রবিবার, ২৮ জুন, ২০২০

রম্যরচনা || ভুল ভুলাইয়া~১ || কাশীনাথ সাহা

রম্যরচনা

ভুল ভুলাইয়া ( ১ম পর্ব)
কাশীনাথ সাহা

মানুষ মাত্রই ভুল করা। এক্কেবারে হক কথা। ভুল করা মানুষের গনতান্ত্রিক অধিকার। ভুল করুন ক্ষতি নেই, তবে ব্রাদার ভুলের মাত্রা জ্ঞানটা ঠিক রাখা চাই। ডোজ কমবেশি হলেই সব্বোনাশ। এমন ভুল করবেন না যে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নেই।
আমাদের প্রথম ভুল কিশোর বয়সে। ওই বয়সেই বুকে কৃ্ষ্ণচূড়ার ফুল ফোটে। থোকা থোকা লাল নীল হলুদ বেগুনি ফুল।গন্ধ না থাকুক বাহার আছে। সেই সুগন্ধিতেই মানুষ প্রেমের গাড্ডায় পড়ে খাবি খায়। তুম মেরী দিল কা ধড়কন!  বার তের বছরের কিশোর, যার ভাল মতো দিল-ই তৈরী  হয়নি তারও ধড়কন!  ক্লাসে শিক্ষক মোগল সাম্রাজ্য বিস্তার পড়াচ্ছেন, আর ছাত্রের মাথায় তখন টুনি- টুনটুনি। টুনি বাল্ব জ্বলছে নিভছে। ঘোষাল পাড়ার টুনি দুপাশে বিনুনি ঝুলিয়ে স্কুলে যায়, ছাত্রের মন বৃন্দাবন। সেই টুনির টানে টালমাটাল। স্যর জিজ্ঞেস করলেন, দীপক দিল্লির সিংহাসনে প্রথম কোন মহিলা প্রথম সম্রাজ্ঞী হয়েছিল? দীপকের সিংহাসনে তখন টুনির ফোকাস। হাসি হাসি মুখে দীপক বলল, টুনি স্যর। টুনি? কোন টুনি?  মেরা দিল কা মোরব্বা। পাশ থেকে গনশা ত্রুটি সংশোধন করে দেয়। মোরব্বা নয় উল্লুক, মোহাব্বত। দিল কা মোহব্বত। সারা ক্লাসে তখন হাসির সুনামি। স্যর বললেন, বাবা দীপক এই বয়সে সকলেরই একটু আধটু ঘোর লাগে।  মোহব্বতের ঘোরটা কাটাও বাবা, নইলে গাড্ডায় পড়বে। সেই ঘোর আর কাটলো না। গীয়ার পাল্টে পাল্টে কোনরকমে ক্লাস নাইন। নাইনে তিনবার। ঘোর যখন কাটলো তখন জীবন এগিয়ে গেছে দীপক খাবি খাচ্ছে পচা ডোবায়।
বিয়ে করাও একটা মারাত্মক ভুল। মানুষ বিয়ে করে কেন? সারাজীবন গুঁতোগুঁতি করবার একটা হৃষ্টপুষ্ট পার্টনারের জন্য। সারাজীবন এ ওকে আঁচড়ায় ও একে গুঁতোয়। প্রেম ফ্রেম বোগাস। ওসব সিনেমা, গল্প উপন্যাসে হয়। বাস্তব জীবনে বসন্তকাল নেই। হয় গ্রীষ্ম নয় বর্ষা। জ্ঞানপাপী হয়ে তাই বিয়েটাই করে ফেলি। জীবনে বিয়ে করাও ভুল, বিয়ে না করাও ভুল। মানুষকে যে কোন একটা ভুল করতেই হয়। অতএব বিয়ে।। দিল্লীকা লাড্ডু না খেয়ে কেন পস্তানো!  খেয়েই দেখি যা থাকে কপালে। বউ মানে জ্যোৎস্না রাতে দীঘার সী বিচ। পূর্ণিমা রাতে খোলা ছাদে, সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে...। বিয়ের প্রথম প্রথম জ্যোৎস্না থাকে, দীঘা মন্দারমনির সী বিচ থাকে। রবি ঠাকুরের গান থাকে।বউয়ের নরম কোলে মাথা রেখে জয় গোস্বামী, সুনীল গাঙ্গুলিও লেজ ঝাপটায়। সবেতেই সুর। শ্যাওড়া গাছকেও দেবদারু মনে হয়। তারপর বছর ঘুরতেই সব প্রেম ফরসা। সব ধূ ধূ মরুভূমি। এই ভুলের হাত ধরে সন্তান জন্মায়। সেই সন্তানও ভুল করে  হিসেবের গন্ডগোলে এসে গেছে। মা বাবার দিন গোনার হিসেবের গন্ডগোলে ল্যান্ড করেছে। ভুল করে এসেই যখন পড়েছে, তখন গ্রীনরুমে থাকুক। এই নিয়ে স্বামী স্ত্রী তে অশান্তি। এখন স্ত্রী রা সহজে মা হতে চায় না  ওতে চটক কমে যায়। গ্লামার চটকে যায়। স্ত্রীর অভিযোগ, দিলে তো আমার জীবনটা বরবাদ করে!  এখন আমি কি করি!  বোগাস।
এই রকম ভুলের হাত ধরে সন্তান জন্মায়। নার্সিং হোমে নার্সের ভুলে সেই সন্তান আবার অদলবদল হয়ে যায়। বহুৎ কাঠখড় পুড়িয়ে থানা পুলিশ করে সেই সন্তান আবার স্ব মহিমায় স্বস্থানেই ফিরে আসে।
সংসার জীবনে ছোটখাটো ভুলও মারাত্মক হয়ে যায়। স্কুলের ফাস্ট বয় মাধ্যমিক পরীক্ষায় ব্যাক পেয়ে দুঃখ হতাশা অপমানে জীবনকে গুডবাই বলে ঝুলে পড়লো সিলিং ফ্যানে।পরে রিভিউ করে জানা গেল ছাত্রটি শুধু পাশই করে নি সব বিষয়ে ষ্টার মার্কস পেয়েছে। কিন্তু ছাত্র তখন ষ্টার হয়ে দূর আকাশে জ্বলজ্বল করছে।
বোঝার ভুলে বিপরীত প্রতিক্রিয়াও ঘটে যায়!  আমার বন্ধু সতীশকে ওর অফিসের বস বললেন, সতীশ প্রায় দেখছি, তোমার কাজকর্মের ভুল হচ্ছে। তুমি বড্ড অমনোযোগী হয়ে পড়ছো। আমারও প্রথম প্রথম ওরকম হতো। সেই সময় আমি ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যেতাম।সেখানে কিছুক্ষণ আমার স্ত্রী র সাথে সময় কাটিয়ে তার আদর সোহাগ একটু খেয়ে নিয়ে আবারও অফিসের কাজে মন দিতে পারতাম। আমার উপদেশটা মনে রেখ। পরদিন সতীশ বসের কথা মতো টিফিনের পর সময় কাটাতে আর আদর সোহাগ খেতে বসের বাড়ি চলে গেল। সবই ঠিকঠাক চলছিল। বসের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে  পালন করে আদর সোহাগও বেশ খাচ্ছিল তবুও বস যে কেন ওর চাকরিটা কেন খেয়ে নিয়েছিল সতীশ সেটাই এখনও বুঝতে পারলো না। ভুল একটা কোথাও হয়েছিল নিশ্চয়ই।
এই যে আমার কবি বলে একটুখানি পরিচিতি আছে।আমার এই কবি হওয়ার পেছনেও একটা ছোটখাটো ভুল আছে। খুব গোপনে বলি, পাঁচকান করবেন না। তখন সদ্য কলেজ থেকে বেরিয়ে মল্লিকার প্রেমে ( শেরওয়াত নয়)  হাবুডুবু খেতে খেতে গোটা দশেক জম্পেশ প্রেমের কবিতা নামিয়ে দিলাম। লিখেই যখন ফেললাম, তখন সে কবিতা বাক্সবন্দী থাকে কেন!  ভাইকে বললাম কবিতা গুলো একটা পত্রিকার শারদ সংখ্যার জন্য ডাকে পাঠিয়ে দিতে। ভাই চটজলদি ভুল করে ( ইচ্ছাকৃতও হতে পারে)  আমার কবিতার বদলে দিদির ছেলের অন্নপ্রাশনের লম্বা ফর্দ খানা খামে ভরে পত্রিকা দপ্তরে পাঠিয়ে দিল। পত্রিকা সম্পাদক সেই ফর্দটাই কবিতা বলে ছাপিয়ে দিলেন। তিনি ভাবলেন নতুন আঙ্গিকের পোস্ট মর্ডান কোন কবিতা হবে। কবিতাটা বাজারে হেবি হিট করে গেল । যাকে বলে সুপার ডুপার হিট। আরও মস্ত বড়ো খবর সেই বছর আমি ওই কবিতাটির জন্য  জেলার শ্রেষ্ঠ কবির পুরস্কারটাও পেয়ে গেলাম। সেই যে দাঁড়িয়ে গেলাম তখন থেকে দাঁড়িয়েই আছি। মঞ্চ ছাড়া এখন আর কোথাও বসিই না! 😄
সৎ চরিত্রবান মানুষও সামান্য ভুলে জীবন থেকে হড়কে যায়।
ইদানিং বিচারকদেরও ভুল হচ্ছে। নিম্ন আদালত যাকে বেকসুর খালাস বলে রায় দিচ্ছে, উচ্চ আদালতের রায়ে সেই ব্যক্তিই যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। উল্টোটাও হয়। ভুলটা যে কোথায় হচ্ছে ঠিক ধরতে পারছি না!
নেতা নেতৃদেরও ভুল হয়। কখনো ঐতিহাসিক কখনো প্রাগৈতিহাসিক ভুল। এই ভুলের জন্য বাংলার কপালে যদিও বা একবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শিকে ছিঁড়েছিল সেটাও জুটলো না!
ছুটির দিন স্বামী স্ত্রী নিকোপার্কে বেড়াতে গেছে।সেখানে স্ত্রী র হঠাৎ মনে পড়লো, এ্যাই তোমাকে ঘরের চাবিটা লাগাতে বলেছিলাম, ঠিক মতো লাগিয়েছিলে তো? স্বামী আধ হাত জিব কাটে, এই যাঃ এক্কেবারে ভুলে গেছি। কি হবে! রইলো নিকোপার্ক ঘোরা। দু'জন দুজনেই দোষ দিতে দিতে বাড়ি ফিরে দেখে দরজা হাট করে খোলা। ফাঁকা ঘর পেয়ে চোর সব ফাঁকা করে দিয়ে গেছে। রসিক চোর যাবার সময় সাদা কাগজে লিখে রেখে গেছে। দাদা দিদি আপনারা কি ভাল মানুষ। আমার কাজটা সহজ করে দেওয়ার জন্য বিজয়ার শুভেচ্ছা রইল। ইতি আপনাদের স্নেহধন্য - চোরভাই।

ক্রমশ....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...