শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ৪৪ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev DasHe Amar Swadesh

 হে আমার স্বদেশ- ৪৪

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das







  লেখক পরিচিতি--এ সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।


(৪৪)

সম্বলপুরে আসা দু'বছর হল। বার্ড কোম্পানি উড়িষ্যা এবং বিহার সরকার থেকে নেওয়া জঙ্গলগুলির পরিদর্শনের সঙ্গে জঙ্গলের কাঠ কেটে শ্লিপার তৈরির কাজের দায়িত্ব  অর্পণ করেছিল লক্ষ্মীনাথের ওপরে। নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার জন্য লক্ষ্মীনাথ কোম্পানির কর্মকর্তাদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলেন। অফিসিয়াল আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও তাদের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্ক গড়ে উঠল। তারা সম্বলপুরে এলে লক্ষীনাথের বাড়িতে অতিথি হয়ে খাওয়া-দাওয়া করতে লাগলেন। তাই পরিশ্রম হলেও কোম্পানির কাজ করে লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগে।তাছাড়া কোম্পানি থেকে বেতনাদি,বাড়ি-ঘর,চাকর-বাকর এবং টাঙার খরচ পাওয়ায়  এখন তার আর্থিক অবস্থাও ভালো।

  মেয়ে অরুণা কলকাতার ডায়োসেশন কলেজে বিএ পড়ছে। রত্না এবং দীপিকা ও সেই শিক্ষানুষ্ঠানের ছাত্রী। পড়াশোনায় ওদের অগ্রগতি সন্তোষজনক।। পড়াশোনা ছাড়া ওরা সংগীতের চর্চা করছে। তাই কলকাতায় ছেড়ে আসার সময় মেয়েদের লেখাপড়ায় অসুবিধা হতে পারে ভেবে যে একটা দুশ্চিন্তা ছিল সেখান থেকে লক্ষ্মীনাথ মুক্ত হতে পেরেছেন।

 কলকাতা ছেড়ে সম্বলপুরে আসার সময় সবচেয়ে বেশি করে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন ‘বাঁহী’র সম্পাদনা এবং প্রকাশনাকে নিয়ে। লক্ষ্মীনাথ ভেবেছিলেন সম্বলপুরে থেকে ‘বাঁহী’র প্রকাশের সমস্ত কাজ করাটা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তার জন্য সম্পাদনার দায়িত্বটা নিজের হাতে রেখে লক্ষ্মীনাথ ‘বাঁহী’র প্রকাশনা এবং পরিবেশনের দায়িত্বটা কলকাতার ৪৫ নম্বর হ্যারিসন রোডে থাকা অমিয় কুমার দাস,  ধীরেন্দ্রনাথ আগরওয়ালা, রাজেন্দ্রনাথ বরুয়া ইত্যাদি জনকয়েক উদ্যোগী ছাত্রের হাতে অর্পণ করেছিলেন।সেটা সুবিধাজনক হল না দেখে এক বছর পরে যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা করে ‘বাঁহী’র পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন  ডিব্রুগড়ে থাকা বন্ধু চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা কে। চন্দ্রকুমারের সম্পাদনায় ‘বাঁহী’প্রকাশের পর থেকে সেই চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারলেন।

এদিকে গত দুটো বছরের মধ্যে লক্ষ্মীনাথ কয়েকজন আত্মীয়কে হারালেন। সময়ের প্রবাহের সঙ্গে এরকম ঘটনা ঘটবেই। তথাপি নিজের আত্মীয়কে হারানোটা বেদনা দায়ক। শিবসাগর থেকে জয় দাদার মৃত্যুর সংবাদ (১৮১৮ সনের ১৬ আগস্ট)এল। তারপর একই বছরে ৬ ডিসেম্বর গোলাঘাটে লক্ষীনাথের সবচেয়ে আদরের শ্রীনাথ দাদা মৃত্যুবরণ করলেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের কথা তারপরের দিন সদ্য মৃত শ্রীনাথ দাদার পত্নী এবং পুত্র  অকালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন।

 কলকাতার বাইশ নম্বর রোজমেরির বাড়িটা (লরেলস)লক্ষ্মীনাথের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। লরেলসে থাকার বছরগুলিতে লক্ষ্মীনাথের সাহিত্য সৃষ্টির ধারা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে ছিল। সেখানে থেকেই তিনি ‘বাঁহী’ সম্পাদনা করে বের করেছিলেন। সেই বাড়িটিতে প্রতিদিন বিকেলে যতীন্দ্রনাথ,জ্ঞানদাভিরা্‌ম এবং কলকাতায় পড়তে আসা অসমিয়া ছাত্রদের সঙ্গে অসম, অসমিয়া জাতি, অসমিয়া সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হতেন। কিন্তু সম্বলপুরে স্থায়ীভাবে থাকার পর থেকে ২২ নম্বর রোজমেরির লরেলসের বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণ করাটা লক্ষ্মীনাথের পক্ষে অসুবিধা জনক হয়ে পড়ল। তার জন্য তিনি বাড়িটা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং চব্বিশ হাজার টাকায় বিক্রির জন্য রামনাথ সাহা থেকে ১০১ টাকা অগ্রিম বায়না নিলেন। কিন্তু রেজিস্টার করে ক্রেতাকে দখলস্বত্ব দেননি। পরে মূল্য বেড়ে যেতে দেখে সেই বায়নার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে ১৯১৮ সালের ৫ জুলাই একত্রিশ হাজার টাকায় লরেলস একজন মারোয়ারির কাছে বিক্রি করলেন।

লরেলস বিক্রি করার পরে সম্বলপুর থেকে কলকাতায় এসে প্রজ্ঞা এবং  তিন মেয়ে জোড়াসাঁকো অথবা বালিগঞ্জে ভায়রা আশুতোষ চৌধুরীর বাড়িতে থাকে। এদিকে বার্ড কোম্পানির কাজে অথবা অন্যান্য কারণে লক্ষ্মীনাথকে প্রায়ই কলকাতা আসতে হয়। তিনি থাকেন হাওড়ায় ভোলানাথ বরুয়ার বাড়িতে অথবা ঠাকুর বাড়িতে।এদিকে নতুন  পরিবেশে নিজের গতিশীল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নগরের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি এবং সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে প্রায়ই মৃগয়ায় যাওয়ার ফলে এবং সামাজিক কার্যসূচিগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য গত দুই বছরে লক্ষ্মীনাথ নিজেকে সম্বলপুরের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেন। সম্বলপুরে অনুষ্ঠিত সরকারি অথবা স্থানীয় উড়িয়া সমাজের সভা-সমিতি থেকে তাকে আমন্ত্রণ করতে লাগল। এভাবে প্রবাস যদিও কলকাতা যেভাবে তার জন্য নিজের বাসভূমির মতো হয়ে পড়েছিল, সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক দিকে এতটা সমৃদ্ধ না হলেও সম্বলপুরও তার কাছে মনোরম বাসস্থান হয়ে উঠল।সম্বলপুরের জনজীবন থেকেও লক্ষ্মীনাথ জীবনের রস খুঁজে পেলেন। 

 তাই কলকাতা ছাড়ার দুঃখ ভুলে সমস্ত কিছুর সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে এখন লক্ষ্মীনাথ সম্বলপুরে স্থিতিশীল, সুখী। কিন্তু সেদিন রাতের আহার খেয়ে ঘুমোতে যাবার সময় প্রজ্ঞা বলল অরুণা বড়ো হয়েছে, তাকে বিয়ে দিতে হবে। পরের দিন সকালবেলা অরুণার দিকে তাকিয়ে তিনি মেয়েকে নতুন এক রূপে দেখতে পেলেন।হ্যাঁ রূপ যৌবনে অরুণা সত্যি দেখছি বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে । সুপাত্র খুঁজে তার বিয়ে দেওয়াটা পিতা মাতার কর্তব্য । এই চিন্তাটা লক্ষ্মীনাথ কে কিছু পরিমাণে অস্থির করে তুলল।

  বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া অরুণার বয়স কুড়ি বছর। শিক্ষিতা, চেহারা আকর্ষণীয় ,কথাবার্তা শান্ত, বুদ্ধিমতী অরুণাকে বিয়ে দেবার পরে সে পতিগৃহে চলে যাবে কথাটা ভাবতেই লক্ষ্মীনাথ কীরকম হয়ে পড়েন। অরুণা বাড়িতে থাকবে না, অরুণাবিহীন বাড়ির দৃশ্য মনে পড়তেই তার চোখ দুটি সজল হয়ে উঠে।

প্রজ্ঞা স্বামীর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারেন । তিনিও অরুণার মা ।কন্যাকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বের বের করে দেওয়াটা মায়ের জন্য কম বেদনাদায়ক নয়। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে প্রজ্ঞা ধীরে ধীরে বলল, কন্যা সন্তান যখন, তাকে তো চিরকালের জন্য মায়ের ঘরে রাখা যাবে না।রাখাটা সংসারের নিয়ম নয় ।তাই পাত্ৰস্থ  করে তাকে সাংসারিক জীবনে এগিয়ে দিতে হবে।

  অবশেষে লক্ষ্মীনাথ সুযোগ্য পাত্রের সন্ধানের জন্য আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে লাগলেন ।কিন্তু অরুণার সঙ্গে মানিয়ে নেবার মতো সুদর্শন উচ্চ শিক্ষিত সংস্কৃতিবান এবং অভিজাত বংশের অসমিয়া কোনো ছেলের সন্ধান পেলেন না। এই ক্ষেত্রে আর ও একটি অসুবিধা হল লক্ষ্মীনাথের ব্রাহ্ম কন্যাকে বিয়ে করা নিয়ে। তিনি নিজে মহাপুরুষীয় বৈষ্ণব ধর্ম অনুসরণ করে নাম সংকীর্তন জপ-তপ করলেও অসমে থাকা তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতরা তাকে ব্রাহ্ম বলেই মনে করেন ।তাদের ধারণা ব্ৰাহ্ম  এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই।এখন ও তারা পুরোনো সংস্কার অতিক্রম করতে পারেনি। এই সমস্ত ভেবে লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া পাত্রের সঙ্গে অৰুণার বিয়ে দেওয়ার কথাটা বাদই দিলেন। তারপরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজনের সামনে কথাটা উত্থাপন করলেন। কিন্তু ঠাকুরবাড়িতে থাকা  সদস্যদের মধ্যে আগের সেই  পারিবারিক বাঁধনটা  আর নেই।ভায়রা ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরীও কোর্ট কাছারি মামলা মোকদ্দমা ছাড়া সাাংসারিক কথায় উদাসীন। এমনিতেই একদিন প্রজ্ঞা এবং দীপিকার সঙ্গে নিয়ে ছাড়ার থেকে রেলের সম্বলপুরে যাবার সময় বৰোদা থেকে আসা সুপ্রকাশ কর নামে একজন প্ৰৌঢ়ের সঙ্গে পরিচয় হল। আগে থেকে পরিচয় থাকা সুপ্রকাশ  করের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পরে যোগ্য পাত্রের কোনো সন্ধান আছে কিনা লক্ষ্মীনাথ জানতে চাইলেন।

সুপ্রকাশ কর বললেন একজন উপযুক্ত পাত্র আছে। কিন্তু তিনি চাকরি করেন  বরোদার রাজার রাজসভায়। বরোদা মুম্বাই থেকে আরও কয়েক ঘন্টার রেল ভ্ৰমণ। অরুণাকে বিয়ে দিয়ে এতদূর পাঠাতে হবে ভাবতেই লক্ষ্মীনাথের পিতার মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রজ্ঞা বাস্তববোধ সম্পন্ন মহিলা। ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রজ্ঞা বললেন দূর কোনো সমস্যা নয়। জাতি ,ভাষা ও বাধা নয় ।পাত্র শিক্ষিত স্বাস্থ্যবান এবং সাংস্কৃতিক চেতনায় উদার হতে হবে। সেটা হলে পাত্রের অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে ।তখন সুপ্রকাশ কর জানালেন পাত্রের পিতা-মাতার বিষয়ে তিনি বিশেষ কিছু জানেন না। কিন্তু পাত্রের ভগ্নিপতি একজন কলকাতার বালিগঞ্জে থাকেন।

পাত্রের নাম কী, বরোদার রাজার রাজসভায় কী ধরনের পদে অধিষ্ঠিত জানতে চাইলে সুপ্রকাশ কর জানালেন পাত্রের নাম সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় ,বরোদা রাজ্যের সেন্সাস কমিশনার।

সত্যব্রত  নামটা শুনেই লক্ষ্মীনাথের পরিচিত বলে মনে হল। এদিকে প্রজ্ঞা ও ভাবী জামাতার প্রতি কৌতুহলী হয়ে পড়লেন। কিন্তু উড়িষ্যার এই ঝাড়চোগোড়া বা সম্বলপুর থেকে বরোদায় থাকা সত্যব্ৰত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবেন এটা নিয়ে চিন্তিত হতে দেখে প্রজ্ঞা বলল,' তুমি বাপু মেয়ের বাবা। প্রস্তাব নিয়ে তোমাকে পাত্রের অভিভাবকদের কাছে যেতে হবে।'

' অরুণা কি আমার কোনো দিকে খুঁত থাকা মেয়ে যে বাবা হয়ে আমি পাত্রের অভিভাবকের কাছে ছুটে যাব?' উষ্মা প্রকাশ করে লক্ষ্মীনাথ বললেন, তাছাড়া আমাদের পারিবারিক প্রথা হল কন্যা বিবাহযোগ্যা হলে পাত্রের তরফ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে।

‘আসাম দেশের নিয়ম তো  আর এদেশে চলবে না।মেয়ের বাবা হিসেবে তোমাকে নম্র হতেই হবে।’

‘ তা কীভাবে কতটুকু নম্র হব তুমি বল।’

‘ বরোদাতে গিয়ে পাত্রের সঙ্গে দেখা করে তুমি সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দাও। আর সঙ্গে যদি অরুণাকে নিয়ে যাও তাহলে আরও ভালো হবে।’

‘আমি বাবা যখন আমার যাওয়াটা তবু ঠিকই আছে। তা বলে অরুণাকে সঙ্গে নিয়ে যাব, এসব কী বলছ বুঝতে পারছি না।’

‘ওগো বিয়ের পর মেয়ে যাতে সুখী হতে পারে তার জন্য বাবা মায়েরা এইটুকু করেই থাকেন। আর তুমি দেখবে, একবার দেখার পর সত্যব্রত আমাদের অরুণাকে পছন্দ না করে থাকতে পারবে না।

‘ তথাপি—?’

‘ আহা, তুমি যে সত্যব্রতকে দেখানোর জন্যই অরুণাকে নিয়ে যাচ্ছ সেটা বলবে না।অরুণাকে নিয়ে বোম্বাই বরোদা বেড়াতে গিয়েছ। তাছাড়া অরুণা শিক্ষিত মেয়ে যার সঙ্গে ঘর-সংসার করবে তাকে আর পছন্দ হয় কিনা সেটাও তো আমাদের দেখতে হবে নাকি

 প্রজ্ঞা এত কিছু বলার পরেও লক্ষীনাথ অরুণাকে  সঙ্গে নিয়ে বরোদায় যাবার উৎসাহ পেল না । এরকম মনে হল যে এভাবে যাওয়াটা ঠিক  হবে না।এদিকে উচ্চশিক্ষিত বরোদা রাজ্যে রাজবিষয়া সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়কে হারাতেও চাইছেন না। অবশেষে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অরুণার দিকে তাকিয়ে লক্ষীনাথ জিজ্ঞেস করল ‘কী মা অরুণা সত্যি তুই আমার সঙ্গে বরোদাা যাবি?’

লজ্জিতভাবে বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি শেষে অরুণা বলল—‘হ্যাঁ যাব।’

 অবশেষে লক্ষ্মীনাথ এবং অরুণা ঝাড়চোগোড়ার থেকে বরোদায় যাত্রা করল। উনিশ সেপ্টেম্বর (১৯২০ সন) সকাল আটটার সময় মুম্বাই ভিক্টোরিয়ার টার্মিনালে পৌছাল। সেখান থেকে বরোদায় যাবার সকাল সাতটা  কুড়ি মিনিটের ট্রেনটা পেল না। আট টাকার বিনিময়ে দুজনে হোটেল মেট্রোপলিতে আহার করে রাত পো্নে নটার সময় কাথিহার এক্সপ্রেসে উঠলেন।পরের দিন সকাল আটটার সময় বরোদা পৌঁছালেন। তারা যে আসবেন টেলিগ্রাম করে প্রকাশ করকে জানিয়েছিলেন। সেই অনুসারে সুপ্রকাশ স্টেশন থেকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাবার জন্য মানুষ পাঠিয়ে দিলেন। লক্ষীনাথ এবং অরুণা দ্রুত তাদের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। আদর-অর্ভ্যথনায় সুপ্রকাশ আন্তরিক। অরুণাকে নিয়ে লক্ষীনাথের থাকা খাওয়ার অসুবিধা হল না। সুপ্রকাশ সেদিন বিকেলে সত্যব্রত মুখার্জীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করলেন।

বিকেলে সত্যব্রত সুপ্রকাশ করের বাড়িতে এল। উঁচু লম্বা গৌরবর্ণ সাজ পোশাকে সাহেব সত্যব্রতকে দেখেই লক্ষীনাথের ভালো লেগে গেল। এদিকে সত্যব্রত যেভাবে অরুণার দিকে তাকাচ্ছে তাতে সে অরুণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে বলে মনে হল। অরুণার চোখে মুখে মুগ্ধ ভাব ফুটে উঠল। চা জল খাবার খাবার পরে অরুণা গান গাইল। উপস্থিত প্রত্যেকেই অরুণার সললিত কন্ঠের প্রশংসা করল।। গানের আসর শেষ হওয়ার পরে সবাই সুপ্রকাশ আয়োজন করা রাতের আহার খেতে বসল। আহার খেতে শুরু করে  সত্যব্রত অরুণাকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করল।

সত্যব্রতের এই সরলতা এবং স্পষ্টবাদিতা লক্ষীনাথের ভালো লাগল। পরের দিন সুপ্রকাশের সঙ্গে সত্যব্রত দেওয়া গাড়ি করে বরোদার জাদুঘর দেখল। সত্যব্রত নিজের বাংলোয় লক্ষ্মীনাথ অরুণা এবং সুপ্রকাশকে দুপুরের খাবার খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানালেন। কয়েক ধরনের সুস্বাদু ব্যঞ্জনে ভোজনের পরে সত্যব্রত অরুনার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য লক্ষ্মীনাথের অনুমতি চাইলেন। লক্ষ্মীনাথ আধুনিক মনের মানুষ।তিনিও সানন্দে অনুমতি দেওয়ায় অরুণা সত্যব্রত বাইরে বেরিয়ে একে অপরের কাছে মনের কথা ব্যক্ত করল। তারপর দুজনেই একসঙ্গে এসে যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছার কথা জানাল তখন লক্ষ্মীনাথের পিতৃ হৃদয় আনন্দে ভরে উঠল। দুই হাতে দুজনকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আবেগ ভরা ভারী কন্ঠে বললেন— ‘তোমরা আমাকে ধন্য করলে, আমি খুব খুশি হয়েছি।’

 এদিকে সিদ্ধান্ত হলেও ‘পাকা কথা’ বলে একটা আনুষ্ঠানিকতা থাকে। তার জন্য পরের দিন সকালে আয়োজন করা হল।বরোদায় সত্যব্রতের পিতা-মাতা অথবা   আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই।সত্যব্রতের অভিভাবক হলেন বরোদার চিফ জাস্টিসের মিসেস টায়াবজী।। মিসেস টাায়াবজী দুটো গিনির আংটি পরিয়ে অরুণাকে আশীর্বাদ করলেন।। রাতে ঘুমোতে এসে লক্ষ্মীনাথের প্রজ্ঞার কথা মনে পড়ল। তিনি চিঠি লিখতে বসলেন। 

'পরি,

… আমি সত্যব্রতকে দুটো গিনির আংটি দিয়ে আশীর্বাদ করেছি। সেও গিনির আংটি দিয়ে অরুণাকে আশীর্বাদ করেছে। ছেলে আমার মনের মতো হয়েছে। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি সত্যব্রত তোমারও মনের মতো হবে। যেমন বিদ্বান তেমনই সচ্চরিত্র। সত্যব্রত এখানকার সকলের প্রিয় পাত্র। আমি যেমন সব বিষয়ে সরলতা ভালোবাসি সেও অবিকল আমার মতো। ভগবান আমাদের কৃপা করলেন, তাই আমাদের মনের মতো জামাই দিলেন।

… আগামী সোমবার বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা জানাবার জন্য সত্যব্রত স্টেট ডিনারের মতো পার্টি দেবে। শুক্রবার চলে যাবার দিন ঠিক কিন্তু সত্যব্রত ছাড়ল না । এখানকার প্রত্যেকেই অরুণাকে বিখ্যাত বিউটি বলছে । সত্যব্রতেরও একই ওপিনিয়ন। সে একটি বহুমূল্য রত্ন পেয়েছে বলে অহংকারে উৎফুল্ল হয়ে বেড়াচ্ছে । আর একটা আমোদজনক কথা শোনো, সত্যব্রত মিলিটারি গোঁফ রেখেছিল। তোমার মেয়ের এক কথায় গোঁফ কামিয়ে ফেলেছে।….

ইতি তোমার লক্ষ্মীনাথ।  

বরোদা থেকে সম্বলপুরে আসার পরেই অরুণার বিয়ের প্রস্তুতি আরম্ভ হল। বিয়ের পাকা কথা হওয়ার দিনই বর কনের আশীর্বাদ হয়েছে। সেদিনই বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিয়ের তারিখ হল ১৭ নভেম্বর (১৯২০) সন। তাই বেশি দিন নেই ।

এদিকে এই প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠান হতে চলেছে। সম্বলপুরে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যদিও এখানে লক্ষীনাথ-প্রজ্ঞার আপন আত্মীয়-স্বজন নেই। এর মধ্যে আবার মেয়ের বিয়ে বলে কথা। বিয়ের জন্য শুধু অর্থবল থাকলেই হয় না লোকবলের ও প্রয়োজন।এ সমস্ত নিয়ে কথা বলতে  যেতেই প্রজ্ঞা পরামর্শ দিল যে বিয়েটা কলকাতার জোড়াসাঁকোতে হতে হবে।বিষয়টা নিয়ে টেলিফোনে ব্যারিস্টার ভায়রা আশুতোষ চৌধুরী এবং প্রজ্ঞার দিদি প্রতিভা দেবীর সঙ্গে কথা বলার পর একই অভিমত পাওয়া গেল।। জোড়াসাঁকোর  থেকে ঋতেন্দ্রনাথেরও একই মত।এভাবে আত্মীয়-স্বজনের উপদেশ-পরামর্শ শুনে লক্ষ্মীনাথও ভাবলেন,জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে অরুণার বিয়ে দিলে সুবিধা হবে এবং অভিজাতভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে।

বার্ড কোম্পানির কর্মকর্তা মিঃকার্ক পেট্রিককে অরুণার বিয়ের কথা বলতেই লক্ষীনাথের জন্য পনেরো দিনের ছুটি মঞ্জর করা হল। বিয়ের কাপড়চোপড় অলংকার কেনার জন্য অরুণাকে নিয়ে কিছুদিন আগে থেকেই জোড়াসাঁকোর  ঠাকুরবাড়িতে থাকতে লাগলেন। রত্না এবং দীপিকাকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ নভেম্বরের পাঁচ তারিখ কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সম্বলপুর থেকে যাওয়া ট্রেনে করেই ভাবী জামাই  সত্যব্রত মুখার্জি বরোদা থেকে এসেছিল।ঝাড়চোগোড়াায় তাকে দেখতে পেয়েই লক্ষ্মীনাথ আনন্দিত হলেন। সত্যব্রত তাড়াতাড়ি ভাবী শশুর মশাইকে তার কামরায় আসার জন্য বলল। লক্ষ্মীনাথ রত্না দীপিকাকে মহিলাদের কামরায় তুলে দিয়ে ভাবী শ্বশুর জামাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে হাওড়ায় এসে উপস্থিত হলেন।

হাওড়ার ডবসন রোডের বাড়িতে ভোলানাথ থাকেন। লক্ষ্মীনাথও এভাবে আসার কথা ভোলানাথ জানে। তার জন্যই দায়িত্ববোধ সম্পন্ন ভোলানাথ ড্রাইভারের সঙ্গে নিজের ট্যাক্সিটা স্টেশনে পাঠিয়ে দিলেন। তার স্বাস্থ্যটা ভালো নয় বলে শুনে সবাইকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথকে দেখতে এলেন।। সত্যি ভোলানাথ সুস্থ নয়। আগের চেয়ে রোগা হয়ে গেছেন। লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথের সঙ্গে সত্যব্রতের পরিচয় করিয়ে দিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পরে চা-জল খাবার খেয়ে সত্যব্রত বালিগঞ্জে থাকা তার বোনের বাড়িতে চলে গেল। রত্না দীপিকাকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ জোড়াসাঁকোয় ফিরে এলেন।

  জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে।আত্মীয়-স্বজনের আগমনে ঐতিহ্যমন্ডিত ঠাকুরবাড়ি প্রাণ পেয়ে উঠল।সুগৃহিনী প্রজ্ঞা নতুন বউদের সঙ্গে নিয়ে অরুণার বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে আরম্ভ করলেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কীভাবে পালন করা হবে, বরযাত্রীদের কীভাবে আপ্যায়ন করা হবে, কোথায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে, বিয়ের পুরোহিত সমস্ত ঠিক করা হল। তথাপি বিয়ে বলে কথা। তার মধ্যে আবার মেয়ের বিয়ে। হাজারটা নিয়ম, সেই সমস্ত নিয়ম পালনের জন্য হাজারটা কাজ করতে হয়। তবে লক্ষ্মীনাথ সৌভাগ্যবান যে আত্মীয়দের জন্য সে সমস্ত করতে হল না। তিনি নিমন্ত্রণের দায়িত্ব নিলেন। সুদীর্ঘ আঠাশ  বছর কলকাতায় ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজন ছাড়া বন্ধুবান্ধব, ব্যবসায়িক সহযোগী কম নয়। নিমন্ত্রণ করতে যাওয়ার সময় এক সময়ে কলকাতার এক নম্বর কাঠের ব্যবসায়ী কালী কৃষ্ণ প্রামাণিকের ছেলে উদার হৃদয় মন্মথ প্রামাণিক নিজের ট্যাক্সিটা দিলেন। সেটা নিয়ে লক্ষ্মীনাথ নিমন্ত্রণ পর্ব শেষ করলেন।

  ১৫ নভেম্বর গায়ে হলুদ। স্নান করানোর পরে অরুণা কনে সাজার জন্য তৈরি হল। অরুণা বিয়ের দুদিন পরেই মা-বাবাকে ছেড়ে, দুই বোনকে ছেড়ে চলে যাবে। বিয়ের পরদিন থেকে অরুণা আর তাদের সঙ্গে থাকবে না। এটাই নিয়ম। এটাই সমস্ত মেয়েদের ক্ষেত্রে হয়। লক্ষ্মীনাথও সেটা জানে। তথাপি কী এক যন্ত্রণা,কী এক অবুঝ  আবেগ লক্ষ্মীনাথের বুকটাকে ভারী করে তুলল।

 সব সময় সবাইকে আনন্দ দান করা লক্ষ্মীনাথকে  হঠাৎ চুপ করে যেতে দেখে প্রজ্ঞা তার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। তিনি স্বামীকে ভেতরের ঘরে ডেকে আনলেন।শান্ত করুণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বললেন— ‘তুমি তো আমার থেকে জ্ঞানী। তোমার প্রজ্ঞাবোধ আমার থেকে অনেক ওপরে। বিয়ের আগের দিন তুমি এরকম করলে আমার কী হবে? আমি কীভাবে মেয়ের বিদায় সহ্য করব বল।’

‘পরি, আমি—আমি বুঝি—।’ লক্ষীনাথের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে পড়ল, অরুণা শ্বশুর বাড়ি যাবেই, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মনটা মেনে নিতে পারছে না। ও চলে গেলে আমার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যাবে।’

  ‘সুরভি তো তোমার মাথার মনি ছিল।’ প্রজ্ঞার কণ্ঠস্বর ভারী, ‘তুমি কি কখনও ভেবেছিলে সুরভি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে?’

‘পরি—না, দয়া করে ওর কথা ওভাবে বল না।’

‘ওভাবে বলছি না। সুরভি অকালে সংসারের মায়া ত্যাগ করে  চলে যাওয়াটাকেও যে তুমি সহ্য করেছ, সেটাই তোমাকে বোঝাতে চাইছি। কিন্তু অরুণার এই যাওয়াটা তেমন নয়। তাছাড়া তুমি তো সাহিত্যিক, কবি। তোমার মন উদার। উদার মন দিয়ে তুমি অনেক কিছু অনায়াসে গ্রহণ করতে পার। স্নেহের বন্ধন অতিক্রম করে তুমি কেন ভাবতে পারছ না যে সত্যব্রতকে বিয়ে করে আমাদের অরুণা জীবনের পরিপূর্ণতার দিকে এগোচ্ছে।

 অশ্রুসজল লক্ষ্মীনাথ অপলক নয়নে পত্নী প্রজ্ঞার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার এরকম মনে হল যেন প্রজ্ঞার আলোকে প্রজ্ঞা সত্যিই সুন্দর। তারপরে প্রজ্ঞা যখন তার কোমল উষ্ণ ডান হাতটা লক্ষ্মীনাথের বা হাতে আলগোছে রাখল তখন লক্ষ্মীনাথের দেহ মনে অদ্ভুত এক অনুরণন খেলে গেল।আর তখন তার মধ্যে তিনি অনুভব করলেন সবাই চলে গেলেও প্রজ্ঞা তাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।

 লক্ষীনাথের ইচ্ছা অনুসরণ করে বরোদার রাজ্যরত্ন সত্যব্রত মুখার্জির সঙ্গে অরুণার বিবাহ সম্পন্ন হল। লক্ষ্মীনাথ নিজে কন্যা সম্প্রদান করলেন।। সম্প্রদানের পরে তার দুই চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে লাগল।

  পরের দিন বাসি বিয়ের পরে অরুণা সত্যব্রতের সঙ্গে বালিগঞ্জে চলে গেল। এই বিদায়টাও লক্ষীনাথের কাছে হৃদয়বিদারক। তিনি সহ্য করতে পারলেন না। বাড়িতে থাকতে পারলেন না।বিয়ে দিয়ে বের করে দেওয়া মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে এখনই যেতে নেই  বলে প্রজ্ঞা এবং আত্মীয়-স্বজনরা বোঝানো সত্ত্বেও লক্ষ্মীনাথ একটা টেক্সি করে জোড়াসাঁকো থেকে বালিগঞ্জে এলেন।

বিয়ে করে কনে নিয়ে বাড়িতে আসার এক ঘন্টা পার না হতেই শ্বশুরের আগমন। লক্ষ্মীনাথকে দেখে সত্যব্রতের বাড়ির প্রত্যেকেই আশ্চর্য হল কিন্তু সন্তানের স্নেহ মমতায় বিবশ লক্ষ্মীনাথের মনে বুদ্ধি জ্ঞান কাজ করছে না। তিনি সত্যব্রতকে ডেকে পাঠালেন। সত্যব্রত এলে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে আবেগজড়িত কন্ঠে বললেন—বাবা জীবন সত্য এভাবে এসেছি বলে কিছু মনে কর না। অরুণা মাকে নিয়ে তোমরা চলে আসার পর আমি আর থাকতে পারলাম না। সবাই নিষেধ করা সত্ত্বেও চলে এলাম।

 ‘ঠিক আছে এসে ভালোই করেছেন। আপনি থাকুন, এখানেই থাকুন।’

 ‘না, বাবাজীবন আমি থাকব না। এখন এটাই তো মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের বাবার প্রথম বছর থাকতে নেই। লক্ষ্মীনাথ বললেন মানে কথাটা হল অরুণা মা তোমাদের বাড়িতে নতুন। তুমি ছাড়া এখানে সবাই ওর অপরিচিত। ওদের সঙ্গে ওর অসুবিধা, থাকা খাওয়ার ব্যাপারে ওর—।’

 ‘একি বলছেন, বাবা!’ লক্ষ্মীনাথকে শেষ করতে না দিয়ে ব্যস্ত ভাবে সত্যব্রত বলে উঠল ,আমার সঙ্গে অরুণার বইয়ে দিয়ে আপনি তো আমাকে ধন্য করেছেন। অরুণাকে পেয়ে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান। কোনো কিছুতে ওর অসুবিধা হবে, এটা কি আমার সহ্য হবে? না বাবা, আপনি ওকে নিয়ে একটুও চিন্তা করবেন না।’

 ‘না বলছিলাম কি, খাওয়া দাওয়াতে ওর কিছু বাছ বিচার আছে। কাতর কণ্ঠে লক্ষ্মীনাথ বললেন, ‘খাবার টেবিলে বসে এটা খাব না ওটা খাব না বলে। ওর মা ওর পছন্দ মতো খাবার রান্না করে খাওয়ায়। তুমি যদি নিজে ওর খাওয়ার ব্যাপারটা একটু নজর দাও।’

  ‘নিশ্চয় দেব। সত্যব্রত বলল, ‘তাছাড়া বরোদা যাওয়ার পর অরুণাই তো রান্নাঘর সামলাবে। ওখানে আমার একজন ভালো খানসামা আছে। আমি খানসামাটিকে অরুণার পছন্দ অনুসারে রান্না করতে বলব।’

  তারপরেও যেন লক্ষ্মীনাথের কথা শেষ হয় না। অরুণার ভালোলাগা খারাপ লাগার কথাগুলি বলে কী কী করতে হবে সেইসবও সত্যব্রতকে বলতে ইচ্ছা হল কিন্তু রাত হয়ে গেছে। এদিকে বাইরে ড্রাইভার ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করছে।।অবশেষে অন্দরমহলে ঢুকে  হাসিমুখে কথা বলতে থাকা অরুনাকে দেখে লক্ষ্মীনাথের বুকের যন্ত্রণা কমল। তারপরে অরুণাকে  বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে তিনি তার মাথা পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন—‘মা ভালো থাকিস। সবাইকে আপন করে নিয়ে সুখী হোস বলে  প্রাণ ভরে আশীর্বাদ জানিয়ে অশ্রু সজল চোখে বিদায় নিলেন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...