পাখিদের পাড়া পড়শী - ৪
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
Pankaj Gobinda Medhi
(চার)
সকালবেলা খাওয়া দাওয়া করার পরে সৌম্যদা আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকা জায়গাটিতে জয়ন্ত দত্ত আমাকে নিয়ে এল।
বুড়িদিহিং নদীটির ওপর দিয়ে পার হয়ে কিছুদূর আঁকাবাঁকা পথে এসে আমরা জয়পুরে উপস্থিত হলাম। জয়পুর শহর নয়, একটি উন্নত গ্রামের বাজার-টাজার থাকা কেন্দ্রীয় অঞ্চল। নাহারকাটিয়া থেকে ছয় কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। জয়ন্ত আমাকে জয়পুর থেকে আরও পূব দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাঁর মোটরসাইকেলে মহা আরামে বসে চারপাশটা দেখতে দেখতে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে আমরা অরণ্য অঞ্চলে প্রবেশ করলাম।
দুজনেই মৌন।
সৌম্যদার কাছে গিয়ে না বসলে জয়ন্ত হয়তো আমাকে অরণ্যের বিষয়ে কিছুটা সম্যক জ্ঞান দিত। অরণ্যটির বিষয়ে আমার যে কথা জানার প্রয়োজন তা সৌম্যদাই জানাবে বলে জয়ন্ত ধরে নিয়েছে। তার মধ্যে আমি আবার সৌম্যদার অতিথি।
কিছুদুর যাবার পরে দূর থেকে দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে কোনো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম তিনি আর কেউ নন– আমার শ্রদ্ধার সৌম্যদা। যার জন্য আমার জীবনের এই পট পরিবর্তন।
সৌম্যদার কাছে আমাকে রেখে জয়ন্ত ফিরে গেল।
– আসার সময় রাস্তাঘাটে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি?
– না সৌম্যদা, কোনো অসুবিধা হয়নি ।
– খাওয়া-দাওয়ায়?
– না ,না। এই ধরনের সুস্বাদু খাদ্য আগে কোথাও খেয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না।
এটা নিশ্চয় ভালো নেতৃত্বের, ভালো লিডারের চিহ্ন। যে অন্যের খবর নেয়, অন্যেরাও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ।
সৌম্যদা এবং আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার পিঠে একটা রুকসেক। রুকসেকের ভেতরে আমার দৈনন্দিন ব্যবহার্য সমস্ত জিনিস নিয়ে এসেছি। সবকিছু। তাবলে রুট সেকের ভার বইতে পারব না তেমন কিছু নয়। কিছুটা কষ্ট হচ্ছে তবে চলে যাচ্ছে।
– অরণ্যে আসতে হলে যতটা সম্ভব কম জিনিস সঙ্গে আনা উচিত।
– না সৌম্যদা । বিশেষ কিছু নেই। না হলে চলে না এমন দুই একটি জিনিস আছে ।
– অরণ্যে তুমি কতদিন একনাগাড়ে থাকতে পারবে?
কথা বলতে বলতে গেলে পথ সংক্ষিপ্ত হয়, বহন করে আনা জিনিসের ওজন কমে।সৌম্যদা এই বুদ্ধিটাকেই কাজে লাগাচ্ছেন বলে মনে হল।
– আপনি যতদিন আমার সঙ্গে থাকবেন।
– টের পাবে চল, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। দেখতে না জানলে প্রতিদিন এখানে দেখতে পাওয়া সমস্ত কর্মকাণ্ডই একরকম বলে মনে হবে।
– আপনি তো দাদা দেখাবেন বলেই ডেকে–
আসা যাওয়ার রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের একটা শুকনো ডালে হোঁচট খেয়ে আমি ছিটকে পড়ে যাচ্ছিলাম।
– দেখে। দেখে। একটু সতর্ক হয়ে পথ চল।।
আমার অসচেতনতার জন্য আমি একটু লজ্জিত বোধ করলাম।সৌম্যদা কোনোরকম পরোয়া না করেই এগিয়ে যাচ্ছে। আমার মনের ভাবের পরিবর্তন করার জন্য সৌম্যদা বক্তব্য বিষয়ের পরিবর্তন ঘটালেন।
– এগুলি প্রাকৃতিক রাস্তা নয়, লগিং অপারেশনের রাস্তা। অতীতে ব্রিটিশ অরণ্যের অভ্যন্তরে কাটা গাছ আনা-নেওয়া করার জন্য ব্যবহার করা পথ। বহুদিন- বহু বছর ব্যবহার না করার ফলে পথ গুলি আগাছায় ঢেকে ফেলেছে যদিও আসা-যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
কিছুদূর হাঁটার পরে আমরা একটি নদীর তীরে উপস্থিত হলাম। নদীটা খুব বেশী বড় নয়। বর্ষার সময়েও জল কম থাকে। পাহাড় থেকে বয়ে আসা বলে নদীটি খুবই খরস্রোতা। নদীর বুকে থাকা পাথরে ধাক্কা খেয়ে জল কুলু কুলু সুরধ্বনি তুলেছে। এক উতলা সঙ্গীত।
সৌম্যদা বললেন–' এই নদীটির নাম নামচাং।
নতুন করে পরিচয় হওয়া কোনো লোকের চোখের সঙ্গে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে করমর্দন করার মতোই আমি দেখতে পাওয়া দূরত্ব পর্যন্ত নদীটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত আমার দৃষ্টি প্রসারিত করলাম।
আমি বললাম– সুন্দর নাম।
সৌম্যদা নদীতীরের একটু খোলামেলা জায়গায় ' 'টু মেন টেন্ট' লাগিয়েছে। এই তাঁবুর ভেতরে দুজন মানুষ অনায়াসে রাত কাটাতে পারে। সবুজ রঙের তাঁবুটা দেখতে অনেকটা একটি বসে থাকা কাছিমের মতো। আমি ত়াঁবুটার দিকে এগিয়ে গিয়ে আমার পিঠ থেকে রুকসেকটা নামিয়ে রাখলাম।
পিঠ থেকে পৃথিবীটা নামিয়ে রাখলাম বলে মনে হল।
সৌম্যদাকে ছেড়ে আমি নদীর ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। ছোট একটি পাথরের ওপরে বসে ডান হাতের অঞ্জলিতে নেওয়া জল চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলাম। জলটা বেশ ঠান্ডা। জলবিন্দু লেগে মুখটা কুঁচকে যাওয়ার মতো হল। তা সত্বেও হাত মুখ ধুয়ে সতেজ বলে মনে হল এবং অবসাদ দূর হয়ে গেছে বলে মনে হল।
পকেটে থাকা গামছাটা বের করে মুখ মুছতে মুছতে আমি সৌম্যদার কাছে পৌঁছে গেলাম।
– কী করবে? চল অরণ্যের ভেতরে যাই।
আমি অরণ্যের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। সৌম্যদার কথা শুনে আমার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল।
আমরা নদীর তীরে তীরে পাথরের অরণ্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলাম। কিছুদূর সেভাবে যেতে যেতে পাথরের অরণ্য ছেড়ে আমরা সবুজ অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করলাম ।
অরণ্যের মধ্যে নাহর ফুটেছে। নাহরের ফুলের গন্ধ আমার নাসিকা গহ্বরকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
চোখের সামনে সবুজের মহাসমারোহ। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই ভিন্ন প্রজাতির গাছপালা- তরু-তৃণ -বৃক্ষ । উঁচু উঁচু ঢেঁকিয়া, বন্য কলা, নানা রঙের কচু, দুই হাত প্রসারিত করে গোড়ার অর্ধেক পর্যন্ত হাত না পৌঁছানো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষ, শূন্যে ঝুলে থাকা– মায়াময় স্বর্গীয় পরিবেশ।
সৌম্যদার পেছনে পেছনে বোকার মতো আমি এগিয়ে চলেছি । জানিনা এই স্বপ্নপুরীর শেষ কোথায় ! কোথায় বাসর পেতে অপেক্ষা করে রয়েছে স্বপ্নের সবুজ রাজকুমারী । প্রতিটি গাছপালাতেই হয়তো রাজকুমারীর রাজপ্রাসাদ, তা না হলে প্রকৃতি এত অপূর্বভাবে প্রতিটি গাছপালাকে এত নিপুণতার সঙ্গে সাজাবে কেন ?
– বর্ষারণ্যের মধ্য দিয়ে হাটার মজাই আলাদা। বর্ষারণ্যে বছরে আশি ইঞ্চি বা তার চেয়ে অধিক পরিমাণে বৃষ্টি হয়। এখানে চারটি স্তরের উদ্ভিদ দেখা যায়। প্রথম স্তরটি হল 'হার্ব লেয়ার' বা ভূমি সংলগ্ন স্তর। তার ওপরের স্তর কয়টি যথাক্রমে ' 'আন্ডারস্টোরি লেয়ার' বা নিম্ন স্তর; 'কেনোপি লেয়ার' বা 'মধ্যস্তর ' এবং' ইমাজেন্ট লেয়ার বা 'শীর্ষ স্তর'।
আমি একান্ত মনে শুনে চলেছি।
দেখে! জোঁক আছে কিন্তু। একেবারে সাবধান হবে।
আমি পায়ের মাসলে অনেকক্ষণ থেকেই চুলকানি অনুভব করছিলাম। এতক্ষণে আমার চেতনা ফিরে এল। প্যান্টটা গুটিয়ে নিতেই একটা জোঁককে মহা-আনন্দে আমার শরীর থেকে রক্ত খেতে থাকা দেখতে পেয়েই একটানে জোঁকটা ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললাম। থেমে থাকার জন্য চারপাশ থেকে এক ঝাঁক জোঁক আমার দিকে তেড়ে এল।জোঁকের ঝাঁকটা দেখে আমার মনে হল, সেগুলি যেন জোঁক নয়, অজস্র লিলিপুট।
– বেরিয়ে এসো,বেরিয়ে এসো।
সৌম্যদা প্রায় দৌড়ে এসে যত দ্রুত সম্ভব অরণ্য অঞ্চল থেকে একটু খোলা জায়গায় আসার চেষ্টা করলেন। ফিরে এসে আমরা আবার নদীর তীর পেলাম। সৌম্যদা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় খুলতে লাগলেন।সৌম্যদার শরীরে কয়েকটি জোঁক।শরীরের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত একটা একটা করে জোঁকগুলি ছাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
–' তোমার শরীরেও আছে, দেখ।’
তখনই আমি পরে থাকা জামা এমনকি লংপ্যান্টটাও খুলে ফেললাম। আমার শরীরে সৌম্যদার শরীরে লেগে থাকার মতো অনেকগুলো জোঁক নেই । শুধু একটা লেগে আছে। সেটা ছাড়িয়ে দেওয়ার পরে ক্ষতস্থান থেকে প্রবল ধারায় রক্ত বের হতে লাগল। আমি সৌম্যদার দিকে তাকালাম।তাঁর দেহের কয়েক জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে ।সৌম্যদা মানিব্যাগ থেকে পেপার সাবান বের করে তখনই নদীর জলে নেমে গেলেন এবং সাবান দিয়ে ক্ষতস্থান গুলি ধুয়ে দিতে চেষ্টা করলেন।
আমি নদীর খাড়াইয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।
–জোঁক রক্ত খাবার পরে এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ ঢেলে দেয় ।
সৌম্যদা বললেন । প্রত্যুত্তরে আমি সৌম্যদাকে বললাম – সেটা হিপারিন বা হিরুডিন। এটা রক্তের জমাট বাঁধা বন্ধ করে দেয়।
– সেই জন্য সাবান দিয়ে ধুয়ে দিয়েছি। কিন্তু শরীর থেকে সাবান ধুয়ে দিতে অসুবিধা হবে।
– কেন সৌম্যদা?
– এই নদীর জল কঠিন, হার্ড ওয়াটার।জোঁকে খাওয়া স্থান থেকে হওয়া রক্তক্ষরণ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য আমি সাবান ঘষেছি। সাবান থেকে পরিত্রান পাবার জন্য আমাকে লালমাটি গায়ে ঘষতে হবে বলে মনে হচ্ছে।
সৌম্যদার এই ধরনের যন্ত্রণা দেখে অরণ্যের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র মোহভঙ্গ ঘটল না। ঠান্ডা জলে শিহরিত হয়ে থাকা সৌম্যদা , অরণ্যকে নতুন রূপে দেখার জন্য আমার সহায়ক হল। আমিও জলে নেমে গেলাম। পাহাড়িয়া খরস্রোতা নদীর সঙ্গে আমার পুরোনো পরিচয় নেই। সেই জন্য জলে বেশিক্ষণ না থেকে দ্রুত উঠে এলাম।
গা- মাথা- চুল শুকোনোর জন্য আমি আর সৌম্যদা মুখোমুখি ভাবে দুটো পাথরে বসলাম । পড়ন্ত বেলার সূর্যের আলো দুজনকেই ভাসিয়ে নিল।
– একটা কাজ করি চল। নদীর তীর ধরে হাটতে থাকি!
আমার আপত্তি করার মতো কিছু ছিল না। বরঞ্চ আমি খুশিই হলাম ।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে হাঁটার পরে আমরা নামচাং নদী এবং বুড়ি দিহিং নদীর সংযোগস্থলে পৌঁছে গেলাম। সেখানে একটি পাকা সেতু ।
এই সেতুটা পার হয়ে অরুণাচল যাওয়া যায় । দেওমালি নামে জায়গায় ।
আমি এবং সৌম্যদা সেতুর ওপরে উঠে দাঁড়ালাম। জায়গাটা সুন্দর। দেওমালি বোধ হয় আরও সুন্দর হবে। দেওমালি যাবার ইচ্ছা হল ।
সৌম্যদা কম সময়ের মধ্যে আমার মন বুঝতে পেরে গেলেন ।
– আমরা দেওমালি যাব।যদি তুমি তোমার ছুটি বাড়াতে পার।
– এখানে থাকার সুযোগ পেলে চাকরিটাই ছেড়ে দেব।
– না, চাকরি ছাড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে মাঝেমধ্যে এসো আর চাকরি করতে থাক।
ফিরে আসার পরে সৌম্যদা গতকাল জেলেদের নৌকায় করা নৌকা বিহারের কাহিনি বলতে শুরু করলেন।
– একটা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে তিনজন মাঝি বুড়িদিহিং নদীতে নৌকা বেয়ে যাচ্ছিল । আমি হাতের ইশারায় ডাকায় তারা কাছে চলে এল এবং আমাকে তাদের নৌকায় উঠিয়ে নিল। মাঝির নাম গেনিয়া। সঙ্গের একজন ধরিচান্দ এবং অন্যজন শংকর। শংকর গেনিয়ার ছেলে। বয়সে ছোট, তেরো বছর। ধরিচান্দের বয়স তিন কুড়ির কাছাকাছি। গেনিয়ার বয়স দুই কুড়ির বেশি।
সৌম্যদা কথাগুলি এভাবে বললেন আমার ভ্রমণ-কাহিনি পড়ে নিজেই ভ্রমণ করার মতো বলে মনে হল। সৌম্যদার বর্ণনারীতি অত্যন্ত মনোরম।সরল এবং প্রাঞ্জল।
– ওদের নৌকায় মাছ ধরা এবং একটি ছোট সংসারের সমস্ত উপকরণ রয়েছে। কটারি,দা,কড়াই,জাল,টাকুরি, দুটি থালা, সরষের তেলের টিন কেটে মাটি ভরে নিয়ে তৈরি করা উনুন,জলে ভেসে থাকা খড়ির টুকরো, তামাক, পুরোনো খবরের কাগজ– মাঝির নৌকায় গৃহস্থালির এই ক্ষুদ্র সংস্করণের মধ্যে আমরা চারটি প্রাণী। নৌকাটি থেকে মাছ এবং মাছ ডুবিয়ে রাখা জলের কাঁচা মাছের গন্ধ ভেসে আসছে। তাঁদের বুড়িদিহিং নদীতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা এবং ছোট ছোট জালে মাছ ধরতে দেখলাম। নৌকা তীরে লাগিয়ে অরণ্য থেকে বণ্য তেলাকচু,কৌপাত সংগ্রহ করতে দেখলাম। তেলা কচু দিয়ে রান্না করা মাছের তরকারি দিয়ে দুপুরের আহার ওদের সঙ্গেই উদরস্থ করে খুবই তৃপ্তি পেলাম।
সৌম্যদার মনে গতকালের তরকারির স্বাদ এতটাই ভালো লেগেছিল যে তিনি পুনরায় সে কথা স্মরণ করে তালুতে জিভ ঠেকিয়ে তৃপ্তির আওয়াজ তুললেন। তারপরে সৌম্যদা আরম্ভ করলেন গেনিয়া তাকে বলা একজন পিশাচিনীর কথা।
– গেনিয়া আমাকে বলে চলেছে পিশাচিনী মেয়েটির কথা– পেছন থেকে মেয়েটিকে দেখতে নাকি খুব সুন্দর, দীর্ঘ চুল, শরীরের গড়ন আঠারো উনিশ বছরের যুবতির মতো। মেয়েটিকে কেউ অনুসরণ করলে নামচাঙের কাদামাটিতে পুঁতে মেরে ফেলে। আর যদি মেয়েটিকে আপনি ডাকেন তাহলে আপনি তার বীভৎস মুখটা দেখতে পাবেন। কুচকুচে কালো, ঠোঁট নেই বলে বেরিয়ে আসা দুই পাটি দাঁত, ধবধবে দুটি সাদা চোখ, চোখের মনি নেই। তার মুখটা দেখার পরে আপনার জ্বর আসবে এবং আপনার মৃত্যু হবে। আমি এই সমস্ত বিশ্বাস করিনা। তবু আমার কেমন যেন একটা ভয় হতে লাগল। গত রাতে তাঁবুতে একাই ছিলাম। মেয়েটিকে দেখার আগ্রহে ঘুম এল না। মাঝেমধ্যে মাথা বের করে নদীর দিকে তাকাই।নেই, কোথাও নেই। কেবল ঝিল্লি এবং উচ্চিংড়ের শব্দ । হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভোর হয়ে এল।
– তার মানে সৌম্যদা গতরাতে আপনি পিশাচিনী মেয়েটির প্রেমে পড়লেন।
সৌম্যদা ঈষৎ এসে আমার দিকে তাকালেন।সৌম্যদা হয়তো আমার মুখটা পিশাচিনীর মতো দেখলেন।সৌম্যদা মুখটা কুঁচকে নেওয়ায় আমার সেরকমই মনে হল।
গেনিয়া এবং পিশাচিনী মেয়েটির কাহিনি সৌম্যদা আমার সামনে প্রায় এক ঘণ্টা সময় ধরে বর্ণনা করে থাকার জন্য আমাদের পথ অনেকটা সংক্ষিপ্ত হয়ে এল। আমরা নদীটি নির্দিষ্ট জায়গায় তৈরি করা তাঁবুটার কাছে পৌঁছে গেলাম। ক্লান্তি দূর করার জন্য দুজন দুটো পাথরের ওপরে বসলাম। পাথর দুটি ইতিমধ্যে আমাদের কাছে দুটো পিঁড়ি হয়ে উঠেছিল।
আমাদের ক্লান্ত লাগছিল। আকাশের চাঁদ রাতটা আমাদের পাহারা দেবার জন্য সেজেগুজে তৈরি হয়ে এসেছে। রাতের আহারের জন্য আমি কিছু খাবার পুঁটলি করে এনেছিলাম। আমার রুকসেকটা থেকে রাতের জন্য প্রয়োজনীয় দুই একটি জিনিসের সঙ্গে খাবার জিনিসটুকু বের করে নিলাম। সিদ্ধ করে আনা চাওমিনের একটি পুঁটলি সৌম্যদার দিকে এগিয়ে দিয়ে আমিও আমার পু়টলিটা খুলে চাওমিনটুকু বের করে নিলাম। দুই ঘন্টা ধরে একনাগারে হাঁটায় আমার বেশ ক্ষুধা পেয়েছিল। তাই চাওমিনটুকু গোগ্রাসে গিলে ফেলতে বেশি সময় লাগল না।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সৌম্যদা এবং আমি তাঁবুটিতে অনায়াসে ঢুকে পড়লাম। অরণ্যে এই প্রথম আমার রাত্রি যাপন। রাতের বেলা বেশি কথা না বলাই মঙ্গল জনক। সেই জন্য আমরা দু একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া কথা বললাম না।
– গুড নাইট।
– গুড নাইট।
দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
রাত কত হয়েছে আমি জানিনা। কোনো একটি বন্য জন্তুর আকুল চিৎকারে আমি জেগে গেলাম। হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালাম। রাত তিনটে বেজে পঞ্চাশ মিনিট ।সৌম্যদার দিকে উৎসুক ভরা দৃষ্টিতে তাকালাম।সৌম্যদা ও জেগে উঠেছেন। বন্যপ্রাণীটা তখনও থেমে থেমে চিৎকার করছিল। রাতের গভীরতার মধ্যে সেই চিৎকার অরণ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ।
– সম্বর
সৌম্যদা বলেছিলেন।
সম্বর হরিণ জাতীয় প্রাণী। আমার ভয় হচ্ছিল না। এরমধ্যে পাশে আবার সৌম্যদা রয়েছে। আমার চোখে পুনরায় ঘুম নেমে এল।
জানিনা কতটা বেলা হয়েছে।সৌম্যদা আমাকে ডাকতে লাগলেন। ঘুমের জড়তা কাটিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম সৌম্যদার চা বানানো শেষ। দুটো কাপে তিনি চা ঢালতে লাগলেন।আমি তখনই মুখ হাত ধুয়ে আমার নিত্যকর্মাদি শেষ করলাম।সৌম্যদা আমার চায়ের কাপটা বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে রেখেছে।দুটি বিস্কুট দিয়ে চা খেয়ে আমি সৌম্যদার সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলাম।
সৌম্যদার কাঁধে একটা ক্যামেরা এবং গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে একটা বাইনোকুলার।
আমি আমার ক্যামেরাটা এবং তিনশো মিমি জুম লেন্সটা নিয়েছি ।পাখির আলোকচিত্র সংগ্রহ করার জন্য আমার তিনশ মিমি জুম লেন্সের প্রয়োজন হবে। লেন্সটিতে স্টেবিলাইজার সংযোজিত হয়ে থাকার জন্য ট্রাইপড না নিলেও চলবে। আমার হাত খুব একটা কাঁপে না ।
সৌম্যদার পেছন পেছন এসে আমরা দুজনেই একটা পাকা রাস্তায় উঠলাম।
– এই রাস্তাটা জয়পুর থেকে এসেছে। কঁঠালগুড়িতে রাস্তাটা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ভাগ গিয়েছে অরুণাচলের খুনচা পর্যন্ত এবং অন্য ভাগটি গিয়েছে দেওমালি পর্যন্ত। আমরা এখন গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে জয়পুরের দিকে যাব।
ভোরবেলার মুখ ফুলিয়ে রাখা অরণ্য। ঝিল্লি এবং নানারকম পতঙ্গের তীব্র আওয়াজ। ওদের আওয়াজগুলি এমন ভাবে কানে এসে লাগছে যে অন্য কথা শোনার উপায় নেই।
– এই ঝিল্লি এবং পোকামাকড়ের শব্দের জন্য বর্ষারণ্যে পাখিদের পর্যবেক্ষণ করা একটি কঠিন কাজ। পাখির কণ্ঠস্বর না শুনলে চট করে পাখিকে সঠিকভাবে চিনতে পারা কঠিন । তাছাড়া ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাখিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তার কণ্ঠস্বর শোনা প্রয়োজন ।
আমি সৌম্যদার কাছ থেকে একান্ত মনে দীক্ষা গ্রহণ করে চলেছি । এক ঝাঁক পাখি আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে এসে আমাদের সামনে থাকা অশ্বত্থ গাছে বসল ।আমি পাখিটাকে চিনতে পারলাম না ।
– স্কারলেট মিনিভেট বা রূপসী পাখি। অশ্বত্থ গাছের ডালে কিছু ছোট ছোট পতঙ্গ বাসা বেঁধেছে।এরা বাসা ভেঙ্গে পতঙ্গের সংসার ভক্ষণ করবে।
সৌম্যদা বাইনোকুলারটা আমার হাতে তুলে দিলেন।
আমি একান্তমনে পাখিদের ঝাঁকটা এবং ওদের কাজকর্ম নিখুঁতভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম ।সৌম্যদা খালি চোখেই পাখিদের ঝাঁকটাকে লক্ষ্য করছিলেন ।
সৌম্যদাকে বাইনোকুলারটা ফিরিয়ে দিয়ে আমি এবার ক্যামেরার লেন্স দিয়ে পাখির ঝাঁকটাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম এবং রেঞ্জ মিলিয়ে দুই একটি পাখির আলোকচিত্র নিতে সক্ষম হলাম।সৌম্যদা এবার বাইনোকুলারটা দুই চোখে লাগিয়ে নিয়ে একান্ত মনে পাখির ঝাঁকটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। আগেও নিশ্চয় সৌম্যদা স্কারলেট মিনিভেট পাখি দেখেছেন, কিন্তু প্রতিবারই যেন পাখিগুলি নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হয়।সৌম্যদা সেই সুধা একান্তমনে পান করছেন।
আমরা এগিয়ে গেলাম। কিছুদূর এগিয়ে এসে আমরা একটা কাঁচা রাস্তা পেলাম। রাস্তার দু'পাশে ফুলের সমাহার।
–সৌম্যদা এসব কী ফুল?
– দোপাটি ফুলের মতো নয় কি? ইংরেজিতে বলে ওয়েস্টার্ন হিল বলচাম।
আমরা দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তা দিয়ে মানুষ অরণ্যে যাওয়া আসা করে। রাস্তাটা বেশ বড় সড়।সৌম্যদা এবং আমি রাস্তাটা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলাম। কিছুদূর এগিয়ে গিয়েই আমরা একটি ঝর্ণা দেখতে পেলাম। সুন্দর ছোট একটি ঝর্ণা। অতিশয় চঞ্চল।এ কি! ঝর্ণার তীরে প্রজাপতির বাগান। ফুটফুটে প্রজাপতি গুলি সেই বাগানে একান্ত মনে উড়ে বেড়াচ্ছে। একঝাঁক যদি মাটির এক ফুট দেড় ফুট উঁচুতে উড়ছে, অন্য ঝাঁক ঝর্ণার জলে ভেজা পাথরের ওপরে বসে পান স্পৃহা নিরসন করছে। পরিবেশটা আমার রূপকথার পরীর মনোরম বাগানের মতো মনে হল।
প্রজাপতির বাগানের পাশ দিয়ে আমরা দুজনেই উঁচু উঁচু হোলোং গাছের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম। যুগ যুগ ধরে এই গাছগুলি অরণ্যের শোভাবর্ধন করেছে তাই নয় অরণ্যকে অভয়ও প্রদান করে আসছে।
রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটা প্রকাণ্ড পাথরে আমরা দুজনেই বসলাম ।সৌম্যদা উঁকি দিয়ে কী দেখছে । এবার বাইনোকুলারটা চোখে লাগিয়ে নিয়েছে।আরেকবার নামিয়ে নিয়ে দেখছে ।
– ভেলভেট ফ্ৰন্টেড নাথোস ।
– মনে থাকবে না সৌম্যদা।
– তুমি আমার পাখি পর্যবেক্ষণের বইটা হাতের কাছে রাখবে ।
তখনই আমার মনে পড়ল রুকসেকে বইটা যেভাবে ঢুকিয়ে রাখা ছিল সেভাবেই থেকে গেছে।আনতে ভুলে গেছি ।
– বইটা আছে। রুকসেকেই থেকে গেল।
– কোনো অসুবিধা নেই। পাখি গুলির পরিচয় সেখানে দেওয়া আছে।
নীল রঙের ছোট পাখি। সেই পাখিটির দিকে আমরা স্থির ভাবে তাকিয়ে থাকায় এক জোড়া পাখি এসে গাছের গুড়িতে পড়ে চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। আমি আবার উৎসুক ভাবে সৌম্যদার দিকে তাকালাম।
– কাঠঠোকরা। এত ছোট কাঠঠোকরা আমি এর আগে দেখিনি। ইংরেজিতে বলা হয় হার্টস্পটেড উডকিপার।
পাখি দুটি ঘন অরণ্যের দিকে উড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা দুজনেই নিজের নিজের ধরনে পাখিগুলির সান্নিধ্যে প্রায় দশ মিনিট সময় অতিবাহিত করতে সক্ষম হলাম।
তারপরে আমরা পুনরায় সেই পথ দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
কিছুদূর এগিয়ে এসে আমরা পুনরায় নামচাং নদীর তীরে উপস্থিত হলাম। নদীর তীরে আমরা একটি ঝুপড়ি ঘর দেখতে পেলাম। ঘরটা দেখে মনে হয় তাতে মানুষ রয়েছে।সৌম্যদা উৎসুক ভাবে এগিয়ে গেলেন। ঘরটার সামনে এগিয়ে গিয়ে সৌম্যদা আওয়াজ দিতেই ভেতর থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে এল। মানুষটার সঙ্গে সৌম্যদা কী কথা বললেন আমি শুনতে পেলাম না। আমি কেবল নদীটি দিয়ে বয়ে যাওয়া জলরাশিতে চোখ রেখে ভাবে বিভোর হয়ে ছিলাম।সৌম্যদা যে কী সাহসে একা একা এই নদীর তীরে তীরে অরণ্যের মধ্যে বন্য প্রাণীকে বিন্দুমাত্র ভয় না করে ঘুরে বেড়াতে পারেন। তিনি কেন বিন্দুমাত্র নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন না। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়।সৌম্যদা ও বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। তিনি নিঃসঙ্গতার কাঁটা উপড়ে ফেলার জন্য হয়তো অরণ্যের এই নিঃসঙ্গতার মধ্যে ছুটে আসেন।
– মানুষটার নাম অনিল গগৈ। বন বিভাগের অস্থায়ী কর্মচারী।জায়গাটির নাম সুগরী পথার ।
মানুষটাকে বললাম একদিন পরে আমি এখানে আসব। তুমি যাওয়ার পরে আমি একা থাকার চেয়ে এখানেই থাকব বলে ভাবলাম। মানুষটাও আপত্তি করলেন না।
আমার এবং সৌম্যদার প্রত্যাবর্তন শুরু হল।পুনরায় একই পথে ফিরে এসে আমরা পাকা রাস্তাটা পেলাম। তখনই অরুণাচলের দিক থেকে একটা ট্রাক আসায় সৌম্যদা ট্রাকটাকে থামালেন। আমরা দুজনেই ট্রাকের পেছনে উঠে পড়লাম। কিছুদুর গিয়ে আমরা ট্রাক থেকে নেমে পুনরায় নামচাং নদীর তীরের টেন্ট হাউসে ফিরে এলাম।
আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল। সারাদিন এভাবে হাঁটার আমার অভ্যাস নেই । তাতে আবার পাহাড়িয়া নদীপথ । দৌড়াদৌড়ি করে গিয়ে আমি নদীতে একটা ডুব মেরে এলাম । আমার সমস্ত শরীর ঠান্ডা জলে কেটে নেওয়ার মত মনে হল।
সৌম্যদা রাতের বেলা খাবার জন্য মেগি রান্না করছে ।
খেয়েদেয়ে তাঁবুর মনোরম অস্থায়ী বিছানায় শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রা দেবী আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ।
সকালে যখন আমি এবং সৌম্যদা জেগে উঠলাম তখন সাতটা বেজে গেছে । সূর্য দেবতা মহা আয়াসে বাসর পেতেছে । আজ বেশি দূরে যাব না বলে আমরা রাতেই স্থির করে রেখেছিলাম।সৌম্যদা বুঝতে পেরেছেন এই মহাজনের শরীর একদিনের হাঁটাতেই অবশ ।
দৈনন্দিন কাজ করে চা-বিস্কুট সেবন করতে করতে ন'টা বাজল। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন কথার চর্চা ও চলতে থাকল।
– আজ আমরা বেশিদূর যাব না। কাছেই পাখি থাকার জায়গায় একটু ঘোরাফেরা করব।
আমি খুশি হলাম।শরীর কিছুটা অসহযোগ করছে বলে মনে হল।
ঘরোয়া জিনিসপত্রগুলি গুছিয়ে আমরা পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রস্তুত হয়ে বের হলাম। নামচাং নদীর তীর ধরে কিছু দুরে গিয়ে একটা কাশবন পেলাম।কাশবনের মধ্যে চরতে থাকা একটা নেউলের পরিবার দেখে ভালো লাগল। ওরা মনের আনন্দে গাছ থেকে খসে পড়া পাতার মধ্যে পোকা জাতীয় প্রাণীগুলি খুঁজে বেড়াচ্ছে। নেউলের দলকে দেখে কাছে থাকা কাঠবিড়ালি একটা চিৎকার করছে। নেউলের দলের সঙ্গে তার কোনো সহমর্মিতা নেই। কাঠবিড়ালির তীব্র চিৎকার শুনেই যেন সেখানে দুটি পাখি উপস্থিত হল।
– এই দুটি কী পাখি সৌম্যদা?
– এক ধরনের পেঁচা,হেয়ার ক্রেচটেড ড্রংগো।
পাখি দুটি নিজস্ব ভঙ্গিমায় বেশি শব্দ করে নেউলের দলকে অপমান করতে লাগল। ঠিক সেই সময়ে সেখানে উপস্থিত হল অন্য একটি পাখি।
-এটা?
এই পাখিটাও গাছের ডালে পরে অশান্তিকর ভাবে চিৎকার চেঁচামিচি করতে লাগল। তিনটির সম্মিলিত বাহিনীর হাতে নেউল বাহিনী রণে ভঙ্গ দিল এবং অরণ্যের মধ্যে কোথায় যেন চলে গেল ।
সৌম্যদা একান্ত ভাবে বিভোর হয়ে আছে। চিন্তায় নিমগ্ন। আমি তাকে অসুবিধা দিতে চাইলাম না ।
কিছুক্ষণ এভাবেই ভাবমগ্ন হয়ে থাকার পরে হঠাৎ দূরে সরে এসে সৌম্যদা আমাকে বললেন–চল।
–কী ভাবছিলেন সৌম্যদা।
– আর বল না। প্রকৃতির মধ্যে থাকলে আমি কখনও কখনও নিজেকে হারিয়ে ফেলি। কখনও নিজেকে হারিয়ে দেখ। নিযুত নিযুত বছর পুরোনো এই পৃথিবীতে আমরা কত তুচ্ছ বাসিন্দা। আমরা মরে যাব, গাছপালাগুলি থেকে যাবে। থেকে যাবে এই মনোমুগ্ধকর সুবিশাল অরণ্যভূমি। নিজেকে দুর্বল ভাবতে কার বা ইচ্ছে হয়। একদিন যে মরে যাব সে কথাও কেউ চট করে ভাবেনা । ভাবলে দেখতো কেমন লাগে।তবে আমি মরার কথা ভাবছি না। ভাবছি এই অরণ্য সমূহের সঙ্গে যাতে সারাজীবন নিবিড় ভাবে কাটাতে পারি।
– আপনি আমাকে অরণ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।সুন্দর পাখপাখালি, জীবজন্তু, গাছপালার সঙ্গে।সত্যি কথা বলতে গেলে আমি নতুন জীবন লাভ করেছি। কয়েক বছর আগে যদি আপনার সঙ্গে দেখা হত।
কোনো কথা নেই । এখনও তুমি সময় পেলে অরণ্যের কাছে চলে এসো । সবুজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে দেখ।
সৌম্যদা থামলেন। হাতের বাইনোকুলারটা দু চোখের সামনে তুলে ধরলেন ।
– ওটা রাজধনেশ,গ্ৰেইট হর্ণবিল।
সৌম্যদা বাইনোকুলারটা আমার হাতে তুলে দিয়ে পাখি দুটি দেখার জন্য সুবিধা করে দিলেন।
–ঐ যে পাখির ঝাঁকটা গাছের ডালে এসে বসেছে– সেগুলি পাহাড়ি ময়না। ধনেশ এবং ময়না পাখির ঝাঁক গাছের গুটি খেতে এসেছে।
পাখি দেখতে দেখতে কিছুদূর এগিয়ে যাবার পরে ঝোপের মধ্যে গুমগুম শব্দ শুনে আমরা দুজনেই থমকে দাঁড়ালাম। আমার কাছে একেবারে অপরিচিত শব্দ। সৌম্যদাও হয়তো শব্দটির উৎস বুঝতে পারছে না।
– এক ধরনের কবুতর,ইমারেল্ড ড'ভ।পুরুষ পাখিটা গুম গুম করে ডাকছে।
অরণ্যের মধ্যে সন্ধ্যে হওয়া পর্যন্ত আমরা দুজনেই এভাবে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ালাম ।সৌম্যদা চোখের সামনে পড়া সমস্ত পাখির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি একটা কথা ভেবে অবাক হই মানুষটা কীভাবে এতগুলি পাখির স্থানীয় নাম, ইংরেজি নাম এবং বৈজ্ঞানিক নাম মুখস্থ রেখেছেন।এই দুই দিনে আমি কেবল কয়েকটি পাখির ইংরেজি নাম মুখস্ত করতে সমর্থ হয়েছি।
ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে দিনটা কীভাবে অতিক্রান্ত হয়ে গেল আমি বুঝতেই পারলাম না। মাঝেমধ্যে ক্ষুধার ভাবটা জেগে উঠেছিল যদিও সামনের প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাকে এভাবে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল যে আমি পেটের ক্ষুধার প্রতি কোনোরকম গুরুত্ব আরোপ করিনি। আমার হাঁটার অনভ্যাসের জন্য পা দুটিও মাঝেমধ্যে অসহযোগ করছিল। আমি পা-দুটির অনাকাঙ্ক্ষিত আবদারকেও অবহেলা করলাম। তবে এখন নদীর তীরের পাথর দুটিতে বসে পা দুটি ঠান্ডা জলে ভিজিয়ে দেওয়ায় পাদুটি ব্যথায় ভেঙ্গে পড়ছে বলে মনে হল। চোখেমুখে জল ছিটিয়ে নিজেকে সতেজ করে তোলার চেষ্টা করলাম।সৌম্যদা ইতিমধ্যে অস্থায়ী উনুনে মেগি সিদ্ধ করতে শুরু করেছে।এ ধরনের যাত্রাকালে সহজলভ্য খাদ্য সম্ভার হল মেগি চাও চাও জাতীয় খাদ্য সমূহ। তৈরি করতেও সময় লাগে কম এবং ক্ষুধার সময় তা হয়ে উঠে পরমান্ন ।
সৌম্যদাকে বিদায় বিদায় জানাতে খুব মনোকষ্ট হচ্ছে। খাবারটা হাতে নিয়ে দেখতে পেলাম জয়ন্ত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দুলিয়াজান স্টেশনে সে আমাকে নামিয়ে দেওয়ার কথা। জয়ন্তকে দেখার পর থেকেই আমার মনোকষ্ট আরম্ভ হয়ে গেল। গত দুটিদিন সৌম্যদার সঙ্গে একসঙ্গে ঘুরেছি-বেড়িয়েছি, খেয়েছি- ঘুমিয়েছি।
সৌম্যদা জয়ন্তের দিকেও কিছুটা মেগি এগিয়ে দিলেন। সে খাবে না বলল।
আমাকে বিদায় জানিয়ে সৌম্যদা সুগরি পথারের অনিল গগৈ থাকা ঝুপড়িটিতে যাবে। রাতের অন্ধকার পৃথিবীতে নেমে আসতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি। আমি জানি না সৌম্যদা সেখানে কতদিন সবুজ এবং অরণ্যের সঙ্গে একসঙ্গে থাকবেন। তাকে জিজ্ঞেস করায় বললেন– আমিও জানিনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন