অলিম্পিয়া বেনেট
ইমরান শ্বাহ
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ -বাসুদেব দাস
অলি বেনেটের এই ধরনের পরিণতি হবে বলে ভুলেও ভাবিনি। অলি বেনেটকে নিয়ে কখনও গল্প লিখতে বসব সেকথাও ভাবি নি। পৃথিবীর নিয়মের ঠেলা ধাক্কায় কিছু ভালোবাসা, কিছু স্বস্তি চাওয়া একজন সাধারন মাপের মহিলা বলেই ধরে নিয়েছিলাম অলি বেনেটকে। অলি বেনেটের শরীরে দুই-একটি বিশেষত্ব থাকলেও অলিবেনেটে বিশেষত্ব ছিল না। কিন্তু এখন যতই চিন্তা করছি অলি বেনেটকে ততই রহস্যময়ী বলে মনে হচ্ছে। না, অলি বেনেট সাধারণ নয় ।তাকে নিয়ে লিখতে বসে ভয় হচ্ছে ।এই আত্মগর্বী মানুষটার প্রতি আমি অন্যায় করতে যাচ্ছি না তো ? আমি কতটুকুই বা জানি অলি বেনেটের ফসিল হয়ে পড়া দ্বন্দ্বাক্রান্ত,কূহকাচ্ছন্ন ,নারী মনের কথা! এই সমস্ত ছোটখাটো সাংসারিক লেনদেনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অলি বেনেট নামে নারীর হয়তো যে প্রচ্ছন্ন মহীয়সীতা তা বুঝে ওঠার সময় এখন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে ।সুযোগ এসেছিল ,বোকার মতো সেই সুযোগ হারিয়েছি। কত কথাই শুনেছিলাম। নিজে জানার ,দেখার ,বোঝার সুযোগ পেয়েছিলাম। অলি বেনেট নামের একসময়ের শহরটির মনে ধরা নগর নারীর বিষয়ে। সব কথা আজ আর মনে নেই। মনে রাখার জন্য চেষ্টাও করা হল না। রোমন্থন করলে এই মানুষটির যে ছবি মনে পড়ে তা যেন অসম্পূর্ণ ,ছাড়া ছাড়া । কংকালটা রয়েছে, রঙগুলি বিস্মৃতির বৃষ্টি ধুয়ে নিয়েছে । অলি বেনেটের কথা লিখতে বসে আমার অবস্থা উপরে উপরে পড়ে গিয়ে পরীক্ষার হলে বসা পরীক্ষার্থীর মতো হয়েছে । বইয়ে সব রয়েছে বলে মনে পড়ছে অথচ কলমের ডগায় কিছুই আসছে না । কবিতার একটি পঙক্তি মনে পড়ছে ।এক একটি পংক্তি সারি ভুলে গেছি। যা লেখব তা হয়তো হয়ে উঠবে গাঁজাখুরি। নাম্বার পাওয়ার অযোগ্য । আমার তাস খেলার বন্ধুমহল অবশ্য অনেকদিন আগেই অলি বেনেটকে নিয়ে একটা গল্প লেখার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছিল। তার কারণও ছিল । তখন অলিবেনেট ছিল ছোট্ট শহরে ছোট ছেলে থেকে বড় পর্যন্ত সবারই আড্ডার এক নম্বরের আলোচনার বিষয় । অলি বেনেটের কথায় অনেক ঘন্টা অতিক্রান্ত হয়ে যায় । প্রধানত কলেজের যুবকদের কাছে। এরা অলি বেনেটের কাছে খুব বেশি প্রশ্রয় পায় নি। কেবল দেখেছিল অলি বেনেট এক রহস্যঘন আকর্ষণীয় জিনিস। পঞ্চান্ন বছরের বিশ্বেশ্বর হাকিমের সঙ্গে অলি বেনেটের কী সম্পর্ক,ত্রিশ বছরের আবেদালি অ্যাকাউন্টের সঙ্গে অলি বেনেটের কী সম্পর্ক, পিতৃহীন বিরাট অর্থের মালিক মুরুলির সঙ্গে অলি বেনেটের কিসের এত মাখামাখি ,এই ধরনের সম্পর্কের অজস্র মুখরোচক গল্প বাতাসে উড়ে এসে আমাদের আড্ডা গরম করে জমিয়ে তোলে। অলি বেনেটের সম্পর্কে যেকোনো গল্প তা সে যতই নিরর্থক হোক না কেন,বিনা তর্কে বিশ্বাস করে নেবার জন্য আমরা সবসময় প্রস্তুত। আমাদের কথা হল আড্ডায় জমে যাওয়া যেকোনো বিষয় হলেই হল ।গাঁজা মেনে না নিয়ে যুক্তিতর্কের অবতারণা করা হলে আড্ডার মেজাজ নষ্ট হয়।
আমি তখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি । এক ডজনের মতো গল্প লিখে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ করে রীতিমতো লেখক হয়ে বসেছি। আমার বন্ধু মহলে আর ও দুই তিন চার জন ছোটখাটো গল্পকার এবং কবি ছিল । তা সত্ত্বেও অলি বেনেটের গল্পটা লেখার জন্য সবাই আমাকে আনন্দের সঙ্গে স্বত্ব ছেড়ে দিয়েছিল। তার কারণ অলি বেনেটের সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে, পথে ঘাটে হেসে কথা বলা, একাধিকবার একই রিক্সায় উঠে যাওয়া স্বচক্ষে দেখা অনেককেই পাওয়া যাবে। ওরা ভেবেছিল অলি বেনেট সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানি । আমি স্বভাবত কম কথা বলি। কম কথা বলা মানুষ বেশি কথা জানে বলে ওদের ধারণা হয়েছে। আর একটা কথা । হয়তো অন্তত কয়েক জন ভেবেছিল, যা ভাবার জন্য ওদের উপরে আমার রাগ হয়েছিল, করুণা ও জন্মেছিল। সংকীর্ণ গণ্ডির কয়েকটি মাত্র কথা নিয়ে ব্যস্ত থাকা ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। মানুষের স্বভাবই এরকম। পথ দিয়ে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে একসঙ্গে হেঁটে গেলে ওদের মধ্যে কিছু না কিছু থাকতে পারে ভাবার আগে যে কথা আমরা সংখ্যাগুরু দল ভাবি সেটা কী তা না বললেও চলে। আর অলি বেনেটের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বসে -যাক সেই সমস্ত কথা।
জীবন থেকে ইতিমধ্যে কয়েকটি বছর খসে পড়েছে। চাকরিবাকরি করছি। সারা পৃথিবীর মনে এই একটি প্রশ্নই রয়েছে এবং সেই অবস্থায় পৌঁছেছি যদিও বিয়ে-সাদি করার নতো মনে এখনও সাহস জোগাতে পারিনি। প্রেম-বিয়ে জীবন ইত্যাদি বস্তুগুলির ধারণা বাস্তবের আঘাত পেতে পেতে দিনদিন পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। বেশি মধুর থেকে কম মধুর হয়ে এসেছে। ধূসর থেকে ধূসরতর । গল্প-টল্প লেখায় আজকাল আর খুব একটা প্রেরণা নাই। তখন লিখেছিলাম রাতকে দিন করার উচ্ছ্বাসে।এখন কখনও সাহিত্যের প্রতি থাকা একটা নৈতিক কর্তব্যবোধের তাগিদে ধরে বেঁধে কলম হাতে নিই। কেবল উচ্ছ্বাসের দ্বারা ভালো সাহিত্য তৈরি হয় না। উচ্ছ্বাস না থাকলে কলম চালিয়ে যাওয়াই কঠিন। সমস্যা অবসর ও নেই।একমাস ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিলাম, বহুদিন থেকে মনে মনে পরিকল্পনা করে থাকা একটা উপন্যাস লিখব বলে। আসার সময় ধরে-বেঁধে বিয়ে করিয়ে দেওয়ার ভয় বুকে নিয়ে উপন্যাস লেখা কঠিন দেখছি।এমনই একদিনে অলি বেনেটের সঙ্গে দেখা হল। অনেকদিন পরে।
পোর্টিকতে বসে উপন্যাসটার কথাই ভাবছিলাম। মনের মধ্যে হতাশার ভাব এসেছিল। ছুটিটা বোধহয় এমনিতেই যাবে। শেষ করা দূরের কথা উপন্যাসটা আরম্ভ করাই বোধহয় হয়ে উঠবে না। নিজের ওপরেই অকারণে রাগ হয়েছিল। অন্যের উপরে। অসমিয়া কিছু লেখক-পাঠক-প্রকাশক সমালোচক জোগাড় করে নিয়ে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছা করছিল। এমনিতে কেমন যেন অসহায় অসহায় বলে মনে হচ্ছিল। তখনই দেখি ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে অলি বেনেট।একদিনের সোনার বরণ হারিয়ে কিছুতেই বাধা না মানা চুল গুলি আর হাঁটার ধরণ থেকেই চিনতে পারলাম।
আগের মতোই ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। আগে অলি বেনেট রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে নতুন করে ভর্তি হওয়া পোষ না মানা মিলিটারির নির্ভীক বুকের মতো উন্নত জঙ্ঘা কাঞ্চনজঙ্ঘার উত্তুঙ্গতাকে নেচে নেচে অবজ্ঞা করে করে গিয়েছিল। এখন সেখানে কিছুই নেই। তার পরিবর্তে ঝক ঝকে দাঁত বের করে হাসছে। তন্বী বলে এক কথায় বলে দিতে পারা অলি বেনেটকে এখন খুব বেশি শুকনো বাঁশের বেড়া বলা যেতে পারে।আগের মতোই গাউন পরেছে যদিও তা রেশমের জন্য নয়, তেল চকচকের জন্য জ্বলজ্বল করা জীর্ণ এক বস্ত্র মাত্র। হাইহিলের জুতোয় এক ইঞ্চি ধুলো। এক পাটিতে ফিতা আছে ,অন্য পাটিতে নেই। আগে দেখলে হাতিদাঁত অথবা মোমবাতির কথা মনে পড়ে যাওয়া পায়ের গুলের স্বাস্থ্যহীনতা এবং যত্নহীনতার অজস্র আঁকবাঁক বিদ্যমান। অলি বেনেট অথবা আট নয় বছর আগের অলি বেনেটের ছায়া অলিবেনেট ভেতরে প্রবেশ করল।
আমি এক দৃষ্টে তাকিয়ে বসেছিলাম।
‘হ্যালো বিমান,তুমি কখন এলে,হোয়েন?-ও মাই ডার্লিং-হাউ লাভলি ইউ হ্যাভ গ্রোন!’
আর আমি কোথায় পালিয়ে বাঁচব? বুঝতেই পারলাম না। কী বিপদ!কী আক্রমণ!ছোঁ-মারা চিল পাখির মতো এসে অলি বেনেট আমাকে জড়িয়ে ধরল এবং পটাপট গালে মুখে এক কুড়ি চুমু খেয়ে ফেলল। কোনো দিনই দাঁত না মাজা মুখ থেকে বাজে গন্ধ বের হচ্ছে। কোনো দিন না ধোওয়া ,হয়তো না খোলাও ঘর্মাক্ত কাপড় চোপড় থেকে মদ মদ গন্ধ বের হচ্ছে। কোনো দিন না কাটা এই বড় বড় নখ যখিনীর মতো গায়ে বিঁধছে। বুঝ ঠেলা। সাত শ্ত্রুকে ঈশ্বর বাঁচিয়ে রাখুক।
সম্ভাষণের পর্ব শেষ হল। একথা সেকথার পরে ঘপ করে একবার অলি বেনেট আমার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, ওহো ছয় মাস। আচ্ছা ডার্লিং,এখনই আমাকে দশটা টাকা দাও তো। খুব দরকার।মিঃভূঞার গ্রেভে একটা ক্রুস পুঁততে হবে।আজ তার মুক্তির দিন।ডোন্ট মাইণ্ড।কাল পরশু ইউ উইল গেট ইট।কামিং জিন্টুজ মানি –‘মে বি টু-ডে’।…’
অনুরোধের চেয়ে হুকুমের পরিমাণ বেশি ছিল।অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।রকেটের দুনিয়ায় পরিবর্তনও এত বেগে হয় তা ভাবি নি। মাঝখানে আমি এই আট নয় বছর এদিকে-ওদিকে ছিলাম এবং তার সুযোগে মিঃভূঞা গ্রেভে। জিন্টু একেবারে টাকা পাঠানোর মতো হয়ে গেল।প্রহেলিকা প্রহেলিকা বলে মনে হচ্ছিল।কিন্তু এই মুহূর্তে আমি বেঁচে গেলেই হল।অলি বেনেটের চাহিদা পূরণ করে দিলাম।
মাকে যখন ঘটনাটা বললাম সামনেই বসে থাকা ভন্টি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠেছিল।আমার নিজেকে বোকা বোকা বলে মনে হচ্ছিল।যাই হোক মা এক ধমক দিয়ে ভন্টিকে দূরে পাঠিয়ে অলি বেনেটের কথা আমাকে বলেছিল।মা বলেছিল…কথাগুলি একটু আগে থেকেই শুরু করা যাক।
আমি যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি তখন অলি বেনেট পপুলারিটির চূড়ান্ত শিখরে।ছেলে থেকে বুড়ো পর্যন্ত সবার মুখে মুখে অলি বেনেট। পায়ে হেঁটে হাইহিলের জুতো পরে সর্বাঙ্গ দুলিয়ে দশটার সময় স্কুলে যায়।পথে দেখা হলে পরিচিত-অপরিচিত প্রত্যেকেই সুন্দর করে হাসি-‘কী খবর,ভালো?’-বলে কথা বলে যায়।নিজে চিনতে না পারলেও বোধহয় অলি বেনেট ধরে নেয় সবাই অলি বেনেটকে জানে। কথাটা সত্য। স্কুল থেকে ফিরে আসার সময় বেনেট সবসময় রিক্সায় আসে।এসেই বাড়িতে কী খেল কী না খেল সেজে গুজে আবার বেরিয়ে যায়। এক প্রহর রাত পর্যন্ত অলি বেনেট কোথায় যায়,কী করে সেই সমস্ত তত্ত্ব স্বয়ং ভগবানও জানে কী না সন্দেহ রয়েছে। রাতে বাড়ি প্রবেশ করার সময় জিন্টুর নাক ডাকে।আর নাক ডাকে স্কুলের চৌকিদার জিন্টুর বিকেলের রাখাল রঘুনাথের।একটা শিশুও জিন্টু চৌকিদারনীর তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছে বলা যেতে পারে।আর তারপরে মানুষের মুখে মুখে সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য হাজার গল্প রূপ লাভ করলে কাকে আর দোষ দেওয়া যেতে পারে।চাঁদের বুকে খরগোসের বসে থাকার কথা,স্বাতী নক্ষত্রের চোখের জলে মুক্তো হওয়ার কথা,সুন্দর সুন্দর কল্পনা করতে পারা দেশের মানুষ আমরা।আমাদের কল্পনা যখন লাগাম ছাড়া হয়ে নারী পুরুষের অবৈধতা,কেলেঙ্কারী,কথা কল্পনা করায় উঠেপড়ে লাগে তার দৌড় কতটা হয় সহজেই মনে করা যেতে পারে।কার সাধ্য রোধে তার গতি!আর অলি বেনেট নির্বিকার।
তখন আমার ডজন চারেক গল্প লেখা হয়ে গেছে।আমাদের ছোট শহরটিতে আমিই এক প্রকার শিয়াল রাজা।মাসিক,পাক্ষিক,সাপ্তাহিকে গল্প বেরিয়েছে।বিকেল চারটের সময় কলেজ থেকে গম্ভীর পদক্ষেপে একা একা বাড়ি ফিরে আসি। একা আসার কারণ ছিল। নির্জনতাকে ভালোবাসার চেয়েও অন্য কোনো একটা কারণ। আর কলেজ থেকে ফিরে আসার সময় প্রায়ই পথে অলি বেনেটের সঙ্গে দেখা হয়।পেছন থেকে রিক্সায় আমাকে পেছন ফেলে এগিয়ে যায়।কখনও ডাকে না।প্রায়ই ডাকে।আমার গল্প কোথাও বের হলেই ডাকে।‘-ওহো সুইট বিমান,তোমার গল্পটা পড়লাম।ওহো সুইট-কী নাম ছিল গল্পটার?-‘অলি বেনেট সব সময় আমার গল্প পড়ে আর সব সময় নামটা মনে থাকে না।
তারপরে একদিন।
কলেজ থেকে এসেছি।হঠাৎ একটা রিক্সা পেছন থেকে এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।অলি বেনেট!-‘কাম অন ডার্লিং বয়।’-আমার কোনো-‘চাই না আমি হেঁটে যাব।’আমার কথা না শুনে অলি বেনেট আমাকে রিক্সায় তুলে নিয়ে সোজা নিজের বাড়িতে গিয়ে হাজির হল।দুটো রুমের ছিমছাম বাড়ি। আসবাব পত্র বিশেষ নেই।বর্ণনা দেওয়ার চেয়ে না দিলেই অলি বেনেটের বাড়িটার বিষয়ে উচিত কথা বলা হবে মনে হয়।
‘আমি বিছানাটায় বসেছিলাম।আমার পাশে বসেছিল অলি বেনেট।কোনো প্রস্তাবনা ছাড়াই পেছন থেকে অলি বেনেট সাপের মতো মিহি দুটো হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল।অনতিবৃহৎ সুদৃঢ় স্তন যুগল আমার পিঠে যেন বিঁধে যাচ্ছিল।আমি ঘামছিলাম।অলি বেনেট খুব ধীরে ধীরে বলেছিল-‘একটা গল্প লিখবে বিমান।আমার গল্প।ইউ মাস্ট রাইট ইট,-অফকোর্স।’
বলার মতো কথা খুঁজতে গিয়ে আমি ইতস্তত করছিলাম।একটু দূরে সরে বসার জন্য চেষ্টা করে শরীরটা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করছিলাম। আমাকে ছেড়ে না দিয়ে অলি বেনেট বলেছিল-‘ইউনিক,একটা স্টোরি হবে জান? দেখায় আমি মেটার অফ ফ্যাক্ট হতে পারি। কিন্তু আসলে নয়।তোমাকে আমি সব কথা বলব। তোমাকে লিখতেই হবে।আজ নয়,অন্য একদিন নিরলে বসব কেমন। আজ তুমি চলে যাও।’
…বন্ধু মহলে খবর পৌছে গিয়েছিল। আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নবাণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলাম। অন্য কথার অবতারণা করে এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম। ফলে ওদের সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছিল। শেষে আমাদের তাসের আড্ডার স্পষ্টবাদী সভ্য রমেশ তাসজোড়া সাফল করতে করতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল , ‘ঠিক আছে,আমাদের বিমান ভাইয়ের হয়ে গেছে। যা ভাই,আমাদের কী? আমার একটা কথা খালি মনে রাখবি –সি উইল ডেভায়ার ইউ রাইট টু দি বোনস।অলি বেনেটের শরীরে নরখাদকের রক্ত আছে। এক নাম্বার মেন-হান্টার। এণ্ড,ইউ আর সফট এনাফ।’
কান মাথা লাল করে বসে থাকা ছাড়া আর কী করতে পারি আমি!
তারপর থেকে আমি অলি বেনেট থেকে পালিয়ে বেড়াতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বেশিদিন পারলাম না।একদিন পথে পাকড়াও করে অলি বেনেট আমাকে নিয়ে বাড়ি গেল। ভয়ে ভয়ে ইষ্ট নাম জপ করে আমি ভেজা বেড়ালের মতো বসে ছিলাম।আমার সামনে বসেছিল অলি বেনেট।আগুনের মতো যৌবনবতী যুবতি আমাকে জড়িয়ে ধরে নি। তুলনামূলক ভাবে কৃশকায় আমাকে বিছানায় টেনে নিয়ে যায়নি। অনেক সময় অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পরে অলি বেনেট সত্যিই আমাকে নিজের জীবনের কাহিনি বলেছিল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি বসে বসে শুনেছিলাম,কিন্তু ভয়ে ভয়ে।
আমরা বিসর্জন দেওয়ার জন্য নানা রকম রং মেখে প্রতিমা সাজাই। কে জানে এই অন্তরঙ্গতার পরিণতি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে কিনা? অলি বেনেটের কাহিনি বলছিলাম। ধীরে ধীরে রাতের বয়স বাড়ছিল। কখন পালাই ,কখন পালাই মনে হচ্ছিল। এত রাত পর্যন্ত অলি বেনেটের সঙ্গে কাটানোর পরে কে জানে আমার জীবনে সূর্যের আলো আগামীকাল সকালবেলা আগুন হয়ে আসবে না। কিন্তু হায় এখন ভাবছি, তখন কিছুটা মনোযোগ না দিয়ে কত টুকরো হীরে হারিয়ে ফেললাম!
'তোমার খুব ভয় হচ্ছে তাইনা? বুঝতে পারছি'- অলিবেনেট নির্লজ্জের মতো হাসছিল,- মানুষেই আমাকে ভয় করে। করবেই। এই যে মানুষগুলি আমার বদনাম করে- আই ডোন্ট কেয়ার এ ফিগ- জান? কখন ও দুঃখ হয়। ডিউ ড্রপের মতো নিষ্কলুষ একজন মানুষের সঙ্গে আমার বদনাম হলে আমার দুঃখ হয়। কী করবে !আমি নিরুপায় ।আর এই মানুষগুলি এত খারাপ, কেউ বুঝতে চায় না ।কেউ না ।সেইজন্যই নিজের কথা নিজের মধ্যেই রাখি ,কাউকে কিছু বলি না। তুমি হয়তো আমাকে বুঝতে পারবে ,এই ভুল আমি কেন করি।তোমার গল্প আমি পড়েছি ,আমি বুঝেছি অসহায় নারীর প্রতি তোমার কমপ্যাশন আছে। তুমি বুঝতে পারবে। তুমি আমার গল্পটা লেখ। লেখবেই। অন্তত আমার জন্যই তোমাকে ভালোবাসা। আয়না দেখতে আমার ভালো লাগে। কত ভালো লাগবে তোমার গল্পে আমার নিজেকে সজীব হয়ে উঠতে দেখে। আর ও ভালোভাবে হয়তো নিজেকে চিনতে পারব।…'
অপূর্ব !অদ্ভুত আর অপূর্ব! এই ধরনের আবেগ মাখানো ভাষায় এক নারী আত্মকাহিনি বলতে পারে। আমি জানি সেই অন্তর উজাড় করা ভাষায় আমি আজ আর লিখতে পারব না ।কোনোদিনই পারতাম না। আজও মনে আছে সেই আবেদন ।সেই মনের কথা উজার করে বলার এক আকূতি। ক্ষমা কর আমাকে অলি বেনেট - তোমার কাহিনি আমি আমার অক্ষম ভাষায় বলতে গিয়ে অক্ষমনীয় পাপ ও যদি করে ফেলি ।
মিঃভূঞার সঙ্গে অলি বেনেটের প্রথম যখন পরিচয় হয়, তখন বেনেট প্রথম বার্ষিকের ছাত্রী।চঞ্চল প্রজাপতি অলি বেনেট তখন অযুত রোমিও য়ের স্বপ্ন জুলিয়েট। কিন্তু অলি বেনেট মিঃ ভূঞার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে বুঝতে পারলেন প্রেম কেবল একটি কোমল শব্দই নয় । অলি বেনেট বুঝতে পারলেন এই পৃথিবীতে একমাত্র যুবক যার জন্য অজস্র জীবনের তপস্যা উৎসর্গ করে দেওয়া যেতে পারে । ফুলশয্যার রাতে এই যুবক অলি বেনেটকে বলতে পারবে,তোমার আমার প্রেমের গাথায় ফুলশয্যার রাতের খুব বড় কোনো মানে নেই জান অলি? কারণ-'
কারণ প্রেমের জন্য যে প্রেম তাতে বস্তুজীবনের কোনো মানে নেই। কারণ অলি বেনেটের জীবন বৃত্তান্ত শোনার পরে মিস্টার ভূঞা অলি বেনেটকে সহানুভূতিতে গলে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন-' তোমাকে আমি বিশ্বের চোখে মহান আসন দেব অলি। আমি দেখিয়ে দেব জন্মের চেয়ে প্রেম অন্তর অনেক বড়।' আর অলি বেনেট-তাকে যদি ভুল বলা যেতে পারে- ভুলটা করে ফেলেছিল। হাসতে হাসতে। সামান্য একটা কথা ভেবে লাভ ইজ এ বিউটিফুল থিং বাট ইট স্পয়েলস ক্যারেক্টার ।-দায়িত্বের কাছে আত্মসমর্পণ যদি চরিত্রহীনতা হয় তাহলে সেই চরিত্রহীনতাকে অলি বেনেট কপালে তিলক করে পরতে রাজি।
একটা কম বেশি পরিমাণে গতানুগতিক কাহিনি। উজান অসমের কোনো একটি চা বাগানের নাগা ক্রিশ্চান নার্স ছিলেন আলমলা রেংমা। খুব শীঘ্রই আলমলা সাহেব ডাক্তারের মেম হয়ে অলমলা বেনেট হয়ে পড়েছিল। সেই এক অনেক নারী করে আসা পুরোনো ভুলের চিহ্ন স্বরূপ পৃথিবীতে এসেছিল অলিম্পিয়া বেনেট এক রহস্যময় ভবিষ্যৎ সামনে নিয়ে। যথানিয়মে ডাক্তার সাহেব বেনেট দেশে ফিরে যাওয়ার পরে আলমলা বেনেট পুনরায় নার্সিং নিয়ে মেয়েকে বড় করার চিন্তায় জীবন নিয়োজিত করেছিল। লোকেরা বলে হয়তো খুব একটা মিথ্যা কথা নয় নার্স গিরি ছাড়াও আলামালা আরও অনেক কিছু করতেন। করতে হয়েছিল। বড় কথা নয়। আর আমার জন্য মেয়ের ভবিষ্যৎ অনেক বড় আর মেয়েটিকে কনভেন্টে রেখে পরিয়ে কলেজ অবধি নিয়ে যাবার জন্য একটা বিশাল খরচ। একজন নার্স কত টাকা বেতন পায়? অলি বেনেট যখন আইএ পাস করে তার ঠিক পরেই জিন্টুর জন্ম হয়। ভুতের ওপর দানোর মতো এই সময়ে আলামলার মৃত্যু হয়। তখন মিস্টার ভূঞা ছিলেন এই পৃথিবীতে জাত পাত নিয়ে আশ্ৰয় হীন। একটা প্রেসে চাকরি করে টিউশন করে পড়াশোনা চালাচ্ছিল। তার চেয়েও বড় কথা মিঃ ভূঞা ছিলেন ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সাংঘাতিক মেধাবী ছাত্র ।
দায়িত্বের জন্য জীবন উৎসর্গ করে মহৎ ত্যাগ আদর্শ গ্রহণ করার মধ্যেই তো দয়িতা নারীর প্রানের শান্তি। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এবং জারজ সন্তান জন্ম দেওয়ার কেলেঙ্কারিতে মিস্টার ভূঁইয়াকে সংশ্লিষ্ট করে মানুষের চোখে ছোট করে তুলতে অলি বেনেট রাজি হল না। মিস্টার ভূঞা যে অলি বেনেটের প্রাণের দেবতা। এখন নয়। এখন নয়। পরে আরও পরে। অর্থহীন এক উচ্ছ্বাস অলি বেনেটকে পেয়ে বসেছিল। কিছু একটা বড়, কিছু একটা দশজন মেয়ে করতে না পারা নিজেকে অসামান্য প্রেমিকা বীরাঙ্গনা বলে প্রতীয়মান করার লোভ হয়েছিল প্রেম বস্তু অন্ধ করে ফেলা এই মেয়েটির মনে।
মিস্টার ভূঞার ওপরে অনুরোধ, অনুযোগ নয় রীতিমতো হুকুম হল। তাকে পড়াশোনা চালু রাখতে হবে। আর খুব নাম করে বিএ তার পরে এম এ পাশ করতে হবে। এই সমস্ত প্রেস ট্রেস টিউশনি ফিউশনি আর চলবে না। খরচ? কিছু একটা হবে।
মিস্টার ভূঞা থার্ড ইয়ারে নাম লেখালেন। জিন্টুকে সঙ্গে নিয়ে অলি বেনেট সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি ছোট শহরে এলেন। একটি নবপ্রতিষ্ঠিত মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে । সেই সময় আইএ পাশ শিক্ষয়িত্রী পাওয়া কঠিন ছিল। নতুন স্কুল, খুব বেশি বেতন দিতে পারবে না । নিজের যোগ্যতা এবং কর্মদক্ষতায় অলি বেনেট চাকরিতে স্থায়ী হয়ে গেলেন । কিন্তু সত্তর আশি টাকায় কোনোমতেই সংসার চলে না। আরও টাকার প্রয়োজন। আর ও…
দুই তিনটা টিউশনি যোগাড় করে নিয়েছিল। কিন্তু আরও টাকা চাই। বাধ্য হয়ে অলি বেনেট আপাতদৃষ্টিতে কুৎসিত ,হয়তো হীন, একটা পন্থা বেছে নিলেন। অলি বেনেট বলেছিল…
' হীনতা সহ্য করা খুব কঠিন কথা, বিমান । কিন্তু আমার মনের দ্বন্দ্ব তোমাকে কীভাবে বোঝাবো? একদিকে প্রেম অন্য দিকে পৃথিবী। দুঃখীর পৃথিবীতে প্রেম বেঁচে থাকে না। লাভ নকস এট দী ডোর এণ্ড ফ্লাইজ বাই দী উইণ্ড এট দী সাইট অফ পভার্টি। মিস্টার ভূঞা বড়লোক হতে না পারলে আমাদের প্রেম সম্পূর্ণ হতে পারবে না। কোমল জিন্টু কষ্ট পাবে । বাধ্য হয়ে আমি মানুষের সঙ্গে খুব মেলামেশা করতে লাগলাম। এই শহরে এমন কোনো বাড়ি নেই এমন একজন বিভিন্ন বয়সের মানুষ নেই যার সঙ্গে আমি অন্তত মাসে এক ঘন্টা সময় কাটাই নি। এত নিচ এই মানুষগুলি। আমি কাছে গেলেই যেন সবাই তৎপর হয়ে উঠে। আমার মন পাওয়ার জন্য। মন অথবা দেহ। আমার জন্য যেন সবাই সাগর মন্থন করতে প্রস্তুত । এই কয়েক বছরে আমি কত বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, কত চক্রান্ত, কত প্রলোভন। মিস্টার ভূঞার প্রতি আমার ,আমার প্রতি মিঃ ভূঞার । ডিভাইন লাভের জোর যদি না থাকত তাহলে হয়তো আমি ইতিমধ্যে উড হেভ বিকাম এ রেগুলার প্রস্টিটিউট।'
খিলখিল করে পুনরায় নির্লজ্জের মতো হেসেছিল অলি বেনেট। তাহলে কীসের খোঁজে মানুষের পেছন পেছন ঘুরে বেড়াও তুমি?- জিজ্ঞেস করিনি যদিও সেটাই আমার প্রশ্ন হয়ে আমার ঠোঁটের ডগায় এসে থেমে গিয়েছিল। অলি বেনেট বলেছিল-‘ তুমি হয়তো দেখেছ ব্যাগটা আমার কত বিশাল। মানুষ ভুল বুঝে, এর মধ্যে কিছু থাকেনা। জান বিমান, ভাত আমি প্রায়ই খাইনা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভদ্রলোকের সঙ্গে মেলামেশা করে চা টা খেয়ে আমার পেট ভরে যায়। দেখতেই তো পাচ্ছ, আমি একটু সুবিধা পেলেই ব্যাগটিতে সবার অজান্তে নিমকিটা, আপেলটা ভরিয়ে নিই। সপ্তাহে দুই চার দিন কারও কারও বাড়িতে ভাতও জুটে যায়। জিন্টুর জন্য অল্প ভাত বানাই। আমার চলে যায়। ভাত খাবার সময় অতিথি এলে তুমি তো আর তাড়িয়ে দিতে পার না।‘
আমার লজ্জা লাগছিল। অলি বেনেট কিন্তু হাসতে হাসতে বলছিল । ‘আর তো বেশিদিন নেই । লেট মিস্টার ভূঞা কাম। আমাদের বিয়ে হবে। পুরো শহরটাকে খাওয়াব। ভূঞা চাকরি করবে আর সবাই জানতে পারবে হু ইজ জিন্টু ভূঞা।'
আশ্চর্য এবং বেশ প্রলোভনযুক্ত মনে হয়েছিল যদিও অলি বেনেটের গল্পটা তখন আর লেখা হল না। শেষের কাজটিতে অলিবেনেটের স্বার্থপরতাকে আমি সহজভাবে নিতে পারিনি। সেই জন্য। হয়তো আমার তাসের বন্ধু মহলকে ভয় পেয়েছিলাম। কী ঠিক, রমেশ সোজা সুজি বলে দিতে পারে এসব তোর উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা । আসলে তুই লস্ট আণ্ডার দেট সিলেকশন গাউন। আর রমেশ তো শুধু আমাকে বলেই ছেড়ে দেবে না । সেই জন্য।….
…. টাকা দশটা নিয়ে অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে অলি বেনেট চলে গিয়েছিল। মা তারপরে অলি বেনেটের তার পরের ঘটনাগুলি বলেছিল। শোনা কথা। খুব বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাছাড়া এই সমস্ত খবর তৈরি করা মানুষ আমি জানা খবরটুকু জানেনা । যাইহোক মায়ের বলা কাহিনীর সঙ্গে আমার মুক্ত কল্পনা যোগ দিলে অলি বেনেটের গল্পটা এই ধরনের হবে।
অনেক কষ্ট করে অর্জিত এবং অনেক হীনতা সহ্য করে পাঠানো অলি বেনেটের টাকায় মিস্টার ভূঞা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণি নিয়ে এমএ পাস করলেন । আনন্দে উল্লসিত হয়ে অলি বেনেট চিঠির পরে চিঠি দিয়ে যেতে লাগলেন । প্রথমে মিঃ ভূঞা উত্তর দিতেন ।-'আর কিছুদিন অপেক্ষা কর অলি। আমি এখানে একটি কলেজে চাকরি করছি। কিছু টাকা তো লাগবে । কিছুদিন অপেক্ষা কর । আমি আসছি।'
কিন্তু মিস্টার ভূঞা এল না। কোনো একটা তারিখ থেকে তার চিঠি কমে এল। তারপর কোনো একটি তারিখে বন্ধ হয়ে গেল। অলি বেনেটের অন্তর চমকে উঠলঃ' আমার জন্য নয়। অন্তত তুমি জিন্টুর জন্য একটু তাড়াতাড়ি কর। ওকে আর কতদিন তুমি জারজ করে রাখবে ?সে বড় হয়েছে ।বাবা কোথায় জিজ্ঞাসা করে।টাকার কথা তুমি ভেবনা।'
তারচেয়েও যদি মিঃভূঞা উত্তরে একটা বিষের বোতল দুটো প্রাণীর জন্য পাঠিয়ে দিতেন।মিঃ ভূঞা লিখলেন-' প্রেমে পড়ার ভুল একটা বয়সে মানুষ করেই থাকে। সেই ভুলকে খামচে ধরে থাকা মূর্খতা মাত্র। তোমার বংশগৌরব আমার চেয়ে তুমি বেশি ভালো করে জান। সেটা আমি ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু এটা? আমি এখানে থাকাকালীন তুমি সেখানে করা কীর্তিকলাপগুলিকে তুমি প্রত্যেকটাই মিথ্যা বলবে নাকি? টাকার কথা ভাবতে তুমি সহজেই মানা করে দিতে পার। দিনটা কাটানোর জন্য স্কুল আছে রাত কাটানোর জন্য ….। যাক সেইসব ভাবা ও পাপ । জিন্টুর কথা এত করে ভেবনা ।মা বাবার বিয়ে না হলেও সন্তানকে ফেলা যায়না তার প্রমান তো তুমিই। তা ভূঞাই লেখুক বা বেনেটই লেখুক আমার আপত্তি নেই। আমি তোমাকে বিয়ে করলে তোমার মাঝখানের এই অতীতটা মুছে ফেলা যাবে না। আমি চিৎকার করে করে জিন্টু আমার ছেলে বললেও পৃথিবীর মনে প্রশ্ন থেকেই যাবে। সত্যিই কি তাই? তুমি হয়তো শুনে সুখী হবে আমি এখানে আমার মতোই শিক্ষিত খুব উচ্চ বংশের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছি । আমার অতীতকে হাসতে হাসতে মেনে নিতে পারা মেয়ে। তোমার প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ থাকব। অনুগ্রহ করে জানাবে জিন্টু কত টাকা মাসে পেলে চলতে পারবে। তুমি ও...।'
আত্মহত্যা করাই উচিত ছিল যদিও এর পরেও অলি বেনেট বেঁচে থাকল। এখন অলি বেনেটের দিনরাত্রির চিন্তা হল জিন্টুকে মানুষ করে তোলা। এত বড় মানুষ যাতে পরবর্তী কালে তার আর পিতৃ পরিচয়ের কোনো দরকার না পড়ে। জিন্টুর পরিচয়ের কাছে যেন মিস্টার ভূঞার পরিচয় খর্ব হয়ে পড়ে। সে হবে এক প্রেম প্রত্যয়ের সন্তান। কোনো ব্যক্তি বিশেষের নয়। কত ক্ষুদ্র এই পরিচয় । কিছুটা লোভ, অল্প কামনার জন্য এই ব্যক্তি এক দেব শিশুকে ডেকে এনে অন্ধকার হিমের রাতে উঠোনে বের করে দিতে পারে কাঁদতে কাঁদতে ঠান্ডায় বরফ হয়ে যাবার জন্য । কত সংকীর্ণ এই পরিচয়।
অলি বেনেট আর একটি কথাও বলল না। চিঠি লিখল না। মিস্টার ভূঞাকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে চেষ্টা করে জিন্টুকে বুকের রক্তে মানুষ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নিরবচ্ছিন্ন সেই প্রচেষ্টার কথা বলে মা বলেছিল 'জিন্টুই ছিল অলি বেনেটের জীবন। মানুষটা ছেলেটির জন্য কী না করেছিল। এমন না হয়ে আর কী হবে!'
তারপর থেকেই অলি বেনেটের সেরকম হল। ক্লাস ফোর কী ফাইভে পড়ার সময় জিন্টুকে নিষ্ঠুর ভগবান অলি বেনেটের কাছ থেকে কেড়ে নিলেন। মৃত্যুর পরে এক সপ্তাহ অলি বেনেট বাড়ি থেকে বের হয়নি । তারপর বেরিয়ে এল।
আমার ভুল হতে পারে ।কিন্তু ভুল হলে সুস্থ থাকলে অলি বেনেট ক্ষমা করতেন বলে আমি জানি। আজকাল অলি টো টো করে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। পেলে খায়, না পেলে নেই। কাপড় চোপড়ের কোনো খবর নেই। জুতোর ফিতে নেই, কারও সঙ্গে দেখা হলেই জিন্টুর কথা বলে। কীভাবে এম এ তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। কীভাবে রিসার্চ করে ডক্টর হয়েছে। ডাকঘরে গিয়ে খবর করে বারবার চিঠি এবং মানি অর্ডার আছে কিনা । মিস্টার ভূঞা এখন কোথায় জানিনা। কখনও দেখা হলে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা আছে। জিন্টুকে নিজের অন্য এক চেতনার দেশে অলি বেনেট খুব বড় মানুষ করে তুলেছে,অলি বেনেট নামে একজন মাতা। মিঃভূঞার উপরে কোনো অভিযোগ নেই অলি বেনেট নামের একটি ছোট ক্ষীণাঙ্গী প্রেম সর্বস্বা নারীর। অন্য চেতনার দেশে অলি বেনেট কোনোদিন কাছে না আসা প্রেমিককে ভুল করে মৃত বলে ধরে নিয়ে তার কল্পিত প্রেমে এখনও প্রেমের ক্রুস পুঁতে। সব সময়। অলিম্পিয়া বেনেট নামে একজন প্রেমিকা।...
---------
লেখক পরিচিতি-অসমিয়া সাহিত্যের প্রসিদ্ধ গল্পকার,কবি, ঔপন্যাসিক ইমরান শ্বাহ ১৯৩৩ সনে শিবসাগরের ধাই আলিতে জন্মগ্রহণ করেন। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় ‘বনবাসী’ নামে কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে অপরিচিতা, ক্রান্তিরেখা ,জবানবন্দি, সাগরিকা,বর্ণালী, বনজ্যোৎস্না, আদি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।পথিক,প্রতিবিম্ব, পোড়া মাটির মালিতা,বন্দী বিহঙ্গম কান্দে, হয়তো বা দেবদাস, কুকুহা অন্যতম গল্প সংকলন। অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি ইমরান শ্বাহ অসম ভ্যালি লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড এবং পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত হন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন