রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

পাখিদের পাড়া পড়শী ।। পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস ।। দ্বিতীয় অধ্যায়। । Pankaj Gobinda Medhi

 পাখিদের পাড়া পড়শী 

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস 



দ্বিতীয় অধ্যায় 


দুই


অরণ‍্য  অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় মানুষের সঙ্গে কথা বলতে জানে। রুশ দেশের ভাষা না জানা একজন মানুষ যেমন রুশ দেশের লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারেনা; তেমনই যারা অরণ‍্যের ভাষা বুঝতে পারো না, তারা অরণ‍্যের সঙ্গে একান্ত ভাবে কথা বলতে পারেনা। কিন্তু ভাষা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একমাত্র মাধ্যম নয়। অরণ‍্যের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।

আমি অরণ্যের ভাষা শেখার জন্য সুযোগ সুবিধা পেলেই অরণ্যের কাছে দৌড়ে যাই। অরণ‍্যের বুকে সন্তর্পনে হাঁটি। হাতে হাত ধরে কথা বলি। কথায় কথায় গুণগুণ করি।

দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে আমি অরণ্যের জন্য সময় বের করি। এখন অরণ্য আমার জীবন, আমার একমাত্র সংসার।

ভারতীয় স্টেট ব্যাংকের অত্যন্ত ব্যস্ততাপূর্ণ  চাকরি। সকাল নয়টাতেই কর্ম সংগ্রাম আরম্ভ করি এবং রাত ন'টায় কাজ শেষ করি। আমার কুড়ি বছরের চাকরি জীবনে আমি প্রতিদিন অত্যন্ত ব্যস্ত শাখাসমূহে চাকরি করে এসেছি। একই ধরনের দৈনন্দিনপঞ্জী। একই গতানুগতিক কাজ। কাজ করতে গিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি না। কাজের মধ্যে জীবনের সৌন্দর্য উপলব্ধি করি, সেজন্যই হয়তো। এভাবেই জীবনটাকে চালিয়ে নিতে শিখেছি। বছরের যে কয়েকটি দিন ছুটি হিসেবে লাভ করি সেই কয়েকটি দিন আমি অরণ্যের সঙ্গে নিবিড় ভাবে কাটাতে ইচ্ছা করি। অরণ্য আমার নিজস্ব পরিবার।

জীবনের এক কুড়ি আঠারোটা শীত আমি এভাবে পার করিনি।

প্রকৃতির মধ্যে বসন্তের প্রাচুর্য ঘটলেও আমার জীবনে কোনোকালে বসন্ত এল না।

তার জন্য আমার কোনো আক্ষেপ নেই। প্রত্যেকের জীবন এক রকম ভাবে অতিবাহিত হতে হবে এরকম কোনো কথা নেই।‌ আমার জীবনে বসন্ত আসেনি বলে এমন নয় যে কোকিলের ডাকে আমি অসুন্দর শুনি, গাছের কোমল কিশলয় আমি হলদে দেখি। চঞ্চল মাছের ডুব দিয়ে ভেসে  উঠাকে আমি  অস্পৃশ‍্য  বলে মনে করি। বাতাসে উড়তে থাকা ফুলের সুগন্ধ বিশ্রী বলে মনে হয়।‍

আমার জীবন সংক্রান্ত  কথা ভাবার জন্য   আমি বছরে মাত্র এক মাস সময় পাই। আমার কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে ছুটি কাটানো সময়টুকুতে আমি জীবন সম্পর্কীয় কথাগুলি চিন্তা করতে পারি। কিন্তু যখন থেকে অরণ্যের মধ্যে প্ৰবেশ শুরু করেছি  তখন থেকে আমি আবার অন্য ধরনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । তাই আমি আমার জীবনকে নিয়ে চিন্তা করার জন্য কোনো অবসরই পাচ্ছি না ।

আমার খুব ছোটবেলাতে আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। জানিনা আমার বয়স তখন কত।

মায়ের মুখের ছবিটা আমার মনে এখন ধূসর, ক্রমে ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে চলেছে। আসলে মায়ের মুখের কোনো  ছবিই আমার মানসপটে সঞ্চিত হয়ে থাকে নি। মায়ের একটি কাল্পনিক মুখঅংকন করে আমি আজও আমার মাকে ভালোবাসি । এরকম মনে হয় তিনি আমার কাছে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

– মায়েরা কেন যে অকালে মরে যায়? 

মিশনারি স্কুলের নিম্ন  শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার সহপাঠীদের মায়েদের  সন্তানদের স্কুলে  দিতে আসতে  দেখে আমার মায়ের কাল্পনিক মুখটি আমার বিষাদে পরিপূর্ণ বিমর্ষ মুখে নিয়ে আমি আমাকে প্রশ্ন করেছিলাম।

অন্য অনেক প্রশ্নের উত্তর না থাকার মতো সেই প্রশ্নের উত্তরও আমার কাছে ছিল না।

মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন এবং আমাকে দাদুর বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। আমাকে খ্রিষ্টান মিশনারি বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে রেখে দাদুরা নাকি বাবা পড়িয়েছিলেন সে কথাও আমি ভালোভাবে জানতে পারলাম না। আজও আমার কাছে সেকথা রহস্য হয়ে  রইল।বিদ্যালয় বন্ধের সময়ও আমাকে ছাত্রাবাসেই  থাকতে হয়েছিল।অনাথ শিশুদের জন্য বিদ্যালয় বন্ধের দিনেও ছাত্রাবাস খুলে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এবং সেই মতে আমাকে  অনাথ ছেলেদের সঙ্গে থাকতে  হয়েছিল। আমি অনাথ ছিলাম না, কিন্তু অনাথ হতে বাধ্য হয়েছিলাম। দাদু ঠাকুমারা সময়ে বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। কাকাদের  নিজের নিজের সংসার ছিল। তাদের সংসারের একজন সদস্য হওয়ার জন্য আমি কোনো কথায় অপারগ ছিলাম। একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর ও  নাকি মৃত্যু হয়েছিল। বাবা তৃতীয়বারের জন্য বিয়ে করেছিলেন। তারপরে আমি বাবার অবস্থিতির বিষয়ে কোনো কথাই জানতে পারিনি। বর্তমানকে সব সময় প্রাধান্য দেওয়া তার জন্য আমি বোধহয় অতীত হয়ে পড়েছিলাম এবং বাবা আমার কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে গিয়েছিলেন।  বাবার কাছে সেটাই বোধহয় বাধ্যবাধকতা ছিল। বাবার মনোজগতের কথা আমি আজও সে ভাবেই ভাবি। কিন্তু মায়ের কাল্পনিক মুখটা আমার মনে পরার মত বাবার মুখটা আমি মনে করতে পারছিলাম না। কেন এরকম হয়েছিল? বাবা আমার  জন্য চরম ত‍্যাগ  না করার জন্য! করতে না পারার জন্য। জানিনা। অন্য অনেক কথা না জানার মতো সে কথাও আমি জানতাম না।

আমার সম্পর্কীয় লোকের কাছ থেকে ভালোবাসা আদায় করতে না পারা আমি একজন সৌভাগ্যশালী ব্যক্তি। কোনোদিন আমাকে দুর্ভাগা বলে আমার কাছে প্রতিপন্ন করতে না শেখার জন্য চিনতে চাইলাম না । বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষয়িত্ৰীর  কাছ থেকে আমি স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছিলাম। তার কারণ ছিল। শ্রেণীর মধ্যে আমি একেবারে নির্বাক ধরনের ছাত্র ছিলাম। অন্য অনেক কথা শেখা থেকেই বঞ্চিত হওয়ার জন্য উৎপাত কীভাবে করতে হয় আমি সে কথাও শিখতে   চাইলাম না। সম্ভবত সেটাই আমার জীবনে পট পরিবর্তন করে ফেলল।

কখন  ও  তড়িৎ গতিতে এবং কখনও ধীরে ধীরে আমার ছাত্র জীবন অতিবাহিত হল। উচ্চতর মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই  আমি  অবতীর্ণ হওয়া ভারতীয় স্টেট ব্যাংকের ক্লারিকেল পোষ্টের পরীক্ষা আমার জন্য সফলতা নিয়ে এল। এই সফলতাই আমার জীবনটির একটি নাটকীয় মোড় দিল। অতি নাটকীয়তা আমার খুব একটা পছন্দ হল না। কিন্তু আমার উপায়হীন জীবনের ধারা পরিবর্তিত করতে চেয়ে আমি চাকরিতে যোগদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলাম। আমি পড়াশোনা করা বিদ্যালয়টির অবদান, শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের ইচ্ছাকে আমি অস্বীকার করতে পারলাম না, মোটেও চাইলাম না। 

তারপরে আরম্ভ হল  আমার অন্য এক জীবন।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...