রবিবার, ৩ মার্চ, ২০২৪

পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ৪ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi

পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ৪

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  

Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi




তৃতীয় অধ্যায়, চতুর্থ অংশ ।। পাখিদের পাড়া- পড়শী

......

তৃতীয় অধ্যায়


(চার)

 লাউস থেকে আসার পরে আমি পাখিদের পাড়াপড়োশিতে কীভাবে কাজ করব তার মোটামুটি একটা খসড়া প্রস্তুত করলাম। তাদের পদ্ধতিতে কাজ করায় আমার অসুবিধা আছে। প্রথম কথা আমাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য সরকার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে থাকবে না। দ্বিতীয়তঃ তারা ‘সাসটেনেবল লাইভলিহুড’ বা জীবিকার গ্রহণযোগ্যতার জন্য শুধুমাত্র কাঠকেই মূল হিসেবে বিবেচনা করছে।যা আমার বিবেচনায় আমাদের জন্য শুদ্ধ হবে না। তৃতীয়তঃ তারা অরণ্য গ্রামে কয়েকটি গ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সেটাও আমাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। চতুর্থত তারা সমস্ত কাজকর্ম সরকারি যন্ত্রের আওতার মধ্যে করার ফলে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শেষে তারা অরণ্য গ্রামের ধারণাকে কিছু বিকৃত করা বলে অনুভব হচ্ছে। অরণ্য বললে গাছের সঙ্গে তরু তৃণ পাখ-পাখালি, জীবজন্তু, সাপ-প্রজাপতি,মাছি ব্যাঙ সবাইকে সমান গুরুত্ব প্রদান করতে হবে এবং সমস্ত প্রাণীর জন্য সুরক্ষা কবচ তৈরি করতে সমর্থ হতে হবে।

 সর্বোপরি লাওসের অরণ্য গ্রামের ধারণা আমাদের অরণ্য গ্রামের ধারণার প্রায় বিপরীতমুখী বলে আমার মনে হল। তারা অরণ্য গ্রামের যে সূত্র তৈরি করেছে তা থেকে তাদের ধারণা আমার বিপরীত বলে স্পষ্ট প্রতিপন্ন হয়েছে। তারা অরণ্য গ্রাম বলতে বলছে—’অরণ্য সম্পদকে জীবিকামুখি করে গড়ে তোলার জন্য লাওসের গ্রাম এবং স্থানীয় বন প্রশাসনের মিলেমিশে কাজ করার প্রচেষ্টা চলছে। আমাদের ক্ষেত্রে জীবিকা মুখিতা চেয়ে সংরক্ষণের উপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। সংরক্ষণ সুদৃঢ় হলেই জীবিকার পথ প্রশস্থ হবে। আমাদের সংরক্ষণ হবে বর্ণময় প্রচেষ্টা, সরকারি যন্ত্রের মারপ্যাঁচ থেকে সেখানে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে প্রকৃতির প্রতি থাকা গ্রামবাসীর আন্তরিক স্বতঃস্ফূর্ত স্নেহ ভালোবাসাকে।

 লাওস থেকে ফিরে আসার পরে তৈরি করা খসড়াটা আমি আলাদা আলাদা ভাবে লিপিবদ্ধ করে বের করলাম।

 প্রথমে অরণ্য গ্রামের উপর ভিত্তি করে প্রকৃতি কর্মীদের একটি শিবিরের আয়োজন করতে হবে। সেখানে আমি তাদের কাছে অরণ্য গ্রামের ধারণাটা তুলে ধরব। যারা এই ধারণাকে নিয়ে কাজ করতে চায় তাদের নিয়ে আমরা প্রত্যেকেই এগিয়ে যাব। সেই জন্য শিবিরটাতে বেশি সংখ্যক প্রকৃতি কর্মীর যোগদান নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে থানটার নিকটবর্তী নদী অঞ্চলে যাদের নিজেদের জমি আছে তাদেরকে জড়িত করতেই হবে। তাদের সাহায্যে আমরা গাছের চারা বপন করতে আরম্ভ করব এবং পর্যায়ক্রমে সমূহ গ্রামবাসীকে জড়িত করব।

 আমার মানসিক প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হওয়ার পরে আমি সুনন্দকে ফোন করলাম।

প্রকৃতি শিবির অনুষ্ঠিত করার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সুনন্দ আনন্দে ফেটে পড়ার উপক্রম হল। সে যেন আমার কাছ থেকে এই কথাটা শোনার জন্যই বহুদিন থেকে অপেক্ষা করেছিল।

 — এইবার প্রকৃতি শিবিরের বিষয় কী নির্বাচন করা হয়েছে উদয় দা?

 — অরণ্য গ্রাম।

 — অরণ্য গ্রাম?

 প্রশ্নবোধক প্রতিক্রিয়ায় সে আমার কাছ থেকে সমাধান আশা করে ফোনটার বিপরীত দিকে অপেক্ষা করে রইল।

 — নদীর দুপাশে এবং গ্রামের মানুষের বস্তিগুলি এমনিতেই দেখছি পড়ে আছে। আমরা সেখানে বিভিন্ন ধরনের গাছ রোপণ করে পরিবেশটা অরণ্যে পরিবর্তিত করতে পারিনা কি?

 — পারি। কেন পারব না ।

 সুনন্দ স্পষ্ট এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বলল।

 — এই ধারণাটা প্রত্যেকের মনে রোপণ করার জন্য এইবারের প্রকৃতি শিবিরের বিষয়— অরণ্যগ্রাম। আমাদের প্রতিজন সদস্য গাছের চারা রোপণ করবে,প্রতিপালন করবে। এটা হল প্রথম পর্যায়ের কাজ।

 — দ্বিতীয় পর্যায়ে?

 সুনন্দ আমাকে উল্টে প্রশ্ন করল।

 — দ্বিতীয় পর্যায়ে গড়ে উঠা অরণ্য গ্রাম থেকে আমরা প্রকৃতি পর্যটনের জন্য প্রস্তুত করে তুলব। অথবা হয়তো প্রকৃতি পর্যটনের কাজও একই সময়ে এগিয়ে নিয়ে যাব। তার মধ্যে এমন ধরনের আন্তঃগাঁঠনির সৃষ্টি করা হবে যাতে অরণ্য গ্রামটিতে দেশ-বিদেশের পর্যটক আসে।

 কেউ নদীতে বড়শি বাইতে আসে, গঙ্গাপুকুরে অস্থি ভাসাতে আসবে, অরণ্য গ্রামে পাখ-পাখালি পর্যবেক্ষণ করতে আসবে, স্থানীয় সুস্বাদু খাদ্যের স্বাদ নিতে আসবে। অনেক, ইত্যাদি। তার জন্য গ্রামের মানুষকে সচেতন প্রশিক্ষিত এবং সহযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। ভাবনাকে কার্যে রূপায়িত করা সহজ কথা নয়। আমাদের কয়েকজনকে বেশ কিছুদিন কষ্ট করতে হবে। হয়তো আমরা সুফল পাব এবং অসমের ভেতরে নয় ভারতের ভেতরে নতুন উদাহরণ স্থাপন করতে সক্ষম হব।

 আমার কথা শুনে সুনন্দ  খুব উৎসাহ অনুভব করল। তার বার্তালাপে সে প্রকাশ করা উস্মাকে অত্যুৎসাহ বলা যেতে পারে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল শিবির অনুষ্ঠিত করার জন্য আমি দিন ঠিক করেছি কিনা। আমি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ বলায় সে নিরাশ হয়ে পড়ল  বলে মনে হল।

 —তোমার কোনো অসুবিধা আছে নাকি? আমি সুনন্দকে জিজ্ঞেস করলাম।

 —আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে হলে ভালো। ছয় মাসের পরীক্ষা শেষ হবে এবং গ্রীষ্মের বন্ধ আরম্ভ হবে।

 —বল নাই কেন! আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই হবে। সেই অনুসারে তুমি কাজ আরম্ভ করে দাও। নবজিৎ বৈশ্য, কীচক, জেপিদের নিয়ে একবার বস। আর টিংকু, পুলক, রাতুলদের সঙ্গে নাও। আমাদের আগের শিবিরগুলিতে যারা অংশগ্রহণ করেছিল তাদের খবর দাও। তাদের মনোভাব কী রকম জানার চেষ্টা কর।

 —উদয়দা, প্রত্যেকেই শিবিরের জন্য উৎসুক হয়ে আছে। আমার সঙ্গে দেখা হলে তারা জিজ্ঞেস করতে থাকে, পরবর্তী শিবির কখন অনুষ্ঠিত হবে।

 —তুমি কী বল?

 — খুব তাড়াতাড়ি হবে বলে রাখি কারণ আপনার থেকে নির্দিষ্ট দিন- বার- খবর কিছুই পাইনি যে, সেই জন্য।

 — সুনন্দ। আমি শিবিরের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। মাঝখানে অরণ্য গ্রামের বিষয়ে অধ্যয়ন করার জন্য লাওসে গিয়েছিলাম। তোমাদের জানানো হয়নি। সৌম্যদাকে আজ পর্যন্ত বলিনি। সমস্ত তথ্যাদি নিয়ে আমি তোমাদের শিবিরে জানাব বলে মনে মনে স্থির করেছি। কাকাবাবু ভালো আছো কি? দেখা হয়েছে? অনেকদিন হল আমি কাকাবাবুকে  ফোন করিনি। ফোন করলেই বলেন— কালকেই চলে এসো। আমি উনাকে যাব যাব বলে রেখেছি— তখন ফোন করতে ভালো লাগেনা।

 আমি অনেকক্ষণ একনাগরে সুনন্দকে বলে কিছুক্ষণ বিরতি নিলাম। দেখি সুনন্দ কী বলে।

 — কাকাবাবুর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমাদের খবর নেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আপনার খবরও নিয়ে থাকেন। বলেন—তোমরা কী ধরনের মানুষ হে? কাজগুলি এভাবে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। ছেলে মেয়েদের উঠিয়ে দিয়ে তোমরা সরে পড়লে।একই কথা বলতে থাকেন বলে, আমি মানুষটাকে এড়িয়ে চলি।

 — মানুষটা আমাদের কাজের মধ্যে নিজেকে জড়িত করে ব্যস্ততা অনুভব করেছিলেন। সেই জন্যই হয়তো একই কথা বারবার বলে থাকেন। মানুষটা ছেলের মৃত্যুর শোক কিছুটা ভুলতে পেরেছেন কি?

 — বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝা যায় না উদয়দা।

 — একমাত্র ছেলের মৃত্যুর শোক কোথায় আর ভুলতে পারবেন! আমরাই পারিনি। আসলে কাকাবাবু আমাদের কাজের মধ্যে নিজেকে জড়িত করে পুত্রশোক  ভুলে থাকতে. চান। এর সঙ্গে ভাবেন জ্যোতিষকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আমাদেরই কিছু একটা করা উচিত। 

 শেষ পর্যন্ত সুনন্দকে  প্রকৃতি শিবিরের আয়োজন এগিয়ে নিয়ে যেতে পুনরায় মনে করিয়ে দিলাম।

 আগস্টের চার তারিখ থেকে দু দিনের জন্য অরণ্য গ্রামের ওপরে প্রকৃতি শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে। সৌম্যদা পাঁচ  তারিখ শিবিরে উপস্থিত থাকবেন এবং তিনি প্রকৃতি পর্যটনের ওপরে প্রকৃতি কর্মীদের বিস্তৃত আভাস দেবেন। আমি সুনন্দের সঙ্গে নবজিৎ বৈশ্য, কীচক, প্রণব কুমার ভাগবতী, নবজিৎ বর্মন ইত্যাদি যাদের প্রকৃতি শিবিরে অংশ নেওয়া ফোন নাম্বার আমার কাছে ছিল তাদের ফোন করলাম। যারা ইতিমধ্যে শিবির অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর পেয়েছে, তারা প্রত্যেকেই উৎসাহিত হয়ে উঠল। তাদের কথাগুলি এরকম যে আমি আদেশ দিলেই হল— তারা সবকিছু করার জন্য প্রস্তুত। আমি বললাম— আমার আদেশ দেবার কিছু নেই, তোমরা এক নির্ধারিত পদ্ধতিতে কাজ করে যাও এবং আমরা প্রত্যেকেই সফল হব,হবই।

 দুই তারিখ সকাল বেলা সাড়ে আটটার সময় আমি বগলছ চকে পৌছালাম। দেড় বছর পরে চকটাতে গাড়ি থেকে নেমে কিছু পরিবর্তন দেখতে পেলাম। মূল চকটার গুয়াহাটির দিকে বাঁদিকে একটা প্রকাণ্ড অট্টালিকা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখানে টিভি, ওয়াশিং মেশিনের একটি দোকান, সুদৃশ্য কাপড়ের একটি দোকান দেওয়া হয়েছে। ডানদিকে ফাস্টফুডের রেস্টুরেন্ট একটা গড়ে উঠেছে। ফলে চকটির গাম্ভীর্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চকটি সমৃদ্ধ হয়ে পড়ায় আমারও মনটা ভালো লাগল। স্থানীয় মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয় মানুষেরই ব্যবসা না করলে বহিরাগত এসে সবকিছু দখল করে নেবে। বরপেটা কে বাদ দিয়ে অসমের একটি শহরেরও বাণিজ্য স্থানীয় অসমিয়াদের হাতে নেই। কী দুঃখজনক, পরিতাপের কথা।

 স্বভাববশতঃ তুলিকা মিষ্টির ঘরে ঢুকলাম। পুষ্কর বলে ডাকা ছেলেটি আছে। আমাকে দেখে সে এগিয়ে এল। আসার সময় হাতে করে আনা কাগজটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল— পুরি খাবেন তো?

 — দাও, পুরিই দাও।

 একটাই বাক্য তারও মুখস্ত হয়ে গেছে এবং সম্ভবত আমার উত্তর ও একই ধরনের হয়েছে।

 আমি হোটেলটার পেছন দিকে গিয়ে চাপাকলে হাতমুখ ধুতে লাগলাম। সূর্যটা বিপুল পরাক্রমে উত্তাপ দিতে শুরু করেছে বলে মনে হল। প্রখর রোদ আজ চারপাশকে দহন করে ফেলছে। চাপা কলের ঠান্ডা জল গালে মুখে ছিটিয়ে দেওয়ায় কিছুটা সতেজ বলে মনে হল। গরম পুরির ধোঁয়া নাকে মুখে প্রবেশ করায় পেটের মধ্যে ক্ষুধা চাগাড় দিয়ে উঠল। টেবিলের ওপরে কাগজটা পেতে নিয়ে কাগজ পড়া আর পুরি খাওয়ার মজা— দুটো সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিতে লাগলাম।

 পেটটা পরম শান্তি লাভ করার পরে আমি ভাঙড়া গোঁহাইর থানে থাকা পর্যটক নিবাসটার দিকে এগিয়ে গেলাম। মূল পথ থেকে পর্যটক নিবাস পর্যন্ত যাওয়া  মোড়টায় পৌছে আমি দেখতে পেলাম কিছু দূরত্বে একটি দোকান গড়ে উঠেছে। দোকানটার সামনে কিছু পরিমাণে কাঠ স্তূপীকৃত অবস্থায় রাখা আছে। আমি দোকানটা দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম। দোকানটার নাম রেখেছে ‘প্রাকৃতিক বৈভব’। দেখলে বেটাকে দেখলে— কবি হয়ে অরণ্য ধ্বংস করার জন্য খড়ির দোকান দিয়েছে। দোকানটা দেখে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। খড়ির দোকান আরম্ভ হয়েছে মানে এখানে গাছ কাটার পর্ব আরম্ভ হয়ে গেছে।

 পর্যটক নিবাসটায় এসে থানটা এবং এর চারপাশের বিশেষ পরিবর্তন দেখতে পাইনি। কেবল চার-পাশটা নোংরা দেখছি। শীতকালের চেয়ে গ্রীষ্মকালে পরিবেশ কিছুটা কদর্য হতে দেখা যায়। চারপাশে বন‐বাত গজিয়েছে এবং পরিবেশটা কিছুটা বিশ্রী লাগাটা স্বাভাবিক। সম্ভব হলে একদিন সামগ্রিকভাবে সাফাইয়ের কাজে লাগতে হবে। পারলে না করতেই হবে। পর্যটক নিবাসের চাবি নিয়ে সুনন্দ আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।

 —পরিবেশটা খুব নোংরা হয়েছে সুনন্দ। একদিন হাতে কলমে শুরু করে দেওয়া ভালো হবে নাকি?

 —তাহলে প্রকৃতি শিবির আরম্ভ হওয়ার আগে আগে আমরা শুরু করে দিই।

 —প্রথম দিনে হবে না। তারা প্রস্তুত হয়ে আসবে না। গরমে এই সমস্ত করে তারা শিবিরে মন বসাতে পারবে না।

 আমি সুনন্দকে একথা বলায় সেও আমার কথায় সায় দিল।

 —তাই প্রথম দিন প্রকৃতি কর্মীদের বলে দিলে দ্বিতীয় দিন সাফাইয়ের কাজ শুরু করলে ভালো হবে। তবে সুনন্দ এখানে দেখছি খড়ির দোকান আরম্ভ হয়েছে। খড়ির দোকান আরম্ভ হয়ে গেছে মানে গাছ কাটাও শুরু হয়েছে।

 —তার মানে আপনি দেখতে পেয়েছেন। আমি আপনাকে টেলিফোনে জানাব বলে ভেবেও বলিনি। আপনি নিজে এসে পরিস্থিতি অনুধাবন করুন আর আমাদের কী করতে হবে বলুন। আপনি নেই বলে আমরা কিছুই করতে পারিনি। খড়ির দোকানই নয়, সেতু পার হয়ে বাঁধের তীর ধরে কিছু দূরে এগিয়ে গেলে দেখবেন —সেখানে একটা কাঠ চেরার মিল ও খোলা হয়েছে।

 ঘরের তালাটা খুলতে খুলতে সুনন্দ বলল।

 —কাঠ চেরা মিল!

 ঠ‌ঙ করে তালা খোলার শব্দ এবং আমার উষ্মা জড়িত বাক্যটা এক সুরে জড়িয়ে পড়ল।

 সুনন্দের কথা শুনে আমার মাথায় বজ্রাঘাত হওয়ার  মতো মনে হল। দ্রুত সমস্ত কিছু দেখছি খারাপের দিকে যাচ্ছে। সুনন্দ গতকাল পরিষ্কার করে রাখা ঘরের একমাত্র বিছানাটায় আমার সঙ্গে আনা রুকসেকটা রেখে সুনন্দকে একটা পরামর্শ দিলাম।

 —সুনন্দ, তুমি আমাদের শিবিরে খড়ির দোকানটার এবং মিলের মালিককে বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ করবে। পারবে কি?

 —খড়ির দোকানের মালিক অচ্যুৎ। অচ্যুৎকে বলা যাবে এবং সে হয়তো আসবেও। কিন্তু মিলের মালিককে বলায় একটু সমস্যা আছে। তাকে বললেও আসবেনা।

 —কেন?

 —অবৈধ কাঠচেরা কলের মালিক পরিবেশ শিবিরে আসবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া তিনি আত্মসমর্পণকারী বিদ্রোহী। গলায় সোনার চেইন, বুলেট চালানো নিবারণের আদব কায়দাই আলাদা।

 —বাহ তাই নাকি? চেষ্টা করে দেখ। তারপরে দেখা যাবে কী হয়। 

    --চেষ্টা করে দেখব উদয়দা।তবে আসবে বলে মনে হয় না।

 —না এলেও খবরটা অন্তত পাবে।

 —সেটা ঠিক। আমরা যে প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজ শুরু করেছি সেটা তার জানা উচিত।

 —আজ সন্ধেবেলা আমরা দোকানটা এবং কাঠচেরা মিলটা দেখতে যাব। তাদের দুজনকে আমরা দুজন প্রকৃতি শিবিরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে আসব।

 সুনন্দের  সম্মতিতে আমরা সন্ধেবেলা সেদিকে যাব। কথা প্রসঙ্গে আমি শিবিরের আয়োজনের বিষয়ে সুনন্দের কাছ থেকে খবরা-খবর নিলাম। তখনই কীচকের সঙ্গে নবজিৎ বৈশ্য এসে উপস্থিত হল। তারা দুজন শিবিরে যোগদান করতে চলা প্রকৃতি কর্মীদের সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছিল। সুনন্দ দুজনকেই যাবার পথে এখানে হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল। সেই সূত্রে দুজনে এসে উপস্থিত। আমি তাদের শিবিরে ছেলে-মেয়ে বিশেষ করে এই অঞ্চলে স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতা পাব কিনা জিজ্ঞেস করলাম। তিনজনেই একেবারে নিশ্চিত বলে জানাল।

 —এবার দুই চার জন স্থানীয় ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করবে। যেহেতু এইবার শিবিরের মূল বিষয় অরণ্য গ্রাম, স্থানীয় লোকের অংশগ্রহণ ছাড়া আমাদের শিবির সাফল্যমন্ডিত হবে না।

 —সৌম্যদা কী বিষয়ের ওপরে বলবে?

 —কীচক জিজ্ঞেস করল।

 —তিনি প্রকৃতি পর্যটনের বিষয়ে বলবেন। অরুণ্য গ্রামের সঙ্গে প্রকৃতি পর্যটন ও শিবিরের বিষয়। প্রকৃতি কর্মীদের এই বিষয়েও অবগত করবে। মাঝখানে মাত্র কালকের দিনটি আছে। এইবার পঞ্জিয়ন মাশুলের পরিমাণ কত ধার্য করেছ?

 —ত্রিশ টাকা। অনেকদিন পরে প্রকৃতি শিবির অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পরিমাণ বেশি হলে অংশগ্রহণকারী সেভাবে নাও পাওয়া যেতে পারে, সেই জন্য। আগেরবারের কিছু টাকা আমার হাতে জমা আছে। দুটো মিলিয়ে সকালের চা এবং দুপুরের দুবেলার আহার হয়ে যাবে।

 —আমিও কিছুটা দেব। অল্প নয়, যা লাগে বলবে।

 কথাটা বলে আমার সুদীপ্তের কথা মনে পড়ে গেল। কেন জানিনা। সব কথা জানার প্রয়োজন থাকে না।

 সুনন্দরা নিজের নিজের কাজের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে চলে গেল। ওরা চলে যাবার পরে আমি পুরোহিত শর্মা এবং বাপুটির সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা জমালাম। তাদের কথা শুনে এরকম মনে হল, আমাকে কাছে পেয়ে ওদের হারানো জিনিস ফিরে পাবার মতো অবস্থা হয়েছে। এটাই মানুষের প্রতি থাকা মানুষের আন্তরিকতা। শাশ্বত ,প্রাকৃতিক। আমার প্রতি থাকা তাদের অগাধ বিশ্বাস এবং সাহচর্যকে আমাকে এবার কাজে লাগাতে হবে।

 দুপুরের তীব্র রোদ ভীষণ মূর্তি ধরে পাখিদের পাড়া-পড়োশির চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবুও আমি জলাশয় তীরের শিমুল গাছ গুলোর নিচে যাবার কথা ভাবলাম। শর্মা এবং বাপুকে এখনই আসছি বলে বিদায় নিলাম।

 —আপনি এই দুপুর বেলা বনে জঙ্গলে এভাবে ঘুরে বেড়াবেন না। এই সময় ভূত-প্রেত চলাফেরা করে।

 আমি বাপুর কথায় কোনো গুরুত্বই দিলাম না। বরং আমি তাকে খ্যাপানোর জন্য ডান হাতটা দিয়ে টা টা জানালাম। বাপুটি রাগ করে চিৎকার করে জোরে জোরে বলতে লাগল—ঠিক আছে ,ঠিক আছে। কিন্তু আপনাকে ভূত প্রেতে ধরলে আমাদেরও খারাপ লাগবে।

 আমাকে শুনিয়ে কথাগুলি বলে বাপুটি পুকুরের দিকে রওনা হল।

 বৃষ্টি পড়ে গাছপাতা গুলি দ্রুত বেড়ে উঠেছে। দেখতে পরিচ্ছন্ন লাগছে। বর্ষায় অরণ্য স্নান করে। আমি থাকা কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টি হলে পাখিদের পাড়া পড়োশির  সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। পাখিদের পাড়া পড়োশিকে নিয়ে আমি নানারকম স্বপ্ন দেখি। পাখিদের পাড়াপড়োশি একটি অরণ্য গ্রামে পরিণত হবে, চারপাশে গাছে গাছ থাকবে। পাখ– পাখালি এবং সাপেরা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াবে, বন্য জীবজন্তুর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে, সেই অরণ্য গ্রামটি দেখার জন্য দূর দুরান্ত থেকে পর্যটক আসবে, নদীর তীরে ছোটো ছোটো ঝুপড়ি গুলোতে রাত্রি বাস করবে। গ্রামের ছেলেরা তার মধ্যে নিজেদের আর্থিক সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবে। সেই সমস্ত কথা ভেবে কখন যে আমি জলাশয়ের তীরে পৌঁছে গেছি বুঝতে পারলাম না। জলাশয়ের তীরের শিশু গাছটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে আমি বক বসবাস করা আমার আশা আকাঙ্ক্ষার শিমুল গাছ কয়েকটার দিকে তাকালাম।

 একি! সেখানে একসঙ্গে থাকা প্রকাণ্ড তিনটি শিমুল গাছের মাঝখানের একেবারে কাছের গাছটা নেই। আমি প্রায় দৌড়ে গিয়ে সেখানটায় পৌছালাম।গাছটার গোড়ায় করাত দিয়ে কেটে গাছটা উপড়ে ফেলেছে।কেবল গাছটার গোড়ার অংশ এবং শুকিয়ে যাওয়া পাতাগুলি ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে।গাছটা টুকরো টুকরো করে কাটা অংশে কাঠের গুড়ো স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে।সেইসব কাঠের গুড়ো নয়,গুলি খাওয়া আমার বুকের রক্ত।টুকরোগুলি ছেঁচড়ে নেওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। ঘাসগুলি এখনও এখনও মোচড় খেয়ে রয়েছে। তারমানে গাছটি কাটার বেশিদিন হয়নি।সুনন্দরা গাছটা কাটা হয়েছে বলে জানতে পারেনি নিশ্চয়। পেলেও ওদের করার কিছু নেই।ওরা কাঠুরিয়াদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো সংঘবদ্ধ নয়। 

 অতি বিমর্ষ মনে চারপাশে তাকিয়ে থাকার সময় হঠাৎ আমার চোখে পড়ল বকদের খসে পড়া একটা বাসা।বাসাটা জঙ্গলের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে আছে।জঙ্গলে লুটিয়ে পড়ে থাকা বাসাটা দেখে ভূমধ্যসাগরের পারের বালিতে লেগে থাকা মৃত শরণার্থী শিশুটির কথা আমার মনে পড়ল।দুটির মধ্যে আমি ব্যাপক সাদৃশ্য দেখতে পেলাম।এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতেই হবে।হয়তো তার জন্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কষ্ট করতে হবে।স্থানীয় জনগনকে বোঝাতে হবে।কাঠচেরাই মিলটা যেভাবেই হোক উৎখাত করতে হবে।হবেই।মিলটা এবং খড়ির দোকানটা যতদিন পর্যন্ত এখানে থাকবে,ততদিন পর্যন্ত আমরা করে যাওয়া কাজগুলি হবে বৃথা কর্ম।

 গাছের টুকরোগুলি ছেঁচড়ে নেওয়া পথটা দিয়ে আমরা কিছু দূর এগিয়ে গেলাম।কাঠের ব্যাবসায়ীরা কাঠের টুকরোগুলি নদীর দিকে ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।তারপরে নদীর জলে ফেলে দিয়ে সেইসব উজানে,যেখানে কাঠচেরা মিলটা স্থাপন করা হয়েছে সেখানে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে।যারা কিছুটা পয়সার বিনিময়ে গাছ কাটা কাজে উৎসাহ দিয়েছে তাদের সঙ্গে দেখা করে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে,তাঁদের দেখাতে হবে বিকল্প সংস্থাপনের পথ। তাঁরা প্রথমে না মানতে পারে।নামানার সম্ভাবনাই বেশি।কিন্তু তাদের সমবয়স্করা যখন মান্য এবং সম্মানজনক উপার্জনের পথে চলা তাদের সামনে আরম্ভ করবে,নিশ্চয় তাদের মনেরও পরিবর্তন হবে।আমরা কাজগুলি ভাবার চেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি আরম্ভ করতে হবে।অন্যথা কাঠুরিয়ারা লাই পেয়ে যাবে। 

 তাদের বলতে হবে শিমুল গাছ অনুমতি ছাড়া কাটা দন্ডনীয়।অনুমতি?প্রাক্তন বিদ্রোহীর কাছে তাঁর কথাই আইন,অনুমতি।সেই সামাজিক বিশৃ্ঙ্খলা আমাদেরই দূর করতে হবে।লাগবে না কি?মনের দুঃখে আমি নিজের মনে কথা বলতে বলতে জ্যোতিষের সমাধির কাছে উপস্থিত হলাম।সমাধিটার চারপাশে ইট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে যদিও গাঁথনিটা সম্পূর্ণ নয়।দেখলে কোনো রকমে দায়সারা গোছের কাজ করেছে বলে মনে হয়।আমি বন্য ফুল একটা ছিঁড়ে এনে জ্যোতিষের সমাধিতে দিয়ে প্রণাম করার জন্য মাথা নিচু করলাম।মাথা নিচু করে থাকা অবস্থায় আমার মনে পড়ল জ্যোতিষের বিয়েতে যাওয়ার দিনটা।কেবল কয়েক মাসের ব্যবধান।

 মাথা তুলে আমি একেবারে শিউরে উঠলাম।একেবারে না ভাবা না চিন্তা একটা কান্ড আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।আমার সামনে কাকাবাবু-কাকিমা এবং অনামিকা।তাঁরা ধূপ-ধুনো এবং প্রসাদের একটা শরাই নিয়ে সমাধিক্ষেত্রে হাজির।আমাকে মুখের সামনে এভাবে দেখতে পেয়ে কাকাবাবু মূক হয়ে পড়লেন।আমি একান্ত মৌ্ন হয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।তাঁরা ধূপ-ধুনো নিয়ে সমাধি ক্ষেত্রের চারপাশে তিনপাক ঘুরে প্রসাদের থালাটা সমাধিস্থলে রাখল।

 --উদয়, তুমি এসেছ!আমরা কল্পনাও করতে পারিনি যে তুমি আজকের দিনটিতে এসে জ্যোতিষকে এভাবে শ্রদ্ধা জানাবে।তার মৃত্যুর আজ দেড় বছরের তিথি।

 আমি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি আবেগিক হয়ে পড়লাম এবং আমার দুইচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।আমি কাকাবাবুদের সঙ্গে না থেকে তাঁদের নিজের মতো করে স্নেহাঞ্জলি অর্পণ করার সুবিধা দিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম।কাকাবাবু আমাকে কিছু একটা বলতে চাইছিলেন।আমি পুনরায় দেখা করব বলে চলে এলাম।পরিবারটি নিজের স্বাধীনতা অনুসারে সময়টুকু ব্যবহার করা উচিত।শিমুল গাছটা হারিয়ে আমি ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।তারমধ্যে আবার পরিবারটিও আমার জন্য অতি আবেগিক মুহূর্তে জ্যোতিষকে স্মরণ করতে এসেছে।সত্যিই আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।আমি পর্যটক নিবাসে ফিরে এলাম এবং বিছানায় শুয়ে পড়ে গাছটার কথা ভাবতে লাগলাম।গত বছর গাছটিতে কয়েকটি বক পরিবার পাখির বাসা তৈরি করেছিল।

 কত সময় এভাবে পার হয়ে গেল আমি ঠিক বলতে পারি না।আমার কিছুটা ঝিমুনি এসেছিল।

 সুনন্দ এসে ডাকায় সচেতন হলাম।

 --চলুন উদয়দা,আপনি খড়ির দোকানটা এবং কাঠচেরা মিলটা দেখতে চেয়েছিলেন।

 আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম।আমার কাছ থেকে তখনও জ্যোতিষ দূরে সরে যায় নি।সুনন্দকে কয়েক ঘন্টা আগের পরিস্থিতির বিষয়ে আমি অবগত করলাম।সে আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বলল--রাতের দিকে আমরা কাকাবাবুর বাড়িতে যাব।        

 সুনন্দকে সম্মতি জানিয়ে আমরা কাঠ খড়ির দোকানটা  এবং কাঠ চেরাই মিলটা দেখতে বের হলাম। যাবার সময় আমরা দুজনে হেমেনদাদের বাড়িতে ঢুকে হেমেনদাকে কথাগুলির বিষয়ে একটু জানিয়ে রাখলাম । তিনি আমাদের যথেষ্ট সাহস দিলেন এবং সঙ্গে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

 আমরা গিয়ে পৌঁছাতে কাঠ খড়ির দোকান দেওয়া অচ্যুৎ দোকানে বসে ছিল। তাকে দেখে আমরা দোকানের ভেতরে প্রবেশ করলাম। অচ্যুতকে আমরা সোজাসুজি প্রকৃতি শিবির আয়োজন করার কথা বলায় সে দেখছি এক কথায় উপস্থিত থাকবে বলে সম্মতি জানাল। আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। ছেলেটি প্রকৃতির শিবিরের যোগ দেওয়া এবং হাতের কুঠার পায়ে মারা একই কথা নয় কি। আমি এভাবেই ভাবলাম।

 — আপনারা কাজ করা বিষয়ে আমি জানতে পেরেছিলাম। তবে অনেকদিন থেকে আমার কোনো সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।

 — আশা করব তুমি আমাদের সঙ্গে জড়িত হয়ে পুনরায় তোমার সামাজিক ব্যস্ততা আরম্ভ করবে। আচ্ছা তুমি তোমার দোকানের জন্য খড়িগুলি কোথা থেকে আন?

অচ্যুত দেওয়া সুযোগ নিয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।

 — কিছুটা আগে যে কাঠ চেরাই কলটা বসেছে সেখান থেকে।

 -কাঠের জন্য তারা গাছগুলি এই অঞ্চলেই কাটে?

     -আর কোথা থেকে কাটবে? দূর থেকে আনার জন্য বহন করার খরচের জন্য কাঠের দাম বেশি হয়ে যাবে নাকি?

  আমি অচ্যুতের কথায় সহমত পোষণ করলাম যদিও খড়ির দোকানটির বিরুদ্ধে আমি একটি কথাও বললাম না। অরণ্য গ্রামের বিষয়ে বলার সময় দোকানটা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করব।

 অচ্যুতের ‘প্রাকৃতিক বৈভব’ নামে খড়ির দোকান থেকে বেরিয়ে আমরা সোজাসুজি এসে সোণকুরিহাত পাগলা দিয়া নদীর ওপরে থাকা সেতুটা পার হলাম।। তারপরে বাঁদিকে ঘুরে বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্ব যাওয়ার পরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ঘর ঘর শব্দ শুনতে পেলাম ।নদীর বিপরীতে বাঁধের গায়ে লাগা প্রায় দেড় কাঠার মতো জমিতে কাঠচেড়া মিল স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চালিত উন্মুক্ত করাতের নিচে তখনও একটা প্রকাণ্ড গাছ ফেলে নিয়ে তক্তার হিসেবে কাটার জন্য বিভিন্ন কর্মচারী কয়েকজন চেষ্টা করছিল এবং আমি কিছুটা দূর থেকে কর্মচারী কয়েকজনের কারুকার্য লক্ষ্য করতে লাগলাম। এরকম সময়ে দেখতে পেলাম ট্রাক্টরের ট্রলিতে করে গাছের কয়েকটি টুকরো মিলে বহন করে আনা হয়েছে। মিলটার কাছেই খোলা জায়গায় ইতিমধ্যে এরকম কয়েকটি ট্রলি গাছের টুকরোগুলিকে স্তূপীকৃত করে রাখা হয়েছে। তার বিপরীতে কাঠের তক্তা এবং বিভিন্ন আকারের বাটাম গুলি ভাগে ভাগে সাজিয়ে রাখা আছে।

 অরণ্য্য নিধন যজ্ঞে ঘৃতাাহুতি  দেওয়া কর্মচারী কয়েকজনের গতিবিধি দেখে প্রচন্ড আঘাত এবং দুঃখে জর্জরিত  হয়ে পড়লাম। আমাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য  ধুলোয় মিশিয়ে দিতে দেখছি মিলটার মাত্র কয়েক মাস লাগবে।তারপরে বৃহত্তর পাখিদের পাড়া-পড়োশির আমরা হয়ে পড়ব অকাল  কুষ্মান্ড ।আমি নিজের ভেতরে ছটফট করতে লাগলাম ।এমন সময় একটি বুলেটের ধপধপানি আমাদের কাছে চলে এল।। আমি ভাবলাম ভালোই হল। মিলের মালিককে প্রকৃতি শিবিরে নিমন্ত্রণ জানানো হোক।

  মিলের মালিক নিবারণ আমাদের পাশ দিয়ে দুই চাকার যান চালিয়ে নিয়ে কিছুটা আগে গিয়ে রাখল। আমাদের সামনে দিয়ে পার হয়ে যাবার সময় আমাদের  দিকে সন্দেহজনক ব্যক্তির মতো তাকাতে তাকাতে গেল। আমি আর সুনন্দ নিবারণের দিকে এগিয়ে গেলাম।

 -কাকে চাই?

  অত্যন্ত রুক্ষ এবং কর্কশ কণ্ঠে নিবারণ আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল। তার কথা থেকেই আমরা বুঝতে পারলাম যে তিনি সুনন্দাকে চেনেন না।

  --আপনাকে।

  দাঁড় করিয়ে রাখা বুলেটটাতে পা মাটিতে লাগিয়ে বসে নিয়ে নিবারণ বীরত্বের ভঙ্গিমা প্রদর্শন করে আমাদের জিজ্ঞাসা করল—কেন?

 --আমরা আগামী পরশুদিন একটা প্রকৃতি শিবিরের আয়োজন করছি। আপনাকে--

  নিবারণ আমার বাক্যটা শেষ হতে দিল না।।

  --ও, চাঁদা। কত লাগবে?

  --না চাঁদা লাগবে না। আমরা চাঁদা নিতে আসিনি।। 

 -- তাহলে।

  কটুক্তি করার ভঙ্গিতে নিবারণ বলল।

  --আমরা শিবিরে আপনার উপস্থিতি কামনা করছি।

 -- প্রকৃতি শিবিরে গিয়ে আমি কী করব। সেখানে তো আমার কোনো কাজ নেই।

 --আছে। আপনারই বেশি দরকার।প্রকৃতি সংরক্ষণের বিষয়ে আপনিও দু'চারটা কথা জানার দরকার।

  নিবারনের কটুক্তিকে উত্তর দেওয়ার জন্য আমিও কিছুটা রুক্ষভাবে বললাম--

যান যান আপনারাই পরিবেশ রক্ষা করুন। কী করতে পারেন সময়ে দেখা যাবে। এই কথা বলে নিবারণ উদ্ধতভাবে কাঠচেরা কলের পরিসরে ঢুকে পড়ল।

  রাগ এবং ক্ষোভে আমি এবং সুনন্দ ফিরে এলাম। আসার সময় নিবারণের সঙ্গে আমরা কীভাবে টক্কর দেব সেই বিষয়ে আলোচনা করলাম।

  --আমরা সৌম্যদা এলে তার সঙ্গে কথা বলে এগোলে ভালো হবে।কিন্তু তার আগে সমস্ত কথা কাকাবাবুকে জানিয়ে রাখি। তিনি আমরা এসেছি জানতে পেরেছেন যখন তার বাড়িতে না গেলে মানুষটার আবার অভিমান হবে।।

  কাকাবাবুর বাড়িতে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে ।মানুষটা বৈঠকখানা ঘরে বসে টিভির পর্দায় অসমিয়া ধারাবাহিক দেখছিলেনন। আমাদের দেখে তিনি টিভির সুইচ অফ করে দিলেন। আমরা বললাম বন্ধ করতে হবে না।। আপনি যা দেখছেন দেখুন।

 --এতদিন পরে তোমাদের এভাবে কাছে পেয়েছি। টিভি দেখতে থাকলে কী হবে আজকাল টিভি দেখা মানে সময়ের হত্যা করা।।।

  আমাদের উদ্দেশ্য করে বলা কথাগুলি আমাদের চেয়ে কাকাবাবুকে বেশি খুশি করার মতো মনে হল।

 --বল উদয়, কেমন আছ?

  --খারাপ কাকাবাবু।

 --খারাপ? তোমার! 

  আমাকে অপ্রস্তুত করে কাকাবাবু প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। আমার যেন খারাপ হওয়ার কোনো অবকাশই নেই।

  আমি এবং সুনন্দ কিছুক্ষণ আগে নিবারণের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে লাভ করা তিক্ত অভিজ্ঞতার বিষয়ে সবিস্তারে কাকাবাবুর কাছে বর্ণনা করলাম।

  --এগুলি চারা শুদ্ধ উপড়ে ফেলতে হবে। দুদিন ধৈর্য ধর। তোমরা নাকি পুনরায় শিবিরের আয়োজন করছ।সেটা ভালোভাবে হয়ে যেতে দাও এবং তারপরে রাস্তার কাঁটাগুলি একটি একটি করে সরিয়ে ফেল।

  কাকাবাবুর মানসিক দৃঢ়তা আমাদের স্তব্ধ করে দিল ।

 --আমাদের বাড়িতে নাকি অতিথি এসেছে? ঠাট্টার সুরে কথাটা বলে কাকিমা এসে বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করলেন। পেছন পেছন একটা ট্রেতে চায়ের কাপ নিয়ে অনামিকা এল। 

 --উদয় ভালো আছ? 

 --হ্যাঁ কাকিমা, ভালো আছি।

 --কী ধূর্ত হে তুমি। আমি খবর জিজ্ঞেস করায় বললে খারাপ আর এখন বলছ ভালো।

  মানুষের খবরও স্থান কাল পাত্রের ভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে।

 -- দাও, আমরা বুড়ো মানু্‌ষ, আমাদের শিখিয়ে দাও।

  আমি নমস্কারের ভঙ্গিমায় দুহাত কাকাবাবুর সামনে তুলে ধরে বললাম—‘ কাকাবাবু আপনাকে শিক্ষা দেওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই।’

  --তোমরা দুজনে এভাবে কথার খেলায় মাতবে নাকি চায়ের কাপে মুখ দেবে।

  সুনন্দ ইতিমধ্যে চায়ের কাপে দীর্ঘ চুমুক দিয়েছে। চুমুকের শব্দ ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। আমি তার দিকে তাকানোয় সে কিছুটা লজ্জিত ভাবে বলল, ‘কখন থেকে এক কাপ চা খাবার জন্য ইচ্ছা করছিল।’

  --চা খান। আমার দিকে তাকিয়ে অনামিকা বলল।

  আমি অনামিকার দিকে তাকালাম। তাকে একজন বিধবার মতো মনে হচ্ছে না। বরং তাকে একটি উজ্জ্বল মেয়ের মতো মনে হচ্ছে।

  --তোমরা এবার শিবিরের বিষয় কী নিয়েছ?

  আমার নিজেরই লজ্জা করতে লাগল। তখনই অনামিকার থেকে চোখ সরিয়ে এনে কাকাবাবুর প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি প্রস্তুত হলাম।

  --অরণ্য গ্রাম এবং প্রকৃতি পর্যটন।

  --দুজনেই বুঝতে পারল না।

  সেই জন্যই তো কাকাবাবু প্রকৃতির শিবিরের আয়োজন ।

 প্রকৃতি পর্যটন মানে যদি ইকো ট্যুরিজম হয় বুঝতে পারলাম আজ কয়েকদিন আগে কোন একটি দৈনিক কাগজে করেছি বলে মনে পড়ছে কিন্তু অরণ্য গ্রাম বুঝতে পারলাম না।

 --পরশুদিন আমরা বোঝাতে চেষ্টা করব।

  কাকাবাবুকে বলার মতো অনামিকাকেও আমি এভাবেই বললাম।

  --উদয়দা সেই সব কথা যদি শিবিরের বলেন তাহলে আপনার খবরাখবর বলুন।

   অনামিকার থেকে এই ধরনের প্রশ্ন এবং ব্যবহার আমি আশা করিনি আমি ভেবেছিলাম জ্যোতিষের মৃত্যুর পরে অনামিকা কাকাবাবুর ঘরের বন্ধ পরিসরের একজন বাসিন্দায় পরিণত হবে কিন্তু আমি এখন একটা উল্টো ছবি দেখতে পেলাম। অনামিকা আগে আমার সঙ্গে এত খোলাখুলি ভাবে কথা বলত না।

  --মেয়ে, তোমার চা?

  কাকাবাবু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অনামিকাকে জিজ্ঞেস করল।

 পুত্রবধূকে মেয়ে বলে সম্বোধন করতে দেখে আমি এমনিতেই কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকালাম।

  --ও এখন আর আমার বউমা নয় উদয়।

  কী বলেন কাকাবাবু। জ্যোতিষের মৃত্যুর পরে একটা বছর পার হয়েছে কী না হয়েছে কাকাবাবু পুত্রবধূর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ককে নস্যাৎ করলেন। আমি সন্দিগ্ধ নয়নে কাকাবাবু আর কি বলেন শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলাম।

  --ও এখন আমার মেয়ে। আমার মেয়ে অনামিকা। একটা ভালো ছেলে পেলে আমি ওর বিয়ে দেব।

  --বাবা আপনি এসব কী কথা বলেন। এতদিন পরে উদয় দাদা এসেছে। আমরা এখন তাদের সুখ-দুঃখের খবর করা উচিত। তারা করতে চাওয়া ভালো কাজকর্মে সহযোগিতা করা উচিত। আপনি কখনও কখনও ছোটো ছোটো জিনিস নিয়ে পড়ে থাকেন।

  --হ্যাঁ সত্যিই তাই। মানুষটার কথা আর কী বলব!

  কাকিমা অনামিকার কথায় সায় দিল।

  দুই মা ঝি একদিকে চলে গেছে। তোমরা দেখলে, ঘরের দুই নারী একদিকে আর আমি সংখ্যালঘু পুরুষ অন্যদিকে। আমার অবস্থা ওরা পাকিস্তানে থাকা হিন্দুর মতো করে তুলেছে।

  --কাকাবাবু আমি এসেছি। আপনার কাছে আমি থাকলে ৫০-৫০ হয়ে যাবে।

  --ঠিক, তুমি থাকবে আমার সঙ্গে।

  কাকাবাবুর সঙ্গে হাসিমজা করে আন্তরিকতার সঙ্গে কথার বার্তা বলে থাকার সময় আমাদের খোঁজে নবজিৎ বৈশ্য,কীচক এবং জেপি কাকাবাবুর বাড়ি এসে উপস্থিত হল। ওরা আসায় আমরা কাকাবাবুর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে আসতে চাইলাম।

  --তোমরা কোথায় যাবে?

  --শিবির আয়োজনের আলোচনা করার জন্য পর্যটক নিবাসে যাই।

  আমি কাকাবাবুকে সাধারণভাবে জানালাম।

  --কেন? কোনো গোপন কথা আছে নাকি? গোপন কোনো কথা নাই যদি এখানে আলোচনা করতে পার। অনামিকা সময়ে সময়ে চা ভাতের যোগান দিয়ে যাবে। তোমাদের কোনো টেনশন নেই।

  কাকাবাবুর আগ্রহকে সম্মান জানিয়ে আমরা এবার প্রকৃতিশিবিরে উপস্থিতি কীরকম হবে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কী হবে ইত্যাদি আদ্যোপান্ত কাকাবাবুর ঘরেই আলোচনা করতে লাগলাম। আমি এবারের প্রকৃতি শিবিরে ছাত্র-ছাত্রীর চেয়ে যুবক যুবতীর অংশগ্রহণে অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে চাইছি। সেই অনুসারে প্রকৃতি কর্মীর উপস্থিতি হবে কি বলে জিজ্ঞেস করায় সুনন্দ,নবজ্যোতি,বৈশ্য এবং কীচক সম্মতিসূচক মন্তব্য করল।তারা একই সঙ্গে বলল যে কয়েকজন লোককেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারা নাকি কীচকদের দেখতে পেলেই প্রকৃতি শিবিরে আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলে ।বয়সকে অন্তরায় হিসেবে ধরে না নিয়ে সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং জিদের মনোভাব ঢুকিয়ে দিতে পারলে অনেক কাজ সহজে এবং দ্রুত সম্পন্ন হয় ।এবারের শিবিরে যেহেতু শিক্ষার চেয়ে কর্মে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হবে সেই জন্য আগের শিবির গুলির চেয়ে এই শিবিরের মূলগত পার্থক্য থাকবে। সুনন্দদের আমি আগেও বুঝিয়ে বলেছি এবং এখনও সেই বিষয়টাতে অধিক গুরুত্ব দিতেই চেষ্টা করছি। খাওয়া-দাওয়ার  ব্যবস্থা নিয়েও আমাদের মধ্যে আলোচনা হল ।সেই সমস্ত কিছুর দেখাশোনার ভার নবজিৎ বৈশ্য তাদের একজন কাকাকে দিয়েছে। মানুষটা এই ধরনের সামাজিক কাজে থাকতে ভালোবাসে। এক একটি গ্রামে এই ধরনের ব্যক্তি থাকে বলেই সেই গ্রামের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলি পরিচ্ছন্নভাবে সম্পন্ন হয়।

  নিবারনের ঘটনাটি আমার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অবশেষে আমরা প্রত্যেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে সৌম্যদা এলে কাঠচেরাই কলটা বন্ধ করার জন্য নেওয়া ব্যবস্থা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হবে। 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...