বুধবার, ৫ জুন, ২০২৪

পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ৭ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi

 পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ৭

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  

Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi




তৃতীয় অধ্যায়, সপ্তম অংশ ।। পাখিদের পাড়া- পড়শী

......

তৃতীয় অধ্যায়

(সাত)


    

সুনন্দকে বিদায় দিয়ে সৌম্যদা স্নান করতে  গেল ।আমি রাতের আহার প্রস্তুত করার জন্য স্টোভটার ওপরে কেটলিটা  বসিয়ে দিয়েছি।জল গরম হলে মেগীর ওপরে গরম জল ঢেলে রাতের আহার প্রস্তুত করব ।

তখনই কারও বিকট চিৎকার শুনতে পেলাম।

সৌম্যদা ভেতরে দৌড়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন— শুনেছ?’

— শুনেছি সৌম্যদা।রাতের কোনো মাতাল হবে হয়তো। আমি মাঝেমধ্যে এই ধরনের চিৎকার শুনতে পাই। বাঁধের ওপর দিয়ে যাবার সময় চেঁচামেচি করে যায়। কখনও বিকট স্বরে চিৎকার করে।

—তার মানে তুমি এই ধরনের রাতের চিৎকারের সঙ্গে অভ্যস্ত। আমি আরও চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম।

কিছুক্ষণ পরে হাতে টর্চ নিয়ে কোনো একটি ছেলেকে আমাদের দিকে দৌড়ে আসতে দেখতে পেলাম।

 আমি তখনই জানলা দিয়ে লাফিয়ে সৌম্যদাকে বললাম আমি কোনো বিপদের সতর্কবাণী দেখতে পাচ্ছি সৌম্যদা।

  সৌম্যদা সাবধান হলেন।

 দৌড়ে আসা ছেলেটি গ্রামেরই পুলেন। সে হাঁফাতে হাঁফাতে আসছে।

  দাদা দাদা দাদা— পুলেন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই —দাদা, সুনন্দদাকে  কেউ বাঁধের ওপরে ছুরি মেরেছে ।

সৌম্যদা এক মুহূর্ত দেরি না করে বলল— চলো। চলো।

  আমিও এক মুহূর্ত সময় দেরি না করে স্টোভটা নিভিয়ে দিয়ে ল্যাম্পটার সলতেটা একেবারে নামিয়ে দিয়ে মিটমিট করে ল্যাম্পটা জ্বলতে থাকার মতো অবস্থায় রেখে দিলাম।লেপটপটা এবং ক্যামেরার সরঞ্জাম গুলি পিঠে নেওয়া ব্যাগটায় ভরে দরজায় তালা মেরে থাকার সময় শুনতে পেলাম অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন এবং বাঁধের ওপর দিয়ে গড়িয়ে আসা আলোর রশ্মি।

  টর্চের আলো ফেলে আমাদের সামনে  পুলেন প্রায় দৌড়ে যাওয়ার মতো চলেছে। সৌম্যদা এবং আমি দ্রুত অনুসরণ করছি।

—গ্রামের মানুষ জানতে পেরেছে কি?

  আমি পুলেনকে জিজ্ঞেস করলাম।

— পুলেনদার চিৎকার শুনে গ্রামের মানুষ ভর্তি হয়ে গেছে। আমাকে আপনাদের খবর দিতে পাঠিয়েছে।।

  আমরা গিয়ে বাঁধের ওপর পৌঁছাতে পৌঁছাতে সুনন্দকে মৃত্যুঞ্জয় গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছে। আমরা তাকে দেখার সুযোগ পেলাম না। বাঁধের ওপরে কুড়ি পঁচিশটা বাইক। যুবক ছেলে এবং বয়স্ক মানুষের ভিড়।কয়েকজন মহিলাকেও উদ্বিগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখতে পাচ্ছি। আমি পুলেনের হাতে আমার ল্যাপটপটা এবং ক্যামেরাটা সুনন্দদের বাড়িতে রেখে দিতে পাঠালাম।

  যুবক ছেলেরা এম্বুলেন্সের পেছন পেছন বাইক চালিয়ে দিল।। সৌ্ম্যদা এবং আমাকেও দুটি ছেলে তাদের বাইকের পেছনে বসিয়ে নিল।। আমরা চিকিৎসালয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সুনন্দকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। সে কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। সমস্ত শরীর রক্তে মাখামাখি। ডান কাঁধ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। মুখটা অক্ষত রয়েছে বলে মনে হল। অ্যাম্বুলেন্স সেবার লোক চিকিৎসালয়ে থাকা আরক্ষী কেন্দ্রে খবর দিল। আরক্ষী এসে গেল। আরক্ষীর উপস্থিতিতে চিকিৎসা বাহিনীর দল অপারেশন থিয়েটারে সুনন্দের চিকিৎসা আরম্ভ করল। ভেতরে কী চলছে আমরা বাইরে থেকে বুঝতে পারছি না।

  কিছুক্ষণ পরে অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসা একজন চিকিৎসক কর্মী বললেন— আপনাদের রোগীকে গুয়াহাটিতে নিয়ে যেতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করুন।

  খুব কম সময়ের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হয়ে গেল। হাতে স্যালাইনের একটা পাইপ সংযুক্ত করে সুনন্দকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হল। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠানোর সময় সৌম্যদা এবং আমি কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। সুনন্দকে অত্যন্ত ভীতিগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। তার মুখ দিয়ে অস্ফুট গোঙানি বেরোচ্ছে। সেই মুহূর্তে সৌম্যদা এবং আমি খুব অসহায় অনুভব করতে লাগলাম।

সুনন্দকে গুয়াহাটি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে নিয়ে যাবার পরে আমরা অস্ত্রোপচার কক্ষের চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাদের কাছে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রইলেন। নবজিৎ বৈশ্য তার পরিচিত একজন চিকিৎসক কর্মীকে সুনন্দের অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করল। তিনি বললেন আঘাত খুব একটা গুরুতর  নয়। কিন্তু কোনো রোগীর সঙ্গে এত সংখ্যক মানুষ এলে চিকিৎসক হতে পারা অঘটন এড়ানোর জন্য রোগীকে গুয়াহাটিতে রেফার করে। তিনি এই কথাও জানালেন যে সুনন্দকে ছুরি দিয়ে নয় ভাঙ্গা বোতল দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। মাংসপেশীর ভেতরে দুই এক  টুকরো কাঁচ ঢুকে থাকার আশঙ্কা অস্বীকার করা যায় না। 

সৌম্য দা বললেন— চলো থানায় যাই। একটা এজাহার লেখাতে হবে।

  গ্রামের কয়েকজন ছেলের সঙ্গে আমরা থানায় এলাম। এসেই সোজাসুজি কর্তব্যরত অফিসারের কাছে গেলাম। থানার আরক্ষী আমাদের চারজনকে ছাড়া বাদবাকি সবাইকে বাইরে বের করে দিলেন।সৌম্যদা কর্তব্যরত অফিসারের সামনে বসে এজাহার লিখলেন  এবং তাকে প্রদান করলেন।। সৌম্যদা স্পষ্টভাবে সুনন্দের উপরে করা আক্রমণ নিবারণ বাহিনীর কার্য বলে এজাহারে উল্লেখ করলেন। উপস্থিত প্রত্যেককেই এজাহারটিতে সই করলেন।

অফিসারটি এজাহারটা পড়লেন এবং একটা পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে টেবিলের উপরে রেখে দিলেন।।

  আশা করি দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। দোষীকে—

 অফিসারটি যেন এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

— আপনি কীভাবে দোষীর কথা বলছেন। দোষীর কথা ন্যায়ালয় বলবে। আমাকে শেখাতে এসেছেন নাকি?

কর্তব্যরত অফিসারের অস্বাভাবিক ব্যবহারে সৌম্যদা হতভম্ব হয়ে পড়লেন।

   আপনাদের আরক্ষী অধীক্ষক কে?

—কে আপনি আমাকে আরক্ষী অধীক্ষকের ভয় দেখাচ্ছেন?এজাহার দিতে এসেছেন, এজাহার দেওয়া হয়ে গেছে।এখন আসুন, না হলে আপনাকেও ভেতরে ঢুকিয়ে রাখব।

  এই মানুষটার সঙ্গে কথা না বলাই ভালো হবে ভেবে, সৌম্যদা কাউকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন— নলবাড়ি জেলার আরক্ষী অধীক্ষকের ফোন নাম্বারটা দাও তো।

বিপরীত দিক থেকে কী বলল আমি শুনতে পেলাম না।কেবল কিছুক্ষণ পরে সৌম্যদার মোবাইলে একটা মেসেজ ঢুকল বলে মনে হল। সৌম্যদা পুনরায়  কারও সঙ্গে ফোনের সংযোগ ঘটাল। আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের সামনে বসে থাকা আরক্ষী অফিসারটি বেপরোয়া ভাবে বসে আছে ।

--আমি সৌম্য।পরিবেশ কর্মী।আপনার মনে আছে হয়তো প্রশাসনিক মহাবিদ্যালয়ে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।

সৌম্যদা হয়ে যাওয়া ঘটনাক্রম এবং আরক্ষী থানায় এসে পাওয়া ব্যবহারের কথা অফিসারের  কাছে জানালেন।

  বিপরীত দিক থেকে হয়তো সৌম্যদাকে আশ্বাস দিয়ে বলা হল— ঠিক আছে একটু অপেক্ষা করুন। আমি এখনই থানায় আসছি।

 সৌম্যদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— আরক্ষী অধীক্ষক আসছেন। চল আমরা বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করি।

কর্তব্যরত আরক্ষী অফিসারের ততক্ষণে কাণ্ডকারখানা দেখে হুঁশ ফিরে এসেছে। এই সাধারণ কথাটায় রাত নটার সময় আরক্ষী অধীক্ষক নিজে থানায় আসতে চলেছেন।নিশ্চয় মানুষটা বেশ বড়ো কেউ, মিডিয়ারও হতে পারে।। ভ্রাম্যমানের সুদক্ষ অভিনেতার মতো তখনই আরক্ষী অফিসার কথার সুর পাল্টে ফেললেন।

 বাইরে কেন অপেক্ষা করবেন? এখানে বসুন। স্যার এলে তার ঘরে যাবেন।…

 অফিসারটি একজন সিপাহীকে ডেকে বললেন— স্যারের রুমটা খুলে পরিষ্কার করে রাখ।

  আরক্ষী অধীক্ষক আসবে বলে জানতে পারার পরে আরক্ষী থানার ভেতরে সমগ্র পরিবেশটাই রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেল।

সৌম্যদার অনুরোধে আরক্ষী অধীক্ষক বিষয়টা গম্ভীর ভাবে গ্রহণ করলেন। তিনি তখনই বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা জানিয়ে সৌম্যদা কে বললেন— আজকাল কিছু বিষয় খুব গম্ভীর হয়ে পড়েছে। তার ভেতরে আপনাদের পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়টাও অন্তর্ভুক্ত।

— গ্রীন ট্রাইবিউনেলের জন্য ও প্রকৃতি সংরক্ষণে আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে  বলতে পারি।

  পাশের চেয়ারে বসে থাকা ভারপ্রাপ্ত অফিসারটি সমস্ত কথাগুলি মন দিয়ে শুনতে থাকলেন।

  আমরা আরক্ষী অধীক্ষকের আশ্বাস পেয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলাম।। সুনন্দকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটা গুয়াহাটি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে পৌঁছে গিয়েছে। খবরটা সঙ্গে যাওয়া  পুলক এবং রাতুল নবজিৎ বৈশ্যকে ফোনে জানিয়েছে।। চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে সুনন্দের চিকিৎসার জন্য অসুবিধা হওয়ার কোনো কথাই নেই গুয়াহাটিতে থাকা গ্রামের ছেলেদের কয়েকজনকে সমস্ত কথা ইতিমধ্যে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।। ওরা টাকা পয়সা নিয়ে সুনুন্দ পৌঁছানোর আগেই চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে হাজির। ওরা আগে থেকে যা কিছু করা দরকার সব করে রেখেছে।

আমরা ফিরে এসে সুনন্দের বাড়ি পৌঁছালাম।সুনন্দের বাড়িতে তখনও গ্রামের কয়েকজন তরুণ এবং জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি উপস্থিত ছিল। তারা ঘটনাটার বিষয়ে চর্বিত চর্বণ করে আলোচনা করছিল। আমরা গিয়ে সুনন্দের স্ত্রী জ্যোৎস্নাকে ডেকে পাঠালাম। বেচারীর মুখটা চোখের জলে উপচে রয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে তার মুখটা  শুকিয়ে গেছে। উপস্থিত জনগণের কাছ থেকে জানতে পারলাম গুয়াহাটিতে প্রেরণ করার জন্য জ্যোৎস্না জ্যোতি মালারা আঘাত অনেক গুরুত্বর বলে ভেবেছে। প্রকৃত কথাটা নবজিৎ বলায় তারা কিছুটা আশ্বস্ত হল। তখনই চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে থাকা পুলক ফোন করে জানাল যে সুনন্দের অস্ত্রোপচার  এক্সরে আদি সমস্ত কিছুই হয়ে গেছে। আর কাচের টুকরো ছাড়া বাইরের আঘাত খুব বেশি গুরুতর  নয়। কেবল কাঁধে বারোটা সেলাই পড়েছে ।চিকিৎসক নাকি চিকিৎসায় বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেনি। পুলক জ্যোৎস্না এবং জ্যোতিমালাকে ফোন করল।সুনন্দের মা জ্যোতিমালাকে এক কাপ করে লাল চা করে দিতে বলল। আমরা লাগবে না বলায় ওরা সম্মত হল না। গ্রামের মেয়ে জ্যোতিমালার সমবয়সী হিরন তখনই সবাইকে এক কাপ করে লাল চা এগিয়ে দিল।অতি প্রয়োজনীয় সময়ে  চায়ের কাপ তৃপ্তি দিল। অনেকক্ষণ ধরে আমাদের  পেটে কিছুই পড়েনি। গ্রামের ছেলে কয়েকজনের সঙ্গে সকালবেলা গিয়ে আমরা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় সুনন্দকে দেখা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সুনন্দের মা এবং জ্যোৎস্নাদের সঙ্গে কথা বলে ফিরে এলাম। রাত তখন এগারোটা বেজেছে।

  ঘটনাটা সৌম্যদা এবং আমাকে সবচেয়ে বেশি বিব্রত করে তুলল। ঘটনাক্রম খারাপের দিকে যাচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল। অশান্তি অসূয়া চলতে থাকলে কাজ করে ভালো লাগবে না।ছেলেমেয়েরা ভীতগ্রস্ত হয়ে পড়বে। পর্যটক নিবাসে ফিরে এসে আমরাও কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করতে বাধ্য হলাম।

—মদ খাওয়া ছেলে এত রাত পর্যন্ত থাকার কথা নয়। তার জন্যই ওরা আজ সুনন্দকে আক্রমণ করতে পেরেছে।গ্রামের সমস্ত মানুষ বেরিয়ে এসেছে,ওদেরকে সেটাও বুঝতে হবে দেখছি।

 সৌম্যদা আমাকে  আশ্বস্ত করার জন্য বলল।

 আমি মেগিটা সিদ্ধ করতে করতে সৌম্যদাকে বললাম —সৌম্যদা ওদের রিমোট কন্ট্রোল অন্য জায়গায় আছে।সেখান থেকে যা হুকুম আসে, ওরা মদ মাংসের বিনিময়ে তাই পালন করে।

রাতে সৌম্যদা এবং আমার ভালো ঘুম হল না। একেবারে ভোরের দিকে ঘুম থেকে উঠে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হওয়া ছেলে কয়েকজনের সঙ্গে আমরা দুজনে  গুয়াহাটি পৌঁছালাম। সুনন্দের মুখে যন্ত্রণা  এবং ভীতি গ্রস্ততার ছাপ। সারা রাত তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যথা কমা এবং প্রতিষেধক ঔষধ  দেবার পরে তার যন্ত্রণার কিছুটা উপশম হয়েছে।

আমাদের কণ্ঠস্বর শুনে সুনন্দ চোখ মেলে তাকাল।

—কী হয়েছে সুনন্দ? ব্যথা করছে?

সুনন্দকে পরিবেশের সঙ্গে সহজ করার জন্য আমি আন্তরিকতার সঙ্গে বললাম।

—না উদয় দা কিছু না। এসবই সাধারণ কথা বলে ভাবছি। সমাজের কাজ করতে গেলে কোনো ব্যক্তি বিশেষের অনিষ্ট হলে আক্রমণ তো করবেই। ওরা হাতে ভাঙ্গা বোতল নিয়ে এসেছিল। আমার মুখ লক্ষ্য করে ছুরি মারার মতো বোতল গুলি ছুঁড়ে মেরেছিল। মুখটা রক্ষা করতে গিয়ে কাঁধে লাগল। আমি পা পিছলে বাঁধের ওপর থেকে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়লাম এবং সজোরে  চিৎকার করতে লাগলাম।বাঁধের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ার জন্য ভালোই হয়েছে। ওরা দ্বিতীয়বার আক্রমণ করার সুযোগ পেল না। আঘাত পাওয়ার পরে আমার এরকম মনে হচ্ছিল যেন কাঁধটা খসে পড়েছে। তারপরে আমি আর কিছু বলতে পারি না। আরটিআই করার জন্য নিবারণই  কাজটা করেছে বলে মনে হয়।

— মনে হয় না, ওই করেছে।আমরা তার নামে থানায় এজাহার দিয়ে এসেছি। না হলে সে আরও অঘটন ঘটাতে পারে।নবজিৎ সুনন্দাকে বলল।

 আমি জ্যোৎস্না জ্যোতিমালা এবং মাকে ফোন করার জন্য তার হাতে ফোনটা তুলে দিলাম। সুনন্দ ওদের সঙ্গে কথা বলল। বাড়ির মানুষের সঙ্গে কথা বলার পরে সুনন্দের মনটা হালকা হতে দেখা গেল।

—-জ্যোৎস্নার শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এই সময়ে সে দুঃখ পেল বলে খারাপ লাগছে।

 আক্ষেপের সঙ্গে বলল। 

—ওহো ভালো খবর দেখছি। কনগ্রাচুলেশন।

  সুনন্দ ডানহাতটা  এগিয়ে দিতে পারছে না। বাঁ হাতটায় স্যালাইন দেওয়া আছে যদিও সে ধীরে ধীরে বা হাতটা এগিয়ে দিল। আমি এবং সৌম্যদা তার হাতটা খামচে ধরলাম। জ্যোৎস্না এইজন্যই এবার প্রকৃতি শিবিরে উপস্থিত থাকতে পারেনি?আমি তার অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে ভেবেছিলাম মেয়েদের মাসিকের সমস্যার জন্যই সে হয়তো উপস্থিত থাকতে পারেনি। আমি সুনন্দকে না বলে নিজেকে বলার মতো বললাম।

— এন্টিবায়োটিকের কোর্সটা শেষ হলে তোমাকে বাড়িতে যেতে দেবে মনে হয়।

সৌম্যদা এবং আমি সারাদিন সুনন্দের সঙ্গে রইলাম।সঙ্গে যাওয়া ছেলেদের কারও কারও গুয়াহাটিতে দুই একটি কাজ আছে।এই ছেলেরা তাদের কাজগুলি শেষ করে যেতে চায়। আমরা বললাম যার যা কাজ আছে সব শেষ করে আয়।, যাবার সময় কেবল আমাদের নিয়ে যাবি। সন্ধ্যে হলেও অসুবিধাধা নেই। দিনে সুনন্দকে আমি নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দিলাম। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সে আমার হাতটা খাামচে ধরেছিল ।

--প্রকৃতি কর্মীরা এত প্রাকৃতিক এবং মানবতাবাদী উদয়দা।

  নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে সুনন্দের দুই চোখ সজল হয়ে উঠল। আমি সুনন্দের দুই চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।। কিছু বললাম না।। সে যে বুঝতে পেরেছে সেটাই তার কাছে সত্য হোক।

  সন্ধের সময় আমরা ফিরে এলাম। ফেরার সময় আমি সুনন্দের হাতে তিন হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে এলাম। সে নিতে চাইছিল না।

--‘ পয়সা আছে আমার সঙ্গে দাদা।

--- ঠিক আছে। রেখে দাও হঠাৎ প্রয়োজন হতে পারে।

 সুনন্দদের বাড়ি হয়ে আমরা ফিরে এসে পর্যটন নিবাসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্ধকার হয়ে গেল। সারাদিনে ঘটনাক্রমের কোনো পরিবর্তনের খবর আমরা পেলাম না। আশা করেছিলাম আরক্ষীর লোক এসে সুনন্দের ঘটনাটির কোনো তদন্ত করবে। গুয়াহাটি থেকে এসে সুনন্দের বাড়িতে খবর নিতে গেলে তারা বলল আরক্ষীর লোক আসেনি। কেবল গ্রামের বিভিন্ন লোক এসে খবরাখবর করে গেছে। আমরা দুজনেই ভালো আছি কিনা গ্রামের মানুষ সুনন্দের পরিবারকে জিজ্ঞেস করেছে। আমাদেরকেও কিছুটা দেখে শুনে সাবধানে চলার জন্য তারা অনুরোধ করে গেছে। সুনন্দের মা সুনন্দ দিনের বেলা ভাত খেয়েছ কিনা আমাকে জিজ্ঞেস করল। আমি নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছি বলায়  আবেগ রুদ্ধ কন্ঠে মা বলল--  তুমি কোনো জন্মে আমাদের আত্মীয় ছিলে নিশ্চয়।  আচ্ছা তোমরা ভাত খেয়েছ কি?

  -- খেয়েছি।

  অত্যন্ত বেপরোয়া ভাবে আমি উত্তর দিলাম। তবে মায়ের স্নেহের নজরের কাছে আমি ধরা পড়ে গেলাম ।

---না খাওনি। আমি খারাপ পাব বলে বলছ!

-- খাইনি। আমরা দুজনেই সারাদিন চিকিৎসালয়ে ছিলাম। বাইরে বেরিয়ে খাবার সময় এবং সুযোগ দুটোই পেলাম না।

-- হিরণ, কিরণ, এই জ্যোতি।

 দুজনেই দৌড়াদৌড়ি করে মায়ের কাছে চলে এল। 

--তাড়াতাড়ি করে দুজনের জন্য অল্প ভাত বসিয়ে দে।

 সৌম্যদা বললেন--  না না এই সন্ধ্যা বেলা আমরা কোনোমতেই ভাত খাব না। 

আমি বললাম   অসময়ে হয়েছে। এই অবেলায় ভাত খাওয়া ঠিক হবে না।।

  মা আমাদের মাঝখান থেকে উঠে কিছুক্ষণের জন্য ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে জ্যোৎস্না দুজনের জন্যই  চালের গুড়ি দিয়ে তৈরি দুই বাটি সান্দহ   এবং দুই গ্লাস দুধ নিয়ে এল। সান্দহ   খাবার ইচ্ছা না থাকলেও সুনন্দদের মায়ের স্নেহের আবদারকে এড়াতে পারলাম না।সান্দহ দুই বাটি উদরস্থ করার পরে আমাদের রাতের আহারের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। আমরা বসে থাকার মধ্যেই কাকাবাবু এলেন সুনন্দের খবর নেবার জন্য। আমরা গুয়াহাটিতে সুনন্দের খবর নিতে যাবার খবর কাকাবাবু বৌমা অনামিকার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। অনামিকা দিনের বেলা সুনন্দের স্ত্রী জ্যোৎস্নার খবর নিতে এসেছিল। কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা হওয়ায় ঘটনার সম্পর্কে বিভিন্ন কথা আলোচনা হল। কাকাবাবু বললেন    জনগণ তোমাদের সঙ্গে আছে।  তোমরা কোনো চিন্তা কর না  কিন্তু সাবধানে থাকবে নিবারণ নরখাদক। সে মানুষ শিকারি। তার জিভে নর মাংসের স্বাদ লেগে আছে। কথাটা মনে রেখো।

  ---কাজ করতে গেলে সমস্যার সম্মুখীন হতেই হবে সেটা আমাদের জানা। কিন্তু আমাদের জন্য সুনন্দকে চিকিৎসালয়ে থাকতে হবে বলে আমরা ভাবতেই পারিনি।।

   বিনীতভাবে আমি বললাম। কাকাবাবুর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলল। কাকাবাবুর জমিতে কবে নাগাদ ঘর তৈরির কাজ আরম্ভ করব জিজ্ঞেস করলেন। তার জমিতে পর্যটক নিবাস দ্রুত গড়ে ওঠাটা তিনি আন্তরিকভাবে চাইছেন।

  --বুড়ো মানুষ হঠাৎ মরে যাব । দেখতে পারবো না মনে হয়।

 --বাহ কাকাবাবু আপনি আমাদের আবেগিকভাবে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছেন আমরা আগে এই সমস্যা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে নি। কাঠ চোরাই কলটা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত নিবারণ নামের ছেলেটি আমাদের শান্তিতে কাজ করতে দেবে না। সে আমাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে।। আজ সুনন্দকে, কাল আমাকে, পরশু আপনাকে    ব্যাপারটাকে এভাবে এগোতে দেওয়া যায় না।।

ঠিক অন্ধকার নেমে আসতেই কাকাবাবু এবং সুনন্দদের পরিবারের কাছ থেকে আমরা দুজনেই বিদায় নিলাম।। গুয়াহাটিতে যাবার পথে রেখে যাওয়া ল্যাপটপটা এবং ক্যামেরার সাজসরঞ্জাম সমূহ বিষয়ে জ্যোতিমালাকে মনে করিয়ে দিলাম।

---আমি বললাম আজ থাক। রাতে বিশেষ কাজ করব না। চার্জ শেষ হয়ে গেছে। আগামীকাল এসে চার্জ দিয়ে নিয়ে যাব।

 সুনন্দের বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় গতকাল সুনন্দকে আক্রমণ করা স্থানে উপস্থিত হয়ে টর্চের আলোতে দেখতে পেলাম সেই জায়গায় কয়েকটি খালি মদের বোতল।। তার মধ্যে কয়েকটি ভাঙ্গা।। আরক্ষী  এসে তদন্ত করে এই সমস্ত নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। আত্মসমর্পণকারী বিদ্রোহী বলে আরক্ষী ঘাটাতে চাইল না নাকি। সৌম্যদাকে কথাটা বলায় সৌম্যদা বললেন ধৈর্য ধর।। আর দুদিন দেখব। তারপরে আরক্ষী অধীক্ষককে গিয়ে জিজ্ঞেস করব জনগণ আইন হাতে তুলে নিলে আপনি কী করবেন? সরকারের পয়সায় জনগণককে কারাগারের ভাত খাওয়াবেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আপনাকে সবাই যাতে জানতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আপনার জন্য সেটাই হবে হয়তো উচিত সম্মান।

 বাঁধ থেকে নেমে আমরা সোজাসুজি পর্যটক নিবাসের দিকে এগিয়ে গেলাম।। সাধারণত আমি এই রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করি না। আজ পরিবর্তন করার প্রয়োজন অনুভব করলাম ।

পর্যটন নিবাসে পৌঁছানোর পরে আমার কেমন যেন একটা শারীরিক অস্বস্তি হল। কোনো দিক থেকে ভেসে আসা বিপদের অপরিচিত গন্ধ নাকে এসে লাগল।। আমি সৌম্যদাকে বললাম-- সৌম্যদা আজ আমরা রাতে এখানে থাকব না নাকি?

 কোথায় থাকবে?

  --আমার সঙ্গে দুটো তাঁবু আছে। অরণ্যের মধ্যে থাকব নাকি?

--রাতে কেউ আসবে বলে ভেবেছ?  অরণ্যের মধ্যে ওরা আমাদের পাবে না নাকি?

 --- সৌম্যদা অরণ্যের মধ্যে ওরা আমাদের খুঁজতে যাবে না। মদ খেয়ে সেই সমস্ত জায়গায় যেতে ওরা ভয় করবে। মোটের উপর জায়গা পরিবর্তন করাটা আজকের জন্য ভালো হবে বলে আমার মন বলছে। 

সৌম্যদা  আমার কথায় সহমত প্রকাশ করলেন। অন্ধকারের মাঝে  তাঁবুটা খাটানোর জন্য প্রয়োজন হওয়া কয়েক পদ সামগ্রী নিয়ে আমরা দুজনে চুপি চুপি পর্যটক নিবাস ছেড়ে এলাম। এমনকি যাবার সময় হাতে থাকা টর্চটাও ব্যবহার করলাম না। আমরা যেতে যেতে জ্যোতিষের সমাধির কাছে অরণ্য অঞ্চলে পৌঁছে গেলাম। সেখানে আমরা এমন একটি জায়গায় তাঁবু টানালাম যাতে আমাদের দূর থেকে কেউ দেখতে না পায় অথচ আমরা অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাই। তাঁবুটা টানাতে আমরা ন্যূনতম আলো ব্যবহার করলাম। তাঁবুটা টানার পরে না দিলেও হত যদিও তার উপরে কিছু গাছের ডাল ভেঙে চাপিয়ে দিলাম। তার সঙ্গে দুটি একটি লতা ও বিছিয়ে দিলাম। এই জায়গা থেকে মানুষ আসা-যাওয়া করা রাস্তাটা, আর নদীর পাড়ের দণ্ডিটা— দুটোই দূরে। সাবধানতা অবলম্বন করে আমরা দুজনেই ধীরে ধীরে কথা বলতে লাগলাম। বিভিন্ন কথা। সন্ধ্যাবেলা আবহাওয়া একটু মেঘলা ছিল। এখন আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় চারপাশ চন্দ্রালোকে আলোকিত হয়ে উঠেছে। তাঁবুর ফুটো দিয়ে নদীটা এবং রাস্তাটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। রাতের নদীটা দেখার জন্য আকুল হয়েছিলাম বলে মনে হচ্ছে। সেই জন্যই হয়তো জোনাকি পোকারা রাশি রাশি আলো ছিটিয়ে চলেছে। আকণ্ঠ জ্যোৎস্না পান করে নদীটা হয়ে উঠেছে একটি জ্যোৎস্নার নদী।

রাত বারোটার সময় আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমার যখন ঘুম ভাঙল পাশেই কোথাও নড়াচড়ার শব্দ পেলাম। আমি সৌম্যদার দিকে তাকালাম। মানুষটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ধীরে ধীরে শব্দটা কাছাকাছি এগিয়ে এল। আমি তাঁবুর ফুটো দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। বাইরে রাত প্রভাত হতে খুব বেশি দেরি নেই। তাঁবু থেকে একটু দূরে একঝাঁক শিয়াল। ওরা ইঁদুরের গর্ত শুঁকে বেড়াচ্ছে বোধহয়। অথবা আমাদের গন্ধ পেয়ে ভয়ে ভয়ে অনুসন্ধানের জন্য এগিয়ে এসে থাকতে পারে। প্রকৃতির সমস্ত প্রাণীই অনুসন্ধিৎসু। দূরের কোনো মসজিদে ভোরের আজান দিচ্ছে। আমি তাঁবুর মূল চেইনটা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে গেলাম। সামনে একটা মানুষকে দেখে শিয়ালের ঝাঁকটা দৌড়ে পালাল। প্রস্রাব করে এসে আমি আবার তাঁবুর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সৌম্যদা নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে আছে। সূর্য উঠার পরেও আমি তাঁবুর ভেতরেই গড়াতে থাকলাম । বাইরে বেরোলে কেউ দেখে ফেলার আশঙ্কা। আমরা যে এখানে আছি সে কথা কাউকে জানাতে চাইছি না। সৌম্যদা জেগে ওঠা পর্যন্ত এই সময়টুকুতে বোতলের জলই হল আমার সারথি। আমি সময় কাটানোর জন্য মাঝেমধ্যে এক ঢোক এক ঢোক করে জল পান করতে লাগলাম। এটা আমার পুরোনো অভ্যাস।

সৌম্যদা যখন জেগে উঠল তখন সকাল সাতটা বাজে। ঘুম ভেঙ্গেই তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন।

— কটা বাজে?

— সাতটা।

কী বলছ হে। জীবনে এত বেলা পর্যন্ত কখন ও ঘুমোইনি।

— আজ ঘুমিয়েছেন। রেকর্ড হল।

—চল। চল।উঠ।

আমরা দুজনে ধরাধরি করে তাঁবুটা খুলে কষে বেঁধে নিলাম।

অরণ্যের মধ্যেই আমরা দুজনে নিত্যকর্মও সম্পাদন করলাম। অরণ্যের মধ্যে নিত্যকর্ম সম্পাদন করার জন্য পরিবেশকর্মীরা গর্ত খুঁড়ে নেয়। ব্যবহার করার পরে মাটি দিয়ে সেই গর্তটা পূরণ করে পুঁতে ফেলে। আমার তাবুর সঙ্গে গর্ত খোঁড়া ডালকাটা ইত্যাদি বিভিন্ন সরঞ্জামের জন্য একটা অতিরিক্ত ব্যাগ আছে। সঙ্গে আছে প্রাথমিক চিকিৎসায় সাহায্যকারী অন্য একটি ব্যাগ। তাঁবুটা এবং প্রয়োজনীয় সাজ সরঞ্জাম আমার পিঠে নিয়ে আমরা নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য স্নান করে নেওয়া। অনেকদিন নদীতে স্নান করিনি। নদীর জল এখন ও ঘোলা হয়েই রয়েছে। তবুও প্রতিদিনের মতো মাথাটা ভালোভাবে ভিজিয়ে শরীরটাকে কোনোমতে ধুয়ে নিলাম। সৌম্যদা পুকুরের জলে স্নান করার স্থির  করলেন। তিনি নদীর তীরে কাপড় ধোয়ার জন্য ব্যবহার করা একটা পাথরের উপর বসে অনেক দূরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

হঠাৎ সৌম্যদা বলে উঠলেন— বার্ন আউল। লক্ষ্মীপেঁচা।

নদীর ওপার থেকে একটা লক্ষ্মী পেঁচাকে উড়ে আসতে দেখলেন সৌম্যদা। একটা কাক পেঁচাটাকে আসার পথে বিরক্ত করছে। পেঁচাটা উড়ন্ত অবস্থায় কাকটাকে প্রতি আক্রমণ করছে। অরণ্যের ভেতরে প্রবেশ না করা পর্যন্ত সৌম্যদা পেঁচাটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলেন।

এবার সৌম্যদার চোখে পড়ল গ্রেট কর্মোরেন্ট পাখি একটা। অসমিয়াতে পাখিটির  নাম দৈকলা।

— দেখেছ?

আমি সৌম্যদা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া পাখিটার দিকে তাকালাম। প্রায়ই দেখা পাখি। পাখিটা আমাদের নজর থেকে দূরে যাওয়ার জন্য কোথাও উড়ে চলে গেল।

সৌম্যদা এবং আমি নদীর তীর ধরে হেঁটে পর্যটক নিবাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। হাত ঘড়িতে তখন সাড়ে নয়টা। দূর থেকেই দেখতে পেলাম থানের সামনে অনেক মানুষের ভিড়। আমার মনটা দমে গেল। এই সময়ে এত মানুষ কখনও আমি থানে আসতে দেখিনি। সৌম্যদাকে বললাম— আর ও কিছু অঘটন ঘটেছে।

আমরা দ্রুত এসে মানুষের ভিড়ের কাছে পৌঁছে গেলাম।

-- আপনারা গতরাতে এখানে ছিলেন না নাকি?

— না। আমি মানুষটাকে বিনয়ের সঙ্গে বললাম।

— আমরা আপনাদের দুজনকে না দেখে খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম আপনাদের  দুজনকে কেউ অপহরণ করে নিয়ে গেছে।

— কেন। কিসের জন্য?

দেখা অথচ নামে চিনতে না পারা মানুষটাকে আমি বললাম।

মানুষটা পর্যটক নিবাসের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল— যান। দেখে আসুন।

আমি ঘরের ভেতরে এসে ভিমরি খেলাম। পুরো ঘরটা মানুষের বিষ্ঠা এবং মূত্রে পরিপূর্ণ। মেঝেতে আছড়ে ফেলা ভাঙ্গা বোতলের টুকরো এবং আমার অবশিষ্ট সাজসরঞ্জাম ছিন্নভিন্ন। স্টোভটা মেঝেতে আছড়ে ফেলায় ভেঙ্গেচুরে বিকৃত হয়ে গেছে। স্টোভটাতে কেরোসিন কম ছিল। সেটা মেঝেতে ছড়িয়ে গিয়ে শুকিয়ে যাওয়ায় দাগ হয়ে গেছে। বিছানাটা উল্টে ফেলা হয়েছে। বিছানার চাদরটা বিষ্ঠা এবং প্রস্রাবের মধ্যে পড়ে রয়েছে। মোটের উপর অমানুষিক উপদ্রব। উপস্থিত জনগণ ভেবেছিল আমাদের দুজনকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে ঘরটাকে লন্ডভন্ড করে রেখে গেছে।

— গতরাতে আমরা দুজনেই ওদের লক্ষ্য হব বলে আমার কেন জানি মনে হয়েছিল। সেই জন্য রাতটা বনের মধ্যেই কাটালাম। আর শেষ পর্যন্ত আমরা যা ভেবেছিলাম তাই সত্য হল। গতরাতে ওরা আমাদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে এসেছিল।

উপস্থিত জনগণের মধ্যে বিভিন্ন কথা চলতে থাকল। কেউ বলল— ওদের এত সাহস মন্দিরের সম্পত্তির ওপরে হাত দিয়েছে। কেউ বলছেন— এই দুজন আমাদের গ্রামের অতিথি। অতিথিকেই যদি রক্ষণাবেক্ষণ দিতে না পারি আমরা তাহলে কিসের গৃহস্থ। মাঝখানে আবার কেউ বলল— এইগুলো চুপ করে সহ্য করার কথা নয়, এর উচিত বিচার হওয়া উচিত। রাতের বেলায় যদি দুজনকে মেরে রেখে যেত। আমাদের মাঝখানের কেউ কি আজ আর মুখ দেখাতে পারত।

দূর থেকে পুরোহিত কৈলাস শর্মা মাথাটা নেড়ে নেড়ে আসছে। মানুষটার মুখটা একেবারে গম্ভীর। রাস্তায় কেউ খবর দেওয়ার পর থেকে তিনি তাড়াহুড়ো করে সাইকেল চালিয়ে চলে এসেছেন। সাইকেলটা ঘরের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে তিনি সোজাসুজি পর্যটক নিবাসের রুমের কাছে পৌঁছে গেলেন।

—ইস। ইস। মানুষের বিষ্ঠা এবং মূত্রের গন্ধ দাঁতে লাগায় পুরোহিত মশাই নাক মুখ কুঁচকে নিলেন।

— থানায় গিয়ে কেউ কেস দিয়ে আসা উচিত।

পুরোহিত শর্মার কাছে এসে বাপুটি  বলল। নাক টিপে ধরা পুরোহিত শর্মা বারান্দা থেকে নেমে এলেন।

— আপনাকে তো আবার স্নান করতে হবে?

এবার পুরোহিত শর্মা স্থির থাকতে পারলেন না।

— আমার সামনে থেকে দূর হ। কী সব মাথামুণ্ড বলছিস।

—ভালো কথা বললে পন্ডিত শনি হয়ে দাঁড়ায়।

—যা বলছি। 

বাপুটির কথা শুনেই নাকি অন্য কারও মনে কথাটা উদয় হওয়ায় জনগণ থান পরিচালনা সমিতি সম্পাদক এবং একজন সদস্যকে থানায় এজাহার দেবার জন্য পাঠিয়ে দিল। তারা থানায় যাওয়ার বিপরীতে বণিক সংস্থার সভাপতি বিপিন ডেকাকে নিয়ে জনগণ একটা জনসভা আয়োজন করার মনস্থ করলেন। কেবল তারা দুজনে থানা থেকে ফিরে আসার পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করবে। আরক্ষী যদি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে জনগণকেই করতে হবে। একটার পরে আরেকটা ঘটনা বেড়েই চলেছে। এদিকে থানে করা উপদ্রপের ঘটনা মানুষের কান থেকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে থানে মানুষের ভিড় বাড়তে লাগল। থানের ঘটনার জন্য, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন সহকারী পরিদর্শক, কয়েকজন আরক্ষী এবং সিআরপি বাহিনী আধ ঘন্টার ভেতরে থানে এসে উপস্থিত হল। থানে লোকে লোকারণ্য। আরক্ষী এসে ঘরটা পরীক্ষা করল। যে প্রথম ঘরটা দেখেছিল তার সাক্ষ্য গ্রহণ করল। আমাকে এবং সৌম্যদাকেও দু একটি কথা জিজ্ঞেস করল। পুরোহিত শর্মা এবং বণিক সংস্থার বিপিন ডেকাকেও দুই চারটি কথা জিজ্ঞেস করে নিয়মমাফিক লিখে নিল। আরক্ষী বিহিত  ব্যবস্থা নেবে বলে আরক্ষী বাহিনী চলে গেল। 

আরক্ষী যাবার পরে বিপিন ডেকার পৌরোহিত্যে সভা আরম্ভ হল। প্রত্যেকেই সুনন্দকে আক্রমণ এবং আমাদের দুজনকে আক্রমণ করতে আসা ঘটনাকে ধিক্কার জানাল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কী করা উচিত তার উপরে বিভিন্ন জনে বক্তব্য রাখলেন। একজন বক্তা বললেন—এরা এখানে যে ধরনের কাজ করতে এসেছে সেই সব বন্ধ করলেই সমস্যার শেষ। 

তখন সবার মাঝখান থেকে একজন বলল—নিবারণ গাছ কেটে সমস্ত তছনছ করে দিলে সমস্যার শেষ হবে? এরা গাছ লাগিয়ে আমাদের গ্রামটিকে সবুজ করতে এসছে আর সে কারখানা বসিয়ে সমস্ত ধ্বংস করতে চাইছে। কে ভালো কাজ করছে জনগণ ভেবেচিন্তে দেখুন। গায়ের জোরে সব কিছু করার দিন এখনও আছে বলে জনগণ ভাবে নাকি? সেই দিন পার হয়ে গেছে। বক্তব্য রাখা মানুষটি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে বলে মনে হল।

সভা চলার সময় কেউ খবর দিল যে আরক্ষী এবং বন বিভাগের লোক এসে কাঠ চেরাই কলটা বাজেয়াপ্ত করেছে। কারখানা খুলে সাজ সরঞ্জাম গুলি ট্রাকে ওঠাতে শুরু করেছে। 

কোথাকার সভা কোথায় গেল। কেউ বুঝতেই পারল না। প্রত্যেকেই তাড়াহুড়ো করে বাঁধের নির্দিষ্ট জায়গাটার দিকে এগিয়ে গেল। সৌম্যদা এবং আমি জনগণকে বারবার সতর্ক করে বলে দিলাম–আপনারা শুধু দেখতে থাকবেন আমাদের কাতর অনুরোধ আপনারা কোনো কথায় আইন হাতে তুলে নেবেন না।জনগণ গিয়ে দেখল কথাটা সত্যি। 

নিবারণ তার বুলেটটিতে বসে দুই হাত জড়িয়ে অত্যন্ত বেপরোয়া ভঙ্গিমায় বসে আছে। মাঝেমধ্যে সে বন বিভাগের এবং আরক্ষীর উদ্দেশ্যে বলে চলেছে—আপনারা একটা নেবেন আমি দুটো বসাব।

বন বিভাগ এবং আরক্ষীর লোকেরা কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। নিবারণকে কোনোরকম পাত্তা দিচ্ছে না।

তারা নিবারণকে গুরুত্ব দিতে না দেখে সে জনগণের দিকে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল—গতরাতে কুকুর দুটোকে পেলাম না। পেলে  বালুতে পুঁতে রাখতাম।

নিবারণের উত্তেজক কথাবার্তা শুনে জনগণের ধৈর্যের বাঁধ খসে পড়ল। বন বিভাগ এবং আরক্ষীর লোক কাঠ চেরাই কলটা ট্রাকে ভরিয়ে নিয়ে গেল। 

এইবার নিবারণ ক্রোধের বশে বন বিভাগের লোক এবং আরক্ষীর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে পুনরায় অহংকার করে বলতে লাগল–পুলিশ আমার (অশ্লীল) করবে। ফরেস্টের মানুষ আমার ঘন্টা করবে। আগামীকাল আরও একটি নতুন বসাব। আর কুকুর দুটো, কোথায় যাবে ওরা। আজ না পেলেও কাল পাব। বালিতে পুঁতে রাখব(অশ্লীল)।

জনগণ আর সহ্য করতে পারল না। 

—ওটাকে ধর। 

জনগণের মাঝখান থেকে কেউ একজন চিৎকার করল। হুড়মুড় করে বাঁধের ওপর থেকে নেমে আসা মানুষের দলটা নিবারনের দিকে দৌড়ে গেল। নিবারণ এক দৌড়ে নদীর তীরে পৌঁছে গেল। সে পালাতে যেতেই জনগণ থমকে দাঁড়াল। দলবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা জনগণকে উদ্দেশ্য করে নিবারণ পুনরায় বলতে লাগল—তোদের মধ্যে কারা কারা কুকুর দুটোর সঙ্গে আছিস আমি জানি। আমি কাউকে ছাড়ব না। এই বালিতে—নদীর বালির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে সে বলল—এই বালিতে অনেককে পুঁতে রেখেছি, এইবার তোদের কয়েকজনের পালা। জনগণ সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। প্রত্যেকেই হুড়মুড় করে তার দিকে ছুটে গেল। নিবারণ পুনরায় দৌড়াতে শুরু করল। সে কাচিনে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলে। জনগণ কোথায় তাকে ধরতে পারবে। জনগণ তার পেছনে তাড়া করে যাবার সময় কয়েকজন তার বুলেটটিতে আগুন লাগিয়ে দিল। দপ দপ করে জ্বলে উঠা আগুনে তার সুন্দর বাহনটা ভস্মীভূত  হয়ে গেল। তারপরে তার কারখানায় মজুদ করে রাখা কাঠগুলোতে অগ্নিসংযোগ  করল। আগুনের লেলিহান শিখা জায়গাটাকে ঘিরে ধরল। 

আমি, সৌম্যদা, পুরোহিত শর্মা এবং বাপুটি থান থেকে দেখতে পেলাম আগুনের প্রচন্ড লেলিহান শিখা।

—ঠিক করেছি, ঠিক করেছি। আগেও জ্বালিয়েছে, এখনো জ্বালাচ্ছে। প্রত্যেককে বালুতে পুঁতে রাখার ধমক দেয় সে, আজ হয়তো ওকেই পুঁতে রাখতাম।

এই গ্রামের মানুষ একেবারে মারকুটে। আজ তার চারা শুদ্ধ উপড়ে ফেলেছে। সে আর গ্রামে ঢুকতে পারবে না। 

পুরোহিত শর্মা গম্ভীর কন্ঠে বলল। 

কাঠ চেরাই  কলটার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে জনগণ ফিরে আসা পর্যন্ত আমি এবং সৌম্যদা মিলেমিশে ঘরটা পরিষ্কার করতে শুরু করলাম। পুরোহিত শর্মা নাক টিপে ধরে দূর থেকে আমাদের কাজ দেখতে লাগল। আমাদের দুজনের কাজ দেখে বাপুটি ছটফট করতে লাগল।

—কী মানুষ হে আপনারা। এত নোংরাতেও হাত দিতে পারেন। আমি ভেবেছিলাম জমাদারকে খবর দিতে হবে। 

রুমের মধ্যে বিষ্ঠা সমূহের ওপরে বালি ছিটিয়ে সেগুলি কোদাল দিয়ে তুলে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রাখলাম। তারপরে জল দিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট নোংরাটাকেও সরিয়ে দিলাম। কেউ একজন এলে বগলচক থেকে একটা ফিনাইলের বোতল আনতে বলতে হবে।

ঘটনাস্থল থেকে জনগণ ফিরে এসে আমাদের কাজ দেখে হতভম্ব। তাদের মধ্যে একজন বলল—আপনারা এই সমস্ত কাজও ঘৃণা না  করে করতে পারেন।

প্রকৃতি সংরক্ষণের স্বার্থে আমাদের  সব ধরনের কাজই পারতে হবে। এসব অত্যন্ত সাধারণ কথা। মানুষের করা কাজ মানুষকেই করতে হবে।

ফিরে আসা জনগণ পুনরায় একজোট হল। বিপিন ডেকা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল—এদেরকে নিরাপত্তা দেওয়া গ্রামবাসীর কর্তব্য। আপনাদের সেই কর্তব্য পালন করতে হবে। নিবারণ কলিতাকে আর কোনো মতেই গ্রামে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আমরা লক্ষ্য রাখব, আপনারা কীভাবে কাজ করেন—সৌম্যদা এবং আমার দিকে তাকিয়ে বিপিন ডেকা  বলল—দশের, জনগণের কাজ করব। আমরা সব সময় আপনাদের সঙ্গে থাকব। আজ আমাদের একটা অধ্যায় শেষ হল।











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...