হে আমার স্বদেশ- ১৮
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।(১৮)
সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ প্রতিকূলতার মধ্যেও মাতৃভাষা এবং সাহিত্যের উন্নতির জন্য অ. ভা. উ. সা সভার গঠন করেছিল। তার কিছুদিন পরেই তাঁরা ' জোনাকী' প্রকাশ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাহিত্য সৃষ্টির এক বাতাবরণ গড়ে তুলল। জোনাকীর জনপ্রিয়তা এবং নিজের সৃষ্টির বিরামহীন ধারা সমালোচক নিন্দুকদের চুপ করালো এবং প্রত্যেকেই লক্ষ্মীনাথের প্রতিভাকে স্বীকার করে নিল। এদিকে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছিল, বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল; সেগুলিও স্বাভাবিক হয়ে এল। কিন্তু দুটি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, তারপরে গুনাভিরাম বরুয়ার মৃত্যু… লক্ষ্মীনাথ চেষ্টা করেও হতাশা এবং শোকের বেদনা থেকে রক্ষা পেল না। এদিকে প্রজ্ঞার সঙ্গে তাঁর দ্বৈত জীবন আরম্ভ হয়েছে। এই দ্বৈত জীবনের সফল রূপায়ণ করে তোলা যাবে পৃথক একটি বাড়িতে সংসার পাতার মাধ্যমে । তার জন্য চাই উপার্জনের কোনো সুনিশ্চিত উপায়। কিন্তু উপার্জনের বিষয়ে লক্ষ্মীনাথ এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তার জন্যই তাঁর কাজকর্মে একাগ্রতা নেই, সুখভোগে এত আগ্রহ আসক্তি নেই ।
তবু নিজেকে সামলে রাখে । চন্দ্রকুমার কলকাতায় থাকে না, হেমচন্দ্র অন্য জায়গায় থাকার ফলে আগের মতো ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ হয় না । ভোলানাথের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেও তাকে দুঃখ, মন- খারাপ,সমস্যা, সংকটের কথা সেভাবে বলে না । এদিকে বয়সে ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথের চেয়ে দশ এগারো বছরের বড় । তাছাড়া তিনি চন্দ্রকুমার-হেমচন্দ্রের মতো সংবেদনশীল মনের মানুষ নয়। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হল ব্যবসা। সব সময়ই লাভের চিন্তা করা ভোলানাথের কাছে মনের কথা বলা যায় না।
কিন্তু প্রজ্ঞার ভালোবাসা-সংবেদনশীলতার সামনে লক্ষ্মীনাথ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেনা । অন্তরের আকুলতায় হৃদয়ের আবেগে প্রজ্ঞা তার দুঃখ– মন খারাপ বুঝতে পারে। অবশেষে প্রজ্ঞার সামনে সমস্ত কথা প্রকাশ করল। গুনাভিরামের মৃত্যুর জন্য লক্ষ্মীনাথকে শোকে কাতর হতে দেখে প্রজ্ঞা বলল, কারও কাছেই মৃত্যু কাম্য নয়। কেউ মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তবু মৃত্যু আসে। অসহনীয় হলেও মৃত্যুকে স্বীকার করে নিতেই হবে ।
একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে ক্লান্ত দেহে লক্ষ্মীনাথ তার বিছানায় আশ্রয় নিল । পূব দিকের জানালার কাছে চেয়ারে বসে প্রজ্ঞা কাপড় সেলাই করছিল। লক্ষ্মীনাথকে অসময়ে বিছানা নিতে দেখে হাতের কাপড় এবং সূঁই সুতো রেখে প্রজ্ঞা স্বামীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল তিনি কেন মন খারাপ করে থাকেন ? অন্য কোনো কারণে ভেতরে ভেতরে খারাপ পাচ্ছেন নাকি?
লক্ষ্মীনাথ তখন বি এ পাশ করার পরে সরকার তাকে হাকিমের পদে যোগদান করার জন্য অনুরোধ করার কথা বলল। বাড়ির প্রত্যেকেই চেয়েছিল সে হাকিম হোক। কিন্তু ইংরেজের অধীনে চাকরি করবে না, আরও পড়াশোনা করবে বলে সবাইকে আশ্বাস দিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে এসেছিল। আইন পাস করে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতির পেশাকে গ্রহণ করবে বলে স্থির করেছিল। কিন্তু পরীক্ষায় অকৃতকার্য হল, তারপরে মামলায় হেরে তার উকিল হওয়ার আশা একেবারে চুরমার হয়ে গেল। এটা তার পক্ষে কতটা বেদনাদায়ক, ডিগ্রি লাভ করতে সক্ষম না হওয়াটা কতটা লজ্জার কথা!
প্রজ্ঞা বলল, পরীক্ষায় পাশ- ফেল থাকেই। তারপরে ডিগ্রির কথা– রবি কাকার তো কোনো ডিগ্রিই নেই। রবি কাকার কি শিক্ষা জ্ঞান কম? এদিকে পরীক্ষার আগের দুটো মাস মেসে থেকে অসুস্থ ভোলানাথবাবুর সেবা করলে, তখন প্রজ্ঞাই ঠাকুরবাড়িতে থেকে তাকে পড়াশোনা করতে বলেছিল। এখানে থেকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিলে নিশ্চয় পাশ করতে। তারপরে প্রজ্ঞা তাকে পুনরায় পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে অনুরোধ করল।
লক্ষ্মীনাথ পলকহীন দৃষ্টিতে প্রজ্ঞার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, পড়াশোনা করার চেয়ে এখন আয় উপার্জনের কথা ভাবাটা বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। তার জন্যই প্রজ্ঞার ডান হাতের উপর নিজের হাতটা রেখে লক্ষ্মীনাথ বলল, ঠাকুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁরা এখন আলাদাভাবে নিজেদের ঘর-সংসার পাতবে।
'এ বাড়িতে তোমার অসুবিধা হচ্ছে?'
' এখানে কোনো অসুবিধা নেই, পরি। বরঞ্চ এখানে তো শুধু আরাম। কিন্তু আমাকে নিয়ে তোমার যে নিজের সংসার গড়ার সেটা কি এখানে থাকলে কোনোদিন সম্ভব হবে?'
' তা কী করে সম্ভব?'
তারপরে লক্ষ্মীনাথ ধীরে ধীরে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, প্রজ্ঞা এই ঘরের– এই রাজপ্রাসাদ সদৃশ বিশাল ঠাকুরবাড়ির মায়া ছাড়তে হবে। ঠাকুরবাড়ি ছাড়াটা প্রজ্ঞার পক্ষে বেদনাদায়ক। বেদনাদায়ক হলেও স্বামীর সঙ্গে পৃথকভাবে সাংসারিক জীবন গঢ়ার জন্য এই কষ্ট বেদনা সহ্য করতেই হবে। এদিকে লক্ষ্মীনাথ কর্তামশাইর মতো জমিদার নয়। কলকাতায় তার কোনো বিষয় সম্পত্তি নেই। নতুন সংসার পাতার জন্য বাইরে বাড়ি একটা ভাড়া নিতে হবে। বাড়ির বড়ো গেট থাকবে না, দারোয়ান থাকবে না, সামনের দিকে সযত্ন লালিত ফুলের বাগান থাকবে না, বিশাল বারান্দা থাকবে না, সুদৃশ্য আসবাবে সজ্জিত বিশাল বৈঠকখানা ঘর বা কাছারি ঘর থাকবে না, রান্নাবান্না করার জন্য ঠাকুর থাকবে না–।
প্রজ্ঞা আর বলতে দিল না। ডানহাতে লক্ষ্মীনাথের মুখ চাপা দিয়ে বলল,' হবে আর বলতে হবে না। আর কিছু না থাকলেও তুমি তো থাকবে। তুমি থাকলেই হবে। তোমার থেকেই আমি সব পাব।
' শুধু সঙ্গেই থাকব না। সঙ্গে থেকে এই শর্মা সবদিক থেকে তোমাকে সাহায্য করবে। তোমার সঙ্গে থেকে তোমার সংসারের প্রয়োজনে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত করবে।' প্রজ্ঞার কোমল হাত ধরে চুমু খেয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' তাই ভাবছিলাম কি, আয় উপার্জনের উপায় তো একটা চাই। ভোলা দাদার সঙ্গে কাঠের ব্যবসায়ে লেগে যাই।'
' কাঠের ব্যবসা! তুমি কাঠের ব্যবসা করাটা–!'
' দ্বিজেন জ্যাঠামশাই ' অশ্রুমতি',' সরোজিনী' নাটক লিখে নাট্যকার। তিনি সুবিখ্যাত দার্শনিক। অথচ কলকাতায় সর্বপ্রথম স্বদেশী জাহাজ চালিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। আর আমি কাঠের ব্যবসা করতে পারব না? তাছাড়া, এই ব্যবসার মূল ব্যক্তি হলেন ভোলানাথ দাদা। আমি তার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজ করব।'
' ঠিক আছে। যা ভালো বুঝ কর।'
' এমন করে বললে যে! আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস জাগছে না বুঝি?'
' বিশ্বাস কেন জাগবে না,বল?' কাতরভাবে লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে প্রজ্ঞা বলল' এখন তো তুমিই আমার সব। তোমার যা চলার পথ, আমাকে তো সেই পথেই চলতে হবে।'
শোবার ঘরের বিছানায় বসে দুজনের মধ্যে মত বিনিময় হল। এভাবে কথাবার্তা বলে একে অপরকে বুঝতে পারল। সহৃদয়তার সঙ্গে একে অপরের দুঃখ- কষ্ট উপলব্ধি করল। তারপর দুজনেই সেই দুঃখ কষ্ট নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। ভাড়া ঘরে থেকে ঘর সংসার শুরু করার কথা শুনে প্রথমে প্রজ্ঞা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। তারপরে সেও পৃথকভাবে বসবাস করার গুরুত্ব বুঝতে পেরে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে নিল। এদিকে সমস্ত কথা খোলাখুলি ভাবে বলতে পেরে লক্ষ্মীনাথেরও ভালো লাগল। কিছুদিন ধরে ভোগ করতে থাকা কষ্ট যন্ত্রণা অনেকখানি কমে গেল ।
লক্ষ্মীনাথ পুনরায় কাজকর্মে মনোযোগ দিল। জোনাকীর আরও একটি সংখ্যার কাজ শেষ হল। নিজের লেখাও এগিয়ে চলল। সঙ্গে ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে দেখা করে কাঠের ব্যবসা করবে বলে সম্মতি জানাল। ভোলানাথ অবাক হল।
'কী হল, আপনার সঙ্গে ব্যবসা করব বলে বলায় এত অবাক হলেন যে!'
' তুমি আমার বিজনেস পার্টনার হওয়াটা অনেকদিন আগেই চেয়েছিলাম। কিন্তু–' ভোলানাথ বরুয়া বলল,' সাহিত্যের অঙ্গনে বিচরণ করা মানুষ তুমি। মন থেকে তুমি ব্যবসাকে মেনে নিতে পারবে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল। '
'কী আর করব দাদা ! লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বর গম্ভীর, কলেজ স্ট্রিটের মেসে থাকার সময় আমরা অ. ভা. উ. সা সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। প্রস্তুতি সভায় বিনন্দ বরদলৈ জাতির উন্নতির জন্য অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক স্বতন্ত্রতার কথা বলেছিল। তখন আমরা তার কথায় গুরুত্ব দিইনি। এখন অনুভব করছি, বিনন্দের কথার যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা ছিল। আর দুর্ভাগ্যের কথা এই চেতনাটা আমার মনে দেরি করে জাগল। ব্যক্তিগত জীবনে পৃথকভাবে বসবাস করতে গিয়ে কথাটার গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। এখন আমার অর্থ চাই। ঘর সংসার চালানোর জন্য অর্থ উপার্জনের একটি সুনিশ্চিত উপায় চাই।'
' এম এ এবং আইন পরীক্ষায় তোমার ফলাফল খারাপ হল। আগামীবার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। '
' মামলা করে যেভাবে হারলাম, তারপরে আমি আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার সীমায় প্রবেশ করব না। তাই ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।'
রোমান্টিক চেতনা ভাব- অনুভূতি এবং বৌদ্ধিক বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখনীয় অবদান জোগায়। কিন্তু সেই সবের আতিশয্যে অনেক ক্ষেত্রে বহু প্রতিভাধর ব্যক্তিই বাস্তবতা হারিয়ে ফেলে। লক্ষ্মীনাথের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। তার জন্যই বিয়ের আগে সে আর্থিক স্বনির্ভরতার কথাটার গুরুত্ব বুঝতে পেরেও নিজের ক্ষেত্রে তার রূপায়ণ করতে পারেনি।
তাই তার কিছু কষ্ট হল। এই কষ্টের জন্যই ঠাকুর বাড়ির আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে লালিত পালিত হওয়া প্রজ্ঞাকে আরও কিছুদিন আশঙ্কায় ভুগতে হল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ পরিশ্রমী এবং কর্মে নিষ্ঠাবান। ভোলানাথের সঙ্গে আন্তরিকতা নিয়ে ব্যবসায় লেগে পড়ল।তাঁর নিজের গাড়ি নেই, ঘোড়া নেই ,কেরানি মুহুরিও নেই। ব্যবসায়িক বুদ্ধি সম্পন্ন ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ ' নিতাই গৌর দুই ভাই' হয়ে প্রতিদিন একসঙ্গে ট্রাম অথবা পদব্রজে ব্যবসায়ের কাজে লেগে পড়ল।
ভোলানাথের গায়ে খাকি কোট এবং মাথায় কালো অথবা ছাই বর্ণের টুপি, হাতে ছাতা। এদিকে লক্ষ্মীনাথের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ইউরোপীয় পোশাক। দুধে আলতা গায়ের রং। একেবারে সাহেব।সুচতুর ভোলানাথ চালচলনে যেমন তৎপর, কথাবার্তাতেও তেমনই প্রাণবন্ত। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে বেরিয়ে ট্রাম থেকে নেমে পদব্রজের আশ্রয় নিলেই সে গুণগুণ করে ওঠে,
' চল রে মন যাইরে কাশী,
বাবা বিশ্বনাথকে দেখে আসি।
কাশী গেলে দেখতে পাব,
কত শত যোগী ঋষি।'
এভাবে কিছুদিনের মধ্যে তারা ব্যবসায় সাফল্যের মুখ দেখতে পেল। ব্যবসায় সাফল্য মানেই লাভ, প্রভূত অর্থ উপার্জন। লক্ষ্মীনাথ শোভারাম বসাক লেনে মোটামুটি একটা ভালো বাড়ি ভাড়ায় নিল। নতুন করে রং করিয়ে ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রজ্ঞাকে নিয়ে এসে নতুন করে সংসার পাততে উদ্যোগী হল।
বিধবা মা, দাদা- বোন, আত্মীয়-স্বজন এবং বিশাল ঠাকুরবাড়ির জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ ছেড়ে আসার সময় প্রজ্ঞার দুচোখ দিয়ে জল পড়ছিল।তা বলে সে কিন্তু কাতর হল না। বরং ভাড়ায় নেওয়া নতুন বাড়িটা এসে নিজের হাতে দাদারা কিনে দেওয়া সাংসারিক জিনিসপত্র সাজিয়ে সাত দিনের মধ্যে সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করে ফেলল। এই বাড়ির বাইরের ঘরে লক্ষ্মীনাথ জোনাকীর কার্যালয় স্থাপন করল। ইতিমধ্যে ব্যবসায় সহায়ক রূপে ভোলানাথ তাদের বংশের গোপীনাথ বরুয়াকে নিয়ে এল। ব্যবসার কাজের অতিরিক্ত লক্ষ্মীনাথ এই গোপীনাথকে জোনাকী কার্যালয়ের হিসেবপত্র রাখার কাজে নিয়োগ করল।
সমস্ত দিক দিয়ে লক্ষ্মীনাথ একটা সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে এগোতে লাগল। সংসারের কাজকর্মে অভিজ্ঞা প্রজ্ঞার জন্য কিছুদিনের মধ্যেই সংসারে একটা শৃংখলা এল । লক্ষ্মীনাথও মানসিক স্থিরতা ফিরে পেল ।
বি এ পড়ার জন্য চন্দ্রকুমার পাটনায় চলে যাওয়ার পরে কিছুদিনের জন্য হেমচন্দ্র লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে একটা মেসে ছিল । লক্ষ্মীনাথ বিয়ে করার তিন মাস পরে দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হল । এদিকে এফএ পাশ করে হেমচন্দ্র বি এ ক্লাসে নাম লিখিয়ে পাঠ্যপুথি পড়ার চেয়ে জোনাকীর কাজে বেশি ব্যস্ত ছিল । সম্পাদক না হয়েও সম্পাদনার প্রায় সমস্ত কাজে সে আন্তরিকভাবে সাহায্য করত। তার জন্য পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগ দিতে পারত না। তাই তার পক্ষে বি এ ডিগ্রি লাভ করা সম্ভব হল না। হতাশ হেমচন্দ্র অসমে ফিরে যাবে বলে স্থির করল।
অসমে যাওয়ার আগের দিন লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য হেমচন্দ্র শোভারাম বসাক লেনের ভাড়াবাড়িতে এল। লক্ষ্মীনাথ তাকে আদর যত্ন করে ভেতরে এনে বসাল। ছাড়াছাড়ি হওয়ার পরে দেখা হলেও কথা- বার্তা বলার সুবিধা ছিল না । অনেকদিন পরে আজ দুজন কাছাকাছি বসে কথা বলতে লাগল। জোনাকীতে লেখা লেখক কবিদের বিষয় থেকে কাঠের ব্যবসায় লক্ষ্মীনাথ লাভ করা বিচিত্র অভিজ্ঞতা …. অনেক কথাই আলোচনা হল।তাঁদের আলোচনার মধ্যে ভেতর থেকে প্রজ্ঞা এসে হেম চন্দ্রের কুশল বার্তা জিজ্ঞেস করল। চা মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করল।
' অসমে ফিরে যাবে, বি এ ডিগ্রিটা নিয়ে যেতে পারলে ভালো হত।'
'কী আর করব, বেজ!' হেমচন্দ্র বলল কপালের দোষ দেওয়াটা ঠিক হবে না । পড়াশোনায় আমার যত্নের অভাব ছিল ।'
'এটাই আসল কারণ,হেম গোঁসাই।' লক্ষ্মীনাথের কন্ঠেও আক্ষেপের সুর,' প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন এবং যত্নের অভাবে আমিও এম এ এবং আইন পরীক্ষায় সফল হতে পারলাম না। তাই অদৃষ্টে নেই, কপালের লেখা ইত্যাদি বলে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ না করাটাই ভালো। তবে অসমে গিয়ে কী করবে?'
' পুরোনো অসমের ইতিহাসের সঙ্গে ভট্টদেবের কথা গীতার ওপরে কাজ করার একটা ইচ্ছা আছে । দেখি কী করতে পারি ?'
'জীবিকার একটা উপায় বের করতে হবে তো।'
' কিছু একটা করব। আচ্ছা একটা কথা ছিল ,বেজ–'
'বল।'
' বিয়ে-সাদি করে ঘর সংসার পাতলে। ভোলানাথ দাদার সঙ্গে কলকাতায় ব্যবসা করতে শুরু করলে। এইসব দেখে শুনে এরকম মনে হচ্ছে যেন তুমি কলকাতায় স্থায়ীভাবে থেকে যাবে।'
এই কথাটা নিয়ে লক্ষ্মীনাথের মনেও একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাড়ি থেকে বাবার চিঠি এসেছে, প্রজ্ঞাকে নিয়ে বাড়ি যেতে হবে। বাবার কথা হল, এম এ পাশের সঙ্গে আইনের ডিগ্রি যখন নেওয়া হল না, তখন অসমে ফিরে যেতে হবে। সরকারি চাকরি নিয়ে অসমেই থাকতে হবে। কিন্তু অসমে গিয়ে ইংরেজ সরকারের চাকরি করার ইচ্ছে তার নেই । জীবিকার জন্য ভোলানাথের সঙ্গে কলকাতায় যে কাঠের ব্যবসা শুরু করেছে এই সুবিধা অসমে নেই। তার চেয়েও বড় কথা হল কলকাতার যে বৌদ্ধিক- সাংস্কৃতিক পরিবেশ এটাও অসমে এখনও সৃষ্টি হয়নি। অসমে জীবনের গতি এতই মন্থর যে কিছুদিন থাকার পরই তার মনপ্রাণ অস্থির হয়ে উঠে।
চিন্তিত লক্ষ্মীনাথ বলল, স্থায়ীভাবে থাকার কথা না ভাবলেও এই মুহূর্তে আমাকে কলকাতাতেই থাকতে হবে।'
' তুমি অসমে থাকলে তোমাকে কেন্দ্র করেও সাহিত্যের পরিমণ্ডল একটা গড়ে উঠত। তোমার দ্বারা অনেকেই অনুপ্রাণিত হত। নগাঁও শহরে রায়বাহাদুর গুনাভিরাম বরুয়া যখন হাকিমের চাকরি করতেন তখন আমরা তার কাছ থেকে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম । সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি আমাদের সাহায্য করেছিলেন । এখন আমরা লিখছি পরবর্তীকালে আমাদের প্রজন্মও যাতে লিখতে পারে , আমাদের কি সেটা দেখা উচিত না ?'
' তুমি ঠিকই বলেছ গোঁসাই।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' অবসর নেবার পরে কলকাতায় এসে রায় বাহাদুর কলকাতা স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন বলে জানতে পেরে আমিও তাকে এই অনুরোধ করেছিলাম। কলকাতায় থাকার সপক্ষে পারিবারিক কারণ দেখানো ছাড়া তিনি কি বলেছিলেন জান?'
'বলতো–।'
' বিদেশে থেকেও মাতৃভাষার সেবা করা যায়।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' তিনি বলা এই কথাটা যে সত্যি, সেটা গত চার বছরে আমাদের কাজকর্মের দ্বারা প্রমাণিত হল। আমরা যে অ. ভা. উ. সা সভা গঠন করলাম, জোনাকী প্রকাশ করে এত সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি, এসবই তো এই কলকাতাতে থেকেই হল।'
' তবু–?'
' আমি না থাকলেও মাজিউ, পদ্মনাথ, সত্যনাথ, আনন্দচন্দ্র, হিতেশ্বর, চন্দ্রধর, তুমি– তোমরা অসমে থাকবে। তাছাড়া কলকাতায় থাকলেও আমি জোনাকীর সম্পাদনার কাজ করেই যাব। তাই জোনাকীর মাধ্যমে তোমাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকবেই।'
তারপরে হেমচন্দ্র আর কিছু বলল না। অব্যক্ত একটা মন খারাপ নিয়ে সে বিদায় নিল।
হেমচন্দ্রের কথাগুলিতে মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমির প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেল। হেমচন্দ্রের এই অনুরাগ লক্ষ্মীনাথের অন্তরেও রয়েছে। মাতৃভূমির কথা ভেবে তার মনটাও ভারী হয়ে পড়ল।
হেমচন্দ্রকে বিদায় দিয়ে লক্ষ্মীনাথ ভেতরে প্রবেশ করল। প্রজ্ঞা ঘরোয়া কাজে ব্যস্ত। কাজের মেয়ে রাখলেও সে সবসময়ের জন্য থাকে না। নির্দিষ্ট কাজটুকু করে চলে যায়। বাকি সময়ে সমস্ত কিছু একাই করতে হয়– প্রজ্ঞার অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু তার জন্য কোনো অভিযোগ নেই। বিরক্তি নেই।
কোনো ধরনের ভূমিকা না করে লক্ষ্মীনাথ জিজ্ঞেস করল, সে যদি অসমে যায়, অসমে বসবাস করতে শুরু করে, তাতে প্রজ্ঞার কোনো আপত্তি আছে কিনা?'
' তুমি যেখানে থাকবে, আমাকে তো সেখানেই থাকতে হবে।'
বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ ভালোভাবেই জানে, ঠাকুর বাড়ির কোনো সদস্যই কলকাতার বাইরে অন্য জায়গায় থাকতে চায়না। এমনকি বঙ্গের ঢাকা, বিক্রমপুর, চিটাগাং, খুলনা, যশোরেও যেতে চায়না। তার মধ্যে অসম– অসম সম্পর্কে তাদের ধারণা খারাপ এবং তার প্রভাব প্রজ্ঞার উপরে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। তাই অসমে স্থায়ীভাবে থাকার কথাটার প্রত্যক্ষ বিরোধিতা না করলেও অন্তর থেকে প্রজ্ঞা চাইবে না।
অভিমানের সুরে প্রজ্ঞা বলল, স্থায়ীভাবে থাকার বিষয়ে বিবেচনা করার আগে লক্ষ্মীনাথ কি একবার তাকে অসমে নিয়ে যাবে না? বিয়ে হওয়ার তিন বছর পার হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত তার শ্বশুরবাড়ি দেখার সৌভাগ্য হল না। বাপের বাড়ি থেকে এখানে এই ভাড়া ঘরে আসার গত চার মাস ধরে অসমে যাওয়ার কথা শুনছে, এটা ওটা অসুবিধার কথা বলে লক্ষ্মীনাথ বারবার যাওয়াটা পিছিয়ে দিচ্ছে।
না, এবার যেতেই হবে। বাবার স্বাস্থ্যটা ভালো নয়। মা বাবা প্রজ্ঞাকে দেখতে চাইছে। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞার পূজনীয় দাদাদের কথা উল্লেখ করে বলল যে তারা তাকে অসমে পাঠাতে চাইবে না। অসম দূরে, অসম বনে জঙ্গলে ভরা, অসমে কালাজ্বর–।
লক্ষ্মীনাথের কন্ঠে ব্যঙ্গাত্মক সুর প্রকাশ পাওয়ায় প্রজ্ঞা চটে উঠল,' বাজে কথা বল না। বরের সঙ্গে আমি আমার শ্বশুরবাড়ি যাব। তার জন্য ওরা আমাকে বাধা দিতে পারে না।'
মুচকি হেসে লক্ষ্মীনাথ বলল,' আসামে তোমার নিরাপত্তা সুরক্ষিত কিনা এ নিয়ে তাদের চিন্তা করাটা স্বাভাবিক।'
' ওরা যখন তোমার সঙ্গে আমাকে বিয়ে দিল, তখন থেকেই আমার নিরাপত্তার ব্যাপারটা তোমার উপর বর্তেছে।' প্রজ্ঞা বলল,' এ নিয়ে আমি বাপু তর্ক করতে চাই না। কথাটা হল, তোমার সঙ্গে আমিও আসাম যাব। আর শোনো, কয়েক মাস ধরে যাওয়া হবে বলে কথা চলছে– আমি বাড়ির সবার জন্য কাপড় কিনে নিয়েছি। বাবার জন্য একটা ভালো বেনারসি ধুতি আনতে হবে। এগুলির সঙ্গে বাবার ওয়েল পেইন্টিংটাও নিয়ে যাব।'
' ওয়েল পেইন্টিংটা নিয়ে যাবে!'
' কেন, অসুবিধাটা কী?'
' এতদূর! ট্রেইন, তারপর জাহাজ– নিয়ে যাওয়াটা ঝামেলা!'
' আমরা যেতে পারলে বাবার ওয়েলপেন্টিং টাও যাবে। আজই বিকেলে বেরিয়ে তুমি বাবার ধুতিটা কিনে আনবে।ওয়েল পেইন্টিংটা ভালোভাবে প্যাকিং করার জন্য কাগজও আনতে হবে।'
অসমে যাত্রার দিন ঠিক করা হল। খবরটা শুনে যথারীতি দাদারা বাধা দিল। ঠাকুর বাড়ির মহিলা মন্ডলের দুই একজন এ কথাও বলল যে অসমে যাচ্ছে যখন প্রজ্ঞা আর ফিরে আসবে না। তাদের এই অহেতুক আশঙ্কাটা লক্ষ্মীনাথকে ভীষণভাবে বিরক্ত করল। তবে কাউকে কিছু বলল না। সহৃদয়া শাশুড়ি মায়ের সম্মতি এবং প্রজ্ঞার আন্তরিক ইচ্ছার জন্য বাধা নিষেধগুলি দূর হল।
অবশেষে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল।
অসমে যাত্রা।
ঠাকুরবাড়ির কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরীকে সঙ্গে নিয়ে
লক্ষ্মীনাথের গৃহভূমি অসমে যাত্রা ।
এতদিন লক্ষ্মীনাথের কাছে এটা একটি স্বপ্ন ছিল । এখন সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিতে চলেছে ।
জোড়াসাঁকো থেকে বিদায় নিয়ে শোভারাম বসাক লেনে নিজের বাড়ি, সেখান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে শিয়ালদহ স্টেশন। শিয়ালদহ থেকে ট্রেইনে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে জলপথে উজিয়ে আসামে…।
কলকাতার বাইরে কত নতুন নতুন জায়গা, কত নতুন পরিবেশ, কত বিচিত্র বেশে বিচিত্র চরিত্রের সহযাত্রী। দীর্ঘ যাত্রাপথে খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা, ঘুমোনোর কষ্ট … অথচ অনভ্যস্ত প্রজ্ঞার চোখে মুখে অস্বস্তি নেই বা বিরক্তির চিহ্নমাত্র নেই। সঙ্গে স্বামী রয়েছে, এ পথ স্বামীর পরিচিত। তাই যাত্রাপথের কোনো অসুবিধাই প্রজ্ঞার অসুবিধা বলে মনে হচ্ছে না। বরং নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে ভ্রমণের আনন্দে প্রজ্ঞা উৎফুল্ল হয়ে পড়েছে। সেও উপভোগ করছে। স্বামীর সঙ্গে বসে কিশোরীসুলভ কৌতূহল নিয়ে এটা কি, ওটা কি জায়গাটার নাম কি এসব প্রশ্ন করছে। লক্ষ্মীনাথও পরম উৎসাহের সঙ্গে সমস্ত বুঝিয়ে বলছে। ধুবড়ি পার করে এবং একরাত জাহাজের কেবিনে কাটিয়ে গুয়াহাটিতে এল। গুয়াহাটি থেকে জাহাজ এগিয়ে গেল উজনি অসমের দিকে।
নদী বক্ষে চলমান জাহাজে প্রভাত। প্রভাতের আলো বহিঃ প্রকৃতিকে সপ্রাণ করে তুলল। কিছুক্ষণ পরে পূব দিগন্তে অরুণাভের উদয় হবে । সেই অরুণাভের প্রথম কিরণের অপূর্ব শোভা প্রত্যক্ষ করার জন্য লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞাকে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। ওপরের ডেকের আরাম চেয়ারটাতে দুজনেই পূবের দিকে মুখ করে বসল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কেবিনের বাথরুমে হাত পা ধুয়ে প্রজ্ঞা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে । ভেজা চুলগুলি তার পিঠে বিন্যস্ত । চোখে মুখে কোমল সজীবতা।
এদিকে হেমন্তের স্নিগ্ধতায় ব্রহ্মপুত্রের দুই পারের মাঠে শালিধান হেলছে দুলছে, কাছে কাছে ছবির মতো গ্রামগুলিতে জনপদ কর্মমুখর হয়ে উঠেছে, সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ব প্রকৃতির এক অপূর্ব দৃশ্য! লক্ষ্মীনাথ দৃষ্টি মেলে উদার প্রকৃতির দিকে তাকাচ্ছে আর তাকাচ্ছে প্রিয়তমা পত্নীর মুখের দিকে । তখনই পূব দিগন্তে রক্তিম আভা নিয়ে সূর্যের উদয় হল। সূর্যের প্রথম কিরণ প্রজ্ঞার মুখের ওপরে পড়তেই লক্ষ্মীনাথের মনে পড়ে গেল সেই স্বপ্নটির কথা কলকাতার জুরি গাড়ির জানালার কাছে বসে যাওয়া অপরূপ এক নারী, গাড়ির গতিবেগের সঙ্গে নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ… এবার লক্ষ্মীনাথ দৃষ্টি ফেরাতে পারল না।
'কী দেখছ এমন করে?'
ভাবনার আবেশে আড়ষ্ট কন্ঠে লক্ষ্মীনাথ বলল,' তোমাকেই দেখছি।'
' ইস, এভাবে দেখছ যেন আমাদের শুভদৃষ্টি হল।'
' শুধু শুভদৃষ্টি নয়গো,পরি। মনে হচ্ছে যেন হৃদয় দিয়ে জয় করে অপরূপা রাজকন্যাকে নিয়ে বিজয় নিশান উড়িয়ে রাজপথে নিজের সাম্রাজ্যের দিকে যাত্রা করেছি।'
' আবার কাব্য!'
' তুমিই তো আমার এই কাব্যের উৎস, প্রিয়ে।'
' বেশ!' মধুর হেসে প্রজ্ঞা বলল,' তোমাদের বাড়ি এই প্রথম যাচ্ছি– তোমাদের বাড়ির নিয়ম-নীতি সব আলাদা। কোথায় কি করতে হবে আমাকে শিখিয়ে- বুঝিয়ে দেবে কিন্তু।'
অবশেষে লক্ষ্মীনাথ সস্ত্রীক সগৃহে পদার্পণ করল। নিমেষের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল।
ঘরগুলি থেকে সবাই বেরিয়ে এল। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা এল। লক্ষ্মীনাথ কলকাতা থেকে শিবসাগরে এল। এবার বৌমাকেও সঙ্গে নিয়ে এল। বৌমা কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির বিদূষী কন্যা। প্রত্যেকেই ঘিরে ধরল। অবাক হয়ে প্রজ্ঞার সাজ পোশাক, দেহের অলংকার, রূপ সৌন্দর্য দেখল। তারপরে লক্ষ্মীনাথের বৌদিরা আদর যত্ন করে প্রজ্ঞাকে ভেতরে নিয়ে গেল। বৌমাকে পেয়ে ঠানেশ্বরীর আনন্দ আর ধরে না । বৈঠকখানা ঘরে পুথি পড়তে থাকা দীননাথও খবর পেয়ে লাঠিটা নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
এদিকে কলকাতা থেকে সাবধানে এবং অক্ষত অবস্থায় ওয়েল পেইন্টিংটা আনা হয়েছে। অন্যান্য কাপড় এবং উপহারের সঙ্গে বাবার জন্য আনা হয়েছে বেনারসি সিল্কের একটি ধুতি। পিতাকে আসতে দেখে লক্ষ্মীনাথ ওয়েল পেন্টিংটার ওপরের কাগজটা সরিয়ে দিল। প্রজ্ঞা সুটকেস খুলে ধুতিটা নিয়ে এল। বাবা শ্বশুরের হাতে সেটা তুলে দিয়ে প্রজ্ঞা তার দুটি পা স্পর্শ করে প্রণাম জানাল। তারপরে দুই হাতে ওয়েল পেন্টিংটা দীননাথের দিকে এগিয়ে দিল।
বয়স এবং বাতের অসুখে দুর্বল হয়ে পড়া দীননাথ প্রজ্ঞার দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। এ যে দেখছি সর্বগুণ লক্ষণযুক্ত অপরূপ সুন্দরী কন্যা । এর চোখে মুখে ভাব বিকারে দেখছি খারাপ কিছুই নেই। নেই অশুচি বা অপবিত্রতার কোনো চিহ্ন। আর এত রূপসী! মেখেলা চাদরের পরিবর্তে শাড়ি ব্লাউজেও তাকে অভিজাত বলে মনে হচ্ছে । কীভাবে একে অবহেলা করবে?...দীননাথের ডান হাতটা কাঁপছে। বাঁধানো পেইন্টিংটা নিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,' এটা কি?'
'এটা আপনার একটি তৈলচিত্র, বাবা।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' আপনার ছোটো একটি ফোটোগ্রাফ এনলার্জ করে তার থেকে এটি এঁকেছে।'
স্নেহকাতর পিতা দীননাথ আবেগে আকুল হয়ে প্রজ্ঞাকে বলল, 'বৌমা, তুমি আমার ছবি আঁকলে!'
ছবিটার দিকে তাকিয়ে দীননাথের চোখ দুটি সজল হয়ে পড়ল। তারপরে তিনি বড়ো সন্তোষ মনে বৌমাকে আশীর্বাদ করতে লাগলেন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন