বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২১

বিদেহ নন্দিনী~ ২৩ || ডঃমালিনী || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস || Bideha Nandini - 23

 বিদেহ নন্দিনী~ ২৩

ডঃমালিনী 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস 



(২৩)

পঞ্চবটী বনে  আসার সময় স্বামী রামচন্দ্র রাক্ষস বধ করাটা উচিত হবে না বলে যদিও আমি যুক্তি দেখিয়েছিলাম এখন তিনি একাই জনস্থানের সমস্ত রাক্ষসকে নির্মূল করে ঋষিদের মহৎ উপকার করায় আনন্দিত হয়েছিলাম। দেবতাদের পুষ্পবৃষ্টি, সুবচন এবং মহর্ষিদের আশীর্বাদের পরে আমাদের মন গুলি পরিষ্কার হয়ে পড়েছিল। আমরা পুনরায় আনন্দের সঙ্গে পর্ণকুটিরে জীবন কাটাতে লাগলাম। কিছুদিন পরের কথা। একদিন আমি পূজার জন্য ফুল সংগ্রহ করতে গিয়ে এক অপরূপ সৌন্দর্যের সোনালী হরিণ দেখতে পেলাম।‌ সোনালি আবরণের উপরে রুপোলি রঙের চক্কর, উঁচু  কাঁধ। কানদুটি নীল পদ্মের রঙের। পা দুটি মনি দিয়ে বাঁধানো। শিঙে মূল্যবান পাথর ঝলমল করছিল। আমি হরিণটা দেখে খুব মুগ্ধ হলাম এবং তা পাবার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। আমি স্বামীকে চিৎকার করে বললাম-‘এদিকে দেখুন কী সুন্দর একটি হরিণ। আমার চিৎকার শুনে রাম লক্ষ্ণণ দুই ভাই কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন। দুজনেই অবাক হয়ে হরিণটর দিকে তাকালেন। লক্ষণ হরিণটার প্রতি বিন্দুমাত্র মোহ না দেখিয়ে সোজাসুজি বলল-‘দাদা আমার মনে হয় এটা  রূপধারী কোনো মায়াবী রাক্ষস। আশ্রমের মুনি-ঋষিরা যে বলেছিলেন এই বনে মারীচ নামের মায়াবী রাক্ষস হরিণের রূপ নিয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে  ভুলিয়ে হত্যা করার কথা। লক্ষ্ণণের কথা শুনে আমার রাগ হল।  প্রতিটি জীবকে রাক্ষস বলে ভাবা লক্ষ্ণণের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ভাইয়ের কথা যাতে স্বামী মেনে না নেয়  তার জন্য তাকে আমি অহরহ একই কথা  বলতে লাগলাম-‘হে স্বামী আপনি এই হরিণটা যেভাবেই হোক আমাকে ধরে এনে দিন। এত বছর আমি বনে কাটালাম এই ধরনের সুন্দর প্রাণী আগে কখনও দেখিনি। দেখুন কীভাবে আপন মনে আনন্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনি তাকে জীবন্ত ধরে আনুন। আমি তাকে পুষব। কথাটা বলে আমি স্বামীর মুখের দিকে তাকালাম। তিনি কিছু একটা বলার আগে আমি পুনরায় আরম্ভ করলাম  দেখুন আমাদের বনবাস শেষ হতে চলেছে ফিরে যাবার সময় বন থেকে কিছু একটা নিয়ে যাওয়া উচিত হবেনা কি ?আমি এই হরিণটা নিয়ে যাব। ভরতকে উপহার দেব। তিনি কত ভালোবাসবেন। একথা বলেই আমি পুনরায় দুই ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য তাদের মুখের দিকে তাকালাম। লক্ষণের মুখ দেখে বুঝলাম যে সে আমার কথা পছন্দ করেনি। তাই আমি তাকে কিছুই বলার সুবিধা না দিয়ে  পুনরায় স্বামীকে বললাম-‘ আপনি যদি  হরিণটাকে জীবন্ত ধরে দিতে না পারেন  তাহলে ওটাকে বধ করে চামড়াটা হলেও এনে দিন। আমি তার চামড়াটা  নিয়ে যাব। মনোরম চামড়াটার উপরে বসতে কত কোমল হবে।'

স্বামী কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে লক্ষণকে বললেন যদি তুমি বলা অনুসারে   হরিণটা  রাক্ষসের রূপ হয় তাহলেও ওটা বধ করা আবশ্যক । যদি সত্যিই হরিণ তাহলে তাকে জীবন্ত ধরে আনব। সীতা এত আশা করেছে। তাই তাকে হরিণটা ধরে এনে দেওয়া আমার কর্তব্য। স্বামীকে তীর-ধনুক নিয়ে হরিণ ধরার জন্য বেরোতে দেখে আমি আনন্দিত হয়ে পড়লাম। তিনি লক্ষণকে সাবধানে থাকার জন্য বলে এবং তিনি না ফিরে আসা পর্যন্ত আমাকে একা ফেলে কোথাও না যাবার জন্য আদেশ দিয়ে হরিণের পেছনে পেছনে দৌড়ে গেলেন। আমি আনন্দে আপ্লুত হয়ে  লক্ষণকে বলেছিলাম-‘তাকিয়ে থাক, কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার দাদা আমাকে সোনার হরিণ উপহার দেবে। কিন্তু লক্ষণ আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মৌন হয়ে বসে রইল। আমি স্বামী এই আসবে, এই আসবে বলে পথ চেয়ে থাকতে থাকতে অনেকক্ষণ সময়  পার হয়ে গেল। একটা সময় আমি অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। মনে নানারকম দুশ্চিন্তা আসতে লাগল। ঠিক তখনই একটা আর্তনাদ শুনতে পেলাম। স্বামীর চিৎকার হা সীতা, হা লক্ষণ আমি ভয় পেয়ে লক্ষণকে বললাম-‘তোমার দাদা কোনো বিপদে পড়েছে, তা নাহলে তিনি এভাবে চিৎকার করছেন কেন? না তুমি এখনই তার সাহায্যের  জন্য চলে যাও। কিন্তু লক্ষণ আমার কথায় বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে বলল বৌদি চিন্তা করনা দাদার কোনো বিপদ হয়নি। এটা মায়াবী রাক্ষসের  চিৎকার। আমাদের বিপথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে মায়াবী রাক্ষস এভাবে চিৎকার করছে। লক্ষণকে এভাবে স্থির হয়ে থাকতে দেখে আমার রাগ হয়েছিল। আমি কড়া কন্ঠে বললাম-‘ লক্ষণ দাদা বিপদে পড়ে আর্তনাদ করছে। তুমি তাকে বিপদে সাহায্য করতে যাচ্ছ না কেন? তুমি দাদার বিপদে পড়াটা চাইছ নাকি? লক্ষণ একই ভাবে উত্তর দিল দাদা আমাকে কুটির ছেড়ে যেতে মানা করেছে। তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনাকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে বলেছে। তাই আমার তার আদেশ অমান্য করা উচিত হবে না। লক্ষণের কথা শুনে আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাকে একা ফেলে রেখে লক্ষণ কোথাও যাবে না। তাই আমি এমন কিছু বাক্য বাণ প্রয়োগ করলাম যাতে ক্রোধিত লক্ষণ সেই জায়গা ত‍্যাগ করে তখনই দাদাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যায়। আমি তাকে বললাম, সৌমিত্র আমার বোঝার কিছু বাকি নেই। তুমি দাদাকে সাহায্য করার জন্য বনে এসে এখন তার শত্রু হয়ে পড়েছ। তোমার আচরণ আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তুমি দাদার অবিহনে আমাকে পাবে বলে ধরে নিয়েছ।  তাই তার অমঙ্গল ঘটাটা অন্তর থেকে কামনা করছ। না হলে দাদার আর্তনাদ শুনে কোনো ভাই এভাবে স্থির থাকতে পারে না।’ কথাটা বলে আমি কাঁদতে লাগলাম। 

 আমার কথা শুনে লক্ষণের সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। তারপরে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করল বৌদি আপনি অবান্তর চিন্তা করছেন। দাদাকে দেবতা, গন্ধর্ব, কিন্নর,দক্ষ, মানব-দানব, পশু- পাখি কেউ পরাস্ত করতে পারবে না। কিছুক্ষণ পরেই দাদা স্বর্ণমৃগ চামড়া নিয়ে আপনার কাছে ফিরে আসবে। যে চিৎকার আমরা শুনলাম প্রকৃতপক্ষে তা দাদার নয়। জনস্থানের রাক্ষস কুল নিপাত হয়েছে। যদিও বেঁচে থাকা দুই-একজন আমাদের কৌশলে অপকার করার চেষ্টা করবেই। কোনো রাক্ষস মায়া বলে দাদার কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে চিৎকার করেছে যাতে আমরা তিনজন তিন জায়গায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। তাই আপনি ধৈর্য ধরুন, খারাপ চিন্তা মনে জায়গা দেবেন না। লক্ষণের কথা আমাকে আরো ক্রোধিত করে তুলল। আমি উন্মাদিনীর মতো হয়ে পড়েছিলাম। মুখে উচ্চারণ না করার মতো কিছু কথা আমি  বললাম -'শত্রু লক্ষণ, তুমি নিষ্ঠুর, কপট এবং মহা ধূর্ত। মনের অভিপ্রায় এতদিন লুকিয়ে আমাদের সঙ্গে বনে এসেছ। জগতকে দেখালে ভ্রাতৃস্নেহ বলে, কিন্তু ভেতরে যে তোমার উদ্দেশ্য আলাদা ছিল তা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সুমিত্রানন্দন একথা ঠিক যে আমি শুধু শ্রীরামচন্দ্রের পত্নী। কামনার্তভাবে  অন্য পুরুষের দিকে তাকানো আমার প্রকৃতি নয়। স্বামীর কিছু ঘটলে এক মুহূর্ত বেঁচে থাকব না। হয় গোদাবরীতে ঝাপ দেব,না হয় গলায় ফাঁস লাগাব, না হয় পর্বতের চূড়া থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করব। তবু পরপুরুষকে আমার দেহ স্পর্শ করতে দেব না। আমার কথা শুনে লক্ষণ উঠে দাঁড়াল। সে বলল হে দেবী এ কথা শোনাও পাপ।আমার প্রতি আপনি যে বাক্যবাণ প্রয়োগ করলেন তা তপ্ত লৌহ শলাকার মতো আমার কাছে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে পড়েছে। দেবীতুল্য একজন মায়ের মুখে এই ধরনের কথা দুর্ভাগ্যজনক। এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই কারণ এটাই সংসারের সমস্ত নারীর স্বভাব। তারা স্বভাবত চঞ্চল নির্দয় এবং ঝগড়া প্রিয়। তারপরে লক্ষণ বনের পশু পাখি, গাছ, লতা, সবাইকে সাক্ষী করে বলেছিল হে মাতা আমার কথা শুনুন আমি সৎ মন, সৎ চিন্তা এবং সৎ পথে থেকে দাদার কর্তব্য পালন করছি। আপনি বিনাদোষে আমাকে অনেক কটু কথা শোনালেন। আমিও বুঝতে পেরেছি আপনার বুদ্ধিনাশ হয়েছে। আপনি নিজেই সর্বনাশ ডেকে আনছেন। আপনার ব্যবহার স্ত্রীজাতির অসৎ চিন্তাধারার পরিচয় হয়ে থাকবে। লক্ষণ আমার ব্যবহারের সঙ্গে  সমগ্র নারী জাতির আচরণ জড়ানোয় খারাপ পেয়েছিলাম। যদিও প্রতিবাদ করে কিছু বললাম না কারন তখন আমি স্বামীর চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম। লক্ষণ তীর দিয়ে পর্ণকুটিরের সামনে দাগ কেটে বলেছিল ঠিক আছে, আমি দাদার কাছে যাচ্ছি ।কিন্তু আমার মনে কিছু একটা অমঙ্গল ঘটবে যেন বলে মনে হচ্ছে। তাই মাতা আপনি এই রেখা অতিক্রম করবেন না। তারপরে লক্ষণ ক্রন্দনরত হয়ে  বলল হে দেবী হে মাতা আপনাকে পশুপাখির হাতে রেখে গেলাম। আপনাকে যেন তারাই রক্ষা করে. কথাটা বলে লক্ষণ দ্রুত বেরিয়ে গেল।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...