রবিবার, ২ জুলাই, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ৩৮ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das

হে আমার স্বদেশ- ৩৮

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das





  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

(৩৮)

' জ্ঞান বাবা, অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির প্রতিবাদের প্রতিবাদী প্রবন্ধটার কিছু কথা তোমাকে শোনাচ্ছি।

 ‘প্রতিবাদের প্রতিবাদী প্রবন্ধ!’

 ‘মানে আমি যে ‘প্রাচীন আসামের একটি ঝিলিক’ লিখেছিলাম মহাশয় তার প্রতিবাদে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তার সেই প্রতিবাদের প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা এই প্রবন্ধ। শোনো-

 ‘বিদ্যানিধি মহাশয় লিখিয়াছেন, ‘আমি আসামের ইতিহাস আসামের ভাষা কিছু মাত্র জানিনা।’ আমরা বলি, এ স্থলে তিনি এ কার্যে হস্তক্ষেপ না করিলেই ভালো হইত, কারণ আসামের ইতিহাস ও আসামের ভাষা অন্তত কিছু মাত্র তাহার জানা থাকিলে নিশ্চয় দুই-দশটি হেঁয়ালি হইতে জ্ঞান সঞ্চয় করিয়া একটা মস্ত প্রবন্ধ লিখিয়া অসমীয়া ভাষাকে বাংলা বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে যাইতেন না।’

 মনোযোগের সঙ্গে শুনে জ্ঞানদাভিরাম বলল, বড়িয়া ,আপনি দেখছি প্রথমে অ্যাটাক করেছেন।' 

‘অ্যাাটাক করেই আমাদেরকে  আমাদের ভাষার স্বতন্ত্রতা রক্ষা করতে হবে। কারণ, অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স। তারপরে শোনো–

' প্রাচীন আসামের একটি ঝিলিক’ প্রবন্ধটি বাংলা ও অসমীয়া ভাষার পৃথকত্ব প্রতিপাদন করার জন্য লিখিত হয় নাই তাহার উদ্দেশ্য অন্যপ্রকার ছিল। বাংলা ও অসমীয়া ভাষার পার্থক্য বহুকাল আগেই প্রতিবাদিত হইয়া গিয়েছে, বিদ্যানিধি মহাশয় আসামের বিষয়ে  সত্যিই কিছু জানেন না, নতুবা তিনি শুনিতে পাইতেন যে অসমীয়া ভাষা বিএ  পর্যন্ত পাঠ‍্য হইয়া গিয়াছে, সে ভাষায় ভুরি ভুরি পুস্তক প্রণীত হইয়াছে।

… যাহারা আসামী, বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ভালো রূপে জানেন তাহারা তর্কবিতর্ক করিয়া বহুকাল হইল আসামী ভাষার পৃথকত্বের বিষয়ে মীমাংসা করিয়াছেন। লেখককে( যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি) আমরা সেইগুলি পাঠ করিতে বলি, নতুবা তিনি অন্ধকারে ঢিল নিক্ষেপের ন‍্যায় কতকগুলি অসংলগ্ন কথা বলিলে চলিবে না।

তদুপরি অসমীয়া ভাষা প্রসঙ্গে রেভারেন্ড  মাইলস ব্রনসন তাহার আসামী ইংরেজি অভিধানের ভূমিকায় লিখিয়াছেন,

Now in regard to the supposed identity of Assamese and Bengali ,let it be borne in mind that wherever Hinduism goes ,it takes it's sacred language the Sanskrit ,along with it.In all the dialects of India spoken by Hindus ,the religious and scientific terms are mostly of Sanskrit origin modified more or less by the peculiarities of each dialect. But the grammars of these dialects are different; hence they are distinct languages, not with standing they have many words in common. So in the case before us .Both Assamese and Bengali borrow largely from Sanskrit, but grammars are quite different, as will readily seen by comparing them together. It might as well be said that French and Italian are one language, because both sprung from the Latin, as that Bengali and Assamese are one, because they borrow in common from the Sanskrit.'

তারপরে লক্ষ্মীনাথ থামার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানদাভিরাম উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল,' ব্রনসন  সাহেবের এই উক্তি তুলে ধরার পেছনে বিদ্যানিধি মহাশয়ের আর বলার মতো কী থাকবে?'

' থাকবে। এইসবের প্রতিবাদ জানানোর জন্য বাংলা ভাষার ইতিহাস বের করে পুনরায় অসমিয়া বাংলার উপভাষা বলে প্রচার করা ভুল তথ্যের  প্রতিবাদ করার চেষ্টা করব। তারপরে শোনো,' 

‘লেখক( বিদ্যানিধি) বলিয়াছেন আসামে আসামী, বাংলায় বাংলা, উড়িষ্যায় উড়িয়া, বিহারে বিহারি না থাকিয়া যদি মেশামিশি থাকিত, তাহা হইলে আরও আনন্দের কথা হইত না কি? আসামী ভাষা লোপের চেষ্টা কি ভ্রমের অপকর্ম? উড়িয়ার অক্ষরের প্রভেদ আছে, আসামি বাংলার সে  প্রভেদটুকু নাই।' আমরাও বলি তাহা হইলে তো এক প্রকার আনন্দের কথাই, কিন্তু আরও আনন্দের বিষয় হয় যদি বাঙালিরা বাংলা ভাষা ছাড়িয়া হিন্দি বা উর্দু ভাষা ব্যবহার করেন। হিন্দি ভারতের এক রকম Lingua Franca. ভারতীয় জাতিসমূহকে এক করিয়া  একটি Nation করিবার পক্ষে এক অক্ষর Script দেবনাগরী  এবং এক  ভাষা হিন্দি হওয়াটা কি ভালো নহে? ভারতীয় জাতিদের অগ্রণী বাঙালিরা এইটুকু স্বার্থ ত্যাগ করিয়া দেশের উপকার করেন না কেন? আমরা আসামীরা না হয় পরে তাহাদের অনুসরণ করিব; আর সে পর্যন্ত না হয় আমরা আমাদের ভাষাটা লইয়াই  থাকিব। কি জানেন, নিজের ‍মাতৃভাষাটা বড়ই প্রাণের জিনিস। বাবু চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের  লেখা ' বিদ্যাসাগর' গ্রন্থে মাতৃভাষা সম্পর্কে বিদ্যাসাগর উল্লেখ করা পঙক্তিটি আপনার জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করলাম,

‘জননীর সুকোমল ক্রোড়ে শয়ন করিয়া স্তন্যপান করিতে করিতে মানুষ যে ভাষায় সর্বপ্রথম মা বলিয়া ডাকিতে শিখে, যে ভাষার সরল ও সুমিষ্ট শব্দ গুলি উচ্চারণ করিতে করিতে জিহ্বার প্রথম জড়তা কাটিয়া যায়,যে ভাষায় ক্ষুদ্র জীবনের সুখ দুঃখ প্রকাশ করিয়া শিশুগণ কাঁদিয়া থাকে, যে ভাষায় আনন্দে আত্মহারা বালক বালিকা আপনার জয় ও পরের পরাজয়ের পরিচয় দিয়া থাকে, যে ভাষায় বাল্যকালের ক্রীড়া কৌতুকের মধ্য দিয়া লোকে শিক্ষা গ্রহণ করিয়া থাকে, যে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করিয়া আনন্দে আত্মহারা হয়, যে ভাষায় কাঁদিতে কাঁদিতে মানুষ তাহার হৃদয়ের দ্বার খুলিয়া দেয়, যে ভাষায় আপন দুঃখের কাহিনি বর্ণনা করিয়া অন্তরের তীব্র জ্বলা জুড়াইয়া থাকে, তাহাই মাতৃভাষা।' এমন মাতৃভাষাটা কি সহজে ছাড়িতে পারা যায?'

এতটুকু পর্যন্ত পড়ে লক্ষ্মীনাথ  পুনরায় থামলেন। তারপর সামনের চেয়ারে বসে শুনতে থাকা জ্ঞানদাভিরামের দিকে মাথা তুলে লক্ষ্মীনাথ বলল, পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হল বাংলা সাহিত্যের জনক। এই পন্ডিতের কথায় বিদ্যানিধিকে মাতৃভাষার পাঠ দিলাম। বুঝেছ জ্ঞান, এ হল বিষ দিয়ে বিষের  প্রতিকার করা। কেবল এটাই নয় তারপরে প্রতিবাদ প্রবন্ধটি এভাবে শেষ করলাম–

' পরিশেষে বিদ্যানিধি মহাশয়কে ১৮৯৬ সনে বেঙ্গল লাইব্রেরিয়ান এর রিপোর্টের নিম্নলিখিত ছত্রটি উপহার দিয়ে এই প্রবন্ধের উপসংহার করলাম,

'Assamese is never a dialect of Bengali, and  its  claims to be regarded as a separate language are extremely strong and valid .Since the separation of Assam from the Lieutenant Governor of Bengal, an indomitable movement has been set up in that province which has been for the last few years doing its best to give Assamese a character quite distinct from Bengali and in that noble and plausible attempt they have succeeded beyond all expectations.'

এখন সামগ্রিক ভাবে প্রবন্ধটি কেমন হয়েছে বলতো।'

সপ্রশংস দৃষ্টিতে লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে জ্ঞানদাভিরাম  বলল,' সত্যিই ভালো হয়েছে, দাদু। বিদ্যানিধি মহাশয়কে আপনি আপনার জ্ঞানদীপ্ত যুক্তির বাণে ক্ষতবিক্ষত করেছেন।'

'হুঁ, কত হাতি  গেল তল মশা বলে কত জল!' গর্বের সুরে লক্ষ্মীনাথ বলল,' যে বিষয় নিয়ে স্বয়ং রবি কাকা আমার সঙ্গে বলে না পেরে শেষে পিছিয়ে গিয়েছিলেন, সেই বিষয় নিয়ে একজন অবিদ্যার নিধি অদ্ভুত অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র আমার সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে! আচ্ছা তুমিও লিখবে বলেছিলে না। লিখেছ কি?

'লেখব ,দাদু।'

' আবার লেখ। এতদিন আমরা যুদ্ধ করেছি। এখন এই সমস্ত কথায় তোমরা যুবকরা সক্রিয় হওয়া উচিত।'

' এখনও আমাদের এই অসমিয়া ভাষার স্বতন্ত্রতা নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রে কটকের যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীনেশচন্দ্র সেনের  মতো কিছু অধ্যাপকের বিপরীতে ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জির ভূমিকা প্রশংসনীয়।'

' প্রশংসীয় মানে অসমিয়া ভাষার পৃথক অস্তিত্বের বিদ্যায়তনিক ভিত নির্মাণের ক্ষেত্রে আশুতোষ মুখার্জি স্যার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯০৬ সনে স্যার আশুতোষ মুখার্জি উপাচার্য পদে যোগদান করার পরের বছর কটন কলেজে অসমিয়া এবং বাংলা ভাষা পঠন-পাঠন শুরু হয়। স্যার আশুতোষ কতটা মহান হৃদয়ের ব্যক্তি দেখ, তার নির্দেশে কটন কলেজের তখনকার প্রিন্সিপাল ফেডারিক উইলিয়াম সুদমার্শন অসমিয়া ভাষার উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছিলেন এবং এই কাজে সহায় করেছিল আমাদের হেমচন্দ্র গোঁসাই । আর শোনো, সুদমার্শন সাহেবের মাধ্যমে প্রস্তুত করা নোটস অন দ্য আসামিস ল্যাঙ্গুয়েজ পুস্তিকাটার প্রতিবেদন অনুসারেই স্যার আশুতোষ ১৯০৮ সালে বি এ শ্রেণিতে অসমিয়া ভাষা- সাহিত্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন ।'

যোগেশচন্দ্র নবীনচন্দ্রের মতো সংকীর্ণ মনের অধ্যাপকরা স্যার আশুতোষ মুখার্জির থেকে উদার মনের মানুষ হওয়ার পাঠ নেওয়া উচিত ।'

তারপরে লক্ষ্মীনাথ টেবিলে থাকা ডিবেটা থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালাল। একটাতে হেলান দিয়ে আয়েসের সঙ্গে সিগারেটে টান দিয়ে ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছেড়ে প্রসঙ্গ বদলে বলল,' গুয়াহাটি কমিশনার অফিসে ইএসির অ্যাপয়েন্টমেন্টের পালা। কখন যাবে?'

' ১৯১২ সনের ডিসেম্বরের ভেতরে জয়েন করতে হবে।'

' তুমি চাকরি পাওয়ার আমি খুবই খুশি হয়েছি।'

' হ্যাঁ দাদু দেরিতে হলেও চাকরিটা পেয়ে আমি কিছুটা 'নিরাপত্তা অনুভব করছি।'

' অসমে যেতে লতিকা রাজি হয়েছে কি?

'ঠাকুর বংশের কন্যা। কলকাতা ছেড়ে কোথাও যেতে চায়না। তবে স্বামীর সঙ্গে না গিয়ে উপায় কি?

' তুমি? কলকাতা ছাড়তে তোমার ভালো লাগবে কি?'

' দেখুন দাদু, জন্ম অসমের নগাঁও শহরে হলেও আমার স্কুল কলেজের এডুকেশন এই কলকাতায়।কলকাতার সোসাইটিতে আমার সমস্ত কিছু। এত বছর কলকাতায় থাকার জন্য এখানকার কালচারাল পরিবেশটা আমার মন-মানসিকতাকে গড়ে তুলেছে। কলকাতায় ওয়েস্টার্ন সোশ্যাল, পলিটিক্যাল, ফিলোসফিকেল ঢেউ গুলি দ্রুত আসে এবং এখানকার বাঙালি বৌদ্ধিক সমাজ সেগুলো নিয়ে যেভাবে আলোচনা সমালোচনা করে সেটা অসমে পাওয়া যায় না ।'

' ঠিকই বলেছ জ্ঞান। তুমি উল্লেখ করা কথাটার জন্যই সুযোগ পেয়েও আমি অসমে থেকে সরকারি চাকরি গ্রহণ করলাম না। আমাকে সমালোচনা করে অনেকে বলে যে আমি এমনিতেই কেবল নিজের লেখায় বাঙ্গালিদের খারাপ পাই দেখাই। আসলে আমি বাঙালিদের অপছন্দ করি না। হ‍্যাঁ,কথাটা সেটাই। আমার শিক্ষাগুরু গোস্বামী স্যার, আমার দাদা শ্বশুর ঋষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাকা শ্বশুর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ভায়রা আশুতোষ চৌধুরী, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যবসায়ী সহযোগী অতুল বাবু, উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আদি শিক্ষিত– সাংস্কৃতিবান উদার বাঙালিদের আমি খারাপ পাই না। আর কেনই বা খারাপ পাব? এদের খারাপ পেলে এরা অর্জন করার মানবীয় গুণগুলির ঐশ্বর্য বুঝতে পারব না। এমনিতেও বঙ্গদেশে এই ধরনের বাঙালির সঙ্গে আমি মনেপ্রাণে বাঙালি। তা বলে আমার মাতৃভূমি অসমের বিষয়ে নন-অসমিয়া যদি কোনো খারাপ কথা বলে এবং অনর্থক অসমিয়াদের সঙ্গে বিবাদ করতে চায়, তারা যেই হোক না কেন, আমি তাদের বিরুদ্ধে আমার সর্বশক্তি প্রয়োগ করব।'

' সেটা আপনি করে চলেছেন।' জ্ঞানদাভিরাম বলল,' অন্যদিকে, আমাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী অসমিয়াদেরও বুঝতে হবে, আজকের বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালি মনীষাকে শ্রদ্ধা করতে হবে।'

' উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মন খুব সংকীর্ণ হয়। সংকীর্ণমনা অসমিয়া খারাপ পেল অকপটে স্বীকার করছি, বাঙালি মনীষা থেকে আমি নিজেকে সমৃদ্ধ করি। সাংস্কৃতিক চেতনা থাকা বাঙালির সঙ্গে কথা বলে মানসিকভাবে তৃপ্ত হই। তার জন্যই আমি কলকাতা ছেড়ে বেশি দিন বাইরে থাকতে পারিনা।'

' এই একই কারণে বাবা অসম ছেড়ে শেষ জীবনটা কলকাতায় কাটাল নাকি?'

' তোমার বাবার কথাটা একটু আলাদা ছিল, জ্ঞান। তোমার মা, বিষ্ণুপ্রিয়া ছিল অকাল বিধবা। তাকে বিয়ে করার জন্য তোমাদের বাড়ির প্রত্যেকেই তোমার বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল। তখনকার রক্ষণশীল অসমিয়া সমাজও তাকে অশেষ গঞ্জনা দিয়েছিল। তার জন্যই তিনি ব্রাহ্ম হয়েছিলেন এবং চাকরির সময়কালীন অসমে থেকে তারপরে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তাছাড়া তোমাদের সুশিক্ষা দেবার জন্য ও কলকাতায় থাকাটা আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে, তখন তিনি থাকার জন্য আমরা কলকাতায় পড়তে আসা অসমিয়া ছাত্ররা খুবই উপকৃত হয়েছিলাম। কলকাতায় থেকে 

অসমিয়া ভাষা সাহিত্য বিকাশের জন্য কাজ করায় তাঁর শলা-পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। আর তুমি তো জানই,' জোনাকী' প্রকাশ করার সময় তিনি আমাদের অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।'

' দাদু, লরেলস কিনে হাজার হাজার টাকা খরচ করে মেরামতি করালেন, ওপরের মহলটা সুন্দর করে সাজালেন। আপনি বোধহয় কলকাতায় স্থায়ীভাবে থাকার কথা ভাবছেন?'

' বলতে পারছি না।'

'কেন?'

' আমার ব্যাবসার অবস্থা ভালো নয়। ক্যাপিটাল শর্ট হয়ে এসেছে। ক্যাপিটাল জোগাড় করার জন্য বাড়িটা বন্ধকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই বিজনেসে সাফল্য লাভ করতে না পারলে ভাগ্য আমাকে কোন দিকে টেনে নিয়ে যায়?'

কথা বলতে বলতে লক্ষ্মীনাথ সিগারেটে টান দিতে ভুলে গিয়েছিল। আগুন নিভে যেতে দেখে সিগারেটে পুনরায় অগ্নিসংযোগ করে লক্ষ্মীনাথ বলল' যাইহোক না কেন, তুমি তো অসমের জাতীয় জীবনে অনন্য সাধারণ অবদান রেখে যাওয়া হলিরাম, আনন্দরাম, গুণাভিরাম বরুয়ার বংশধর। সরকারি চাকরি করেও তারা যেভাবে দেশ জাতির সেবা করে গেছেন, তুমিও নিশ্চয় সেই ধারাটা রক্ষা করবে।'

' এসব কথা আপনি আমাকে আগেই বলেছিলেন।'

' হ‍্যাঁ, বলেছিলাম। পরেও বলব। আবার বলছি তুমি লেখালেখি শুরু কর।'

' আমি আমার সাধ্য অনুসারে চেষ্টা করে চলেছি।'

' অবশ্য এতদিন 'বাঁহী'র পাতায় ধারাবাহিকভাবে তোমার 'বিলাতের কথা' বেরিয়েছে। লেখাটা মনোগ্রাহী হয়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনুভবের পরিবেশ এবং বিলাতের শিক্ষা সংস্কৃতির কথা বর্ণনা করে লিখেছ। পাঠকদের জন্য বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মের জন্য লেখাটা খুবই উপযোগী হয়েছে। তোমার কাছ থেকে এই ধরনের লেখা আরও আশা করছি।'

প্রজ্ঞার সঙ্গে আলোচনা করে ১৯১২ সনের কুড়ি সেপ্টেম্বর তারিখে ২২ রোজমেরি লেনের বাড়িটা( লরেলস) ১০ হাজার টাকায় বন্ধক দেওয়ার চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হল। চুক্তি অনুসারে প্রতিমাসে ১০০০ টাকা কিস্তি ছাড়াও ১০০ টাকা সুদ পরিশোধ করতে হবে। প্রথমটা কিস্তি এবং সুদের টাকা বাদ দিয়ে বাকি টাকাটি চেক নিয়ে ব্যাংকে জমা দিয়ে লক্ষ্মীনাথ নতুন করে ব্যবসা আরম্ভ করল।

লক্ষ্মীনাথের আর্থিক দুরবস্থা দেখে বন্ধুবর চন্দ্রকুমার চা পাতা বিক্রির এজেন্সি দিল। তার জন্য কমিশন হিসেবে উপার্জনের একটা উপায় তৈরি হল। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেই উপার্জন নিতান্তই সামান্য। লক্ষ্মীনাথ তখন সিটি অফ গ্লাসগো ইন্সুরেন্স কোম্পানির এজেন্সি নিল। জ্ঞানদাভিরামকে ৭৫০০ টাকার জীবন বীমা করিয়ে ৭৫ টাকা কমিশন পেল। চাকরিটা লক্ষ্মীনাথের রুচি এবং ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খাপ খেল না। তারপরে উপার্জনের উপায়ের খোঁজে লক্ষ্মীনাথ 'জয়ন্তী' নামে মাথায় মাখার এক ধরনের তেল বের করল। তেলের উপকারিতা বর্ণনা করে আমি বিখ্যাত ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি দিয়ে অসমিয়া বাংলা এবং ইংরেজি কাগজে বিজ্ঞাপন দিল।' জয়ন্তী' তেল কিছুদিন ভালোই চলল। কিন্তু তেলটাকে  জনপ্রিয় করে তুলতে হলে দোকানে দোকানে ঘুরতে হবে, বিতরণ ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য একটি মানুষকে নিয়োগ করতে হবে–সুপরিকল্পিতভাবে সেসব করতে না পারায় তেলের চাহিদা বাড়ল না। ফলস্বরূপ 'জয়ন্তী' তেল উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ করা টাকার পুরোটা ফেরৎ পেল না।

তবু লক্ষ্মীনাথ সংসার চালানোর খরচ কমায় না। বিএ পাশ করার পর সরকার হাকিমের চাকরি দিতে চেয়েছিল, চাকরিতে যোগদান করলে এতদিনে সে উচ্চ পদ অধিকার করতে পারত। উচ্চ হারে বেতন পেত। সরকারি বাসস্থানে থাকতে পারত। সরকারই চাকর বাকরের খরচ যোগাত। স্বাধীনচেতা মনোভাবের জন্য সরকারের অধীনে কাজ করল না। তার জন্যই আজ তার এই পরিণতি নাকি? পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে লক্ষ্মীনাথ ভাবতে বাধ্য হল, বাবা এবং দাদাদের কথা শুনে তখন সরকারি চাকরিতে যোগদান না করাটা তার জীবনের একটা বড়ো ভুল হয়েছে।

সংকটজনক আর্থিক পরিস্থিতি লক্ষ্মীনাথকে এভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। এসব চিন্তা তাকে বিব্রত করে, অস্থির করে। তবে কাউকে বলে না। আর্থিক অনিশ্চয়তার কথা বলে দুঃখ, মন খারাপে কষ্ট পাচ্ছে বলেনা। সে নিজের লেখায় মনোযোগী হয়।'বাঁহী' সম্পাদনায় নিজেকে মগ্ন রেখে আর্থিক সংকটের কথা ভুলে থাকতে চেষ্টা করে ।

'বাঁহী' সম্পাদনা এবং 'বা 'বাঁহী'র জন্য লেখা ছাড়া লক্ষ্মীনাথ নিজের সৃষ্টিতে অধিক সময় দেবার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হল। তার জন্যই সে নাটক নিয়ে চিন্তাভাবনা আরম্ভ করল।শৈশবে লখিমপুরে থাকার সময় কমলাবাড়ির ক্ষেত্রে ভক্তরা মঞ্চস্থ করা ‘জরাসন্ধ বধ’ এবং ‘নৃসিংহযাত্রা’ দেখে লক্ষ্মীনাথ এতটাই অভিভূত হয়েছিল যে অনেকদিন পর্যন্ত রচনা বলে বেড়াত। তারপরে কলকাতা এসে স্টার ন্যাশনাল এবং বেঙ্গল থিয়েটার প্রায় কোনো  কোনোদিন সারারাত থিয়েটার দেখত। নতুন নাটক মঞ্চস্থ হলে এত ব্যস্ততার মধ্যে এখনও নাটক উপভোগ না করে থাকে না। এভাবে তার মনে একটা নাট্যচিন্তা গড়ে উঠেছে।

ছাত্র অবস্থায় লক্ষ্মীনাথ ‘হ্যামলেট’ এবং ‘কমেডি অফ এরর্স' অনুবাদ করতে শুরু করেছিল। বিয়ের পরে ঠাকুরবাড়িতে থাকার সময় সংগীত শিল্পী এবং সু-অভিনেতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে নাটকের অভিনয়, মঞ্চসজ্জা, আবহসংগীত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করত। রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ দস্যু রত্নাকর ভূমিকায় অভিনয় করে লক্ষ্মীনাথ দর্শকদের ভূয়ষী প্রশংসা লাভ করেছিল। নাট্যকার হিসেবে তার প্রথম প্রচেষ্টা প্রহসন'লিটিকা'। 'জোনাকী'তে খন্ড খন্ড ভাবে প্রকাশ পাওয়ার পরে সেটি বইয়ের আকারে প্রকাশ পেয়েছে(১৯০১ সনে)। লক্ষ্মীনাথ পুনরায় প্রহসন লিখতে শুরু করল।

সংঘাত মুক্ত ঘটনা, চরিত্র গুলির অসংগতিপূর্ণ কার্যকলাপ এবং পরিস্থিতি প্রধান দৃশ্যের সৃষ্টি রসাল এবং সজীব মনের অধিকারী, লক্ষ্মীনাথের প্রচেষ্টা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলল উদ্ভট পরিস্থিতিতে জধা  মূর্খ সাত ভাই দাদার অস্বাভাবিক কার্যকলাপের শেষে পাঠককে আমোদ দান করার লিটিকা লেখার ২৩ বছর পরে লক্ষ্মীনাথ লিখলেন ‘ধর্মাই পাচনির অতিথি পরায়ণতা’ এবং তার স্ত্রীর অতিথি বিমুখতার  প্রতিযোগী মনোভাব এবং তার জন্য হাস্যোদ্দীপক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা'পাচনি'(১৯১৩সনে)। পাঁচটি ছেলের মৃত্যুর পরে স্ত্রীর কথা অনুসারে স্বামী সত্রাধিকারের কাছে গিয়ে জন্মানো ষষ্ঠ ছেলেটির জন্য একটি নাম পছন্দ করে দিতে বলায়'নোমল' এর জায়গায় 'নেমেল' নাম ছেলের জন্য ভার বেঁধে আনা– এটাই নোমল  প্রহসনের কাহিনি ভাগ। শেষেরটা হল দুই দক্ষ চোরের চৌর্য ক্রিয়ার কৌতুক পূর্ণ কৌশল এবং ওদের বিচারের নামে বিচার বিভাগের দুর্নীতি পরায়ণতা বিষয় নিয়ে 'চিকরপতি নিকরপতি'। একই বছরে লিখে লক্ষ্মীনাথ তিনটি প্রহসন বইয়ের আকারে প্রকাশ করল। এদিকে এই বছরের শুরুতে দ্বিতীয় গল্প সংকলন 'জোনবিরি' প্রকাশিত হল। তাছাড়া ইতিমধ্যে তিনি আর ও দুটি গল্প লিখেছেন। সেইসব গল্প সংকলিত করে 'ককা দেউতা আরু নাতি লরা' নাম দিয়ে প্রকাশ করবেন বলে ভাবলেন।

' যাদু বাপু, খবরটা কত বড়ো, কত গুরুত্বপূর্ণ অনুমান করতে পারছ কি?’

'বড়ো মানে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জন্য এটা একটি যুগান্তকারী খবর। ব্রিটিশ রাজশক্তি বোধ হয় স্বপ্নেও ভাবেনি যে তাদের শাসনের অধীন ভারতবর্ষের একজন কবি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হবে।'

' সত্যিই আর নাই নাই নয়। আমাদের অনেক কিছু আছে। ভারত ভূমি কেবল বিশ্বজনীন আধ্যাত্মিকতার বাণীতে ঐশ্বর্যশালী নয়। আমাদের চতুর্বেদ আছে আমাদের রামায়ণ এবং মহাভারতের মতো দুটি মহাকাব্য আছে আমাদের জাতির জন্য গীতার মতো মহাগ্রন্থ রয়েছে। আমাদের উপনিষদের শাশ্বত ভাবরসে সমৃদ্ধ সাহিত্যই যে অশান্ত বিশ্বের মানুষকে প্রশান্তির বাণী শোনাতে পারে রবি কাকা, সেটা প্রমাণ করেছেন। যদু, ভারতীয় হয়ে আমি গর্বিত। একজন কবি বৈবাহিক সূত্রে আমার আত্মীয়, তার জন্য খুব ভালো লাগছে। খবরটা শুনেই আমি জোড়াসাঁকো গিয়েছিলাম। খুশি আনন্দে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি এখন আনন্দে উৎফুল্ল। কিন্তু রবি কাকা সেখানে নেই। এখন তিনি থাকেন শান্তিনিকেতনে। কলকাতার মানুষ দলে দলে শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে–।'

' কাকাবাবু, আমিও আনন্দিত হয়েছি ,ভারতীয় হিসেবে আমিও গৌরব অনুভব করছি। তবে এটা কীভাবে হতে পারল বলুন তো?'

উৎসাহিত হয়ে লক্ষ্মীনাথ বলতে শুরু করল, রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি প্রকাশ করেছিলেন ১৯১০ সনে। ব্রিটিশ কবি ইয়েটস এবং গল্পকার এজরা পাউন্ডের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ নিজেই গীতাঞ্জলি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং এই অনুবাদ এই বছর মানে ১৯১৩ সনের মার্চ মাসে শিকাগোর পোয়েট্রি  কাগজে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার পরেই কবি-সাহিত্যিক মহলে আলোড়নয়ের সৃষ্টি হয়। ন্যাশন পত্রিকা ইউনিয়ন অফ দা ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট সমিতি এবং ইন্ডিয়া সোসাইটি কবিকে অভিনন্দন জানায়। এই সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন এবং বক্তা ছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক এবং সাহিত্যিক রোদেন স্টাইন। এই সভাতেই গীতাঞ্জলির অনুবাদ'সঙস অফ অফারিং' গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রোদেনস্টাইন গীতাঞ্জলির কপি সুইডিস নোবেল কমিটি অন্যতম সদস্য স্টপফোর্ড ব্রুকের কাছে পাঠিয়ে দেন। তারপরে নোবেল কমিটির মূল ব্যক্তি প্রাচ্য তত্ত্ববিদ কবি হের্ণার হাইজেনস্টাইন বইটির উচ্চ প্রশংসা করে পুরস্কারের জন্য অনুমোদন জানান এবং নোবেল কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সেই অনুমোদন গ্রহণ করে।

১৯১৩ সনের নভেম্বরে ঘোষিত পরাধীন ভারতবর্ষের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভারতবর্ষের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত রবীন্দ্রনাথ প্রথম এশিয়াবাসী। রবীন্দ্রনাথ হয়ে পড়লেন পরাধীন ভারতবর্ষের আত্মসম্মান এবং সৃজনশীল প্রেরণার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এতখানি বলে উচ্ছ্বাস আনন্দ প্রকাশ করেই লক্ষ্মীনাথ শান্ত হলেন না। গুণগুণ করে গীতাঞ্জলির একটি গীত আবৃত্তি করতে লাগলেন-

'সীমার মাঝে, অসীম, তুমি  বাজাও আপন সুর।

আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।

কত বর্ণে কত গন্ধে, কত গানে কত ছন্দে,

অরূপ, তোমার রূপের লীলায় জাগে- হৃদয়-পুর-

আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।।'

জীবন দেবতার মহিমাময় এই গীতের অপার আনন্দে বিভোর লক্ষ্মীনাথ কিছুক্ষণ মগ্ন বিভোর হয়ে রইল। তারপরেই সে চিন্তিত হয়ে পড়ল।

'কী হল, কাকাবাবু? আপনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন!'

' যদু বাপু–।' মাথা তুলে যতীন্দ্রনাথের  দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' রবি কাকা বাংলা ভাষা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলা সাহিত্য অনেক এগিয়ে গেল।'

তারপরেই লক্ষ্মীনাথ নিজের সৃষ্ট সাহিত্যের কথা ভাবল। রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করা কবিতা, গীত, নাটক, গল্প উপন্যাস, প্রবন্ধের সঙ্গে নিজের কবিতা গল্প, প্রহসন, জীবনী গ্রন্থ, কৃপাবরী প্রবন্ধের তুলনা করল।নেই, সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ বিচরণ করার ক্ষেত্র লক্ষ্মীনাথের চেয়ে বিশাল, বেশি বৈচিত্র্যময়, মননশীলতায় বেশি গভীর। এদিকে ভাষার আলংকারিক মান, কবিতার ছন্দের ব্যঞ্জনা, ভাবের বিশালতা…নেই, লক্ষ্মীনাথ আর ভাবতে পারল না। তার অন্তরের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। 

অনেকক্ষণ চুপ দেখে যতীন্দ্ৰনাথ  বলে উঠল,' কাকাবাবু আপনার যেন  খারাপ লাগছে।'

' হ্যাঁ যদু, আমার খারাপ লাগছে।' লক্ষ্মীনাথ বলল, 'খারাপ লাগছে নিজের কথা ভেবে। বুঝেছ, চেষ্টা করছি যদিও আমরা অনেক পেছনে পড়ে আছি। অনেক দিক থেকে আমাদের আজকের সাহিত্য অনুন্নত হয়ে আছে। তুমি কবিতা লেখ, তোমাকে আর ও ভালো কবিতা লিখতে হবে। তার জন্য রবি কাকার কবিতা পড়। পড়ে বোঝার চেষ্টা কর। তিনি কীভাবে কবিতার কথা ভাবেন, কীভাবে কী আদর্শ নিয়ে কবিতা লেখেন। তা বলে আমি তাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে বলছি না। তাঁর কাব্যিক কলাকৌশল গুলি বুঝে নিয়ে সুখ দুঃখ আবেগ অনুভূতিতে আমাদের ভাষায় কবিতা ফুটিয়ে তোল।'

ইতিমধ্যে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কাছে ব্রিটিশ সরকারকে নতি স্বীকার করতে হল। ১৯১১ সনের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ লর্ড কার্জন প্রণয়ন করা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন রদ করলেন। সেদিন কলকাতা তথা বঙ্গে বিজয় উৎসব পালন করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেও সমগ্র বঙ্গে এরকমই আনন্দ উৎসব আরম্ভ হল। অথচ এই সম্মান পেয়ে রবীন্দ্রনাথ এতটা উচ্ছ্বসিত হল না। খবরটা পাবার পরে কলকাতা থেকে বিশেষ একটি রেলে শান্তিনিকেতনে গিয়ে গুণমুগ্ধরা যখন কবিকে অভিনন্দন জানাল, তখন তিনি বললেন যে নোবেল প্রাইজের দ্বারা কোনো রচনা গুণ বা রসবৃদ্ধি হয় না। এদিকে শান্তিনিকেতন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ তখন প্রচন্ড অর্থ- সংকটে ভুগছিলেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে তিনি বলেছিলেন,' টাকার অভাবে শান্তিনিকেতনের নর্দমার কাজটা বন্ধ হয়ে আছে। এবার কাজটা হবে।'

কবিকে সম্মান জানানোর জন্য লক্ষ্মীনাথেরও কিছু একটা করতে ইচ্ছা হল।কী করা যায়?কী করলে তাকে যথার্থ সম্মান জানানো হবে? অবশেষে ভালো একটা সুযোগ এল।

ক্রিসমাস বা বড়োদিন উপলক্ষে রেল কোম্পানি এবারও ভাড়া রেহাই দিয়েছে। পরিবারের সঙ্গে শাহজাহানপুরে যাবার জন্য লক্ষ্মীনাথ রেলের টিকেট কাটল। ১৯১৪ সনের ২১ জানুয়ারি শাহজাহানপুর পৌছাল। সেখানে মিসেস জালাপ্রসাদ  এবং এন মুখার্জি তাদের স্টেশন থেকে আদর করে নিয়ে গিয়ে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করল। রবীন্দ্রনাথের 'বাল্মিকী প্রতিভা' নাটকটা মঞ্চস্থ করার জন্য অনুরোধ করল।

সবাইকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ শাজাহানপুরে ১৫-২০ দিন থাকবে। তাই অভিনেতা নির্বাচন করে এই কয়েকটি দিন আখড়া দিয়ে নাটকটা অনায়াসে মঞ্চস্থ করতে পারবে।

লক্ষ্মীনাথ 'বাল্মিকী প্রতিভার' মঞ্চায়নের সঙ্গে জড়িত হওয়াটা এই প্রথম নয়। বিয়ের পরে জোড়াসাঁকোতে থাকার সময় ঠাকুরবাড়িতে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ায় লক্ষ্মীনাথ মঞ্চ সজ্জার  দায়িত্বে ছিলেন। তারপরে ১৯১২ সনের ২২ মার্চ অনারেবল জাস্টিস আশুতোষ চৌধুরীর( লক্ষ্মীনাথের ভায়রা) বাড়িতে নাটকটি মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। লক্ষ্মীনাথ তখন পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছিল। লক্ষীনাথের নির্দেশে ব্যারিস্টার এট ল জ্ঞানদাভিরাম বরুয়া ডাকাতের সর্দার এবং অরুণা রত্না বনদেবীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। জ্ঞানদা ভিরামের অভিনয় এত উপভোগ্য হয়েছিল যে উপস্থিত দর্শকরা  মুক্তকণ্ঠে তাকে প্রশংসা করেছিল। দর্শকদের ভেতরে বড়লাট হার্ডিং এবং তার পত্নী লেডি হার্ডিং জ্ঞানদাভিরামের অভিনয়ে এতটাই প্রসন্ন হয়েছিলেন যে কে সেই অভিনেতা, জজ চৌধুরীর পত্নী প্রতিভা দেবীর( প্রজ্ঞার দিদি) থেকে জেনে নিয়েছিলেন। তারপরে জ্ঞানদাভিরামের অভিনয়ের কথা 'এম্পায়ার' কাগজেও প্রকাশিত হয়েছিল।

এখন 'বাল্মিকী প্রতিভা' শাহজাহানপুরের গ্যারিশন থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হবে। এবার দস্যু রত্নাকরের ভূমিকায় অভিনয় করবে স্বয়ং লক্ষ্মীনাথ, প্রজ্ঞা সুন্দরী হবে দ্বিতীয় দস্যু, অরুণা হবে সরস্বতী বালিকা, শোভনা হবে বাল্মিকী, রত্না আর দীপিকা হবে বনদেবী। লক্ষ্মীনাথের নির্দেশনায় পূর্ণোদ্যমে আখরা শুরু হল।

নাটকটা ৫ জানুয়ারি মঞ্চস্থ হবে। উদ্যোক্তারা গ্যারিশন থিয়েটার হলে সমস্ত ধরনের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করল। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ সাহেব নাটকটা উপভোগ করতে এলেন। শুরুতে প্রধান উদ্যোক্তা এন মুখার্জি উদ্বোধনী ভাষণে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাইঝির জামাই, অসমিয়া ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক এবং 'বাঁহী' পত্রিকার সম্পাদক শ্রীযুক্ত লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া মহাশয় নাটকটা নির্দেশনার সঙ্গে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করছেন বলতেই দর্শকরা হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল। লক্ষ্মীনাথ ও অনুপ্রাণিত হয়ে উঠল।

মহাকবি বাল্মিকী মহাকাব্য রামায়ণের স্রষ্টা। নিষ্ঠুর দস্যু রত্নাকরের অন্তরে কীভাবে মানবীয় চেতনার বিকাশ হল, কীভাবে তিনি কাব্যিক ঐশ্বর্য আহরণ করলেন সেটাই বাল্মিকী প্রতিভার  কাহিনি। নাটকটির সংলাপ লক্ষ্মীনাথের মুখস্ত। তার অন্তরটিও কাব্য ভাবে সমৃদ্ধ। তাছাড়া আগের সমস্ত মলিনতা দূর হয়ে এখন শ্রদ্ধাভাজন রবি কাকা তার অন্তরে প্রতিষ্ঠিত। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উজার করে অভিনয় এবং নির্দেশনার মাধ্যমে লক্ষ্মীনাথ অমর স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। লক্ষ্মীনাথের  মূৰ্ত অভিনয়ে বিমুগ্ধ হয়ে ।দেশি বিদেশি প্রতিটি দর্শক ঘন ঘন হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...