধ বিরক্তিতে লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে থাকা এত বছরের ব্যবসায়িক সম্পর্কটা ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছিল।সেই মুহূর্তে নিজের দৈহিক এবং মানসিক শ্রমের অধিকাংশই বি বরুয়া এবং বি বরুয়া কোম্পানির জন্য সমর্পণ করে কলকাতার এক নম্বর কাঠের ব্যবসায়ী রূপে প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিজ হাতে পুনঃনির্মাণ করা ৩৮ নম্বর ডবসন রোডের সুন্দর বাড়িটা তার কাছে গৌণ হয়ে পড়েছিল।আর তার জন্যই ডবসন রোডের বাড়িটার মায়া–মোহ ত্যাগ করে মাসিক ৭০ টাকা ভাড়ায় দু মাসের বন্দোবস্ত করে পরিবারের সঙ্গে এই দশ নম্বর সল্ট গোলালেনের বাড়িতে উঠে এসেছে ।

ভোলানাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের মতবিরোধ হয়েছে,আলাদা হয়ে দুই জায়গায় থাকতে আরম্ভ করেছে– রাতের ভেতরে খবরটা প্রচার হয়ে গেল। লক্ষ্মীনাথ নিজে কাউকে কিছু বলেনি।বলেনি মানে বলতে খারাপ লাগে,অপমান বোধ হয়। কিন্তু বি ব্রাদার্স কোম্পানির মতো কলকাতার ব্যবসায়িক সংস্থার প্রধান দুজন অংশীদারের মধ্যে সংগঠিত দুর্ঘোর সংঘাত! সংশ্লিষ্ট কর্মচারীছাড়া ঠিকাদার গ্রাহকদের মুখে মুখে খবরটা প্রচার হয়ে গেল ।

ঘটনাটা জানতে পেরে কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের ছেলে মন্মথ,অতুলকৃষ্ণ বাবু ,কিশোর বাবু এবং বটুবাবু লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে দেখা করতে এল। দেখা করে কিশোর বাবু বলেই ফেললেন,' আপনাদের মধ্যে এসব কী ঘটল, বলুন তো? এতকাল জানতুম ভোলানাথ- লক্ষ্মীনাথ দুই ভাই, একেবারে অভেদ আত্মা ।এখন দেখছি লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথের সহোধর ভাই নয়,' সুবিধামূলক' ভাই ।আমরা তো মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি, এসব জানলে কোন বেকুব এই কোম্পানিতে চাকরি করতে আসত।লজ্জা, অপমানে লক্ষ্মীনাথের চোখ দুটি সজল হয়ে পড়ল। কোনো কিছু না বলে মাথা নিচু করল। ব্যবসার সমস্ত কাগজপত্র ভোলানাথের নামে, বাড়িঘর সম্পত্তিও তার নামে। তার জন্য লক্ষ্মীনাথের মনে কোনো ধরনের সন্দেহ বা আশঙ্কা ছিল না। সেটা যে তার দিক থেকে নিতান্তই বালকসুলভ কার্য হয়েছিল এখন বুঝতে পারল। অবশেষে প্রিয় বন্ধু মাজিউর আশঙ্কাই সত্যি হল। সরল বিশ্বাসের এতই করুণ পরিণতি যে বি বরুয়া কোম্পানির অংশীদারিত্বের দাবি হারানোর সঙ্গে এত কষ্ট করে মেরামত করা ডবসন রোডের বাড়িটাও ত্যাগ করতে হল।

ইন্ডিয়া ক্লাবের বিলিয়ার্ড খেলার বন্ধুরা এল। এল হাওড়া কোর্টের মাননীয় সদস্যরা, মিসসেলিনিয়াসের কর্মচারীরা, দাদা ডক্টর গোলাপ বেজবরুয়া এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজনরা। তারা নিজের নিজের বোধ বিচার অনুসারে লক্ষ্মীনাথকে পরামর্শ দিতে এগিয়ে এল। ভায়রা ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী বিচক্ষণ ব্যক্তি। ভোলানাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের এই বিচ্ছেদের কথা শুনে তিনি মর্মাহত হলেন । নিজে আইনের মানুষ হয়েও তিনি ভোলানাথের সঙ্গে বসে ভুল বোঝাবুঝিটা দূর করে আপোশে মীমাংসা করে নিতে পরামর্শ দিলেন। তারপরে জোড়াসাঁকো থেকে লক্ষ্মীনাথের সম্বন্ধী হিতেন্দ্র,ক্ষিতীন্দ্র এবং ঋতেন্দ্রও এল।

শুভার্থীরা বিদায় নেবার পরে থাকল‍ হিতেন্দ্রনাথ এবং ক্ষিতীন্দ্রনাথ। অনেকক্ষণ চিন্তিতভাবে বসে থেকে ক্ষিতীন্দ্রনাথ বলল, ‘লক্ষ্মীনাথ আবেগের বশবর্তী হয়ে তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে নাকি ?'

সিদ্ধান্তটা তাড়াহুড়ো করে বা আবেগের বশবর্তী হয়ে নেওয়া হয়নি। আসলে লক্ষ্মীনাথ মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল।

ক্ষিতীন্দ্রনাথ পুনরায় বলল,' মানে কথাটা হল, মাথাটা একটু ঠান্ডা রেখে ব্যবসায় নিজের অংশটুকু আদায় করে নিয়ে তারপর যদি ভোলানাথ বাবুর সঙ্গে ব্যবসা না করার সিদ্ধান্ত নিতে–।'

' না মেজদা, সেদিন ভোলা দাদার সঙ্গে ওভাবে সম্পর্ক চুকিয়ে ঠিকই করেছি।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' আসলে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। এতগুলি ঘটনার পরে ওই বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমার আত্মাটা পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল।'

' এখন ভোলানাথবাবু যদি তোমার প্রাপ্যটুকু না দেন?'

' কী দেবেন কী দেবেন না সেটা ওর ব্যাপার। না দিলেও আমি আর ওর কাছে চাইতে যাব না।'

' ভোলানাথ বাবু যেরকম পাকা বুদ্ধির লোক–।' প্রজ্ঞার বড়ো দাদা হিতেন্দ্রনাথ বললেন,' এখন তোমাকে এমন কিছু ফ্যাসাদে ফেলবে যে চাইলেও তোমার দাবি অযৌক্তিক বলে শূন্য হাতে তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন।'

ক্ষিতীন্দ্রনাথ বললেন,' লক্ষ্মীনাথ বাড়ি গিয়ে কি মাকে এসব বলব? মা কি ভোলানাথ বাবুর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন?'

' মাকে না বলে তো থাকা যাবে না। সেটা উচিতও হবে না।'

লক্ষ্মীনাথ বলল,' তবে তিনি যেন আর ভোলা দাদার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার উদ্যোগ না নেন।'

পাশে দাঁড়িয়ে প্রজ্ঞা শুনছিল। সে বলল,' আমার তো মনে হয়, আমাদের প্রাপ্যটুকু দিতে ভোলানাথ দাদা এতটা অবিবেচক হবেন না।'

' দেখা যাক, তিনি কি করেন? ছোটো করে একটা নিশ্বাস ফেলে ক্ষিতীন্দ্রনাথ বলল,' তারপর ডবসন রোডের ওই বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে এসে এই বাড়িটা নিলে। ছোটো বাড়ি, এখানে তোমাদের অসুবিধা হচ্ছে।তারচেয়ে চল আমাদের সঙ্গে জোড়াসাঁকোতে থাকবে।'

' না, মেজদা এখন আর জোড়াসাঁকো যাব না। বাড়ি খুঁজছি।তাড়াতাড়ি পাওয়ার জন্য দালাল লাগিয়েছি।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' তাছাড়া অতুলবাবু প্রতিপত্তিশালী লোক। তিনিও বাড়ি খুঁজছেন। মাসখানেকের মধ্যে বাড়ির ব্যবস্থা হয়ে যাবে'

' হাওড়াতেই না কলকাতার দিকে–?'

' হাওড়াতেই খুঁজতে বলেছি।'

তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে লক্ষ্মীনাথ যে ডবসন রোডের বাড়িটা ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেই সবাইকে নিয়ে সল্ট গোলালেনের এই ছোটো বাড়িটাতে চলে এল, এটা প্রজ্ঞা এখনও মেনে নিতে পারেনি।

ডবসন রোডের সেই বাড়িটার সঙ্গে তাদের দাম্পত্য জীবনের সাড়ে চার বছরের স্মৃতি জড়িত হয়ে রয়েছে ।প্রজ্ঞা কোনোমতেই বাড়িটার কথা ভুলতে পারেনি। লক্ষ্মীনাথের ও একই অবস্থা। অথচ অন্তরের দুঃখ- ক্ষোভ প্রকাশ না করে লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞাকে বোঝাল। মানুষ কোথায় থাকবে, কোথায় তার বাসস্থান হবে ,মানুষ নির্ণয় করতে পারে কি? না, পারে না ।প্রভাব প্রতিপত্তিশালী বড়ো বড়ো মানুষও পরিস্থিতির দাস। অবস্থা পরিস্থিতি এবং জীবিকার জন্য মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে বাধ্য হয়। আজ ডবসন রোডের বাড়ি ছেড়ে সল্ট গোলা লাইনে বাস করছেন, কিছুদিন পরে নতুন করে কেনা বাড়িতে থাকবেন। কিন্তু নতুন সেই বাড়িতেই কি জীবনের বাকি দিনগুলি থাকতে পারবেন?না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। আবার কোন পরিস্থিতি তাদেরকে কোথায় নিয়ে যায়?

লক্ষ্মীনাথের কথা শুনে প্রজ্ঞার বুকটা হাহাকার করে উঠল। সে ভবিষ্যতের এতটা চিন্তা করতে পারল না। সে ভাবছে বর্তমানের কথা।‌ প্রজ্ঞা, ডবসন রোডের বাড়িটিতে চাকর-বাকর থাকার সুবিধার কথা বলল, ঘোড়ার আস্তাবলটার কথা বলল, গরুর গোয়ালের কথা বলল, বাড়ির সামনের দিকে সুন্দর ফুল বাগানের কথা বলল, লন টেনিস কোর্টের কথা বলল এবং এখনও হৃদয়ের অন্তস্থলে বিরাজ করতে থাকা সুরভির মূর্তি রাখা ছোটো মন্দিরটার কথাও বলল।

লক্ষ্মীনাথ কথার রসিক। রসাল কথায় মানুষের মন- মানসিকতা পরিবর্তিত করতে পারে।তাঁর কথায় পরিবেশ-পরিস্থিতি পৃথক হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রিয়তমা পত্নীর মন খারাপের সামনে তাঁর কথা হারিয়ে গেল। তবুও হাসিতে নিজেকে লুকিয়ে ধীরে ধীরে বলল, মানুষ সব কিছু পায় না। প্রজ্ঞার মায়ের বাড়ি এবং শিবসাগরের তাদের বাড়ির পরিবেশের কথা উল্লেখ করে লক্ষ্মীনাথ বোঝাল ঐতিহ্যপূর্ণ ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশ কি ডবসন রোডের বাড়িটাতে সৃষ্টি হয়েছিল? নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব দীননাথ বেজবরুয়ার বাড়িতে যে ধরনের আচার- সংস্কারে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপনের শুদ্ধাচারী পরিবেশ একটি ছিল,সেটাও কি ডবসন রোডের বাড়িতে সৃষ্ট করা সম্ভব হয়েছিল? না, হয়নি। সেটা সম্ভব ও নয়। তবু নতুন করে কিনতে চলা বাড়িতে প্রবেশ করে যতটা সম্ভব করে নেবে। সুরভির মূর্তিটা রাখার জন্য একটা ঘর না হলেও ডবসনরোডের ঘরটি থেকে মূর্তিটা তুলে এনে নতুন বাড়ির ঘরের কোথাও রাখবে। তারপরে কিছুটা আবেগিক হয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল, এবার কিনতে যাওয়া বাড়িটা তার নামে হবে। আইনগতভাবে সেই বাড়িটাতে কেবল তাদের অধিকার থাকবে। বিয়ের পরে বিগত প্রায় চৌদ্দ বছরের দাম্পত্য জীবনে এটা প্রশ্নাতীতভাবে সাব্যস্ত হয়েছে যে প্রজ্ঞা তাঁর বেঁচে থাকার শক্তি, প্রজ্ঞা তার আত্মিক সত্তা। প্রজ্ঞা তার সহধর্মিনী, ইহকাল পরকালের সঙ্গী, বান্ধবী। অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজের হাতে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা, সেই বাড়ি থেকে ভোলানাথ তাকে বের হয়ে আসতে বাধ্য করলেও জীবনের বাড়ি থেকে প্রজ্ঞাকে কোনো অবস্থাতে কখনও বেরিয়ে যেতে বলবে না। আর নতুন করে কিনতে চেষ্টা করতে থাকা বাড়িটাতে লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞাসুন্দরীকে জীবন দেবীরূপে প্রতিষ্ঠা করবে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-পা ধুয়ে অন্যান্য দিনের মতো ভাগবত রাখা আসনের সামনে বসে গুণগুণ করে কিছুক্ষণ নাম- প্রসঙ্গ করল। অরুণার এখনও ঘুম ভাঙ্গেনি। রত্না ঘুম থেকে উঠে ভেতরের বারান্দায় আয়ার সঙ্গে খেলাধুলা করছে। বাবাকে দেখেই দৌড়ে এসে কোলে উঠল। রত্মাকে আদর করে লক্ষ্মীনাথ তার গালে চুমু খেল। তারপরে তাকে আয়ার সঙ্গে খেলতে বলে এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে গেল। অতুলকৃষ্ণ বাবু ইতিমধ্যে একটা বাড়ি খুঁজে পেয়েছেন বলে গতকাল জানিয়েছিলেন। সেই বাড়িটা দেখতে যাবে।

সল্ট গোলা লেনের এই বাড়িটা থেকে অতুলকৃষ্ণ বাবুর বাড়িটা বেশি দূরে নয়। লক্ষ্মীনাথ পায়ে হেঁটেই তাঁর বাড়িতে এল।

অতুলকৃষ্ণ বাবুর বয়স ষাটের কাছাকাছি। মাঝারি উচ্চতার সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। এমনিতেও তিনি সেগুন কাঠের জহুরী। তাছাড়া বাজারের দর নিয়ন্ত্রণে রেখে কীভাবে যোগান- বিতরণ করতে হয় সেই বিষয়ে সময়োচিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার সমান অভিজ্ঞ ব্যক্তি কলকাতায় দ্বিতীয় একজন নেই।এমনিতে আচার-আচরণ কথাবার্তায় একশ শতাংশ বাঙালি যদিও ব্রিটিশের সময়নিষ্ঠা, কর্মকুশলতা, রাজনৈতিক বাস্তব-বিচার বুদ্ধি, সাহস এবং দূরদর্শিতার উচ্চ প্রশংসক। এদিকে কোট, হ্যাট পরে ক্লাবে গিয়ে বিলিয়ার্ড খেলে সাদা হাফ প্যান্ট, সাদা জুতো পরে পঁচিশ বছর বয়সের যুবকের মতো লন টেনিস খেলে। হাওড়ার পাবলিক কোর্টের অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের আসনে বসে লক্ষ্মীনাথ অতুলকৃষ্ণ বাবুর সঙ্গে আলোচনা করেই বিভিন্ন জটিল মামলার রায়দান করে হাওড়াবাসী জনগণের সমীহ শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছেন।

উঁচু সুদৃশ্য ফটক পার হয়েই লক্ষ্মীনাথ দেখল, বিশাল বারান্দার একটা আরাম চেয়ারে বসে অতুলকৃষ্ণ বাবু' অমৃতবাজার পত্রিকা' পড়ছেন। লক্ষ্মীনাথকে আসতে দেখেই উষ্ণ সম্ভাষণে স্বাগত জানিয়ে অন্য একটি আরাম চেয়ারে তাকে বসতে বললেন। তারপরে কোনো ধরনের ভূমিকা না করে কড়া সুরে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের সমালোচনা করতে লাগলেন। হাতের কাগজটা ভাজ করে সামনের ছোটো টেবিলটাতে রেখে তিনি বলতে লাগলেন, কার্জন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রানকেন্দ্রস্বরূপ বঙ্গকে দ্বিখণ্ডিত করে হিন্দু বাঙালিকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে চাইছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কায়েম রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন বাঙালিকে পঙ্গু করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ রুদ্ধ করে হিন্দু- মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে দিতে চাইছে।

লক্ষ্মীনাথ এসব শুনতে চায় না। সে অতুলকৃষ্ণ বাবুর সঙ্গে বাড়ি দেখতে এসেছে। কিন্তু ভাইসরয় কার্জনের বঙ্গকে ভঙ্গ করার কার্যসূচী রূপায়িত করার পথে এগিয়েছেন বলে অমৃতবাজার পত্রিকায় খবর বেরোতে দেখে অতুলকৃষ্ণ বাবু ভেতরে ভেতরে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন যে লক্ষ্মীনাথ কেন এসেছে সেই কথাটা জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেলেন।

অতুলকৃষ্ণ বাবু পুনরায় বললেন যে কার্জনের বঙ্গকে ভঙ্গ করার ঘৃণ্য পরিকল্পনার বিরোধিতা করে আজকের কাগজে একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯০৩ সনের কংগ্রেস অধিবেশনেও বঙ্গ বিভাজনের পরিকল্পনাকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছিল। তারপরে কার্জন কীভাবে সাংঘাতিক কাজ করল দেখুন, তিনি পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করে মুসলমান নেতাদের বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করার জন্য খেপিয়ে দিলেন। কার্জন নবাব সলিমুল্লাহ খানকে নামমাত্র সুদে এক লক্ষ টাকা ধার দিলেন এবং তিনি এটাও বললেন যে বঙ্গ বিভাজন হলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা অধিক সুযোগ-সুবিধা পাবে। প্রবন্ধকার স্যার হেনরি কটন সাহেবের একটা উদ্ধৃতি তুলে দিয়েছে। নিজে ব্রিটিশ হয়েও স্যার কটন কার্জনের সমালোচনা করে লিখেছেন–'It was not a administrative reason that lay at root of the planning of partition of Bengal. It is a policy to enfeeble the growing power and destroy the political tendencies of the patriotic spirit. The Bengalees are the leaders of political agitation of India.'

'কী হল লক্ষ্মীনাথ বাবু, আপনি আনমনা হয়ে আছেন।' কপাল কুঁচকে অতুলকৃষ্ণ বাবু বললেন,' আপনি যেন আমার কথা শুনছেন না বলে মনে হচ্ছে!'

লর্ড কার্জনের বঙ্গকে ভঙ্গ করার নীতির বিরুদ্ধে অতুলকৃষ্ণ বাবুর এই ধরনের সরোষ উত্তেজনা লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগেনি। তবে ভালো না লাগার কথাটা প্রকাশ করা যায় না। প্রকাশ করলে অতুলকৃষ্ণ বাবুর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আঘাত করা হবে । তার জন্যই লক্ষ্মীনাথ বলল, 'বুঝতেই তো পারছেন, মেন্টালি আমি একটু ডিস্টার্ব হয়ে আছি। তাছাড়া আপনি আমাকে আজ বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন, সেটাই ভাবছিলাম। আপনি তো জানেন, আমার এখন একটা বাড়ি খুঁজে পাওয়া কত দরকার।'

' আপনি বাড়ি পাবেন আর আমার বিশ্বাস এই বাড়িটাও আপনার পছন্দ হবে।'

'তাহলে চলুন দেখে আসি।'

অতুলকৃষ্ণ বাবুর সঙ্গে গিয়ে বাড়িটা দেখে এল। বাড়িটার ঠিকানা, ২২ নম্বর রোজ মেরি লেন। বাড়িটার মালিক একজন ফিরিঙ্গি। নাম মিস্টার ফ্রানকুম(Mr.Frankum)। বাড়িটা দেখে লক্ষ্মীনাথের পছন্দ হল। ডবসন রোডের বাড়িটার মতো এতটা বড়ো না হলেও বাড়িটির অবস্থা ভালো। গৃহপ্রবেশের আগে খুব একটা মেরামতি করাতে হবে না। শুধু চূন-কাম করেই গৃহ প্রবেশ করা যাবে।মিঃ ফ্রেনকুমের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাড়িটার মূল্য বারো হাজার টাকা স্থির করা হল। দুদিন পরে আলিপুর কোর্টে ৫১ টাকার বায়না পত্র লিখে উভয়ে সই করল। এবারও সাক্ষী হিসেবে রইলেন অতুলকৃষ্ণ ঘোষ। রেজিস্ট্রিপত্র লেখার দায়িত্ব দেওয়া হল ভৈরব বাবুকে। পরের দিন লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞা এবং জ্ঞানদাভিরামকে বাড়িটা দেখিয়ে আনল। তাদেরও পছন্দ হল।

২২ নম্বর রোজমেরী লেন এর বাড়িটা কেনার জন্য বাকি কাজটুকু দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল। রেজিস্ট্রি করার তারিখ স্থির করা হল।

ইতিমধ্যে ভোলানাথ বরুয়ার লিখিত নির্দেশ মতে লক্ষ্মীনাথ ম্যানেজার অতুলকৃষ্ণ বাবুকে ব্যাংকের পাসবুক, চেকবুক এবং হিসাব পত্র বুঝিয়ে দিলেন। বি ব্রাদার্স কোম্পানির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বর্তমান মূল্য ১২ লাখ টাকার কাছাকাছি। লক্ষ্মীনাথের পছন্দ অনুসারে ভোলানাথ তাঁকে সেগুন কাঠের ব্যবসাটা ছেড়ে দিল কিন্তু লাভজনক স্লিপার এর ব্যবসাটা নিজের সঙ্গে রাখল। নতুন বাড়ি কেনার জন্য ভোলানাথ অতুল কৃষ্ণ বাবুর মাধ্যমে ১৪ হাজার টাকা দিলেন। অতুলকৃষ্ণ বাবু তার কার্যকালের হিসেব দাখিল করে বি বরুয়া কোম্পানি থেকে ইস্তফা দিলেন। তারপরে তিনি লক্ষীনাথের সঙ্গে সেগুন কাঠের ব্যবসা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। অতুল কৃষ্ণ বাবুকে পেয়ে লক্ষীনাথ খুশি হল।

১৯০৪ সনের ১৯ আগস্ট বুধবার হাওড়া কোর্টের রেজিস্ট্রি অফিস ২২ নম্বর রোজমেরি লেনের'লরেলচ' নামের বাড়ির মালিক জিসি ফ্রেনকুম ( বিক্রেতা) এবং শ্রীমতী প্রজ্ঞাসুন্দরী বেজবরুয়ার (ক্রেতা) মধ্যে দলিল প্রস্তুত করা হল। কোর্টের সেরেস্তাদার আশুবাবু, জিসি ফ্রেনকুম, অতুলকৃষ্ণ বাবু এবং লক্ষ্মীনাথকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরে সুকলমে রেজিস্ট্রি হয়ে গেল। বায়না-পত্র করার সময় দেওয়া ৫১ টাকা রেখে লক্ষ্মীনাথ ফ্রেনকুমকে ১১,৯৪৯ টাকা আদায় দিলেন। সদাশয় ফ্রেনকুম সেদিন এই 'লরেলচ' এর দখলিসত্ত্ব প্রদান করলেন। অনেকদিন পরে লক্ষ্মীনাথের মুখে হাসি ফুটল। সত্যিই সে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে সক্ষম হল। দালালি বাবদ ১২০ টাকা অতুলকৃষ্ণ বাবুকে দিয়ে ওয়ালেস রেস্তোরায় দাদা ডক্টর গোপাল বেজবরুয়া এবং জ্ঞানদাভিরামের সঙ্গে ভালোভাবে ভূরিভোজন করে বাড়ি ফিরে এল।


1 টি মন্তব্য:

  1. ঠাকুরবাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবির স্বামী সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়ার জীবন বড় সুন্দর ভাবে ধারাবাহিক পড়ছি এই অনুবাদে। খুব ভাল লাগছে জেনে। শুধু একটি প্রশ্ন ছিল মূল অসমিয়া গ্রন্থ সন্তোষকুমার কর্মকারের "হে আমার স্বদেশ" কী শ্রী লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া রচিত তাঁর আত্মজীবনী থেকে সংগৃহীত? যদি জানান সেই তথ্যসূত্র বড় বাধিত হই।

    উত্তরমুছুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...