হে আমার স্বদেশ- ১৬
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(১৬)
বিয়ের অনুষ্ঠানটিকে একটি সাংস্কৃতিক উৎসব বলা যেতে পারে। এখন এই উৎসবের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যদি সাহিত্য-কলার সঙ্গে জড়িত থাকা ব্যক্তি হয়, তাহলে উৎসবটি একটি আলাদা মাত্রা লাভ করে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার শেষ হওয়ার পরে ঠাকুর বাড়ির 'সুশিক্ষিত- সুমার্জিত' তরুণরা একটি নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য উদ্যোগী হল। নাটকটি হল রবীন্দ্রনাথের 'মায়ার খেলা'। অন্দরমহলের প্রত্যেকেই সভা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে পরিবারের সদস্যরা নাটকটির অভিনেতা- অভিনেত্রী হবে। মঞ্চস্থ করা হবে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর থাকা বিজিতলার বাড়িতে। তাঁর অভিনয় যেমন প্রাণবন্ত, নাটক পরিচালনাতেও সেরকম অভিজ্ঞ। নাটকটিতে কে কী অভিনয় করবে ঠিক করে অভিনয়ের সঙ্গে তিনিই পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। মহিলা চরিত্র অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হল সত্যেন্দ্রনাথের বিদূষী কন্যা ইন্দিরা দেবী,' ভারতীর' সম্পাদিকা মহর্ষির কন্যা স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা ঘোষাল। আরও একজন মহিলা অভিনেত্রীর আবশ্যক হওয়ায় প্রজ্ঞার নাম উত্থাপিত হল। কিন্তু এখন প্রজ্ঞা বিবাহিতা। তাই তার জন্য উদ্যোক্তারা লক্ষ্মীনাথের অনুমতি চাইল। লক্ষ্মীনাথ সানন্দে অনুমতি দিল। কেবল অনুমতি দেওয়াই নয়,নাটকটির মঞ্চায়নের ব্যবস্থাপনায় লক্ষ্মীনাথ পূর্ণ সহযোগিতা করল। অভিনয় দেখার জন্য অভিজাত আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধবদের আমন্ত্রণ জানানো হল। তাদের উপস্থিতিতে নাটকটি সফলভাবে মঞ্চস্থ হল এবং প্রত্যেকেই উচ্চ প্রশংসা করে পরম সন্তোষের সঙ্গে আহারাদি করে বাড়ি ফিরে গেল ।
এভাবে কিছুদিনের মধ্যে ঠাকুরবাড়ির যুবকদের মধ্যে লক্ষ্মীনাথ একজন অন্যতম সদস্য হয়ে পড়ল। বিয়ের বহুদিন আগেই সুধীন্দ্রনাথ এবং বলেন্দ্রনাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের পরিচয় হয়েছিল। এখন তাদের বন্ধুদের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের মিত্রতা স্থাপিত হল। এদিকে সম্বন্ধী হিতেন্দ্রনাথ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ এবং ঋতেন্দ্রনাথের সঙ্গেও লক্ষ্মীনাথের বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। বিকেলের দিকে সবাই 'আড্ডা' দিতে লাগল।তাঁরা 'সুহৃদ সমিতি' নাম দিয়ে একটি সমিতি গঠন করল। উদ্দেশ্য, সভ্যদের মধ্যে সদ্ভাব- সম্প্রীতি বাড়ানো এবং সাহিত্য আলোচনা। এই সমিতির কার্য প্রণালীগুলিতে লক্ষ্মীনাথ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে লাগল। সভায় সদস্যরা নিজের নিজের রচনা পাঠ করে এবং বাকিরা মুক্তভাবে সেসবের সমালোচনা করে। কিছুদিনের মধ্যেই সমিতিটি জমে উঠল এবং এই সমিতি থেকেই জন্ম লাভ করল' সাধনা' নামের বাংলা মাসিক পত্রিকা। শুরুতে সম্পাদক হল সুধীন্দ্রনাথ। তিন মাস পরে সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের হাতে 'সাধনা' বঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাগজের আসন অধিকার করল।
লক্ষ্মীনাথ সমিতির প্রায় সমস্ত কার্যসূচিতে অংশগ্রহণ করে । সমিতির গৃহীত প্রস্তাব রুপায়ণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে আলোচনা সমালোচনায় যুক্তিপূর্ণ মতামত তুলে ধরে । সমিতির সদস্যরা সাহিত্যে তার জ্ঞান অনুরাগের আভাস পায় । স্বাভাবিকভাবে লক্ষ্মীনাথও বাংলায় লেখালেখি করুক – সমস্ত সদস্যরা কামনা করে । কিন্তু এখন, বিশেষ করে, বাংলা কবিতা লিখে সম্পাদকের কাছ থেকে অপমানসূচকপত্র পাওয়ার পর থেকে লক্ষ্ণীনাথ বাংলায় লেখার কোনো আকর্ষণ অনুভব করে না। এমনিতেও এই সন্দর্ভে হেমচন্দ্র বলা সেই কথাগুলি লক্ষ্মীনাথের চেতনা বোধে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে । বাংলা সাহিত্যের বিকাশ করার জন্য বাঙালি মনীষার অভাব নেই । অসমিয়া হয়ে অসমিয়া সাহিত্যের বিকাশ করাটাই হল তাঁর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব এবং কর্তব্য। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ নিজের এই সংকল্পের কথা'সুহৃদ সমিতি'র সদস্যদের সামনে ব্যক্ত করতে পারবেনা।
' দেখ লক্ষ্মীনাথ, তুমি শেলী, কীটস, বাইরণের কবিতার রসিক। সেক্সপীয়েরের নাটক তোমার প্রিয়। মাইকেলের 'মেঘনাদবধ' কাব্যের অনেক সর্গ তোমার মুখস্থ। তুমি আমাদের থেকে ভালো আবৃত্তি করতে পার। তুমি যে অধ্যয়নশীল আমরা তার ভুরি ভুরি প্রমাণ পেয়েছি। তুমি একজন ভালো সাহিত্য বোদ্ধা, সমালোচক। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে সুধীন্দ্রনাথ বলল,' তোমার এত গুণ, তুমি তো বাপু 'সাধনা'য় লিখতে পার।'
' ঠিকই বলেছ, সুধীন দাদা। বলেন্দ্রনাথ বলল,' কলকাতার বিদ্বৎ সমাজ ওকে আরও ভালোভাবে জানবে।'
লক্ষ্মীনাথকে উৎসাহ দেবার জন্য তাঁর মেজ সম্বন্ধী ক্ষিতীন্দ্রনাথ বলল,' হ্যাঁ লক্ষ্মীনাথ, তুমি শুরু কর। তোমার যা প্রতিভা দেখছি, একটু চেষ্টা করলেই এই বাংলার মাটিতে তুমি একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক হতে পারবে। সাহিত্যিক বোনের জামাই বলে আমরা তোমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারব।'
কিন্তু লক্ষ্মীনাথ নীরব। নিরুত্তর।
' লক্ষ্মীনাথ তুমি কিছু বলছ না! আমাদের পরামর্শটা পছন্দ হল না বুঝি? বলেন্দ্রনাথ বলল,' আচ্ছা, তুমি যে বাপু অসমিয়া ভাষায় লিখছ, উদয়াস্ত খেটে একখানা পত্রিকার সম্পাদনা করে ছাপাচ্ছ, তোমার ওই পত্রিকা কয়জন পড়ে বল তো? ওই পত্রিকার পাঠক হল আসাম থেকে কলকাতায় পড়তে আসা গুটিকয়েক' আসামী' ছাত্র আর আসামের কিছু শিক্ষিত ভদ্রলোক। আর পাঠক পাবেই বা কেমন করে বল– আসামে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা যে শূন্য শতাংশের কাছাকাছি। তুমি বাংলায় লিখলে আমাদের এই বাংলাদেশে তো কথাই নেই, সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিরাও তোমার লেখা পড়বে। এটা কি কম বড় কথা!'
' তাছাড়া, ওহে লক্ষ্মীনাথ–।' শক্তপোক্ত ঋতেন্দ্রনাথ এগিয়ে এসে বলল,' তুমি যে অসমিয়া ভাষায় লেখালেখি করছ, এই অসমিয়া ভাষাটা তো বাংলারই একটি উপভাষা।'
' মোটেই না।' সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ প্রতিবাদ করে উঠল,' আপনাদের এই ধারণাটা সত্যের উপরে আধারিত নয়।'
' আরে শোনই না–।' জোর দিয়ে ঋতেন্দ্রনাথ বলল,' এই যেমন পূর্ববঙ্গের রংপুর, শ্রীহট্ট, নোয়াখালি,চাঁটগা– আর এদিকের মানে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, শান্তিপুরের ভাষা… এগুলি কি সত্যিকারের শুদ্ধ- শালীন ভাষা? এগুলির যে একেবারে গুরু-চণ্ডালি দশা! এগুলি চাষা- ভুষোদের কথ্য ভাষা। তুমিই বল, এসব কথ্যভাষাকে কি মান্যতা দেওয়া যায়? এসব ভাষার কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে? এসব ভাষায় কি মহৎ কোনো সৃষ্টি সম্ভব?'
' না–না, তাই কি সম্ভব নাকি। কথ্য ভাষায় মহৎ সাহিত্যের উচ্চাঙ্গ ভাব প্রকাশ করা যায় না। ওই সব ভাষায় মানব অন্তরের ঐশ্বর্যময় অনুভূতি গুলি প্রকাশ করার মতো শব্দ নেই।'
কপাল কুঁচকে বলেন্দ্রনাথ বলল,' দেখ লক্ষীনাথ, তুমি বাপু খারাপ পেও না, তোমাদের ঐ 'আসামী' ভাষাটাও ঠিক তেমনই একটি আঞ্চলিক কথ্য ভাষা। সেজন্যই বলছি–।'
তাঁর কথা শেষ না হতেই সুহৃদ সমিতির অন্যতম সদস্য অমিয়ভূষণ বলল,' অসমিয়া সাহিত্যের জন্য বৃথা সময় ব্যয় না করে তুমি বাংলায় লিখতে শুরু কর। আসাম থেকে এলেও তুমি তো এখন কথাবার্তায় বারো আনা বাঙালি হয়ে গিয়েছ।'
' তারমানে আপনারা চাইছেন–।' অন্তরে অপমানের যন্ত্রণা নিয়ে মুচকি হেসে লক্ষ্মীনাথ বলল,' বাংলা সাহিত্যের চর্চা করে অচিরেই আমি ষোলো আনাই বাঙ্গালি হয়ে যাই।'
' হ্যাঁ, এইবার তুমি ঠিক বুঝেছ। আরে সেটা তো আমরা চাইবই,ভায়া। তুমি যে এখন আমাদের স্নেহের বোনের জামাই।' ছোট সম্বন্ধী ঋতেন্দ্রনাথ বলল,'ক্ষিতীন দাদা ঠিকই বলেছেন, বাংলায় লিখলে তুমি একটা বিশাল প্লেটফর্ম পাবে। দিকে দিকে তোমার নাম ছড়াবে,যশ ছড়াবে।'
নাম যশের প্রলোভন দেখিয়ে উৎসাহ দিলেও লক্ষ্মীনাথ ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হল। রাগও হল। উত্তর দিলেই বিতর্কের তুফান উঠবে। হয়তোবা আক্রমণ প্রতি আক্রমণে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। তাই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাবার জন্য সে বলল,' ঠিক আছে। ভেবে দেখব।'
' ভেবে দেখবে কী হে? তুমি লেগে যাও। তোমার সম্ভাবনা প্রচুর। কিছু ক্ষেত্রে তুমি তো আমাদের রবি কাকার মতো।'
'কী যে বলেন!' লক্ষ্মীনাথের কন্ঠে বিনয়ের সুর,' কার সঙ্গে কীসের তুলনা!'
এই আলোচনার দুদিন পরে লক্ষ্মীনাথ রবীন্দ্রনাথের সামনাসামনি হল।
বাইরের উন্মুক্ত বিশাল বারান্দার একটা আরাম চেয়ারে গা এলিয়ে রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন। ইতিপূর্বে কয়েকবার দেখাদেখি হলেও কখনও এরকম সাক্ষাৎ হয়নি। বাইরে থেকে গেট দিয়ে লক্ষ্মীনাথকে ভেতরে আসতে দেখেই আরাম চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে কাব্য ভাবনায় বিভোর রবীন্দ্রনাথ সাদরে তাকে ডাকলেন। ঘন কৃষ্ণ দাড়ি এবং কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা দীর্ঘ চুলের অনিন্দ্য সুন্দর চেহারা। প্রশস্ত কপাল। ভুরুর নিচে দীপ্ত চোখ জোড়া। পাশের ছোট টেবিলে কাগজ-কলম ইত্যাদি লেখার সরঞ্জাম। বাঁ পাশের অন্য একটি ছোট টেবিলে ইংরেজি সাহিত্যের বই। লক্ষ্মীনাথের আপাদমস্তক লক্ষ্য করে পাশের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে স্নেহের সঙ্গে বসতে বললেন।
লক্ষ্মীনাথ সসঙ্কোচে বসল।
আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের যে সমস্ত কবিতার বই বেরিয়েছে, সে সবের অধিকাংশই লক্ষ্মীনাথ পাঠ করেছে। খুবই কম বয়সে রবীন্দ্রনাথ রচনা করা' ভানুসিংহের পদাবলী'র বৈষ্ণব ভাব রস,' প্রভাত সংগীত'এ আবেগিক হতাশা,' ছবি ও গান',এ প্রেমের ক্ষুধার নান্দনিক প্রকাশ,' কড়ি ও কোমল',এবং 'মানসী' কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত অতীন্দ্রিয় প্রেমের অনুভূতি লক্ষ্মীনাথের হৃদয় মন ছুঁয়ে গেছে । এক সময়ে এই সমস্ত কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি লক্ষ্মীনাথের মনে কত যে আলোড়ন তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা গুলি হল উপনিষদের ভাব রস, কালিদাসের কাব্যিক নিপুণতা, এবং বাংলার বৈষ্ণব কবিদের আবেগি সংগীতময়তার মূর্ত প্রকাশ । রবীন্দ্রনাথ রচনা করা গীতি নাটক 'বাল্মীকি প্রতিভা',' কালমৃগয়া',' প্রকৃতির প্রতিশোধ', ট্রাজেডি নাটক' রাজা ও রানী' এবং' বিসর্জন', নাটকীয় গীতি কবিতা 'চিত্রাঙ্গদা' আদিও লক্ষ্মীনাথকে আকৃষ্ট করে। কবিতা এবং নাটক ছাড়া তিনি যে এখন গল্প লিখতে শুরু করেছেন–' ভারতী'তে প্রকাশিত তাঁর গল্পগুলি বাংলা গদ্যের অপূর্ব সৃষ্টি। বিস্ময়ের কথা এটাই যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ধারা অবাধ, স্বচ্ছন্দ, বিরামহীন। দেশ-বিদেশের সাহিত্য অধ্যয়ন, সাহিত্যের বিচার এবং দুরন্ত গতিতে সাহিত্য রচনা করা, ভাব আবেগের উচ্ছ্বাসে গীত রচনা, সৃষ্ট গীত গুলির সুর দিয়ে গাওয়া, নিজের নাটকে নিজেই অভিনয়.. এই সবই তাঁর কর্ম, সাহিত্য সৃজনে তাঁর মনপ্রাণ সম্পূর্ণরূপে সমর্পিত।
মাইকেল মধুসূদন এবং বঙ্কিমচন্দ্রের পরে রবীন্দ্রনাথ এখন বাংলা সাহিত্যের আকাশে অত্যুজ্জ্বল মহিমায় বিরাজমান। এরকম একজন পুরুষের সামনে একটা চেয়ারে বসে লক্ষ্মীনাথ ভেতরে ভেতরে কিছু পরিমাণে উত্তেজিত। সত্যি এযেন এক দুর্লভ সান্নিধ্য। অপূর্ব এক সংযোগ।
রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্মীনাথের কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করলেন।
বারান্দা থেকে দক্ষিণের বিশাল নীল আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রবীন্দ্রনাথ বললেন,' লক্ষ্মীনাথ, শুনেছি আসামের শিলং বড় ভালো শৈল শহর।'
' হ্যাঁ কাকাবাবু, শিলঙের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অপরূপ।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' তাছাড়া শিলং খুবই স্বাস্থ্যকর। আপনার ভালো লাগবে।'
' যেতে হবে। পাহাড় আমাকে খুবই টানে।' রবীন্দ্রনাথ বলল,' বন জঙ্গল কেটে সাহেবরা চায়ের চাষ করেছে।'
' হ্যাঁ, অসামে এখন অনেক চায়ের বাগান। বিশেষ করে পূর্ব আসামে শস্য বলতে চায়ের চাষ । চারদিকে সবুজ,শুধু সবুজ।'
' এসব আমার দেখতে ইচ্ছা করে, বুঝেছ। তোমাদের ওখানকার যাতায়াতের ব্যবস্থাটা কেমন, বল দেখি?'
' শিয়ালদহ থেকে ট্রেইনে গোয়ালন্দ। তারপর জলপথ– জাহাজ বা নৌকায় যাত্রা। গঙ্গা পার হয়ে ধুবরিতে ব্রহ্মপুত্র। আসামের ব্রহ্মপুত্রই যাতায়াতের একমাত্র উপায়।'
' নদীপথে যাতায়াতটা মন্দ নয়, কী বল?'
' খুবই ভালো, কাকাবাবু। আমি তো বাড়ি যাওয়া এবং বাড়ি থেকে আসার সময় জলপথের ভ্রমণটা খুবই উপভোগ করি।'
রবীন্দ্রনাথ ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। পুনরায় দৃষ্টি মেলে ধরলেন সামনের উদার নীল আকাশের দিকে। অনেকক্ষণ সেভাবে চেয়ে থেকে বললেন,' ব্রহ্মপুত্র– এক বিশাল ঐতিহ্য। আমাদের এই বাংলাদেশের সৃষ্টিকার্যে ব্রহ্মপুত্র নদ তো আবহমান কাল ধরে বিস্তর পলি মাটি বহন করেছে। আজ এই মাটিতেই আমার জন্ম। পদ্মার যেসব চরে আমরা আমাদের প্রথম যৌবন যাপন করেছি, সে সবের রচনায়ও ব্রহ্মপুত্রের অবদান রয়েছে।'
এটা কবির কাব্য ভাব। শান্ত লক্ষ্মীনাথ কবি রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে সম্মোহিত।
' সে যাই হোক–।' রবীন্দ্রনাথ তারপর বললেন, সেদিন পরি বলল, রায়বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়া তোমাদের কী রকম আত্মীয় হন।'
' উনার পত্মী বিষ্ণুপ্রিয়া আমাদের ভাগ্নি সম্পর্কীয়।'
' তাই নাকি! শিক্ষা জ্ঞান মননে বরুয়া মহাশয় সত্যিই উদার। অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি।' রবীন্দ্রনাথ বললেন,' সেদিন তিনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। তোমার খুব প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, কলকাতায় পড়তে এসে' আসামী' সাহিত্যের উন্নতির জন্য তোমরা খুব উঠে পড়ে লেগেছ। তুমি নাকি 'আসামী' সাহিত্যের একখানা পত্রিকার সম্পাদক?'
' হ্যাঁ, কাকাবাবু। অবশ্য আগে আমি এই দায়িত্বে ছিলাম না। গতবছর থেকে আমাকেই সম্পাদনা করতে হচ্ছে।'
' আসাম থেকে এখানে এসে'আসামী' সাহিত্যের উন্নতির জন্য চেষ্টা করছ– এই ভাষাটার কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে?
এতক্ষণ ভালোই লাগছিল, রবীন্দ্রনাথের কথা শুনে সত্যিই সম্মোহিত হয়ে পড়েছিল। বিনম্র শ্রদ্ধা সহকারে তিনি জিজ্ঞেস করা কথাগুলির উত্তর দিয়ে আসছিল। কিন্তু অসমিয়া সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের সেই সবিনয় শ্রদ্ধার ভাবটা নাই হয়ে গেল। ঠাকুরবাড়ির প্রত্যেকেই অসমিয়া না বলে'আসামী' বলে। শুনতে খারাপ লাগলেও লক্ষ্মীনাথ তাদের কথা খুব একটা ধরে থাকেনি। এখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এভাবে বলায় লক্ষ্মীনাথ বিরক্ত হল। এদিকে গত কিছুদিন ধরে'সুহৃদ সমিতি'র সাহিত্যিক সদস্যরা তাকে ষোলো আনা বাঙালি করে তোলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সঙ্গে তারা অসমিয়া ভাষার প্রতি হেয় ভাব প্রকাশ করে আক্রমণও চালাচ্ছে। এখন, কবি রবীন্দ্রনাথও অসমিয়া ভাষার সম্পর্কে এই ধরনের একটি উন্নাসিক প্রশ্নের অবতারণা করলেন! লক্ষ্মীনাথ কিছুটা রুষ্ট কণ্ঠে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল,' কেন ভবিষ্যৎ নেই, কাকাবাবু?'
' সেটাই তো তোমার কাছে জানতে চাইলাম। তুমি কি সত্যিই অসমিয়া সাহিত্যের কোনো ভবিষ্যৎ দেখ?'
রবীন্দ্রনাথের উন্নাসিকতার মাত্রা বৃদ্ধি পেল। এবার তার সামনে বসে থাকা লক্ষ্মীনাথের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল।
' কিহে লক্ষ্মীনাথ, তুমি কিছু বলছ না!'
' কাকাবাবু–।' বিরক্তি ক্রোধ সংযত করে লক্ষ্মীনাথ বলল,' আপনার সঙ্গে বিতর্কে জড়াবার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি আপনারা অসমিয়া ভাষাটাকে যে একটা আঞ্চলিক ভাষা মনে করেন, এটা কিন্তু সত্য নয়। আপনাদের মধ্যে একাংশ এটাও মনে করেন যে অসমিয়া বাংলারই একটি উপভাষা– এই মতবাদেরও যুক্তিপূর্ণ কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।'
তাঁর কথায় প্রতিবাদের সুর। আর এই সুরটি নিজের অজান্তেই একটু কঠিন হয়ে পড়ল।
সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি সম্পন্ন রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্মীনাথের মনোভাবটা বুঝতে পারলেন। তার জন্যই তিনি আর ভাইঝি জামাইয়ের সঙ্গে বিতর্কে অবতীর্ণ হলেন না।
যুবক সাহিত্যিক সম্বন্ধীদের প্রত্যেকেই লক্ষ্মীনাথের বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছে। তাদের কথায় লক্ষ্মীনাথ খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতির পূজারী সর্বজন শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথও যে অসমিয়াকে বাংলার উপভাষা বললেন– এটা লক্ষ্মীনাথের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করল। সঠিক তথ্য অনুসন্ধান না করে, ভালোভাবে বিচার বিবেচনা না করে এই ধরনের তরল মন্তব্য! রবীন্দ্রনাথের মতো একজন ব্যক্তির এই ধরনের অবিবেকী মনোভাব! অসমিয়া চাষা-ভুষোদের কথ্য ভাষা! অসমিয়া ভাষার কোনো ভবিষ্যৎ নেই! তারমানে তারা অসমিয়া ভাষা-সাহিত্যকে স্বীকৃতি দিতে চাইছে না। এটা যে অন্য ভাষাকে মান্যতা দিতে অস্বীকার এবং এটাও যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন– তা এরা বিশেষ করে, এদের শিরোমণি রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতে নাই কি?
লক্ষ্মীনাথ পুনরায় একটি সংকটে পড়ল। অবশ্য এটা ব্যক্তিগত নয়। সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভব হওয়া সংকট। এই বিরোধকে অতিক্রম করতে হলে লড়াই করতে হবে। রায়বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়া এই ধরনের দ্বন্দ্ব সংঘাতের সঙ্গে লড়াই করার জন্য জ্ঞান এবং ব্যক্তিত্ব নিয়ে দাঁড়াতে উপদেশ দিয়েছিলেন । তাঁর কথা স্মরণ করে লক্ষ্মীনাথ নিজেকে সেভাবে তৈরি করে তুলল।
তথাপি লক্ষ্মীনাথের অন্তর পীড়িত হতে লাগল। এত সুখ, এত আরাম, পত্নীর উষ্ণ সান্নিধ্য এবং শাশুড়ি মায়ের এত ভালবাসা পেয়েও ঠাকুরবাড়িতে থাকাটা তার পক্ষে কষ্টদায়ক হয়ে উঠল। তার জন্যই লক্ষ্মীনাথ দিনের অধিকাংশ সময় ঠাকুরবাড়ির বাইরে থাকতে লাগল।
লক্ষ্মীনাথের এই পরিবর্তন প্রজ্ঞার চোখে ধরা না পড়ে থাকল না। কেন লক্ষ্মীনাথ বাইরে বাইরে থাকে সে উৎকণ্ঠিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ মনের ক্ষোভ যন্ত্রণার কথা প্রিয়তমা পত্নীর সামনে ব্যক্ত করতে চায়না। আর ব্যক্ত করেই বা কীভাবে? লক্ষ্মীনাথকে যে প্রজ্ঞার আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে বলতে হবে। সেটা প্রজ্ঞার পক্ষে অস্বস্তি এবং মন খারাপের কারণ হবে।
অসমিয়া ভাষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্যের বিরুদ্ধে লক্ষ্মীনাথ যে প্রতিবাদ জানাল, তার এক মাস পরে ঠাকুরবাড়ি থেকে নতুন করে প্রকাশিত'ভারতী' পত্রিকায় ' ভাষা বিচ্ছেদ' শীর্ষক রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথ অসমিয়া ভাষাকে বাংলার উপভাষা বলেই ক্ষান্ত রইলেন না, অসমিয়া ভাষা সম্পর্কে অপমান সূচক কিছু মন্তব্যও প্রকাশ করলেন।' ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রবন্ধটির কথা সম্পর্কে লক্ষ্মীনাথ কিছুই জানে না। প্রজ্ঞা কাগজটা এনে লক্ষ্মীনাথকে দেখাল।
প্রবন্ধটা পড়ে লক্ষ্মীনাথ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। কাগজটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে সে অস্থিরভাবে ঘরের ভেতরে পায়চারি করতে লাগল।
'কী হল?' প্রজ্ঞার উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর,' রবি কাকা অন্যায় কিছু লিখেছেন?'
' অন্যায় মানে? মাসখানেক আগে ওঁর সঙ্গে আমার এই নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তখনই আমি রবিকাকার এই ধারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। তথাপি তিনি সেই একই কথা লিখে 'ভারতী'তে ছাপালেন! রবিকাকা একজন সম্মানীয় ব্যক্তি। এই রচনা পড়ে সবাই ওনার কথা মেনে নেবে। কিন্তু অসমিয়া বাংলার উপভাষা, এই কথাটা ভুল। আসলে অসমিয়া ভাষা, বাংলা ভাষার থেকেও প্রাচীন। ঐতিহাসিক দূর্বিপাকে অসমিয়া জাতীয় জীবনে অন্ধকার নেমে আসার সুযোগ নিয়ে সম্প্রসারণবাদী বাঙালি কেরানি- মুহুরীদের প্ররোচনায় বাংলা ভাষা প্রচলন করার জন্য অসমিয়া ভাষার উন্নতিতে ব্যাঘাত জন্মেছিল।'
এক নিঃশ্বাসে এতগুলি কথা বলার পরে লক্ষ্মীনাথের ক্ষোভ কিছুটা কমল। তারপরে খাটের কাছে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে সে অনুভব করল, না প্রজ্ঞার সামনে এভাবে ক্রোধ উত্তেজনা প্রকাশ করাটা উচিত হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের মুখটা ম্লান হয়ে পড়ল। ক্লান্তভাবে বিছানায় এসে বসল।
প্রজ্ঞা এসে লক্ষ্মীনাথের বা পাশে বসল। স্বামীর বাঁ হাতটা আদর করে তুলে নিয়ে কাতর কণ্ঠে অনুযোগ করল যে বারবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও লক্ষ্মীনাথ কেন বিষয়টা তাকে জানায়নি? সে এখন বুঝতে পারল লক্ষ্মীনাথের দুঃখ এবং মন খারাপের উৎস কী। তবে কেন লক্ষ্মীনাথ তার দুঃখের কথা প্রজ্ঞাকে বলতে পারল না? প্রজ্ঞা কি তারা আপন নয়? বিয়ের পরেই লক্ষ্মীনাথ যে বলেছিল, গত জন্ম থেকে তাদের সম্পর্ক, কথাটা তাহলে মিথ্যা? লক্ষ্মীনাথ তখন বোঝাতে চেষ্টা করল যে তাঁর আশঙ্কা হয়েছিল, অসমিয়া ভাষা সাহিত্য সম্পর্কে রবি কাকার মন্তব্যের কথা শুনে সে অসন্তুষ্ট হয়েছে বললে প্রজ্ঞা দুঃখ পাবে। প্রজ্ঞা তখন সঙ্গে সঙ্গে বলল যে কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করলেও তাঁর অন্যায় মন্তব্য শুনে লক্ষ্মীনাথের অসন্তুষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। আর স্বামী অসন্তুষ্ট হলে পত্নীর কি ভালো লাগবে?
প্রজ্ঞার স্নেহ মাখানো কাতরতা লক্ষ্মীনাথের বুকের যন্ত্রণাটা অনেকটা কমিয়ে দিল।
' তুমি রবি কাকার ভুল বা অন্যায় মন্তব্যের জবাব দাও।' প্রজ্ঞা বলল, মাতৃভাষার স্বাভিমান রক্ষার জন্য রবি কাকার প্রবন্ধের বিরুদ্ধে তুমিও' ভারতী'তে প্রতিবাদী প্রবন্ধ লেখ।'
'রবি কাকা সেটা ছাপবেন?'
' কেন ছাপবেন না? আমি যখন 'সাধনা'র সম্পাদিকা ছিলাম, এই ধরনের একটি বিতর্কিত প্রবন্ধ প্রকাশ করার জন্য কয়েকটি চিঠি এসেছিল। আমি সেই চিঠি গুলি পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশ করেছিলাম।'
' কলেজ স্ট্রিটের ম্যাচে থাকাকালীন বলিনারায়ণ বরার 'মৌ' কাগজের প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের বিরুদ্ধে আমিও একটি চিঠি লিখেছিলাম। কাগজের অপকার হবে জেনেও বলিনারায়ণ বরা আমার সেই প্রতিবাদী চিঠিটা ছাপিয়েছিলেন। ঠিক আছে, রবি কাকার ওই প্রবন্ধটির বিরুদ্ধে আমিও একটি প্রবন্ধ লিখব। তার জন্য কাল আমাকে মেসে যেতে হবে।'
' মেসে কেন যাবে? এখানে থেকেই তো লিখতে পার।'
'ওহো, প্রতিবাদী প্রবন্ধটি লেখার জন্য তথ্য জোগাড় করতে হবে। মাজিউ এবং হেম গোঁসাইয়ের সঙ্গে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে যুক্তিযুক্ত ভাবে রবিকাকার ভুল ধারণা গুলি খণ্ডন করতে হবে।'
পরের দিনই ত্রিমূর্তি মেসে বসল। গভীর আলোচনায় মগ্ন হল। অসমিয়া ভাষার ওপরে বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ 'ভারতী'তে প্রকাশ করা অপমানজনক মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই হবে। অসমিয়া সাহিত্যের প্রাচীনতম যুগ ষষ্ঠ থেকে অষ্টম খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। লোক- সাহিত্য, লোকগীত, প্রবাদ -প্রবচন এবং সাধু কথাই ছিল এই যুগের বৈশিষ্ট্য। এই সময়ে বাংলা সাহিত্যের বিকাশই হয়নি। তারপরে চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধান্তদের দ্বারা বিকাশ হয় চর্যাপদের সাহিত্য' 'চর্যাপদ বিনিশ্চয়' (?)। এই সাহিত্যের বিকাশের সময় অসম এবং বঙ্গের সাহিত্যিকদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। চর্যাপদের যুগের পরে প্রাক শংকরী যুগে হেম সরস্বতী, রুদ্র কন্দলী, হরিহর বিপ্র, কবিরত্ন সরস্বতী এবং মাধব কন্দলী অসমিয়া সাহিত্যের বিকাশ ঘটায়। তারপরে পঞ্চদশ শতক থেকে অসমিয়া ভাষায় বৈষ্ণব সাহিত্যের যুগ আরম্ভ হয়। শংকরদেব মাধব দেব অসমিয়া ভাষা সাহিত্যকে একটি বিশেষ রূপে গড়ে দিয়ে সাংস্কৃতিকবন্ধনে অসমে অসমিয়া জাতিসত্তার ভিত মজবুত করে। শংকরদেব মাধব দেবের পরে সপ্তদশ শতক থেকে অসমীয়া সাহিত্যে চরিত পুথি রচনার মাধ্যমে বৈকুন্ঠনাথ ভট্টাচার্যের হাতে অসমিয়া গদ্যের সৃষ্টি হয়। তখন বাংলা ভাষায় কোনো গদ্য ছিল না। তাই অসমিয়া ভাষা কোনো কারণেই বাংলার একটি উপভাষা হতে পারে না– ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রতিবাদ প্রবন্ধটি লেখার পরে লক্ষীনাথের বুকের জ্বালা কমল। বাংলায় লেখা প্রবন্ধটির নকল রেখে সেদিনই 'ভারতী' পত্রিকার সম্পাদকের কাছে প্রেরণ করল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা এটাই যে সম্পাদকের কলামের অত্যাচারে প্রবন্ধটি ঠিকভাবে প্রকাশিত হল না। লক্ষ্মীনাথ তখন একই প্রতিবাদী প্রবন্ধ'পুণ্য' পত্রিকায় পাঠিয়ে দিল। সেখানে ভালো করে প্রকাশিত হল যদিও তাঁর উপাধি বেজবরুয়ার পরিবর্তে ' বিদ্যাবর্য' বলে ছাপা হল। পত্রিকাটা বন্ধুদের এবং তারপরে প্রজ্ঞাকে দেখিয়ে লক্ষ্মীনাথ খুব হাসল।
এই ঘটনার পরে ঠাকুরবাড়ির সাহিত্যিক সদস্যরা এবং তাদের শিরোমণি রবীন্দ্রনাথ ভালো করে বুঝতে পারলেন যে অসমিয়া ভাষার জন্য তীর ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকা লক্ষ্মীনাথকে সহজে বশ করা যাবে না। জামাই হলেও লক্ষ্ণীনাথকে ঠাকুর পরিবারের বাঙালি সংস্কৃতিক ধারায় পোষ মানানো যাবে না। কথাবার্তা, চিন্তাধারা, মননশীলতায় বাঙালি বলে মনে হলেও তাকে ষোলো আনা বাঙালি করাটা সম্ভব নয়। সম্বন্ধীরা নিরাশ হল এবং গতি বিষম দেখে রবি কাকাও মৌনতা অবলম্বন করাটাকেই শ্রেয় বলে বিবেচনা করলেন।
এটা একটা সাফল্য।
এই সাফল্যে আনন্দিত হলেও প্রজ্ঞার সান্নিধ্যে এলে লক্ষ্মীনাথের মন খারাপ হয়ে যায়। আগে তার সান্নিধ্যে যে আত্মিক পূর্ণতা অনুভব করেছিল, এই ঘটনার পরে তাতে যেন কিছু একটা বিসঙ্গতি দেখা দিল। এই বিষয়ে প্রজ্ঞাকে কিছু বলে না। বলতে ইচ্ছা করে যদিও বলতে পারেনা। তার জন্যই প্রজ্ঞার সেবা যত্ন, প্রজ্ঞার স্নেহ আকুলতার মধ্যে নিজের স্বাভিমানকে আরও মহিমাময় রূপে মর্যাদা দেবার জন্য তাকে এই ঠাকুরবাড়ি পরিসীমা থেকে বের করে নিয়ে যেতে হবে বলে অনুভব করে।
কিন্তু এই কথাগুলিকে কীভাবে সাকার করবে? এখন পর্যন্ত এম এ এবং আইন পাশ করা হল না। উপার্জনের সুনিশ্চিত একটা উপায়ও স্থির হল না। তার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত ভোলানাথ বরুয়া কাঠের ব্যবসা করে। এই ব্যবসাটা লাভদায়ক। কিছুদিন থেকে ভোলানাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের আন্তরিকতা গড়ে উঠেছে। সে ব্যবসায় লক্ষ্মীনাথকে অংশীদার রূপে পেতে চায়। কিন্তু কাঠের ব্যবসায় যোগদান করবে কিনা লক্ষ্মীনাথ এখনও স্থির করতে পারেনি।
তখনই একদিন রিপন কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার সময় হেডমাস্টার চন্দ্রমোহন গোস্বামীর সঙ্গে দেখা হল। লক্ষ্মীনাথের স্কুল জীবনের শিক্ষাগুরু। তিনি ইতিমধ্যে অবসর গ্রহণ করে কলকাতায় ফিরে এসেছেন। গোস্বামীদেব আগের চেয়ে রোগা হয়ে গেছেন। চোখে মুখে বার্ধক্যের ছাপ।
লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে দেখা হওয়ায় গোস্বামীদেব খুবই আনন্দিত হলেন। আগের মতোই মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে লক্ষ্মীনাথকে আদর করতে লাগলেন।
লক্ষীনাথের তখন স্কুলের দিনগুলির কথা মনে পড়ল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ আর স্কুলের ছাত্র হয়ে নেই। বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। তার জন্য গুরুদেবের সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীনাথের লজ্জা লাগছে। প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময়ের পরে গোস্বামীদের হাসতে হাসতে বললেন,' বিয়ে করেছিস। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ। আমি সবকিছুই জানি।'
' কিন্তু স্যার, বাড়ির প্রচন্ড বিরোধিতা—।'
' সেইসব শুনেছি।'
' বাড়ির সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। কেউ আমার খোঁজ খবর নেয় না।' লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বর ভারী,' এভাবে বিয়ে করে অন্যায় করেছি বলে মনে না হলেও বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় খারাপ লাগে।'
' না, মন খারাপ করিস না।' প্রসন্ন হেসে গোস্বামী দেব বললেন,' নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকলে খারাপ পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ না থাকাটা সাময়িক, লক্ষ্মী। আমি তোর বাবাকে জানি। বেজবরুয়া মানুষটা স্নেহশীল। ছেলেকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারবে না। তুই একটা কাজ কর।'
' কী কাজ স্যার?'
' একবার শিবসাগরে যা–। বাড়িতে গেলে তোকে দেখেই বাবার মনে পরিবর্তন আসবে, দেখবি।'
' বাবা বদলাবে কি?'
' লক্ষ্মী, সন্তানের জন্য ভালোবাসা অন্যরকম। আমি যতটুকু জানি, সেই ভালোবাসা এবং সংবেদনশীলতা বেজবরুয়ার আছে। বাড়িতে গিয়ে একবার তার সামনে দাঁড়া তো।'
' এখনই যাব নাকি, স্যার?'
' এখনই মানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব,যা–।'
লক্ষ্মীনাথ গুরুদেবের পরামর্শটা শিরোধার্য করে নিল। তারপরই তার মনটা অপরাধ বোধে ঘিরে ধরল।
'কী হল, মুখটা কালো হয়ে গেল যে!'
'স্যার, বিয়ে করলাম– আপনাকে জানানো হল না। নিমন্ত্রণ করা হল না।' সবিনয় কাতরতার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ বলল,' এটা আমার বড় অপরাধ হল।'
গোস্বামী দেবের হাসিটা সস্নেহ কাতরতায় অনুপম হয়ে উঠল। পুনরায় তিনি লক্ষ্মীনাথের পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বাংলায় বললেন–' পাগল ছেলে! নিমন্ত্রণ করিস নি, তাতে কি হয়েছে? এর পরে নিমন্ত্রণ করবি। তোর নিজের বাড়ি গিয়ে বৌমার হাতে রান্না খাব। আর শোন, তুই যে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে বিয়ে করেছিস– আমি খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু নিজের বংশের সম্মান রেখে চলবি। কাজের দ্বারা, কথার দ্বারা ঠাকুরদের বুঝিয়ে দিবি– তারা যেমন বেঙ্গলে বড়লোক, তোরাও তেমনই অসমে স্বাভিমান মর্যাদা নিয়ে চলা ব্যক্তি। কোনো বিষয়েই হীনতা স্বীকার করবি না।'
গুরুদেবের কথায় লক্ষ্মীনাথের হৃদয়- মন আবেগ মথিত হয়ে উঠল। কথাগুলি কত মহত্ত্বপূর্ণ! গুরুদেবের চিন্তা চেতনা কত উচ্চ স্তরের। তাঁর অন্তর কত মহৎ! লক্ষ্মীনাথ গুরুদেবের দুই চরণ স্পর্শ করে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন