শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

কিছু বই কিছু কথা ২৯১ || কালপুরুষের ইস্তেহার : সুনেন্দু পাত্র || আলোচক- অলোক বিশ্বাস

কিছু বই কিছু কথা ২৯১|| কালপুরুষের ইস্তেহার : সুনেন্দু পাত্র || আলোচক- অলোক বিশ্বাস



কালপুরুষের ইস্তাহার : সুনেন্দু পাত্র

আলোচক : অলোক বিশ্বাস

শূন্য পরবর্তী দশকের, অর্থাৎ প্রথম দশকের কবি সুনেন্দু পাত্র। 'কালপুরুষের ইস্তাহার' তাঁর প্রথম কবিতার বই হলেও পরিণত লেখায় পরিপূর্ণ। কবিতার আন্তর- সৌন্দর্যে অবগাহনের পরিবাহী ভাষা ওঁর বহু পংক্তিতে ধরা আছে। ১. "ঘুম থেকে উঠে দেখি/এক গুলিবিদ্ধ ভারতবর্ষ আমার উঠোনে"(ভোর-২)। ২. "আমি ধীরে ধীরে ইঁট কাঠ পাথর সরাই/ক্রমে হয়ে উঠি ভোরের গ্রামীণ গাছ"(ঘুণধরা কাচের গল্প)। ৩. "যারা আজ হলুদ বিকেলে ভিজবে/মুখোমুখি ছুঁড়ে দেবে বাংলা ভাষার চরম বিজ্ঞাপন/তাদের আমি চরৈবেতি শোনাবো" (অবগাহন)। ৪. "হে আমার অতীন্দ্রিয় ইচ্ছে, নেমে এসো/পৃথিবীর ঢালু পথ ধ'রে/নেমে এসো, শামুক গুগলি বিছানো পথে"(ইচ্ছের স্বপ্নেরা)। ৫. "আপনি শূন্যের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছেন আরেক/শূন্যের ভেতর"(শূন্য)।
#
পারস্পরিক এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাতদীর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার চরম ফলশ্রুতি, মানব মনের ওপর নিসর্গ প্রকৃতির সক্রিয় প্রতিক্রিয়া, নস্টালজিক অবহের নিবিড় সেমিওসিস, প্রেম তথা রোমান্সের প্রবহমান মাধুরী, নির্জনতার ঘনীভূত আবেশ, একাকিত্বের আনন্দ চেতনা ও একাকিত্ব জনিত বেদনা বিধুর ঔদাসীন্য, প্রকৃতির অন্তর্মুখে অন্তহীন হেঁটে যাওয়ার অবিরাম ইচ্ছা, সমগ্র সাংসারিক জগতকে মায়াময় চোখ দিয়ে দেখা, স্বপ্ন আর কঠিন বাস্তবকে মিশ্রণ ঘটানোর প্রয়াস, অতীন্দ্রিয় জগৎকে সাদামাটা গ্রামীণ জীবন প্রবণতায় নেমে আসতে বলা--- এসবই একেবারে অকৃত্রিম মানসিকতায় হাসতে হাসতে লিপিত
করা হয়েছে সুনেন্দু পাত্রর কবিতায়, অন্তত এই কাব্য গ্রন্থটিতে। সহজ মানুষের সহজ প্রাণের উচ্ছাস বেজে ওঠে তাঁর কবিতায় পরম চেতনায়। তিনি পরম চেতনাকে লিখছেন ঘরোয়া ভঙ্গির আলাপনে--- ১. "আজ অজস্র আলো নেমে এসেছে ঘাসের বার্নিশ করা উঠোনে"(ইচ্ছের স্বপ্নরা)। ২."ধীর পায়ে নেমে আসে তার টেরাকোটা মুখের আদল"(ঘুম ৪)। ৩. "আমি তো এখন শুধুই প্রিয়জনের ডাকবাক্স"(বৃষ্টি)।
#
প্রকৃতির খেলা কবির স্মৃতিকে উস্কানি দেয়, জাগায়। প্রকৃতির জাদু দেখে তাঁর আরও অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে প্রিয়জনকে। প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়মিত আদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন প্রিয়জনের ডাকবাক্স। তাঁর ইচ্ছা করে যাবতীয় প্রেমকে পাঁজরের পোস্টকার্ডে এঁকে রাখতে। কবিদের ইচ্ছেগুলো অদ্ভুত জগৎ প্রসঙ্গে যাবার প্রবণতায় ভরা থাকে। ইচ্ছেরও আবার স্বপ্ন হয়, সুনেন্দু জানালেন। তাঁর ইচ্ছের স্বপ্নেরা অনেক সময় শুকিয়ে নক্ষত্র হয়ে যায়। এই দেখার মধ্যে আছে কবির শিশুসুলভ সরল মনের প্রাচুর্য। একই সাথে সংহত কল্পনার পৃথিবী কবিতার বিভিন্ন স্তবকে ভাস্কর্যিত অবস্থায় পাওয়া যায়---১. "রোজ মিশে যাই আমি জামরঙা শব্দের আলিঙ্গনে/গোত্রহীন কৃষকের দলিত গন্ধে"(আমার কবিতা)। ২. "আমি তাকিয়ে অপলক, পাতার সঙ্গম নৃত্যে। সহস্রাব্দ/আর কোনো এক ভাঙাচোরা কবি/নিপুণ  মুগ্ধতায় আঁকতে থাকবেন বোহেমিয়ান শব্দের সিঁড়ি"(সৃষ্টি)। কবি লিখে চলেছেন চলমান সৌন্দর্যের অন্তহীন শিল্পসত্তা। স্মৃতিচিহ্নের পথে পথে তিনি খুঁজে পান ভাবনায় স্বতস্ফূর্তভাবে সম্প্রসারিত হয়ে থাকা কতো প্রকারের সৌন্দর্য--- "মাচার লাউগাছটা আমায় স্বাগত জানায়/বুঝিয়ে দেয়, পাশাপাশি এক হওয়া দুটি জীবন/কিভাবে এগিয়ে চলেছে অনন্তের দিকে"(ভয়)। নাগরিক মনের স্বাভাবিক যন্ত্রণা ব্যাপ্তি অর্জন করেছে সুনেন্দুর কবিতায়। প্রচুর মন খারাপের কথা আছে। আছে পারিবেশিক বিপর্যয়জনিত সংকট ভাবনা--- "এক একদিন এই যন্ত্রণায় ভিজতে ভিজতে/আমি নদীর ধারে আসি/দেখি এর চেয়ে ঢের বেশি যন্ত্রণা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে/আমাদের মৃতপ্রায় নদী; ঘুণধরা বিপন্ন সুন্দরবন"(প্রাণ)। কবিতাকে তিনি বলেছেন, প্রেমিকা--- "আমার ব্যক্তিগত কষ্টগুলো গায়ে মেখে/আবার ফিরে আসি আমার প্রেমিকা কবিতায়"(প্রাণ)। সুনেন্দুর কবিতার ভেতরে কতো অ্যালুশন ব্যবহৃত হয়েছে।  রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে ইঙ্গিতপ্রসারী স্থানের উল্লেখ কবিতায় গাম্ভীর্য সম্প্রসারিত করে। উপলব্ধি করা যায় কবির মননবিশ্ব কিভাবে কতোটা ভৌগলিক চেতনায় লালিত হয়েছে। বিশ্ব সংস্কৃতির মিলনবোধ কিভাবে আত্মীয়তায় পর্যবসিত হয়েছে তাঁর কবিতায় অনুভব করা যায়। তাঁর কবিতায় উল্লিখিত শুধু নয়, অঙ্কিত হয়েছে আব্রাহাম লিঙ্কন, লেনিন, আলেকজান্ডার, হ্যামিল্টন, কিউবা, গাজা, গোসাবা, আমাজন, ব্যাবিলন, বার্মিংহাম, ডুয়ার্সের বনঝোপ, প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, বসিরহাট, যশোর রোড, দার্জিলিং, অজন্তা ইলোরা প্রভৃতি। তিনি লক্ষ্য করেছেন দুঃস্থ ভারতবর্ষের গেরুয়া স্কেচ, শ্রাবস্তী নগরীর গেরুয়া কুঠুরি, অজন্তা ইলোরার রুগ্ন মানচিত্র। বরাক উপত্যকার শহীদের ছাই, দিশেহারা কাশ্মীর। তাঁর কবিতায় বিরামচিহ্নহীন একা একা কবির সামগ্রিক অনুভবের কথা, আত্মপর্যটনের  উন্মেষ পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে। 'কালপুরুষের ইস্তাহার' কবির প্রথম কাব্য প্রকাশ হিসেবে ভাষায় কিছুটা পিছুটান থাকলেও, ভাবনায় কোথাও পিছুটান রাখেননি কবি। ব্যথিত জীবনের আলেখ্য, আগামী জন্মের ভবিষ্যত, ক্ষীণ উৎসারিত আলোর মাঝে ইত্যাদি ভাষাগত ক্লিষ্টতা প্রথম গ্রন্থে থাকাই স্বাভাবিক। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ভেঙে গেলে যে রক্তপাতের উদ্বোধন শুরু, তার দেখে কবির বিষণ্ণতা প্রচ্ছন্ন থাকেনি। মনোবেদনা প্রকাশিত হয়েছে কবিতার নিজস্ব চলন সংহতিতে। বেদনা ও কান্না অনেকটা স্থান দখল করেছে কবির প্রকাশিত উপলব্ধিতে। বেদনাবিধুরতায় প্রক্ষুদ্ধ উপাদান তথ্য নয়, কবিতা হয়েই আছে অক্ষরে। আছে তরবারির পরাজয়ের কথা। তরবারি, সন্ত্রাসকে ইঙ্গিত করে। রক্তপাতের ইতিহাসকে উন্মীলিত করে। তরবারির পরাজয়ের শেষে আকাশের খোলা বারান্দায় বসে থাকার কথনবিশ্ব নির্মিত হয়েছে কবি সুনেন্দু পাত্র লিখিত  'কালপুরুষের ইস্তাহার' কবিতা গ্রন্থে।

1 টি মন্তব্য:

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...