মঙ্গলবার, ৪ আগস্ট, ২০২০

স্মৃতি কথা || নীলাঞ্জন কুমার || এই আমি চরিত্র

স্মৃতি কথা || নীলাঞ্জন কুমার

                    এই আমি চরিত্র

                              


                         ।। ২ ।।

                 ( গত মাসের  পর)

বাকি তিন দাদা-দিদি (  যারা এই স্মৃতি কথায় ইচ্ছে অনিচ্ছেয় এসে পড়বে)  একজন সদ্যোজাতের প্রতি পার্থিব মায়া মমতা নিয়ে পাশে থাকার জৈবিক গুণগুলি নিয়ে সে সময় আমার সঙ্গে ছিল মা বাবার সঙ্গে যা আমাকে বাড়তি কিছু দিয়েছিল । জন্মস্থান তমলুক শহরের পার্বতীপুরে, সেখানে দাদু কাকুদের স্নেহচ্ছায়া অন্যতম পাওয়া বলে মনে করি । স্বাভাবিকভাবেই এই সদ্যোজাত অবোধ চরিত্রটি তার সেই সময় থেকে মা বাবার কাছে তাদের স্মৃতিমতো (পরবর্তীতে  যখন বাবা মা আমায়  নিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়তো ) জেনেছে সেই অবোধ সময়ের কিছু খন্ড মুহূর্ত । যেমন,  খুব একটা মা বাবাকে বিব্রত করিনি,  কি যেন ভেবে যেতাম । ভেতরে ভেতরে একটা চন্ঞ্চলতা ছিল,  তেমন কিছু দেখলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম । যার জন্যে মা আমায় আদর করে বলতো ' হাঁ করা ছেলে '। সবচেয়ে মজা হয়েছিল  আমার অন্নপ্রাশনের দিন , সেদিন ছিল ভীষণ বৃষ্টি । বৃষ্টির জন্য রুই কাতলা   মাছ পাওয়া যাচ্ছিল না । তবে ছিল কেবল ইলিশ । বাবার মাথায় হাত , কি হবে! মা বুদ্ধি দিলো, অন্য মাছ নেই তো কি হয়েছে,  ইলিশ তো আছে । তাই সবাই খাবে । এলো ইলিশ,  সবাই মহানন্দে খেয়ে আমায় আশীর্বাদ করে চলে গেল । মা আর একটি কথা বারবার বলতো,  ওই দিন প্রথা অনুযায়ী আমার সামনে দেওয়া হয়েছিল  একটি রেকাবিতে একখানা রুপোর টাকা ও একটি বাবার সখের দামী সোনার নিব দেওয়া পারকার পেন । মায়ের  জবানিতে জানাই  :  যখন খোকনের  ( মা'র আমাকে দেওয়া ডাকনাম) সামনে এগুলো রাখা হল তখন কিছুক্ষণ  সেদিকে চেয়ে আস্তে আস্তে তুলে নিলো পেনটা । তখন ওর কি আনন্দ ! শক্ত মুঠোয় ধরে আছে,  মনে হচ্ছে আর ছাড়বে না । কিছুক্ষণ তাই নিয়ে খেলার পর এলো ঘুম , হাতে কিন্তু সেই কলম । ওর বাবা বুদ্ধি করে আস্তে আস্তে হাত থেকে পেনটা বের সেখানে ঢুকিয়ে দিলো একটা অন্য কলম । ঘুম থেকে উঠে অন্য পেন দেখে বাবুর কি কান্না!  অনেক কষ্টে ভোলাতে হয়েছিল ।
        আমি নামের এই চরিত্রের সঙ্গে মা বাবা সহোদর সহোদরা দাদা দিদি রূপে যে সব চরিত্র পাইয়ে দিয়েছেন   প্রকৃতি তাঁদের মধ্যে  হলেন বাবা মুক্তিদারন্ঞ্জন চক্রবর্তী, যিনি তাঁর তারুণ্যে যৌবনে তমলুক শহরের দামাল ব্যক্তি । ছিলেন যশস্বী অভিনেতা ,যাত্রা নাটকের পরিচালক । বাবা নিয়মিত তমলুকের কুস্তির আখড়ায় ব্যায়াম ও কুস্তি লড়তেন।  উনি মেদিনীপুর শহরের এক অনুষ্ঠানে নটসম্রাট হিসেবে বিভূষিতও হয়েছিলেন । ১৯৫৬ সালে  তমলুক বান্ধব সমাজের প্রযোজনায় কলকাতার চেতলায় অহীন্দ্র মন্ঞ্চে 'কেদার রায় ' নাটকে বাবা   'শ্রীমন্ত ' চরিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে স্বর্ণ পদক লাভ করেন। প্রতিযোগিতায় একজন বিচারক হিসেবে ছিলেন সাহিত্যিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় । বাবার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর লেখা উপন্যাসের সিনেমা ' না ' তে বাবাকে সুযোগ দিয়েছিলেন । কিন্তু তৎকালীন তিন ছেলে মেয়ের বাবা  (আমি তখনও পৃথিবীতে আসিনি  )  ও সরকারি চাকুরে হিসেবে সব ছেড়ে ছুড়ে  সিনেমাতে অভিনয় করা মানে সর্বনাশ , চরিত্র ও নিজেকে নষ্ট করে দেওয়ার পথ বেছে নেওয়ার সে সময়ে বদ্ধমূল ধারণার বশবর্তী হয়ে প্রধানতঃ দাদুর বাধায় সে প্রস্তাবে বাবা সায় দিতে পারেননি। পরে সে চরিত্র নবাগত বিকাশ রায়কে দেওয়া হয় । তাঁকে দেখি মেদিনীপুর জেলার শৌখিন নাটক ও যাত্রায় অসামান্য দক্ষতায়  অভিনয় ও পরিচালনা করতে । যা অবিভক্ত মেদিনীপুরের নাট্য ইতিহাসে আজও অম্লান ।১৯৯৮সালে ৭২ বছর বয়সে স্নায়বিক রোগের কারণে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি দেন ।
          মা অশ্রুকণা চক্রবর্তী ছিলেন সে সময়ের  ডাকসাইটে  সুন্দরী ও কণ্ঠশিল্পী । স্বাধীনতার আগে মহিলাদের মাইকে গেয়ে ফাংসন করতে খুব একটা দেখা যেত না । যারা করেছেন তাদের মধ্যে মা একজন । '  বালুচরি ' সিনেমা খ্যাত  সুরকার  রাজেন তরফদারের শিষ্যা ছিলেন তিনি।  হুগলির  শেওড়াফুলির  এক রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম হলেও মা ছিলেন ব্যতিক্রমী । তাঁর সাজপোশাক ছিল আধুনিক। যা মাত্র ষোল বছর বয়সে এক অনাধুনিক শহর তমলুকে বিয়ে হয়ে এসে পাড়াপড়শির অনেক কটুক্তি তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে । যা নিয়ে  পরে মাকে রসিয়ে রসিয়ে  দিদিদের সঙ্গে গল্প করতে শুনেছি । যেমন চল্লিশের দশকে কলকাতায়  নতুন ফ্যাশন উঠেছিল হাতকাটা ব্লাউজ পরা। মা প্রথম তমলুকে হাতকাটা ব্লাউজ পরেন । তা নিয়ে সারা পার্বতীপুরে মায়ের বিরুদ্ধে  গিন্নিবান্নিরা কটুক্তির বণ্যা বইয়ে দেয় । কিছুদিন পরে যারা কটুক্তি করতো তাদের একজনকে কোন বিয়েবাড়িতে মা হাতকাটা ব্লাউজ পরতে দেখেন ।মা তার দিকে তাকাতেই সেচোখ নামিয়ে নেয় । মায়ের কিছু কিছু গুণ আমার ভেতরে আছে বুঝতে পারি । যেমন অসম্ভব জেদ, স্থৈর্য ইত্যাদি । একটি অস্থির ও নানা জটিলতায় চলা একটি পরিবার তিনি যে কত কষ্ট সয়ে ধরে রেখেছিলেন তা শিক্ষণীয় । ২০০২সালে তিনি আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে যাবার পর তা ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করতে পারি ।
   সত্যি বলতে কি, তমলুকের কোন সমৃতি প্রাকৃতিক কারণে বোধে আনা সম্ভব নয়।  বাবা চাকরির
বদলি গত কারণে মেদিনীপুর শহরে চলে আসেন সপরিবারে । তখন  আমার বয়স মাত্র আড়াই । তার কিছুদিন পরপরেই আমার বোধ আসে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...