রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০২৩

পাখিদের পাড়া পড়শী- ১৩ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi

পাখিদের পাড়া পড়শী- ১৩

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  

Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi




দ্বিতীয় অধ্যায়, পাখিদের পাড়া- পড়োশী


(১৩)


সৌম্যদা স্লাইড ব্যবহার করার ফলে প্রণব কুমার ভাগবতীর সুবিধা হল।

আজ শিবিরের দ্বিতীয় দিনের কার্যসূচিতে সে প্রজাপতির বিষয়ে বলবে। নির্দিষ্ট সময়ে সকাল ন'টার সময় প্রত্যেকেই এসে গঙ্গাপুকুরি হাইস্কুলের হল ঘরে মিলিত হয়েছে। জেনারেটর চালানো ছেলেটি জেনারেটারটা অতিরিক্ত ঠান্ডার জন্য স্টার্ট করতে পারছে না। অবশেষে কষ্ট করে লড়াই করে করে ছেলেটি জেনারেটরটা স্টার্ট করতে সক্ষম হল। বিদ্যুৎ যোগান অব্যাহত ছিল যদিও ছেলেটি সাবধানতা অবলম্বন করল। সৌম্যদাকে সামনে বসে থাকতে দেখে প্রণব কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল। প্রণব মহাবিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ায়। নির্দিষ্ট ক্রমণিকায় সীমাবদ্ধ হয়ে  থাকা পাঠক্রম। এই শিবিরে তারা প্রকৃতির বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এর পাঠক্রম নির্ধারিত নয়। প্রতিদিন নতুন নতুন আবিষ্কার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমকে শক্তিশালী করে এসেছে। সেই জন্য সামনে অজস্র প্রশ্ন। হয়তো সেরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর প্রণবের অবগত নয়, সৌম্যদার সামনে মানসে  অনুষ্ঠিত হওয়া প্রকৃতি শিবিরের স্মৃতি প্রণবের মনে পড়ল। মনের মধ্যে দ্বিধা থাকায় কিছু কথা সে সেখানে স্পষ্টভাবে বলতে পারেনি।আজও যদি তার কোথাও ভুল হয়ে যায় সৌম্যদা কী ভাববে? কিছুই ভাববে না। প্রণব শিবিরে বক্তব্য রাখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে তৈরি হল। হাতে আনা পেন ড্রাইভটা উদয়শঙ্করের হাতে দিয়ে বলল – এটা নিন। বাটারফ্লাই নামের ফাইলটা পাওয়ার পয়েন্টে আছে। সেটা বের করে দিলেই হবে।শিবিরের শুরুতে উদয়শঙ্কর প্রণবকে অংশগ্রহণকারী প্রকৃতিপ্রেমীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল- ইনি আমাদের মধ্যে ডঃ প্রণবকুমার ভাগবতী। মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অসমিয়া পড়ান। গবেষণা করেছেন নদী বিষয়ক অসমিয়া উপন্যাস নিয়ে। তাছাড়া ইনি পাখি এবং প্রজাপতির ওপর অধ্যয়ন করছেন। আমাদের মধ্যে উপস্থিত হওয়া প্রণব কুমার ভাগবতী আজ তোমাদের প্রজাপতির বিষয়ে সম‍্যক জ্ঞান দিতে প্রয়াস করবেন।

অসমিয়া ভাষার প্রবক্তা দেখতে উচুঁ-লম্বা। যথেষ্ট ক্ষীণ। দুই চোখে অধ্যয়নপুষ্টতার উজ্জ্বলতা। চুল একদিকে করে আঁচড়ানো, প্রণবের গোঁফ বা মোচ বেশ আকর্ষণীয়। প্রজাপতির দুটো মেলে দেওয়া ডানার মতো। সেই জন্য প্রণবের মুখটা চট করে মনে রাখতে পারার মতো। পরনে সবুজ রঙের লং প্যান্ট এবং শার্ট। হাতে নিয়ে আসা ক্যামেরাটা প্রজেক্টর রাখা টেবিলের ওপর রেখে প্রণব আরম্ভ করল– এই ধরনের শিবিরে প্রজাপতির বিষয়ে বলার অভিজ্ঞতা আমার প্রায় নেই বললেই হয়। তাই আমি জানিনা সৌম্যদা আমি কী বলব,কীভাবে বলব।

প্রণব সৌম্যদার উদ্দেশ্যে বলা কথার প্রত্যুত্তরে সৌম‍্যদা বলল – প্রণব তুমি আরম্ভই করনি এভাবে কেন ভাবলে । মানসেও তুমি একই কথা বলেছিলে। প্রজাপতি আমাদের অংশগ্রহণকারীদের কাছে প্রায় নতুন কথা। প্রজাপতিও যে অধ্যয়নের বিষয় হতে পারে সে কথা অনেকের কাছেই অজ্ঞাত। তাই তুমি সুন্দরভাবে বলে যাও।

প্রণব প্রজেক্টর রাখা টেবিলটার কাছে এল। সে কিবোর্ডে এন্টার বাটন চাপার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম স্লাইডে লেখা ' ওয়েলকাম' শব্দটি উঁকি দিল। নিচে প্রণবের নামটা ডঃ প্রণব কুমার ভাগবতী।শ্লাইডটিতে  বিভিন্ন প্রজাতির কয়েকটি উড়তে থাকা প্রজাপতি সন্নিবিষ্ট  করা হয়েছে। প্রজাপতি গুলিকে ছোটো ছোটো আকৃতিতে সাজানো হয়েছে বলে দেখতে ভালো লাগছে। ভ্রাম্যমান থিয়েটারের' নেম কাস্টিং' এর মতো। প্রণব পরবর্তী শ্লাইডে স্ক্রিন প্রক্ষেপ করে নিজের বক্তব্য শুরু করল। 

– প্রজাপতির বর্গীকরণ প্রক্রিয়ায় শুরু করি আসুন। তার আগে তোমাদের জানিয়ে রাখি– প্রজাপতির অধ্যয়নকে বলা হয় লেপিড'পটেরোলজি আর যারা প্রজাপতি পর্যবেক্ষণ এবং অধ্যয়ন করে তাদেরকে বলা হয় লেপিড'পটেরিস্ট। সমগ্র পৃথিবীতে প্রজাপতির আঠারো হাজার প্রজাতি আছে। ভারতে থাকা প্রজাপতির প্রজাতির সংখ্যা হল এক হাজার পাঁচশো এক।

অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টি প্রণবের মুখমন্ডল এবং অঙ্গভঙ্গির উপরে প্রসারিত হয়েছে। প্রত্যেকেই একান্ত মনে প্রণবের প্রজাপতি সম্পর্কীয় ব্যাখ্যা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ার মতো দেখাচ্ছে। সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয়ের সঙ্গে আজ তাদের পরিচয় ঘটবে।

– প্রজাপতি 'এনিমেল কিংডম' প্রাণীজগতের অন্তর্ভুক্ত। তোমরা ইচ্ছা করলেই লিখে নিতে পার। তোমরা প্রায়  সবাই আমার চেয়ে বয়সে ছোটো বলে মনে হচ্ছে তাই তুমি বলেই সম্বোধন করব। প্রণব অংশগ্রহণকারীদের  প্রতিক্রিয়ার প্রতি মনোনিবেশ না করে বলতে শুরু করল।

–প্রজাপতি আর্থ'প্রডা পর্ব বা ফাইলামের অন্তর্ভুক্ত । ফেনী বা ক্লাস ইনছো , গোত্র বা লেপিড'পটেরা, উপগোত্র বা সাব অর্ডার রোপালোচেরা অতি বর্গ বা সুপার ফ্যামিলি পেপিলিঅ'নৈইডে।এই অতিবর্গের অধীনে কয়েকটি বর্গ বা ফ্যামিলি আছে প্রথমটি বর্গের  নাম পেপিলিঅ'নৈইডে। এই বর্গের প্রজাপতির সমূহকে 'সোয়ালো টেইলস এণ্ড প্রজাপতি বলে বলা হয় । প্রজাপতির সমূহ আকৃতিতে বড়ো এবং ঠেং সম্পূর্ণ উন্নত। এই বর্গের দুটি উপবর্গ এবং পৃথিবী জুড়ে এই বর্গে ১০৭ টা প্রজাতি বা স্পেসিজ  আছে। অন্য একটি বর্গ পাইরেডে। এই বর্গের প্রজাপতি সমূহকে 'হোয়াইট স এণ্ড ইয়েলো' প্রজাপতি বলে জানা যায় । এই বর্গের কোনো উপবর্গ নেই। প্রজাতির সংখ্যা ১০৯ টা। পাইরেডে বর্গের  প্রজাপতি সমূহের সমস্ত ঠেং কর্মক্ষম। অন্য একটি বর্গ নিমফেলাইডে। এই বর্গের  প্রজাপতিকে ' ব্রাছ ফুটেড প্রজাপতি' বলে জানা যায়। এই বর্গের উপবর্গের সংখ্যা ১০ টি ।নিমফেলাইডে বর্গে অন্তর্ভুক্ত প্রজাতির সংখ্যা হল পাঁচশো বাইশ। এই ধরনের  প্রজাপতি সামনের ঠেং  সমূহের দ্বারা হাঁটতে পারে না । পুরুষ প্রজাপতির ক্ষেত্রে দুর্বল ঠেংগুলি ব্রাশের মতো দেখায়। অন্য একটি বর্গ লিসেনাইডে।এই বর্গের প্রজাপতিকে ' ব্লুজ' প্রজাপতি বলে জানা যায়। এই বর্গের উপ-বর্গের সংখ্যা আটটি এবং প্রজাতির সংখ্যা ৪৪৩ টি। এই বর্গের প্রজাপতিদের সমস্ত ঠেং কার্যক্রম।সম্প্রতি 'রিঅ'ডিনাইডে বর্গকে লিসেনাইডে বর্গ থেকে পৃথক করা হয়েছে এবং প্রজাপতি সমূহকে ' পাঞ্চেস অ্যান্ড জুডিস ' প্রজাপতি বলে বলা হয়।লিসেনাইডে বর্গের হেসপেরিওডে নামে একটি অতি বর্গ আছে ।

প্রজাপতির বর্গীকরণের ওপরে সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করে প্রণব শ্লাইডটা বদলে নিল এবং প্রকৃতি কর্মীদের দিকে লক্ষ্য করল। শ্লাইডটা ইংরেজিতে লেখা বর্গীকরণের ভাগ গুলি প্রণব অসমিয়াতে বলায় অংশগ্রহণকারীরা বুঝতে যথেষ্ট সুবিধে জনক হল পাইলাম বা অর্ডার বলে বললে তাদের মাঝখানের অনেকেই বুঝতে পারত না। প্রণব এইমাত্র পরিবর্তন করা শ্লাইডটিতে একটা প্রজাপতি এবং প্রজাপতিটার বিভিন্ন অঙ্গের নাম তীর চিহ্নের দ্বারা অঙ্কিত করে দেখানো হয়েছে।

– তোমরা দেখতে পাওয়া শ্লাইডটিতে এটা প্রজাপতির দেহাবয়ব বা এনাটমি। প্রজাপতির দেহাবয়ব মাথা এবং ১৩টা খন্ড বা সেগমেন্টের দ্বারা গঠিত। এই খন্ডগুলি বাহ্যিকভাবে সহজে দেখতে পাওয়া যায় না। এই পতঙ্গগুলির শরীর মুখ‍্যত  তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। শির, বক্ষ এবং উদর। শির ভাগে আছে একজোড়া এন্টেনা একজোড়া চোখ, দীর্ঘ নলের আকৃতি একটা প্রব'ছকিছ এবং একজোড়া সংবেদনশীল পালপস। এন্টেনার সাহায্যে প্রজাপতি পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কী ধরনের তার সন্ধান করতে পারে। প্রজাপতির চোখ দৃষ্টিশক্তির জন্য ব্যবহৃত হয়। উড়ন্ত অবস্থায় মানুষের চোখের চেয়ে প্রজাপতির চোখ প্রায় তিনগুণ বেশি শক্তিশালী। প্রব'চকিছের সাহায্যে প্রজাপতি খাদ্য হিসেবে ফুল থেকে মধু শোষণ করে। অব্যবহৃত অবস্থায় প্রজাপতি প্রবছকিছ নামের অঙ্গটা সংকুচিত করে রাখতে পারে এবং প্রয়োজনে বের করে দেয়। সেভাবে পেড বা পালপসের সাহায্যে প্রজাপতি সংবেদন গ্রহণ করতে পারে। প্রজাপতির বক্ষ ভাগ তিনটি খন্ডে সংযুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে। প্রতিটি খন্ডে এক জোড়া করে ঠেং আছে, প্রথম দুটো খন্ডে এক জোড়া করে পাখনা আছে। পাখনার সামনের দিকটাকে সামনের পাখনা ফর উইং এবং পেছনের ভাগকে পুচ্ছ পাখনা, হাইন্ড উইংস হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রজাপতির ছয়টি ঠেং ছয় অংশে  ভাগ করা হয়েছে। সেই ভাগ গুলি তোমাদের খুব একটা প্রয়োজন নেই।

– বলুন স্যার। লিখে নিই, কখনও প্রয়োজন হতে পারে।

উৎসুক অংশগ্রহণকারী বিপাশা বলল।

– তাহলে লেখ। প্রজাপতির ঠেং ছয় অংশে  বিভক্ত, সেই ছয়টি অংশ ক্রমে কা, ট্রকেনটার ,ফিমার, টিবিয়া ,টারসাস এবং প্রিটারসাস।  

শ্লাইডে উল্লেখ না থাকার জন্য প্রণব শব্দগুলি ধীরে ধীরে  পুনর্বার আউরে গেল যাতে অংশগ্রহণকারীরা নিজের নিজের নোট বইয়ে শব্দগুলি শুদ্ধ করে লিখে নিতে পারে।

– হয়েছে? তোমরা জান আমরা নাক দিয়ে গন্ধ এবং জিহ্বা দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করি। প্রজাপতির ঠেঙের শেষ ভাগের টারসাস অংশে কেম'রিছিপ্টরছ বা রাসায়নিক সংবেদক গ্রহীতা আছে। তার সাহায্যে প্রজাপতি গন্ধ এবং স্বাদ লাভ করে। এমনকি নারী প্রজাপতি গাছের পাতায় ধাক্কা দিয়ে সেই গাছের পাতা থেকে নিঃসরিত হওয়া রাসায়নিক পদার্থ নিরীক্ষণ করে ডিম পাড়ার উপযুক্ত কিনা বলতে পারে। প্রজাপতি ঠেঙে থাকা রাসায়নিক সংবেদক গ্রহীতার সাহায্যে খাদ্যের উৎসেরও সন্ধান করে।

প্রণব শ্লাইডটা বদলে নিল। স্ক্রিনে ভেসে এল প্রজাপতির জীবন চক্র বিষয়ক কয়েকটি আলোকচিত্র। প্রথম ছবিটিতে প্রকৃতি কর্মীরা দেখতে পেল টনি কষ্টার নামক প্রজাপতির সহবাস, দ্বিতীয়তঃ ডিম পাড়ার দৃশ্য, তৃতীয়তঃ ডিম পাড়ার বিস্তৃতি।

– তোমাদের মধ্যে অনেকেই জান প্রজাপতির জীবন চক্র চারটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। সেই সব ক্রমে এগ বা ডিম, ক্যাটারপিলার বা বিছা, পিউপা বা লেটা এবং এডাল্ট বা পূর্ণবয়স্ক প্রজাপতি। সহবাসের পরে প্রজাপতি ডিম পাড়ার জন্য উপযুক্ত মাধ্যম বিশেষ করে ওদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হওয়া গাছের পাতা খুঁজে বেড়ায়। তার জন্য প্রজাপতি দৃষ্টিশক্তি এবং ঘ্রাণশক্তি ব্যবহার করে। রাসায়নিক সংবেদনশীলতার মাধ্যমে প্রত্যেক প্রজাপতির প্রজাতি নির্বাচিত গাছ বনের প্রজাতিকে ডিম পাড়ার উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করে। প্রজাতি ভেদে প্রজাপতির ডিমের আকার এবং  আকৃতি ভিন্ন হতে দেখা যায়। ডিম সমূহে থাকা আঠা জাতীয় পদার্থের সাহায্যে ডিমগুলি গাছের পাতায় সংযোজিত হয়ে থাকে।

প্রণব শ্লাইডটা বদলে দিয়ে ভিন্ন প্রজাতির ডিমের আকার এবং আকৃতি অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীদের দেখিয়ে দিয়ে পুনরায় প্রজাপতির জীবন চক্র ব্যাখ্যা করতে লাগল।

– নিষিক্ত ডিম গুলির ভেতরে বিছা জন্ম লাভ করে। ডিম থেকে বিছা জন্মানোর আগে ডিমের পাতলা খোসার মধ্যে দিয়ে বিছার গঠন স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাওয়া যায়। ডিম থেকে বিছা জন্মাতে প্রজাতি ভেদে তিন দিন থেকে সাত দিন সময় লাগে। বিছার প্রথম খাদ্য হল সে জন্ম লাভ করা ডিমের খোসাটা। তারপর ধীরে ধীরে আশ্রয় নেওয়া পাতার কোমল অংশ ভক্ষণ করতে শুরু করে যখন বিছার হনু পূর্ণাঙ্গ রূপে উন্নীত হয় তখন বিছা আশ্রয় নেওয়া গাছকে খাদ্য খাওয়া যন্ত্র একটার মতো একদিক থেকে সংহার রূপ ধারণ করে ভক্ষণ করতে শুরু করে। বিছার আকার বড়ো হয়ে গেলেও এর ত্বক বা ছালের আকার বৃদ্ধি হয় না। তখন বিছা  খাওয়া ছেড়ে দিয়ে নতুন ছাল গঠন হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। পুরোনো ছালের নিচ থেকে নতুন ছাল গঠন হলে বিছা ছলম ছাড়ে। নতুন ছাল কঠিন হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা পুনরায় পূর্ণোদ‍্যমে খেতে শুরু করে। একটা বিছা নিজের জীবনকালে তিন থেকে চারবার ছলম ছাড়ে।

প্রণব শ্লাইডটা বদলে নিয়ে বিছার ছলম ছাড়ার কয়েকটি আলোকচিত্র স্ক্রিনে প্রদর্শন করল। দুজন প্রকৃতি কর্মী এরকম ভাব করল, বিছাগুলি দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শরীরে চুলকানি শুরু হয়েছে। কিছু কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটা সংবেদনশীল সাধারণ জৈবিক পরিক্রমা। প্রণব তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিল না। সে শ্লাইডটা না বদলে পুনরায় বিছার বিষয়ে বলতে লাগল।

– একটা বিছার শরীর ১৪টা খন্ডে গঠিত। বিছার শ্রবণ ক্ষমতা নেই কিন্তু স্পন্দন অনুভব করতে পারে। পূর্ণাঙ্গ প্রাপ্ত বিছা খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে এবং আশ্রয় নেওয়া গাছের ডালের উপরে বিশ্রামহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়। সেভাবে ঘুরে বেড়ানো বিছা উপযুক্ত স্থানের সন্ধানে অন্য গাছ বেড়া পাথর ইত্যাদিতেও বাইতে শুরু করে। তোমরা সেরকম বিছা দেখতে পেয়েছ। সেই রকম বিছা  শরীরে থাকা অজীর্ণ  খাদ্য সমূহ বের করে ফেলে। দল বদ্ধ ভাবে থাকা বিছার জায়গার লক্ষ্য করলে তোমরা এই ধরনের বিষ্ঠা সতত দেখতে পাবে। উপযুক্ত স্থানে আশ্রয় নেওয়া বিছা পায়ের সাহায্যে নির্মাণ করা সিল্কের মতো সুতোয় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ঢেকে ফেলে।

প্রণব শ্লাইডটা পাল্টে দিল এবং প্রজাপতির লেটা অবস্থার কয়েকটি আলোকচিত্র প্রকৃতি কর্মীদের সামনে প্রদর্শন করল।

– ধীরে ধীরে বিছাগুলি লেটায় পরিবর্তিত হয়। কয়েকটি নৈমিত্তিক পর্যায় অতিক্রম করার পরে লেটা থেকে জন্মলাভ করে প্রজাপতি। লেটার শির অংশ প্রথমে বিভক্ত হয় এবং নতুন করে জন্ম লাভ করা প্রজাপতি আশ্রয় নেওয়া পাতার নিচে ছেঁচড়ে যায়। সম্ভবত নিরাপত্তার সন্ধানে। তারপরে প্রজাপতি খাদ্যের সন্ধানে পরস্পরের সঙ্গে লড়াই যুদ্ধ এবং সহবাসে লিপ্ত হয়। ফুল, ফলের রস, গাছ থেকে নির্গত রস, কাদামাটি ,জীবজন্তুর মূত্র এবং বিষ্ঠা, মৃত প্রাণীর শবদেহ ইত্যাদি থেকে আহার গ্রহণ করে। প্রজাপতির আয়ু গড় হিসেবে দুই থেকে চার সপ্তাহ। সোয়ালো টেইল,ব্রাশ ফুটেড প্রজাপতির আয়ুকাল  ৮ মাস পর্যন্ত হতে দেখা যায়। প্রজাপতির জীবন চক্র জলবায়ু খাদ্য এবং আশ্রয়স্থলের উপরে অত্যন্ত নির্ভরশীল।

প্রণব শ্লইডটা পুনরায় বদলে নিল ।

নীরব নিস্তব্ধভাবে প্রতিজন অংশগ্রহণকারী কথাগুলি শুনে চলেছে। কিন্তু প্রণবের সন্দেহ হচ্ছে তারা কথাগুলি কতটা বুঝতে পেরেছে। প্রজাপতির জীবন চক্র চারটা ভাগে বিভক্ত হলেও প্রতিটি ভাগের পরিবর্তন মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে হবে।প্রণব শ্লাইডে বুঝিয়ে গেছে যদিও কোথাও যেন বোঝাতে তার একটু অসুবিধা হয়েছে ।ইংরেজিতে হলে বলতে সুবিধা। অসমিয়া প্রতিশব্দ হাতড়ে  বেড়াতে হয় বলে প্রণব অসমিয়ার পরিবর্তে ইংরেজি শব্দই ব্যবহার করেছে । অংশগ্রহণকারীরা শব্দ গুলির সঙ্গে কতটা পরিচিত সে বিষয়ে প্রণবের সন্দেহ আছে। ধীরে ধীরে তারা সমস্ত বুঝতে পারবে বলে প্রণব বিষয়বস্তু এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

– এবার আমরা প্রজাপতির আচরণের বিষয়ে কিছু আলোচনা করব। তোমরা এই শ্লাইডের আলোক চিত্র গুলির মধ্য দিয়ে প্রজাপতির কিছু সাধারণ আচরণ প্রত্যক্ষ করেছ। প্রথম ছবিতে দেখতে পেয়েছ প্রজাপতি রোদ পোহাচ্ছে। ইংরেজিতে একে বাস্কিং বলা হয়। নিম্ন উষ্ণতায় প্রজাপতির দৈনন্দিন জীবন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত জন্মে। সেই জন্য সূর্যের প্রত্যক্ষ আলোতে শরীরে রোদ লাগিয়ে প্রজাপতি উত্তাপ সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় ছবিটিতে দেখতে পেয়েছ প্রজাপতিরা পাহাড়ের ঢালুতে একত্রিত হয়েছে, একে বলা হয় হিল টপিং। এগুলি পুরুষ প্রজাপতি। পাহাড়ের উঁচুতে আশ্রয় নিয়ে এই প্রজাপতি গুলি স্ত্রীপ্রজাপতির সঙ্গে সহবাস করার জন্য অপেক্ষা করছে। এই ছবিটি কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। এই প্রজাপতিটার প্রজাতির নাম কমন ক্র। এটা তার পেটের নিচে থাকা পেন্সিলের মত চুল দাঁড় করিয়ে নিয়ে অরণ্যের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে সহবাসের জন্য সান্নিধ্যের খোঁজে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় পেট্রোলিং। প্রজাতি ভেদে প্রজাপতির পেট্রোলিং প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে দেখা যায় । প্রজাপতি সহবাসের জন্য স্ত্রী প্রজাপতির সন্ধানে যেভাবে পাহাড় বেয়ে যায় সেভাবে খাল নর্দমা জল যাওয়া নালা ইত্যাদিতেও সামূহিকভাবে জমা হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় গাল্লি বাটমিং। নতুন করে জন্ম লাভ করা একটি বা ততোধিক পুরুষ প্রজাপতি দলবেঁধে কাঁদার উপরে পড়ে কাদা থেকে নুন এবং জল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রজাপতির এই আচরণকে বলা হয় মাডপুডিং।শেষের আলোকচিত্রটা প্রজাপতির সহবাস প্রক্রিয়ার। প্রজাপতির এই আচরণকে কোর্টশিপ বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রণব প্রজাপতির আচরণের বিষয়ে ব্যক্ত করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। বুঝতে পারুক বা না পারুক প্রকৃতিকর্মীরা তার বক্তব্য মন দিয়ে শুনছে।

– তোমাদের হয়তো বোঝায় কিছুটা অসুবিধা হতে পারে। পরবর্তী সময়ে যখন শব্দগুলির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে তখন তোমাদের জন্য সবকিছু সহজ হয়ে যাবে ।কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দের অসমিয়া প্রতিশব্দ তোমাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে দিই। তোমরা লিখে নিতে পার।

– হ্যাঁ স্যার লিখে নেব। আস্তে আস্তে বলবেন। পুনরায় বিপাশা প্রণবকে অনুরোধ করল।

– ঠিক আছে। একেবারে আস্তে আস্তে বলছি। তোমরা লিখে নাও। কিংডম‐ জগত, ফাইলাম‐পর্ব, ক্লাস‐শ্রেণি, অর্ডার‐ গোত্র, সাব অর্ডার- উপগোত্র, সুপার ফ্যামিলি- অতি বর্গ, ফ্যামিলি‐ বর্গ, সাব ফ্যামিলি‐ উপবর্গ, জেনাস‐ গণ এবং স্পেসিস‐ প্রজাতি। গণ এবং প্রজাতি প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম। প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম লিখতে বাঁকা অক্ষরে লেখা হয়। তোমরা সোজা করে লিখে নিচে লাইন টেনে দেবে। প্রাণী জগতের'দ্বি নামাকরণ পদ্ধতি' এবং বর্গ বিভাজনের শ্রেণীবদ্ধ সূত্রের উদ্ভাবক হলেন কেরলাস লিনিয়াস নামের একজন বৈজ্ঞানিক। তার মতেই জীবজন্তুর নামকরণ করে আসছি। তুমি যে মানুষ তোমারও একটা নাম আছে জান কি? সেটা হল হোমো সেপিয়েন্স ।

- আজ পর্যন্ত এতটুকু। ঠিক আছে সৌম্যদা? প্রজাপতির নিরাপত্তার জন্য গ্রহণ করা ব্যবস্থা, প্রব্রজন, জৈব  ভৌগোলিক কারক ইত্যাদি কিছু কথা বলা বাকি রইল। পরবর্তী সময়ে আমরা নিশ্চয় আলোচনা করতে সুযোগ পাব।

সৌম্যদা, উদয়শঙ্কর, সুনন্দ, নবদা, কীচক ,জ্যোতিপ্রসাদ, টিংকু মহন্ত, নব জিৎ বর্মন ইত্যাদি প্রণবের প্রজাপতি বিষয়ক কথাগুলি একাগ্রতার সঙ্গে শুনে যাচ্ছিল। প্রণব নিজের বক্তব্য শেষ করায় তারা নিজেদের সম্বিত ফিরে পেয়েছে বলে মনে হল। প্রজাপতির পৃথিবী থেকে তারা বাস্তবের পৃথিবীতে ফিরে এল। রংচং এ প্রজাপতিদের একটি নিজস্ব পৃথিবী আছে, আছে প্রকৃতির মধ্যে সুনির্দিষ্ট স্থান- অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যের কয়েকজন কল্পনাও করতে পারেনি। স্লাইডে বিভিন্ন প্রজাতির রঙ্গিন প্রজাপতির সঙ্গে ওরাও মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছিল। জীবনচক্রের বিছা অবস্থা থেকে অনেকের মনে ঘৃণার  মনোভাব উদয় হওয়া বা এলার্জি হলেও পূর্ণবয়স্ক প্রাপ্ত প্রজাপতির রং গ্রুপ এবং বাতাসে লাফিয়ে বেড়ানো নৃত্য দেখে তারা সত্যি আপ্লুত হয়ে পড়ল। বিছা অবস্থার কথা বলার সময় কয়েকজনের মুখে ভাব ভঙ্গির পরিবর্তন দেখে প্রণব বলেছিল‐- এরকম করা উচিত নয়। কয়েকদিন পরে বিছা থেকে জন্মগ্রহণ করা প্রজাপতির পেছনে তোমরা দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াবে।

- খুব ভালো লাগল প্রণব। তুমি আমাদের প্রত্যেককে অনেক অজানা তথ্য জানালে।

সৌম্যদা এগিয়ে এসে প্রণবের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়াল। প্রণব ভয়ে ভয়ে তার বক্তব্য শুরু করেছিল এবং শেষের দিকে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ায় শুরুর ভয়টা আর ছিল না।

- শুধুমাত্র প্রজাপতিকে বিষয় হিসেবে নিয়ে আগে কখনও বক্তব্য রাখার অভিজ্ঞতা ছিল না সৌম্যদা।

- অভিজ্ঞতা হওয়ার জন্য তোমাকে কোনোদিন কাজটা তো শুরু করতে হবে। প্রথম দিন আমাদের ও অভিজ্ঞতা ছিল না। তুমি শুরু করেছ এবং আশা রাখব নতুন প্রজন্মকে তুমি এই দীক্ষা দিয়ে যাবে।

- নিশ্চয় সৌম্যদা। এটা আপনাদের অনুপ্রেরণা। মানসে আপনি বলা কথাগুলি আমি অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখেছি । না হলে হয়তো আমি একা প্রজাপতির আলোকচিত্র সংগ্রহ করেই দিন কাটাতাম ।

- আমার নয়। উদয়শঙ্করের। এখানে করা সমস্ত কাজের ভালো-মন্দ- সবকিছু উদয়শঙ্করের। অবশ্য মানসের  কথা আলাদা।চল। ঠান্ডার দিন। বেলা পড়ে এলেই অন্ধকার হবে।

অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীরা ইতিমধ্যে খাবার স্থানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেছে। প্রজেক্ট্রর চালানো বলীন ইতিমধ্যে তাঁর- কেবল- কর্ড গুলি খুলে সেগুলি নির্দিষ্ট বাক্সে ভরিয়ে রাখল। মাইক্রোফোন সেই ব্যবহার করেছে। সেসবও  সামলে সুমলে রাখল। জেনারেটর চালানোর প্রয়োজন হয়নি। এটা খুব ভাগ্যের কথা যে ঠান্ডার দিনেও বিদ্যুৎ সংযোগ একবারও ব্যাহত হয়নি।

অংশগ্রহণকারীরা প্রত্যেকেই দল বেঁধে ঘাসের উপরে পেতে দেওয়া ত্রিপালে বসে ভাত খেতে শুরু করেছে। উদয় শঙ্করদের দেখে তাদেরও একসঙ্গে ভাত খাবার জন্য থানের  বাইরে ভোজ-ভাতের ব্যবস্থাপনা করা কয়েকজন ব্যক্তি অনুরোধ জানাল। সঙ্গে আছে বাপুটি। এই মানুষ কয়েকজনকে উদয়শঙ্কর চেনে না। আগে কখনও দেখেছে বলে তার মনে পড়ছে না। উদয়শংকররা দলটির সঙ্গে একসঙ্গে খেতে বসল। আজকের ভাতের সঙ্গে মাছের ব্যবস্থা করেছিল উদয়শংকর। মাছের ব্যবস্থা থাকার জন্য ওরা থানের বাইরে বনভোজ খাওয়া স্থানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল।

ভাতের গ্রাস মুখে নিয়ে সুনন্দ দেখতে পেল বাঁধের দিক থেকে গ্রামের চারজন ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে থানের দিকে এগিয়ে আসছে। সুনন্দ ছেলেগুলিকে চিনতে পারল। গ্রামের ছেলে। ওদের দেখে সুনন্দর  বিপদের আশঙ্কা হল। কোথাও কিছু অঘটন ঘটেছে নিশ্চয়। আগে সৈন্য বাহিনীর লোক এলে কেউ দৌড়ে এসে সবাইকে এভাবে খবর দিত। এখন তো আর সেই দিন নেই। তাহলে কী হয়েছে! যেভাবে দৌড়াদৌড়ি করে ছেলেরা এসেছিল, অংশগ্রহণকারীদের ভাত খেতে দেখে ওরা প্রায় নিশ্চুপ হয়ে পড়ল এবং ইতস্তত করে থানের বারান্দায় বসে রইল। ওদের মুখাবয়বে উৎকণ্ঠা এবং চাঞ্চল্যের রেশ। সুনন্দা ভাবল নিশ্চয় কোনো গভীর ব্যাপার হয়েছে, কোনো অঘটন ঘটেছে।

আগে খেতে বসে অংশগ্রহণকারীরা ভাত খাওয়া হওয়ার পরে মুখ হাত ধুতে গেছে। ছেলেগুলোকে মুখহাত  ধুতে যাবার জায়গায় এগিয়ে যেতে সুনন্দ লক্ষ্য করল ।

সে যেরকম ছিল সেভাবে ভাতের থালা থেকে উঠে ছেলেগুলোর দিকে এগিয়ে গেল ।

- তোমার খাওয়া হয়েছে সুনন্দ?

উদয়শঙ্কর তাকে জিজ্ঞেস করল। সুনন্দ কোনো উত্তর দিল না।

- এভাবে খাওয়ার জিনিস নষ্ট করা একেবারেই অনুচিত। উদয়শঙ্করের দিকে তাকিয়ে সৌম্যদা বলল।

- সুনন্দ তো এভাবে উঠে যাবার ছেলে নয়। কিছু একটা হয়েছে তার।

সুনন্দ সোজা এগিয়ে গিয়ে দেখল ছেলেরা কাকাবাবুর বৌমা অনামিকার সঙ্গে কথা বলছে। সে অনন্ত বৌমাকে বলা কথাগুলি শুনতে পেল‐-' বৌদি কাকাবাবু আপনাকে খুঁজছে। আমাদের বলেছে আপনাকে নিয়ে যেতে।

‐ আমার হয়ে গেছে দাঁড়াও। সবাইকে একটু বলে আসি।

অনামিকা সুনন্দকে  বলল‐-' বাবা নাকি ডেকেছে। আমি আসছি। উনার অসুখ-বিসুখ করে থাকতে পারে।

সৌম্যদার  কাছে এসে অনামিকা সৌম্যদাকে বলল- দাদা আসছি। আমাদের বাড়িতে আসবেন। বাবা খুব খুশি হবে।

– যাবার আগে আমি কাকাবাবুকে একবার বলে যাব।সৌম্যদা প্রত্যুত্তরে বলল।

উদয়শঙ্করের দিকে তাকিয়ে অনামিকা সাধারণভাবে বলল— এলাম।

অনামিকা এগিয়ে যাওয়ায় সুনন্দ অনন্তকে একপাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল‐- কী ব্যাপার অনন্ত ।এত দৌড়াদৌড়ি করে যে অনামিকাকে ডেকে নিতে এসেছ। কাকাবাবুর কিছু—

অনন্ত কেউ যাতে শুনতে না পায় সেভাবে সুনন্দের কানের কাছে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল– জ্যোতিষদা  মারা গেছে।

সুনন্দ বাঁ হাতটা নিজের মাথার ওপরে রেখে জিজ্ঞেস করল–কী ভাবে? জ্যোতিষদার কী হয়েছিল?

– আজ সকাল বেলা নকশালবাদীর সঙ্গে গোলাগুলিতে নাকি মৃত্যু হয়েছে– সেরকম খবর এসেছে।

অনন্ত আর বেশি কথা বলল না। সাধারণভাবে সেই কথাটা বলে অনন্ত অনামিকার পেছন পেছন প্রায় দৌড়ে যাবার মতো এগিয়ে গেল।

সুনন্দ দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটিতে বসে পড়ল।

দাঁড়িয়ে থাকা জায়গায় বসে পড়তে দেখে উদয়শঙ্কর দৌড়ে তার কাছে এল– কী হয়েছে সুনন্দ। তুমি এরকম করছ কেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সুনন্দ প্রকৃতিস্থ হল।

– জ্যোতিষদা মারা গেছে।

– কী বলছ হে।কী বলছ। কাকাবাবুর ছেলে জ্যোতিষের মৃত্যু হয়েছে!

দুজনেই সৌম্যদার কাছে এসে সৌম্যদাকে কথাটা জানাল। সেই মুহূর্তে সৌম্যদার মনটাও বিমর্ষ হয়ে পড়ল। মুখটা লাল হয়ে দুচোখ কোনো অনির্দিষ্ট স্থানে স্থির হয়ে রইল। সেই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে প্রকৃতিস্থ হয়ে সৌম্যদা সুনন্দকে বলল– সুনন্দ যারা ভাত খায়নি তাদের কথাটা না জানিয়ে ভাত খাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবকিছু গুছিয়ে নাও। উদয়শংকর, না  করলেই নয় কাজ গুলি তাড়াতাড়ি করে ফেল। আমাদের কাকাবাবুর কাছে যেতে হবে।

সুনন্দ বাপুটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল– আর কতজন মানুষের খাওয়া বাকি আছে?

– আমরা চার পাঁচ জন।

– আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে, তাই তাড়াতাড়ি কর।

– এই বসছি ধরে নিন।

বাপুটি কয়েকজন মানুষের জন্য থালা  পেতে চিৎকার করতে লাগল– এরা নাকি কোথায় যাবে। তাড়াতাড়ি ভাত নিয়ে আয়। দেরি করলে এখানেই রাত হয়ে যাবে।

বাপুটির চিৎকার শুনে ভাত খেতে থাকা কয়েকজন এসে নিজের নিজের থালায় বসল। সুনন্দ এবং উদয়শঙ্কর ওদের ডাল- ভাত পরিবেশন করল। ওদের ভাত খাওয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থানে হুলস্থূল লেগে গেল। অনন্তের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে আসা হরিশ পুনরায় ফিরে এসে সকলকে আদ্যোপান্ত বিস্তৃতভাবে জানাল।

– জ্যোতিষদারা নাকি সকালবেলা পেট্রোলিঙে বেরিয়ে গিয়েছিল। নকশালবাদিরা মাইন ফাটিয়ে ওদের ওপরে ধরাসার গুলি বর্ষণ করতে শুরু করে। জ‍্যোতিষদারা আক্রমণ করার কোনো সুযোগই পেল না। টিভির খবর অনুসারে মোট আটত্রিশ জন জোয়ানের বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে।

হরিশের  কথা শুনে প্রত্যেকের মুখের কথা বন্ধ।

–কী বলছ হে বাপু, এত সুন্দর  লম্বা চওড়া ছেলেটা মারা গেল। মা-বাবা আর স্ত্রী কী নিয়ে বেঁচে থাকবে।

বাপুটির কথা শুনে প্রত্যেকের মুখ শোকে উথলে উঠল।

– এইতো সেদিন তার বিয়েতে গিয়েছিলাম। কী হাসিমুখ স্ফূর্তিবাজ ছিল ছেলেটি। সে আজ নেই। বিশ্বাস করতেও কঠিন মনে হচ্ছে। আর কাকাবাবুর বৌমা অনামিকা–

উদয়শঙ্কর কথাটা শেষ করতে পারল না। তার মুখটা বর্ষার কালো মেঘের মতো ভার হয়ে উঠল।

দুঃখ এবং শোকের মধ্যে বাপুটিরা সবকিছু গুছিয়ে রাখল। অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীরা তিনজনকেই জানিয়ে পরস্পর থেকে বিদায় নিল। তারা কী ঘটছে তার কিছুই আভাস পেল না। প্রণব নবজ্যোতিদেরও এভাবেই বিদায় জানাল। সৌম্যদা সুনন্দ এবং উদয়। নবদা এবং কীচক কথাটা জানতে পেরে সুনন্দদের  সঙ্গে থেকে গেল।

সৌম্যদা, উদয়শঙ্কর, নবজিৎ বৈশ্য ,কীচক, টিংকু এবং সুনন্দ তখনই গিয়ে কাকাবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হল। বাড়ির সামনে লোকে- লোকারণ্য।

কাকাবাবু উঠোনে পায়চারি করছে। দেখলেই বুঝতে পারা যায় মানুষটা অভাবনীয়ভাবে অস্থির হয়ে পড়েছেন।

সৌম্যদা এবং উদয়শঙ্করকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন।সৌম্যদা দুহাত জোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিতে বুকের কাছে রেখে কাকাবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন।

– ও যেদিন সৈনিকের ড্রেস পরেছিল আমি ওকে সেদিনই বিদায় দিয়েছিলাম। কেবল আনুষ্ঠানিকতাটুকু বাকি। সৈনিক মৃত্যুর কাছে ধার খেয়ে রেখেছে। সেইজন্যই সৈনিককে মৃত্যু তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

সৌম্যদা লক্ষ্য করলেন কাকাবাবু কথাগুলি অসংলগ্ন ভাবে বলছেন। মানুষটা হঠাৎ পড়ে যেতে পারে বলে ভয় হওয়ায় সৌম্যদা সাবধানতা অবলম্বন করে কাকাবাবুর প্রায় গায়ের কাছে দাঁড়াল।

কাকাবাবু ডুবন্ত সূর্যের দিকে মুখ করে বলে উঠল– ও  ঐদিকে গিয়েছে। ওই রাস্তায়। ওকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না ,ও কিন্তু আমাদের দেখতে পাচ্ছে।

তারপর কাকাবাবু সৈনিকের 'সাবধান পজিশনে' দাঁড়ালেন। উদয়শংকর লক্ষ্য করল কাকাবাবুর বা হাতের মুঠোটা বজ্র কঠোর। মানুষটা যেন ক্রমে পাথর হয়ে যাচ্ছেন। তিনি ডান হাত দিয়ে কপালে সেলাম ঠুকে চিৎকার করে উঠলেন– জয় হিন্দ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি আবার চিৎকার করে উঠলেন–জ‍্যেই হিন্দ। জ্যোতিষ অমর রহে। পুনরায় সুতীব্র কন্ঠে চিৎকার করলেন – জয় আই অসম । পিতৃ সৈনিক পুত্র সৈনিককে নিজের পদ্ধতিতে বিদায় জানাল। কত দুঃখকর হতে পারে সেই দৃশ্য, উপস্থিত প্রতিটি ব্যক্তি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন। আবেগকে ধরে রাখতে না পেরে পুরুষ মহিলা ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। 

প্রত্যেককে কাঁদতে দেখে কাকাবাবু পুনরায় জোরে চিৎকার করে উঠলেন– বিশ্রাম।

কাকাবাবুর অবস্থা দেখে সৌম্যদা  একজন বয়স্ক লোকের কাছে এসে বললেন– কাকাবাবু, ইনি খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। আমাদের সান্ত্বনার ভাষা নেই। আপনি তাকে একটু দেখবেন। মানুষটার–

– তুমি ঠিকই বলেছ। হরগোবিন্দের একজন বন্ধু আছেন। তার কাছে খবর পাঠিয়েছি। তিনি এলে তাকেই হরগোবিন্দের দায়িত্ব দিতে হবে।

অন্যদিকে উদয়শঙ্কর সুনন্দকে বলল– আশেপাশে কোনো চিকিৎসকক আছে কি? যদি থেকে থাকে একটু আসতে বলবে। কাকিমার বা কী অবস্থা। তুমি পার যদি একবার খবর নিও।' ডেড বডি আসতে  সময় লাগবে।

সুনন্দ উদয়শংকরের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল– মধু বৈশ‍্য নামে একজন চিকিৎসক কাছাকাছি থাকেন। তিনি শুনে থাকলে না ডাকলেও এসে যাবেন। তাকে খবরটা দেবার ব্যবস্থা করি আর কাকিমার খবর নিই।

সুনন্দ বাড়ির ভেতর চলে গেল। সুনন্দ গ্রামের ছেলে, এভাবে যেতে পারে। উদয়শঙ্কর পারে না, তার মধ্যে আবার স্ত্রীলোক, কী অবস্থায় আছেন কে জানে! কেউ এগিয়ে দেওয়া একটা চেয়ারে  কাকাবাবু মাথা নিচু করে বসে আছে। চারপাশে মানুষের ভিড়। বাড়ির উঠোন, বাঁধের ওপরে জায়গা নেই। এরকম সময় একজন মহিলাকে পাগলের মতো বাঁধের ওপর দিয়ে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। তার পেছন পেছন আসা পুরুষটি মহিলাকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে বিফল হচ্ছে।

– ইনি জ্যোতিষের দিদি। পেছন পেছন আসা পুরুষটি মহিলার স্বামী।

কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন উদয়শঙ্করকে বলল। 

জ্যোতিষের দিদি হুড়মুড়  ভেতরে প্রবেশ করে বাবার পায়ের কাছে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। কাকাবাবু নির্নিমেষ  চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কাকাবাবুর জামাই স্ত্রী কে মাটি থেকে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে ।অথচ পারছে না ।উদয়শঙ্কর মানুষটাকে সাহায্য করার জন্য জ‍্যোতিষের দিদির বাঁ হাতটা ধরে টেনে তুলল। স্বামীর গায়ে হেলান দিয়ে চিৎকার করতে করতে জ্যোতিষের দিদি ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। ঘরের ভেতরে কান্নার রোল উঠল।

উদয়শঙ্কর দেখতে পেল ভেতরের ঘর থেকে সুনন্দ বেরিয়ে আসছে।

– ভেতরের অবস্থা আরও খারাপ। মধু বৈশ‍্যকে নিয়ে আসতেই হবে। এদের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখার বাইরে আর কোনো উপায় নেই। না হলে অঘটন ঘটে যেতে পারে। বৌমা অনামিকার হয়তো হুঁশই নেই। যেভাবে ঘাড় মটকে পড়ে আছে সেভাবেই রয়েছে। আমি কিন্তু সাড়া- শব্দ দেখিনি। কাকিমা মেয়ের আসার খবর পেয়ে উঠে বসেছেন এবং মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেছেন। মাঝেমধ্যে তিনি ছটফট করে উঠছেন।

– সুনন্দ, তুমি যাও। যত তাড়াতাড়ি পার একজন চিকিৎসকের ব্যবস্থা কর।

সুন্দের আর যেতে হল না।অনন্ত আর হরিশের সঙ্গে একজন চিকিৎসক অনিল রায়মেধি এসে উপস্থিত হলেন। উপস্থিত প্রত্যেকেই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সুনন্দ ডাক্তারবাবুকে ভেতরে নিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু অনামিকা বৌমার হাতে রক্তচাপ মাপার যন্ত্রটা দিয়ে এবং স্টেথোস্কোপ দিয়ে রক্তচাপ মাপলো।

– ঠিকই আছে। ঘুমিয়ে আছে যখন ঘুমোক। কান্নাকাটি করার জন্য ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে উঠলে একটু সাবধান হবেন। দেখবেন যাতে দেওয়ালে মাথা না ঠোকে।

উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে রায়মেধি  বললেন। তারপর কাকিমার রক্তচাপ মেপে তিনি বেগ থেকে ট্যাবলেটের একটি পাতা বের করে বললেন– এখান থেকে একটি ট্যাবলেট এখনই উনাকে খাইয়ে দিন।

— আমি কিছুই খাব না। আমি বলছি কিছুই খাব না–অ'অ'অ'–

কাকিমা চিৎকার করতে লাগলেন।

– আপনাকে খেতে হবে। একটু বুঝতে চেষ্টা করুন। আপনি এরকম করলে ডেকার কী হবে।

রায়মেধি কাকিমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন। কাকাবাবুর কথা বলায় কাকিমা রাজি হলেন এবং পাশের একজন মহিলা এনে দেওয়া জল নিয়ে ট্যাবলেটটা মুখে দিলেন ।

— এখন অন্তত রাতটা ভালোভাবে পার হবে। ইনি ঘুমিয়ে পড়বেন। কেউ ওকে বিরক্ত করবেন না ।

রায়মেধি বুঝিয়ে সুঝিয়ে জ্যোতিষের দিদিকেও একটি ট্যাবলেট খাইয়ে স্বামীকে বললেন –  বিছানায় নিয়ে একে ভালো করে শুইয়ে দিন । গরম কাপড় চোপড় গায়ে দিতে ভুলে যাবেন না। কাকাবাবুর রক্তচাপ সুস্থির । সারারাত কষ্ট পাওয়ার চেয়ে কাকাবাবুকেও  রায়মেধি একটা ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিলেন।

– তুমি আজ আমাকে যা দেবে তাই খাব।

কাকাবাবু জল ছাড়া ট্যাবলেটটা গিলে  ফেললেন। গলায় অস্বস্তি হওয়ায় তিনি হাতের ইশারায়  বললেন–জল,জল। কেউ হাতে থাকা জলের বোতলটা এগিয়ে দেওয়ায় কাকাবাবু তৎক্ষণাৎ কয়েক ঢোক জল খেয়ে ফেললেন।

– তোমার আজকাল খবরই পাইনা। ভালো আছ তো। আমার এমনিতে ভালো। কখনও কখনও শরীরটা একটু খারাপ লাগে। তোমার কাছে যাব বলে ভাবতে ভাবতেই তুমি এসে হাজির হয়েছ।

রায়মেধির বুঝতে বাকি রইল না যে কাকাবাবু ভুল বকতে শুরু করেছেন।

অনন্তের দিকে তাকিয়ে রায়মেধি  বললেন–' দাদাকে একটু ধর, আমরা দুজনে তাকে সুন্দর করে বিছানায় শুইয়ে দিই।

– আজ তুমি যা করবে তাতেই আমার সায় আছে।

কাকাবাবু সোজা হয়ে এরকম ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রইলেন যেন তিনি নতুন করে কিনে আনা শার্ট-প্যান্ট শরীরে ঠিকমতো ফিট হচ্ছে কিনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছেন।

রায়মেধি এবং অনন্ত কাকাবাবুকে ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন।সৌম্যদা এবং উদয়শঙ্কর দূর থেকেই এই সমস্ত কিছু লক্ষ্য করতে লাগল। তাদের করার মতো বিশেষ কিছু ছিল না। পরিবারটার সদস্যরা সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে এবং প্রয়োজন হলে তাকে যখন তখন ডেকে দেবার জন্য বলে উপস্থিত দুই চারজনের কাছ থেকেই বিদায় নিয়ে রায়মেধিও চলে গেলেন।

সৌম্যদা এবং উদয়শংকর সুনন্দকে বলল – আমাদের আর এখানে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন নেই । সকালবেলা আসব। জ্যোতিষের মৃতদেহ আসতে নিশ্চয় দেরি হবে । কখন এসে পৌছাবে কাল জানা যাবে । ফৌজের মানুষ দেখছি এখনও আসেনি ।

– আমরা শিবিরে থাকতেই এসে কাকাবাবুকে বলে গেছে নাকি । প্রথমে খবরটা কাকাবাবুকে হেড অফিস থেকে ফোনে জানিয়েছে এবং ঠিক তারপরে তাদের একজন অফিসার এসে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে গেছে ।

– তারা তাদের দায়িত্ব অত্যন্ত সুচারুরূপে পালন করে।ফৌজের কাজ করার পদ্ধতিই আলাদা। উদয়শঙ্কর সুনন্দের কথায় সায় দিল।

রাতটা প্রত্যেকেরই কোনোমতে পার হল। অনেক দেরি পর্যন্ত সৌম্যদা এবং উদয়শঙ্করের ঘুম আসেনি অথচ দুজনেই কথা বলছিল না । কেবল উদয়শংকর সৌম্যদাকে জিজ্ঞাসা করেছিল – সৌম্যদা আপনার রাজধানীর টিকিট কাটা ছিল না ?

— ছিল।এভাবে চলে যাওয়া তো ঠিক হবে না। আমি আগামীকাল অথবা না পারলে পরশুদিন নাইট সুপারে চলে যাব।

শেষ রাতের দিকে দুজনেরই একটু তন্দ্রার ভাব এসেছিল।

ঘুমের মধ্যে উদয়শংকর বহুদিন পরে মায়ের দেখা পেল । তার কাল্পনিক অবয়বের মায়ের সঙ্গে সে অনেক কথাই বলল। কী কথা বলল সকালের দিকে সে ভুলে গেল।তার শুধু মনে আছে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল– মা সম্পর্কীয়দের দুঃখ-কষ্ট দিয়ে মানুষগুলি কেন অকালে মরে যায় মা? উত্তরে মা কি বলেছিল উদয়শঙ্কর সকালবেলা কিছুতেই  মনে করতে পারল না। হাতে দাঁত মাজার ব্রাসটা নিয়ে সে এক ভাবে  এক জায়গায় অনেকক্ষণ বসে রইল। সৌম্যদা পেছন থেকে এসে ডাকায় তার সম্বিত ফিরে এল।

হরিণের দোকানে ঢুকে সৌম্যদা এবং উদয়শংকর যখন কুশিয়ার চক হয়ে কাকাবাবুর বাড়িতে পৌঁছালো তখন সকাল ন'টা  বাজে। কাকাবাবু তখনও ঘুম থেকে উঠেননি। রায়মেধি আটটার সময় এসে পরিবারের সবাইকে পরীক্ষা করে বলেছেন সব ঠিকঠাক আছে। তাদের এখন শুয়ে থাকতে দিন। 

উদয়শঙ্কর এবং সৌম্যদা পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কয়েকটি গাড়ি এসে কাকাবাবুর বাড়ির সামনে দাঁড়াল। তারা গ্রামের গ্রাম প্রধানকে ডেকে আনাল। জ্যোতিষের শেষকৃত্য কোথায় সম্পন্ন করা হবে গ্রাম প্রধান এবং গ্রামের নেতৃ স্থানীয় লোককে জিজ্ঞেস করল। গ্রামের প্রত্যেকেই কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করতে হবে বলে জানাল। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আশা চিকিৎসক পরিবারের সবাইকে একবার পরীক্ষা করল এবং সন্তুষ্ট মনে বলল– সব ঠিক আছে।

সৌম্যদার পরিচিত অফিসারও একজন তাদের মধ্যে ছিল। সৌম্যদার সঙ্গে  নাকি অফিসারটার সিকিমে পরিচয় হয়েছিল বলে জানা গেল।সৌম্যদা অফিসারকে বড়ো কুরিহায় কেন আসতে হয়েছে জানাল। গত দুদিন কীভাবে সৌম্যদারা শিবিরের আয়োজন করেছে সেই বিষয়েও অফিসারকে জানাতে হল। সৌম্যদার কাজকর্মকে অফিসার এরকম অবস্থাতেও প্রশংসা করতে ভুললেন না। অফিসারটি সৌম্যদাকে জানিয়ে গেল – সন্ধের দিকে জ্যোতিষের নশ্বর দেহ পিতৃভূমিতে আসার সম্ভাবনা আছে।

দৌড়াদৌড়ি, দীর্ঘশ্বাস, কান্নাকাটি মাঝখানে দিনটি কীভাবে পার হয়ে গেল উদয়শংকর বুঝতেই পারল না। কাকাবাবু সারাদিনের মধ্যে যথেষ্ট প্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছেন যদিও মানুষটা কারও সঙ্গেই বেশি কথাবার্তা বলেনি । সুনন্দের বক্তব্য অনুসারে বাড়ির প্রত্যেকেই সেরকমই আচরণ করেছে। হয়তো জ্যোতিষের নশ্বর দেহ এসে যাবার পরে পরিস্থিতি আবার বদলে যাবে। উদয়শঙ্কররা দেখা করা কাকাবাবুও তাদের সঙ্গে এসেছে।তাঁরা আসার পরে যথেষ্ট গম্ভীর হয়ে পড়ল। অনামিকা কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারল না। কোনো অব্যক্ত বেদনা বেচারির গলা চেপে ধরেছে। অভাবনীয় পরিস্থিতিতে পড়ে বেচারি কাতর হয়ে পড়েছে।

কাকাবাবু জ্যোতিষের অন্তিম নিদ্রার জন্য স্থান নির্বাচন করে দিয়েছেন। বলেছেন– সে নদীকে খুব ভালোবাসত। তাতে সাঁতার কাটতে ভালোবাসত। আমাদের নদী তীরে মাটির গাছের নিচে বসে থেকে সে নদীর বেড়ে আসা জল দেখতে গিয়েছিল। সে সেখানেই থাকবে। অনন্তকাল তার প্রিয় নদীটার দিকে তাকিয়ে থাকবে।

বিএসএফের জোয়ান কয়েকজন স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় জ্যোতিষকে বিদায় জানানোর জন্য স্থাপন করা চিতা স্থানের তদারক করছে। নিজের সহকর্মীকে বিদায় জানানোর জন্য তারা আনুষ্ঠানিকতার সমস্ত দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখাশোনা করছে। কোথাও যেন কোনো খুঁত থেকে না যায়।

জ্যোতিষের শেষকৃত্য সমাপনের জন্য পাখির বাসা থেকে একটু দূরের নদীর তীরে সমতল  স্থান বেছে নেওয়া হয়েছে । সেটা জ্যোতিষের পিতৃভূমি । চিতা সাজানোর জন্য জায়গাটাকে বালি দিয়ে উঁচু করে বেঁধে নেওয়া হয়েছে । নির্দিষ্ট দূরত্বে জনসমাগমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে । চিতাটা সাজিয়ে তার চারপাশে রাশি রাশি করে ফুলের মালা সাজানো হয়েছে। অন্ধকার দূর করার জন্য দূর থেকে তার টেনে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জ্যোতিষকে সামরিক মর্যাদা সহকারে বিদায় জানানোর জন্য সমস্ত ব্যবস্থা আড়ম্বরপূর্ণ করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করা হয়নি । দুঃখের মধ্যেও সমগ্র পরিবেশটা উৎসবমুখর হওয়ার মতো দেখাচ্ছে।কাজগুলি যান্ত্রিকভাবে এগিয়ে চলেছে।

চিতার স্থান নির্বাচনে উদয়শঙ্করের আপত্তি ছিল। সেখানে চিতা সাজানো মানে পাখিদের প্রতিবেশীদের অসুবিধা হওয়াটা নিশ্চিত। তবে এই সময় কিছু বকের অসুবিধা হবে বলে বলার উদয়শঙ্করের সাহস হল না। অনামিকাকে বলতে পারলে হয়তো ফল পাওয়া যেত। মনের মধ্যে দোলা দেওয়া প্রতিক্রিয়া, উপায়হীন হয়ে নিজের মনের মধ্যে মেনে নিতে বাধ্য হয়ে পড়ল উদয়শঙ্কর।

বিএসএফের উদ্ধৃতি দিয়ে তার মধ্যে কেউ খবর দিয়েছে জ‍্যোতিষের নশ্বর দেহ বরঝার পৌঁছে গেছে। আর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাওয়া উচিত। সময় তখন দুপুর একটা বাজে। আশেপাশের কোনো বাড়িতে উনুন জ্বলে নি। পরিবারের কে কী খেয়েছে খবর নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। পরিবারের মূল মানুষ দুটি যদি জ্যোতিষদের বাড়িতে, ছেলেরা শ্মশান স্থানে, মেয়েরা বাঁধের ওপরে। উৎকণ্ঠিত সময় অনায়াসে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে।

তিনটের সময় সামরিক বাহিনীর গাড়িতে কফিনের ভেতরে জ্যোতিষের নশ্বর দেহ এসে পৌছাল। ছয় জন জোয়ান কফিনটা বহন করে এনে কাকাবাবুর উঠোনে রাখল। কান্নার রোল চারপাশে বিষাদ ছড়িয়ে দিল। আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা দুটি বেঞ্চের ওপরে কফিনটা রেখে কয়েকজন জোয়ান কফিনের আবরণ সরাতে লাগল। ঠিক সেই সময় ঘরের ভেতর থেকে জ্যোতিষের দিদি দৌড়ে এসে কফিনটার উপরে উবুর হয়ে পড়ল। এত ঠান্ডাতেও দিদি উড়তে থাকা শালটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। বিএসএফের দু একজন একটু সরে দাঁড়িয়ে দিদিকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মহিলার দিকে ইঙ্গিত করলেন। জ্যোতিষের জামাইবাবু দিদিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেও পারেনি। অর্ধসামরিক জোয়ান কয়েকজন নিরুত্তর। জামাই বাবুকে সাহায্য করার জন্য অনন্ত আর সুনন্দ এগিয়ে এল। অনন্ত আর সুনন্দ কোনোভাবে দিদিকে ধরে একটু সরিয়ে নিয়ে যেতে  সক্ষম হল। 

বিশেষ রাসায়নিক দ্রব্য ছিটিয়ে আনা জ্যোতিষীর নশ্বর দেহটা কফিনের ভেতর থেকে বের করে দুজন বেঞ্চের উপরে সাদা কাপড় পেতে সুন্দর করে সাজিয়ে তার উপরে ভারতের রাষ্ট্রীয় পতাকাটা সাজিয়ে দিল। রাশি রাশি ফুলের মালা এবং ফুলে সাজিয়ে তোলা হল ইহলীলা সংবরণ করা জ্যোতিষকে। বাড়ির ভেতর থেকে জ্যোতিষের মা এবং অনামিকারা বেরিয়ে এল। মা বারান্দা থেকে দৌড়ে এসে জ্যোতিষের মুখটায় একনাগারে কয়েকবার চুমু খেল।সৌম্যদা লক্ষ্য করল অনামিকা যথেষ্ট ধীর গম্ভীর। তিনি দেখে আশ্চর্য হলেন বধূটি দেখতে সাধারণ অসমিয়া মহিলার মতো শোকে কাতর হওয়ার মতো আচরণ করছে না। দেহান্তরিত হওয়া কোনো রাজনেতার পত্নীর মতো শান্ত এবং স্থির। অনামিকা জ্যোতিষের দু পা খামচে ধরে পা দুটির মাঝখানে মাথাটা গুঁজে দিল। মা এবং দিদি জ্যোতিষের শরীর দুই দিক থেকে জড়িয়ে ধরেছে। তারা কাঁদার শেষ শক্তিটুকুও ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে আসছে কিছু অস্ফুট যন্ত্রণাকাতর শব্দ। পাশের মহিলা একজন জ্যোতিষের পা দিয়ে অনামিকার সিঁথির সিঁদুর মোছে আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত করল।

অতি দুঃখজনক এবং শোক কাতর  পরিবেশের মধ্য দিয়ে জ্যোতিষকে পরিবারের লোকজন বিদায় জানাল। জামাইবাবু, জ্যোতিষের কাকাবাবুর ছেলেরা চাঙটা তুলে দেবার পরে চারজন জোয়ান জ্যোতিষের শেষ যাত্রার চাঙটা কাঁধ পেতে নিল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনামিকাও শব যাত্রার সঙ্গী হবার জন্য এগিয়ে এল। দুই একজন মহিলা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল।

– বাধা দিও না। ওকে যেতে দাও।কাকাবাবু মহিলা কয়জনকে বললেন।

অনামিকাকে বেরিয়ে আসতে দেখে জ্যোতিষের দিদি হেমাঞ্জলিও পাগলের মতো শোভাযাত্রার প্রথম ভাগে  ঢুকে পড়ল। উদয়শংকর প্রায়ই যে পথ দিয়ে পাখিদের প্রতিবেশীতে আসা যাওয়া করে, সেই পথ দিয়ে শোভযাত্রাটা এগিয়ে চলেছে। হাজারেরও বেশি মানুষের একটি শোভাযাত্রা। গ্রামের যুবক- যুবতী, বুড়ো- বুড়ি সবাই শোভাযাত্রায় যোগদান করেছে। এত অসংখ্য মানুষ অরণ‍্য পথটা একসঙ্গে ব্যবহার করার ফলে কী অবস্থা হতে পারে উদয়শঙ্কর একবার ভেবে দেখল। সবাই আবেগিক হয়ে আছে, এই সময় কাউকে কিছু বলার পরিবেশ নেই। কেবল বক গুলি বিশেষ কষ্ট না পেলেই হয়।

বহু সংখ্যক অর্ধ সামরিক অফিসার এবং জোয়ানের উপস্থিতিতে জ্যোতিষের নশ্বর দেহের শেষকৃত্য সমাপন করার জন্য প্রস্তুত করা হল। জ্যোতিষের কাকুর ছেলে হিতেশ মুখাগ্নির মাধ্যমে জ্যোতিষের নশ্বরদেহে অগ্নিসংযোগ করবে। পুরোহিত স্তোত্র পাঠ শুরু করেছে। চিতার উপরে নশ্বর দেহ সংস্থাপিত করা হয়েছে। শুভ্র পোশাক পরিহিতা অনামিকা হাত জোড় করে দাম্পত্য জীবনের সর্বস্ব অর্পণ করছে জ্যোতিষের উদ্দেশ্যে। নমস্কারের ভঙ্গিতে দুহাত দুই ঠোঁটের উপরে রেখে সে নির্বাক, নিস্পন্দ। যৌবনের দুপুর বেলা জীবনের সর্বস্ব হারিয়ে সে আজ ক্লান্ত। দিনকে বিদায় জানানোর জন্য দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রাশি রাশি অন্ধকার। 

অর্ধ সামরিক বাহিনীর অফিসাররা, জেলা প্রশাসনের অফিসাররা জ্যোতিষকে অনন্ত শয্যায় ফুলের মালায় শেষ বিদায় জানাল।হিতেশ হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে এগিয়ে চলেছে । অর্ধ সামরিক বাহিনীর কোনো অফিসার জ্যোতিষকে জানাচ্ছে সেলুট। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা জোয়ানরা তার নির্দেশ পালন করে চলেছে। হাতে থাকা রাইফেল গুলি বিশেষ ভঙ্গিমায় রেখেছে। হিতেশ এগিয়ে চলেছে। তার হাতে জ্বলন্ত মশাল। সে মশালটা মৃত জ্যোতিষের মুখে লাগিয়ে দিয়েছে এবং চিতার চারপাশে এক পাক ঘুরে চলেছে। পুনরায় পুনরাবৃত্তি করছে। জোয়ানরা হুকুম তালিম করার জন্য আকাশের দিকে রাইফেল তাক করেছে।

গুড়ুম– গুড়ুম– গুড়ুম।

আকাশ বাতাস নিনাদিত  করে রাইফেলের শব্দ চারপাশকে ঘিরে ধরল।

উদয়শঙ্কর দুহাতে নিজের মুখটা ঢেকে  ফেলল।

তাৎক্ষণিক অপরিচিত শব্দে কিচিরমিচির শব্দ করে পাখিগুলি সাগরে দিশাহারা নাবিকের মতো এদিক ওদিক উড়ে চলেছে। উদয়শঙ্কর দেখতে পেল ঠোঁট দিয়ে টক টক শব্দ করে কয়েকটি বকও উড়তে শুরু করেছে।

গুড়ুম –গুড়ুম- গুড়ুম।

গুড়ুম– গুড়ুম– গুড়ুম ।

তিনবার তোপধ্বনি করে রাইফেল গুলি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। প্রত্যেকেই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল– জ্যোতিষ অমর রহে।

নুন, তিল এবং ঘি ছিটিয়ে দেওয়ায় চিতার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।

উদয়শঙ্কর উড়তে থাকা বকের ঝাঁকটার দিকে লক্ষ্য করল। রাইফেলের শব্দ আর দপ দপ করে জ্বলে উঠা আগুনের আতঙ্কে শিহরিত হয়ে বকের ঝাঁকটা দিগ্বিদিক হারিয়ে যেদিকে সেদিকে উড়তে শুরু করেছে। নিজের বাসায় ফিরে আসার জন্য বলে মনে হচ্ছে। বকগুলি উড়ে গিয়ে দূরের একটি শিমুল গাছে এক এক করে বসতে লাগল। জ্যোতিষ ওদের দিকে কিছুক্ষণ নিমেষহীন ভাবে তাকিয়ে রইল।

ঘন্টা তিনেট পরে চিতার আগুন ধীরে ধীরে স্থিমিত হতে লাগল। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত করে জ্যোতিষের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে গেল। একজন দুজন করে শেষ দলটিও সেই স্থান পরিত্যাগ করল।

পাখিদের পাড়া পড়োশিতে বকের ঝাঁকটা আজ সম্ভবত পুনরায় ফিরে আসবে না! তবুও তারা কী করে দেখার জন্য উদয়শংকর সারারাত নিভন্ত চিতার কিয়দংশ উষ্ণতা নিয়ে সেখানেই থেকে যেতে চাইল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...