মঙ্গলবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ৫১ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das

 হে আমার স্বদেশ- ৫১

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das



  লেখক পরিচিতি--এ সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।


(৫১)

মত্যু অপ্রতিরোধ্য।মৃত্যু অমরত্ব দানের প্রতিবন্ধক।কিন্তু মানবীয় কর্ম এবং মানবতা উন্মেষকারী সৃষ্টি সৃষ্টিকর্তাকে অমরত্ব প্রদান করে।লক্ষ্মীনাথের একটি মানবীয় সৃষ্টির অন্য একটি স্বীকৃ্তি দিল তেজপুরের তরুণ কিন্তু প্রতিশ্রুতিবান কবি-লেখক জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা।জ্যোতিপ্রসাদ শুধুমাত্র নতুন চিন্তা-চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া কবি-লেখক নয়।তিনি অসমের কেউ না করা একটা কাজের পরিকল্পনা নিয়েছেন।লক্ষ্মীনাথ রচনা করা নাটক ‘জয়মতী’র আধারে তিনি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন।চলচ্চিত্রটি ১৯৩৫ সনের ১০ মার্চ কলকাতার রাওনাক হলে প্রথমবারের জন্য প্রদর্শন করার আয়োজন করা হল।উন্মোচনী সভায় উপস্থিত থাকবেন প্রযোজক প্রমথেশ চন্দ্র বরুয়া,সুগায়ক সাইগল,মিঃহাঞ্চ,হেমন্ত কুমার চৌধুরী আদি বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি।সভা উদ্বোধন করার জন্য লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া আমন্ত্রিত হলেন।

নিজের সৃষ্ট একটি নাটক ছায়াছবিতে রূপান্তরিত হয়েছে,সেটি আবার অসমের প্রথম চলচ্চিত্র,উন্মোচিত হবে ভারতের সাংস্কৃতিক মহানগর কলকাতায়—উদ্বোধন করার আমন্ত্রণ পেয়ে লক্ষ্মীনাথ খুবই আনন্দিত হলেন।  

উৎসাহের সঙ্গে সভায় এসে উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বললেন , ‘আজ আমাদের অসময়ের জন্য এটি একটি গৌরবের দিন। এই ‘জয়মতী’নামে ছবিটি শ্রীমান জ্যোতিপ্রসাদের অশেষ চেষ্টা ,অপরিসীম ধৈর্য ,সূক্ষ্ম শিল্প চেতনা ,অভিনয় দক্ষতা এবং উদার ভাবে ধন ব্যয় করার ফসল। তিনি প্রকৃত অর্থে একজন শিল্পী।তার মধ্যে  শিল্পীর সমস্ত গুণ বর্তমান। আমি আশা করছি এভাবে তিনি আরও অধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সমগ্র ভারতে  অসমের গৌরব বৃদ্ধির সঙ্গে অসমীয়ার মনে জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তুলবেন’।

  লক্ষ্মীনাথের পার্থিব  জীবনের সূর্য অস্তায়মান।সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতির সঙ্গে মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা সম্বর্ধনা পেলেও জাগতিক ঘটনাক্রমে তাকে মাঝেমধ্যে বিমর্ষ করে ফেলে ।শিবসাগর থেকে খবর এল রায় সাহেব এবং অনোরারি  ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া লক্ষ্মীনাথের প্রিয় এবং ছোটো দাদা জগন্নাথ বেজবরুয়ার ৪ জুলাই (১৯৩৫) মৃত্যু হয়েছে। এদিকে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়, সুখ দুঃখের পরামর্শদাতা ,বন্ধু ছোটো দাদা ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরলোকগমন করেছেন। এই দুজন আত্মীয়ের মৃত্যু বার্ধক্যজনিত কারণে।মানুষের জীবনে এভাবেই মৃত্যু আসে। বার্ধক্যে উপনীত হওয়া লক্ষ্মীনাথ সেটা জানেন। তথাপি আপনজনের বিয়োগের শোকটা অসহনীয়। শোকে-দুঃখে কষ্ট পেয়ে থাকার সময় তার এরকম মনে হয় যেন মৃত্যু দেবী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

  জীবনের শেষ বেলার উদাসী চেতনা ভারাক্রান্ত করলেও তার মধ্যেও সম্বলপুরে তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা বাড়ল। এখানে আসার কিছুদিন পর থেকেই এখনকার ইউরোপিয়ান ক্লাব ,বেঙ্গলি ক্লাব আদির সদস্য হওয়ায় লক্ষ্মীনাথ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কার্যসূচির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছেন। এখনকার ভিক্টোরিয়া হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ বা নিজে লেখা নাটক  মঞ্চস্থ করার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ শৈশবে নাটকে অভিনয় করেছেন। তার জন্য স্থানীয় জনগণের মধ্যে তিনি একজন সাংস্কৃতিক পুরুষ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে পড়েছেন। এদিকে তিনি ক্রফর্ট হাইস্কুলের পরিচালনা সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তাছাড়া কয়েক বছর আগে থেকে তিনি সম্বলপুর মিউনিসিপালিটি বোর্ডের সরকারের মনোনীত সদস্য।। মিউনিসিপালিটি বোর্ডের তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার পরিকল্পনা এবং তত্ত্বাবধানে মিউনিসিপালিটির বর্তমান অফিস ঘরটা নির্মাণ করা হয়েছিল।।

এত  প্রভাব প্রতিষ্ঠা যদিও তার কাঠের ব্যাবসায়ে উন্নতি হল না।।সত্যিই সম্বলপুরে ব্যাবসাটা জমাতে পারলেন না। তার মধ্যে টুকটাক করে কোনোমতে সাংসারিক খরচটা বের হয়ে আসে।। এভাবে কষ্ট হচ্ছে। লক্ষ্মীনাথ পুনরায় আর্থিক সংকটের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এসব দেখে অরুণা সত্যব্রত অস্থির হয়ে পড়ল।সত্যব্রতের  উপর্যুপরি  অনুরোধ এবং অরুণা কান্নাকাটি করার জন্য প্রজ্ঞাকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ পুনরায় বরোদা রওনা হলেন ।

বরোদায় এসে এবার প্রায় ৪০ দিন থাকলেন।বরোদার আর্য কন্যা মহাবিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া সভায় মহারাজা গায়কোয়ারের সঙ্গে বসে জামাই সত্যব্রত মুখার্জির জ্ঞান উন্মেষকারী বক্তৃতা শুনলেন। লক্ষ্মীনাথ খুশি হলেন ।জামাই বক্তৃতা দিতে থাকা দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে তার বুক ভরে উঠল। তাছাড়া এবার বিশেষ কোনো জায়গায় বেড়াতে যাওয়া হল না। স্বাস্থ্য জনিত কারণে বাংলোয় থেকে দুই নাতি-নাতনীর সঙ্গে কাটিয়ে দিলেন।বিদায় নেওয়ার দিন সকাল বেলা থেকে লক্ষ্মীনাথ গম্ভীর হয়ে পড়লেন। প্রকাশ না করলেও তার মনে এরকম একটা ভাব হল যেন এটাই তার শেষ বরোদা ভ্রমণ।

বরোদায় থাকার সময়ই দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। দুই বছর আগে থেকেই তাকে দাঁতও অসুবিধা দিয়ে আসছে। কলকাতায় গিয়ে কয়েকটি গোড়ার দাঁত ফেলতে হবে। সম্বলপুরে আসার পরে তার ডাক্তার দাঁত না ফেলে নতুন একটা দাঁত লাগিয়ে দিলেন তবে সেটাতে সুবিধার চেয়ে অসুবিধা হল। এমনিতেই একদিন বাথরুমে  পড়ে গিয়ে প্রজ্ঞা ব্যথা পেল।সার্জন এসে ব্যান্ডেজ বেঁধে ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরও অস্থির যন্ত্রণায় প্রজ্ঞা সারা রাত জেগে কাটাল। পরের দিন থেকে লক্ষ্মীনাথ জ্বরে আক্রান্ত হলেন। জ্বর এতটাই বেশি যে বিছানা নিতে হল। খবর পেয়ে সিভিল সার্জন বাড়িতে এসে পরীক্ষা করে লক্ষ্মীনাথকে ঔষধ খেতে দিলেন ।

মোট কথা কমজোরী হয়ে পড়া লক্ষ্মীনাথের শরীরটাতে দ্রুত নানা রকম রোগ  বাসা বানিয়ে নিল ।অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন খুব বেশিদিন এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন না ।অবশ্য তার জন্য হা–হুতাশ  নেই।তাকেও জীবনের মহামুহূর্তগুলিকে স্বীকার করে নিতে হবে। তার জন্য এখনই নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। তারই একটা প্রস্তুতি হিসেবে লক্ষ্মীনাথ ১৯৩৬ সনের ২৫ নভেম্বর সম্বলপুরের বাড়িটা দান রূপে মেয়ে অরুণা মুখার্জির নামে রেজিস্ট্রি করে দিলেন।

তারপরে কিছুদিন ভালোই চলল। পরের বছর মে মাস থেকে লক্ষ্মীনাথের পুরোনো বদহজম এবং অম্ল শূলের অসুখটা বৃদ্ধি পেল। পেটের ব্যথা শুরু হল, কিছু খেলেই ঢেকুড় উঠে, বমি হয়। আহারে লক্ষীনাথের এত রুচি, খেতে এত ভালোবাসেন, অথচ খেতে পারেন না। স্বামীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে দেখে প্রজ্ঞা সম্বলপুরের সিভিল সার্জনকে ডেকে আনালেন। লক্ষ্মীনাথকে  পরীক্ষা করে সার্জন ঘোষণা করলেন, ‘ডিউডেনাল আলসার।’ লক্ষ্মীনাথের অন্ত্রে ঘা হয়েছে।

বাবার অসুখের কথা শোনার পরেই ডিব্রুগড় থেকে রত্না এল। সকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত সব সময় কর্মব্যস্ত থাকা বাবাকে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে রত্নার চোখ ছল ছল হয়ে উঠল। বাবার উন্নত চিকিৎসা এবং সেবা– শুশ্রুষার প্রতি রত্ন গুরুত্ব দিল। তাতেই লক্ষ্মীনাথ কিছুটা সুস্থ হলেন বলে মনে হল। বরোদা থেকে অরুণা– সত্যব্রত এল। একটু সুস্থ হয়ে ওঠার পরে কিছুদিনের জন্য বাবাকে রত্না নিজের সঙ্গে রাখবে বলল। তার জন্য সে বাবাকে ডিব্রুগড়ে  নিয়ে যাবে। অন্যদিকে অরুণাও বাবাকে বরোদায় নিয়ে যেতে চাইছে। এটা নিয়ে দুই বোনের মধ্যে তর্ক হল। কিন্তু রত্নার জিদের কাছে অরুণাকে হার মানতে হল। মা-বাবাকে নিয়ে রত্না কলকাতায় এল। সত্যিই বাবার অন্ত্রে ঘা হয়েছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কলকাতার একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাল। কলকাতার ডাক্তার একই কথা বললেন এবং লক্ষ্মীনাথকে বিশ্রাম নেবার পরামর্শ দিলেন।

অবশেষে ১৯৩৭ সনের আগস্ট মাসের ২১ তারিখ ডাঃ ভুবনেশ্বর দাস, রত্না এবং প্রজ্ঞার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ ডিব্রুগড়ির রওনা হলেন।

রওয়ানা হওয়ার দ্বিতীয় দিন তারা পান্ডু এসে উপস্থিত হলেন। তিনি আসবেন বলে খবর পেয়ে চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা, জ্ঞানদাভিরাম আদি পান্ডু স্টেশনে এসে দেখা করলেন। অসুস্থ যদিও আরাম কেদারায় বসে লক্ষ্মীনাথ প্রফুল্লিত । যেন তাঁর কোনো অসুখ নেই। আগের মতোই সবার সঙ্গে আনন্দ স্ফুর্তি করে কথাবার্তা বললেন ।ডঃ দাসকে আলাদাভাবে ডেকে এনে জ্ঞানদাভিরাম লক্ষ্মীনাথের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। কিছুটা সন্দেহের ভাব নিয়ে ডঃ দাস বললেন ’ অবস্থা খারাপ নয়। ভালো হয়ে যাবেন, যদি মাঝখানে অভাবনীয় কোনো সমস্যা উপস্থিত না হয়।’

বন্ধুবর চন্দ্রকুমার, আত্মীয় জ্ঞানদাভিরামের সঙ্গে বিনন্দ বেজবরুয়ার( লক্ষ্মীনাথের দাদা) ছেলে আনন্দ বেজবরুয়াও এসে উপস্থিত হলেন। লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞা, রত্না এবং রত্নার মেয়েদের রেলে উঠিয়ে দিয়ে তারা সঙ্গে আনা গাড়িতে গুয়াহাটিতে এসে উপস্থিত হলেন। গুয়াহাটি স্টেশনে আর্ল ল কলেজের অনেক ছাত্র এবং অনেক ভদ্রলোক লক্ষ্মীনাথকে সম্বর্ধনা জানাল। চন্দ্রকুমার লক্ষ্মীনাথকে দুদিন  গুয়াহাটিতে থেকে বিশ্রাম নিয়ে যেতে বলল। রত্না রাজি হল না। সেদিনই গুয়াহাটি থেকে রেলে যাত্রা করল। পরের দিন তারা তিনসুকিয়া গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং সেখান থেকে মোটরে ডিব্রুগড় উপস্থিত হলেন।

মেজ জামাই রোহিণী কুমার বরুয়া নতুন করে একটা বাড়ি তৈরি করেছেন। এই বাড়িটা ব্রহ্মপুত্রের তীরে। সুন্দর করে তৈরি করা বিশাল বাড়িটাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো বাতাস। লক্ষ্মীনাথের মতো রোগির পক্ষে স্বাস্থ্যকর জায়গা। বাড়িটাতে ঢুকেই মহাবাহ ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে গড়িয়ে আসা নির্মল বায়ু সেবন করে লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগল। মাতৃভূমি অসমের প্রাণধারা ব্রহ্মপুত্রের পারে থাকার জন্য তিনি যেন নতুন শক্তি লাভ করলেন।

খবরের কাগজের মাধ্যমে অসমের জনগণ লক্ষ্মীনাথের অসুস্থতার কথা জানতে পারল। ডিব্রুগড়ে থাকার দুদিন পর থেকেই জনগণের চিঠিপত্র আসতে লাগল। সেইসব করে উত্তর লেখার জন্য সাহিত্য পুথীর সমালোচনা করার জন্য অসুস্থ শ্বশুরের মনের ওপরে চাপ পড়বে। তার স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে পড়বে। তাই দায়িত্বশীল জামাই রোহিণী খবরের কাগজে বিবৃতি দিলেন,’ শ্রীযুক্ত লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া সম্প্রতি কঠিন অসুখ থেকে আরোগ্যের পথে। তিনি বর্তমানে মোটামুটি সুস্থ থাকলেও আরও কিছুদিনের জন্য তার বিশ্রাম নেওয়াটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই আশা করি, দেশবাসী যেন তার কাছ থেকে চিঠির উত্তর, পুথি সমালোচনা, সাহিত্যের ইতিহাস ইত্যাদির মতামত না চায় এবং সম্পূর্ণ বিশ্রামের জন্য তাকে কিছুদিনের জন্য রেহাই দেয় ।’

ঠিক তখনই ইতিহাসবিদ বেনুধর শর্মা শিবসাগর থেকে ডিব্রুগড়ে গিয়ে রোগ শয্যায় পড়ে থাকা লক্ষ্মীনাথকে দেখতে চাইলেন। রোহিণী প্রথমে তাকে অনুমতি দিলেন না। তারপরে বেনুধরের  নাম বলায় লক্ষ্মীনাথ আকুল অগ্রহে বেনুধরকে শয্যার পাশে ডাকলেন। বেনুধরকে দেখে আনন্দিত হলেন যদিও লক্ষ্মীনাথ বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না। নিস্তেজ ভাবে বিছানায় পড়ে রইলেন। তার পা দুটির শোচনীয় অবস্থা দেখে বেনুধরের মন খারাপ হয়ে গেল।

তারপরেই ‘দৈনিক বাতরির’ ২৪ আগস্ট( ১৯৩৭) সংখ্যায় প্রকাশ পেল,’ অসমীয়া জনগণ এই পুণ্য ভাদ্র মাসের ৩ তারিখ সরকারিভাবে ঘরে ঘরে পালন করবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক জীবনী এবং মহাপুরুষ শ্রী শ্রী শংকরদেবের নির্মল চরিত্র যে বেজবরুয়া মহাশয়ের অমর লেখনীতে অমিয়া ভাবে প্রকাশিত হয়েছে, এই তিন তারিখ অসমিয়া জনগণ যেন সেই বেজবরুয়া মহাশয়ের সম্পূর্ণ আরোগ্য কামনা করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানায়।’

লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া অসমিয়া জাতির প্রাণপুরুষ।’ দৈনিক বাতরি’র এই আবেদনে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অসমিয়া জনগণ অসমের বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ্মীনাথের আরোগ্য কামনা করে সভা সমিতি এবং নাম কীর্তন অনুষ্ঠান করলেন।

‘ দৈনিক বাতরি’র সহকারী সম্পাদক করুণাকান্ত গগৈ বেজবরুয়ার জামাই রোহিণী বরুয়াকে অনুরোধ করলেন,’ অসমের সমস্ত মানুষই শ্রীযুক্ত বেজবরুয়া মহাশয়ের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এই সন্দর্ভে জনগণ একটি করে বুলেটিন প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। তাই আপনার কাছ থেকে বেজবরুয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সংবাদ পাব বলে আশা করছি।’

সঙ্গে সঙ্গে রোহিণী জানাল,’ এখন পূজনীয় বেজবরুয়া মহাশয়ের শারীরিক অবস্থা ভালো হওয়ার পথে। কোনোরকম শারীরিক বিকার নাই বললেই হয়। রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে এবং রুচিসহকারে খেতেও পারছেন। কারও সাহায্য ছাড়াই উঠাবসা করতে পারছেন। এমনকি আমাদের অতিথি নিবাস থেকে আমরা থাকা ঘরটিতে বিনা সাহায্যে নিজে নিজে হেঁটে যেতে পারছেন। সম্প্রতি তিনি ডাঃ প্রভাত চন্দ্র দাস, এমবিডিটি মহাশয়ের চিকিৎসাধীনে রয়েছেন।ডঃ দাসের বক্তব্য অনুসারে, বেজবরুয়া মহাশয়কে দু-এক দিনের মধ্যে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া যাবে।’

সত্যিই স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হল। চলাফেরা করতে সক্ষম হলেন। লক্ষ্মীনাথ নিজেই ‘ দৈনিক বাতরি’ খবরের কাগজের মাধ্যমে নিবেদন জানালেন,’ অসমের জনগণের আশীর্বাদ এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহে আমি ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছি। তাই এই খবরের কাগজের মাধ্যমে খবরটা সবাইকে জানানোর জন্য অনুরোধ করছি।’ আমার এই অসুস্থতা আমাকে একটা গৌরব এবং আনন্দের খবর দিয়ে গেল। আমি আগে জানতাম না যে আমি আমার মাতৃভূমি অসম দেশের কাছে এত ভালোবাসার পাত্র।’

শরীরে শক্তি লাভ করে লক্ষ্মীনাথ বাড়ি থেকে বের হলেন। চলাফেরা করতে লাগলেন। দুই এক জায়গায় যেতে লাগলেন। কিন্তু তাকে একা বের হতে দেওয়া হয় না। সঙ্গে প্রজ্ঞা, রোহিণী,রত্না… কোনো একজন থাকেই।

নভেম্বরের দুই তারিখ ডিব্রুগড় ‘আলোচনী ক্লাব’এর উদ্বোধনী উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়ে লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞাকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। কিন্তু বক্তৃতা দিতে উঠে দেখেন উদাত্ত ভাবে বক্তৃতা দেওয়ার আগের সেই শক্তি নেই ।তথাপি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে লক্ষীনাথ বললেন এখন আমার দিক থেকে আপনাদের আশীর্বাদ ছাড়া দেওয়ার মতো কিছু নেই। কারণ বামুনের এটাই পেশা। তারপরে কলকাতায় উ-ভা-ই-সা  সভার বিষয়ে কয়েকটি কথা বলে তিনি বললেন এত বছর আগের আলোচনা ক্লাব মরে ছিল বলে বলেছে সে আসলে মরেনি এটা কেবল ‘সাসপেন্ডেন্ট অ্যানিমেশন।’

 এভাবে বাইরে বেরিয়ে, গুনমুগ্ধদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দেওয়ায় লক্ষ্মীনাথের দেহে বাসা বাঁধা জড়তাটা কিছু কমে এল। ভাঙ্গা মনে আশাও কিছুটা জাগল।এই সংসারে তার দিন ঘনিয়ে এসেছে বলে বুঝতে পেরেও নিজের ওপরে একটা ভরসার সৃষ্টি হল।আশা নেই যদিও বেঁচে থাকার মোহটা মরে যায়নি।। মৃত্যু শাশ্বত, নিষ্কাম মনোভাবে মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা উচিত জেনেও লক্ষ্মীনাথ সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারলেন না। তার মানে তার মনটি আরও কিছুদিন পর্যন্ত বিশ্বসংসারের আলো বাতাস উপভোগ করতে চায়।

 ডিব্রুগড় সাহিত্য সভা সাহিত্যরথী সংবর্ধনা জানানোর জন্য ১৯৩৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর রবিবার বিকেল তিনটের সময় অসমিয়া নাট্য মন্দিরে একটি জনসভার আয়োজন করল। সভার উদ্দেশ্য হল (ক)বর্তমান অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব শ্রীযুক্ত লক্ষ্মীনাথ কঠিন অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ করার জন্য আনন্দ প্রকাশ করে তাকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন এবং (খ)অসমিয়া ভাষা এবং সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেজবরুয়া মহাশয়ের বাণী শ্রবণ।

 সভার কাজ আরম্ভ হল।শ্রীমিঠারাম বরা সভাপতির আসন গ্রহণ করলেন।সভাপতির নির্দেশ অনুসারে সম্পাদক আনন্দরাম হাজরিকা  অভিনন্দন পত্র পাঠ করে সেটা লক্ষীনাথ বেজবরুয়ার হাতে অর্পণ করলেন। সভায় উপস্থিত থাকা জ্ঞানমালিনীর কবি মফিজুদ্দিন আহমদ হাজারিকা, তুলসীপ্রসাদ দত্ত, গনেশরাম ফুকন আদি বেজবরুয়াকে  সম্বর্ধনা জানিয়ে  কিছু কথা বললেন।অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করার জন্য সদিচ্ছা সূচক প্রস্তাব গ্রহণ করার পরে হাতে তালি দিয়ে লক্ষীনাথ  বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন।

  ‘মাননীয় সভাপতি মহোদয় এবং সভায় উপস্থিত অসম প্রেমী সুধী সমাজ,

  আমি আমার  অসুস্থ অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে উঠার মূলে প্রথমে জনগণের আশীর্বাদ দ্বিতীয়ত ডাক্তার, তৃতীয়ত আমার পরিবার এবং আমার মেয়েদের যত্ন। যমরাজা আমাকে ভালো করে দৌড় করিয়েছেন। তবে বামুনের ছেলে যদিও টিকি না থাকায় আমাকে ধরতে পারলেন না। দেশ দস্তুর মতে আমার মাথার সামনের দিকে চুলের গোছাটা ,সেই গোছায় যম ধরতে গিয়েছিল।কিন্তু আমি এক দৌড়ে পগার পার।সেইজন্যই আমি আজ সশরীরে এই সভায় বিদ্যমান।’

 শ্রোতাদের মধ্যে হাসির রোল উঠল।

 ভূমিকা শেষ করে লক্ষ্মীনাথ তারপরে বললেন,‘আজকাল যেখানে সেখানে শোনা যায়, ‘আমাদের দেশটা গেল,বিজাতীয় হয়ে গেল।আমি বলি—‘ভয় কর না,চিন্তা কর না।বিদেশির স্রোত দেখে চমকে যেও না।পরিবর্তন সৃষ্টির নিয়ম।ভাস্কর বর্মার দিনের অসম এবং আজকের অসম দেশের মধ্যে পার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক।

 এখানে একটা গল্প বলি।সত্য যুগে বটগাছের গুটিগুলি ছিল একটি লাউয়ের সমান।বটগাছের নিচে বিশ্রাম নেবার সময় গুটি পড়ে অনেক পথিকের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটেছিল।তথাপি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার হুঁশ নেই।এভাবে কিছুদিন যাবার পরে একদিন গুটি খসে পড়ে একজন বামুনের মৃত্যু হল।এবার কিন্তু ব্রহ্মার আসন টলল।তিনি স্বয়ং এসে বটগাছকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন বামুন মারলি?’

বটগাছ উত্তর দিল, ‘তাকে মরতে হবে বলে মারলাম।তাতে আবার কি অসুবিধা হল?বামুনের প্রতি তোমার এত পক্ষপাতিত্ব কেন?

বটগাছের অভদ্র উত্তর শুনে ব্রহ্মা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে অভিশাপ দিলেন।‘বটগাছ,আজ থেকে তোর গুটিগুলি এই এতটুকু হয়ে যাবে।সেদিন থেকে বটগাছের গুটিগুলি ছোটো হয়ে গেল।কিন্তু গুটির ভেতরে সার বা ভাইটালিটির জন্যই ছোট্ট একটি গুটি থেকে আজও যেখানে সেখানে এক একটি প্রকাণ্ড বটগাছ জন্মায়।

তাই বিদেশি চারপাশ থেকে চেপে ধরে অসমিয়া জাতিকে আকারে ছোটো করে ফেলা সত্ত্বেও ভাইটালিটি থাকলে অসমিয়া কখনও মরতে পারে না।    

গীতার কথামতো বলি, কাজ করে যাও— ফলের অপেক্ষা কর না। অন্যেরা কী বলে সেদিকে তাকিও না। মাত্র ঈশ্বরে মতি রেখে সমস্ত কাজের ফলাফল তার হাতে সঁপে দিয়ে কাজ করে যাও।নিখুঁত অসমিয়া ভাষা বলবে, লিখবে। অসমিয়া সাজ পোশাক পরবে। শুধু শুধু বিদেশির অনুকরণ করবে না ।

নহি কল্যাণ কৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গছতি। ‘

লক্ষ্মীনাথের কন্ঠে আগের মতো ভাবের উচ্ছ্বাস নেই। কঠিন শব্দের প্রয়োগ নেই। বক্তৃতা ও সংক্ষিপ্ত।খুবই কম সময়ে তিনি সমাপ্তি টানলেন। সঙ্গে সঙ্গে  এক ধরনের সংযোগহীনতার যন্ত্রণায় তাঁর অন্তরটা কেঁপে উঠল। বড়ো দুর্বল অনুভব করলেন । ধীরে ধীরে নিস্তেজ  পদক্ষেপে নিজের আসনে এসে বসলেন। 

এটাই লক্ষ্মীনাথের শেষ জনসভা এবং শেষ বক্তৃতা। এমনিতে সুস্থ বলে মনে হলে ও ভেতরে ভেতরে লক্ষ্মীনাথ দুর্বল হয়ে পড়লেন। ইচ্ছা থাকলেও বেশি দিন যে বেঁচে থাকতে পারবেন না এই বিষয়ে তিনি নিজেও নিশ্চিত হলেন। কাউকে বললেন না। উল্টে সম্বলপুর ফিরে যাওয়ার কথাই বলতে থাকেন। কিন্তু দুই কুড়ি বছর ধরে সুখ-দুঃখের সঙ্গী, ঘর সংসার সমস্ত ক্ষেত্রে সুযোগ্যা , পরম বান্ধবী প্রজ্ঞা লক্ষ্মীনাথের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। এই বিষয়ে তিনি কন্যা রত্নার সঙ্গে কথা বললেন। মমতাময়ী রত্না বাবাকে সম্বলপুরে  নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করল। মেজ জামাই রোহিণী কুমার ও দায়িত্বশীল। সম্বলপুরে যাবার জন্য টিকিট কাটার কথা বলতেই তিনি বলেন,’ বাবা নতুন একটা বাড়ি করছি। বাড়িটা তৈরি না হওয়ার আগে আপনি সম্বলপুর যেতে পারবেন না।’

বাবার শারীরিক অবস্থাটা ক্রমশ খারাপ হয়ে পড়ছে শুনে বরোদায় থাকা অরুণা অস্থির হয়ে পড়ল। দীপিকাকে নিয়ে বাবার মনে যে একটা অশান্তি আছে অরুণা জানে। অরুণা চিঠি লিখে দীপিকাকে দেশে ফিরে আসতে লিখল । অন্য একটি চিঠিতে লন্ডন স্থিত ব্যাপ্টিস্ট মিশনারির কর্মকর্তাদেরও অনুরোধ জানাল যাতে অন্তত কিছুদিনের জন্য দেশে এসে দীপিকা অসুস্থ পিতাকে দেখে যাবার সুযোগ পায়। অরুণার সকাতর আবেদন অস্বীকার করতে না পেরে প্রধান নান দীপিকার ছুটি মঞ্জন করলেন। অবশেষে ইংল্যান্ড থেকে স্ট্রথেডেন নামক জাহাজে বোম্বাই, সেই রাতেই রেলে বোম্বাই থেকে কলকাতায় এবং কলকাতা থেকে ১৯৩৮ সনের এক ফেব্রুয়ারি দীপিকা ডিব্রুগড় পৌঁছাল।

দীপিকা এখন দীপিকা বেজবরুয়া  নয়। দীপিকা এখন সিস্টার দীপিকা। আগের চেয়ে তার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। আড়াই বছর শীত প্রধান ইংল্যান্ডে থাকার ফলে গায়ের রং উজ্জ্বল হয়েছে। তাছাড়া তার পরনে নানের পোশাক, গলায় সাদা সুতোয় ঝুলানো যিশুখ্রিস্টের মূর্তি। দীপিকা খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী।

সে এসে সামনে দাঁড়াতেই লক্ষ্মীনাথের মনে এক অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি হল। এটা রাগ নয়, ক্ষোভ নয়, খ্রিস্টান ধর্ম নিয়েছে বলে তার প্রতি ঘৃণা নয়। এটা ভালোবাসা। সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা। দীপিকার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথের অন্তর এক অদ্ভুত শান্তি লাভ করল। এই শান্তির সঙ্গে কীসের এক আনন্দ। ব্যাখ্যাতীত এক আনন্দে লক্ষ্মীনাথের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

এদিকে খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী হওয়ার জন্য আত্মসমাহিত যদিও বাবার আদর  ভালোবাসা অনুভব করে দীপিকার দুই চোখ ও জলে ভরে  উঠল।

খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়া নিয়ে এক সময় দীপিকার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের তীব্র বিরোধ হয়েছিল। এখন দুজনের মধ্যে মিলন হতে দেখে বাড়ির সবাই আনন্দিত হল।

তারপরে দীপিকা সহজ হয়ে পড়ল। আগের মতোই কথা বলতে লাগল। বোম্বাই থেকে জাহাজে ইংল্যান্ডের দীর্ঘ যাত্রা, ঐতিহ্যপূর্ণ ইংল্যান্ডের  কোথায় কীভাবে থাকে, সেখানকার নানদের সঙ্গে তার দৈনন্দিন জীবন, তাদের সেবামূলক কর্ম, তাদের উপাসনা… লক্ষ্মীনাথ আগ্রহ নিয়ে দীপিকার কথা শুনল। বিদেশিনী নানদের সঙ্গে দীপিকা ভালই আছে, নিজেকে সেবামূলক কাজে উৎসর্গ করেছে বলে জানতে পেরে লক্ষ্মীনাথ শান্তি পেলেন। তারপরে দীপিকার সঙ্গে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে তাঁর আলোচনা হল। শারীরিক অসুস্থতার জন্য বাবার যে কষ্ট হচ্ছে, এই বিষয়ে দীপিকা সচেতন। বাবার মানসিক শান্তির জন্য সে বাইবেলের স্তোত্র এবং কিছু গান গেয়ে শোনাল। অন্য ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে মেয়ে এভাবে গান গেয়ে স্তোত্র শুনিয়ে শান্তি পাচ্ছে দেখে লক্ষ্মীনাথ সুখী হলেন।

অবশেষে অন্তঃসলিলা ভালোবাসা এবং আত্মিক এক অনুভূতিতে উদার লক্ষ্মীনাথ দীপিকার কাঁধে ডান হাতটা রেখে বললেন,’ মা দীপি, ঈশ্বরের ওপর নির্ভরতা এবং ভালোবাসায় যদি আন্তরিকতা থাকে— তোর মঙ্গল হবেই। রাম ,রহিম, যিশু যার মাধ্যমেই চলার পথ বেছে নিস না কেন, আন্তরিক সমর্পণ তোকে তোর গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবেই দেবে। ‘

‘পাপা—।’দীপিকার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল,’আজ তুমি একথা বলছ !’

‘আমি বলছি নারে,আমাদের ভাগবতে এসব কথা আছে।শ্বাশত বাণীতে সমৃদ্ধ আমাদের ভাগবতের কথাই আমি বলছি।যাই হোক,তুই সুখী হ,মা।তোর আত্মা শান্তিতে থাকুক।’

তারপরে পিতার কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়ে দীপিকা কলকাতা যাত্রা করার দিন ঠিক করল।ছোটো মেয়ের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের এই বিদায় বড়ো করুণ।ডিব্রুগড় স্টেশন থেকে দীপিকা ট্রেইনে কলকাতা যাত্রা করবে।তার সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না।একটা মুহূর্তের জন্যও লক্ষ্মীনাথ তাকে চোখের আরাল করতে পারে নি।তার জন্যি তিনি স্টেশনে  গিয়ে দীপিকাকে বিদায় জানাতে চাইলেন।রত্না,রোহিণী এমনকি প্রজ্ঞা দুর্বল হয়ে পড়া দেহটা নিয়ে  স্টেশনে যেতে লক্ষ্মীনাথকে বাধা দিল।কিন্তু তিনি মানলেন না।দেহ সাথ না দিলেও কন্যার প্রতি ভালোবাসা এবং শুধুমাত্র মনের জোরে লক্ষ্মীনাথ অবশেষে স্টেশনে এসে দীপিকাকে সাশ্রু নয়নে বিদায় জানালেন।

দীপিকা আসার পরে উদার চেতনায় লক্ষ্মীনাথের মনের পরিবর্তন ঘটল।  পুনরায় কিছুটা আত্মবিশ্বাস পেলেন।তার জন্যই রত্না রোহিণী বিরোধিতা করা সত্ত্বেও লক্ষ্মীনাথ সম্বলপুরে ফিরে যাবার জন্য লক্ষ্মীনাথ ট্রেনের টিকেট কাটলেন।যাত্রার তারিখ ১৮ মার্চ বলে ধার্য করা হল।সঙ্গে তিনি যতীন্দ্রনাথ দুয়ারাকে জানিয়ে দিলেন,’২০ মার্চ সকালবেলা দার্জিলিং মেলে বোধ করি সাতটার সময় শিয়ালদহ গিয়ে পৌছাব।শিয়ালহ  থেকে হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন।  হাওড়াতে সারাদিন থেকে সেদিনই বোম্বে মেইল ধরে সেদিনই সম্বলপুর চলে যাব। হাওড়াতে তোমাকে পেলে বেশ মজা হবে।’ কিন্তু এবারও রত্না প্রচন্ড বিরোধিতা করল,’বাবা এই শরীর নিয়ে তুমি এতদূর জার্নি করতে পারবে না।এই অবস্থায় আমি তোমাকে যেতে দিতে পারব না।’ অবশেষে জেদি কন্যা রত্নার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথকে আপোষ করতে হল।

এমন সময় গুয়াহাটি থেকে চন্দ্র কুমার আগরওয়ালার মৃত্যু সংবাদ এল ( ২ মার্চ ১৯৩৮ সাল)। অভিন্ন হৃদয় চন্দ্রকুমারের মৃত্যু সংবাদ শুনে লক্ষ্মীনাথ মর্মাহত হলেন। চন্দ্রকুমার ছিলেন তার জন্য বহু সমস্যার সমাধান করা বন্ধু। চন্দ্রকুমার ছিলেন তার জন্য বেঁচে থাকার এক অন্যতম শক্তি। চন্দ্র কুমার ছিল তার জন্য জীবনটা উপভোগ করার, জীবনটাকে বিস্তার করার প্রাণময় এবং নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। চন্দ্রকুমার ছিল তার বহু সৃষ্টির প্রেরণা দাতা। চন্দ্রকুমার ইহসংসার ত্যাগ করার খবর শুনে লক্ষ্মীনাথের অন্তরটা কেঁপে উঠল। এবার তার এরকম মনে হল  যেন মৃত্যুদূত তার দরজার  সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সুখে দুঃখে ভেঙ্গে পড়ে লক্ষ্মীনাথ লিখলেন,’ বন্ধু ,সখা ,সুহৃদ— কাজটা উল্টো হয়ে গেল । আমারই যাবার কথা ছিল । আমাকে ছেড়ে তুমি এগিয়ে গেলে । এটা ঈশ্বরের কী ধরনের ইচ্ছা ? তুমি চলে যাবার খবর শুনে আমার আঙ্গুল অবশ হয়ে পড়েছে ,গলা শুকিয়ে আসছে, জিভ কড়কড়ে হয়ে গেছে। এই অবস্থায় প্রভু আমাকে গায়ে জোর দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে কি?’

মাজিউকে হারিয়ে মানসিকভাবে লক্ষ্মীনাথ বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুই ভালো লাগছে না। লেখা মেলা করার শক্তি তো আগেই নাই হয়ে গিয়েছিল। একটু আধটু বই পত্র পড়তেন। এখন পড়ার জন্য কিছু একটা মেলে ধরলেই অবশ আচ্ছন্নতার সঙ্গে চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসে। রত্নার মেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করে সময় কাটছিল। ওদের সঙ্গে খেলতে শুরু করলে কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তখন তার মনটা আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়ে। তাঁর মনটা শান্ত করার জন্য কাছে বসে প্রজ্ঞা ব্রাহ্ম  গীত গায়। না এভাবে শান্তি পাচ্ছেন না। তারপরে মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহের রবিবার তাকে আনন্দ দেবার জন্য রোহিণী এবং রত্না ব্রহ্মপুত্রের চরে বনভোজের আয়োজন করল। একটা মোটর বোটের ব্যবস্থা করে বাড়ির সবাইকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ বের হলেন।

ভটভট শব্দে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে মটর বোট এগিয়ে চলেছে। এখন ব্রহ্মপুত্রের দুই পার উত্তাল জলরাশিতে প্লাবিত নয়। তীর থেকে জল নিচের দিকে নেমে গেছে। দুই তীরের  গাছপালায় চৈত্র মাসের ধূসরতা। তীর থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত বালুময় চর পার হয়ে মূল জলধারা। ধীরগতিতে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রকে এখন বিবাগী বলে মনে হচ্ছে। তথাপি নদীবক্ষের মুক্ত পরিবেশে এসে লক্ষ্মীনাথ আনন্দিত হলেন।

ব্রহ্মপুত্রের বালুচরের কাছে নৌকায় তার জন্ম। শৈশবে বাবার সঙ্গে এই নদী দিয়ে নৌকায় অসমের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া, উচ্চ শিক্ষার্থী গোবিন্দ দাদার সঙ্গে দিশাং মুখ থেকে এই নদী দিয়ে কলকাতায় যাত্রা… এই নদী দিয়ে যাত্রা করার সময় দুই পারের বিস্তীর্ণ মাঠ সবুজ গাছপালা চিত্রময় গ্রাম ওপরের বিশাল নীলাকাশ, জ্যোৎস্না রাতের রুপালি আলো ঝকঝকে তীরের বনভূমি… সবকিছু মনে পড়ছে।

পরিবারের সবার সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের চরে বনভোজন খেলেন। মোটর লঞ্চ দাঁড়িয়ে থাকা জায়গায় একটা চালতে গাছের নিচ থেকে চালতে কুড়িয়ে প্রফুল্ল মনে লক্ষ্মীনাথ বাড়ি ফিরলেন। তাকে প্রফুল্ল চিত্ত দেখে প্রজ্ঞা, রত্না এবং রোহিণীও খুশি হলেন। কিন্তু সেদিন বিকেল থেকেই তিনি জ্বরে আক্রান্ত হলেন। সঙ্গে তার পুরোনো অন্ত্রের ঘা টা চাগাড় দিয়ে উঠল। রোগটা এত খারাপ ভাবে বেড়ে গেল যে আগে থেকে তাকে চিকিৎসা করতে থাকা ডঃ দাস দেওয়া কোনো ঔষধেই কাজ দিল না। ২৫ মার্চের রাত থেকে লক্ষ্মীনাথ ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়লেন। তার স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটতে লাগল। শেষ রাতের দিকে তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে লাগলেন ।

১৯৩৮ সালের ২৬ মার্চ । শনিবার । সকালে ব্রহ্মপুত্রের পারে বিদায়ের করুণ সুর বেজে উঠল। বাতাস নিস্তব্ধ হল। সকালের সজীবতা নাই হয়ে গেল। শয্যাগত লক্ষ্মীনাথ কাতর ভাবে বুকের পাশটাতে বসে থাকা পত্নীর দিকে তাকালেন । ইতিমধ্যে অন্তিম মুহূর্তের আশঙ্কায় প্রজ্ঞার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। তার দুচোখ দিয়ে জলের ধারা বয়ে চলেছে। তথাপি নিজেকে সামলে স্বামীর শিথিল শক্তিহীন ডান হাতটা চেপে ধরল। পায়ের কাছে বসে থাকা রত্না এবং মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা রোহিণী পরমেশ্বরের কাছে লক্ষ্মীনাথের জীবনের জন্য মিনতি করছে । কিন্তু না সবকিছুই অসার হয়ে গেল । জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে একটা ঝাঁকুনি দেওয়ার পরে লক্ষ্মীনাথের হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেল । লক্ষ্মীনাথ চিরকালের জন্য চোখ বুজলেন। 

যিনি ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসমান নৌকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যিনি প্রাণের সম্পত্তি স্বরূপ ব্রহ্মপুত্র নদীটিকে কৃপা বরুয়ার শেষ উইলে অসমিয়া জাতিকে দান করে গেছেন, সেই তিনি আজ লুইতের তীরে দেহত্যাগ করলেন।দেশকে ভালোবাসা যেখানে সেখানে দেশের গুণ গাওয়া মাতৃভাষার সামান্য অপমান অবহেলা হলেও বজ্র গম্ভীর কণ্ঠে মেতে উঠা এবং যার জীবনের মূল মন্ত্র দেশ, দেশের জাতি এবং মাতৃভাষা সেই লক্ষ্মীনাথ অসম মায়ের কোলে চির বিশ্রাম নিলেন ।

মুহূর্তের মধ্যে  দুঃসংবাদটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।চা ব্যাবসায়ী রোহিণী কুমার বরুয়ার বাসভবনে সাহিত্যরথীকে অন্তিম দর্শন করার জন্য জনতার স্রোত বইতে লাগল। ডিব্রুগড়ের সমস্ত শিক্ষানুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। কিছু সরকারি অফিস খোলা থাকলেও জেলা উপায়ুক্ত এই উপলক্ষে সোমবার দিনের দুটো থেকে সরকারি  কার্যালয়ের ছুটির আদেশ দিলেন।

 শনিবার দিন নগরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্ন শিক্ষা অনুষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষয়িত্রী,ছাত্র-ছাত্রী রোহিণীকুমার বরুয়ার বাসভবনের প্রাঙ্গণে সমবেত হলেন।ন্তিম শয়নে শায়িত্ত বেজবরুয়ার দেহটা ফুল দিয়ে সাজিয়ে নাম কীর্তন করে নগর পরিভ্রমণ করে নদীর ঘাটে নিয়ে আসা হল।

লুইতের তীরে চিতা সাজানো হল।

 ইতিমধ্যে শিবসাগর থেকে ভাগ্নেপুত্র পুষ্প ফুকন এসে উপস্থিত হয়েছে।

 হিন্দু সংস্কার মতে অপুত্রক বা পুত্রের অপারগতার ক্ষেত্রে অন্তেষ্টিক্রিয়ার অধিকারী হয় বিবাহিত স্ত্রী কন্যা এবং জামাতা। দৌহিত্র হিসেবে অরুনার পুত্র স্বরূপ কুমার মুখার্জি লক্ষ্মীনাথের মুখাগ্নি করার অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু এখন বরোদা থেকে এনে মুখাগ্নি করানোটা অসম্ভব কথা। তাছাড়া জীবিত থাকতেই এই বিষয়ে লক্ষ্মীনাথ সজ্ঞানে বিধান দিয়ে গেছেন। তার ইচ্ছা অনুসারে ভাগ্নেপুত্র পুষ্প ফুকন তার মুখাগ্নি করল।

কিছুক্ষণের মধ্যে চিতাগ্নি জ্বলে উঠল।লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার দেহটা পঞ্চভূতে বিলীন হল। 

লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার প্রয়াণের কথা শুনে প্রবীণ সাহিত্যিক পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া শোক প্রকাশ করে লিখলেন—‘ বেজবরুয়া জন্মভূমি থেকে দূরে দূরে অন্য প্রাদেশিক ভূমিতে কাটিয়েছেন। তথাপি ‘চরণে জানে মরণের ঠাঁই’ এই নীতি অনুসারে তার  লুইতিয়া নশ্বর দেহটি লুইতের বালুতে এসে বিলীন হয়ে গেল।

 কবি যতীন্দ্রনাথ দুয়ারা তার শোকগাথায় ব্যক্ত করলেন,

 লুইতের বুকে জন্ম লভিলে

 লুইতের বুকে মহাপ্রয়াণ

 লুইতের সুরে সুর বেঁধে নিয়ে

 দিলে অসমকে হারানো প্রাণ।

বঙ্গের অভিজাত দেশ পত্রিকা লিখল অসমিয়া সাহিত্যের ভান্ডারে  বেজবরুয়া মহাশয়ের দান অতুলনীয়।বাংলার সহিত তাহার অন্তরের যোগ ছিল। ব্যাবসা সূত্রে তিনি সম্বলপুরে বাস করিতেন। উড়িষ্যার সঙ্গেও তাহার যোগাযোগ ছিল। তাহার সাহিত্য সৃষ্টিতে বাংলা উড়িষ্যা এবং অসমের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়।

বেজবরুয়ার মৃত্যুর সংবাদ জানতে পেরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শোক প্রকাশ করে লিখলেন—‘ভারতবর্ষের প্রত্যেক প্রদেশে তাহার আপন আপন ভাষার পূর্ণ ঐশ্বর্য উদ্ভাবিত হলে তবেই পরস্পরের মধ্যে নিজের শ্রেষ্ঠ অর্ঘের দান--প্রতিদান সার্থক হইতে পারিবে এবং সেই উপলক্ষেই শ্রদ্ধা সমন্বিত ঐক্যের সেতু প্রতিষ্ঠিত হইবে। জীবনে লক্ষ্মীনাথ  বেজবরুয়ার এই সাধনা অতন্দ্রিত ছিল। মৃত্যুর মধ্য দিয়া তাহার এই প্রভাব বল লাভ করুক এই কামনা করি।’ 


  


    


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...