বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০২১

একজন বুড়ো মানুষ-১৩ || নিরুপমা বরগোহাঞি || অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস,

একজন বুড়ো মানুষ-১৩,

নিরুপমা বরগোহাঞি,

অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস,


(১৩)
সঙ্গে সঙ্গে কমলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে তার চিন্তার স্ৰোতে বাধা পড়ল-' উপদেশ এবং উপদেশ- আজকাল তোমার মুখে উপদেশ ছাড়া আর অন্য কোনো কথা নেই। কিন্তু আমি এত বোকা নই বুঝেছ, পুরুষ জাতিটা সবসময় এভাবে বড় বড় কথা বলে, আদর্শের দোহাই দিয়ে মহিলাদের পায়ের নিচে রেখে আসছে, ঘরের মহৎ আদর্শের ছবি তুলে ধরে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে। তোমরা সমস্ত পুরুষরাই এক। যতোই বিলাতে, আমেরিকায় পাস করে আস না কেন, তোমরা সবাই এক। মেয়েদের পরাধীন করে রাখার কথাটা যুগ যুগ ধরে তোমাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে গেছে। তোমাদের আর আমার চিনতে বাকি নেই। সবার দিন চিরকাল সমান যায় না। আমাদের মেয়েদের দিন এখন শুরু হয়েছে বুঝেছ, আমরাও-' এরপরে কমলার এই ধরনের কথা চলতে থাকল। আর বিজয় ভরালীখেয়াল করল  সঞ্জয়ের কণ্ঠস্বর আর শোনা গেল না। বইটা চোখের সামনে মেলে নিয়ে তিনি ও পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। মনের চোখে ভেসে উঠল আর ও একটি স্তব্ধ মূর্তি -ছেলে সঞ্জয়ের।
একদিন কমলাদের বাড়ি তৈরি করার কাজ শেষ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে কমলার একটি ছেলের জন্ম হয়েছিল।
বিজয় ভরালী সেই একদিনই যা বাড়ি তৈরির কাজ দেখতে গিয়েছিলেন। তার পরে আর যাননি। এখন বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হওয়ায় আরও একদিন যেতে হল। শিশুটিকে ভাবিত এবং খাসিয়া আয়ার কাছে রেখে কমলা শশুর এবং স্বামীর সঙ্গে বের হল। বাড়িটা সত্যি সুন্দর হয়েছে।  কমলার মুখ গর্ব এবং আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।  ঘরের ভেতর ঘুরে ঘুরে সে শশুরকে সমস্ত বাড়িটা দেখাল। সামনের বারান্দা, ড্রইং  রুম এবং একটা বাথরুমে ছাই রঙের মোজাইক করা। বাথরুমে একটা প্রকাণ্ড শুভ্র বাথ-টাব।বেডরুমের দেয়ালগুলোতে কায়দা করে কয়েকটা দেওয়াল আলমারি করা হয়েছে। পর্দা লাগানোর জন্য দরজার চৌকাঠে ব্যবস্থা করে রাখা আছে। কমলা ঘুরে ঘুরে শ্বশুরকে সব কিছু দেখাল। সামনের বারান্দার কাছে এভাবে পাকা করে রাখা হয়েছে যে সেখানে টবে ফুল রোপণ করা যাবে। বিজয় ভরালী মন খুলে বাড়িটার প্রশংসা করলেন। সত্যিই কমলা বেশ হিসেবি মেয়ে। বাড়ির দরজা জানালার রং ও খুব সুন্দর হয়েছে।কমলার রুচির প্রশংসা করতে হবে। সেদিন রাতে বিজয় ভরালী বাড়ি তৈরি সম্পর্কে সঞ্জয় এবং কমলাকে কথা বলতে শুনলেন। ইতিমধ্যেই এটা ঠিক হয়েছিল যে রিফাইনারির ঘরটা ছেড়ে দিয়ে নিজের বাড়িতে চলে যাবে। শিশুটি জন্মের পর থেকে ঘরটা যেন আর ও ছোট হয়ে পড়েছিল। তারমধ্যে খাসিয়া আয়াটির ও থাকার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তাই ভালো একটি দিনক্ষণ দেখে গৃহপ্রবেশের কথা ভাবছিল। ভালো দিন দেখার কথায় কমলা জোর দিচ্ছিল। তখন বিজয় ভরালী  মনে মনে হাসছিলেন। বাইরের চালচলনে অতি আধুনিক এই প্রগতিশীলা মেয়েটির মন দেখছি আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আগের দিনের অশিক্ষিত মহিলাদের মতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তিনি নিজে বুড়ো  হয়েও আচার অনুষ্ঠানের প্রতি তার ততটা নিষ্ঠা ছিল না। অবশ্য সেই সমস্ত তার ভালো লাগে, সেই পূজা-পার্বণ,ধূপ ধুনোর গন্ধ মনটাকে  পবিত্র করে। কিছু একটা শুভ এবং মঙ্গলের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে -তাই, তার চেয়ে বেশি মূল্য তিনি তাতে আরোপ করেন না।  তার জন্য  বাইরের আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জীবনের কাজকর্মগুলি শুভ এবং মঙ্গলময় করে তোলার চেয়ে ভেতরের সৎ প্রেরণায় জীবনটাকে সুন্দর করে তোলা বেশি আবশ্যকীয়। ইলার কিন্তু জীবনকে সৎ সুন্দর এবং মঙ্গলময় করে তোলার এই দুই ধরনের আন্তরিকতাই  ছিল। তার এখন সেই কথাগুলি কমলাকে বলতে ইচ্ছা করল। ইচ্ছা হল বলি যে বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের উপরে নির্ভর করে তোমার গৃহ পবিত্র এবং  শুভ করে তোলার উপরে জোর দেওয়ার চেয়ে তোমার নিজের কল্যাণ হাতের স্পর্শে গৃহলক্ষীর প্রকৃত কর্তব্য নিষ্ঠা এবং দায়িত্বে তুমি তোমার ঘর বেশি মঙ্গলময় করে তুলতে পারবে কমলা। তোমার ঘরটা তুমি দেখতে খুব সুন্দর করেছ। সমস্ত সুযোগ সুবিধা আরাম স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থাই তুমি সেখানে করে রেখেছ।তোমার সেই অতি সুন্দর ঘরটিতে দেহগুলি পরম আরামে দিন কাটাতে পারবে। কিন্তু সেটাই জীবনের সবচেয়ে বড় কথা নয় কমলা। তোমার গৃহে, তোমার স্বামী, তোমার সন্তান, মনের অনাবিল শান্তি এবং স্বাচ্ছন্দে বাস করতে পারে। তোমার সৌম্যশান্ত কল্যাণ রূপের মঙ্গল স্পর্শ ওরা সব সময় অনুভব করে জীবন পথে চলতে পারে ।তার জন্য তুমি চেষ্টা কর কমলা, তার জন্য তোমার বাড়ির অভ্যন্তর এবার গড়ে তোল। 
কিন্তু ইলা তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে মনের মতো কথা সে কার সঙ্গে বলতে পেরেছে?কমলার সঙ্গে তিনি আর পারবেন না, কমলার সামনে পড়লেই আজকাল তিনি অপরাধীর মতো সংকুচিত হয়ে পড়েন। মুখের কথা যেন হারিয়ে যায়। তাই এই ধরনের একটি শব্দ কমলার সামনে উচ্চারণ করার কথা একেবারেই অভাবনীয় হবে।কমলার কথামতো গৃহ প্রবেশের দিন বামুন ডেকে পূজা করে গৃহ প্রবেশ করা হয়েছিল। সেসবই বোধহয় দুজনে আলোচনা করছে-সঞ্জয়  এবং কমলা,বিজয় ভরালী চোখদুটো বইয়ের পাতায় রেখে, কান দুটি অভ্যাসবশত সজাগ করে রাখেন।কমলা প্রথম উত্থাপন করেছিল-' একজন বামুন ঠাকুরের কথা বলেছিলাম,বলেছ তো? ' আমার সঙ্গের একজনকে বলে রেখেছিলাম, দুই-একদিনের মধ্যে ঠিক করে দেবে বলেছে । তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সঞ্জয় পুনরায় বলল -কমলা, কেবল পূজা করেই গৃহপ্রবেশের উৎসব করবে? লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে  খাওয়ানোর দরকার ছিল না? আমার সঙ্গের বন্ধুবান্ধবরা তো বলেই রেখেছে। অফিসের সবাইকে ডাকতে হবে কিন্তু ,না হলে কাকে রেখে কাকে বাদ দেব।' কমলা বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। তাঁর ক্রোধে ভরা কণ্ঠস্বর বিজয় ভরালী শুনতে পেলেন। 'শুধু অফিসের মানুষগুলোকে ডাকলেই হবে,  সমগ্র রিফাইনারির মানুষগুলোকেও ডাকছ না কেন?আমি বাড়িটা বন্ধক দিয়ে টাকা ধার করে তাদের চা মিষ্টি খাওয়াব? ছেলের বাবা হলে তবু যদি তোমার বেহিসাবি স্বভাবটা দূর হত। বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে যে নিঃস্ব হতে হয়েছে তোমার বোধহয় সেই খবর নেই।
 একটি ঘর তৈরি করা তো এখন ও বাকি।  আজকালকার এত অভাবের দিনে কোনো মানুষ সামান্য উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করে টাকা পয়সা খরচ করে?  আর আমি কোথাও শুনিনি যে গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে উৎসব পেতে কেউ দুনিয়ার লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে। 'আমার মা কিন্তু করতেন কমলা। মা বোধহয় তার সঙ্গে কাঙ্গালী ভোজনও করাতেন ।' সঞ্জয় যেন কমলাকে নয়, নিজেকে বলছে সেভাবে খুব ধীরে ধীরে আত্মগত ভাবে কথাটা বলল। বিজয় ভরালীর সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল।' আমার মা'- সঞ্জয় তার মায়ের নাম নিচ্ছে।
একটু বড় হওয়ার পর থেকে সঞ্জয়কে আর কোনোদিন বিজয় ভরালী মায়ের নাম নিতে শুনেননি। তাই বিজয় ভরালীর ধারণা  হয়েছিল যে সঞ্জয় তার মাকে ভুলে গেছে। সে কথা ভেবে সেদিন তার একটু দুঃখ হয়েছিল। একটি মাত্র ছেলে জীবিত থাকাকালীন যেন প্রাণ ছিল সেই ছেলেই এভাবে আমাকে ভুলে গেল কিন্তু মনে মনে একটু খুশি হয়েছিল যাক ছেলেটি মাকে হারানোর দুঃখ ভুলতে পেরেছে। তার পরে আজ এত বছর পরে সঞ্জয়ের মুখে প্রথম তার মায়ের নাম নিতে শুনল। মাকে তাহলে সে ভাবার মতো  একেবারেই ভুলে যায়নি। বিজয় ভরালীর বুকটা কেঁপে উঠল। কিছু একটা যেন গলা পর্যন্ত উঠে এসে গলাটাকে রুদ্ধ করে দিল। না, না মাকে একেবারেই ভুলে যায়নি, এমনকি মায়ের স্বভাব পর্যন্ত মনে আছে পোনার। সঞ্জয়ের প্রতি হঠাৎ কৃতজ্ঞতায় বিজয় ভরালীর অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে সঞ্জয়দের রুমটা কমলার কথার শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছিল-' তোমার মা কাঙ্গালী ভোজন  কেন বাঙালি ভোজন ও করাতে পারতেন-'  কমলা তিক্তভাবে রসিকতা করে বলল। কিন্তু তখনকার যুগ ছিল আলাদা। তখন আজকের মতো জিনিসপত্রের এত আগুন ছোঁয়া দাম ছিল না-'
' কিন্তু কমলা যুগ আলাদা হলেও মানুষের মন একই থাকে, অন্যকে যারা ভালোবাসে তারা সবসময়ই সমস্ত অভাব-অভিযোগের মধ্যেও অন্যদের ভালোবাসা বিলিয়ে থাকে। আমার মা আজকের যুগে হলেও গৃহপ্রবেশ উৎসব করতেন। তার জন্য প্রয়োজন হলে তিনি বাথরুমে বাথ-টাব না লাগিয়ে সেই টাকা দিয়ে  মানুষকে খাওয়াতেন-'
জ্বলন্ত আগুনে যেন ঘী পড়ল- 'তারমানে তুমি এটাই প্রমাণ করতে চাইছ যে আমার মন তোমার মায়ের চেয়ে অনেক সংকীর্ণ।সেই জন্য আমি গৃহ প্রবেশ উৎসবে মানুষকে ডেকে খাওয়াতে পারি না। দেশে যখন মানুষ এক মুঠো চালের জন্য হাহাকার করে মরছে, তখন আমি একদল মানুষকে ডেকে অর্ধেক খাবার নষ্ট করে অপচয় করতে চাইছি না বলে আমার মন তোমার মায়ের চেয়ে অনেক সংকীর্ণ হয়ে গেল-'



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...