রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৩

পাখিদের পাড়া পড়শী- ১১ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi

 পাখিদের পাড়া পড়শী- ১১

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  


Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi





দ্বিতীয় অধ্যায়, পাখিদের পাড়া- পড়োশী

(১১)

কাকাবাবু এবং সুনন্দের বাড়িতে দেখা করে সৌম‍্যদা বিকেলের দিকে চলে গেল।

কাকাবাবু সৌম্যদার সামনে উদয়শঙ্করের বিষয়ে তারিফ করে বলল–' সম্পর্ক রাখতে জানা, বড়ো ভালো ছেলে।

সুনন্দের মা বলল– ওর সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকে আমাদের কাজকর্মের পরিবর্তন ঘটেছে। পড়াশোনা এবং অন্যান্য কাজকর্মে এদের মতি-গতি একটু বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।

গুয়াহাটিতে দুদিন থেকে সৌম‍্যদা ডিব্রুগড় চলে যাবে। সৌম্যদা যাবার পরে উদয়শঙ্করের ফাঁকা ফাঁকা লাগা মনটা সুনন্দ, নব, কীচকদের উপস্থিতির জন্য কিছুটা হলেও নিজেকে হালকা বলে মনে হচ্ছে। সৌম্যদা যাবার পরে উদয় শঙ্করের দায়িত্ব বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কী দায়িত্ব বেড়েছে সেটা সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না। মাঝেমধ্যে তার মনে হয় সে একটা বেসরকারি সংগঠন গঠন করা ভালো হবে নাকি! তারপরে মনে হয় চাকরি এবং সংগঠন দুটো একসঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসুবিধাজনক হবে। সুনন্দরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের কর্ম ক্ষেত্রে ব্যস্ত। কাকে দায়িত্ব দেওয়া যাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর তার হাতে নেই। তারচেয়ে বরং দুটো প্রকৃতি শিবিরের ব্যবস্থাই করা যাক। এরকম একটা সময়ে সে একদিন বগলস চকে নবজিৎ বর্মনকে দেখতে পেল। কাজিরাঙ্গায় যে দেখা হয়েছিল– সেই নবজিৎ বর্মনকে।

– কোথা থেকে এলে? নাকি কোথাও যাবে?

– গুয়াহাটিতে গিয়েছিলাম। 

– স্কুটি নিয়ে?

– আমি স্কুটি করেই গুয়াহাটিতে যাই। ঠান্ডা-ফান্ডা দেখি না।

এই নবজিৎ বর্মন নবজিৎ বৈশ্য থেকে দেখতে ক্ষীণকায় এবং একটু কালো। উঁচু লম্বা। মুখটা ছোটো।উপরের পার্টির ডান দিকের একটা দাঁত কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। জেকেটের ওপরে একটা উইন্ড চীটার এবং ফুল মাস্কের হেলমেট পরে চালিয়ে আসা স্কুটারটার রং সাদা।

– কেমন আছ? অনেকদিন তোমাকে দেখিনি?

– চলছে।গতানুগতিক। কিন্তু আপনি যে এখানে?

– বক দেখতে এসে আমি আজ কয়েক দিন ধরে এখানে আছি। তবে তোমার সর্প চর্চা কেমন চলছে? উদয়শঙ্কর জিজ্ঞেস করল।

– এখন সাপের শীত-নিদ্রা চলছে। তাই আমারও সর্প চর্চা স্থগিত। আপনি এখানে রয়েছেন অথচ আমি জানতেই পারিনি।

– কীভাবে পারবে? তোমার মোবাইল নাম্বার যে আমার কাছে নেই।

– শিবিরের সময় নিয়েছিলেন না?

– ভুলে গেছি। অবশ্য আমার সিম কার্ডটা করাপ্ট হয়ে গেছে এবং আমি নতুন সিম নিয়েছি। তোমার নাম্বার নিয়ে থাকলেও উড়ে গেছে। যাইহোক অবশেষে তোমার সঙ্গে তো দেখা হল। আমরা ইতিমধ্যে শিবির অনুষ্ঠিত করেছি। সৌম‍্যদাও এসেছিল। তুমি থাকলে কত ভালো হত। কাছে থাকা সত্ত্বেও তোমাকে পেলাম না। যাই হোক এবার তোমার পালা। সাপকে বিষয় হিসেবে রেখে একটা প্রকৃতি শিবির অনুষ্ঠিত করার কথা ভাবছি। বিষয়টা তোমার কেমন লাগছে?

– উদয়দা খুব ভালো হবে। আপনার সঙ্গে কাজ করতে পেলে ভালো লাগবে। আমি তো আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই।

– তোমার মোবাইল নাম্বারটা দাও। তুমি এই কয়েকদিন ফ্রি আছ তো?

– একদম। আপনি তারিখটা জানালেই হল।

– আমি তোমাকে তারিখটা জানিয়ে দেব কিন্তু আমি এখানে কীভাবে, কোথায় আছি দেখার জন্য একবার চলে এসো না কেন?

– আসব না বলে কে বলল উদয়দা!

নবজিৎ একটা কার্ড বের করে উদয়শঙ্করকে দিল। তাতে নবজিতের নাম ,মোবাইল নাম্বার, ইমেইল আইডি ছাড়াও লেখা ছিল–

– সারদা বেকারী?

– হ্যাঁ। আমাদের। নলবাড়িতে প্রায় প্রত্যেকেই জানে। জানে বলে মনে করি। বাড়িয়ে বলছি বলে ভাববেন না। আচ্ছা আপনি এখানে আছেন কোথায়?

–ভাঙরা গোঁহাইর থানটা জান? সেখানে একটা টুরিস্ট লজ আছে। তাতেই।

নবজিৎ উদয় শংকরকে সমর্থন জানিয়ে বলল– দু-একদিনের মধ্যেই আমি আপনার সঙ্গে দেখা করব।

– যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসো। তাহলে আমাদের কাজে এগিয়ে নিতে সুবিধা হবে।

– উদয়দা আমি আগামীকাল আসব। বিকেলের দিকে।

নবজিৎ উদয়শঙ্করের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। উদয়শঙ্করের মনে পুনরায় নতুন একটি প্রকৃতি শিবির অনুষ্ঠিত করার চিন্তা দোলা দিতে লাগল। সে বগলস রোড থেকে হাজো- নলবাড়ি পথে হাঁটতে লাগল। পাকা রাস্তা দিয়ে এক কিলোমিটারের মতো যাওয়ার পরে সে যে চৌরাস্তায় উপস্থিত হল তার নাম কুছিয়ার চক। হয়তো চকটার পাশ দিয়ে যাওয়া খালটার মধ্যে এক সময় যথেষ্ট কুছিয়া মাছ পাওয়া যেত। অথবা একই নামের কোনো মানুষের নামেও চকটির নাম রাখা হয়ে থাকতে পারে। ডান দিকে ঢুকে যাওয়া পথটি দিয়ে এগিয়ে গেলে গঙ্গাপুখুরি পাওয়া যায়। সেই পুকুরের উত্তর পারে পারে হেঁটে গিয়ে বাঁধে ওঠা আলিটার পাশে সুনন্দের ঘর। বর্তমানে উদয়শঙ্করের লক্ষ্য সুনন্দের ঘর। উদ্দেশ্য সুনন্দের সঙ্গে দেখা করে পরবর্তী শিবিরটির ব্যবস্থাপনা করা।

উদয়শঙ্কর সনন্দের বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করায় সে ফটিক চন্দ্র গগৈর ' ভারতের বন্য জন্তু' নামের বইটি পড়ছিল। উদয়শঙ্কর সুনন্দের নাম ধরে ডাকতেই সে হাতে বইটা নিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল।

– কী বই পড়ছ সুনন্দ?

হাতে থাকা বইটি দেখিয়ে সুনন্দ বলল–এটি।

– ভারতবর্ষের বিভিন্ন জীবজন্তুর প্রারম্ভিক জ্ঞান লাভ করার জন্য এটি একটি বহুমূল্যবান বই। তাছাড়া তুমি ইংরেজি ভাষায় রচিত অন্য কয়েকটি বই পড়তে পার। তার ভেতরে সেলিম  আলির–'দ‍্য বুকস অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস', বিবেক মেননের–' ইন্ডিয়ান মেমেলস' ইত্যাদি। সরীসৃপ বিশেষ করে সাপের বিষয়ে জানতে হলে তুমি পড়তে পার – ফিরোজ আহমেদ অভিজিৎ দাস এবং সুশীল কুমার দত্তের রচিত 'উত্তর-পূর্ব ভারতের উভচর এবং সরীসৃপ' নামের গ্রন্থটি। ইংরেজি ভাষায় রচিত স্মিথ সুজানের – স্নেইকস, রেপটাইলস ,এমফিবিয়ানস, ওয়াইটেকারের– কমন ইন্ডিয়ান স্নেইক,সেমইর সিমনের - স্নেইকস ইত্যাদি।

পতঙ্গ বিশেষ করে প্রজাপতির বিষয়ে জানতে হলে তুমি কয়েকটি বই পড়তে পার। বই গুলি অনলাইন বাণিজ্যিক সংস্থায় উপলব্ধ। তাছাড়া গুগলের সার্চ করলে সেখানে তোমার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য বই কিছু পেয়ে যেতে পার। তবে অন্য একটি উদ্দেশ্য নিয়ে এখন তোমার কাছে এসেছি।

– বলুন উদয়দা।

– পুনরায়  একটা প্রকৃতি শিবিরের আয়োজন করতে হবে। এবারের বিষয় হবে সাপ। নবজিৎ বর্মন নামে নলবাড়ির একটি ছেলের সঙ্গে কাজিরাঙ্গার প্রকৃতি শিবিরে দেখা হয়েছিল। ছেলেটির সাপের ওপরে গভীর দখল আছে। অনেকদিন পরে আজ তার সঙ্গে হঠাৎ বগলস চকে  দেখা হয়ে গেল। কথা প্রসঙ্গে প্রকৃতির শিবিরে বিষয়ে বলায় সে সাহায্য করতে সম্মত হল। আমি ভাবলাম তোমার কাছে আসাই ভালো হবে। দিন তারিখ ঠিক করে নিতে হবে।

– খারাপ নয়। এবার বেশি ছেলে-মেয়ে যোগদান করার সম্ভাবনা নেই। গত শিবিরে যারা সাপের বিষয়ে জানতে আগ্রহী বলে জানিয়েছিল, এই শিবিরটা তাদের জন্য করাই ভালো হবে নাকি! মেয়েদের বোধহয় না নেওয়াই ভালো হবে। নিলে তাদের দ্বারা কাজ হবে কি?

সুনন্দ শিবিরটার বিষয়ে উদয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করে জিজ্ঞেস করল।

– মেয়েদেরও নিতে হবে। যদি ইচ্ছুক হয়। সবার জন্য শিবিরে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। আমাদের কাছে ছেলে-মেয়ে যুবক-বৃদ্ধ বলে কোনো কথা থাকবে না। কেবল থাকবে ভালোবাসা আর ভালো না বাসা– কারও কাছে সাপ পছন্দের বিষয় নাও হতে পারে, কারও কাছে উভচর প্রাণী পছন্দের হবে না, এমনকি কারও কারও প্রজাপতিও পছন্দের  না হতে পারে। তাদের শিবিরে যোগ দিতে আমরা বাধ্য করব না। এখন কথা হল গত শিবিরে কারা কারা হাত তুলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, তাদের নামগুলি তুমি বলতে পারবে কি?

– সবার নাম মনে নেই। একে অপরকে জিজ্ঞেস করে বের করা যাবে।

– আমাদের হাতে সময় কম বলে আমরা একটু দৌড়াদৌড়ি করতে চাইছি।

– নবদা, কীচকদেরকেও বলতে হবে। আমি কালকেই তাদের জানিয়ে দেব।

– কাল নবজিৎ বর্মন আসার পরে আমরা তারিখটা ঠিক করব। তারপরে নবজিৎ বৈশ্য, কীচকদের জানালে ভালো হবে নাকি ? মাঝখানে বেশি দিন বিরতি না রেখে পাখির নিরীক্ষণ শিবিরটাও পারলে তার কয়েকদিন পরেই অনুষ্ঠিত করতে হবে ।

– আপনার যাবার সময় হয়ে এসেছে, নয় কি? আমার কাছে সময় কমে এসেছে। হিসেব করে খরচ করতে হচ্ছে। বুঝতেই পারছ।

উদয়শঙ্কর পরের দিন বিকেলে সুনন্দকে ডেকে পাঠাল‐ নবজিতের সঙ্গে কথা বলার সময় তুমি থাকাটাও প্রয়োজন।

পরের দিন নবজিৎ বর্মন এবং সুনন্দ দুজনেই প্রায় একই সময়ে এসে উদয় শঙ্করের কাছে উপস্থিত হল। ওদের আলোচনার মুখ্য বিষয় হল সাপ বিষয়ক প্রকৃতি শিবির দ্রুত এবং সুকলমে আয়োজন করা। অবশেষে তিনজন তারিখ ঠিক করল এই নভেম্বর মাসের কুড়ি তারিখ রবিবার। পুনরায় ২৭ তারিখ অর্থাৎ পরের রবিবার প্রজাপতি বিষয়ক একটি শিবির অনুষ্ঠিত করার কথায় নবজিৎ গুরুত্ব আরোপ করায় উদয়শঙ্কর এবং সুনন্দ হবে বলে জানাল।

আগের প্রকৃতির শিবির অনুষ্ঠিত করার মতো এই দুটি প্রকৃতির শিবিরের জন্য প্রচারের দায়িত্ব নবজিৎ বৈশ্য এবং কীচককে দেবার কথা বলল সুনন্দ। যেহেতু গত শিবিরটিতে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ তাদের মাধ্যমেই হয়েছিল এবং তারা অংশগ্রহণকারীদের রুচি -অভিরুচির কথা ভালোভাবে জানে , তাদের চেনেন তাই এবার ও তারাই দায়িত্ব নিক।

সুনন্দ নবজিৎ বৈশ্য এবং কীচককে সেই দায়িত্বের কথা বলতে যাওয়ায় দুজনেই কোনো ওজর -আপত্তি করল না। বরঞ্চ খুশি হল। কেবল এইবারের শিবিরে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা হবে কুড়িজন করে। নাম পঞ্জীয়নের জন্য এবারও ৫০ টাকা রাখা হোক বলে তাদের দুজনই দেওয়া সিদ্ধান্তকে বহাল রাখা হল।

উদয়শঙ্কর কাকাবাবুকে নতুন প্রকৃতি শিবির দুটির কথা অবগত করায় কাকাবাবু বললেন‐ তোমরা ঘনঘন প্রকৃতি শিবির অনুষ্ঠিত করে ভালোই করছ। এর ফলে ছেলে-মেয়েরা সচেষ্ট থাকবে। বেশি দিনের বিরতি হলে মনে আলস্য এবং বিরক্তির ভাব আসে।

সুনন্দ কাকাবাবুকে বলল – কাকাবাবু ছেলে মেয়েদের প্রত্যেকেরই নেশা আলাদা আলাদা কার কোথায় নেশা আছে, ইন্টারেস্ট আছে আমরা জানিনা। সেই জন্য ওদের সামনে বিষয় গুলি এগিয়ে দিয়েছি। যে যা ভালোবাসে সেভাবে এগিয়ে যাক ।

কীচকের সঙ্গে আলোচনা করার সময় কীচক বলল‐- 

--প্রকৃতি কর্মীর সংখ্যা কুড়িজন এবং অন্যান্য দশজন  ধরলে ত্রিশ জন হবে দুপুরের আহারের জন্য। নবোদয় এবং আমি দেব এবারের শিবিরের দুপুরের আহার। আমি নবদার সঙ্গে কথা বলেছি । তিনি বলেছেন ‐ হবে ।

  গতবার শিবিরের টাকা কিছু বেঁচে গিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম সেই টাকাতেই‐ 

- লাগবেনা সুনন্দ। বেঁচে যাওয়া পয়সা জমা থাকুক। এবারও যদি বেঁচে যায় একসঙ্গে জমা করে রাখার ব্যবস্থা করলে ভালো হবে।

কীচকের সঙ্গে হওয়া আলোচনা কালে সুনন্দ সম্মতি জানাল‐ কিছু পয়সা জমা হওয়া ভালো কথা। আরো নতুন নতুন কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়।

নবজিৎ বৈশ্য, কীচক, জেপিরা অধিক সময় ব্যয় না করে শিবিরের জন্য অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীর সন্ধানে নেমে পড়ল। এইবার তারা যেহেতু নির্বাচিত অংশগ্রহণকারীকে অন্তর্ভুক্ত করবে সেই জন্য সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেনি। গতবার যে কয়েকজন আগ্রহ দেখিয়েছিল তাদের নাম মনে করে তারা তাদের সঙ্গে দেখা করল। কোনো প্রকৃতি কর্মী কীচকদের ইচ্ছাকে বিমুখ করল না। বরঞ্চ অধিক আগ্রহ দেখাল। বলার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্জীয়নের জন্য পঞ্চাশ টাকা বের করে দিল। নবজিৎ বৈশ্যরা উৎসাহিত হল। তারা ভাবল ভাবার চেয়েও  অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা অধিক হবে বলে মনে হচ্ছে। তবুও তারা কুড়িজনের চেয়ে অধিক প্রকৃতি কর্মীকে না নেওয়াটাই বিবেচনা করল।

যথাদিনে যথাসময়ে শিবিরের কাজ আরম্ভ হল। সমস্ত ব্যবস্থাপনা গত শিবিরটা মতো করা হল। কেবল খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল মন্দিরের ভোগ ঘরে।এবারও নিরামিষ আহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেবল আচার পাপড় বড়া ভাজা ইত্যাদি কয়েকটি উপকরণের অতিরিক্ত ব্যবস্থা করেছে নবজিৎ বৈশ্য আর কীচক। সমস্ত ব্যবস্থাপনা সুকলমে এগোচ্ছে। নবজিৎ বর্মন সকালবেলা এসে উপস্থিত হয়েছে। তার হাতে ক্যামেরা, ক্যামেরার স্ট্যান্ড এর উপরেও সাপ ধরার কিছু যন্ত্র । এসেই সে উদয়শঙ্করের সঙ্গে জলাশয়ের পাড়ের বক পাখির অঞ্চলটা দেখতে যেতে চাইল। উদয়শঙ্কর তখন বলল যে আজ গেলে ভালো লাগবে না । দৌড়াদৌড়ি করে চলে আসতে হবে। কুলাবে না। এদিকে ব্যস্ততা তো দেখতেই পাচ্ছিস। নবজিৎ মেনে নিল।

- কাল পরশুর ভেতরে আসব?

- হ্যাঁ আসবে ।এলে কিন্তু একেবারে সকালবেলায় আসবে। শিশির‐কুয়াশা ভেদ করে।

উদয়শঙ্করের বিছানায় নবজিৎ বর্মন সঙ্গে আনার সামগ্রী সমূহ রেখে এদিক ওদিক পায়চারি  করতে লাগল। বয়স বেশি হয়নি যদিও যুবক সুললভ চঞ্চলতা ধীরে ধীরে নবজিৎ বর্মনের বাহ্যিক আচরণ থেকে নাই হতে শুরু করেছে। সম্ভবত সে নিজেকে একজন প্রশিক্ষকের রূপে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছে। তার চলাফেরাতেও সেরকম ভাব ফুটে উঠছে।

শিবিরে অংশগ্রহণ করার জন্য আসা প্রকৃতি কর্মীরা একজন দুজন করে এসে নিজের নিজের আসন গ্রহণ করেছে। নটা বাজতে তখনও কয়েক মিনিট বাকি। শংকর দেখতে পেল সুন্দের বোন জ্যোতিমালার সঙ্গে কাকাবাবুর বৌমা অনামিকাও আসছে। এবার ওদের দুজনকে শিবিরে অংশগ্রহণ করার কথা বলা হয়নি। কেবল কাকাবাবুকে শিবিরটার কথা জানানো হয়েছিল। কাকাবাবু পাঠিয়েছেন না বৌদি নিজেই এসেছেন উদয়শঙ্কর বুঝতে পারল না। সুনন্দ বোনকে দেখে চোখ বড়ো করে এগিয়ে গেল।

– বৌদির সঙ্গে এলাম দাদা। বৌদি সঙ্গে নিয়ে এল।

বৌদির সঙ্গে এসেছে বলে জানতে পেরে সুনন্দ বোনকে কিছু বলল না। শীতে কাবু হয়ে পরা একদল ছেলে মেয়ের মধ্যে ওরা দুজন শিবির আরম্ভ হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইল। উদয়শংকর  শিবিরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করল। এবারের শিবির কে উদ্বোধন করবে আগে ঠিক করা ছিল না বলে কীচকরা ভাবেনি শিবির উদ্বোধনের জন্য কারও প্রয়োজন হতে পারে। উদ্বোধনের জন্য উদয়শঙ্কর থানের পুরোহিত কৈলাস শর্মাকে আমন্ত্রণ জানাল। শিবিরের কাজকর্ম প্রত্যক্ষ করার জন্য উপস্থিত থাকা পুরোহিত শর্মা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। উদয়শংকর হাতটা এগিয়ে মানুষটাকে পুনর্বার অনুরোধ করলেন। কৈলাস শর্মা নিজেকে প্রকৃতিস্থ করে এগিয়ে এলেন।

– যান, যান। এই ধরনের সুযোগ আপনি আর কোথায় পাবেন।

বাপুটি পারলে পুরোহিত শর্মাকে ঠেলে এগিয়ে দেবে যেন মনে হল।

পুরোহিত শর্মা বাপুটিকে ধমকে উঠল– এই ।কী করছিস।

পুরোহিত শর্মা ভক্তিতে গদ গদ হয়ে এগিয়ে এল। একটা সংস্কৃত শ্লোক আউরে তিনি সকলকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করলেন এবং আশীর্বাদ করলেন। সঙ্গে কাকাবাবু শিখিয়ে দেওয়ার মতো শিবির উদ্বোধন করা হল বলে ঘোষণা করলেন ।সৌম্যদারা সাধারণত শিবির উদ্বোধন করার কোনো কার্যসূচী শিবির পরিচালনার মধ্যে রাখেন না । রাখেননি । উদয় শঙ্কর রেখেছে । এই কার্যসূচির মাধ্যমে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে টেনে আনার সুবিধা হয় । অন্যদিকে পুরোহিত শর্মা তাকে অনেক বড়ো সাহায্য করেছেন তাকে আশ্রয় দিয়েছেন । এই ছেলেদের শর্মার প্রশংসা করার নিশ্চয় প্রয়োজন আছে । একইভাবে কাকাবাবুর থেকে লাভ করা উৎসাহের কথা ওরা অস্বীকার করতে পারে না । সেই মানুষটার কাছেও কৃতজ্ঞতা জানানোর প্রয়োজন আছে ।

পুরোহিত শর্মার শুভাশীষ বাণীর পরে উদয়শংকর সবাইকে সম্বোধন করে বলল– তোমরা প্রত্যেকেই গতবারের শিবিরে অংশগ্রহণ করেছিলে? নতুন থাকলে হাত তুলে জানিয়ে দাও, আমরা প্রত্যেকেই নতুন করে আসা সদস্যদের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। একটি মাত্র হাত তুলতে দেখা গেল।

– তোমার নাম ঠিকানা শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি জানাও। বাকি সবার সঙ্গে আমরা আগের শিবিরটাতে পরিচিত হয়েছি। সেই জন্য পরিচয় পর্ব দীর্ঘায়িত করার প্রয়োজন নেই।

–নমস্কার। আমি অরূপ বর্মন। বাড়ি অররায়। স্নাতকোত্তর। বেলতলার একটি ব্যক্তিগত মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি।

নিজের পরিচয় দিয়ে অরূপ আসন গ্রহণ করল।

এবার উদয়শংকর আরম্ভ করল– এক, দুই, তিন– তার মধ্যে সুনন্দ একটি করে কলম এবং খাতা প্রতিজন অংশগ্রহণকারীর হাতে তুলে দিল। গণনা প্রথম সারি থেকে এক দুই তিন আরম্ভ করায় শেষ হল-বাইশে। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে নিজের নিজের ক্রমিক নম্বর জানিয়ে উদয়শঙ্কর নবজিৎ বর্মনকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পরে উদয়শঙ্কর দায়িত্ব অর্পণ করল নবজিতের ওপরে। নবজিৎ দেখতে পেল তার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি কয়েকজন আছে। আপনি বলে সম্বোধন করে আরম্ভ করল।

– প্রথমে আপনাদের একটা প্রশ্ন করি। সাপ বললে আপনারা কী বোঝেন? অর্থাৎ সাপ মানে কী? আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন এটা আবার কোনো প্রশ্ন হল? আপনাদের মধ্যে যারা তর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন, আপনারা জানেন, কোনো একটি বিষয় অধ্যয়ন বা আলোচনা করতে যাওয়ার আগে বিষয়টির সংজ্ঞা সম্পর্কে জেনে নেওয়া উচিত। এখন বলুন সাপের সংজ্ঞা কী?

কে কী বলে! সব সময় দেখা এক ধরনের প্রাণী, অথচ কী বলে জিজ্ঞেস করলে অসুবিধা হয়।

– কিছু বলুন যা জানেন।

নবজিৎ উপস্থিত প্রকৃতি কর্মীদের দিকে একবার সুতীক্ষ্ম দৃষ্টিতে  তাকাল।নেই। কারও কোনো উচ্চবাচ্য নেই। আঙ্গুলের নির্দেশে তুমি বল বা আপনি বলুন বলে জিজ্ঞেস করতেও তার ইচ্ছা করছে না। কে জানে হয়তো খারাপ পেতে পারে।

কাকাবাবুর বৌমা অনামিকার চোখে চোখ পড়ায় নবজিৎ জিজ্ঞেস করল– বৌদি আপনি কিছু বলবেন কি?

বৌদি অনামিকা উঠে দাঁড়াল– ভারতে পাওয়া ছয় ধরনের সরীসৃপের মধ্যে একটি হল সাপ।

নবজিৎ বেশ খানিকটা অবাক হল।

– ও বৌদি আপনি  কেন আগে বলেননি? আপনি বলতে পারবেন বাকি পাঁচ ধরনের সরীসৃপ কি কি?

কাকাবাবুর বৌমা অনামিকা হাতের কর গুণে বলতে শুরু করল– টিকটিকি, গিরগিটি, কাছিম ঘড়িয়াল এবং কুম্ভীর।

উপস্থিত প্রকৃতি কর্মীরা হাততালি দিয়ে অনামিকাকে অভিবাদন জানাল।

উদয়শঙ্কর অবাক হল। কাকাবাবুর বৌমা প্রকৃতির সম্পর্ক তাহলে অধ্যয়ন এবং অভিজ্ঞতা পুষ্ট। তিনি নিজের মনের তাড়নায় নিমন্ত্রণ ছাড়া শিবিরে উপস্থিত হয়েছেন। নিশ্চয় কাকাবাবু তাকে  সমর্থন জানিয়েছেন। উদয়শঙ্করের নিজেকে অনেক সংকীর্ণ মনের বলে অনুভব হল।

– আর কেউ বলবেন নাকি?

– চুঙা আকৃতির এক ধরনের সরীসৃপ।

বেলতলার কোনো একটি মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা অরূপ বর্মন বলল।

– বৌদি আর আপনি– আপনারা দুজনেই শুদ্ধ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় সাপ হল–' এনি অফ নিউমারাস লিম্বলেস স্কেলড রেপটাইলস উইথ এ লং ট্যাপারিং বডি এন্ড উইথ সেলিভারি গ্ল্যান্ডস অফেন মডিফাইড টু প্রোডিউস ভেনম হুইচ ইজ ইনজেক্টটেড থ্রু গ্ৰুভড অর টিউবুলার ফেঙস।' আপনারা প্রয়োজন মনে করলে লিখে নিতে পারেন।

নবজিৎ ধীরে ধীরে একই কথাটা পুনরায় বলে গেল। অংশগ্রহণকারী প্রকৃতিপ্রেমীরা নবজিৎ বলা কথাটা নিজের নিজের নোট বইয়ে লিখে নিল।

– আপনারা যে এখন সাপের বিষয়ে অধ্যয়ন করবেন, সাপের বিষয়ে অধ্যয়ন, গবেষণা ইত্যাদি করা ব্যক্তিকে কী বলে অভিহিত করা হয়? আপনারা কেউ জানেন কি?

নবজিৎ বর্মনের প্রশ্ন শুনে প্রত্যেকেই মৌন।

–অফিডলজিস্ট। আপনারা লিখে নিতে পারেন।

– সাপ দেখতে চুঙা আকৃতির। সমস্ত সাপই দেখতে চুঙাকৃতির। সাপের পা নেই। এসব আমাদের জানা কথা। অবশ্য কিছু সাপের দেহে লুপ্তপ্রায় পায়ের অবশিষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। সাপের চামড়ায় খোসা থাকে আর সাপ বছরে একবার খোলস ছাড়ে। সাপের ফুসফুস একটি। কেবল বোয়া নামের পরিবারের সাপের প্রজাতির দুটি করে ফুসফুস থাকে। সাপের হনূ এত আঠা দিয়ে সংযোজিত যে এটা নিজের চেয়ে বড়ো আকৃতির প্রাণীকে সহজে গিলে ফেলতে পারে। সূঁচলো এবং ভেতরের দিকে বাঁকা সাপের দাঁত শির সংলগ্ন সহযোগী হাড়ের সঙ্গে সংযোজিত। সাপের কান নেই। সাপ বাতাসে ভেসে আসা শব্দ তরঙ্গ শুনতে অপারগ।  কিন্তু মাটির ওপরে স্পন্দিত হওয়া অতি কম কম্পনাঙ্কৰ স্পন্দনকেও অনুভব করতে পারে। সাপের দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর।নড়াচড়া  করতে পারার মতো সাপের চোখের পাতাও নেই। আমরা দেখতে পাই সাপ তার চেরা জিভ লক লক করতে থাকে। সাপের মুখের সামনে রাসায়নিক সংবেদনশীল বা কেমোসেনচুরি অঙ্গ থাকে । এই অঙ্গ লক লক করতে থাকা জিভার সাহায্যে চারপাশের পরিবেশের গতি গোত্রের সংবেদন লাভ করে। সাপের স্বরগহ্বর এবং লেরিংস নেই বলে সাপ শুধুমাত্র হিছহিছ করতে পারে।

সাপের শ্রেণিবিভাজন করতে হলে সাপ রেপটেলিয়া শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। উপশ্রেণি লেপিডছরিয়া। লেপিডছরিয়া উপশ্রেণির দুটো বর্গ আছে। একটি রিঙ্কোশেফালিয়া আর অন্যটি স্কোয়ামাটা। স্কোয়ামাটা বর্গে টিকটিকি, সাপ এবং উভচর প্রাণীরা পড়ে। স্কোয়ামাটা বর্গের উপবর্গ দুটি। তারই একটি সার্পেন্টেছ। সাপ  এই উপবর্গের অন্তর্ভুক্ত। 

নবজিৎ এবার অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীদের দিকে তাকাল। তারপর বলল‐ এসব বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু মনে রাখায় অসুবিধা আছে। এই পর্যন্ত কারও কিছু জিজ্ঞেস করার আছে নাকি?

সবাই মৌন। ইংরেজিতে বলতে হলে পিন ড্রপ সাইলেন্স। এমনকি কেউ শরীর এপাশ ওপাশ করে নি।

- তাহলে আমরা এগোচ্ছি। আসুন এবার আমরা জানতে চেষ্টা করি সাপ কীভাবে বুকে ভর দিয়ে এগিয়ে যায়। সাপ তার শরীরের পেশীর সংকোচন এবং প্রসারণের মাধ্যমে শরীরটাকে এগিয়ে নিতে কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করে। তার মধ্যে ঢেউয়ের মতো এবং সোজা রেখার মতো এগুনো পদ্ধতি দুটো আমরা সাধারণত দেখতে পাই। এভাবে এগুতে সাপকে সাহায্য করে তার পেটের দিকে থাকা খোলস গুলি। এই খোলসগুলিকে সঞ্চালন করে মেরুদন্ডে থাকা মাংসপেশী।

নবজিৎ বালির উপরে এবং গাছের ডালে বেয়েচলা সাপের দুটো রঙিন ছবি অংশগ্রহণকারীদের সামনে তুলে ধরল। ছবি দুটি কাছ থেকে নেওয়া বলে সাপের পেটের খোলস গুলি সঞ্চালনের মুহূর্ত সমূহ স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

সাপের খাদ্য কী? সাপ কী খায়? এই প্রশ্নটি আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করা যায় না এই জন্য যে আপনারা এর উত্তর ভালোভাবেই জানেন। ছোটো সাপেরা পোকামাকড় এবং বড়ো সাপেরা নিজের সাধ্য অনুসারে বড়ো জীবজন্তু পর্যন্ত ভক্ষণ করে। আগেই আপনাদের জানিয়েছি যে সাপের দাঁতগুলি ভেতরের দিকে বাঁকা এই দাঁতগুলি শিকার আয়ত্তে আনার জন্য এবং ধরে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। সাপের দাঁত খাদ্য চিবোনোর জন্য ব্যবহৃত হয়না। যে সমস্ত সাপ তুলনামূলকভাবে বড়ো জন্তু শিকার করে, সেই জন্তুগুলি ভক্ষণ করার জন্য সাপের হনু, মেরুদন্ড এবং ক্রমবর্ধমান ত্বক‐ এই তিনটি অঙ্গ সাহায্য করে। সাপের প্রজাতি ভেদে শিকার করার পদ্ধতিও আলাদা ধরনের। এইসব আপনাদের দেখা কথা। তাই নয় কি!

শিবির অংশগ্রহণকারীরা সমস্বরে বলে‐ হ্যাঁ, তাদের প্রতিক্রিয়ার গুণগুণানি  চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল।

- সাপের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সাপের বিষ। বিষের উপরে ভিত্তি করে সাপকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। বিষাক্ত, বিষহীন এবং অনিষ্টহীন সাপ। বিষাক্ত এবং বিষহীন সাপ আপনারা বুঝতে পেরেছেন । দুই ধরনের সাপ মানুষকে কামড়ায় এবং অনিষ্ট করে। কিন্তু অনিষ্টহীন সাপেরা মানুষকে কামড়ায় না ।

অংশগ্রহণকারীদের মাঝখান থেকে জেপি জিজ্ঞেস করল‐' এই ধরনের সাপ ও আছে?

‐ আছে ।আছে ।মানুষকে না কামড়ানো সাপও আছে। যাইহোক সাপের বিষ হল এক ধরনের লালা এবং বিশেষ ধরনের লালা গ্রন্থিতে সাপের বিষ উৎপন্ন হয়। সাপ কোনো প্রাণীকে কামড়ালে সেই গ্রন্থি থেকে বের হওয়া বিষ, বিষ দাঁত যাকে ইংরেজিতে ফেংস বলে বলা হয়, তার মাধ্যমে প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে। আমাদের প্রথম কাজ হল কোন সাপগুলি বিষাক্ত এবং কোন সাপগুলি অবিষাক্ত‐ সেই সাপগুলি সম্পর্কে ভালোভাবে পরিচিত হওয়া। বিষাক্ত এবং অবিষাক্ত সাপের মধ্যে শারীরিক গঠনের মৌলিক পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ বিষাক্ত সাপের চোখের মনিটা অণ্ডাকৃতি বা ডিমের মতো এবং অবিষাক্ত সাপের গোলাকার। বিষাক্ত সাপের মাথাটা লম্বা এবং অবিষাক্ত সাপের মাথাটা  তুলনামূলকভাবে ছোটো। সাপে  কামড়ানো ক্ষতস্থান থেকে ও সাপ বিষাক্ত না অবিষাক্ত বোঝা যায়। বিষাক্ত সাপে কামড়ানো স্থানে দুটো দাঁত বসানোর স্পষ্ট চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। সাপের বিষয়ে কথা বলতে গেলে অনেক কথাই থাকে। তাই আপনারা জিজ্ঞেস করুন‐ আমি উত্তর দিতে চেষ্টা করব।

‐ দাদা আপনি যে সাপ ধরেন, সাপ ধরার জন্য কি করতে হয়, মানে কি ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়?

ঋতুপর্ণ নামের ছেলেটি মনের মধ্যে জেগে ওঠা প্রশ্নের নিরাময় করার জন্য সম্ভবত উপায় খুঁজছিল। নবজিৎ প্রশ্ন করার সুবিধে দেবার সঙ্গে সঙ্গে সে সুবিধাটা গ্রহণ করল।

‐ প্রথম কথা তুমি সাপ ধরতে চাইছ যে তোমার সাপ ধরার প্রয়োজনীয়তা কি? এই প্রশ্নের উত্তরটা তুমি নিজেকে দিতে পারতে হবে। যদি তোমার প্রশ্নের উত্তরে তুমি সাপকে বিপদ থেকে উদ্ধার অর্থাৎ রেস্কিউ করতে চাইছ তাহলে তুমি সাপ সনাক্তকরণে বিশেষ দক্ষতা  অর্জন করতে হবে। না হলে নিজেই বিপদে পড়ার অবকাশ রয়েছে। বিষধর সাপের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা নিতান্তই প্রয়োজনীয়। বিষহীন সাপ হলে বিনা দ্বিধায় হাত দিয়ে ধরে যেতে পারে। বিষধর বা সনাক্ত করতে না পারা সাপকে ধরার জন্য 'স্নেক ফৰ্ক ' ব্যবহার করা হয়।

নবজিৎ সঙ্গে নিয়ে আসা ফৰ্কটা সবাইকে দেখিয়ে দিল। সঙ্গে সেটি কীভাবে ব্যবহার করা হয় তারও ব্যবহারিক জ্ঞান তাদের দেখিয়ে দিল। একটা সাপকে কীভাবে আলগোছে চেপে ধরা যেতে পারে দেখানোর জন্য সাপ হিসেবে নবজিৎ একটা রশি ব্যবহার করল।

- সাধারণত মানুষ সাপ থেকে যত বিপদে পড়ে তার চেয়ে সাপ মানুষের কাছ থেকে অধিক বিপদে পড়ে। শিকার অথবা আশ্রয় চেয়ে সাপ মানুষের বাসস্থানে প্রবেশ করে। কোনো মানুষের ঘরে ইঁদুর ইত্যাদির উৎপাত বৃদ্ধি পেলে সাপ মানুষকে পরিত্রান করতে এসে নিজেই সংকটের সম্মুখীন হয়। বিপদে পড়া সাপ নিজেকে রক্ষা করার জন্য মানুষকে আক্রমণ করে। তখনই প্রকৃতি কর্মী হিসেবে তোমার দায়িত্ব বেড়ে যায়। যদি তুমি সাপ উদ্ধার করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত কর তাহলে তোমাাকে এই কথা মনে রাখতে হবে যে তুমি উদ্ধার করা সাপটিকে সুরক্ষিত স্থনে ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোমারই। আর কারও মনে কোনো-

–সাপে কামড়ালে কী করতে হয় এই সম্পর্কে একটু বলবেন কি?

তথাগত নামের অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মী একজন জিজ্ঞেস করল।

– অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং আমাদের প্রত্যেকেরই জানা জরুরী কথা। সাপে কামড়ানো মানে আমরা ধরে নিই যে আমাকে বিষধর সাপে দংশন করেছে। সবসময় কথাটা ঠিক নয়। বিষহীন সাপে কামড়ানোর ফলেও মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায়। তার কারণ হল ভুক্তভোগী মানুষটির মানসিক দুর্বলতা। মানসিক দুর্বলতার জন্য সাপে কামড়ানোর পরে মানুষটা অত্যধিক মানুষের চাপের সম্মুখীন হয় এবং ফলে স্ট্রোক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মানুষটি মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাই প্রত্যেকে সামগ্রিকভাবে সাপ সনাক্ত করতে পারলে সাপ এবং মানুষ দুজনের জন্যই মঙ্গল। মানুষ যে সাপ তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিধন করে তার গরিষ্ঠ সংখ্যক বিষহীন সাপ। বিষহীন সাপ বলে জানার পরে কেউ একটি সাপকে হত্যা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে না। যাইহোক, সাপে কামড়ালে আমরা আধুনিক জীবনযাত্রা প্রণালীতে অভ্যস্ত হয়েও যে ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করি সেইসব কোনোমতেই  বিজ্ঞানসম্মত নয়। সাপে কামড়ানোর চিকিৎসা পদ্ধতি জানার আগে আমরা সাপের বিষের বিষয়ে কিছু কথা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। কিছুক্ষণ আগে আপনাদের জানানো হয়েছে সাপের বিষ লালা সদৃশ উৎসেচক এবং বিষের জটিল মিশ্রণ। মিশ্রনের ওপরে নির্ভর করে সাপ দংশন করা প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্র অথবা রক্ত পরিবহনতন্ত্রের কোনো একটি তন্ত্র অথবা দুটি তন্ত্রেই আঘাত হানে। স্নায়ু তন্ত্রে আঘাত হানা বিষকে বলা হয় নিউরটকি আর রক্ত পরিবহনতন্ত্রে আঘাত হানা বিষকে বলা হয় হিম'টকি। শঙ্খচুর, চকরি ফেটি,রজা ফেটি ইত্যাদি সাপের বিষ নিউরটকি এবং এভাবে বিভিন্ন সাপের বিষ হিমটকি । দুই ধরনের বিষের বিক্রিয়ায় প্রায় একই ধরনের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় । তার মধ্যে ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ, ফুলে উঠা, ব্যথা অনুভব করা, বমি বমি ভাব, তন্দ্রালসতা ইত্যাদিই প্রধান। কোনো ব্যক্তিকে সাপে দংশন করলে টেনে চেপে বন্ধা ধরণী বা টারনিকেট ব্যবহার না করে ব্যান্ডেজ বা ক্রেপ ব্যান্ডেজ ব্যবহার করতে পারলে ভালো। চিকিৎসালয়ের দূরত্ব বেশি হলে যদি ধরণী বাঁধার প্রয়োজন হয়, তখন ক্ষত স্থানের কিছুটা উপরে ধরনী বাঁধার সময় হাতের একটা আঙ্গুল  রেখে তার উপরে ধরনী বাঁধতে হয়। ক্ষতস্থান ব্লেড দিয়ে চিরে  দেওয়া ইত্যাদি কখনও দেখতে পাওয়া যায়। এরকম করা অনুচিত। বেজ, কবিরাজ ধন্বন্তরি সাপের বিষ নির্মূল করতে পারেনা একমাত্র এন্টিভেনম বা প্রতিবিষই সাপের বিষকে বিনাশ করতে পারে। তারা বিষহীন সাপের চিকিৎসা করে সাধারণ মানুষকে বিপথে পরিচালিত করে। সেই জন্য পরম্পরাগত চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিহার করে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা অধিক বাস্তবসম্মত। সাধারণ সাবধানতা অবলম্বন করলেই আমরা সর্পদংশন থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি। আশা করি সর্পদংশনের কথা গুলি আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। এই ধরনের আর কোনো প্রশ্ন–

– আমাদের এখানে দেখতে পাওয়া বিষহীন  এবং বিষধর সাপ কোনগুলি?

ব্যক্তিগত খন্ডে কর্মরত নজরুল নামের প্রকৃতি কর্মী একজন নবজিৎকে প্রশ্ন করল।

– এটা একটি প্রয়োজনীয় প্রশ্ন। প্রকৃতি কর্মীর কাছে বিষহীন এবং বিষধর সাপ সনাক্ত করতে পারাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা। সাপের প্রজাতি অনুসারে বিষহীন অথবা বিষধর হয়। একেবারে বিষহীন সাপগুলি হল– খন্তীয়া সাপ, ব্রাহ্মিনী- ব্লাইন্ড স্নেক এবং ডায়ারড'ছ ব্লাইন্ড স্নেক,অজগর, বার্মিজ পাইথন, ঢোড়া সাপ, চেকার্ড কীলবেক, বামুনি সাপ, স্ট্রীপড কীলবেক,মচোয়া গোম, ইন্ডিয়ান রেড স্নেক,নিলাজী গোম, কপার হেডেড ট্রিংকেট স্নেক ,কার্শলা, পেইন্টেড ব্রঞ্জ বেক খুকুরি সাপ , হোয়াইট বেয়ারড খুকরি স্নেক, মারলি সাপ , কমন ওলফ স্নেক ইত্যাদি আমাদের অতি পরিচিত এই সাপগুলি বিষহীন। বিষধর সাপের মধ্যে ভাইপার, পানক, শঙ্খচুর ইত্যাদি প্রধান। ভাইপারের ভেতরে মাউন্টেন পিট ভাইপার, জারডনছ  পিট ভাইপার, হোয়াইট লিপড ভাইপার, ফেটি সাপের ভেতরে মনক্লেড কোবরা, কিং কোবরা, ব্যান্ডেড ক্রেইট ইত্যাদি প্রজাতি অত্যন্ত বিষধর । এছাড়া কিছু সাপ আছে যেগুলির বিষ আছে কিন্তু বিষের মাত্রা এবং তীব্রতা প্রাণঘাতী নয় । তার ভেতরে মেনী সাপ, কমনওয়াটার স্নেক, সুন্দরী সাপ, অরনেট ফ্লায়িং স্নেক, ক্যাট স্নেক ইত্যাদি অন্যতম । সাপ চিনতে পারার পরে প্রকৃতি কর্মীর কাছে বহু কথাই সহজ হয়ে পড়ে । আশা করি আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

নবজিৎ একবার উদয়শঙ্করের দিকে আরেকবার নজরুলের দিকে তাকাল।

–আমরা যে সাধারণত শুনতে পাই সাপ গরুর বাঁট থেকে দুধ খায়–

পুলক জিজ্ঞেস করতে চাওয়া প্রশ্নটা সম্পূর্ণ করতে দিল না নবজিৎ। সে হেসে বলল– সাপ সম্পর্কে আমাদের অনেক অন্ধবিশ্বাস আছে এবং সাপকে নিয়ে আমরা রহস্য ঘন কথা কাহিনি বলতে ভালোবাসি। দুধ সাপের খাদ্য নয়।বাঁট চোষার মতো সাপের মুখে কোনো ব্যবস্থা নেই। বাজিকর বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে সাপ নাচায়। আমরা সেরকমই ভাবি। সাপের যেহেতু বহিঃকর্ণ নেই নাচার জন্য বাঁশির শব্দ শুনবে কীভাবে? একমাত্র ফেটীসাপ ফণা ধরে। বাঁশি না হয়ে সেটা একটা লাঠি হলেও ওভাবেই ফণা মেলবে। আরেকটি অন্ধবিশ্বাস হল সাপের মাথায় মণি থাকে। মনে রাখবে সাপের কোনো মণি নেই। সাপের মনে রাখার কোনো শক্তিও নেই। তাই সাপ প্রতিশোধ নেবার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে কথাটা একেবারে অবাস্তব। মানুষে বলার মতো সাপ লিখে খায় না আত্মরক্ষার জন্য দেখে খায়। পুনরায় মনে রাখার জন্য কথাটা হল মচোয়া গোমের সঙ্গে ফেটী সাপ জোড়া বাঁধে না, দুটো ভিন্ন প্রজাতি। সাপের প্রজননের সময় গামছা দিয়ে পরিবারের আন্তরিক মঙ্গল কামনা অন্ধবিশ্বাস। এই ধরনের অসংখ্য অন্ধ বিশ্বাসের আমরা বলি হই। প্রকৃতি কর্মী হিসেবে আপনারা বিষধর সর্প দংশনে মৃত্যুবরণ করা লোককে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে পরিবেশ দূষিত না করে, তার অন্তিষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য উপদেশ দিন।

নবজিৎ বর্মন কিছুক্ষণের জন্য থামল। দুই একজনের মধ্যে ক্লান্তির ভাব স্পষ্ট। সে বুঝতে পারছে অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীদের ক্লান্তি লাগছে।

–ঠিক আছে, আজ এখানেই শেষ করছি। আপনাদের হয়তো ক্ষুধা পেয়েছে। আগামী বছর অর্থাৎ আগন্তুক গরমের দিনে এরকম একটি শিবির অনুষ্ঠিত করা উচিত হবে যেখানে আমরা হাতে-কলমে সাপের বিষয়ে শিখতে পারব। জঙ্গলে গিয়ে আমরা সাপের মুখোমুখি হব। সাপ কীভাবে সনাক্তকরণ করতে হয়, আমরা ব্যবহারিকভাবে শেখার চেষ্টা করব। সাপের বিষয়ে এখনও আমাদের অনেক কথা জানার আছে। পরবর্তী সময়ে সেই সবের বিষয়ে আলোচনা করা হবে। হবে তো!

ভাবার চেয়ে সাপ বিষয় হিসেবে নেওয়া শিবিরটা তুলনামূলকভাবে বেশি সফল হল বলে ভাবল উদয়শঙ্কররা। নবজিৎকে তারা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল– সাপের বিষয়ে এত সুন্দর করে তুমি আলোকপাত করলে, সাপের বিষয়ে প্রায় প্রতিটি কথাই  সুন্দর করে স্পর্শ করতে পেরেছ। অংশগ্রহণকারীরা উৎসাহিত, আনন্দিত। উদয়শংকর নবজিৎকে সাধুবাদ জানাল।

কী বলবে কিছুই ভেবে না পেয়ে  নবজিৎ হাতে নিয়ে থাকা ফেংকসটা নাড়াচাড়া করে মৃদুভাবে হাসতে থাকল।

অংশগ্রহণকারী কয়েকজন প্রকৃতি কর্মী যাবার সময় প্রজাপতির ওপরে করতে যাওয়া শিবিরটা কবে অনুষ্ঠিত হবে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করল। সুনুন্দরা তাদের পরবর্তী শিবিরের তারিখ ইত্যাদি জানাল। তারা নাকি নিশ্চিত ভাবে  পরবর্তী প্রতিটি শিবিরে অংশগ্রহণ করবেই।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...