বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ।। স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর কাহিনি
বাসুদেব দাস
বিখ্যাত ব্যায়াম বীর রামমূর্তি চট্টগ্রাম এসেছেন সার্কাস দেখাতে। রামমূর্তির বুকের ওপর দিয়ে হাতি চলে যায়, চলন্ত মোটর থামিয়ে দেন অনায়াসে। এমনই সব অবিশ্বাস্য শারীরিক ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে চট্টগ্রামের যুব সমাজে আলোড়ন তোলেন তিনি। দলেরই এক সাহেব মোটরের সঙ্গে বাঁধা মোটা শেকল ছিঁড়ে ফেলে চট্টগ্রামের তরুণদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলে এরকম যদি কেউ করতে পার তবে এগিয়ে এসো। চ্যালেঞ্জের প্রত্যুত্তর দেয় এক যুবক। এগিয়ে এগিয়ে সবার সামনে শিকল ছিঁড়ে ফেলে। এই যুবকটিই পরবর্তীকালের বিখ্যাত বিপ্লবী অনন্ত সিংহ।
রামমূর্তি চলে গেলেন; কিন্তু সেদিন থেকে অনন্তের ধ্যান-জ্ঞান হল কীভাবে প্রফেসর রামমূর্তির মতো শক্তির অধিকারী হওয়া যায়। শুরু হল একলব্যের কঠোর সাধনা, হাতির অভাব অনন্তকে থামাতে পারল না।বসবার বেঞ্চ বুকে নিয়ে তার ওপরে দাঁড় করালেন আটজন ছাত্রকে। শেকলের বদলে পাওয়া গেল মোটা দড়ি। মোটরের বদলে কুড়িজন ছাত্রের বিরুদ্ধে দড়ি টানাটানিতে তিনি একা স্থির হয়ে রইলেন।
সমস্ত চট্টগ্রাম তখন রীতিমতো অগ্নিগর্ভ। বিপ্লবী নেতা সূর্যসেন ওরফে মাস্টারদার নেতৃত্বে তখন ভেতরে ভেতরে বিপ্লবী তরুণরা সংগঠিত হতে শুরু করেছে। তবে সমস্ত ব্যাপারটাই ছিল একান্তই গোপনীয় ।মাস্টারদার সঙ্গে অনন্তের তখনও পরিচয় হয়নি। একদিন সে সুযোগ এসে গেল। অন্তরঙ্গ সহপাঠী প্রমোদের সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের কর্ণফুলীর তীরে এক কুটিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন অনন্ত। তখনও ভোর হতে অনেক দেরি। সংকেত অনুসারে দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। ঘরের মধ্যে একটি মাত্র খাট, লোক একজন। দেখলে আর যাই হোক বিপ্লবী নেতা বলে ভুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অথচ এই ক্ষীণকায় লোকটি সমস্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে যে একদিন ভাবিয়ে তুলবে তাকি কেউ সেদিন কল্পনা করতে পেরেছিলেন? না অনন্ত সিংহও পারেননি ।বরং তিনি এই সাধারণ আকর্ষণবিহীন চেহারা দেখে হতাশই হয়েছিলেন। এই লোকটি সর্বজন শ্রদ্ধেয় চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাই স্কুলের অংকের শিক্ষক মাস্টারদা। বিশেষ করে মাস্টারদার কাছে কোনো রিভলভার ছিল না এবং তখন পর্যন্ত একজন সাহেবকেও মারেন নি শুনে অনন্ত সিংহ রীতিমতো দমে গিয়েছিলেন । তবে ধীরে ধীরে মাস্টারদা ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে অনন্ত সিংহের মনে স্বাধীনতার স্পৃহা জেগে উঠল। নতুন নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজ শুরু হল।Charity begins at home সুতরাং প্রথমেই দলে এলেন অনন্তের দাদা ও দিদি ইন্দুমতী সিংহ । বাড়ির সবার পরোক্ষ সমর্থন রইল বিপ্লবের হোম শিক্ষা প্রজ্বলনে । ক্লাসের ভালো ছাত্র আফসারউদ্দিন এবং গণেশ ঘোষ ও চলে এলেন একদিন। ব্যায়াম, বক্সিং, যুযুৎসু ইত্যাদির অনুশীলন চলতে লাগল। তারপর এসে গেল বহু প্রতীক্ষিত সেই দিন। ১৯৩০ সনের ১৮ এপ্রিল। রাত তখন দশটা। সর্বাধিনায়ক মাস্টারদার পূর্ব পরিকল্পনা মতো সবার আগে এগিয়ে এলেন যুব বিদ্রোহের অন্যতম দুর্ধর্ষ দুই নায়ক অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষ। সঙ্গে বিধু ভট্টাচার্য ,হরিপদ মহাজন ,হিমাংশু সেন আর সরোজ গুহ। প্রত্যেকের পরিধানেই সামরিক পোশাক।সামনে রয়েছে পুলিশ লাইন। যেভাবেই হোক জেলার অন্যতম ঘাঁটি এই পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগারটি দখল করতে হবে। অতর্কিত আক্রমণে অস্ত্রাগারের প্রহরীরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল। বড়ো বড়ো হাতুড়ির ঘায়ে ম্যাগাজিন কক্ষের শক্ত তালা ঝন ঝন করে ভেঙ্গে পড়ল। একটি দুটি নয় শত শত পুলিশ মাস্কেটি রাইফেল, সেই সঙ্গে অসংখ্য রিভলভার আর কার্তুজ। বিপ্লবীদের আনন্দের আর সীমা রইল না। ওদিকে জেনারেল লোকনাথ বল ও নির্মল সেনের নেতৃত্বে তখন আর এক অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে অক্সিলারি আর্মারিতে। প্রয়োজন মতো অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিয়ে পেট্রোল ঢেলে অস্ত্রাগারে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। হিমাংশু সেনের জামাকাপড়ে কিছু পেট্রোল পড়ে যাওয়ায় আগুন ধরাতে গিয়ে সমস্ত শরীর দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। সে এক বীভৎস অবস্থা। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষ হিমাংশুকে গাড়িতে তুলে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চললেন। ফলস্বরূপ তাঁরা মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। এরপর হাজার চেষ্টা করেও তাঁরা মূল বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হননি। ২২ এপ্রিলের রাত আটটায় চট্টগ্রাম থেকে আট মাইল দূরে পুঁটিয়ারি রেল স্টেশনে কাউন্টারের সামনে অনন্ত সিংহকে দেখা গেল সঙ্গে আরও তিনজন। দেখে মনে হয় নিরীহ গ্রাম্য লোক। ততদিনে সমস্ত চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের অভ্যুত্থানের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপার দেখে লোভী স্টেশন মাস্টার অশ্বিনী ঘোষের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে জলে উঠল। এই সুযোগকে যেভাবেই হোক কাজে লাগাতে হবে। দু'একজনকে ধরিয়ে দিতে পারলে সরকার বাহাদুরের বদান্যতায় বাকি জীবনটা বেশ আরামে কাটানো যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গাড়ি প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই গার্ডকে নিজের সন্দেহের কথা জানিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তী স্টেশন গুলিতে টেলিগ্রামে টিকিট নম্বর জানিয়ে সংশ্লিষ্ট যাত্রীদের সন্দেহজনক গতিবিধির উপর নজর রাখতে বললেন। ট্রেন তখন হু হু করে ছুটে চলেছে। কামরার ভেতরে চারজন নিরীহ গ্রাম্য যাত্রী।অনেক চেষ্টা করেও মাস্টারদার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি । আপাতত গন্তব্যস্থল কলকাতা মহানগর । রাত দুটোয় ট্রেন ফেনী স্টেশনে ঢুকতেই কামরায় উঠে এল এক বিরাট সশস্ত্র পুলিশবাহিনী।অনন্ত সিংহ ততদিনে রূপকথার নায়ক।কত গল্প,কত অলীক কাহিনিই না তৈরি হয়েছিল তাকে কেন্দ্র করে।তিনি নাকি শুধু হাত দিয়ে নয়,হাত,পা,চোখ,কান দিয়েও রিভলভার চালাতে পারেন।এ কথাটা যে খুব একটা মিথ্যা নয়,সেদিন তার প্রমাণ পাওয়া গেল।পুলিশ ততক্ষণে তল্লাশি শুরু করে দিয়েছে।এবার শরীর তল্লাশির পালা।প্রথমেই ডাকা হল জীবন ঘোষালকে।দেখি তোমার কোমরে কী আছে?ব্যস,আর যায় কোথায়?অনন্ত সিংহের রিভলভার গর্জে উঠল দ্রাম।দ্রাম।ইঙ্গিত পেয়ে জীবন ঘোষাল ও আনন্দ গুপ্তের রিভলভার গর্জে উঠল।শুরু হল চিৎকার,চেঁচামিচি আর হইচই। ঐ যে পালাল।ধর ওদের।সব বৃথা।নিমেষে সব হাওয়া।রাতের অন্ধকারে ছুটে পালাতে গিয়ে অনন্ত সিংহ দলছুট হয়ে পড়লেন।অনেক পরে সবাই চন্দননগরের আশ্রয়স্থলে পৌছালেন।এপ্রিল শেষ,মে মাসও শেষ হওয়ার পথে।ততদিনে যুববিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকে ধরা পড়েছেন।কয়েকজন সম্মুখসমরে ইতিহাস সৃষ্টি করে মৃত্যুবরণ করেছেন।কিন্তু কোথায় অনন্ত সিংহ বা গণেশ ঘোষ।সর্বাধিনায়ক মাস্টারদাই বা কোথায়?২৮ জুন একটা খবরে সবাই চমকে উঠলেন।অনন্ত সিংহ সেদিন গোয়েন্দাবিভাগের হেড কোয়ার্টাস ইলিসিয়াম রোতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলেন।অনন্ত সিংহের মতো একজন প্রথম শ্রেণির নেতার এই ধরনের আত্মসমর্পণের মূল কারণ অনেকেই খুঁজে পেলেন না।লোম্যানকে লেখা এক চিঠিতে তিনি এটাকে পুরোপুরি ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় বলে জানালেন।তবে অন্যদিক দিয়ে ব্যাপারটা বেশ ফলপ্রসূ হয়েছিল বলে মনে হয়।রাজবন্দিদের অনেকেই ছিল বেশ অপরিণত বালকমাত্র।শারীরিক ও মানসিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে অনেকেই পুলিশের কাছে কিছুটা স্বীকারোক্তি করে ফেলে।প্রিয় নেতা অনন্তকে কাছে পেয়ে এবার তারা বেঁকে বসল।এই কৃ্তিত্বের দাবীদার নিঃসন্দেহে অনন্ত সিংহ।শুরু হল বিখ্যাত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা।আসামী পক্ষে রয়েছেন শরৎ দাস,বীরেন্দ্রনাথ,শ্রীশ বসু,অখিল দত্ত,কালীচরণ ঘোষ,এন সি মুখার্জী,সন্তোষ বসু প্রমুখ বাংলার সুদক্ষ আইনজীবীরা।দেখা যাক কী হয়।ইংরেজ কী হাতের কাছে এত বড়ো সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দেবে।অবশেষে মামলার রায় বেরোল।অনন্ত সিংহ যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দন্ডে দন্ডিত হলেন।এবার এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনায় হাত দিলেন মাস্টারদা।ডিনামাইট চার্জ করে কোর্টভবন বা জেলখানার দেওয়াল উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করেন।কাজ দ্রুত গতিতে এগোতে লাগল।কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।১৯৩১ সনের ২ জুন একটি কিশোর কর্মীর আকস্মিক গ্রেপ্তারে সমস্ত কিছু ফাঁস হয়ে গেল।দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও অনন্ত সিংহ দীর্ঘকাল বেঁচে ছিলেন।স্বাধীনতার এই অনাকাঙ্খিত বিষাদময় পরিণতি অনন্ত সিংহের মতো বিপ্লবীকে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করে।‘কেউ বলে বিপ্লবী কেউ ডাকাত’নামে অনন্ত সিংহের আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থটি জনসাধারণে আলোড়ন ও বিতর্কের সৃষ্টি করে।চট্টগ্রাম বিপ্লবের অন্যতম যুবনেতা অনন্ত সিংহ ভারতবাসীর কাছে চিরকাল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন