পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ১
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi
তৃতীয় অধ্যায়, প্রথম অংশ ।। পাখিদের পাড়া- পড়শী
......
তৃতীয় অধ্যায়
এক
রামমলের রান্না, বিলাস পাশোয়ানের লন্ড্রি, ব্যাংকের নির্দিষ্ট চেয়ারটা এবং আমার শোবার ঘরের নির্দিষ্ট বিছানাটার আবর্তে আমার জীবন চরকি থেকে একটা বছরের অধিক কাল অতিবাহিত হল। ব্যাংকের চাকরির হইচইয়ের মধ্যে পড়ে পাখিদের পাড়া-প্রতিবেশীর সবুজময় দিনগুলির কথা আমি প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যে সুনন্দ ফোন করে, কাকা বাবু ফোন করে। ব্যাংকের ব্যস্ততার মধ্যে ফোন করলে নৈমিত্তিকভাবে তাদের প্রত্যুত্তর দিই। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করি। তারা আমার খবর জিজ্ঞাসা করলে বলি–আমার খবরের সোম—শনি নেই। প্রতিদিন একই।
মাঝেমধ্যে সুনন্দ জিজ্ঞেস করে—- উদয়দা, কবে আসবে?
__ যাব দাঁড়াও। সময় করে উঠতে পারছি না।
__ আপনার সত্যিই আমাদের কথা মনে পড়ে কি?
আমি নিরুত্তর হয়ে যাই।
__ তোমাদের মনে পড়ে। কিন্তু আবার ভুলে যাই।
একদিন অপরিচিত একটা ফোন নাম্বার থেকে একটি অপরিচিত মেয়ের কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
__ দাদা। আপনি ভালো আছেন?
__ হ্যাঁ ভালো আছি। আমি অতি সংক্ষেপে উত্তর দিলাম।
__ দাদা।আমাদের আপনার একেবারে মনে পড়ে না?
__পড়ে কিন্তু—-
আমাদের কথা মনে পড়ে বলছেন যে বলুন তো আমি কে?
আমি একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।
__ তুমি আমাদের প্রকৃতি শিবিরে অংশগ্রহণ করেছিলে না।
__ করেছিলাম।আমি জ্যোতিমালা।
__নামটি শোনা শোনা বলে মনে হচ্ছে।
__কী বলছেন দাদা আপনি? আমাদের সত্যিই ভুলে গেলেন। আমি সুনন্দদার বোন।
__ তুই যে ফোন করতে পারার মতো আজকাল লজ্জা থেকে মুক্ত হলি, সাহস গোটাতে পাড়ার মতো হলি আমি কীভাবে জানব।
__ সেই জন্যই আপনার এখানে একবার আসা উচিত।আসুন আবার।
__ যাচ্ছি দাঁড়া, লজ্জাশীলা মেয়েটি যে নির্লজ্জ হলি, কথায় পটু হলি সেটাই দেখতে যেতে হবে।
কাকাবাবু বহুদিন খবর নেয়নি। আমিও নিই নি। ভুলে গেলে ভুলে যাওয়াটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে যায়। মাঝেমধ্যে মনে পড়ে, ভাবি ফোন করব পরে আবার কাজের চাপে ভুলে যাই। একদিন কাকাবাবুর ফোন পেলাম। কাকাবাবু ফোনে বলা কথাগুলি ছিল প্রশ্নবোধক, ক্ষোভ উপহাস এবং তাচ্ছিল্যের মিশ্রণ।
— তুমি যদি ছেলে মেয়েদের একটা গতি করে দিতে না পার ওদের সময় নষ্ট করলে কেন? ওদের মনে নেশা ধরিয়ে মাঝপথে ছেড়ে দিলে হবে!
— কাকাবাবু।
— কথাটা এরকম নয়। তুমি এখানে আসার পর ছেলে মেয়েদের মনের পরিবর্তন হয়েছিল। ওরা তোমাকে অবলম্বন করে সমাজের উন্নতিকল্পে কিছু একটা করার হয়তো আশা করেছিল।
— কাকাবাবু আমাকে বলতে দেবেন?
— বল। বল।
— আমি কী করব তার পরিকল্পনার জন্য সময় দিতে হচ্ছে। সমস্ত প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ। আমি বৈশাখ মাসের বিহুর আগে উপস্থিত হব।
কাকাবাবু আমার কথায় সায় দিলেন এবং এভাবে বলার জন্য কিছু মনে না করতে অনুরোধ করলেন। আমি বুঝতে পারি আন্তরিকতার মাত্রাধিক্যতার জন্য বিভিন্ন জন অত্যধিক উষ্মার সঙ্গে নিজেকে প্রকাশ করে। জ্যোতিষের মৃত্যুর পরে কাকাবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। পুত্র শোকে জর্জরিত হয়ে মানুষটির মনের গঠনের কোনো পরিবর্তন হয়ে থাকে যদি আমি দূর থেকে অনুমান করতে পারিনি। বৃদ্ধ অবস্থাও কাকাবাবুর ওপরে আধিপত্য স্থাপন করতে পারে। আমি জানিনা।
— আমি শুনেছি গুলির শব্দ এবং চিতার আগুন বকগুলির অনিষ্ট করার জন্য তুমি নাকি খারাপ পেয়েছ এবং সেই জন্যই তুমি আসছ না। সত্যি নাকি?
কাকাবাবু আমাকে আক্রমণ করছে না আমার কাছ থেকে সত্য কথা জানার প্রয়াস করছে আমি বুঝতে পারলাম না। তবুও আমি কাকাবাবুকে বললাম—
— কথাটা এরকম নয় কাকাবাবু। আপনাদের মধ্যে এভাবে যদি আলোচনা হয়ে থাকে আপনারা তাহলে আমার প্রতি অন্যায় করেছেন। বকগুলির অনিষ্ট হওয়ার জন্য আমার খারাপ লেগেছে। সে কথা সত্যি। কিন্তু চিতার স্থান নির্বাচন করার সময় আমি প্রতিবাদ করিনি। যেহেতু আমি সঠিক পথের সন্ধান দিলাম না বা দিতে পারলাম না এখন আমি তার জন্য আপনাদের ওপরে অসন্তুষ্ট হওয়ার কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। আমি বলার পরে আপনারা যদি আমার কথা না রাখতেন তাহলে হয়তো খারাপ পাওয়ার অবকাশ থাকতো।
আমি বুঝতে পারলাম না, আমার কথায় কাকাবাবুকে কতটা সন্তুষ্ট করতে পেরেছি। কিন্তু আমার অনুপস্থিতির বিষয়ে তাদের মধ্যে ভিন্ন ধরনের কথা চর্চা হয়েছে বলে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। সেটা নঞর্থক হলেও আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। আমার অনুপস্থিতি তারা অনুভব করেছে সেটা আমি ভালোভাবে উপলব্ধি করছি। আমার কাছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আসলে তারা আমার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাটা আমিও চেয়েছিলাম। সামাজিক কাজ করতে গিয়ে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে নেতৃত্ব আদর্শের সঙ্গে কাজ করার দায়িত্ব অনুভব করে।
এই সময়ে নবজিৎ বর্মন, প্রণব কুমার ভাগবতী, জ্যোতিপ্রসাদ মানে জেপি, কীচক প্রত্যেকের কাছ থেকে আমি ফোন পেয়েছি। প্রত্যেকেই আমার সঙ্গে একত্রে কাজ করার আশা পোষণ করেছে। আমি কেন দূরে সরে গেছি তার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি তরুণদের আগ্রহকে পথ দেখানোর প্রয়োজন আছে। তারা প্রকৃতি শিবির অনুষ্ঠিত করার জন্যও অনুরোধ জানিয়েছে। তারা প্রকৃতি শিবিরে নতুন নতুন বিষয় সন্নিবিষ্ট করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।আমি তাদের অনুরোধ এবং আগ্রহকে উপেক্ষা করতে চাই না। প্রকৃতির সংরক্ষণের ভিত বরকুরিহা অঞ্চলে গড়ে উঠেছে,সেই ভিতে আবর্জনা জন্মাতে দিলে অন্যায় করা হবে।
তাদের আমি কীভাবে বলি হজরত মহম্মদকে বুড়ির নাতিকে চিনি খেতে বাধা দেওয়ার আগে নিজেও মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস পরিহার করার জন্য সময় নিতে হয়েছিল। গত একটি বছরে আমিও চেষ্টার ত্রুটি করিনি প্রতিমাসের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ শনি এবং রবিবার বন্ধের সুবিধা নিয়ে আমি অসমের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি।ডিব্রু-চৈখোয়ার গুঁইজান ঘাটে গিয়েছি, অভয়া পুরীর আস্থায় গিয়েছি। চক্রশীলা পাহাড়ে গ্রামবাসী স্থাপন করা পর্যটন ব্যবস্থার খবরা-খবর নিয়ে এসেছি। পর্যটক দেখার জন্য মাজুলি গিয়েছি । তাদের জিজ্ঞাসা করেছি তারা কী ভালোবাসে। সুনন্দকে বলি — আমি মাজুলিতে এসেছি দাঁড়াও । সে জিজ্ঞেস করে — বেড়াতে ? আমি তার মন্তব্যে সায় দিই। তাকে বলিনি তোমাদের জন্য আমি রাতের পর রাত ঘুমের ক্ষতি করে নাইট সুপার এবং রেলে ভ্রমণ করেছি। পুত্র শোকে বিষাদগ্রস্ত কাকাবাবুকে এই সমস্ত কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করি না। কখনও যাত্রা পথে সৌম্যদা থাকে আমার সঙ্গে। তিনিই আমাকে বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন— বেনুদাকে বল আমি তোমাকে পাঠিয়েছি। তিনি তোমাকে সমস্ত রকম ভাবে সাহায্য করবেন। শৈলেশ চৌধুরীকে বল— আমি তোমাকে তার কাছে পাঠিয়েছি। যা জানতে চাও তাকে ভালো করে জিজ্ঞেস করে নিও। তিনি তোমাকে নিশ্চয় সাহায্য করবেন। মাজুলি গড়মুরের রজনী বরদলৈকে আমি আগে থেকেই জানি। মাজুলি গেলে রজনী আমাকে সাহায্য করে। রজনীর গড়মড়ে একটি স্থানীয় কাপড়ের দোকান আছে। সেখানে আগত বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুবিধা রজনী করে দেয়। রজনীর দোকানে আসা বেশিরভাগ পর্যটক ফ্রান্সের। তারা কী ভালোবাসে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি। তারা চায় তারা বেড়াতে আসা জায়গাটা পৃথিবীর ভেতরে অনন্য হোক। পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর সেরকম পর্যটন স্থান না থাকাটা তাদের কাম্য।
আমি ব্যক্তিগতভাবে সেরকম একঝাঁক স্বপ্ন মনের মধ্যে পুষে রেখেছি। বাস্তবে প্রতিফলিত করতে পারার মতো আমার পরিকল্পনা পূর্ণতা প্রাপ্তি না পাওয়ার জন্য আমি আমার পরিকল্পনার বিষয়ে বনকুরিহা পরিবারের কাছে ব্যক্ত করতে পারিনি। বলতে পারিনি সুন্দকে, নবজিত বৈশ্যকে, কীচককে, জেপিকে, বলতে পারিনি শিবিরে অংশগ্রহণ করা প্রকৃতি কর্মীদের, যারা আমাকে আন্তরিকতার সঙ্গে ফোন করে তাদের। আমি মানুষগুলিকে যে রকম বুঝেছি সেভাবে আমার পরিকল্পনার মানচিত্রটি সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছি । মানুষ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণাধীন । পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে আমার কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত করতে হলেও আমি নির্দিষ্ট গতি পথ থেকে বিচ্যুত হই না। আমি আমার কাছে ইতিমধ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে নিয়েছি। সমগ্র পরিকল্পনাটা ছকে নিয়ে দুটি বিষয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত আমার মনে হয়েছে।১) অরণ্য গাঁও এবং ২) প্রকৃতি পর্যটন। জানিনা বিষয় দুটিতে আমি কতটা সফল হতে পারব।
অরণ্যগাঁও বা ভিলেজ ফরেস্ট্রির কথা আমার মনে এসেছিল সুনন্দের সঙ্গে গ্রামটির এক প্রান্ত থেকেও অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর প্রথম দিনটিতে। ভায়োলেট যে শীতার্ত সকালবেলা প্রচন্ড শীতকেও অবজ্ঞা করে কাদামাটির প্রলেপ দিয়ে কাঁচা মাটি র মেঝে মুছছিল , সেই দিনটিতে।
অরণ্যের মধ্যে বা অভয়ারণ্যের মাঝখানে গ্রাম থাকার খবর আমি পাই। ডিব্রু চৈখোয়া অভয়ারণ্যের মধ্যে লাইকা এবং দুধিয়া নামের গ্রাম দুটি থাকার কথা আমি জানি। মাঝেমধ্যে সেই গ্রামগুলিকে নিয়ে হুলস্থূল হতেও শুনেছি। গ্রাম কয়টি উচ্ছেদ করার জন্য কোনো কোনো প্রকৃতি কর্মী দাবী জানিয়ে আসার বিপরীতে কোনো কোনো প্রকৃতি কর্মী গ্রামবাসীর ওপরে অরণ্য সুরক্ষার দায়-দায়িত্ব অর্পণ করার কথা বলে। নিজের দাবির সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে। কখনও কেউ বিপরীত পক্ষের যুক্তি শোনে না আর শুনলেও মেনে চলে না।
অরণ্যের মধ্যে গ্রাম থাকার মতো গ্রামটিকে যদি অরণ্যে রূপান্তরিত করতে পারা যায়— ধারণাটি আমার মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি উৎফুল্ল হয়ে পড়লাম। ধারণাটিকে কীভাবে বিস্তৃত করা যায় অহরহ আমার মনে সেই চিন্তা খোঁচাতে লাগল। গ্রাম অরণ্যের পরিষ্কার ছবি একটি মনে এঁকে নিতে পারছিলাম না বলে সুনন্দ এমনকি সৌম্যদাকেও আমি আমার ধারণার বিষয়ে বলতে পারছিলাম না। আমি শুধু ভেবে নিয়েছিলাম গ্রামবাসীর সহযোগে এই গ্রামে একটি সুন্দর অরণ্য গড়ে উঠতে পারে।। অরণ্যটিই মানুষগুলির জন্য জীবন জীবিকা হতে পারে। তারা গাছপালা রোপণ করবে, প্রতিপালন করবে সেটা হবে তাদের সম্পত্তি। ফলের গাছ লাগাবে, উৎপাদন তাদের ব্যবসায়িকভাবে লাভান্বিত করবে। গাছ তাদের ছায়া দেবে, শুকনো ডাল পাতা তাদের ইন্ধন যোগাবে, গাছ তাদের কাঠ দেবে আর গ্রামের অরণ্যের পরিবেশ আমাদের প্রত্যেকের জলবায়ু নিয়ন্ত্রিত করবে । তার জন্য আমাদের পদ্ধতিগতভাবে এগোতে হবে। গ্রামবাসীকে সজাগ করতে হবে। গাছ রোপণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। গ্রামবাসীর জন্য প্রশিক্ষণ এবং সজাগতার ব্যবস্থা করতে হবে। সমুজ্জল হয়ে বেরিয়ে আসা গ্রামবাসী সৃষ্টি করবে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ এবং বিরল উদাহরণ সেই গ্রাম অরণ্যের ওপরে ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে। আমার দ্বিতীয় চিন্তা প্রকৃতি পর্যটন। দেশি এবং বিদেশি পর্যটক আসবে, গ্রাম অরণ্যের মধ্যে জীবনের কয়েক দিন অতিবাহিত করবে, সবুজ খুঁজে পাবে, পাখির কাকলির মধ্যে জীবনের হারানো ছন্দ ফিরে পাবে। মন মগজের কোনো ক্ষতস্থান হয়ে পড়বে সুস্থ। তারা নগর মহানগর থেকে আসা মানুষ। গ্রামবাসীর সঙ্গে মনের কথা বলবে, হাসবে, নাচতেও পারবে। আমাদের স্থানীয় খাদ্যে জিহ্বার স্বাদ পরিবর্তন করবে, নুন তেল মিশ্রিত করে আলু মাখা যে খাওয়া যায় আমাদের কাছ থেকে শিখবে। ঢেকিয়া ভেজে খাওয়া যায়, খার খেলে যে পরিপাক প্রক্রিয়া সুষময়, কলার মোচার তরকারি যে আহারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে — আমি ধীরে ধীরে অতি বেশি কাল্পনিক হয়ে উঠতে থাকলাম ।
আমি ভেবেছিলাম অরণ্য গ্রামের কথা ভাবা আমিই প্রথমজন ব্যক্তি। একটি গ্রামে অরণ্যের প্রসার এবং প্রচার করে গ্রামটিকে অরণ্যে পরিবর্তন করতে যাওয়া আমিই একমাত্র ব্যক্তি। পৃথিবীর কোথাও কোনো অরণ্য গ্রামের ধারণা ভেবেছে নাকি জানার আগ্রহ প্রকাশ করে প্রথমে আমি বেশ স্তম্ভিত হলাম এবং তারপরে অনুপ্রাণিত। আমার ধারণার সঙ্গে পার্থক্য থাকলেও আমি তাদের বিষয়ে জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লাম। কিন্তু কী আশ্চর্য আমার চিন্তার সঙ্গে কীভাবে অভিনব সাদৃশ্য থাকতে পারে! কথার সঙ্গে কথার মিল থাকে। অজান্তে চিন্তার মিল হয়তো সম্ভব হতে পারে– আর সেটাই আচম্বিতে আমার ক্ষেত্রে ঘটল।
অরণ্য গ্রামের সম্ভেদের খোঁজে আমি গ্রন্থের পরে গ্রন্থ অনুসন্ধান করতে লাগলাম । প্রকৃতি বিষয়ক গ্রন্থ পেলে প্রথমেই দেখি অরণ্য গ্রামের কথা, কোথাও কিছু পাই নাকি। উহু কোথাও পাইনি। অরণ্যের মধ্যে গ্রাম থাকার কথা পড়তে পাই। নেপালে আছে ।আফ্রিকার দেশে আছে। কিন্তু গ্রামটিকে অরণ্যে পরিবর্তিত করার কথা কোথাও পাই না তো দেখছি। আমি সেরকম ধারণা সৃষ্টি করা প্রথমজন ব্যক্তি হিসেবে আত্মসন্তোষ লাভ করতে লাগলাম।
আমার চিন্তায় যতি পড়তে বেশি সময় লাগল না। আমি পৃথিবীর একটি দেশের বিষয়ে পড়তে পেলাম যে দেশে অরণ্য গ্রামের ধারণা আছে। ছোটো একটি দেশ। নাম 'লাও পিপলস ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক',লাওচ। তারা গত শতকের ৯৫ সনে ফিনল্যান্ড সরকার এবং এবং বিশ্বব্যাংকের সাহায্যে গ্রাম অরণ্যের ধারণায় কাজ করতে শুরু করেছে। তাদের জন্য অরণ্য গ্রাম স্থানীয় গ্রামবাসী এবং বনবিভাগের স্থানীয় অফিসারের মধ্যে অরণ্য সম্পদকে সুপরিকল্পিতভাবে উৎপাদনমুখীতার সঙ্গে ব্যবহার করার এক কৌশল।
বিষয়টির অভ্যন্তরে আমি এতই নিমজ্জিত হয়ে পড়লাম যে আমি লাউসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। একজন প্রকৃতি পর্যটক হিসেবে আমি লাউসের অরণ্য গ্রামের বিষয়ে যতটা পারি অধ্যয়ন করতে চেষ্টা করব।
সৌম্যদা এবং সুনন্দকে আমি এই বিষয়ে জানালাম না। জানালাম না কেন জানাবার ইচ্ছা হল না। হয়তো পাশের পরীক্ষার্থী নিজের খাতাটা প্রশ্ন দিয়ে ঢেকে রাখার মতো প্রবণতা আমার ওপরেও কাজ করল। ভাবলাম– এসে সমস্ত কথা বলব।
৩ // ১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন