বিদেহ নন্দিনী
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(ছয়)
আমি অযোধ্যার জনগণের মধ্যে বড় প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলাম। প্রজারা বলাবলি করছিল যে আমি নাকি সৃষ্টিকর্তা শ্রীরামচন্দ্রের জন্যই সৃজিত হয়েছিলাম। তাঁর সান্নিধ্যে আমি নাকি বিষ্ণুর ভার্যা লক্ষ্ণী দেবীর মতোই রূপে-গুণে অপূর্ব হয়ে পড়েছিলাম।
আমি শুরু থেকেই মনে করেছিলাম স্বামী রামচন্দ্রকেকে অযোধ্যাবাসী বা অন্য দেশের অতিথিরাও সাক্ষাৎ ভগবানের মতো দেখত। তাই আমি স্বামীতে মন প্রাণ দিয়ে একান্তচিত্তে তাকে অধ্যয়ন করছিলাম। সত্যিই আমার স্বামী বিন্দুমাত্র গর্ব ভাবনা না থাকা একজন অতি প্রিয়ভাষী ব্যক্তি। গুরুজন, বৃদ্ধ,বিদ্বান এবং ব্রাহ্মণদের প্রতি তাঁর অগাধ ভক্তি। প্রজা এবং দীন-দরিদ্রের প্রতিও বড় স্নেহশীল। অসত্য কথা রামের মুখ থেকে কখনও বের হত না। অস্ত্র এবং ধনুর্বিদ্যায় সেই সময় স্বামীর সমকক্ষ কেউ ছিলনা। সাহিত্য-শিল্প কল্প সংগীত ইত্যাদিতে তার যথেষ্ট নাম ছিল। সবচেয়ে বড় কথা সর্বগুণে বিভূষিত এই মহান ব্যক্তি প্রয়োজনে মনের ভাব গোপন করে রাখতে পারতেন। যদিও মনের ভাব গোপন করতে পারাটা একজন রাজকুমারের প্রয়োজনীয় গুণের মধ্যে পড়ে বলে আমি মনে করি না। প্রকৃতপক্ষে মনের প্রকৃতভাব লুকিয়ে রাখা ব্যক্তিকে আমি ভয় করতাম।
অযোধ্যার প্রজারা স্বামী রামকে রাজ সিংহাসনে বসানোর জন্য এবং আমাকে মহারানী হিসেবে পাবার জন্য খুব আশা করেছিল। শ্বশুর দশরথ ও স্বামী রামচন্দ্রকে রাজ্যভার অর্পণ করার দুর্বার আগ্রহ ছিল যদিও এই বিষয়ে কোনোদিন কারও সঙ্গে আলোচনা করেননি। অবশ্য সিংহাসনে না বসলেও রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বামী অংশগ্রহণ করতেন এবং রাজা দশরথকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করতেন। প্রশাসনিক কাজে ছেলের দক্ষতা দেখে রাজা দশরথ খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই পুত্রের বিচক্ষণতার কথা আমার সামনে প্রকাশ করতেন।
শরতকালের একটি বিকেলের কথা। আমি আমার প্রাসাদের সামনে থাকা বাগানের পদ্মার পাড়ে বসে রাজহাঁসের জলক্রীড়ার দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। ঠিক তখনই আমার ব্যক্তিগত সঙ্গী একজন এসে বলল-‘রাজা দশরথ আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য উদ্যানের দিকে আসতে চাইছেন।’ আমি পরে থাকা সাজ-পোশাক ঠিকঠাক করে তাকে আসতে বললাম। মনে মনে ভাবছিলাম-‘শ্বশুরের কী এমন জরুরী কথা আছে, যার জন্য তিনি আমার সঙ্গে উদ্যানে এসে দেখা করতে চাইছেন।’ তাই আমি আগ্রহের সঙ্গে তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। শশুরকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রণাম জানিয়ে বললাম-‘হে পিতৃদেব আপনাকে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য এত কষ্ট করে আসতে হল কেন? আমি নিজেই আপনার কাছে চলে যেতাম। আপনার যেকোনো আদেশ পালন করার জন্য আমি প্রস্তুত। কেবল আজ্ঞা করুন।’
রাজা দশরথ একটা সরল হাসি হেসে বললেন-‘সেরকম কোনো কথা নেই। আমিও সরোবরের পারে কিছুটা হাঁটব বলেই এলাম।’
শ্বশুর অঙ্গ রক্ষককে ইঙ্গিতে যেতে বললেন। আমি বুঝতে পারলাম তিনি কিছু একটা গোপন কথা আমাকে বলতে চাইছেন। আমি এবং রাজা দশরথ সরোবরের তীর ধরে হাটতে লাগলাম। তিনি দু'একটি কথা জিজ্ঞেস করে বললেন-‘বুঝতে পেরেছ জানকী, আমার জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রের মতো পুরুষসুলভ চেহারা, বল, সাহস, গভীর জ্ঞান, বিচক্ষণতা এই সমস্ত গুণ থাকা আর একজন ব্যক্তি এই ভারতবর্ষে নেই। আমি ইতিমধ্যে রামের হাতে রাজ্যভার তুলে দিতে চাই। এখন ভাবছি আর দেরি করব না, আমি বুড়ো হয়েছি। তাই খুব দ্রুত তার রাজ্যভিষেক পাতার জন্য মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবশ্য এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমি এই বিষয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করিনি। তাছাড়া বেশি আলোচনা করে থাকাটা ভালো হবে না বলে ভেবে তোমাকে মনের কথাটা বলতে এলাম।’
আমি শ্বশুর দশরথের কথার অর্থ ভালো করে বুঝতে পারলাম। তাই তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম –‘হে পিতৃদেব আপনি রাজসভা এবং পরিবারে ব্যক্ত না করা পর্যন্ত আমি এমনকি স্বামী রামের সঙ্গেও এই বিষয়ে কোনো কথা বলব না।’ তার পরে তিনি আরও দুটো ছোট খাটো কথা বলে আমার কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন।
তিনি চলে যাবার পরে আমি মনে মনে ভাবছিলাম শ্বশুর এত সাধারন কথাটা কেন আমাকে এভাবে বলতে গেলেন। তাছাড়া তিনি যেন ভেতরে ভেতরে কিছুটা অস্থির হয়ে পড়েছেন বলে আমার মনে হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম-‘একটা গতানুগতিক কাজ করার জন্য তিনি এত চিন্তা এবং গোপনীয়তা অবলম্বন করেছেন কেন? নাকি শ্বশুর ভেতরে ভেতরে কোনো অসুস্থতা অনুভব করছেন?’ সেই দুদিন পর্যন্ত আমি তার স্বাস্থ্যের খবর নিতে লাগলাম। অবশ্য পরে কর্মব্যস্ততায় আমি সে কথা ভুলে গিয়েছিলাম। শ্বশুর আমার সঙ্গে সরোবরের তীরে দেখা করার প্রায় কুড়ি পঁচিশ দিন পরের কথা। একদিন সকালবেলা আমার দেবর ভরত এসে উপস্থিত হল। এসেই আমাকে প্রণাম জানিয়ে বলল- বৌদি আমি আজ মামার বাড়িতে যাব। একেবারে বের হয়ে এসেছি। তাই আপনাকে প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিতে এলাম।
আমি অবাক হয়ে ভরতকে জিজ্ঞেস করলাম-‘হঠাৎ যাবার জন্য বের হয়েছ যে? আর কে যাবে?’ ঠিক তখনই শত্রুঘ্ন মাণ্ডবী এবং শ্রুতকীর্তিকে নিয়ে আমার কাছে উপস্থিত হল। তারাও আমাকে প্রণাম জানিয়ে পাশেই দাড়িয়ে রইল।
ভরত সেই পরিচিত সরল হাসিটা হেসে বলল-‘বৌদি মামারবাড়িতে বহুদিন ধরে যাইনি। আপনি তো জানেনই বিয়ের আগের দিন কোনো খবর না দিয়ে হঠাৎ মামা কেকয় রাজকুমার কীভাবে মিথিলায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি সেদিন প্রকৃতপক্ষে অযোধ্যায় এসেছিলেন। দাদু কেকয় রাজা আমাকে দেখার জন্য নাকি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাই মামা আমাকে নিতে এসেছিল। হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে তিনি একেবারে মিথিলায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তাই এখন এদের সঙ্গে নিয়ে এক পাক বেরিয়ে আসতে চাইছি। তখনই শত্রুঘ্ন বলল-‘আশীর্বাদ করুন বৌদি কুশলে যাতে ফিরে আসতে পারি।’
আমি বললাম-‘তোমাদের প্রতি আমার আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা সব সময়ই রয়েছে। তবে কতদিনের জন্য যাচ্ছ? তোমাদের ছাড়া রাজপ্রাসাদ একেবারেই ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।’
‘দিন কয়েক থাকব। এমনিতেই তো একবার যাবার ইচ্ছে ছিলই। তারমধ্যে পিতা দুদিন বেশি থেকে শহর-নগর ঘুরেফিরে নতুন কথা শিখে বুঝে আসতে বলেছেন। তাই এবার আর আমাদের পায় কে?’ হাসিমুখে ভরত বলল। আমি দুই হাতে চারজনকে আমার কাছে টেনে নিয়ে বললাম-‘তোমাদের মঙ্গল হোক। যাও বাছারা,কুশলে কুশলে ফিরে আস।’ তারপর ডান হাত ভরতের আর বাঁ হাত শত্রুঘ্নের বাহুতে রেখে বললাম-‘ যেখানে ভরত সেখানেই শত্রুঘ্ন। একজনকে ছেড়ে অন্য জন অসম্পূর্ণ। যেমন রাম লক্ষ্ণণ অভিন্ন। ওরা পুনরায় আমাকে প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিল। ভরতদের বিদায় দিয়ে আমি চুপ করে ভাবছিলাম-‘যদি শ্বশুর রাজা দশরথ স্বামী রামচন্দ্রের অভিষেক পাতার কথা মনে মনে ভেবেছেন, তাহলে ভরত শত্রুঘ্নকে কেন এত দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ওরা অভিষেক হয়ে যাওয়ার পরেও যেতে পারত।’ তবে আমার মনের কথা কারও সামনে ব্যক্ত করলাম না। মাত্র মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলাম যাতে তারা নিরাপদে গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন