বিদেহ নন্দিনী~ ২১
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(একুশ)
আমার স্বামীর ওপরে ভেতরে ভেতরে রাগ হয়েছিল। বসবাসের উপযোগী জায়গার খোঁজে গভীর অরন্যের মধ্য দিয়ে যাবার জন্য। তবে তাকে বলার মত সুবিধা পাচ্ছিলাম না কারন আমার সঙ্গে কয়েকজন ঋষি-মুনিও এসেছিল। তারা সবাই সব সময় স্বামীর কাছে ছিল। তারা ঋষিদের মধ্যে প্রচার করেছে যে রামচন্দ্র দণ্ডকারণ্যের রাক্ষস নিপাত করে ঋষিদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে।
আমি যদিও নিজ হাতে পতি এবং দেবরের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলাম তার অর্থ এটা ছিল না যে আমি রাক্ষস নিধন করার জন্য উৎসাহ জুগিয়ে ছিলাম। আমরা গভীর অরণ্য দিয়ে যাত্রা করার সময় কেউ আক্রমণ করলে যাতে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের দিক থেকে আক্রমণ করা যেতে পারে তার জন্যই নিজ হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলাম। মনের মধ্যে খুব কষ্ট দিতে থাকা কথাগুলি বলে স্বামীকে সতর্ক করে দিতে না পারার জন্য সারাটা রাস্তা খুব অশান্তিতে কেটেছিল। একবার ঋষিরা কিছুটা পিছনে পড়ে যাওয়ায় স্বামীকে বললাম –‘হে নাথ, মানসিকভাবে কষ্ট দিতে থাকা কয়েকটি কথা আপনাকে বলতে চাইছি। দোষ হলে ক্ষমা করবেন।’
স্বামী সাহস দিয়ে বললেন-‘তুমি বিনাদ্বিধায় বলতে পার বৈদেহী।’
আমি স্পষ্টভাবে বললাম-‘ হে পরম পুরুষ আপনি অধর্ম কাজে কোনো দিন লিপ্ত হননি,অধর্ম আর পাপ কর্ম থেকে আপনি সবসময়ই দূরে। তবে দণ্ডকারণ্যে প্রবেশ করে আপনি অধর্ম কাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।’
আমার কথা শুনে স্বামী অবাক হওয়ার সঙ্গে কিছুটা ক্ষুন্ন হলেন বলে মনে হল। কিছুটা রূঢ়ভাবে বললেন-‘তুমি কি বলতে চাইছ জানকী আমি বুঝতে পারছি না। তোমার মনে আমাকে নিয়ে কি সন্দেহ হয়েছে আমাকে খোলাখুলি বল।’
আমি একই উত্তেজনার সঙ্গে বললাম-‘ হে স্বামী সাধারণত কামনা-বাসনা থেকে তিন ধরনের পাপ হতে পারে। সেই তিনটা হল মিথ্যাভাষণ, পরস্ত্রীগমন এবং শত্রুতা। প্রথম দুটি পাপ আপনাকে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারবে না। আপনার জিতেন্দ্রিয় রূপ আমার পরিচিত। কিন্তু আমি ভয় করছি তৃতীয় পাপটির কথা ভেবে। আপনি বিশেষ চিন্তা না করেই ঋষিদের কথা দিয়েছেন যে রাক্ষস নিধন করে এই অরণ্যে শান্তি স্থাপন করবেন। তাই আপনি গভীর থেকে গভীরতর অরণ্যের অভিমুখে এগিয়ে চলেছেন। হাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষের মন সহজেই উগ্র হয়।এভাবে চলতে থাকলে বনচারী রাক্ষসকে দেখে আপনি ওরা আক্রমণ না করলেও বাণ চালাবেন। শত্রুতা ভাব প্রকাশ না করলেও যদি রাক্ষস আপনার হাতে নিহত হয় সেটা কি উচিত কাজ হবে? বর্তমানে আমরা বনব্রতে রয়েছি, তাই বনভূমির ধর্মই কি আমাদের ধর্ম নয়? বনবাসী ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হল বিপদে পড়া জনকে সাহায্য করা। তাই স্বামী, আমার এই দণ্ডকারণ্য যাত্রা মোটেই ভালো লাগছে না। আপনার কোনো অনিষ্ট হবে ভেবে আমি এই কথা বলছি।দোষ হলে নিজ গুনে ক্ষমা করবেন এবং কথাগুলি ভালোভাবে ভেবে দেখ্লেযা ভালো মনে হয় তাই করবেন। কথাটা বলে আমার লজ্জা হল। মনে মনে ভাবলাম কার সামনে ধর্ম-অধর্মবিষয়ে কথা বলছি।
স্বামী আমার কথাবার্তা মন দিয়ে শুনছিল। তবে যে কয়টি উত্তর দিলেন শুনে আমার মনের মতো হল না। তিনি আমাকে বলেছিলেন বৈদেহী তোমার আমার প্রতি অপার স্নেহ প্রেম ভালোবাসা থাকার জন্যই এই চিন্তাগুলি মনে আসছে। তোমাকে আমি কী উত্তর দেব ভাবতেই পারিনি। তোমার প্রশ্নগুলির উত্তর গুলি দেখছি তুমি নিজেই দিচ্ছ। তুমি এইমাত্র বলছিলে না বনবাসে ক্ষত্রিয় ধর্ম হল বিপদগ্রস্তকে রক্ষা করা। তুমি তো নিজের কানে শুনেছিলে ঋষিরা আমাকে তাদের দুর্দশার কথা কীভাবে বলেছিল। তারা ফলমূল খেয়ে শুদ্ধচিত্তে কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন। কারও কোনোদিন অপকার করেনি।অথচ মায়াবী রাক্ষসেরা তাদের অত্যাচার করে বধ করে। ঋষি মুনিরা রাক্ষসদের ভস্ম করতে পারে কিন্তু তা করলে তাদের তপস্যার শক্তির নাশ হয়। কষ্টে অর্জন করা তপ শক্তি রাক্ষস নিধনে এভাবে ব্যয় করতে চায় না। প্রয়োজনে তাদের প্রাণই শেষ হোক। তাই তুমি বলতো এই পুণ্যাত্মাদের রাক্ষসের কবল থেকে উদ্ধার করা আমার কর্তব্য নয় কি? কর্তব্য করতে অপারগতা দেখিয়ে আমার ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা থাকবে কি? আসলে কি জান?এই ধর্মাত্মাদের আমি উপযাচক হয়েই সাহায্য করব বলা উচিত ছিল।তারা আমাকে বলতে আসাটা আমার জন্য লজ্জার। তুমি বলতে পারবে কি যে আমি তাদের রক্ষণাবেক্ষণ দেব বলে প্রতিজ্ঞা করাটা উচিত হয়নি। তাই সীতা মন থেকে দুশ্চিন্তা গুলি দূর করে ফেল। আমার কোনো বিপদ ঘটবে না।’
স্বামীর কথাগুলি যদিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আমার মনে উদয় হওয়া ভয় ভয় ভাবটা দূর হল না। অবশ্য আগের চেয়ে মন কিছুটা হালকা হল। এবার আমাদের অরণ্য অরণ্য গমনে আমার স্বামী লক্ষ্মণকে আমার পেছনে আসতে বলে তিনি নিজেই আমার আগে আগে যেতে শুরু করলেন। এভাবে এগিয়ে আমরা সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে এক বিশাল সরোবরে পৌঁছে গেলাম। সরোবরটি লাল সাদা পদ্ম সুশোভিত হয়েছিল। রাজহংস এবং নানা ধরনের পাখি সাঁতার কেটে সরোবরটির সৌন্দর্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছিল। বিশাল সরোবরটির এক কোণে একদল হাতি জলকেলি করছিল। আমরা সেই দৃশ্য উপভোগ করে থাকার সময় হঠাৎ মধুর সংগীতের সুর শুনতে পেলাম। সঙ্গে তাল মেলানো বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি। আমরা এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে কে সংগীত পরিবেশন করছে তা জানতে উৎসুক হয়ে পড়লাম। তখন আমাদের সঙ্গে থাকা মুনিদের একজন বললেন-‘রাঘব এর নাম পঞ্চস্পর।খরা বর্ষা সবসময় সরোবরটিতে জল উপচে পড়ে। তপশক্তির বলে মাণ্ডকার্নি নামে একজন ঋষি এই সরোবর সৃষ্টি করেছিলেন। ঋষি এই সরোবরের ভেতরে বাস করে মাত্র বায়ুর সেবন করে দশ হাজার বছর কঠোর তপস্যা করেছিলেন। মর্তলোকে মাণ্ডকার্নি ঋষির তপস্যা দেখে দেবতারা ভয় পেলেন। তারা ঋষির তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য স্বর্গ থেকে পাঁচজন অপ্সরা পাঠিয়ে দিলেন। পাঁচজন মিলে এভাবে সৌন্দর্য মেলে ধরলেন যে ঋষির তপস্যা ভঙ্গ হল এবং ঋষি পাঁচ জনকেই বিয়ে করলেন। এই সরোবরের জলরাশির নিচে মুনি নির্মাণ করে দেওয়া বাসগৃহে পাঁচজন বসবাস করে। আমরা যে সংগীত শুনতে পাচ্ছি তা হল সেই অপ্সরাদের নাচ এবং গীতের ধ্বনি।' আমরা মুনির কথা শুনে বিস্মিত হলাম।কিছুক্ষণ সরোবরের সৌন্দর্য উপভোগ করে পুনরায় হাঁটতে শুরু করলাম। সেই সরোবরের কিছুটা দূরে ছিল কয়েকটি আশ্রম। আশ্রমের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত মনোহর। প্রতিটি আশ্রমের ঋষিরা আমাদেরকে স্বাগত জানালেন।তারা নিজের নিজের আশ্রমে আমাদের নিমন্ত্রন করলেন। আমরা কয়েক মাস একটি আশ্রমে, বাকি কয়েকমাস অন্য একটি আশ্রমে,কয়েকবছর সেভাবে পার করলাম। আর একদিন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অগ্যস্ত মুনি আশ্রমের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। আমি তখন পর্যন্ত দেখা সমস্ত ঋষির মধ্যে অগ্যস্ত মুনি আমার অন্তরকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করেছিলেন। তিনি স্বামী কে বলেছিলেন-‘রাঘব, আমরা যে সমস্ত নারীকেই এক স্বভাবের বলে ভাবি প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তোমার পত্নী সীতাদেবী তার প্রমাণ। নারী সাধারণত সুখে থাকতে ভালোবাসে। দুঃখ কষ্ট হবে জানলে স্বামী বা প্রেমিক কাউকে ত্যাগ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। সে রকম ক্ষেত্রে রাজসুখের সঙ্গে অভ্যস্থ সীতাদেবী স্বামীর সঙ্গে দুঃখে সুখে থাকব বলে বনবাসে আসাটা খুব ছোটখাটো কথা নয়। তাই হে রাম তুমি সীতা এবং ভাই লক্ষণের যত্ন নেবে।’
আমরা কিছুদিন ঋষির আশ্রমে বাস করলাম। আমি জীবনে যতগুলি সহজ কথা শিখেছিলাম তার এক-তৃতীয়াংশই আহরণ করেছিলাম মুনি অগ্যস্থের কাছ থেকে। একদিন আমরা কথাবার্তা বলার সময় স্বামী জিজ্ঞেস করলেন-‘হে ঋষিশ্রেষ্ঠ আমরা বনবাসের শেষের দিন গুলি কোথায় কাটালে ভালো হবে?’ মুচকি হেসে ঋষি বললেন-‘তুমি তো এখানে আসার সময় আমার আশ্রমের থাকবে বলেই এসেছিলে। এখন কেন অন্য জায়গার কথা জিজ্ঞেস করছ?’ স্বামী কি বলবেন না বলবেন ভাবতে ভাবতেই ঋষি অগ্যস্ত নিজেই বললেন-‘আমি সব কিছুই বুঝতে পারছি। তুমি ঋষিদের উপরে অত্যাচার করা রাক্ষস নিধন করতে সংকল্প নিয়েছ। সেই জন্য তুমি আমার আশ্রমে থাকতে চাইছ না। কারণ এই আশ্রমে রাক্ষসেরা আসে না। তাই তোমরা পঞ্চবটী পর্যন্ত যাও। অত্যন্ত সুন্দর জায়গা। ফলমূল ও প্রচুর। বনে থাকা দলে দলে হরিণ এবং নানান রঙের পাখপাখালি মন প্রফুল্ল করে রাখবে। ঋষির কথা আমাদের আনন্দ দান করল এবং তার থেকে বিদায় নিতে প্রস্তুত হলাম। মুনি অগ্যস্ত স্বামীকে অক্ষয় তুনের একটি সোনা এবং হীরা বাঁধানো ধনু দেওয়া ছাড়া ও সোনার মুঠি এবং খাপের একটি তরোয়াল উপহার দিয়ে বললেন-‘হে রাঘব ভগবান বিষ্ণু এই ধনুর দ্বারা অসুর নিধন করেছিলেন। এই ধনু অক্ষয় তূণ এবং তরোয়াল তোমাকে অর্পণ করলাম। অত্যাচারী রাক্ষসের হাত থেকে ঋষিদের রক্ষা করার জন্য। আমি নিশ্চিত যে তুমি এই মহৎ কাজ সমাধা করতে পারবে।’
স্বামী পরম আনন্দিত মনে ঋষির কাছ থেকে সেই অস্ত্র গ্রহণ করলেন। তারপর আমরা তিনজন বিদায় নিয়ে পঞ্চবটী অভিমুখে যাত্রা করলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন