হে আমার স্বদেশ- ৩৭
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(৩৭)(৩৭)
'... প্রাচীনকালে অসমে যে একটি সুসভ্য উন্নত দেশ ছিল, তাহা ধর্মশাস্ত্র উপাখ্যান কাহিনী ইত্যাদি আলোচনা করিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। যদিও সেই বিবরণ গুলির সত্যতা সম্বন্ধে নিখুঁত রূপে প্রমাণ করিবার কোনো উপায় নাই, তথাপি চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বৃত্তান্ত থেকে এই কথা প্রমাণিত হয়। পূর্বকালের কথা ছাড়িয়া দিলেও সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে আসাম যে একটি পরাক্রমশালী বৃহৎ ও সভ্য দেশ ছিল তা প্রমাণের কিছু মাত্র অভাব হয় না। সেই সময়ে আসামের পশ্চিম সীমায় ছিল করতোয়া নদী। সেই জন্য আজকালের উত্তরবঙ্গ ,রংপুর ,দিনাজপুর ,বগুড়া ,জলপাইগুড়ি আর ময়মনসিংহের একটি খন্ড আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। করতোয়া একটি বিখ্যাত নদী, মহাভারত ও অন্য পুরাণে করতোয়ার উল্লেখ আছে। মহাভারতের ভীষ্ম পর্বে করতোয়ার বিষয়ে লিখিত আছে,
'লৌহিত্যং করতোয়াং চ তথৈব বৃষ বাহুয়ম।'
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে আছে,
' করতোয়া মহাগৌরী দুর্গা চান্ত শিবা তথা।'
হিউয়েন সাং তাহার ভ্রমণ বৃত্তান্ত সেই কালের আসামী ভাষার সহিত অনেক বিষয়ে সৌসাদৃশ্য আছে বলিয়া লিখিয়াছেন। এখানে অবধান করিয়া দেখা আবশ্যক যে তিনি আসামী ভাষাকে বাংলা ভাষার অপভ্রংশ বা অন্য কোনো ভাষার শ্রেণীভুক্ত হইবার অযোগ্য (পেটোইচ) বলিয়া প্রকাশ করেন নাই। তিনি তাহাকে স্বাধীন অবস্থাতেই পাইয়াছিলেন এবং সেই হিসেবেই তাহার বিষয় উল্লেখ করিয়া গিয়েছেন। আরও একটি কথা যে এই সম্পর্কে বাংলা ভাষার নামও উল্লেখ করেন নাই। আজকাল বাংলা ভাষা যে রূপে গঠিত হইতেছে, সেইকালের সেই ভাষার অস্তিত্বের বিষয় সন্দেহ জন্মে। বরং প্রাচীন আসামি ভাষা আর মৈথিল ভাষার সংমিশ্রনেই বাংলা ভাষার ভিত্তি এইরকম সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে আমরা বাধ্য।
… পূর্বে হইতে আসামী জাতির প্রবাহ আসামে চলিয়া আসিতেছে, সেই একই প্রকারে আসামী ভাষার প্রবাহ আসামে আজ পর্যন্ত চলিতেছে। যেমন কোন বড় নদীতে ছোট ছোট অনেক শাখা নদী মিলিত হইলে তাহার জলের বর্ণ এবং আকারের পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে সেই একইভাবে আসামী ভাষারূপী বিশাল নদীতে অনেক শাখা ভাষার স্রোত মিশ্রিত হইয়া তাহার আকৃতি প্রকৃতির কিঞ্চিত পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে। তবু সে যে প্রাচীনকাল হইতে প্রবাহিত আসামী ভাষা লৌহিত তাহাতে সন্দেহ নাই।
… সেই কালের প্রকৃত পুরাতন আসামী ভাষার লিখিত ভাষার পুথি আমরা প্রাপ্ত হই না। কিন্তু ইহাও ঠিক যে শংকরদেব ,মাধব দেব কন্দলীয়া, পুরাতন আসামী ভাষা ব্রহ্মপুত্রের সমৃদ্ধিশালী নির্মল পূত সলিলে অবগাহন করিয়া তাহার তলদেশ হইতে তাঁহাদের শাস্ত্ৰরূপী উজ্জ্বল মালা গুলি গাঁথিবার জন্য মুক্তা চয়ন করিয়া আনিয়াছিলেন। তাঁহাদের রচিত পুঁথি গুলি পড়িলে স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাওয়া যায় যে তাঁহারা নিজেরা নতুন করিয়া ভাষা হইতে শব্দ ,বাক্য সংগ্রহ করিয়া স্ব স্ব গ্রন্থ রচনা করেন নাই। তাঁহারা যে একটি প্রবাহিত, জীবন্ত, সমৃদ্ধিশালী সাহিত্য ও ভাষা হইতে রত্ন সংগ্রহ করিয়া তাহার দ্বারা নিজের রচনা গাঁথিয়াছিলেন তাহার আর ভুল নাই। শংকর দেব এবং কন্দলীয়া অনেক স্থানে তাঁহাদের পুঁথির ভণিতাতে 'পূর্ব কবিদের গ্রন্থ দেখিয়া পুঁথি লিখিলাম বলিয়া স্পষ্ট স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।
… আজ পর্যন্ত রংপুর, দিনাজপুর, কুচবিহারের স্থানীয় ভাষা (যাহাকে বর্তমান বাংলা নিজস্ব বলিয়া আপনার আয়ত্তে আনিতেছে), বিশেষভাবে পরীক্ষা করিয়া দেখিলে দেখিতে পাইব যে সে ভাষা আসামী ভাষারই নিজস্ব জিনিস । আজকালের শক্তিশালী বাংলা ভাষার অধিকার তাহাতে নাই। থাকিলেও নামমাত্র।…'
এতটুকু পর্যন্ত পড়ে জ্ঞানদাভিরাম থামল। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে প্রবন্ধটির শেষে উল্লেখ করা বাংলার সঙ্গে অসমিয়াতে অনুবাদ করা ধাঁধা গুলি পড়তে লাগল। এই ধাঁধা গুলির অনুবাদে লক্ষ্মীনাথ দুটো ভাষার মিল অমিল গুলি যুক্তিপূর্ণ ভাবে তুলে ধরেছে। সেইসব ধীরে ধীরে পড়ে জ্ঞানদাভিরাম নিজের মনে অধিগত করল। তারপরে চুপ করে বসে সে চিন্তা করতে লাগল।
১৯০৮ সনের মার্চ মাসে ভোলানাথের সঙ্গে জ্ঞানদাভিরাম বিলেত গিয়েছিল। ছয় মাস বিলেতে থেকে নিজের উদ্দেশ্যে সফল হয়ে ভোলানাথ চলে এল। লন্ডনে থেকে ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জ্ঞানদাভিরাম ১৯০৯ সনের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় ফিরে এল।তার এই সাফল্যের জন্য লক্ষ্মীনাথ খুবই আনন্দিত হল। জ্ঞানদাভিরাম এখন অনায়াসেই কলকাতা হাইকোর্টে ও ওকালতি করতে পারে। কিন্তু ওকালতি করার চেয়ে বংশ পরম্পরা অনুসারে সে সরকারি চাকরি করা পছন্দ করে। তাই কলকাতায় থেকে সে এখন চাকরির জন্য চেষ্টা করছে ।
'কী হল জ্ঞান বাবা, প্রবন্ধটা শেষ করে তুমি চুপ করে রইলে যে ?'
লক্ষীনাথের কণ্ঠস্বরে ভাবনার বিভোরতা ভাবটা কাটিয়ে উঠে উচ্ছসিত কন্ঠে জ্ঞানদাভিরাম বলল, দাদু এটা একটি অসাধারণ প্রবন্ধ ।এটি প্রস্তুত করায় আপনাকে অনেক অধ্যয়ন করতে হয়েছে ।এটি একটি গবেষণাপত্র।'
' গবেষণা পত্র!
' এটি অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের জন্য একটি হিস্টরিক্যাল ডকুমেন্ট, ঐতিহাসিক দলিল।'
' আসলে, অসমিয়া ছাত্রসভায় পাঠ করা প্রবন্ধটার এটা একটি সংক্ষিপ্ত রূপ। তোমার জামাইবাবু ক্ষীরোদচন্দ্র রায় চৌধুরী বাবু যে সাহিত্য রসিক এটা আগে জানা ছিল না। কটকের রেভেন্স কলেজের প্রিন্সিপাল হয়ে সেখান থেকেই তিনি বাংলা ভাষায় একটি কাগজ বের করেন। তিনি সেই কাগজটির সম্পাদক। দেখা হলেই আমাকে প্রবন্ধ লিখে পাঠানোর অনুরোধ করেন। তবে আমি আর কোথায় বাংলায় প্রবন্ধ লিখব? পরে ভাবলাম, আমাদের অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের স্বতন্ত্রতা নিয়ে এখনও কিছুসংখ্যক বাঙালির মনে ভুল ধারণা থেকে গেছে। সেসব দূর করার উদ্দেশ্যেই একটা প্রবন্ধ লিখে তোমার দিদিমণিকে অনুবাদ করতে বললাম। তিনি বড়ো আগ্রহের সঙ্গে অনুবাদ করে' মৃন্ময়ী'র সম্পাদক ক্ষীরোদ বাবুর কাছে পাঠিয়ে দেন।'
' দিদিমণি এই ধরনের সিরিয়াস প্রবন্ধ একটা অনুবাদ করেছেন।'
' না জ্ঞান ,তুমি তাকে হালকাভাবে নিও না। তিনি হলেন ঠাকুরবাড়ির কন্যা প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী। শুধু রন্ধন বিদ্যায় পারদর্শিনী অথবা তৈলচিত্র শিল্পী নন। তিনি ভালো গান গান ,অভিনয় করেন। তাছাড়া ভালো সাহিত্য-বোদ্ধা। বিয়ের আগে ঠাকুরবাড়িতে থাকার সময় অভিনয় করছেন এক বছরের জন্য ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত 'সাধনা' পত্রিকার সম্পাদনা ও করেছিলেন।'
' তাহলে দিদিমণি অসমিয়া বুঝতে পারেন।'
' মোটামুটি ভালোই বুঝতে পারেন।'
' আপনি তাহলে দিদিমনির সঙ্গে অসমিয়াতে কথা বলেন না কেন?'
' তুমি একটা বড়ো স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রশ্ন করলে। এই একই প্রশ্ন নিয়ে একদিন মাজিউর সঙ্গে কথা হয়েছিল। অসমিয়া সাহিত্যচর্চা করি, অসমিয়া সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে অসমিয়া জাতি, অসমিয়া ভাষার উন্নতির জন্য এত লড়াই করি, বাঙালি এবং বাংলা ভাষার রাহু গ্রাস থেকে অসমিয়া ভাষাকে রক্ষা করার জন্য এত প্রতিবাদ করি, অথচ বাড়িতে পত্নী –কন্যাদের সঙ্গে আমি বাংলায় কথা বলি। এই নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়, আমার বিরুদ্ধে নানান কটুক্তি হয়। তবে জ্ঞান, প্রত্যেক মানুষেরই এক একটি দুর্বল এবং অত্যন্ত সংবেদনশীল বিন্দু থাকে। থাকে একেবারে আপন, অতি অন্তরতম এবং নিজস্ব কিছু সম্পদ। সংবেদনশীল সেই বিন্দুটিতে তিনি বড়ো অবুঝ,বড়ো একরোখা। আর সেই অন্তরতম এবং একান্ত সম্পদটিই তার শক্তি, সেটাই তার প্রেরণার উৎস।'
হাসি স্ফুর্তি করে থাকা লক্ষ্মীনাথকে গম্ভীর সুরে কথা বলতে দেখে জ্ঞানদাভিরাম অবাক হল। সঙ্গে এই ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করায় খারাপ হল ভেবে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়ল।
' দেখ জ্ঞান, বয়সে আমার চেয়ে ছোটো হলেও তুমি এখন বিবাহিত।' কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে লক্ষ্মীনাথ তারপরে বলল,' এখন তোমাকে এসব কথা বলা যেতে পারে। পরি, আই মিন তোমার দিদিমণিকে আমি ভালোবাসি। দেবতার আসনে বসিয়ে তিনিও আমাকে ভালোবাসেন।তাঁর ভালোবাসার মধ্যে আমি আমার সত্তাকে অনুভব করি। তার চেয়েও বড়ো কথা কি জান,তাঁর বাঙালি সত্তার মধ্যেই আমার অসমিয়া সত্তাটা বেশি করে সজীব হয়ে উঠে। কেবল পরির সঙ্গে নয়, কলকাতা অথবা কলকাতার বাইরে যেখানেই কোনো বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়, আমি যে বিন্দুমাত্র সংকোচ অনুভব না করে তাদের সঙ্গে বাঙালি হয়ে বাংলায় কথাবার্তা বলি, তখনও আমার চেতনা বোধে আমার অসমিয়া সত্তাটা জাগ্রত থাকে। তার জন্যই যেখানেই অসমিয়া জাতি বা অসমিয়া ভাষার কোনো অপমান হতে দেখি, তখনই প্রতিবাদ করি।'
জ্ঞানদাভিরাম অবাক হয়ে লক্ষ্মীনাথের দীপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কথাটা এভাবে বলতে পেরে লক্ষ্মীনাথের বুকের ভেতরে জমা হয়ে থাকা বহুদিনের ক্ষোভটা নাই হয়ে গেল। তারপরে মুচকি হেসে তিনি বললেন,' আচ্ছা জ্ঞান, তুমিও তো ঠাকুরবাড়ির কন্যা লতিকাকে বিয়ে করলে। এতদিনে লতিকা অসমিয়া শিখেছে কি?'
' একটু-আধটু শিখেছে। আরু শিখবে। শিখিয়ে নিতে পারা যাবে।'
' কলকাতায় না থেকে যদি গুয়াহাটি থেকে চাকরি কর, তাহলে গুয়াহাটির পরিবেশের লতিকা আরও দ্রুত অসমিয়া শিখবে।'
' দাদু –।' জ্ঞানদাভিরাম ভাবুক হয়ে পড়ল,' অসমিয়া বাংলা ভাষা নিয়ে আর ও কতদিন সংঘাত চলবে?'
' শিক্ষিত অসমিয়া বাংলা ভাষা-সাহিত্যকে সব সময় সম্মান করে, যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে বাংলা বই পড়ে। কিন্তু কিছু বাঙালি এখনও অসমিয়া ভাষার স্বতন্ত্রতাকে স্বীকার করে না বলেই সংঘাতটা লেগে আছে। এই দেখ, এই যে 'মৃন্ময়ী' কাগজে আমার ' প্রাচীন আসামের একটি ঝিলিক' শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রকাশিত হল– তার মধ্যে আমার প্রাচীন অসমের ঐতিহ্য এবং অসমিয়া ভাষার স্বতন্ত্রতার কথাগুলি উল্লেখ করা হয়েছে, সেইসব বাঙালি অধ্যাপক একজন স্বীকার করে নিতে পারেনি।'
' তিনি কে?'
' শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি।'
' যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যানিধি।'
' বিদ্যার একেবারে নিধি, অপরিমেয় পরিধি!' লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বরে ব্যঙ্গ, মহাশয় একজন প্রবাসী বাঙালি। কটক কলেজের বাংলা ভাষার অধ্যাপক ।বিদ্যার পরিধি মহাশয় আমি লেখা প্রবন্ধে উল্লেখ করা অসমিয়া ভাষার প্রাচীনতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রতিবাদী প্রবন্ধ একটি প্রকাশ করেছেন। এখন ,এখন আমি মনে মনে চুপ করে বসে থাকলে হবে কি? বাঙালি হয়ে বিদ্যানিধি মহাশয় যখন অসমিয়া সাহিত্যের ইতিহাসের ওপরে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখলেন, আমি সেটা একটা প্রত্যাহ্বান বলে স্বীকার করে ঢাল তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধে নামতেই হবে। 'বিদ্যানিধির প্রবন্ধটির নাম কি? '
'আসামের ও উৎকলের বঙ্গভাষা' 'মৃন্ময়ী'র পরের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
' দেবেন তো ,পড়ে দেখব।'
অবশেষে লক্ষ্মীনাথের জন্মদাতৃ ঠানেশ্বরী দেবী ১৯১০ সনের ১২ অক্টোবর দশমী তিথিতে ইহলোক ত্যাগ করলেন। গোলাঘাট থেকে দাদা বিনন্দচন্দ্র করা টেলিগ্রামটা পেয়ে লক্ষ্মীনাথ নিজেকে অনাথ অনুভব করতে লাগলেন।' মা, তুমি চলে গেলে' বলে অস্ফুট সুরে উচ্চারণ করতে তার চোখ থেকে জলের ধারা নেমে এল। খবর পাওয়ার পরের দিনই মায়ের শ্রাদ্ধের জন্য ৬০০ টাকা গোলাঘাটে পাঠিয়ে দিলেন। সেই বছরই ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ লক্ষ্মীনাথের শাশুড়ি মায়েরও মৃত্যু হল। খবর পেয়ে প্রত্যেকের সঙ্গে মৃতদেহ নিয়ে নিমতলা শ্মশানে নিয়ে দেহ সংস্কার করে আসার পরে লক্ষ্মী্নাথের এরকম মনে হল যেন জোড়াসাঁকোর সঙ্গে তার শেষ বন্ধনটাও শেষ হয়ে গেল ।
উপর্যুপরি দুটো মৃত্যু শোক সামলাতে একটু সময় লাগল। এদিকে কাঠের ব্যবসায় মন্দা অবস্থাটার উন্নতি হয়নি। এটাও লক্ষ্মীনাথের চিন্তার একটি কারণ। আগের তুলনায় ব্যবসায়িক যোগাযোগগুলি কমে এসেছে। বিক্রি আশানুরূপ নয়। কিন্তু সাংসারিক খরচ বেড়েই চলেছে। চুক্তি অনুসারে সময়ে টাকা পরিশোধ করতে না পারার জন্য সুদের পরিমাণ বেড়ে গেছে।
ব্যবসা থেকে আয় উপার্জন অধোগতিতে গতিকরা বুঝতে পেরেও লক্ষ্মীনাথ লেখালেখি কমিয়ে দেয়নি। বরং লেখালিখিতে আগের চেয়ে বেশি সময় দিচ্ছে। পাঠকের মধ্যে 'বাঁহী'র গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। বিশেষ করে নতুন লেখক এবং নবীন ছাত্রদের মধ্যে 'বাঁহী' নতুন জাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।'বাঁহী'র সম্পাদনার কাজের সঙ্গে শৈশব থেকে তার মানস জগতে আধ্যাত্বিক চেতনার অবিনশ্বর হয়ে বিরাজ করা পরম পুরুষ শ্রীশংকরদেবের জীবনী গ্রন্থ ছাপা হয়ে বের হল(১৯১১ সনের অক্টোবর)।
কেবল জীবনী গ্রন্থ ' শ্রী শংকরদেব' রচনা করেই লক্ষ্মীনাথ ক্ষান্ত হলেন না। তিনি ইতিপূর্বে কেউ না করা আরও একটি মহৎ কর্মে ব্রতী হলেন। শৈশবে রবীনাথ দাদু লক্ষ্মীনাথের সঙ্গী, কার্যের অভিভাবক, সাধুকথার কুকি এবং রামায়ণ, মহাভারত ,পুরাণ ইত্যাদি গল্পের ভান্ডার ছিলেন। গরমের দিনে বিকেলবেলা বারান্দায় এবং শীতের দিনে উনুনের কাছে বসে তার কাছ থেকে দাদা ভাইদের সঙ্গে বসে নানান গল্প শুনত। পুরাণের কাহিনি ছাড়াও দাদু রাজা-প্রজা, ভু্ প্রেত ইত্যাদির গল্প বলেও তাদেরকে আনন্দ দান করত, কখনও আবার ভয় দেখাত। সেই সব গল্প অসমিয়া জাতীয় জীবনের উপকথা, জনপ্রিয় জনশ্রুতি।সুন্দর কণ্ঠস্বর এবং আকর্ষণীয় ভাবভঙ্গিতে রবীনাথ দাদু বলা সেই গল্পগুলি লক্ষ্মীনাথের মনে এখনও অম্লান হয়ে রয়েছে। সেসবের কথা মনে পড়তেই লক্ষ্মীনাথ ভাবল, গল্পগুলি এখনও অসমিয়া সাহিত্যে অনাদৃত এবং মূল্যহীন হয়ে পড়ে রয়েছে। তিনি সেই সব সংগ্রহ করতে লাগলেন। সঙ্গে লেখার জন্য এরকম পরিকল্পনা করলেন যাতে শিশু কিশোররা পড়ে আনন্দ পায়, অসমিয়া জাতীয় জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, পরিবেশ সচেতন হয় এবং অধ্যয়নশীল হয়ে উঠে। তারপরে সেসব লিখে থাকার সময় লক্ষ্মীনাথ ভাবল, পরিকল্পিত সেই শিশু পুঁথিটির নাম দেবেন ' বুড়িমার গল্প'(বুঢ়ী আইর সাধু)।
গল্প লেখার মধ্যে ভাবনা চেতনার বিশেষ কোনো একটি মুহূর্তে লক্ষ্মীনাথ দুটো একটা কবিতাও লিখছেন অবশ্য কবিতা লেখার জন্য তিনি সুসংহত কোনো পরিকল্পনা করেন না। কবিতা হয় যদি হোক না হলে নেই বলে লিখেন যদিও অন্তরের ভাব উচ্ছ্বাসের কথাগুলি ছন্দ অলংকারে লিপিবদ্ধ করে তার ভালো লাগে।
কলকাতায় ব্যবসায়িক কাজের জন্য চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা দুদিনের জন্য লক্ষ্মীনাথের ' লরেন্স' এর অতিথি হল। বিকেলে নিজের পড়ার ঘরে বসে দুই অন্তরঙ্গ বন্ধুর মধ্যে আলোচনা জমে উঠল। যথারীতি আলোচনার শুরুতে ব্যবসার কথা উঠল। নিজের ব্যবসায়ের নিম্নগতির কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে ভোলানাথের ব্যবসার কথা উঠল ।ভোলানাথের ব্যবসা আগের চেয়ে বেড়েছে। উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জে রেললাইন পাতার জন্য স্লিপার সাপ্লাইয়ের কয়েক লক্ষ টাকার ঠিকাটা তিনিই পেয়েছেন এবং লণ্ডণেও বি বরুয়া কোম্পানির অফিস খুলেছেন শুনে চন্দ্রকুমার আশ্চর্য হল।
'বি বৰুয়ার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা ভালো হয়েছে। পুনরায় বি বরুয়া কোম্পানিতে ঢুকবে নাকি?'
' না ,ঢোকার প্রশ্নই ওঠেনা।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' বিজনেসের ক্ষেত্রে তার সঙ্গে আমার কোনো অ্যাডজাস্টমেন্ট হবে না। তাছাড়া তার সঙ্গে কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়েছিলাম বা পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে যে দেখা সাক্ষাৎ হয় আমাদের মধ্যে বিজনেসের কোনো কথা আলোচনা হয় না।'
' বিজনেসে ইন্টারেস্ট না থাকলে মানুষের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক রাখেন না। তোমাকে নিয়ে ভবিষ্যতে তার কোনো প্ল্যান আছে নাকি?'
' এটা প্রজ্ঞা সন্দেহ করে। আমি অবশ্য সেরকম ভাবি না। আসলে, অবিবাহিত মানুষ। ভুবনকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করলেও মানুষটা কখনও কখনও নিঃসঙ্গ অনুভব করেন বলে মনে হয়। তখন তিনি আমার খোঁজ করেন। আগের সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে আমি তার সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক রেখে চলি।'
এমনিতেই একদিন অন্যান্য দিনের মতো যতীন্দ্রনাথ এল। এখন সে বি এ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ইতিমধ্যে 'বাঁহী'ৰ পাতায় লেখা তার কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। সেই সবেৰ মধ্যে 'ভালপোৱা'( ভালোবাসা), 'আবাহন','পাহৰা সুর'( ভুলে যাওয়া সুর)' জাগরণ' ইত্যাদি অন্যতম। বিষাদভাবে পরিপূর্ণ যদিও কবিতাগুলির শিল্প মাধুর্য এবং পরিমিত শব্দের নির্বাচন সবাইকে আকৃষ্ট করে। যতীন্দ্রনাথ আসার সঙ্গে সঙ্গে দুই বন্ধুর আলোচনা অন্য মাত্রা পেল। বর্তমান অসমিয়া ভাষার তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন কবি যতীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে প্রবীণ গীতি কবি চন্দ্রকুমার বলল,' এই যে যদু ,গত কয়েকটি সংখ্যায়'বাঁহী'র পাতায় তোমার কবিতা দেখতে পাচ্ছি না। কবিতা লেখ।'
কবি হিসেবে যতীন্দ্রনাথ সবার প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে প্রচার বিমুখ, কিছুটা লাজুক স্বভাবের। সে ইতস্তত করে চন্দ্রকুমারের কথাটা অন্যদিকে ঘোরাতে চেষ্টা করতেই লক্ষ্মীনাথ বলল,' কী বললে আমাদের যদু কবিতা লিখবে!' হ্যাঁ, ওতো লিখছে।' চন্দ্রকুমার বলল,' আরও লিখবে। লিখতেই থাকবে।'
লক্ষ্মীনাথ হাসল। হাসতে হাসতে মজা করার উদ্দেশ্যে বলল,' ও ভালো কথা বলেছ ওকে কবিতা লিখতে বলে। তার চেয়ে তাকে বল' কাঁদুনি মেলা করার জন্য। চোখের জলের নদী বইয়ে দেবে। আমরা কখন কোথায় ভেসে যাব।'
যতীন্দ্রনাথের কবিতায় ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাস ব্যর্থ প্রেমের করুন স্মৃতি এবং সাংসারিক দুঃখে ভারাক্রান্ত হওয়ার ভাব থাকে। সেইসবের প্রতি ইঙ্গিত করেই লক্ষ্মীনাথ যে এভাবে কথাগুলি বলল সেটা বুঝতে পেরে যতীন্দ্রনাথও মজা করার উদ্দেশ্যে বলল,’আপনিও তো পেট্রয়টিক কবিতা লিখতে গিয়ে কেবল নাই নাই বলে নৈ্রাশ্যের কথা বলে থাকেন।যেমন-
ছিল একদিন আর নেই,ভাবলে বুক ফেটে যায়,
সুখের সূর্য অসমে,রাত আজ অদৃশ্য চক্রে;
নেই সেই মহাভারতের,বাণরাজা শোণিতপুরের
নরকাসুরের কামরূপ,বিধবার মতো বিরূপ
এসবের বাইরে আপনার আর কী বা লেখার আছে?’
সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে লক্ষ্মীনাথ বললেন,কী বললে যদু,অসমের লেখার কিছু নেই!’
‘বললাম না আপনার কবিতায় শুধু নাই নাই ।’
‘না,এখন আর না না লিখি না।আমাদের অসমে সব আছে।অসমে সব কিছু থাকার কথা কবিতায় প্রকাশ করব।’
চন্দ্রকুমার চোখ টিপে যতীন্দ্রনাথকে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে তর্ক করতে উৎসাহিত করল।কারণ চন্দ্রকুমার জানে ,এভাবে তর্ক করলে পরের দিন সেই বিষয়ে লক্ষ্মীনাথ ভালো প্রবন্ধ অথবা কবিতা একটা লিখে ফেলবে।অনেকক্ষণ তর্ক করার পরে যতীন্দ্রনাথ বলল, ‘কাকাবাবু,আমি জানি কাঁদুনি লেখা লিখে আপনাদের নদীর জলে ভাসিয়ে নিয়ে যাই।এখন আপনিও আশার বাণী বহন করা একটা কবিতা লিখে ফেলুন তো।‘
‘নিশ্চয় লিখব।‘
এই বলে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রইল।তারপরে পুনরায় হাসি-ঠাট্টায় মেতে অন্য কথা বলতে শুরু করল।পরের দিন বিকেলে দুই বন্ধুর আলোচনা চলতে থাকা সময়ে পুনরায় যতীন্দ্রনাথ হাজির হতেই চন্দ্রকুমার বলল, ‘শোন যদু,তুমি সফল,বেজের হাতে সত্যি ভালো একটা কবিতার সৃষ্টি হল।’
‘দিনতো দেখি কবিতাটা।’
লক্ষ্মীনাথের মুখে প্রসন্ন হাসি।তখনও মজা করে বললেন,’নেই,লেখার মতো কিছু নেই,কী দেব তোমাকে?’ তথাপি লক্ষ্মীনাথ রচনা করা টেবিলে রাখা কাগজটা যতীন্দ্রনাথের দিকে এগিয়ে দিল। আগ্রহের সঙ্গে কাগজটা নিয়ে যতীন্দ্রনাথ দেখল, কবিতাটির নাম 'বীণ বৈরাগী'। কবিতাটা পড়তে শুরু করল–
শোনো ওই বৈরাগী আনন্দ কাহিনি অসমের যশরাশি
হিয়া মোর হের বলবন্ত হোক, পরাণ উঠুক উল্লাসি
বাণ- ভগদত্ত- নরকাসুর,ভীষ্মকের গুণ গা।
ভাস্কর বর্মার কীর্তি সখ্যাতি শুনি হের' বীণ ,বা।
শংকর ,মাধব ,কন্দলীরা কী করল বীণ ক;
স্বর্গদেব রুদ্র সিংহ কি করল,বল বীণ ,কেন থেমে আছিস?
বরদৈচিলা হেন চিলারায় দেওয়ান, নরনারায়ন রাজা,
কী কীর্তি রাখল,গা ঐ বৈরাগী, বাজা আরও একবার বাজা।'
কবিতাটা শেষ করে যতীন্দ্রনাথ আপ্লুত হয়ে বলল,' আজ পর্যন্ত আমি অসমিয়া ভাষায় এরকম সুস্থ আশাবাদ এবং স্বদেশানুরাগের ভাব প্রকাশ পাওয়া কবিতা পড়িনি।'
চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করল,' কবিতাটার মূল ভাবটা ধরতে পেরেছ কি?'
' অসমের প্রাচীন ইতিহাসের উল্লেখের সঙ্গে মূর্ত হয়ে উঠেছে নতুন অসমের এক স্বপ্ন।' যতীন্দ্রনাথ বলল,' কবিতাটি একটি সার্থক সৃষ্টি।'
দু একজন ছাড়া সাহিত্য কলা স্রষ্টাদের বৈষয়িক সমৃদ্ধির সঙ্গে সৃষ্টি প্রতিভার সম্পর্কটা বিপরীত। সদাগর ভোলানাথের সঙ্গে থেকে লক্ষ্মীনাথ কাঠের ব্যবসাটা ভালোভাবেই শিখেছিল। কিন্তু ক্ষুরধার বুদ্ধির সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্থান কাল পাত্র বিচার করে যেরকম কৌশল অবলম্বন করতে হয়, সেটা লক্ষ্মীনাথের দ্বারা হয় না। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য প্রতিটি মুহূর্তে যে কেবল ব্যবসার কথা চিন্তা করতে হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে কার্যসূচী কিছু গ্রহণ করতে হয় সেটা তার দ্বারা সম্ভব নয়। সাহিত্যপাঠ, সাহিত্য লেখা তো আছেই।'বাঁহী'র জন্য সংগৃহীত লেখাগুলির সম্পাদনা, ছাপা খানার সঙ্গে যোগাযোগ, প্রুফ দেখা কাগজটার অঙ্গসজ্জার পরিকল্পনা, ছাপা হওয়ার পরে বিতরণ, বিক্রির ধন সংগ্রহ করা, পাঠকের চিঠিপত্র পড়ে সে সবের উত্তর লেখা …. নিয়মিত কাজ । অনেক সময় দিতে হয় । তারপরে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় সাহিত্য-সংস্কৃতি মূলক সভা সমিতিতে অংশগ্রহণ, হাওড়া কোর্টের অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন আদিতেও সময় এবং শ্রম দিতে হয়। তাই কাঠের ব্যবসার জন্য সে আর কতটুকু সময় পায় ? আয় দেখে ব্যয় করাটা যে একজন সফল ব্যবসায়ীর অতি আবশ্যকীয় গুণ , এটা বুঝতে পেরেও সেই অনুসারে লক্ষ্মীনাথ নিজেকে পরিচালিত করতে পারেনা। তাই লক্ষ্মীনাথের আর্থিক অবস্থাটা দিনের পর দিন খারাপ হতে লাগল।
আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য লক্ষ্মীনাথ বড় দুঃখের সঙ্গে ইন্ডিয়া ক্লাবের সদস্য পদ ছেড়ে দিল। অত্যন্ত দুঃখিত মনে ১৯১২ সনের মে মাসে হরিনাথকে আসাম বেঙ্গল স্টোর্সের ম্যানেজারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বলল।
ক্ষোভিত হরিনাথ দুদিন পরেই পরিবার এবং সাত মাস আগে জন্মানো শিশুপুত্রটিকে নিয়ে গুয়াহাটিতে যাত্রা করল। ম্যানেজারের অতিরিক্ত হরিনাথ 'বাঁহী'র প্রকাশক ছিল। তার নাম বদলে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বসে লক্ষ্মীনাথ নিজেকে ‘বাঁহী’র প্রকাশকরূপে ঘোষণা করল।
হরিনাথের জায়গায় লক্ষ্মীনাথ উপেন্দ্রমোহন সিংহকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়ে নতুন করে ব্যবসা আরম্ভ করল।তবে ব্যবসা হবে কীভাবে? মূলধন নেই।ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছিল,এখনও পরিশোধ করতে পারেনি।নতুন করে ঋণ নেওয়ার কোনো উপায় নেই।ভোলানাথের কাছে সাহায্য চাইবে-না আর্থিক সাহায্য চেয়ে তার কাছে কীভাবে যাবে?এই সমস্ত নিয়ে কয়েকদিন নিজের মনের মধ্যে আলোচনা করে অবশেষে অত্যন্ত বেদনাদায়ক একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ভারাক্রান্ত মনে ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।তার দিকে তাকিয়ে প্রজ্ঞার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল।
‘তোমার কী হয়েছে বলতো?’
লক্ষ্মীনাথ অসহায়ভাবে প্রজ্ঞার দিকে তাকাল। কী বলবে?কীভাবে বলবে?পত্নীকে কীভাবে নিজের ব্যর্থতার কথা বলবে?
‘কী হল,কথা বলছ না কেন?’
সীমাহীন মন খারাপ নিয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,পরি এ বড়ো লজ্জার কথা।খুবই অপমানের কথা।’
প্রজ্ঞা কাছে চলে এল। তারপরে স্নেহ মাখানো কোমল কন্ঠে হাসতে হাসতে বলল,' যুদ্ধে বিজয়ী হতে অভ্যস্ত সেনাপতি অবলা নারীকে নিজের সমস্যার কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে, অপমান বোধ করছে!'
'পরি, অমন করে বল না। জীবনের সব যুদ্ধ জয় করার মতো বীর আমি নই। চেয়ার থেকে উঠে লক্ষ্মীনাথ বলল,' বড় শখ করে তোমার নামে এই বাড়িটা কিনেছিলাম। ভেবেছিলাম এই বাড়িতেই আমরা আমাদের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু তা হবে না।'
' কেন?'
' বিজনেসের ক্যাপিটাল শেষ হয়ে আসছে। ব্যাংক বা অন্য কারও কাছ থেকে ধার নেওয়ার উপায় নেই। এখন একমাত্র উপায় এই বাড়িটা বন্ধক দিয়ে কিছু ক্যাপিটাল জোগাড় করা।'
'বন্ধক!'
' বন্ধক রাখলে হাজার দশেক টাকা পাব। তাও এমনিতে নয়, যে টাকা নেব তার সুদ গুনতে হবে।'
' তা তো গুণতে হবেই। তা নিয়ে চিন্তা করে মন খারাপ করছ কেন? ব্যবসায় উঠা–নামা থাকেই। এখন বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়ে ব্যবসায় খাটাও। লাভ হলে টাকা দিয়ে বন্ধক ছাড়িয়ে নেবে।'
' তোমার নামে এই 'লরেলছ'। বন্ধক দিতে তোমার খারাপ লাগবে না?'
' কী যে পাগলের মতো কথা বল না! আমি কি তোমার থেকে আলাদা ? তোমার বাইরে আমার কি কোনো অস্তিত্ব আছে?'
' বাড়িটা বন্ধক দিতে খারাপ লাগছে।'
' খারাপ লাগলেও উপায় তো একটা করতে হবে। তুমি বন্ধক দাও। আরেকটি কথা, তোমার খুব খরচের হাত। যেখানে ৫ টাকা লাগে সেখানে তুমি ৫০ টাকা খরচ কর। মেয়েদের জন্য প্রাইভেট টিউটর রেখেছ, ওদের পিয়ানো শেখানোর জন্য মিসেস ব্রাউন কে মাসে মাসে ফীস দিচ্ছ। টানাটানি চলছে যখন আপাতত টিউটরদের ছাড়িয়ে দাও।'
' না অরুণি রত্নার পড়াশোনা মিউজিক শেখানোর ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ হবে না।'
' তাহলে মালি আর বুড়িকে ছাড়িয়ে দাও। এতেও তোমার কিছুটা সুরাহা হবে।'
' আরে ওরা নেহাত গরিব মানুষ। ছাড়িয়ে দিলে কোথায় আবার কাজ খুঁজতে যাবে? কাজ না পেয়ে না খেয়ে থাকবে।না, আমি ওদের ছাড়াতে পারব না'।
পুনরায় একবার স্বামীর উদার দরদী হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে প্রজ্ঞার বুকটা ভরে উঠল। শ্রদ্ধা ভালোবাসায় লক্ষ্মীনাথের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,' মৃন্ময়ী'তে লেখা তোমার প্রবন্ধটির সমালোচনা করে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি 'আসামের ও উৎকলের বঙ্গ ভাষা' শীর্ষক যে প্রতিবাদ প্রবন্ধ বেরিয়েছে সেটার প্রতিবাদ লিখবে বলেছিলে, লিখেছ ?'
লক্ষ্মীনাথ আশঙ্কা করেছিল বাড়ি বন্ধক দেওয়ার কথাটা শুনে প্রজ্ঞা দুঃখে হতাশায় ভেঙ্গে পড়বে । কিন্তু কথাটাকে শুধু সহজ ভাবে নেওয়া নয় উল্টা প্রজ্ঞা তাকে ভরসা দিল, সাহস যোগাল। পত্নীর অন্তরের স্নেহ- ভালোবাসা পেয়ে তার অসহায় গ্লানির ভাবটা নাই হল। অন্যদিকে, অসমিয়া ভাষার স্বতন্ত্রতা রক্ষার যুদ্ধে তার প্রবন্ধটা বাংলায় অনুবাদ করে প্রজ্ঞা সাহায্য করেছিল। এবারও আগের মতোই সাহায্য করবে বলে আগ্রহ প্রকাশ করায় লক্ষ্মীনাথের অন্তরটা আনন্দে ভরে উঠল। সত্যিই প্রজ্ঞা প্রকৃতার্থে তার সহধর্মিণী। এবার লক্ষ্মীনাথ তার স্বাভাবিক মেজাজ ফিরে পেয়ে বলল,' হ্যাঁ আজই লিখব। তুমি তাড়াতাড়ি আমার জন্য জল খাবারের ব্যবস্থা কর।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন