ছোটোগল্প
রুদ্র কিংশুক
মীনমঙ্গল
সতু বলেই সবাই তাকে ডাকে। তার ভালো নাম সত্যপ্রসাদ। সমুদ্রগড়ের কাছে একটা গ্রাম। রামেশ্বরপুর। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খড়িনদী।অন্য পাশে রয়েছে ছোট্ট আর একটা নদী । গুরজোয়ানি। অদ্ভুত নাম।নান্দাই গাবতলার কাছে গুরজোয়ানি মিলেছে খড়িতে।তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে ঝাঁপ দিয়েছে ভাগীরথী প্রবাহে।খড়িনদীর পাড়েই সতুর বাঁশকাবারি ঘর ।নদীর জলো হাওয়া সবসময় ঘরে ঢুকছে।সতু মস্ত বড়ো মেছুয়া। রাতদিন মাছ-ধরাই তার কাজ, তার নেশা।সামান্য একটু জমি আছে। সেটা কোনরকমে চাষাবাদ করে। আর বাকী সময় সে মাছ ধরে বেড়ায় খাল-বিল-নদীতে।কখনো জালে, কখনো ছিপে, কখনো বর্শা দিয়ে। মাছকে কেন্দ্র করেই তার জীবন ঘুরপাক খায়। সে সারারাত মাছেদের স্বপ্ন দেখে। গ্রামের লোক বলে সাতুর গায়ে অদ্ভুত একটা গন্ধ আছে, যেটা মাছেদের খুব পছন্দ । সতু জলের ধারে দাঁড়ালে নাকি মাছেদের শরীরমনে একটা অস্থির ভাব দেখা যায়। তারা নাকি সতুকে ধরা দেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে । অনেকে বলে সতুর শরীরে একটা ব্রহ্মদৈত্য আছে, যার ইচ্ছেতেই এসব হয়। এইজন্য সতুর কাছ থেকে অনেকে দূরে থাকে। অদ্ভুত চেহারা তার। কালো কুচকুচে শরীর। বিরাটাকার। মাথার ঝাঁকড়া চুল। যত্নহীন।চোখগুলো বড়ো বড়ো। লাল ।সদ্য রং-ধরা করমচা।
আজ সন্ধ্যেবেলা থেকেই প্রবল বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। বৃষ্টির এই গানে সব মানুষের ঘুম পায়। কিন্তু এই বৃষ্টিগান সতুকে পাগল করে তোলে, টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায় ঘরের বাইরে। সতু তার ছাতা-ভাঙ্গা শিক দিয়ে বানানো বর্শা নিয়ে বেরুচ্ছে ।
তার বউ বলল --- আজ আর বেরুতে হবে না। আমার শরীরটা ভাল নেই ।
সতুর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। সতু কোনো কথা কানে নিল না ।আমি এখনই আসছি--- বলেই বেরিয়ে গেল। গ্রামের মোড়লদের পুকুরটায় প্রচুর শোল-মাগুর মাছ হয়েছে। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে মাছেদের শরীরে নাচ জেগে উঠবে। রাস্তার জল যেখান দিয়ে পুকুরে নামছে, সেখানকার জলরেখা ধরে এই মাছেরা উঠে আসবে ডাঙ্গায়। যদি উঠে না-ও আসে, তারা তীর সংলগ্ন দলদামে ঘোরাঘুরি করবে। বর্শার ঘায়ে এইসব মাছেদের গেঁথে তোলা কী এমন কঠিন কাজ। তালপাতার পেখে মাথায় বর্শা হাতে সতু পুকুরপাড়ে উপস্থিত।পুকুরপাড়ে তালগাছেরা ভিজছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎচমকের আলোয় গাথেদের মাথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জল নামছে যে জায়গাটায়, সেখানটায় কী একটা লাফালো। সতু কালবিলম্ব না করে বর্শাটা ছুড়ে মারলো আর তা তোলা মাত্র সে অন্ধকারে বুঝতে পারলো একটা কেজিখানেক মাছ। বিদ্যুৎ চমকালো বুঝল একটা মাগুরমাছ ।মাছটাকে বর্শামুক্ত করে সে রাখলো বাঁহাতে ধরা ঝোলায়। তার পর সে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। বাড়ি এসে হ্যারিকেনের আলোর কাছে সতু মাছটাকে ছুড়ে দিল। সতুর বউ দেখল মাছটার পেটের নিচ দিয়ে রক্তধারা বার হচ্ছে তখনও । হাতে নিয়ে সে দেখল মাছটার পেটভর্তি ডিম। আর কিছুদিন পরেই মাছটা ডিম ছাড়তো। সতুর বউয়ের শরীরটা ঝাঁকুনি দিল। পেটের ভেতর তার একটা প্রাণ লাফাচ্ছে। চোখ বুঝে সে দেখতে পেল অসংখ্য মৎস্যসন্তান জলের ভেতর খেলছে। তার শরীরটা ঝাঁকুনি দিল। পেটের ভেতর তারও একটা প্রাণ চঞ্চল। মাছটা তখনও হ্যারিকেনের আলোয় লাফাচ্ছে।
সে বলল---তোমার কাছে একটা অনুরোধ রাখবে ?
সতু বললো--- কী?
বউ বলল---মাছটার পেটভর্তি ডিম। তুমি ওকে ছেড়ে দিয়ে এসো। ও ঠিক বেঁচে যাবে ।
সতু বলল--- কী বলছো! এত কষ্ট করে ধরলাম। আগেও তো এমন ডিমওয়ালা মাছ কত ধরেছি ।
সতুর বউয়ের চোখে জলে চিকচিক করছে।
সে বলল --- আগে কি আর এ মন আমার ছিল?
সতু মাছটার মাথা ধরে আবার বাড়ির বাইরে গেল। বাড়ির পাশে খড়িনদী বর্ষার জলে এখন গান ছলছল ।সেই প্রবহমান জলে মাছটাকে ম
ছেড়ে দিয়ে সতু বলল ---- যাও অসংখ্য মীনসন্তানের জন্ম দাও । আমি কি আর এতকিছু বুঝি? আমাকে কিন্তুক তুমি ক্ষমা করে দিও।
একটা পেঁচা বর্ষারাতের জলভরা মেঘের ভেতরে ভাসিয়ে দিল তার গান।
রুদ্র কিংশুক
মীনমঙ্গল
সতু বলেই সবাই তাকে ডাকে। তার ভালো নাম সত্যপ্রসাদ। সমুদ্রগড়ের কাছে একটা গ্রাম। রামেশ্বরপুর। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খড়িনদী।অন্য পাশে রয়েছে ছোট্ট আর একটা নদী । গুরজোয়ানি। অদ্ভুত নাম।নান্দাই গাবতলার কাছে গুরজোয়ানি মিলেছে খড়িতে।তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে ঝাঁপ দিয়েছে ভাগীরথী প্রবাহে।খড়িনদীর পাড়েই সতুর বাঁশকাবারি ঘর ।নদীর জলো হাওয়া সবসময় ঘরে ঢুকছে।সতু মস্ত বড়ো মেছুয়া। রাতদিন মাছ-ধরাই তার কাজ, তার নেশা।সামান্য একটু জমি আছে। সেটা কোনরকমে চাষাবাদ করে। আর বাকী সময় সে মাছ ধরে বেড়ায় খাল-বিল-নদীতে।কখনো জালে, কখনো ছিপে, কখনো বর্শা দিয়ে। মাছকে কেন্দ্র করেই তার জীবন ঘুরপাক খায়। সে সারারাত মাছেদের স্বপ্ন দেখে। গ্রামের লোক বলে সাতুর গায়ে অদ্ভুত একটা গন্ধ আছে, যেটা মাছেদের খুব পছন্দ । সতু জলের ধারে দাঁড়ালে নাকি মাছেদের শরীরমনে একটা অস্থির ভাব দেখা যায়। তারা নাকি সতুকে ধরা দেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে । অনেকে বলে সতুর শরীরে একটা ব্রহ্মদৈত্য আছে, যার ইচ্ছেতেই এসব হয়। এইজন্য সতুর কাছ থেকে অনেকে দূরে থাকে। অদ্ভুত চেহারা তার। কালো কুচকুচে শরীর। বিরাটাকার। মাথার ঝাঁকড়া চুল। যত্নহীন।চোখগুলো বড়ো বড়ো। লাল ।সদ্য রং-ধরা করমচা।
আজ সন্ধ্যেবেলা থেকেই প্রবল বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। বৃষ্টির এই গানে সব মানুষের ঘুম পায়। কিন্তু এই বৃষ্টিগান সতুকে পাগল করে তোলে, টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায় ঘরের বাইরে। সতু তার ছাতা-ভাঙ্গা শিক দিয়ে বানানো বর্শা নিয়ে বেরুচ্ছে ।
তার বউ বলল --- আজ আর বেরুতে হবে না। আমার শরীরটা ভাল নেই ।
সতুর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। সতু কোনো কথা কানে নিল না ।আমি এখনই আসছি--- বলেই বেরিয়ে গেল। গ্রামের মোড়লদের পুকুরটায় প্রচুর শোল-মাগুর মাছ হয়েছে। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে মাছেদের শরীরে নাচ জেগে উঠবে। রাস্তার জল যেখান দিয়ে পুকুরে নামছে, সেখানকার জলরেখা ধরে এই মাছেরা উঠে আসবে ডাঙ্গায়। যদি উঠে না-ও আসে, তারা তীর সংলগ্ন দলদামে ঘোরাঘুরি করবে। বর্শার ঘায়ে এইসব মাছেদের গেঁথে তোলা কী এমন কঠিন কাজ। তালপাতার পেখে মাথায় বর্শা হাতে সতু পুকুরপাড়ে উপস্থিত।পুকুরপাড়ে তালগাছেরা ভিজছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎচমকের আলোয় গাথেদের মাথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জল নামছে যে জায়গাটায়, সেখানটায় কী একটা লাফালো। সতু কালবিলম্ব না করে বর্শাটা ছুড়ে মারলো আর তা তোলা মাত্র সে অন্ধকারে বুঝতে পারলো একটা কেজিখানেক মাছ। বিদ্যুৎ চমকালো বুঝল একটা মাগুরমাছ ।মাছটাকে বর্শামুক্ত করে সে রাখলো বাঁহাতে ধরা ঝোলায়। তার পর সে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। বাড়ি এসে হ্যারিকেনের আলোর কাছে সতু মাছটাকে ছুড়ে দিল। সতুর বউ দেখল মাছটার পেটের নিচ দিয়ে রক্তধারা বার হচ্ছে তখনও । হাতে নিয়ে সে দেখল মাছটার পেটভর্তি ডিম। আর কিছুদিন পরেই মাছটা ডিম ছাড়তো। সতুর বউয়ের শরীরটা ঝাঁকুনি দিল। পেটের ভেতর তার একটা প্রাণ লাফাচ্ছে। চোখ বুঝে সে দেখতে পেল অসংখ্য মৎস্যসন্তান জলের ভেতর খেলছে। তার শরীরটা ঝাঁকুনি দিল। পেটের ভেতর তারও একটা প্রাণ চঞ্চল। মাছটা তখনও হ্যারিকেনের আলোয় লাফাচ্ছে।
সে বলল---তোমার কাছে একটা অনুরোধ রাখবে ?
সতু বললো--- কী?
বউ বলল---মাছটার পেটভর্তি ডিম। তুমি ওকে ছেড়ে দিয়ে এসো। ও ঠিক বেঁচে যাবে ।
সতু বলল--- কী বলছো! এত কষ্ট করে ধরলাম। আগেও তো এমন ডিমওয়ালা মাছ কত ধরেছি ।
সতুর বউয়ের চোখে জলে চিকচিক করছে।
সে বলল --- আগে কি আর এ মন আমার ছিল?
সতু মাছটার মাথা ধরে আবার বাড়ির বাইরে গেল। বাড়ির পাশে খড়িনদী বর্ষার জলে এখন গান ছলছল ।সেই প্রবহমান জলে মাছটাকে ম
ছেড়ে দিয়ে সতু বলল ---- যাও অসংখ্য মীনসন্তানের জন্ম দাও । আমি কি আর এতকিছু বুঝি? আমাকে কিন্তুক তুমি ক্ষমা করে দিও।
একটা পেঁচা বর্ষারাতের জলভরা মেঘের ভেতরে ভাসিয়ে দিল তার গান।
বেশ ভালো লাগলো। ধন্যবাদ এমন মায়াময় লেখনশৈলীর জন্য। লিখতে থাকুন, ভালো থাকুন। আরো গল্প পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
উত্তরমুছুন