সোমবার, ১ মে, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ৩৫ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস

হে আমার স্বদেশ- ৩৫

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস





  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।


(৩৫)

প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকের কলমে 'উষা' প্রকাশ করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পাদক পদ্মনাথ গোহাঞিবরুয়া লিখেছিলেন ,

‘রাজনৈতিক এবং ধর্ম মূলক বিষয় আলোচনার বিচার সীমার বাজ। কেননা এই দুই বিষয়ের সংযোগে থাকা জনগণ এবং ভেতরের জঞ্জাল সাহিত্য সেবায় সমস্যার সৃষ্টি করে । সাহিত্য সেবা একপ্রকার উদাসীন কর্ম তাতে রাজকীয় এবং ধর্ম সম্পর্কীয় জঞ্জালের বিষয়ের যোগ থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয়।… এখানে এটাও বলতে হবে যে পত্রিকা কেবল পত্রিকার নিমিক্ত, এটা সাধারনের মনোবাদের স্থল নয়। কোনো বিষয়ের আলোচনায় সাধারণের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তাকে যুক্তির সাহায্যে মেলানোর চেষ্টা করা উচিত, লেখকের প্রতি প্রথমেই খৰ্গহস্ত হওয়াটা বিধি নয় ।'

এই নীতি নিয়ে কোনো অপায় অমঙ্গল না হয়ে'উষা'চলছিল। লক্ষ্মীনাথ উৎসাহের সঙ্গে প্রতিটি সংখ্যার জন্য প্রবন্ধ লিখে পাঠাচ্ছিলেন।' উষা'র তৃতীয় বছরের তৃতীয় সংখ্যায় তার ‘কৃপাবর বরবরুয়ার প্রত্যাগমন' এর প্রধান প্রবন্ধের পালি প্রবন্ধ 'অ্যাংলো ইন্ডিয়ান' ছাপা হয়ে বের হল। প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু হল অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা।

এদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনটি সর্বভারতীয় এক রূপ ধারণ করেছে। জাতীয় কংগ্রেসের ভেতরে উগ্রবাদী নেতারা স্বরাজের প্রশ্ন উত্থাপন করে ব্রিটিশ সরকারের নীতির তীব্র সমালোচনা করতে শুরু করেছে। সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সশস্ত্র উগ্রবাদীরাও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাচ্ছে। ১৯০৮ সালের ৩ এপ্রিল ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী মজফরপুরের দন্ডাধীশ মিস্টার কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ভুলবশত মিসেস কেনেডি এবং মিস কেনেডি নামের দুই ইংরেজ মহিলাকে হত্যা করে। ১৯০৮ সনে দুই জুন কলকাতার মানিকতলায় বোমা প্রস্তুত করার কারখানার খোঁজ পেয়ে অরবিন্দ ঘোষকে গ্রেফতার করে। তাই ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তারা দেশের খবরের কাগজে প্রকাশিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ গুলিতে ছায়ার মধ্যে বাঘ দেখতে লাগল।ফলে তাদের বিবেচনায়,’উষা’য় প্রকাশিত কৃপাবর বরুয়া লেখা ‘এংলো ইণ্ডিয়ান’নামে ‘সরকার এবং ব্রিটিশ জাতির বিরুদ্ধে জ্বালাময় বিদ্বেষ পোষণ করা’প্রবন্ধটিতে চোখ পড়ল।সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার কঠোর হয়ে পড়ল।এর বিরুদ্ধে উচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।কালবিলম্ব না করে সরকার উক্ত প্রবন্ধের লেখক ,কাগজের সম্পাদক এবং প্রকাশকের ওপরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করল।প্রবন্ধ লেখকের প্রকৃত নাম না থাকায় সম্পাদকের ওপরেই সেই অভিযোগের দায় পড়ল।আর তার সঙ্গে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রকাশক ‘উষা’প্রকাশ করতে পারবে না বলে আদালতে নোটিশ জারি করল।

ক্লাব থেকে এসেই লক্ষ্মীনাথ চিঠিটা পেল।পাশ করে নি যদিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে বিএলের চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসেছিল।তাছাড়া হাওড়ায় বাস করার পর থেকেই সে হাওড়া পাবলিক কোর্টের অনারেরি ম্যাজিস্ট্রেট। এত বছর ধরে এত মামলার বিচার করল,তাই মামলা মোকদ্দমার বিষয়গুলি তাকে খুব একটা বিচলিত করতে পারে না।কিন্তু যখন মনে পড়ল যে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রকাশক ‘উষা’প্রকাশ করতে পারবে না,তখন সে অস্থির হয়ে পড়ল।এতগুলি নতুন-পুরোনো লেখক -কবি প্রবন্ধকারের আত্মার বাণী প্রকাশ করার মাধ্যম,অসমিয়ার স্নেহে ভালোবাসায় গড়ে উঠা সাহিত্য পত্রিকা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে থাকবে? না না,তা হতে পারে না।অসমিয়া ভাষার জন্য অসমিয়া জাতির জন্য ‘উষা’বা ‘উষা’র মতো পত্রিকা একটি চাই।

কিন্তু ‘উষা’র প্রকাশক,সম্পাদক এবং লেখক রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত।

গুরুতর অভিযোগ।

অভিযোগ প্রমাণিত হলে নিশ্চিত কারাবাস।

এখন এই বিপদকে কীভাবে অতিক্রম করা যেতে পারে।

লক্ষ্মীনাথ চিন্তিত হয়ে পড়ল।তাঁর কৃপাবর বর বরুয়া রাষ্ট্রদ্রোহী। কৃপাবর বর বরুয়া তাঁর সৃষ্ট চরিত্র। কৃপাবর বরুয়া তাঁর ‘অলটার ইগো’দ্বিতীয় সত্তা।তাই লক্ষ্মীনাথও রাষ্ট্রদ্রোহী।তবে সে ব্রিটিশ বিরোধী নয়।মাতৃভূমি ব্রিটিশের শাসনাধীন যদিও সে ব্রিটিশ সরকারকে অপছন্দ করে না। কৃপাবর বরবরুয়া ‘এংলো ইণ্ডিয়ান’প্রবন্ধটিতে জাতীয় কংগ্রেসের উগ্রবাদী নেতা অথবা সশস্ত্র বিপ্লবীদের মতো ব্রিটিশ শাসনের উৎখাত চায় নি।তাই সে কীভাবে রাষ্ট্রদ্রোহী হল?না কি নিজের অজান্তে প্রবন্ধটিতে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কিছু লিখেছে?কৃপাবর বরবরুয়া হিসেবে লেখা প্রবন্ধটিতে আসলে কী লিখেছেন ‘উষা’র সেই বিশেষ সংখ্যাটি বের করে লক্ষ্মীনাথ পড়তে শুরু করল।

প্রবন্ধটির শুরুতে এংলো ইণ্ডিয়ান কারা তার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।তারপরেই কৃপাবর বরবরুয়ার শ্লেষাত্মক মন্তব্য,‘….বরবরুয়া এঁদের(এংলো ইণ্ডিয়ানদের)ভারত জম্বূদ্বীপে থাকা বড়ো জাম গাছের জাম খাবার জন্য একত্রিত হওয়া ,এবং জাম খাওয়া শেষ হলে ফুরুৎ করে উড়ে চলে যাওয়া এক ধরনের পাখি বলেছেন...এঁরা লোকের জাম খেয়ে ধ্বংস করে,এবং নিজের নিজের বড়ো বড়ো থলেতে এক থলে করে জাম ভরে নিয়ে নিজের দেশে উড়ে চলে যায়।এই বিদেশি শক্তিশালী পাখিগুলির কলকলানি,পাখার ছটফটানি এবং সূঁচলো ঠোঁটের ভয়ে দেশি পাখপাখালিগুলি জামের কাছাকাছি যেতে পারে না।….’

সঙ্গে বিবর্তনবাদের নিয়মানুসারে ভারতে এসে ইংরেজ কীভাবে এংলো ইণ্ডিয়ান হয়,লক্ষ্মীনাথের মানসপুত্র কৃপাবর তার ব্যাখ্যাও বিদ্রূপের সুরে তুলে ধরেছেন,‘ ... বামুন পতিত হয়ে কখনও চণ্ডাল হয়।গ্রীষ্মের দাবদাহে পুকুরের গরৈ মাছ কোনো কোনো অবস্থার গুণে ক্ষীণ ছোটো হয়ে লম্বা হয়ে ধীরে ধীরে ঢোরা সাপ হয়।এই বিবর্তনবাদের নিয়মানুসারেই -ব্রাইট,গ্ল্যাডস্টোনের দেশের ইংরেজ-অজাতের হয়ে অবস্থার গুণে ক্ষীণ আর সূক্ষ্ম হয়ে এংলো ইণ্ডিয়ান হয়।’

এতটুকু পড়ে লক্ষ্মীনাথ থামল।ড্রয়ার থেকে সিগারেটের টিনটা বের করল।অগ্নিসংযোগ করে সিগারে দীর্ঘ একটা টান মেরে নিজেকে সুস্থির করে আনার পরে বুঝতে পারল,ব্যঙ্গ-শ্লেষে লেখাা কথাগুলি সত্যি হলেও যেভাবে লিখেছে,সেটা এংলো ইণ্ডিয়ান তথা ইংরেজ ভ্রাতৃ্রা মেনে নিতে পারে না।এইসব পড়ে তাঁরা অপমানিত বোধ করবে,উপহাস করা হয়েছে বলে ভাবাটাও অস্বাভাবিক নয়।

তা বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা।লক্ষ্মীনাথ সম্পাদক পদ্মনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ভাবল।কিন্তু তেজপুরে থাকা পদ্মনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা সম্ভব নয়।হেমচন্দ্র গোস্বামীর কথা মনে পড়ল।হেমচন্দ্র এখন গুয়াহাটির চীফ কমিশনার অফিসে সাব-ডেপুটি কালেক্ট্রর।সে বিএ ডিগ্রধারী ছিল না।অনেক বি এ এবং এম এ প্রার্থীর দাবি অগ্রাহ্য করে তাকে কাজে নেওয়ার জন্য জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।কিন্তু তাঁর বিশ্বস্ততা,কর্তব্যনিষ্ঠা এবং দায়িত্বশীলতা দেখে তখনকার প্রতিপত্তিশালী অফিসার অভয়শঙ্কর গুহ যখন যোগ্যজনকে কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করলেন এবং ‘টাইমস অফ আসাম’পত্রিকাও আনন্দ প্রকাশ করে সরকারের প্রসংসা করল,তখন আর কারও কিছু বলার রইল না।এখন ‘উষা’র বিরুদ্ধে গুয়াহাটি কোর্ট থেকে মামলা করা হয়েছে বলে এবং হেমচন্দ্র নিজেও ‘উষা’র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যখন সে এই মামলার সবিশেষ জানবেই।তাই লক্ষ্মীনাথ হেমচন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করবে বলে স্থির করল।

‘এত বড়ো ঘটনা একটা ঘটল।গুয়াহাটিতে থেকে তুমি নিশ্চয় ম্যাজিস্ট্রেট অর্ডার ইস্যু করার দিনই এই ঘটনার বিষয়ে জানতে পেরেছ।অথচ তুমি আমাকে জানালে না!‘ ' রাগ করনা, বেজ। আমি সেদিন গুয়াহাটিতে ছিলাম না। অফিসিয়াল কাজের জন্য চিফ কমিশনার আমাকে শিলং পাঠিয়েছিলেন। আট দিন শিলং থাকতে হল। শিলং থেকে আসার পরের দিন সকালে পদ্ম বরুয়া আমার বাড়িতে এসে হাজির হল। তার কাছ থেকেই ঘটনার সম্পর্কে সবিশেষ জানতে পারলাম।'

'আমার এই প্রবন্ধটির ভাষা ব্রিটিশ অফিসাররা বুঝতে পারবে না। এটা নিয়ে রাজদ্রোহের মামলা করা যেতে পারে বলে ব্রিটিশদের কে বুঝিয়েছে?'

' আছে না ব্রিটিশের তোষামোদ করে সুবিধা নেওয়া এক শ্রেণির অসমিয়া কর্মচারী। তবে বেজ, তোমার কৃপাবর এবার ' এংলো ইন্ডিয়ান 'লেখাটিতে যে ধরনের তীব্র ভাষায় ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছে– এসব তাদের গায়ে জ্বালা ধরাবেই। সরকারি অফিসারদের বড়ো বড়ো সদাগর বলেছ। এক জায়গায় লিখেছ, এদের অনেকেই ভারতীয় নিগারদের বিনা দোষে গুলি করে মারে।এঁরা ভারতের দুঃখী গ্রামীণ মানুষকে পশু পাখি শিকার করার মতো গুলি করে মারতে পারে বলে ভাবে। তারপরে তুমি তোমার কৃপাবরের মুখ দিয়ে' নিজের গায়ের ঘা গুলি ধুয়ে তাতে যদি ঔষধ না দেয় তাহলে সেই ঘা তাদের কাল হবে' বলে অভিশাপ দিয়েছ। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা এসব কীভাবে সহ্য করবে, বলতো?’

' নিজের অজান্তে লেখাটা বড়ো কড়া ডোজের হয়ে গিয়েছে, গোঁসাই।'

এমনিতে ও তোমার লেখার ধার খুব বেশি। তার মধ্যে লিখেছ আবার সাহেবদের নিয়ে‐-।'

' তবে মহামান্য সরকার লেখাটিতে রাজদ্রোহের কী পেয়েছে? উগ্রবাদী কংগ্রেসের নেতাদের মতো প্রবন্ধটির মাধ্যমে আমি তো ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করতে চাইনি। বরঞ্চ প্রবন্ধটির শেষের দিকে ব্রিটিশ সরকার ভারতের উপকার সাধন করেছে, ভারত বর্ষ ইংরেজের কাছে অনেক প্রকারে নির্ভরশীল, ইংরেজ ভারতের মালিক হয়ে থাকুক ইত্যাদি লিখে প্রশংসাই করেছি।'

' হলেও ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সঙ্গে যে তীব্র বিদ্বেষ এবং ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে, এটা তুমি অস্বীকার করতে পারবেনা।'

' আচ্ছা ,এখন উপায়? পদ্ম বরুয়া তোমার সঙ্গে দেখা করেছে। তোমাদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে?'

' তিনি এক ধর্ম সংকটে পড়েছেন। কৃপাবর বর বরুয়ার প্রকৃত নামটা যদি দেওয়া হতো সম্পাদক হিসেবে তিনি হয়তো কিছুটা অবকাশ পেতেন। কিন্তু আত্মসম্মান থাকা দায়িত্বশীল কোনো সম্পাদকেই এই ধরনের কাজ করতে পারেনা। তাই পদ্ম বরুয়া একা একা দায়িত্ব মাথা পেতে নিল। তোমার কৃপাবরের প্রবন্ধ না ছাপালে 'উষা'র উৎকর্ষের ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটে,ছাপলেও সরকার হয়ে পড়ে খর্গহস্ত। অনেক ভেবে চিন্তে পদ্ম বরুয়াকে সঙ্গে নিয়ে গর্ডন স্যারের রেসিডেন্সিতে উপস্থিত হলাম।'

গুয়াহাটির ডেপুটি কমিশনার কর্নেল পি আরটি গর্ডন !'

হ্যাঁ ডিসি গর্ডন । তুমি তো জানোই গর্ডন স্যারের অনুরোধ অনুসারে অসমের চিফ কমিশনার হেনরি কটন স্যার ১৯০০ সনে হেমচন্দ্র বরুয়ার অভিধান 'হেমকোষ'' ছাপানোর জন্য আসাম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন খরচ বহন করেছিল। গৰ্ডন স্যার আমাকে ভার্নাকুলার পার্টটা সম্পাদনা করার দায়িত্ব দিয়েছিল । তখন থেকেই তার সঙ্গে আমার আন্তরিক সম্পর্ক একটা গড়ে উঠেছে । এমনিতেও অ্যাডমিনিস্ট্রেটর যদিও প্রকৃতই একজন সংস্কৃতিবান পুরুষ। ইন ট্রু সেন্স তিনি অসমিয়ার বন্ধু।’

‘বুঝলাম-গর্ডন স্যার এই সমস্যার কথা শুনে কী বললেন সেটা বল।’

‘অনেকক্ষণ আলোচনা করার পরে গর্ডন স্যার উভয় কুল রক্ষা করার জন্য একটা উপায়ের কথা বললেন।’

‘ও হো উপায়টা কি?’

‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ থেকে ‘উষা’কে মুক্তি দিয়ে গর্ডন স্যার ‘উষা’প্রকাশ করার মতো ব্যবস্থা করে দিলেন।’

‘কীভাবে?’

‘সেটা তুমি ‘উষা’র পরবর্তী সংখ্যায় বিস্তারিত পড়তে পারবে।’

অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করার পরে অবশেষে ‘উষা’র পাতায় লক্ষ্মীনাথ ‘কৃপাবর বরবরুয়ার সঙ্গে অমত’শীর্ষক সম্পাদকের অভিমত একটি প্রকাশ পেয়েছে দেখতে পেল।লক্ষ্মীনাথ রুদ্ধশ্বাসে পড়তে লাগল,- ‘তৃ্তীয় ভাগ ‘উষা’র তৃ্তীয় সংখ্যায় (১৮৩০ শকের ভাদ্র মাস) ‘কৃপাবর বরবরূয়ার প্রত্যাগমন’ নামে প্রধান প্রবন্ধের নিচে ‘এংলো ইন্ডিয়ান’নামে একটি পালি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।সেই প্রবন্ধটি সেই নামের আগের রহস্যময় প্রবন্ধের অংশ বলে ভেবেই তাকে ভুলবশত ‘উষা’য় জায়গা দেওয়া হয়েছিল;তাই,ছাপা হওয়ার আগে তার ভেতরের বিষয়বস্তু গভীরভাবে পরীক্ষা করে দেখা হল না।কিন্তু পরে দেখা গেল,সেই প্রবন্ধের মত এবং কথার সঙ্গে আমাদের মত এবং কথা একেবারেই মিলে না।আর আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে,সেই প্রবন্ধ রাজভক্ত অসমিয়া প্রজার মনে বিরক্তি উৎপাদন করেছে।ভুলবশত প্রবন্ধটি আগেই ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা হল না বলে এখন আমাদের মনে অনুতাপ দেখা দিয়েছে।আশা করি,আমাদের রাজা এবং জনগণ অনুগ্রহ করে সেই ত্রুটি মার্জনা করবেন।এর সঙ্গে আমরা সবাইকে জানাই যে এই ধরনের প্রবন্ধ ভবিষ্যতে আর কখনও দেখতে পাবে না।রাজা এবং জনগণের সন্তোষ বিধান করেই সাহিত্যের চর্চা করা ‘উষা’র কর্তব্য;জাতিগত আক্রমণ বা অন্য কোনো প্রকারে কারও মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।সঙ্গে আমরা এটাও জানাই যে এর দ্বারা আমরা ‘কৃপাবর বরবরুয়ার প্রত্যাগমন’প্রবন্ধ ‘উষা’থেকে আমরা উঠিয়ে নিচ্ছি;আমাদের গ্রাহক পাঠকরাও সেই প্রবন্ধ বাদ দিয়ে ‘উষা’পড়বে এবং সেই প্রবন্ধের সঙ্গে ‘উষা’র কোনো সম্বন্ধ নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হল।

শ্রীপদ্মনাথ বরুয়া 

উষা-সম্পাদক।’   

লক্ষ্মীনাথের মাথাটা গরম হয়ে গেল। এটা কি করল পদ্ম বরুয়া? সরকারের সামনে এভাবে দোষ স্বীকার করে নিল? তিনি প্রবন্ধটা' ভ্রমবশত উষায় জায়গা দিয়েছিলেন'! প্রবন্ধটি' রাজভক্ত অসমীয়া প্রজার মনে নিশ্চয়ই বিরক্তি জন্মিয়েছে'! প্রবন্ধটি ছাপানোর জন্য পদ্ম বরুয়ার ' ঘোর অনুতাপ হয়েছে'! তার জন্য সম্পাদক রাজা এবং জনগণের কাছে ত্রুটি মার্জনা করার মিনতি জানিয়েছে! এভাবে কৃপাবর বরুয়ার প্রত্যাগমন এর প্রবন্ধটি 'উষা' থেকে উঠিয়ে নিতে পারল! পদ্ম বরুয়া এই কাজটি কি ব্রিটিশের আনুগত্য লাভ করা হেমচন্দ্র  গোস্বামীর পরামর্শ অনুসারে করেছে, নাকি এভাবে অন্যায় স্বীকার করে প্রবন্ধটি উঠিয়ে নেওয়াটা ব্রিটিশ সরকারের ডিসি গর্ডন সাহেবের আদেশ?... প্রচন্ড ক্রোধ,ক্ষোভ, লজ্জা এবং অপমানে লক্ষ্মীনাথের মাথায় আগুন জলে উঠল। সে আর চেয়ারে বসে থাকতে পারল না। লাফিয়ে উঠে ঘরের ভেতরে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পায়চারি করার পরে পুনরায় টেবিলে মেলে রাখা 'উষা'র দিকে চোখ পড়তেই লক্ষ্মীনাথ একটি কবিতা দেখতে পেল।

ইস বিদেশি ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রতি সম্পাদক পদ্ম বরুয়ার কী নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ! রাজভক্তির  অকৃত্রিম চিহ্ন  প্রদর্শন করে ক্ষমাভিক্ষা করা পদ্ম বরুয়া এই সংখ্যায় নিজের নাম দিয়ে' রাজভক্তি অসমের' শীর্ষক একটি কবিতা ও প্রকাশ করেছে। লক্ষ্মীনাথ এতই উত্তেজিত হল যে কবিতাটির প্রথম অংশ পড়তে  পারল না। শেষের দুই সারি  হল,

'পতিত উদ্ধারী ভূপ ভারত ঈশ্বর,

রাজভক্তি কৃতজ্ঞতা নাও  অসমর।'

সঙ্গে একটি গান ও প্রকাশ করেছে। যার প্রথম সারি হল,

' হৃদয় উপচি যায় কৃতজ্ঞতা ভাবে

ব্রিটিশের আলোতে দুখ নিশা দূরীভূত হয়

কেঁপে উঠে ধনী দীন

স্মরণ করলে মান দিন।'

না, পদ্ম বরুয়া  শেষ করে দিয়েছে! ক্রোধ– উত্তেজনায় লক্ষ্মীনাথের ফেটে পড়ার মতো অবস্থা হল।তাঁর চিৎকার করে করে বলতে ইচ্ছা করল, পদ্ম বরুয়া, তুমি দাসত্বের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছ। এভাবে কেবল নিজেকে নয়, তুমি সমগ্র অসমিয়া জাতিকে অপমান করলে। আমিও ইংরেজের সততা, সাহস, কর্মনিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, সাংস্কৃতিক রুচি ভালোবাসি। আমার মনে হয়, ইংরেজি আমাদের উপকার করেছে। তাবলে ইংরেজ আমাদের জন্য' পতিত উদ্ধারী ভূপ ভারত ঈশ্বর'নয়। আর সমস্ত অসমিয়ার হয়ে তুমি ইংরেজকে এভাবে রাজভক্তি প্রদর্শন করলে কোন অধিকারে?'

লক্ষ্মীনাথের জীবনের পথ সূচল নয়। এন্ট্রান্স পাশ করে কলকাতায় আসার কথা বলতেই পিতৃদেব দীননাথের কাছ থেকে বাধা পেয়েছিল। দাদা গোবিন্দ চন্দ্রের সাহায্যে সেই বাধা অতিক্রম করে কলকাতায় এসেছিল। তারপরে ঠাকুরবাড়ি ব্রাহ্ম কুলতব্য প্রজ্ঞাসুন্দরীকে বিয়ে করতে গিয়ে এতই প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল যে আত্মীয়দের কেউ তার বিয়েতে এল না। পিতা তাকে ত‍্যাজ‍্যপুত্র করেছিল। বিয়ের পরে ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা তাকে বাঙালি করার জন্য বাংলা ভাষায় লেখার জন্য উৎসাহিত করেছিল। সেইসব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে কলকাতায় থেকেই 'জোনাকী' পত্রিকার মাধ্যমে নিজেকে অসমিয়া সাহিত্যের এক অন্যতম সাহিত্যিকরূপে   প্রতিষ্ঠিত করল। আত্মসম্মান-আত্ম মর্যাদা রক্ষার জন্য ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করল। এরকম একটি দুঃসময় অতিক্রম করে ও রোজমেরি লেনে নতুন করে বাড়ি  কিনে ঘর সংসার পাতল। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে 'আসাম বেঙ্গল স্টোর্স' খুলে অসাম থেকে ভাই হরিনাথ কে এনে তাকে ম্যানেজারের দায়িত্ব দিয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে শুরু করেছে। অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আইন পরীক্ষার পরিবর্তিত নিয়মের বিরুদ্ধে করা মামলায় হার স্বীকার করা ছাড়া জীবনের কোনো ক্ষেত্রে লক্ষ্মীনাথ পরাজয় স্বীকার করেনি। কিন্তু আজ সম্পাদক পদ্ম বরুয়া 'উষা'র পাতা থেকে 'এংলো ইন্ডিয়ান 'প্রবন্ধটি উঠিয়ে নিয়ে  তার সঙ্গে চিরদিনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করল।তাঁর লেখক জীবনে এটি একটি মর্মান্তিক আঘাত। সে কীভাবে এই অপমান সহ্য করবে? না লক্ষ্মীনাথ সহ্য করতে পারেনি। নিজেকে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দিতে পারছে না।

লক্ষ্মীনাথ পুনরায় একবার হেমচন্দ্র গোস্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ভাবল। পরে ভাবল, হেমচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলেই পদ্ম বরুয়া 'উষা'র পাতা থেকে তাঁর  প্রবন্ধটা উঠিয়ে নেবার  কথা ঘোষণা করেছে যখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে লাভ হবে না। লক্ষ্মীনাথের  তখন চন্দ্রকুমারের কথা মনে পড়ল ।মাজিউ  থাকলে…।

আদরের মাজিউ এখন তামোলবারি চা বাগিচায় অথবা তেজপুরে।

লক্ষ্মীনাথ বিকেলের দিকে ইন্ডিয়া ক্লাবে যায়। সেখানে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বসে কথা বলে, বিলিয়ার্ড খেলে। এই মন নিয়ে আজ আর ক্লাবে গেল না। নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য অরুণা রত্নার সঙ্গে হাসিঠাট্টা করেও মন থেকে চিন্তাগুলি দূর করতে পারল না ।নিজের পড়ার ঘরে বসে দু পেগ হুইস্কি পান করার পর যে হালকা হালকা নেশা একটা হল তাতে মনটা কিছুটা স্থির হয়ে এল। তারপরে ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠে ছাদে এল।

আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ। গত তিন দিন ধরে ধীরে বৃষ্টি হওয়ার ফলে গরম কিছুটা কমেছে। বাতাসে জলীয় কণা থাকার জন্য আবহাওয়া স‍্যাৎসেতে। আকাশে মেঘের মাঝে মাঝে দুই একটি তারা একটু আধটু আলোক বিতরণ করছে। তখনই পূব দিকের কোনো ঘর থেকে বাঁশির সুর একটা ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের  শৈশবের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।

দুর্গেশ্বরশর্মা মহাশয় দীননাথ বেজবরুয়ার প্রতিবেশী ছিলেন। সরকারি আমলা হয়ে তিনি কুমোরের বিদ্যা জানতেন। দুর্গোৎসবের সময় বাড়ির পুজোর জন্য একমাস আগে থেকে তিনি নিজেই প্রতিমা তৈরি করতেন। কিশোর লক্ষীনাথ তার প্রতিমা তৈরি দেখত। এবং পরম উৎসাহে প্রতিমার জন্য কাঠামো তৈরি, খড় দিয়ে ইত্যাদি কাজে সাহায্য করত। তার জন্য দুর্গেশ্বর লক্ষ্মীনাথকে খুব স্নেহ করত।

একদিন দুর্গেশ্বর কোমর মাটি দিয়ে একটা বাঁশি  তৈরি করে লক্ষীনাথকে দিল এবং কীভাবে ফুটোতে মুখ দিয়ে ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয়, কৌশলটা ও বুঝিয়ে বলল। আনন্দিত মনে লক্ষ্মীনাথ বাঁশিটা হাতে নিয়ে বাজাতে চেষ্টা করল। প্রথমে ব্যর্থ হল। কয়েকবার চেষ্টা করার পরে মুখের ফুঁ দিয়ে আর ফোঁটা গুলির উপরে আংগুল বুলিয়ে সে বাঁশিতে সুর তুলতে সক্ষম হল। আর এভাবে বাজিয়ে কিছুক্ষণ তার মিহি কম্পন ধ্বনিতে দশদিক কাঁপতে লাগল। সঙ্গে তার হৃদয় তন্ত্রীর আনন্দ কম্পনও ততোধিক হয়ে উঠল।

বাল্য স্মৃতি–এই স্মৃতি কত আনন্দের, কত তৃপ্তির, কত প্রাণময়! কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত লক্ষ্মীনাথ ভোগ করে থাকা অপমানের যন্ত্রণা ভুলে গেল।ত়াঁর চেতনায় অন্য একটি ভাব এল। সেই মুহূর্তে সে যেন এক দিব্য শক্তি প্রাপ্ত হল। কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা সাকার হয়ে উঠল। তারপরে সে নিজের মনে ফিসফিস করে উচ্চারণ করল,' আমি নিজেই একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করব। পত্রিকাটির নাম হবে 'বাঁহী'।'

বিকেল তিনটের সময় হেয়ার স্ট্রিটের অফিসে বসে লক্ষ্মীনাথ ব্যবসা সংক্রান্ত একটি চিঠি লিখছে। এই সময় বাইরে বসে থাকা কেরানি সুধন‍্য বসাকের কাছ  থেকে অনুমতি নিয়ে কলেজে পড়া পাঁচজন অসমিয়া ছাত্র ভেতরে প্রবেশ করল। প্রত্যেকেই টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে সবিনয়ে লক্ষ্মীনাথকে নমস্কার জানাল। ইতিপূর্বে তারা লক্ষ্মীনাথের বাড়িতে গিয়েছিল। লক্ষ্মীনাথ মির্জাপুর স্ট্রিটের জুবিলী ইনস্টিটিউটের মেসে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছে।তাঁরা হল ভোলানাথ কাকতি, নীলমণি ফুকন, রোহিণী কুমার চৌধুরী, পূর্ণানন্দ পাঠক এবং যতীন্দ্রনাথ দুয়ারা।

চিঠি লেখা বন্ধ করে লক্ষ্মীনাথ হাসতে হাসতে বলল,'কী হল অসম মাতার বর পুত্ররা, কোনো বিশেষ কাজ?'

সপ্রতিভ রোহিণী বলল,'স‍্যার রবিবার আমাদের মেসে একটি  সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সভাপতি বি সি ফুকন নিজের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন যে অতীতের কলকাতায় অসমিয়া ছাত্ররা- মানে আপনারা 'জোনাকী' বের করে কলকাতা থেকে কাগজটা চালিয়েছিলেন। সভা যোরহাট থেকে পুনরায় ' জোনাকী' বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ক্ষেত্রে ফুকন স‍্যার  সাহায্য করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। নতুন করে প্রকাশ করতে চলা 'জোনাকী'র জন্য একটি কার্য নির্বাহক সমিতি গঠন করা হল। এই সমিতিটির স্থায়ী সভাপতিরূপে সভা সর্বসম্মতিভাবে আপনাকে নির্বাচন করেছে।'

' আমি নতুন করে প্রকাশিত হতে চলা 'জোনাকী'র কার্যনির্বাহক সমিতির সভাপতি!' উচ্ছ্বসিত হয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল ' তোমরা একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে। বসো, বসো ওহে সুধন্য– একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ওরা এসেছে। চা- মিষ্টি নিয়ে এসো–।'

অফিসে এত চেয়ার নেই লক্ষীনাথের টেবিলের সামনের তিনটায় ভোলানাথ রোহিণী এবং নীলমণি বসল। পূর্ণানন্দ এবং যতীন্দ্রনাথ বসল দেওয়ালের সঙ্গে থাকা বেঞ্চটিতে।

' আমি জানি সভাপতি হলাম ।সম্পাদক কে হয়েছে?'

ভোলানাথ কাকতি  বলল,' রোহিণী কুমার চৌধুরী।'

' ছাপা কোথায় হবে?'

' যোরহাটে'।

' হ্যাঁ, যোরহাটে একটি  ভালো প্রেছ স্থাপিত হয়েছে। ছাপার খরচও খুব বেশি নয়।'

' তোমরা কলকাতায় প্রবন্ধ জোগাড় করবে, কলকাতায় সম্পাদনা করবে, তারপরে  সেসব যোরহাটে পাঠাবে, সেখানে ছাপা হয়ে কলকাতা আসবে, তারপর এখান থেকে বিতরণ করবে!'লক্ষ্মীনাথ বলল,’রাখ তোমাদের এসব অবাস্তব কথা-বার্তা।কাগজ বের করতে চাইছ যদি আমাকে তিন মাসের জন্য ছয়টা করে আঠারোটা প্রবন্ধ যোগার করে এনে দাও।আমি বের করব।’

 রোহিণী এবং নীলমণি সমস্বরে বলে উঠল,’আপনি কাগজ বের করবেন!’

 ‘পদ্ম বরুয়া যে ‘উষা’র পাতা থেকে আমার কৃপাবরী লেখাটা তুলে নিয়ে কৃপাবরের সঙ্গে ভবিষ্যতে আর সম্পর্ক রাখবে না বলে জানিয়েছে,জান না?’ 

 ছাত্রদের মুখে ক্ষোভ আর মন খারাপের ছায়া নেমে এল।পূর্ণানন্দ মাথা নেড়ে বলল, ‘ হ্যাঁ স্যার আমরা জানি।এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।তারজন্যই আমরা পুনরায় ‘জোনাকী’বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

 ‘এভাবে প্রবন্ধ উঠিয়ে নেওয়া এবং ভবিষ্যতে আমার কোনো লেখা না ছাপানোর কথা ঘোষণা করা আমার জন্য আমার লেখক সত্তার জন্য মৃত্যুসম।আমি আমার লেখক সত্তার মৃত্যু সহ্য করতে পারব না।তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ,খুব শীঘ্রই এই কলকাতা থেকে নিজের সম্পাদনায় একটা কাগজ বের করব।’

 ‘ভালো কথা।কাগজটার নাম কী হবে স্যার?’

‘বাঁহী’ নাম রাখার কথা ভাবছি।’যতীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথ জিজ্ঞেস করল,’কী হে দিখৌপারের যুবক,নামটা কীরকম হয়েছে?’

শান্ত কিন্তু বিষণ্ণতার ভাব নিয়ে থাকা যতীন্দ্রনাথ হেসে বলল, ‘সুন্দর,বাঁহী বড়ো অর্থবহ নাম।‘


   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...