রবিবার, ২৩ মে, ২০২১

খনি শ্রমিক এবং কার্লাইল ৷৷ হোমেন বরগোহাঞি ৷৷ মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস

 খনি শ্রমিক এবং কার্লাইল

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে  বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস


 


বেশিরভাগ শিক্ষিত অসমিয়া মানুষই বই আলোচনা পত্রিকা পড়াটা অদরকারি কাজ বলে ভাবে ।স্কুল-কলেজ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ইতি পড়ে ।দেশ যখন পরাধীন ছিল এবং বর্তমানের মতো বাধ্যতামূলক সার্বজনীন শিক্ষার প্রচলন ছিল না তখন দুঃখী গ্রামবাসী মানুষ পাঠশালায় ছেলেদের পাঠাত একটিমাত্র উদ্দেশ্যে। আর তা হল ছেলে যাতে নিজের নামটা সই করতে পারে এবং মাটির দলিল নিজে পড়তে পারে ।সেই যুগে অসমে পাঠশালা তথা প্রাথমিক স্কুল যত ছিল এখন কলেজের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। গ্রামে গ্রামে ,প্রতিটি অঞ্চলে কলেজ ।অর্থাৎ দেশে উচ্চ শিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে ।কিন্তু তা বলে মানুষ প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হয়েছে কি ?আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে গ্রামের চাষার ছেলে স্কুলে যেত নিজের নামটা সই করার উপযুক্ত হওয়ার জন্য এবং পাট্টা পড়তে সক্ষম হওয়ার জন্য। এখন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের  উচ্চতম ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষ ও ফাইলে নিজের নাম সই করা এবং ফাইল  পড়া ছাড়া অন্য কী কাজ করে ?শিক্ষিতের সংজ্ঞা অনুযায়ী যে মানুষ জীবন ধারণের জন্য যত চিন্তা করা প্রয়োজন তার চেয়ে স্বেচ্ছায় বেশি চিন্তা করে একমাত্র তাকেই শিক্ষিত মানুষ বলা যেতে পারে ।এই অর্থে আমাদের সমাজে কতজন মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত বলা যেতে পারে?

অথচ এ কথা আমাদের  গভীরভাবে উপলব্ধি করা উচিত যে পড়ার অভ্যাস না করলে আমরা আধুনিক জগতের তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব না ।পনেরো শতকে ছাপাখানার আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক যুগের সূচনা হল। ছাপাখানার আবিষ্কারের আগে জ্ঞান চর্চার সুযোগ সুবিধা সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের কয়েকজন মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে ।তখন একেকটি হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি এত দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য ছিল যে ইউরোপের খ্রিস্টীয় মঠের গ্রন্থাগার গুলিতে সেই ধরনের পান্ডুলিপি গুলি চুরির ভয়ে লোহার শিকল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হত। সাধারণ মানুষের জ্ঞান অর্জনের সুবিধা একেবারেই ছিল না বলেই তাদের নিজেদের মন বলে কোনো জিনিস ছিল না। ছাপাখানা রাতের ভেতরে অবস্থা একেবারে বদলে দিল। আগে অশেষ কষ্ট করে যে পুঁথি মাত্র দশ বারোটা কপি করা সম্ভব হত এখন ছাপাখানার সাহায্যে রাতের ভেতরে সেই পুঁথির লক্ষ-কোটি প্রতিলিপি করতে পারাটা সম্ভব হল। ব্যাপক উৎপাদনের ফলে গ্রন্থের দাম কম হল। আগে প্লেটো, এরিস্টটলের যে রচনাবলীর পাণ্ডুলিপি ছিল মহার্ঘ এবং মাত্র মুষ্টিমেয় মানুষের অধিগম্য এখন তা অত্যন্ত দুঃখী মানুষ ও মাত্র কয়েকটি টাকা খরচ করে সেই অমূল্য জ্ঞান ভান্ডারের মালিক হতে পারে। হেণ্ড্রিক উইলেম ভান লুনের  চিত্রময় ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়-'মুদ্রিত শব্দের সামনে মানবতাবাদ সমস্ত মানুষকে সমান এবং স্বাধীন করে তুলল ।'

ছাপাখানা গ্রন্থকে সুলভ করে তুলল বটে কিন্তু উনিশ শতক পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেনের মতো দেশেও এত দুঃখী মানুষ ছিল যে প্রাচীন পান্ডুলিপির তুলনায় এখন জলের দামে পাওয়া ছাপা বই কেনার জন্য তাদের আর্থিক সামর্থ্য  ছিল না ।অথচ তাদের জ্ঞানপিপাসা এত তীব্র ছিল যে দারিদ্র তাদের নিরুৎসাহ করতে পারেনি ।এই জ্ঞানপিপাসু মানুষগুলি কিন্তু প্রত্যেকেই তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্র শ্রেণির মানুষ ছিল না ।কয়লা খনির অন্ধকার পাতালে যে সমস্ত অল্প শিক্ষিত মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তারাও জ্ঞান এবং রসের তৃষ্ণায় বইয়ের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করত। কিন্তু যেহেতু বই কেনার মতো তাদের আর্থিক সামর্থ্য ছিলনা সেই জন্য তারা অন্যের বই ধার করে অশেষ কষ্টে সেই সমস্ত বই হাতে নকল করে নিত। এই ধরনের একজন খনিশ্রমিক একজন ঐতিহাসিককে বলেছিল -'আমরা খনির নিচে কাজ করার জন্য মাটির নিচে নেমে যাওয়ার সময় কার্লাইল কিংবা মিলের একটি বই পকেটেভরে নিয়ে যাই। যখন খাবার সময় হয় তখন খেতে খেতে আমরা বইটির দুটি পাতা পড়ে নিই।'

কথাটা গভীরভাবে ভেবে দেখুন ।একজন দরিদ্র, অল্পশিক্ষিত খনি- শ্রমিক ,তিনি কিন্তু খনির নিচে অবসর সময়ে পড়ার জন্য একটি লঘু উপন্যাস নিয়ে যেতে চাননি, তিনি পকেটে ভরে নিয়েছেন কার্লাইল এবং জন স্টুয়ার্ট মিল এর মতো লেখকের গুরুপাক ইতিহাস এবং রাজনৈতিক দর্শনের বই। সেই বইটি কখন পড়ছেন? খনির ভয়াবহ অন্ধকারে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মধ্যে দুপুরের আহার খাবার জন্য যে পনেরো মিনিট বা আধঘন্টা সময় পেয়েছেন সেই সময়। একজন শ্রমিকের জীবনে কঠোর জ্ঞানানুশীলন কী কাজে আসবে? সেই কাজে আসবে -যে কাজের দ্বারা মানুষ ইংরেজ জাতির মতো একটি সচ্চরিত্র বীর্যবান এবং বিশ্বজয়ী জাতি গড়ে তুলতে পারে। ইংল্যান্ডের খনি শ্রমিক শ্রেণির মধ্য থেকে কীভাবে এতগুলি প্রতিভাবান কবি সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদ বেরিয়ে এসেছেন সে কথা বোঝার জন্য এখন আর একটুও চেষ্টা করতে হবে না। যে জাতির অর্ধশিক্ষিত দরিদ্র খনিশ্রমিক বই কেনার জন্য টাকা নেই বলে বই না পড়ে থাকে না ,অন্যের বই হাতে নকল করে নিয়ে হলেও বই পড়ে ,দুপুরের আহার খাওয়ার সময়টুকু গল্প করার পরিবর্তে বই পড়ার জন্য ব্যবহার করে ,সেই জাতি বিশ্বজয় না করে আমরা অসমিয়ারা  করব-যে অসমিয়া সমাজের সম্পদ থাকা মানুষেরা বইয়ের জন্য টাকা খরচ করাটাকে  চরম অপচয় বলে ভাবে এবং ধন না থাকারা ধার করে হলেও দামি কাপড় চোপড় কেনে বা টিভি কেনে কিন্তু মরলেও বইপত্র কেনে না ?


লেখক পরিচিতি- ১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।  




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...