মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ৪৩ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das

 হে আমার স্বদেশ- ৪৩

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das



  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।

   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।


প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

(৪৩)

 এমনিতেও এত দিনের পরেও যখন লক্ষ্মীনাথ পাখির শিকার করে আনে, তখন তার হৃদয়ে রক্তের ফল্গুধারা প্রবাহিত না হয়ে থাকে না। তাই এটাতে কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি চতুষ্পদীয়  বন্যপ্রাণী শিকার করার মতো আবশ্যকীয় শক্তি এবং সাহস অর্জন করতে পারেন নি।তা বলে কোনোদিনই হিংস্র জানোয়ার শিকার করবেন না, এটাও তিনি মেনে নিতে পারেন না। নিজের মনটা দৃঢ় করার জন্য লক্ষ্মীনাথ মহাকবি কালিদাস শকুন্তলা নাটকে লেখা নিম্নোক্ত শ্লোকটি উচ্চারণ করতে লাগলেন,

'মেদশ্ছেকৃশোদরং লঘু ভবত‍্যুৎসাহযোগ‍্যং বপুঃ

সত্ত্বানামপি লক্ষ্যতে বিকৃতি মচ্চিত্তং ক্রোধয়োঃ।

উৎকর্ষঃ স চ ধন্বিনাং মদিষবঃ সিধ‍্যন্তি লক্ষে চলে

মিথ্যৈব ব্যসনং বদন্তি মৃগয়ামীদৃপিবনোদঃকুতঃ।।'


 অর্থাৎ মৃগয়ার দ্বারা মেদ কমে যাবার ফলে পেট ছোটো হয়, শরীর হালকা উৎসাহ বিশিষ্ট হয় এবং জীবদের ভয় ক্রোধ হলে ওদের কীরকম চিত্ত বিকার হয়, সেইসব জানতে পারা যায়। জন্তুগুলির দৌড়ে যাওয়ার সময় লক্ষভেদ করতে পারলে, শিকারির মনে আনন্দ হয়। তাই মনু প্রভৃতি শাস্ত্রকাররা যে মৃগয়াকে ব‍্যসন বলে দোষারূপ  করেছে, সেটা যথার্থ নয়। মৃগয়ার  মতো আমোদ অন্য কিছুতে নেই।

 উল্লিখিত শ্লোক উচ্চারণ করার পরে তার মধ্যে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হল। লক্ষ্মীনাথ চতুষ্পদীয় বন্যপ্রাণী শিকারের জন্য মানসিকভাবে শক্তিশালী এবং সাহসী হয়ে উঠা যেন অনুভব করলেন।

 সকাল ন'টা বেজেছে। একজন চাপরাশির হাতে বন্দুকটা দিয়ে লক্ষ্মীনাথ পরিবারের সঙ্গে বাংলো থেকে জঙ্গলে বেড়াতে বের হলেন। উদ্দেশ্য হল পাখি পেলে মারবেন। তারপরে সেটা বাংলোতে এনে রীতিমতো ভোজন করবেন। বাংলো থেকে পায়ে হেঁটে আধ মাইল  দূরে এলেন। বন্দুক নিয়ে চাপরাশি তাদের পেছন পেছন আসছে। প্রজ্ঞা এবং মেয়ে তিনটিকে নিয়ে ছোটো পর্বতের একটা বড়ো পাথরের ওপর ওঠে লক্ষ্মীনাথ দেখতে পেলেন, ভীষণ আকারের একটা বড়ো ভালুক বেরিয়ে তাদের সামনে দিয়ে গজেন্দ্র গমনে চলে যাচ্ছে। লক্ষ্মীনাথের মনে শিকারের বাসনা জেগে উঠল। পেছনের চাপরাশিকে চিৎকার করে ডাকলেন নটবর বন্দুক লে আও, জলদি বন্দুক লে আও—।' 

 কিন্তু চাপরাশি নটবর এতটাই পেছনে রয়েছে যে বন্দুক নিয়ে সে আর পৌঁছাতে পারল না।

বুড়ো ভালুকটি  বড়ো অদ্ভুত আচরণ প্রদর্শন করল। লক্ষ্মীনাথের তৎপরতা লক্ষ্য করেও বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে সে তাদের দিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাব প্রদর্শন করে ধীর মন্থর গতিতে অরণ্যে প্রবেশ করল।

 ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়া প্রজ্ঞা এবং কন্যা তিনজন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার পরে লক্ষীনাথও বুঝতে পারলেন সৌভাগ্যক্রমে তিনি নিজের বীরত্ব প্রকাশ করার সুযোগ পেলেন না। যদি চাপরাশিটা কাছে থাকত এবং তিনি যদি ভালুকটার গায়ে গুলি চালিয়ে দিতেন এবং গুলিটা মর্মস্থলে না লেগে যদি যেখানে সেখানে লেগে ভালুকটা জখম হত, তাহলে সে প্রলয়ঙ্করী  দৈত্য হয়ে আক্রমণ করে তার তীক্ষ্ণ নখ এবং সূঁচলো দাঁত দিয়ে তাদেরকে খন্ড খন্ড করে ফেলত এবং লক্ষ্মীনাথকে  সেখানেই সপরিবারে ভবলীলা সংবরণ করতে হত। এমনিতেও ভালুকের বড়ো কঠিন প্রাণ। দুই চারটি গুলিতে মরে না।

 ভালুকের বিষয়ে মজার একটা ঘটনা ঘটল। একবার তাড়িয়ে শিকার করার সময় গাছে বাধা মাচায় বসে লক্ষ্মীনাথ দেখলেন, দুটো ভালুক আগু-পিছু করে হেলে দুলে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মীনাথ মাচা থেকে আগেরটাকে গুলি করলেন। গুলি খেয়ে সামনে কাউকে না দেখে তার সঙ্গের ভালুকটাকে দেখে ভাবল যে সেই তাকে আক্রমণ করেছে। তৎক্ষণাৎ সে  ভালুকের সঙ্গে তুমুল সংগ্রামে প্রবৃত্ত হল।

 আজ পর্যন্ত চতুষ্পদীয় কোনো জীবকে গুলি করে ভূপতিত করতে না পারলেও লক্ষ্মীনাথ ভাবলেন, শিকারে তিনি হাত পাকিয়ে তুলতে পেরেছেন। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ায় শিকার করাটা তার কাছে এক নেশার মতো হয়ে উঠল। সম্বলপুর এবং আশেপাশের অঞ্চলের শিকারি মহলে লক্ষ্মীনাথ একজন বিশেষ ব্যক্তি হয়ে পড়লেন। কয়েকজন শিকারির সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের বন্ধুত্ব হল। তারা হলেন সম্বলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, এক্সাইজ সুপারিনটেনডেন্ট,তহশিলদার এবং সাব রেজিস্টার। কিছুদিনের ভেতরে লক্ষ্মীনাথ তাদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন এবং শিকার অভিযানে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা নিলেন।

 মেঘপালের জঙ্গলে বহুবার শিকার করার পরে লক্ষ্মীনাথ শিকারি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জামরায় শিকার করবেন বলে স্থির করলেন।

 জামরা জায়গাটা সম্বলপুর থেকে আট মাইল দূরে, মহানদীর তীরে। জামরার কাছে মহানদীর মাজুলী একটা আছে,নাম হীরাকুদ। সম্বলপুরে রাজার দিনে হীরাকুদে  হীরা পাওয়া যেত। বিশেষ এক ধরনের মানুষের কাজই ছিল হীরাকুদ থেকে হীরা এনে রাজা কে যোগান দেওয়া। দেশি রাজার রাজত্ব শেষ হল, হীরা খুঁজে আনার কাজও শেষ হল। সঙ্গে সঙ্গে সেই কাজ করা মানুষগুলিও হারিয়ে গেল।

 মহানদীর তীরে জামরা নামে জায়গাটিতে অনেক দিনের পুরোনো বড়ো বড়ো আমগাছ। আশেপাশে জনপদ না থাকা নির্জন পরিবেশ। গাছগুলির নিচটা ছায়াশীতল। এক কথায় বলতে গেলে সুরম্য ঠাঁই। কয়েকজন শিকারি বন্ধু ছাড়াও তাদের পরিচিত ২-৪জনের সঙ্গে নিজের নিজের পরিবারকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথের নেতৃত্বে প্রত্যেকেই জামরার আম্রকুঞ্জে বাসর পাতল।

 আম্রকুঞ্জের মনোরম পরিবেশে প্রত্যেকেই দুপুরবেলার খাবার গ্রহণ করবে। আহার প্রস্তুত করার জন্য সকালবেলা সম্বলপুর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে একজন রাঁধুনী এবং দুজন সহকারি পাঠিয়ে দেওয়া হল। জামরায় যাবার জন্য প্রস্তুত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন সাব জজ,একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন এবং অন্যজন আবগারি বিভাগের অফিসার। বাকিরা সরকারি হিসাবের সাধারণ কর্মচারী। কয়েকটি টাঙ্গায় তাদের নিয়ে লক্ষ্মীনাথ দিনের দশটার সময় পূর্বনির্ধারিত জায়গায় এলেন। দলে ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা এগারো জন। তার মধ্যে লক্ষ্মীনাথকে নিয়ে চারজন মৃগয়া লোলুপ, অন্য কয়েকজন বনভোজন এবং লক্ষ্মীনাথরা করতে যাওয়া শিকারের উত্তেজনার সঙ্গে শিকারের ফল ভোজন প্রয়াসী। দুজন আবার এই দুটো বিষয়ে উদাসীন। এই দুজনের উদ্দেশ্য হল পরিভ্রমণ এবং মহানদীর তীরে আম্রকুঞ্জের মনোহর পরিবেশে বিশুদ্ধ বায়ু সেবন। দায়িত্বশীল পত্নীদের আগমনের উদ্দেশ্য হল পতিদের সেবা যত্ন, শিকারে উৎসাহ বর্ধন এবং যাত্রার শোভা বর্ধন।

 পরিবারবর্গ ,মৃগয়ায় অনভিজ্ঞ অনাগ্রহীরা এবং উদাসীন কয়েকজনকে মহানদীর তীরের আম্রকুঞ্জের নৈসর্গিক শোভা উপভোগ করার সুবিধা দিয়ে লক্ষ্মীনাথ আর তিনজন শিকারি চা জল খাবার খেয়ে শিকারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

 বাসর স্থাপন করা জায়গা থেকে শিকারের জায়গার দূরত্ব এক মাইল। জায়গাটা একটা মাঝারি উচ্চতার পাহাড়ের পাদদেশ। বারোটার সময় লক্ষ্মীনাথ এবং তার তিনজন শিকারি নিজের নিজের মাচায় উঠে বসলেন। তারপরে বন্দুক হাতে নিয়ে অপেক্ষা পর্ব। তাদের সামনে জন্তু-জানোয়ার বের হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ওদের গুলি করে ভূপতিত করবেন বলে আশা করে রইল।

 ইতিমধ্যে টিন কোবানোর সঙ্গে উৎকট চিৎকার চেঁচামেচিতে খেদা আরম্ভ হল। বিটররা দেড় মাইল দূর থেকে তাড়া করে জঙ্গলে থাকা জন্তু-জানোয়ারদের শিকারি কয়েকজনের কাছে নিয়ে এল। দুপুর একটার সময় তাড়া যারা করেছিল কাছে চলে এল।

এমন সময় লক্ষ্মীনাথ বসে থাকা মাচার নিচে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি শোনা গেল। মানে কোনো জন্তু এগিয়ে এসেছে। লক্ষ্মীনাথের হাতে ৫০০ নম্বর এক্সপ্রেস বন্দুক। তিনি বন্দুকের ঘোড়ায় হাত দিলেন। তারপরে দেখলেন, পর্বতের চূড়া থেকে বিশাল আকারের একটি জানোয়ার নেমে আসছে।তিনি  সেদিকে বন্ধুকের নিশানা করে গুলি করার জন্য প্রস্তুত হলেন। উত্তেজনার সঙ্গে ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেল। বুকটা ধক ধক করতে লাগল। আর বুকের ধক ধক এতই জোরে হতে লাগল যে তার কানে স্পষ্টভাবে পড়তে লাগল।

 এটা তার এক অতি মানসিক অবস্থা। অবশ্য সামনে থাকা হিংস্র জানোয়ারকে শিকার করার চরম মুহূর্তে অভিজ্ঞ শিকারিদেরও এই ধরনের অবস্থা হয়।

 মর্মর ধ্বনিটা কাছে চলে আসায় লক্ষ্মীনাথ দেখলেন, একটা বড়ো দাঁতাল শুয়োর পর্বত থেকে নেমে লক্ষ্মীনাথ বসে থাকা মাচানের দিকে এগিয়ে আসছে। তার বুকের ধক ধক বেড়ে গেল। তিনি আর আগের মতো দুর্বল মনের শিকারি নন। তাছাড়া এখন মায়া-মমতার মতো দুর্বলতা প্রকাশ করা মানেই সুযোগ হারানো। লক্ষ্মীনাথ নিজেকে সামলে নিলেন। নিজেকে সুস্থির করে নিয়ে লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে প্রচন্ড শব্দে গুলি চালিয়ে দিলেন।

 অব্যর্থ লক্ষ্য।

 এইবার লক্ষ্মীনাথ সফল।

 এক গুলিতে দাঁতাল শুয়োরটা মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। তার শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে মাটিতে জমাট বাঁধল এবং ক্ষণিকের ভেতরে শুয়োরটা তার জীবন লীলা সমাপ্ত করে নিঃসার হয়ে পড়ে রইল।

 তারপরেই খেদার অন্ত পড়ল। চারপাশ থেকে সবাই চেপেচুপে কাছে চলে এল। লক্ষ্মীনাথ এবং তার সঙ্গী শিকারি তিনজন মাচা থেকে অবতরণ করলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের কেউ কোনো কিছু শিকার করতে পারলেন না। তথাপি তারা প্রত্যেকেই লক্ষীনাথকে কনগ্রাচুলেশন জানালেন। অতি আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ তাদের অভিনন্দন গ্রহণ করলেন।

 বিকেল চারটের সময় চারজন শ্রমিক সাঙী করে বিশাল আকারের দাঁতাল শুয়োরটাকে তারা মহানদীর তীরে আম্রকুঞ্জে নিয়ে এল। জানোয়ারটা দেখে সবার ভীষণ আনন্দ হল।

 ' কোন সাহেব নে মারা?' নৈসর্গিক শোভা উপভোগ করা উপেন্দ্র মহান্তি উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন।

 শুয়োরটাকে বহন করে আনা আধ বয়সী মানুষটা বললেন ,'বুড়ো সাহেব নে মারা।'

 আসলে এখানে বুড়ো মানে বৃদ্ধ নয় বুড়ো মানে বরুয়া, বেজবরুয়ার বরুয়া এবং বরুয়ার অপভ্রংশ বুড়া।

 শিকার করে আনা শুয়োরটাকে নিয়ে এভাবে আনন্দ করার সময় একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। বনভোজের সঙ্গী মহিলাদের ভেতরে একজন মহিলা যেই শুনলেন যে শিকার করতে যাওয়া তার স্বামী শুয়োরটাকে গুলি করে মারেনি, লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া সাহেব শুয়োর বধ করেছেন, তখন সেই মহিলা ক্রোধে অগ্নিশৰ্মা  হয়ে পড়লেন। তারপর তিনি যখন শুনলেন যে তার হাকিম স্বামীর ভাগ্যে কোনো জন্তু বধ সংঘটিত হয়নি তখন মুখটা পেঁচার মতো ফুলিয়ে তিনি ভীষণ রোষ প্রকাশ করলেন।তাঁর বয়স্ক স্বামী যে পত্নী পরাধীন, এটা সর্বজনবিদিত। শিকার থেকে ঘেমে নেয়ে আসা স্বামীর সঙ্গে তিনি সবার আগে সত্যাগ্রহ আরম্ভ করলেন। স্বামীর সঙ্গে মৃগয়ার বিষয়ে কথা বললেন না এবং চা জল খাবারও খেতে দিলেন না। এমনকি ক্রোধের পরিমাণ এতটাই বাড়ল যে তিনি বনভোজনে আহারও গ্রহণ করলেন না। বেচারা স্বামী! পত্নীর এই ধরনের অশোভন আচরণে তার মুখটা শুকিয়ে ঝুলে পড়ল।

 বাকিরা মহানন্দে খাওয়া দাওয়া করে, মজা করে রাতে বাড়ি ফিরে এলেন। 

 পরের দিন সকালে লক্ষ্মীনাথ নিজের কাজের লোক দিয়ে বন্য শুয়োরের একটা টেংরি সেই অভিমানী হাকিমনীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু হাকিমনীর অভিমান এবং লক্ষ্মীনাথের ওপরে বিরক্তি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে শুয়োরের টেংরি নিয়ে যাওয়া কাজের লোককে গালিগালাজ করে  ফিরিয়ে দিলেন।

 লক্ষ্মীনাথের খারাপ লাগল। এত আনন্দ ফুর্তির মধ্যে দুর্ভাগ্যজনক এই ঘটনাটি তাকে বহুদিন পর্যন্ত দুঃখ দিল। যাই হোক না কেন, চারপেয়ে জন্তু শিকারের সাফল্যের ট্রফি বা জয়ের চিহ্ন স্বরূপ শুয়োরের মাথাটা লক্ষ্মীনাথের সম্বলপুরের বৈঠকখানা ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হল। 

 এই ঘটনাটা ঘটার পরে লক্ষীনাথ সম্বলপুরের একজন সুদক্ষ শিকারি হিসেবে প্রখ্যাত হয়ে পড়লেন। কিন্তু তিনি নিজেকে এখনও একজন সাধারণ শিকারি বলেই মনে করেন। কারণ বড়ো শিকারি হতে হলে যে অন্তত একটি বাঘকে  শিকার করতে হয়, তাতে সফল হতে পারেন নি। রাজার জন্য পৃথকভাবে রাজ বৈদ‍্য বা বেজবরুয়া থাকে। কেবল তার হাতের বড়ি খেয়ে রাজা বাঁচে বা মরে আর সেই জন্যই রাজা সেই ব্যক্তিকে বেজবরুয়া খেতাব দান করে । আজ পর্যন্ত কোনো বনের  বাঘ লক্ষ্মীনাথের হাতে বড়ি বা গুলি খায় নি। বনের রাজাকে রাজপ্রাণ সংহারিনী একটা বটিকা খাওয়ানোর জন্য কতদিন কত রাত তিনি গাছের উঁচু ডালে মাচায় হাতে বন্দুক নিয়ে সজাগ হয়ে খাপ পেতে বসে রইলেন, কিন্তু কোনো একটি বনের রাজাকে কোনোমতেই  রাজি করাতে পারলেন না।

 নিজে বেজবরুয়া হয়ে এই ব্যর্থতাকে আর কতদিন বহন করে বেড়াবেন?না, কিছু একটা করতেই হবে। তাই ব্যর্থতাকে ঝেড়ে ফেলার জন্য লক্ষ্মীনাথ পরমাণপুর নামে একটি জঙ্গলে যাত্রা করলেন। গহন অরণ্যের উঁচু গাছের ডালে মাচা বাঁধা হল। তাদের প্রত্যেকেই এক একটি পৃথক মাচায় বসলেন।

 শিকার পর্ব আরম্ভ হল।

 অন্যদিক থেকে তাড়া করা মানুষগুলি বাঘকে তাড়িয়ে আনতে লাগল। মাচায় বসে লক্ষ্মীনাথ দেখলেন, একটা লেজ কাটা বাঘ এগিয়ে আসছে। কিন্তু এতদূর দিয়ে যাচ্ছে যে তার বন্দুকের গুলি নাগাল পাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গলের ঝোপের মধ্যে বাঘটা অদৃশ্য হল। মহাপ্রতাপী বনের রাজার এই ধরনের আবির্ভাব এবং অর্ন্তধান লক্ষ্মীনাথকে হতাশ করল। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে তিনি বার চারেক দাঁত কড়মড় করলেন।

খেদা বন্ধ হল। লক্ষ্মীনাথ এবং তার সঙ্গী তিনজন শিকারি নিজের নিজের মাচা থেকে নেমে এলেন। জঙ্গল থেকে ফিরে যাবার জন্য পা চালিয়েছেন, এমন সময় বাঘটাকে তাড়া করা একজন মানুষ এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, সে একটা নালার মধ্যে বাঘটাকে শুয়ে থাকতে দেখেছে।  

 মানুষটা এভাবে বলতেই সকলের মনে ত্রাসের সৃষ্টি হল। তাড়াকরাদের মধ্যে যে সমস্ত যুবক একটু সাহসী প্রকৃতির তারা দৌড়ে গিয়ে কাছের গাছে উঠল। কয়েকজন বিকট শব্দ করে পর্বতের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছাল। শিকারি তিনজনের দুজন নিজের নিজের মাচায় উঠে বসলেন। এখন লক্ষ্মীনাথ আগের মতো দুর্বল মানসিকতার শিকারি নয়। এদিকে সঙ্গে আসা তৃতীয়জন শিকারি সাহসী। হাতে রাইফেল নিয়ে তার সঙ্গে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে ধীরে ধীরে বাঘ শুয়ে থাকা নালাটির দিকে এগিয়ে গেলেন।

  শিকারি বন্ধুটি সামনে, লক্ষ্মীনাথ পেছনে।

 সেই জায়গায় উপস্থিত হয়ে লক্ষ্মীনাথ লতা-বনানীতে ঢেকে থাকা নালার ভেতরে উঁকি দিয়ে তাকালেন, হ্যাঁ একটা বাঘ শুয়ে আছে। সঙ্গী শিকারি বন্ধুটি লক্ষ্মীনাথকে সাবধান করে তার সঙ্গে সঙ্গে এগোতে বললেন এবং নিজেই জন্তুটার দিকে পরপর দুটি গুলি ছুঁড়লেন।

 বাঘ নামে জন্তুটি গুলি খেয়ে কোনোরকম উচ্চবাচ্য করল না। সঙ্গের শিকারিটি তখন ঘোষণা করলেন— আর কোনো ভয় নেই, বনের রাজা মরে কাঠ হয়ে গেছে।

 তাড়া করা মানুষগুলি ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছাল। ওদের ভেতরে দুজন সাহসী ছেলে এগিয়ে এগিয়ে বনের রাজার মৃতদেহ টেনে এনে বের করার পরে দেখা গেল এটা বাঘ নয়, বনবিড়াল ও নয়, হায়েনা।

 সবাই সমস্বরে হেসে উঠল। আসলে বাঘের গায়ে যে ধরনের ঢেকীয়ার মতো আঁচ থাকে, হায়েনার গায়েও ঠিক সেই রকমই আঁচ থাকে। তার মানে এবারও লক্ষীনাথের বনের রাজা শিকার একটা প্রহসনে পরিণত হল।

 লুডলড়ি জঙ্গলের মধ্যে তৈরি বাংলো। দুপুরের আহারের শেষে লক্ষ্মীনাথ বাংলোর বাইরের দিকের বারান্দায় বসে আছেন। এমন সময় লুডলড়ি থেকে পাঁচ মাইল দূরের চামুন্ডা থেকে এসিস্ট্যান্ট কনজারভেটর অফ ফরেস্ট এসে উপস্থিত হলেন।

 তিনি একজন সরকারি অফিসার। লক্ষ্মীনাথ সম্মান প্রদর্শন করে তাকে বসতে বললেন । কিন্তু তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে রয়েছেন । চেয়ারে না বসে উৎকণ্ঠিত কন্ঠে বললেন ,তাঁর চামুন্ডার বাংলো থেকে আট মাইল দূরে কাল রাতে একটা বাঘ একটা গরুকে মেরে রেখে গেছে। আজ বিকেলে নিশ্চয় বাঘটা সেই গরুটাকে খেতে আসবে ।

তার জন্য তিনি গরু মরে থাকা জায়গাটার কাছে দুটি গাছে দুটি মাচা বাধার জন্য সেখানকার মানুষকে লাগিয়ে রেখে এসেছেন।তাই লক্ষ্মীনাথকে তার সঙ্গে যেতে হবে । লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে বসে তিনি বাঘটাকে শিকার করবেন।

 তার মানে বনের রাজা শিকারের আরও একটা সুযোগ এসে গেছে। এবার মনের মধ্যে পুষে রাখার বহুদিনের আশাটা পূরণ হবে। লক্ষ্মীনাথ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। তখনই এসিস্ট্যান্ট কনজারভেটরের সঙ্গে জঙ্গলে এসে বন্দুক নিয়ে ইতিমধ্যে বাধা মাচায় উঠে বসলেন।

 বনের রাজা আসবে— লক্ষ্যভেদ করে লক্ষ্মীনাথ বনের রাজা শিকারের শিরোপা পরবেন। শিকারে তিনি কৌলীন্যের মর্যাদা লাভ করবেন। দিকে দিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। অধীর আগ্রহে লক্ষ্মীনাথ অপেক্ষা করছেন। রাত ন'টা বাজল, বাঘ ভাইয়া অনুগ্রহ করে দেখা দেয়নি। এটা ঠিক যে বাঘটি  আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। তারা যে মাচায় বসে আছেন, এটা বুঝতে পেরেই বোধহয় বেরিয়ে আসছে না।

 আরও এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পরে বনের রাজার কৃপা না পেয়ে মাচা থেকে নেমে বাড়িতে ফিরে যাবেন বলে স্থির করলেন। কিন্তু মাচা থেকে নামার মৈ নেই। এদিকে অন্ধকার। উঠার সময় গাছ বেয়ে উঠে ছিলেন। নেমে আসার সময় আধা পথ থেকে লক্ষ্মীনাথ পিছলিয়ে নিচে পড়লেন।

 ' ইস ইস– আপনি জখম  হয়েছেন—।'এসিস্টেন্ট কনজারভেটর দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,' আর ইউ ফিলিং পেইন ,স্যার?'

 মাটিতে পড়ে কোমরে ব্যথা পেয়েও বীর সেনাপতির মতো লক্ষ্মীনাথ বললেন,' নো নট এট অল।'

 কোমরের ব্যথা নিয়েও অদম্য উৎসাহী লক্ষ্মীনাথ চামুণ্ডার এসিস্ট্যান্ট কনজারভেটরের বাংলোতে এসে আলোচনা করে স্থির করলেন, আগামীকাল সেই জঙ্গলের অনেক দূর থেকে খেদা করাবেন। খেদা করালে জঙ্গলে কোথাও শুয়ে থাকা বাঘটা এদিকে ওদিকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে।

 পরের দিন খেদা আরম্ভ হল।চার কুড়ি মানুষ জঙ্গলের তিন দিক ঘিরে বাঘটাকে লক্ষ্মীনাথ এবং ফরেস্ট কনজারভেটর বসে থাকা মাচানের দিকে তাড়া করে নিয়ে এল। তারা একটু দূরত্ব রেখে দুটি পৃথক মাচায় বসে আছেন । একটা ছোটো নালা দিয়ে বাঘটা লক্ষ্মীনাথের দিকে এগিয়ে এল। লক্ষ্মীনাথের বুকের ধক ধক এর সঙ্গে উত্তেজনা বেড়ে চলল। বনের রাজা শিকার করার সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। কিন্তু বাঘটা কাছে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে মাত্রাধিক উত্তেজনবশত লক্ষীনাথ তাড়াহুড়ো করে গুলি ছুঁড়লেন। লক্ষ্য স্থির না হওয়ার জন্য গুলিটা বাঘের গায়ে লাগল না। বন্দুকের শব্দ শুনে বাঘ তার লেজটা খাড়া করে পাশ কাটিয়ে এসিস্ট্যান্ট কনজারভেটরেৰ দিকে দৌড়ে গেল । তিনিও লক্ষীনাথের মতোই উত্তেজিত অবস্থায় গুলি চালালেন । তার গুলিটাও বাঘের গায়ে লাগল না।

 এভাবেই লক্ষ্মীনাথের বনের রাজা শিকারের অন্য একটি অসফল প্রচেষ্টার গ্লানিদায়ক সমাপ্তি ঘটল।

 পুনরায় ব্যর্থতা। বনের রাজাকে শিকার করার ধারাবাহিক ব্যর্থতা লক্ষ্মীনাথকে ভেতরে ভেতরে হতাশ করে তুলল। বিশেষ করে সেদিন চামুণ্ডায় যা ঘটল, সেটা নিয়ে খেদা করা মানুষরা যেভাবে কানাকানি করেছে বলে শুনলেন, লক্ষ্মীনাথের কাছে তা নিতান্তই অপমান সূচক। এই সমস্ত তাকে খুব পীড়া দিতে লাগল। তা বলে তিনি সহজে দমে যাবার পাত্র নন। এইবার তিনি মনে মনে শপথ নিলেন, বাঘ শিকার করতেই হবে।

 বাঘ শিকারের আরও একটি সুযোগ এল দুর্গাপালি গভর্মেন্ট রিজার্ভ ফরেস্টে। সম্বলপুরের ডেপুটি কমিশনার, ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট কনজারভেটরের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ বাঘ শিকারে বের হলেন। খেদা আরম্ভ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই লক্ষ্মীনাথ বসে থাকা মাচার পঞ্চাশ হাত দূরে একটি চিতা বাঘ দেখতে পেলেন। লক্ষ্মীনাথ বাঘটির মাথায় গুলি করার জন্য নিশানা করতে যেতেই তার সঙ্গে মাচায় বসা অ্যাসিস্ট্যান্ট কনজারভেটর অফ ফরেস্ট খপ করে তার হাতটা ধরে বললেন,' ওয়েট, মিস্টার বেজবরুয়া, ওয়েট।'

 বন্দুকের ঘোড়ায় হাত দিয়েও লক্ষ্মীনাথ অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। বাঘটাকে  এগিয়ে আসতে দেখে লক্ষ্মীনাথ পুনরায় বন্দুকের নিশানা করতে উদ্যত হলেন। এবারও একই অবস্থা হল। পুনরায় আগের চেয়েও জোরে লক্ষ্মীনাথের হাত চেপে ধরে কনজারভেটর বললেন,' নো মিস্টার বেজবরুয়া হেভ পেশেন্স।'

 বিরক্ত হয়ে লক্ষ্মীনাথ বললেন,' ওহো ইট ইজ এ গোল্ডেন মোমেন্ট ।পেশেন্স উইল কিল দিজ গোল্ডেন মোমেন্ট।'

 কিন্তু কনজারভেটর সম্ভবত ভয় পেয়েই লক্ষ্মীনাথের হাত ছেড়ে দিল না। এদিকে বাঘের কি গরজ পড়েছে যে সে শিকারি দুজনের বাক- বিতণ্ডা শুনে তাদের কাছে গলা পেতে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? চৌদ্দ হাত লাফ মেরে বাঘ অরণ্যের ভেতরে অন্তহিত হল।

অর্থাৎ পুনরায় লক্ষ্মীনাথ বনের রাজাকে  শিকার করার একটি সুযোগ হারালেন। পুনরায় তার মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি ভাবতে বাধ্য হলেন, বাঘ শিকারের গৌরবার্জন করাটা হয়তো তার ভাগ্যে নেই। হতাশাগ্রস্ত হয়ে লক্ষ্মীনাথ শিকার করার আত্মবিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলতে লাগলেন। এভাবেই কয়েকদিন পার হয়ে গেল। এদিকে ব্যর্থতাকে স্বীকার করে শিকার করাটা বাদ দেবেন, সেটাও পারছেন না। তাই লক্ষ্মীনাথ পুনরায় সুযোগের সন্ধানে রইলেন।

 পুনরায় চামুণ্ডা জঙ্গলের নিকটবর্তী চামগুড়ি জঙ্গল। এবারও শিকারের সঙ্গী হিসেবে রইলেন সম্বলপুরের ডেপুটি কমিশনার। চামুণ্ডার বাংলোটি বড়ো। তবু পরিবারের সঙ্গে সবাই চার দিন থাকার জন্য তিনটি সুন্দর তাঁবু প্রস্তুত করা হল। সরকারি খরচে থাকা খাওয়া এবং আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথের সেই সবে এতটা আগ্রহ নেই। তার একটাই মাত্র উদ্দেশ্য, বাঘ শিকার। বাঘ শিকার করে পূর্বের ধারাবাহিক ব্যর্থতার প্রতিকার করা।

 সেই উদ্দেশ্যে বাঘ থাকার জঙ্গলে একটা 'কিল' অর্থাৎ জন্তুর কাঁচা মাংসের টোপ বেঁধে রাখা হল।'কিল' রাখা জায়গার কাছে উঁচু গাছে মাচা বেঁধে বন্দুক নিয়ে লক্ষীনাথ এবং তার শিকারি বন্ধুরা বন্দুক হাতে বাঘের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। বিকেল চারটে থেকে সারারাত, ভোর হয়ে সকাল ছয়টা পর্যন্ত তারা মাচার ওপরে বসে রইলেন। কিন্তু বাঘ তাদের দেখা দিল না। তা বলে লক্ষ্মীনাথ ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। এবার তাকে বাঘ শিকার করতেই হবে। পরেরদিন বিকেল পর্যন্ত তারা পুনরায় নিজের নিজের মাচায় উঠে বসলেন। কিন্তু…

 ভাগ্যের কী বিড়ম্বনা! অন্ধকারের মধ্যে লক্ষ্মীনাথ নিজের রাইফেল ম্যাগাজিনে চারটি গুলি একটা নলির ভেতরে ভরলেন। তারপরে তিনি বুঝতে পারলেন যে গুলি গুলি'জাম' মানে নাড়াচাড়া করছে না। বিব্রত লক্ষ্মীনাথ হাত দিয়ে সেই 'জাম' ছড়াতে চেষ্টা করতেই হঠাৎ তার থেকে একটা গুলির আওয়াজ হল। এইবার লক্ষীনাথ আরও বিব্রত হয়ে পড়লেন। ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিজের ভুল সারাতে যেতেই আরও একটি গুলির আওয়াজ হল। ভাগ্য ভালো যে গুলি দুটি যাবার পথে কেউ ছিল না। থাকলে হয়তো একটা ভয়ানক কান্ড হয়ে যেত। এদিকে গুলি দুটির আওয়াজে সমগ্র জঙ্গলে হুলুস্থুল  পড়ে গেল। কাছে থাকা বাঘ দূর-দূরান্তে পালিয়ে গেল।

 তাই তারপরে বাঘ শিকারের আশায় বসে থাকাটা অর্থহীন। লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে থাকা প্রতিটি শিকারি বিমর্য মুখে নিজের নিজের মাচা থেকে নেমে এলেন।

 এটা বিপর্যয়। লক্ষ্মীনাথই এই বিপর্যয়ের কারণ। তাঁর দ্বারাই এই বিপর্যয় ঘটল। তিনিই সবার শিকারের আনন্দে ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন। লজ্জা ,দুঃখ, অপমান বোধের যন্ত্রণায় লক্ষ্মীনাথের অন্তর বিষন্ন হয়ে পড়ল। তাঁর মনে নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মাল। সাত্ত্বিক বংশ কুলে জন্ম নিয়ে বনের রাজাকে শিকারের দ্বারা লক্ষ্মীনাথ নিজেকে রাজসিক বৃত্তিতে উন্নীত করতে পারলেন না। হাতের রাইফেলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তিনি মনে মনে শপথ করলেন,' আজ থেকে আমি আর রাইফেলে হাত দেব না।'


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...