সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ৪৬ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das

হে আমার স্বদেশ- ৪৬

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das







  লেখক পরিচিতি--এ সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।


(৪৬)

' কাকাবাবু ,দেরিতে হলেও অসমিয়া ভাষা এবং সাহিত্যের একমাত্র জাতীয় অনুষ্ঠান' অল আসাম লিটারেরি কনফারেন্স (অসম সাহিত্য সভা) অবশেষে আপনাকে স্বীকৃতি দিল।'

' হ্যাঁ যদু বাবা, খবরটা পেয়ে ভালোই লাগছে।'

অসমিয়া ভাষা সাহিত্যে অমূল্য অবদানের জন্য আপনাকে এই স্বীকৃতি।এখন আপনি কনফারেন্সের মাননীয় সভাপতি ।আপনার জন্য আমি গৌরব অনুভব করছি। আপনার সঙ্গে দেখা করে অভিনন্দন জানাবার জন্য সম্বলপুরে  যেতে চাইছিলাম। আপনি হয়তো কনফারেন্সের সম্পাদকের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পত্র পেয়েছেন?'

' পেয়েছি। কনফারেন্সের সপ্তম অধিবেশনের জন্য আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করার প্রস্তাব সহ নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছে। এবারের অধিবেশনটি গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত হবে। এখন কনফারেন্সে একটা জাতীয় দায়িত্ব যখন অর্পণ করেছে, অস্বীকার করার তো উপায় নেই। আমি যাব,তবে বাড়িতে তোমার কাকিমাও নেই। তিনি বরোদায় অরুণার কাছে গিয়েছেন।'

' কাকিমা বরোদায়!'

' প্রথম ছেলের পরে এবার ছয় ডিসেম্বর অরুণা একটি শিশু কন্যার জন্ম দিয়েছে। প্রসূতির সেবা যত্নের জন্যই তোমার কাকিমাকেও যেতে হল। অবশ্য রত্না বাড়িতে। আমি কনফারেন্সে চলে গেলে ওকে একা থাকতে হবে। তাই রত্নাকেও সঙ্গে নিয়ে এলাম।'

' ভালোই হয়েছে। রত্না অধিবেশনে গান গাইতে পারবে।'

' আসাম লিটারেরি কনফারেন্সের সভাপতি হয়েছি বলে জানতে পেরে আমাকে নিয়ে কলকাতায় এত হুলস্থূল।সম্বলপুর থেকে এসে কলকাতার সিক্স বাই ওয়ান দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনে আছি বলে শুনে কলকাতা অসমিয়া ছাত্ররা আমাকে অভিনন্দন জানাল। তারপরে তারা সেন্ট পল গেস্ট হাউসে আমার সম্মানে টী‐ পার্টি দিল। সেখানে দুর্গাধর বরকাকতী , হরেকৃষ্ণ দাস এসেছিলেন। তাদের অনুরোধ রক্ষা করে টী‐পাটিতে বক্তৃতা দিতে হল।'

' সেটাই হবে। এখন যেখানে যাবেন, সেখানেই জনগণ আপনাকে সম্বর্ধনা জানাবে। সম্বর্ধনা সভায় শৰাই এবং ফুলতোলা গামছা নিতে নিতে আপনার হাত ব্যথা হয়ে যাবে ।'

হবে যদু  বাবা। সেইসব শরাই -সম্বর্ধনা- ফুলতোলা গামছার কথা রাখ। কথাটা হল, ২৫ ডিসেম্বর রত্নাকে নিয়ে গুয়াহাটিতে রওয়ানা হওয়ার জন্য টিকেট কাটলাম। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে কি?'

' সেটা কি আর আপনাকে বলতে হবে? আপনি এখন লিটারেরি কনফারেন্সের পরম শ্রদ্ধাভাজন সভাপতি। আপনার সঙ্গে যাওয়াটা আমার পক্ষে সম্মানের, গৌরবের। শুধু আমি নয় আপনার সঙ্গে গল্প লেখক লক্ষ্মীধর শর্মাও যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।'

' তার মানে যা বুঝতে পারছি, এখন আসাম লিটারেরি  কনফারেন্সের সভাপতির পদ  পাবার জন্যই তোমরা আমাকে সমাদর করবে। ব্যক্তি লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া কে মনে রাখবে না—-।'

না, কাকাবাবু, এভাবে বলবেন না। অন্যের কথা জানিনা, আমার জন্য আপনি যেকোনো পদাধিকারীর চেয়েও ব্যক্তি হিসেবে বেশি আদরের, বেশি মহান।'

' এই যে যদু, বিশেষণ লাগানো বড়ো বড়ো কথাগুলি এত বেশি বলনা।'

' কেন?'

' নিজের মানুষের মুখে সেইসব শুনলে বড়ো লজ্জা লাগে। আচ্ছা, কনফারেন্সের জন্য অভিভাষণটা লিখে তোমাকে পাঠিয়েছিলাম, সেটা পড়ে কেমন লাগল?'

' ভালো হয়েছে। আপনি অধিকার দিয়েছিলেন বলেই আমি কিন্তু ভালোভাবে দেখে দু-চারটা কথা যোগ করেছি। সেসব আপনার পছন্দ হয়েছে তো?'

' তুমি কবি, আমার আদরের কবি। কবির হাতে পড়েছে যখন আমার অপছন্দ হওয়ার কোনো কারণই থাকতে পারেনা।'

অবশেষে যতীন্দ্রনাথ দুয়ারা, লক্ষীধর শর্মা এবং কলকাতায় থেকে কলেজে পড়া কয়েকজন অসমের ছাত্রের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ এবং রত্না রেলগাড়িতে করে ২৬ ডিসেম্বর আমিনগাঁও পৌঁছালেন। আমিন গাঁও রেলগাড়ি থেকে নামার পরেই অসংখ্য লোকের ভিড়। ফেরিতে করে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে পান্ডু ঘাটে নামার পরে ভিড় আরও বেড়ে গেল। সামনে উপচে পড়া জনতা দেখে লক্ষ্মীনাথের হৃদয় উথলে উঠল। এরা সবাই অসমের মানুষ, অসমিয়া মানুষ। সহজ সরল অসমিয়া মানুষের মনে মাতৃভাষা এবং সাহিত্যের প্রতি এত অনুরাগ। অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্রে লক্ষ্মীনাথের অবদানের জন্যই তাকে ঘিরে জনগণের এই ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ। অবশ্য অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা পল্লবিত করেছেন,সমৃদ্ধ করেছেন।জনতার উচ্ছ্বাসপূর্ণ জয়ধ্বনি শুনে লক্ষীনাথের এরকম মনে হল যেন এত বছর ধরে তার সেই সংগ্রাম, সেই শ্রম সার্থক হল।

পান্ডু স্টেশন থেকে লক্ষ্মীনাথ এবং রত্নাকে গন্তব্যস্থানে নিয়ে যাবার জন্য ট্যাক্সির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের নিয়ে ট্যাক্সিটা রাস্তার দু'পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেল। লক্ষ্মীনাথের ইচ্ছা অনুসরণ করে তার  থাকার জায়গা ঠিক করা হল গুয়াহাটিৰ দিঘলী পুকুরের পারে থাকা আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জ্ঞানদাভিরাম বরুয়ার বাড়ি । জ্ঞানদাভিরামের বাড়ি পর্যন্ত  জনতার ভিড় দেখা গেল। অপূর্ব এই দৃশ্য দেখে লক্ষ্মীনাথ ভাবলেন ভাষা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ কর্মশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারলে অসমিয়া আর দুঃখী হয়ে থাকবে না।

২৭ এবং ২৮ ডিসেম্বর ১৯২৪ দুদিনের কার্যসূচি নিয়ে অল আসাম লিটারেরি কনফারেন্সের  অসম সাহিত্য সভার অধিবেশন। ২৭ ডিসেম্বর সকাল বেলা ন’টা থেকে অধিবেশনের কার্যসূচি আরম্ভ হল। নানান রঙের ফুল এবং সবুজ পাতা দিয়ে সাজানো গাড়ি একটায় সভাপতি লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া এবং রত্নাকে আদর করে এনে অধিবেশনের মঞ্চে বসতে দেওয়া হল। সভাপতির আসন অলংকৃত করা লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার বক্তৃতা শোনার জন্য সামনে অপেক্ষমান সাহিত্য অনুরাগী অগণন জনতা।

 সভা আরম্ভ হওয়ার পরে সাহিত্যিক সত্যনাথ বরা কনফারেন্সের প্রাসঙ্গিকতার কথা ব্যক্ত করলেন।তারপরে বর্তমান সভাপতি সৃষ্টি করা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সঙ্গে মাতৃভাষার প্রতি নবনির্বাচিত সভাপতির জাগ্রত অনুরাগ, অগ্রিম স্বদেশ প্রীতি এবং অসমিয়া ভাষার স্বতন্ত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রে তার অবিরত সংগ্রামের কথা ব্যাখ্যা করে অভ্যর্থনার ভাষা পাঠ করলেন।

  কার্যসূচি অনুসারে এবার সভাপতি মহোদয়ের বক্তৃতা দেওয়ার পালা। নবনির্বাচিত সভাপতি লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া অভিভাষণ লিখে এনেছেন। এটা যতীন্দ্রনাথ দুয়ারা দেখে দেবার পরে ছাপা করার কাজে লক্ষ্মীধর শর্মা সাহায্য করেছিলেন।

ইতিপূর্বে প্রায় আট বছর আগে অসম ছাত্র সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে লক্ষ্মীনাথ এই গুয়াহাটিতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার চেয়েও এটিতে জনগণের উপস্থিতির সংখ্যা বেশি। সমস্ত বয়সের সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে বিনম্র প্রণাম জানিয়ে লক্ষ্মীনাথ বক্তৃতা শুরু করলেন।

অভিভাষণে  লক্ষ্মীনাথ প্রাচীন অসম তথা কামরূপের স্থান, প্রাচীনকাল থেকে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের বিকাশ, প্রকৃত সাহিত্যের লক্ষণ, জাতীয় সাহিত্য ইত্যাদি  তাত্ত্বিক আলোচনার মাধ্যমে নিজের মতামত তুলে ধরলেন। তারপরে পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে তিনি ছাত্র সম্মেলনে তুলে ধরা বক্তৃতার সুরে বললেন,' শ্রদ্ধাভাজন সমবেত জনগণ আজ পুনরায় এটা জোর  দিয়ে বলি এবং আপনারা সবাই মূল্যবান বলে মনে করবেন, অসমিয়া ভাষার উন্নতিই হল অসমের উন্নতির প্রথম পদক্ষেপ। হতে পারে  আমাদের মানুষের লেখা সামান্য, হতে পারে আমাদের অবস্থা এত শক্তিশালী নয়— তা বলে ভারতের অন্যপ্রদেশের মানুষের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যেতে না পারায় মনকে মিথ্যা প্রবোধ দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকব নাকি? এভাবে থাকলে ভারতীয় জাতীয় জীবনে আমাদের আসন কোথায় থাকবে? আজ ভারতীয় জাতীয় জীবনকে যে একটা নতুন স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেই ভাবের ঢেউ আমাদের হৃদয়– মন বোধ– চেতনায় আলোড়নের সৃষ্টি করবে না কি? লেখার সংখ্যা কম বলে আজকের বিশ্বের এই জাগরণের যুগেও আমরা ঘুমিয়ে থাকব নাকি? না ,আমরা শুয়ে থাকতে পারব না। আমরা আমাদের অসমিয়া নাম লোপ পেতে দিতে পারি না। আজকের এই নবজাগরণের যুগে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মতো  আমাদের অসমকে ও মর্যাদার আসন লাভ করতে হবে।

মাননীয় অসম প্রেমী জনগণ, আপনারা নিশ্চয় জানেন—কলকাতায় পড়াশোনা করতে যাওয়া মুষ্টিমেয় কিছু অসমিয়া ছাত্র অসমিয়া ভাষার উন্নতি সাধিনী সভার মাধ্যমে প্রথমে যে বীজ বপন করেছিল সেই বীজই এখন বটগাছ হয়ে শান্তির ছায়া রূপে সমগ্র অসমকে ঘিরে রেখেছে। পাঠশালার  সেই ছাত্রের গলা থেকে বের হওয়া ক্ষীণ কন্ঠস্বর ধীরে ধীরে বিশাল হয়ে অসমের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আজ পূব থেকে পশ্চিমে উত্তর থেকে দক্ষিনে সমগ্র অসমে একসঙ্গে সেই কন্ঠের সঙ্গে কণ্ঠস্বর মিলে উদাত্ত কণ্ঠে মাতৃভাষার আরতি করছে।

  বন্ধুরা আসুন আজ এই আনন্দের দিনে এই সাংস্কৃতিক মেলায় আমাদের যথাসাধ্য শক্তি স্বদেশ জাতির উন্নতির জন্য মাতৃভাষার সেবার জন্য উৎসর্গ করে জীবন ধন্য করি আসুন। মাতৃভাষার উন্নতিতেই আমাদের দেশের উন্নতি, মাতৃভাষার সেবাতেই দেশের সেবা, সেবার মাধ্যমে আমাদের লুপ্ত গৌরবের পুনরুত্থান সম্ভব হবে।… … …’

 সভাপতির অভিভাষণের পরে বিকেলে উজান বাজারের নাটঘরে (আজকের কুমার ভাস্কর নাট্য মন্দির) ছয়টা থেকে বিষয়বস্তু নির্বাচনের সভা বসেছে।গম্ভীর পরিবেশে উত্থাপিত প্রস্তাবের সমালোচনা তর্ক-বিতর্ক চলছে।

 রাত ন'টা বাজতে চলেছে। এই সময় একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা  ঘটল। মাথায় ফেল্ট হেট, হাতে লাঠি আর ডান হাতে অলেস্টার কোটটা ঝুলিয়ে নিয়ে পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া সভাঘরে প্রবেশ করলেন।

  সভাপতির আসনে লক্ষীনাথ বসে পদ্মনাথকে দেখতে পেয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন না। কিন্তু তিনি এই জন্য অবাক হলেন যে পদ্মনাথ তার দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি বসে থাকা আসনের কাছে এসে ইউরোপীয় রীতিতে প্রথমেই টুপিটা খুলে বাঁ হাতে নিয়ে চট করে লক্ষ্মীনাথের হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন ‘মিস্টার বরুয়া উই আর মিটিং আফটার টুয়েন্টি ইয়ার্স।’

হ্যাঁ, আজ থেকে সুদীর্ঘ কুড়ি বছর আগে লক্ষ্মীনাথের কৃপাবরী প্রবন্ধ পদ্মনাথের সম্পাদনায় ঊষা তে প্রকাশ পাওয়ার পরে কাগজটা রাজ-রোষে পড়েছিল। প্রবন্ধটি প্রকাশ করার জন্য সম্পাদক সরকার এবং পাঠকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল। ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রবন্ধ প্রকাশ করবে না এবং সেই লেখক কৃপাবর বরুয়ার (লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার) সঙ্গে সম্পাদক কোনো সম্পর্ক রাখবে না বলে শপথ খেয়ে কাগজে বিবৃতি দেওয়ায় পদ্মনাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের বিরোধ শুরু হয়েছিল। তিক্ততাময় সেই বিরোধের জন্যই দুজনের মধ্যে এত বছর যোগাযোগ বন্ধ ছিল। আজ পদ্মনাথ নিজে এসে মিলনের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় লক্ষ্মীনাথ প্রথমে হতভম্ব হলেন। পরে পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়ার আন্তরিকতায় কোনো খাদ নেই দেখে লক্ষ্মীনাথ আপ্লুত হলেন। তারপরে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের দুই অধিনায়ক যে মুহূর্তে কোলাকুলি করলেন সেই মুহূর্তে সভাস্থলে উপস্থিত থাকা লোকেরা একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালো এবং সমগ্র সভাঘর  নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল ।এই মিলনটা স্বর্গের দেবতার জন্যও উপভোগ্য নান্দনিক এক দৃশ্য।

অল অসাম লিটারেরি কনফারেন্সের সমাপ্তির পরে লক্ষ্মীনাথ সংগীত সংঘের অধিবেশনে যোগ দিলেন। ইতিমধ্যে প্রিয় বন্ধু চন্দ্রকুমার তার সঙ্গে দেখা করলেন। মাজিউর সঙ্গে দেখা করে লক্ষ্মীনাথ অধিবেশনের ভাব ও গম্ভীর আনুষ্ঠানিকতায় গম্ভীর হয়ে পড়া মনটা হালকা করে নিলেন। সভাপতির পদ অলংকৃত করার পরেই সর্বসাধারণ অসমিয়া ভালোবাসার যে ধরনের প্রকাশ তাতে তিনি কিছু পরিমাণে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তার জন্যই তিনি সকলের অজ্ঞাতে চন্দ্রকুমারের সঙ্গে বসলেন। দুই অন্তরঙ্গ বন্ধু বসে ব্যক্তিগত, নিজের নিজের সংসার, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া নিজের নিজের জীবিকা, দেশ-সমাজ, ‘বাঁহী’র সম্পাদনা প্রকাশ নিয়ে  সমস্যা, ‘বাঁহী’র নিয়মিত লেখকদের সৃজন প্রতিভা,তারপরে নিজের নিজের সৃষ্টিকর্ম ইত্যাদি এটা ওটা কত যে কথা…কথার শেষই হয় না।

 ‘বুঝেছ মাজিউ,সভাপতি হওয়ার পরে বক্তৃতা দেওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।’ অবশেষে লক্ষ্মীনাথ বললেন, ‘আগামীকাল কটন কলেজের ছাত্রদের অনুরোধ রক্ষা করেও একটা বক্তৃতা দিতে হবে।’

‘তুমি এখন অসমিয়া জাতীয় অনুষ্ঠানের শিরোমণি।’ চন্দ্র কুমার বললেন, ‘অসমিয়া জনগণের সঙ্গে অসমিয়া ছাত্ররা তোমার প্রেরণাদায়ক বাণী শুনতে চায়। তাই ছাত্রদের অনুরোধ রক্ষা না করে থাকতে পার না। তবে বেজ, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি এখন তুমি যেন বিশেষ কোনো লেখার পরিকল্পনা করছ না?’

  পারিবারিক ঝামেলা বুঝেছ, অনেক ঝামেলা গেল।অরুণাকে বিয়ে দিলাম। এখন রত্নার জন্য ছেলে খোঁজ করছি। কন্যা দায়ের চিন্তা একটা লেগেই রয়েছে। তাছাড়া বার্ড কোম্পানির চাকরিতে ব্যস্ততা বেড়েছে। এইসবের মধ্যে মন মগজ সুস্থির করে নতুন কিছু লেখাই শুরু করতে পারছি না। অবশ্য তার মধ্যে সময় বের করে বৈষ্ণব তত্ত্বের উপরে কিছু প্রবন্ধ লিখেছি।

‘লেখাগুলি ভালো হয়েছে। এটা শুধু ধর্মীয় দর্শন নয়, ভালো সাহিত্যও। তুমি যেভাবে ভাগবতের তত্ত্ব দর্শন ব্যাখ্যা করেছ, সর্বসাধারণ অসমিয়া ভাগবতের সারকথা বুঝতে পারবে। আরও একটা কাজ কর।’


 ‘কী কাজ?’

 ‘তোমার জীবনটা সংঘাত-সংগ্রামে বৈচিত্র্যময়। আত্মজীবনী লিখতে শুরু কর।’

 ‘আত্ম-জীবনী! শোন মাজিউ, আত্মজীবনী লেখার কথা বলা সহজ। লিখব বলে ভাবতেও ভালো লাগে। কিন্তু লেখাটা সহজ নয়। আচ্ছা, অধিবেশনে তুলে ধরা আমার বক্তৃতাটা শুনে কিরকম লাগল?’

  ‘কাল তোমার আড়াই ঘন্টার অভিভাষণটা অসমিয়া-ভাষা সাহিত্যের জন্য এক ঐতিহাসিক দলিল।’

  আমার বক্তব্যে এরকম কী পেলে যে এটা একটা ঐতিহাসিক দলিল বলে তোমার মনে হল?’

 তোমার অভিভাষণের প্রতিটি শব্দে প্রকাশ পেয়েছে মাতৃভাষা অসমিয়ার প্রতি তীব্র অনুরাগ, জাগ্রত দেশ প্রেম এবং জীবনের প্রতি গভীর আশাবাদ।’

অল অসাম লিটারেরি কনফারেন্সের সভাপতি হয়ে বছরের বেশিরভাগ সময় সুদূর সম্বলপুরে থাকার জন্য লক্ষ্মীনাথ সংগঠনাত্মক কাজ সেভাবে ঠিক করতে পারলেন না। এদিকে বাঁহীর সম্পাদনা এবং প্রকাশ করার কাজ চন্দ্রকুমারকে দেওয়া হয়েছিল এবং কাগজটি ডিব্রুগড়ের অসমিয়া প্রেস থেকে বের হত। পরের বছর থেকে বাঁহী গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত হতে লাগল। তার জন্য লক্ষ্মীনাথকে পুনরায় সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হল। বাঁহী সম্পাদনা, বৈষ্ণব তত্ত্বকথা লেখা এবং বিভিন্ন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের আমন্ত্রণ অনুসারে বক্ততা দান ছাড়া  লক্ষ্মীনাথ সত্যিই নিজেকে সৃষ্টি মূলক সাহিত্য রচনায়  মনোনিবেশ করতে পারছে না।

 এভাবে লক্ষ্মীনাথের জীবনের আরও একটি বছর অতিবাহিত হল। তিনি ষাট বছরে পা রাখলেন। মানসিকভাবে এখনও সক্ষম যুবকের মতো মনে হলেও শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এদিকে বার্ড কোম্পানির চাকরি— জঙ্গলে চলতে থাকা কাজ দেখতে হয়। কুলি-করাতিদের-গাড়োয়ানদের সাপ্তাহিক মজুরি দেবার জন্য প্রায় তিন চার দিনের জন্য জঙ্গলের মধ্যে তৈরি করা বাংলোতে থাকতে হয়।তারপরে দুর্গম জঙ্গল থেকে কাঠ বহন করে সম্বলপুর স্টেশনের কাছে থাকা গোলায় পাশ করানো, বিশ্রাম না নিয়ে কাজ করার জন্য তার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়ল।

এর মধ্যে একদিন রাতে সম্বলপুরে একটা কৃষি প্রদর্শনীতে প্রজ্ঞা রত্না এবং দীপিকার সঙ্গে স্থানীয় বাঙালিরা মঞ্চস্থ করা নাটক উপভোগ করে থাকার সময় লক্ষ্মীনাথের নাক দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। অনেক রক্ত। রাত বারোটার সময় বাড়িতে এলেন। কোনোমতে রাত পার করে পরের দিন সকালবেলা ডাক্তার ডেকে আনা হল। ডাক্তার  হোমিওপ্যাথি ঔষধ দিলেন।সঙ্গে গরুর ঘি শুঁকতে এবং নস্যি নিতে বললেন ।

এভাবে করায় রক্ত পড়া বন্ধ হল কিন্তু একনাগারে প্রায় ছয় ঘন্টা রক্ত বের হওয়ার ফলে লক্ষীনাথ দুর্বল হয়ে পড়লেন।

 মাঝখানে ১৯২৬ সনের এপ্রিল মাসে ছেলে স্বরূপকুমার এবং ছোট্ট শিশু কন্যাটিকে নিয়ে বরোদা থেকে সত্যব্রত অরুনা এল। ওরা আসার পরে কলকাতা থেকে রত্না দীপিকাও এল। লক্ষ্মীনাথ-প্রজ্ঞার বাড়ি ভরে উঠল। সবাইকে একসঙ্গে দেখতে পেয়ে লক্ষ্মীনাথের সে কি আনন্দ। বাড়িতে থাকলে সর্বক্ষণ তিনি নাতি-নাতনির সঙ্গে থাকেন। নাতি স্বরূপের সঙ্গে এমনিতেই ছোটো ছেলের মতো খেলাধুলা করেন। লক্ষ্মীনাথ জামাই  সত্যব্রতকে  ‘বাবাজীবন’ বলে ডাকেন। সত্যব্রত শ্বশুর মশাইকে ‘পিতাজীবন’ বলে সম্বোধন করে সমবয়সী বন্ধুর মতো আনন্দ ফুর্তি করে পরিবেশ মুখরিত করে রাখেন। জামাইয়ের মধ্যে পুত্র সন্তানের রূপ কল্পনা করে লক্ষ্মীনাথ সত্যব্রতকে ভালোবাসেন।

লক্ষ্মীনাথ অল আসাম লিটারেরি কনফারেন্স বা অসম সাহিত্য সভার সপ্তম অধিবেশনের সভাপতি হয়েছিলেন। দুই বছর পরে সাহিত্য সভার নবম অধিবেশনটি অক্টোবর মাসের উনিশ এবং কুড়ি তারিখে ধুবড়িতে অনুষ্ঠিত হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য প্রবীণ সাহিত্যিক বেনুধর রাজখোয়া নির্বাচিত হলেন।বিভিন্ন দিক থেকে এই অধিবেশনটি গুরুত্বপূর্ণ। তার জন্য প্রধান সম্পাদক শরৎচন্দ্র গোস্বামী পত্রযুগে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়াকে উক্ত অধিবেশনে উপস্থিত থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন। তাছাড়া কোকরাঝাড় থেকে কালিচরণ ব্রহ্ম, পূর্ণচন্দ্র তালুকদার এবং জৈনাউদ্দিন আহমদ, বিলাসীপাড়া থেকে চক্রধর দাস এবং ভূতনাথ সিংহ ধুবরির কমলাকান্ত শর্মা, হরনাথ বরুয়া, হরিনাথ পাঠক আদি পত্র যুগে অথবা তাঁরযোগে তাকে ধুবরি অধিবেশনে উপস্থিত থাকার জন্য বিনম্র অনুরোধ জানালেন। স্বাস্থ্য এতটা ভালো নয় যদিও লক্ষ্মীনাথ জাতির আহ্বানে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলেন না। ১৯২৬ সালের ১৪ অক্টোবর মেয়ে রত্নাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সম্বলপুর থেকে ধুবরির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

  সুদীর্ঘ ভ্রমণ। দুদিন লাগল। অক্টোবরের ১৬ তারিখ ধুবরি পৌঁছালেন। লক্ষ্মীনাথ রত্নার ধুবরির বিজনীতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। আনন্দ আগরওয়ালা তাদের বিশেষ যত্ন নিতে লাগলেন।

  ১৯ অক্টোবর তারিখ লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার কন্যা রত্নাবলীর অসমা-সুষমা কামরূপা যৌথ জননী ধরিত্রী দুহিতা’ গানটির দ্বারা অধিবেশনের কার্যসূচি আরম্ভ হল। রত্নার কন্ঠে লালিত্যময় সুরে এই ধরনের গান— শ্রোতা মন্ডলী অভিভূত হয়ে পড়ল। তারপরে সম্পাদকের স্বাগত ভাষণ। স্বাগত ভাষণের পরে সভাপতি বেনুধর রাজখোয়া মহাশয় মূল অভিভাষণ দিতে উঠে দাঁড়ালেন।

সভাপতি মহাশয়ের অভিভাষণের প্রথম দিকটা ভালোই, সারগর্ভ বক্তব্য।কিন্তু তারপরেই আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে বঙ্গবাসীরা ধুবরি গোয়ালপাড়াকে বঙ্গের অংশ  করে নেবার চক্রান্ত করছে—এটা এক সময়ে অসমের স্কুল কাছাড়িতে  বাংলা ভাষার প্রবর্তন করার মতোই এক জঘন্য ষড়যন্ত্র’ বলে বলতেই ধুবড়ি বিলাসিপাড়ার বাঙালি সম্প্রদায়ের লোকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ল । সভাস্থলে এক উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হল।সভাপতি রাজখোয়া কোনোমতে নিজের অভিভাষণ শেষ করলেন।

তারপরে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার বক্তৃতা দেবার পালা এল। তার কণ্ঠস্বর গুরু গম্ভীর। শ্রুতিকর শব্দচয়নে ভাষা হৃদয়গ্রাহী। কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত শ্রোতা মন্ডলী শান্ত হল। প্রসঙ্গক্রমে লক্ষ্মীনাথ বললেন, …শেষে আমাদের গোয়ালপাড়ার ভাইবোনদের বলছি তারা আত্মবিস্মৃত হয়ে কতদিন থাকবে? আর কতদিন আপনারা বাকি সমগ্র অসমের নিজের মানুষ, নিজের ভাষাকে ভ্রম-সমুদ্রে বিসর্জন দিয়ে বিদেশি বা বিদেশি ভাবাপন্ন লোকের কথায় নিজের প্রাচীন বংশ গৌরব সভ্যতা-ভব্যতা বিসর্জন দিতে থাকবেন?সেদিন হোসেন শাহ গোয়ালপাড়া দখল করাটা নিয়ে আপনারা সুখী থাকবেন না প্রাচীন রামায়ণ মহাভারতের কাল থেকে ‘ট্রেছ’  করে নিজেকে সৌভাগ্যশালী করে ধন্য হবেন? নিজগুরু মহাপুরুষ শ্রী শংকরদেব, শ্রী মাধব দে্ব‌, শ্রী হরিদেবের ধর্ম প্লাবিত সুমহান-সুমধুর আচার-নিষ্ঠা, সাহিত্য-সংগীত, নৃত্য-গীতের সুশীতল ছায়ায় থেকে আপনারা নিজেকে বরেণ্য করবেন না পরের আশায় বনে বাস করে সকাতরে মুক্তা খসিয়ে নিজেকে দুঃখী এবং অন্যের চোখে হেয় করবেন? 

গোয়ালপাড়ার ভাইরা আমাদের জননী জন্মভূমি দীনা, হীনা, শীর্ণা।তা বলে প্রতিবেশী ধনীর গৃহিণীকে মাতৃ বলে সম্বোধন করাটা কর্তব্যের ভিতর পড়ে কি? মহাত্মা গান্ধী দুখিনী ভারত মাতার দুঃখে হাঁটু পর্যন্ত মোটা কাপড় পরে শীত গ্রীষ্ম কাটিয়ে মাতৃভূমির দুঃখ-কষ্ট দূর করার প্রাণপণ সাধনা করেছেন।আর বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের মা বঙ্গভূমিকে দেখে আপনারা নিজের দুঃখিনী অসম মাতাকে পরিত্যাগ করে সেই ধনী বঙ্গমাতাকে মা বলে মাটিতে গড়াগড়ি দেওয়া উচিত কি?’   

লক্ষ্মীনাথ থামলেন। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের বক্তৃতায় কাজ হল। সভা শান্ত হল। প্রত্যেকেই তাঁর ভাষণ মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে লক্ষ্মীনাথ তারপরে ইতিপূর্বে সভায় হুলস্থূল করা বাংলাভাষীদের উদ্দেশ্য করে বললেন—‘এই সম্পর্কে আমার বাঙালি বন্ধুদের বলি যে গোয়ালপাড়া যে অসমের বুক থেকে টুকরো করে নেওয়ার জন্য তাদের ভেতরে যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা অনুগ্রহ করে সেটা পরিত্যাগ করুক। আমাদের প্রাণ থাকতে গোয়ালপাড়াকে আমরা কখনও অসমের বুক থেকে কেড়ে নিতে দেব না। সেরকম করতে গেলে অসমের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে আগুন জ্বলবে। তাই আজ অতি বিনয় পূর্বক তাদের বলি যে দয়া করে ক্ষান্ত হন। আমার বিনীত প্রার্থনায় কাজ না হলে বাধ্য হয়ে আমাদের বলতেই হবে যে আমাদের গোয়ালপাড়া থেকে হ্যান্ডস অফ…।’

  পুনরায় বিরতি। লক্ষ্মীনাথ মঞ্চ থেকে সামনে বসা এবং পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অগণন জনতার দিকে একবার তাকালেন। তারপরে আবেগময় ভাষায় বলতে লাগলেন, ‘আজ আমরা ধুবরিতে আমাদের মায়ের চরণ কমল সেবা করার জন্য নিজের জীবন ধন্য করেছি। ভাইরা, উত্তষ্টিত জাগ্রত। এসো সবাই মিলে মাতৃভূমির সেবা করে মাতৃর অপায়-অমঙ্গল দূর করতে চেষ্টা করি।আজ এই মুহূর্তে, এই জাতীয় মহাযজ্ঞে, তোমরা ঈশ্বরকে সাক্ষী করে প্রতিজ্ঞা কর, যে শয়নে স্বপনে তোমাদের এই একটাই চিন্তা হোক –অমঙ্গল অজগর থেকে মুক্ত করে আমরা মাতৃভূমিকে সুখী করবই।’

 তারপরে কণ্ঠস্বর নামিয়ে এনে লক্ষ্মীনাথ বললেন, ‘কিন্তু মাতৃভূমির সেবক হওয়ার স্পর্ধা রাখা এই বুড়োর গায়ে আগের মতো বল শক্তি নেই। আজ এই বুড়ো শরীর জর্জরীভূত, কলেবর ব্যাধিগ্রস্ত। তাই এই বুড়ো নারায়ণের চরণে করজোড়ে প্রার্থনা করছে—

 কাল অজগরে নিয়ে যায় টানি।

 রাখা রাখা প্রভু সারঙ্গপাণি।। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...