শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ৩ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি । । মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi

 পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ৩

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  

Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi




তৃতীয় অধ্যায়, তৃতীয় অংশ ।। পাখিদের পাড়া- পড়শী

......

তৃতীয় অধ্যায়

তিন 

ফ্লাইট ফাইভ জিরো এইট সি।

কলকাতার সময় রাত বারোটা ত্রিশে প্লেইনটা 

কুনমিঙ অভিমুখে উড়ে যাবে। এখন সময় রাত এগারোটা বেজেছে।

আধ ঘন্টার মধ্যে হাতে থাকা টাকার কিছুটা য়ুবানে আর হিসাবের কিছু টাকা লাউ কিপে বদলে নিলাম।

আমার হাতে থাকা সাধারণ কাপড়-চোপড় ভরা ব্যাগটা নিয়ে আমি এগোচ্ছি চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের লাগেজ চেকআপ করার বিশেষ জায়গাটায়। ব্যাগটা এক্স রে মেশিনে পরীক্ষা করে সিকিউরিটি ট্যাগ ইত্যাদি লাগিয়ে দেওয়ায় এবার বোডিং পাশের দিকে এগিয়ে গেলাম। ব্যাগটা কাউন্টারের যথাস্থানে দিয়ে বোর্ডিং পাশটা নিয়ে অন্যান্য নিরাপত্তা জনিত কাজকর্ম গুলি সম্পূর্ণ করে লাউঞ্জে  এসে বসেছি। আমার হাতে একটা ক্যানন  ক্যামেরা। সিকিউরিটি চেক আপের সময় ক্যামেরার ব্যাগটিতে জলের বোতল ও ভরে রেখেছিলাম। লঙ্গে বসে দুটি ইংরেজি কাগজ এবং ম্যাগাজিনের পাতা এক দিক থেকে উল্টে যাচ্ছি। পেট ভর্তি, মোটেই ক্ষুধা লাগে নি, এমনকি যাত্রার উৎসাহের জন্য ঘুমও আসছে না। ফ্লাইটের সময় হয়েছে বলে ঘোষণা করায় অন্য যাত্রীদের সঙ্গে পাঁচ নম্বর গেটে এসে উপস্থিত হলাম।

এগারো  নাম্বার সারির এফ আসনটা আমার । জানালার পাশে। জানালার বাইরে কলকাতা বিমানবন্দরের উজ্জ্বল অনুজ্জ্বল আলোর রাশির বিচিত্র সমাহার। আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যয় বিধর্ম বিমানটি আমার আসনের সামনের মনিটরে সিনেমা দেখা থেকে শুরু করে গান শোনা পর্যন্ত সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা রয়েছে। আমি সেসবে ভ্রুক্ষেপ করছি না। আসনটাকে হেলান দিয়ে আমি শরীরটাকে আসনে ছেড়ে দিলাম। আরামদায়ক আসনটিতে  শরীরটা শোবার ভঙ্গিমা গ্রহণ করেছে। চাইনিজ এয়ার হোস্টেজ একজন কাছে এসে আমাকে বিমানটা টেক অন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানাল। আমি আসনটা পুনরায় চেয়ারের মতো করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

নির্দিষ্ট সময় বারোটা ত্রিশ  মিনিটের পাঁচ মিনিট আগে বিমানটা উড়ার প্রস্তুতি নিল। কয়েকজন এয়ার হোস্টেজ নিয়মমাফিক বিভিন্ন নিরাপত্তা বিষয়ক কলা কৌশল দেখাল। কৌশল গুলি দেখানো হয়ে গেলে ক্যাপ্টেন এয়ার হোস্টেস কয়জনকে নির্দিষ্ট আসনে বসার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বিমানটা ধীরে ধীরে চালাতে শুরু করলেন। বিমানটা পার্কিং প্লেস থেকে এসে রান ওয়ে পৌঁছাল। রানওয়েতে ধীরে ধীরে দৌড়াতে আরম্ভ করা বিমানটির গতিবেগ ক্রমশ বাড়তে লাগল এবং বিমানটি ভূভাগ ছেড়ে আকাশ মার্গে উড়তে লাগল। ঊর্ধ্বগামী হেলানো বিমানটি একটা সময়ে মাঝ আকাশে সুস্থির অবস্থা পেল। বিভিন্ন যাত্রী শোবার জন্য নিজের নিজের আসনটাকে হেলিয়ে নেওয়ায় আমিও তাই করলাম। বিমান পরিচারিকারা কে কী খাবে তার ফরমায়েস নিচ্ছে। ভূরি-ভোজন করে আমার উদর পরিপূর্ণ। আমি কিছুই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরিচারিকা জিজ্ঞেস করায় আমি ভদ্রতার সঙ্গে কিছুই লাগবে না জানালাম।

কুনমিঙ পৌঁছাতে পৌঁছাতে চিনের আকাশ রৌদ্র স্নাতা হয়ে পড়েছে। সম্পূর্ণ আট ঘন্টা আমাকে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে কাগজপত্র আর বই পড়ে আর মানুষ দেখে কাটাতে হবে। বিমান থেকে নেমে এসে আমি লাউঞ্জে বসেছি। বাইরে বেরিয়ে যাওয়া মানে পুনরায় সিকিউরিটি চেকআপ, কাস্টমসের চেকআপ, নানান ঝামেলা। অন্যদিকে আমার চাইনিজ ভিশা নেই। ঝামেলা কমানোর জন্য আমি লাউঞ্জে বসে থাকতে  বাধ্য হয়েছি। কুনমিঙ ব্যস্ত বিমানবন্দর। লোকজন আসছে যাচ্ছে। আমি খবরের কাগজের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছি। কফি কিনে খাচ্ছি। মাঝখানে গিয়ে নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম সম্পাদন করে এসেছি।

ব্যাগটা, ব্যাগটার কথা মনে পড়ায় আমি দ্রুত চারপাশে ব্যাগটা খুঁজতে লাগলাম। ধ্যাত, ব্যাগটা তো আমি ভিয়েতনামে পাব। আমি পুনরায় কাগজের পাতায় মনোনিবেশ করলাম। মাঝখানে একটু ঝিমুনির মতো এল।ঘুমের মধ্যে আবছাভাবে মাকে দেখতে পেলাম। চিতার আগুন দেখে এবং গুলি ফাটানোর শব্দ শুনে উড়ে যাওয়া বকের কয়েকটি ঝাঁক মানসপটে ভেসে উঠল। পাখিদের পাড়া-পড়োশির দু-একটি দৃশ্য আমার ঘুমের আমেজকে বিরক্ত করে দূরে চলে গেল। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার আমি এক কাপ কফির জন্য এগিয়ে গেলাম। পয়সাগুলি যুবানে না ভাঙ্গালেও চলে যেত। বিপনীটা  ডলারও গ্রহণ করে। আমার হাতে তো ডলারও ছিল না, তাই ডলার নেবার চেয়ে য়ুয়ান নিয়েছি, ঠিকই আছে।

বারোটার সময় কিছুটা ক্ষুধা পেল। চাইনিজ নুডুলস খাওয়ার ইচ্ছা হল। চিনে চাইনিজ নুডুলস খাওয়ার মজাই হয়তো আলাদা হবে। একটা বিপনিতে  আমি নুডুলস এবং কফির কথা বললাম। ছোটো ছোটো চোখ  এবং কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া চুলের পরিচারিকা  জিজ্ঞেস করল— ক্রস ব্রিজ রাইস নুডুলস? এখনকার নুডুলস বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। সেই জন্য আমি সম্মতি সূচক  ভাবে মাথা নাড়লাম। পরিচারিকাটিকে যথেষ্ট অতিথি পরায়ণ বলে মনে হল এবং সেই সাহসে ভর করে পরিচারিকাটিকে জিজ্ঞেস করলাম— চাইনিজ ভাষায় কি বলে?

—-গুও য়িয়া ও মিয়ান।

পরিচারিকাটি  আমি অর্ডার দেওয়া ক্রস ব্রিজ রাইস নুডুলসের চাইনিজ তরজমা করে নিল। জানিনা আমি কতটা শুদ্ধভাবে শুনতে পেয়েছি। তবে দাম শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। নুডুলস এর দাম ৭৬ য়ুয়ান এবং এক কাপ কফির দাম পঁচিশ ওয়ান। মোট একশত য়ুয়ান। ভারতীয় হিসেবে এক হাজার দশ টাকা । অর্থাৎ আমার দুপুরের খাবার খরচ আমার দশ দিনের খরচের সমান।

আমার কাছে বসা একজন সাদা চামড়ার বিদেশি লোক এক কাপ কফি হাতে নিয়ে কীসব বিড়বিড় করছিল। নুডুলসটা খেয়ে  কফির কাপটা হাতে নিয়ে আমি মানুষটার কাছে বসায় তিনি আমার কাছে তার আপত্তির কথা বলতে লাগলেন।

—একই কফি, আমি কুনমিঙের  রেস্তোরায় সকালবেলা খেয়ে এসেছি, ত্রিশ য়ুয়ান  নিয়েছে, এখানে নিচ্ছে ছিয়াত্তর য়ুয়ান। দ্বিগুণেরও বেশি।

— নেবেই। সমস্ত এয়ারপোর্টে একই ব্যাবসা। দিল্লির কফি হাউসে যে কাপ কফির দাম ষাট  টাকা, সেই কাপ কফির দাম এয়ারপোর্টে  ২৬০ টাকা। আমি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যাইনি, হয়তো সেখানেও একই ব্যাপার হবে।

বিদেশি ভদ্রলোক কফির কাপে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে কফি কাপের সম্পূর্ণ পয়সা উশল করার তৃপ্তি লাভ করার চেষ্টা করলেন।

দেড়টার সময় তিন নম্বর গেটের সামনে ভিয়েনটিয়েন  অভিমুখী বিমানের জন্য যাত্রীরা সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়াতে লাগলেন । আমিও এসে দাঁড়ালাম । একই ফ্লাইটের আসন সংখ্যা । সঠিক সময় দুটোতে বিমানটা যাত্রা আরম্ভ করেই মাত্র আধা ঘন্টার ভেতরে ওয়েট্টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হল । বিমানবন্দরে পুনরায় কিছুটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্য প্রসাধন কক্ষে প্রবেশ করলাম ।আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বলে প্রসাধন কক্ষ সমূহ আন্তর্জাতিক মানদন্ডের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ইমিগ্রেশন কাস্টমস চেক ইত্যাদি সম্পন্ন করে এবং কিছু পয়সা ভাঙ্গানোর জন্য বিদেশি মুদ্রা পরিবর্তন করা একটা কাউন্টারে গেলাম। লাওয়ের মুদ্রাকে কিপ বলা হয় । আমাদের এক টাকা একশত কুড়ি  দশমিক আটান্ন লাওয়ের সমান। এসব করে বিমানবন্দরের বাইরে যেতে চারটা বেজে গেল। 

আমি এখন বিদেশের মাটিতে। জীবনে প্রথমবারের জন্য বিদেশের মাটিতে পদার্পণ করার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমি দীর্ঘশ্বাস নেবার চেষ্টা করছি এবং চারপাশটা পলকে দেখে নিচ্ছি।

আমার এখন গন্তব্যস্থান ভিয়েনটিয়েনের সেন্ট্রাল বাস স্টেশন। বিমানবন্দর থেকে সেন্ট্রাল বাস স্টেশন প্রিপেইড ট্যাক্সিতে গেলে সাত ডলার নেয়।সাতান্ন  হাজার কিপ। নেটে বিভিন্ন পর্যটকের মতামত থেকে জানতে পেরেছি ভিয়েনটিয়েন সেন্ট্রাল বাস স্টেশনে যাবার ভিন্ন সবচেয়ে সস্তা হল বাস পরিবহন ব্যবস্থা। তার জন্য আমি বিমানবন্দর থেকে মূল পথে মাত্র পঁচিশ  মিটার পায়ে হেঁটে গেলেই হল। পায়ে হাঁটা মানুষের পেছন পেছন এসে আমি মূল পথটা পেয়ে গেলাম। এখান থেকে ত্রিশ  নম্বর বাসে উঠলে সেন্ট্রাল বাস স্টেশনে যাওয়া যায়। দূরত্ব মাত্র তিন  কিলোমিটার।ভাড়া চার হাজার কিপ। আমাদের ওখানকার টেম্পোর মতো এখানে টুকটুক চলে । এখান থেকে টুকটুকে সেন্ট্রাল বাস আড্ডার ভাড়া পঞ্চান্ন  হাজার কিপ। কিন্তু দরদাম করলে ভাড়ার পরিমাণ হয় ত্রিশ হাজার কিপ। আমি ত্রিশ নম্বর বাস ধরে ভিয়েনটিয়েনের সেন্ট্রাল বাস আড্ডায় পৌঁছে গেলাম । এখন এখান থেকে যেতে হবে ভিয়েনটিয়েনের সাদার্ণ  বাস স্টেশনে । দূরত্ব কুড়ি থেকে ত্রিশ মিনিট । ভিয়েনটিয়েনের সাদার্ণ বাস স্টেশনে যাওয়া পথটার নাম থার্টিন সাদার্ণ  রোড।


 এই বাস আড্ডা থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায়, বাসের চলাচল ছাড়াও আমি যেতে চাওয়া লাওয়ের ছাভানক্ষেত প্রদেশে যাবার জন্যও বাস পাওয়া যায়।সেন্ট্রাল বাস আড্ডা থেকে সাদার্ণ  বাস আড্ডায় উনত্রিশ  নম্বর বাসে যাবার সুবিধা আছে। ভাড়া নেয় দুই হাজার কিপ। টুকটুকে ভাড়া ষাট  হাজার এবং ট্যাক্সিতে নব্বই  হাজার কিপ। আমি অল্প নয় বেশ কিছু পয়সা বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। আমি আসা ত্রিশ নম্বর বাসটা সাদার্ণ বাস আড্ডায় ত্রিশ মিনিটে পৌঁছে গেল। বাসটার বেশিরভাগই বিদেশি পর্যটক বলে মনে হল।স্থানীয় সময় অনুসারে এখন সন্ধ্যে  ছয়টা বাজে ।ছাভানক্ষেটে আমাদের গন্তব্য বাসটার সময় আটটায়। এই বাসটাকে তারা ভিআইপি বাস বলে।বাসটা বাতানুকূল। বসে এবং শুয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে।বাসটাতে  শৌচাদি ক্রিয়ার ব্যবস্থা আছে। বসে গেলে ভাড়া এক লাখ দশ হাজার কিপ এবং শুয়ে গেলে এক লাখ কুড়ি হাজার কিপ। আমি অনলাইনে শুয়ে যাবার জন্য একটা টিকেট আগেই সংগ্রহ করে রেখেছি। লাওয়ের সমস্ত সুবিধা অনলাইনযোগে গ্রহণ করা যায়। নির্ধারিত দূরত্বে বাসটা আট থেকে নয় ঘন্টার ভেতরে পৌঁছে যায়।আমি  হাতে কিছু সময় থাকায় বাস আড্ডাটা ঘুরে দেখলাম। সহজ সরল ভাবে সুন্দর করে সাজানো । প্রাচুর্যের  চিহ্ন নেই । 

আটটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বাসটা যাত্রা  আরম্ভ করল। বাসের বাইরে ঘোরতর অন্ধকার ।কিছুই দেখা যায় না। হাতের ব্যাগটাকে বালিশ করে নিয়ে ক্যামেরাটা সাবধানে উপরে রেখেছি। পরিষ্কার এবং বাতানুকূল  বলে বাসটা ভালো লাগছে। ক্লান্তির জন্য ঘুম ভালো হওয়ায় রাতটা  কীভাবে পার হল আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না । সকালবেলা সাড়ে চারটার সময় আমার গন্তব্যস্থল ছাভানক্ষেট পৌছে গেলাম। ছাভানক্ষেট   বাস আড্ডায়  সকালের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে।লোকগুলিকে দেখে আমার ইম্ফলের বাসআড্ডার কথা মনে পড়ে গেল।গাড়ির ডিজাইনের বাইরে এটা যেন জাতীয় চেহারা এবং পরম্পরায় আবৃত ইম্ফল বাস আড্ডা।

এটা লাওসের  ছাভানক্ষেট প্রদেশ।আকার আয়তনের দিক থেকে লাওসের  সর্ববৃহৎ প্রদেশ। জেলার সংখ্যা পনেরোটি। মাটির ক্ষেত্রফলের প্রায় ষাট  শতাংশ অংশ অরণ্যে পরিপূর্ণ।

আমাকে এখন এখান থেকে অনলাইনে নির্ধারিত করে রাখা, ছালা থঙ্গোয়ন  নামের হোটেলটাতে যেতে হবে।হোটেলটা এই বাস আড্ডা  থেকে দুই কিলোমিটার এবং মেকং নদী থেকে নাকি দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ মেকং নদী থেকে কত দূরে অবস্থিত তার দ্বারাই যেন দূরত্ব মাপে ।টুকটুকের চালকের কথা থেকে আমি তাদের এরকম মনোভাব জানতে পারলাম।

 টুকটুকের চালকটিকে  বললাম আমি ছালা থঙ্গোয়ন  নামের হোটেলটাতে যাব।

ভাড়ার কথা বলায় আমি বললাম ভাড়া হোটেল দেবে। আমি এখানে কোনো দাম দর করব না।টুকটুকের চালক আমাকে ছালা থঙ্গোয়ন  নামের হোটেলটার সামনে নিয়ে  গিয়ে গাড়িটা রাখল।

-- তুমি ভাড়াটা হোটেল থেকে নিয়ে নাও।

চালক কাউন্টারে গিয়ে বলায় হোটেলের পরিচারিকা তাকে ভাড়াটা দিয়ে দিল ।

  অযথা তর্ক বিতর্ক  দরদাম থেকে রেহাই পাবার জন্য আমি এই ব্যবস্থাটিকে গ্রহণ করলাম জানিনা সময়ে হিতে বিপরীতহয় কিনা।

দুই লাও ভগ্নি  পরিচালনা করা ছালা থংগোয়ন  হোটেলটিতে মাত্র দশটি ঘর। তুলনামূলকভাবে হোটেলটিতে থাকার খরচ যথেষ্ট কম প্রতিদিনের জন্য আটশো ছয় টাকা।হোটেলের সামনে একটি কাঠের নাম ফলকে লেখা আছে-- ‘ওয়েলকাম টু ছালা থংগোয়ন বাংলো।’

  আমি হোটেলের ভেতরে ঢুকে গেলাম। ছোটো সাধারন অথচ স্থানীয় রূপে সাজানো অভ্যর্থনা কক্ষে একজন লাও নারী। হয়তো দুই বোনের একজন।

হোটেলে ইংরেজি থাই এবং লাও ভাষা চলে। নেটে হোটেলটিতে থাকা বিভিন্ন সুবিধার বর্ণনা দেওয়ার সময় এই তিনটি ভাষা জানা মানুষের সুবিধা থাকার কথা জানিয়ে রাখা হয়েছে ।সেই জন্য আমি বিনা দ্বিধায় ইংরেজিতে সামনের পরিচারিকাটির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম।

-- ওয়েলকাম।

 পরিচারিকাটি  আমাকে স্বাগত জানাল।

  --থ্যাঙ্ক ইউ। আজকে থেকে  থাকার জন্য আমি হোটেলে অনলাইনে একটি ঘর বুক করেছিলাম।

  --আপনার নাম, আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?

  জনজাতীয় মুখাবয়বের পরিচারিকাটি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।

 আমার নাম এবং আমি ভারতীয় বলে বলায় তিনি আমাকে সাত  নম্বর ঘরটা আমার জন্য সংরক্ষিত করে রাখা আছে বলে জানালেন। তারপরে তিনি হোটেলের পঞ্জীয়ন খাতাটা বের করে আমাকে আমার নাম ঠিকানা লিখে দিতে বললেন। পাসপোর্টের কথা জিজ্ঞেস করায়  আমি পাসপোর্টটা বের করে দেওয়ায় তিনি সেটার একটি ফটোকপি করে নিয়ে  আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। গতানুগতিক এবং রুটিন মাফিক কাজগুলি হওয়ার পরে তিনি আমাকে তার পেছন পেছন যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন।

--আসুন আপনাকে আপনার ঘরটা দেখিয়ে দিই।

  আমি পরিচারিকা অথবা হোটেলের দুই বোনের কোনো একজনের পেছন পেছন যেতে লাগলাম।

 গাছ বনে সাজিয়ে তোলা চৌহদে দেখতে পাওয়া প্রায় ভাগ তরুগুল্ম  আমার পরিচিত। অসমিয়া লোক নিজের চৌহদ  সাজানোর জন্য এই ধরনের গাছপালা যেভাবে ব্যবহার করে এখানেও সেরকম ব্যবহার করে দেখতে পাচ্ছি। জীর্ণশীর্ণ একটি পেঁপে গাছের ডালে কয়েকটি পেঁপে ধরে আছে । টকো এবং নারকেলের গাছ দেখে নিজের জায়গায় আসার মতো মনে হচ্ছে। নিজের জায়গায় রয়েছি বলে মনে হচ্ছে। নৈমিত্তিক কর্ম সম্পাদন করার জন্য আমি দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম ।বাতানুকুল পরিবেশ থেকে বাইরে থাকার ফলে গায়ে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছিল। শরীরে মাথায় জল  ঢালার পরে সেই অস্বস্তির অবসান  হল। বাইরে তাপমাত্রা ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক নয়। ফ্যানের বাতাসের নিচে  আমার ঘুমের ভাব হল। তখনই একজন পরিচারিকা আমার জন্য এক কাপ লাল চা নিয়ে এল। আমি এই চায়ের কাপের অপেক্ষায় ছিলাম । চায়ের কাপ টেবিলে রেখে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল সকালের  আহার আমি এখানেই খাব কিনা?

আমি বললাম—হ্যাঁ।

--কী খাবেন?

  সে আমাকে জিজ্ঞেস করল ।

যেহেতু এখানে কী পাওয়া যায় আমি জানিনা এবং এই মুহূর্তে এসব নিয়ে সময় নষ্ট করার মতো ইচ্ছা আমার ছিল না। কেবল ঘুমোতে ইচ্ছা করছিল। তাই বললাম নুডুলস

  --ননভেজ

  --হ্যাঁ ননভেজ। এক ঘন্টা পরে দিলেই হবে বলে বলায় সে মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল।

  ঠিক এক ঘন্টা পরে একটা ট্রেতে একটা নুডুলসের বাটি এবং সঙ্গে আমার জন্য অপরিচিত কয়েকটি পদ খাবার জিনিস নিয়ে পরিচারিকা আমার ঘরে এল। পরিচারিকাটির বয়স পঞ্চাশের উর্ধ্বে ।দেখলে মনে হয় আমি নাম পঞ্জীয়ন করার সময় সাক্ষাৎ করা পরিচারিকাটির মতো একই বলে মনে হয়। আমি তাকে সাধারণভাবে  স্বাগতম জানালাম। সে টেবিলের উপর খাদ্য সামগ্রীর ট্রেটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল।

সে  চলে যাবার পরে আমি নুডুলসের বাটিটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। খাবার জিনিসের প্রতি আমার কোন বৈষম্য নেই সেতে পারা ধরনের হলে আমি সমস্ত খাদ্য সামগ্রীকে গ্রহণ করি নুডুলস এর বাটিটা হাতে নিয়ে দেখতে পেলাম পালংশাক,ভাজা রসুন ও মুরগির মাংসের রান্না করা নুডুলসটা খেতে বেশ স্বাদযুক্ত।বিশেষ কোনো মশলা ব্যাবহার না করে সিদ্ধ করে রান্না করা হয়েছে। ক্ষুধার তাড়নায় আমি পুরোটা দিয়ে পেট ভরিয়ে নিলাম। 

খাওয়া-দাওয়া শেষে আরও দশ মিনিটের মতো বিশ্রাম নিয়ে আমি  পরিচারিকাটির কাছে এলাম।

আমাকে আপ্যায়ণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকা বলে মনে কর পরিচারিকাটিকে জিজ্ঞেস করলাম ডং সিথুয়ান গ্রামটা কত দূরে কোন জেলায়?

  --অ’ভিলেজ ফরেষ্ট্রি!দুর আছে। আমি যাইনি বলে ভালো করে জানি না। আপনি যেতে চান নাকি?

-- হ্যাঁ যেতে চাই

  আমার উত্তর শুনে সে কারও সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করল। তারা লাও ভাষায় কথা বলছে। কথা বলার সময় মানুষটা ফোনটা খামচে ধরে আমাকে জিজ্ঞেস করল ট্যাক্সি লাগবে।চাই কি?

আমি মাথা নড়লাম। তিনি পুনরায় ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লে কিছুক্ষণ মানুষটার সঙ্গে কথা বলে তিনি আমাকে বললেন আধঘন্টা পরে ট্যাক্সি এসে যাবে। গাড়ি ভাড়া আমি বন্দোবস্ত করে দিয়েছি। আপনি রাস্তায় চাইলেও একটিও কিপো দেবেন না।

  --কেন?

  আমরা বন্দোবস্ত করে দিলে তাদের ভাড়া কম হয় বলে ভাবে। বেশি টাকা নিতে পারে না যে!

  আমি পরিচালিকাটিকে বিশ্বাস করলাম।

নির্দিষ্ট সময় আধঘন্টা পরেই ট্যাক্সি চালক এল। সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বেশভূষায় একজন বয়স্ক চালক। হাসিমুখ। তাকে দেখে আমার এরকম মনে হল আমি যদি লাও ভাষা বুঝতে পারতাম এই ব্যক্তি আমাকে সারাটা যাত্রা পথে হাসির খোরাক জোগাতে পারত।

  আমি বিন্দুমাত্র দেরি না করে ডং সিথুয়ানের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জেলাটির নাম দুবার দুজনের মুখে শুনেও মনে রাখতে পারলাম না। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। চালক আমার সঙ্গে কথা বলছে। ভারতের কথা, অসমের কথা ভারতে থাকা বৌদ্ধ ধর্মের তীর্থস্থান গুলির কথা। সে আমাকে আমি বৌদ্ধ না মুসলমান জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম-- আমি হিন্দু। হিন্দু ধর্ম কেমন জিজ্ঞেস করায় আমি খুব সংক্ষেপে হিন্দু ধর্মের বিষয়ে ব্যাখ্যা করলাম। অসমের এক শৃঙ্গের গন্ডারের কথা বললাম। চালক আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো ব্যবহার করতে শুরু করেছে। প্রায় তিন ঘন্টা পরে আমরা এসে জেলার সদর পেলাম। আমি ট্যাক্সি চালককে বললাম আমার গন্তব্যস্থান জেলা কৃষি এবং বন  বিষয়ার কার্যালয়। আমি চালক থেকে এ কথাও জানালাম যে কার্যালয়টিকে তারা ডাফো বলে।

আরক্ষীকে জিজ্ঞেস করে চালকটি আমাকে নির্দিষ্ট কার্যলের সামনে নিয়ে গেল।

 জেলা কৃষি এবং বন অফিসার নির্দিষ্ট সময়ে এসে কার্যালয়ে বসেছেন। মানুষটা প্রায় আমার বয়সী। আমাদের রাজ্যের যেকোনো জনজাতীয় অবয়বের পঞ্চাশ অনূর্ধ্ব ব্যক্তি। একজনের সঙ্গে আমি তার সাদৃশ্য দেখতে পেলাম। মানুষটা চশমা পরেছেন। অতি সাধারণ বেশভূষা ।আমি তাকে ভারতীয় ধরনে নমস্কার জানালাম। তিনিও প্রতি নমস্কার জানালেন। সম্ভবত ভারতীয় আদব কায়দা এবং রীতি-নীতির দ্বারা মানুষটা পরিচালিত। অথবা তাদের দেশেও আমাদের মতো নমস্কার দেবার নিয়ম আছে। আমি কথাটা জানতে পারলাম না। তিনি তাঁর নামটা বললেন কিন্তু আমি মনে রাখতে অপারগ হলাম ।নামটা জিজ্ঞেস করে লিখে রাখার জন্য আমার মোটেও ইচ্ছা হল না ।বিশেষ করে মানুষটির আন্তরিক ব্যবহারে ।আমি তাকে আমার উদ্দেশ্যের বিষয়ে জানালাম। তিনি আমার সঙ্গে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করলেন। তারপরে তাদের উদ্দেশ্য এবং কাজ করার ধরনের উপরে এক বিস্তৃত ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বলা কথাগুলি সম্পূর্ণ বিদ্যাতনিক ধরনের এবং যান্ত্রিক ছিল বলে আমার মনে হল। তার বলা কথাগুলি আমার কাছে ইন্টারনেটে উপলব্ধ হওয়া বিভিন্ন প্রবন্ধ আদির মৌখিক রূপ বলে মনে হয়েছিল।

  আমি তার সামনে ডং সিথুয়ানে যাবার প্রস্তাব রাখলাম।

তিনি বললেন যেতে পারেন আমরা কীীভাবে কাজ করছি এবং সুফল লাভ করেছি দেখে আসতে পারেন। 

সম্পূর্ণ বাধ্যবাধকতা থাকা একটি কমিউনিস্ট দেশের বিষয়ে একজন কোনো আপত্তি ছাড়াই এভাবে বলায় আমি আশ্চর্যানিত হয়ে পড়লাম। তিনি নাকি ব্যস্ততার জন্য দু'একদিন যেতে পারবেন না। আমি গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তিনি করবেন। আমি কোনো অনুমতি পত্রের প্রয়োজন হবে নাকি জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন আপনি দেখতে যাবেন, আপনাকে আমাদের দেশ ভিসা দিয়েছে। আপনি একজন পর্যটক আপনি নিশ্চয়ই যেতে পারেন।

ডং সিথুয়ান  একটি গ্রামের নাম। সেই গ্রামটিকে অরণ্য গ্রাম হিসেবে প্রতিস্থাপিত করে নাম রাখা হয়েছে ডং সিথুয়ান প্রোডাকশন ফরেস্ট।নামটি দেখছি  বেশি ব্যাবসায়িক বলে মনে হচ্ছে। ডং সিথুয়ান প্রোডাকশন ফরেস্ট দশটি গ্রাম নিয়ে হয়েছে এবং এখানে ছয়টি দল কর্মরত রয়েছে। তারা ব্যবহার করা মোট ক্ষেত্রফলের পরিমাণ ২১২ হাজার হেক্টর ।অফিসারটির কথা থেকে জানতে পারা গেল যে তারা সামূহিকভাবে অরণ্য সুরক্ষার চেয়ে অরণ্য উৎপাদনে বেশি মনোনিবেশ করেছে। সেই উৎপাদন একমুখী। একমাত্র কাঠ কেন্দ্রিক।

  অফিসারটি আমাকে য়ায়ৈ ফুজিটা, থমথন ভংভিছোক, হংফেট চানটাভোং এবং চোমভিলাই চান্থালেউনাভোঙের দ্বারা  ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘ডং ফুজয় এন্ড ডং সিথুয়ানে প্রোডাকশন ফরেস্টঃপেভিং দী ওয়ে ফর ভীলেজ ফরেষ্ট্রি’  নামে একটি গবেষণা পত্র তার ল্যাপটপ থেকে প্রিন্ট আউট করে নিয়ে বের করে দিলেন। সেটির উপরে আমি একবার চোখ বুলিয়ে দেখে বললাম-- ধন্যবাদ। 

আমার ধন্যবাদ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করার ভাব দেখিয়ে তিনি বললেন—এটাতে আপনি আমাদের সমস্ত ধরনের কাজ কর্মের বিষয়ে আদ্যোপান্ত পড়তে পারবেন।এটা পড়লে আপনি ডং সিথুয়ানে না গেলেও হবে।পাকে-প্রকারে মানুষটা আমাকে ডং সিথুয়ানে না যাবার জন্য বলছেন বলে মনে হল।

  তারপরে তিনি দেখালেন ‘ভিলেজ ফরেষ্ট্রি হেন্ডবুক’আমি বললাম—এটা আমি ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে নিয়েছি।

 অফিসারটি মুচকি হাসলেন।

 কথার মাঝখানে মানুষটা আমাকে এক কাপ লাল চা দিয়ে অভ্যর্থনা করতে ভুললেন না।

 অফিসারটি আমার সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বললেন যদিও তার কথা আমার কাছে অনেকটাই যান্ত্রিক বলে মনে হল।আমাদের দেশেও যদি গণ্ডারের হত্যার কথা কোনো বিদেশি নাগরিক জিজ্ঞেস করে সংশ্লিষ্ট বন অফিসার এভাবেই হয়তো নিয়মমাফিক উত্তর দেবে।

 অফিসারকে ধন্যবাদসূচক নমস্কার জানিয়ে আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

 এখন আমরা যাব ডং সিথুয়ান গ্রামে।

 পাহাড়ি পথে আমাদের ট্যাক্সিটা এগিয়ে চলল।রাস্তার দুপাশে হালকা জনবস্তি।চাং ঘর,মুরগি এবং শুয়োর পালন,শুকনো আবহাওয়া—পরিবেশটা আসমের কোনো একটি পাহাড়ি জেলার লাও সংস্করণের মতোই মনে হল।প্রায় দেড় ঘন্টার মতো সময় পরে আমরা ডং সিথুয়ান গ্রামে এসে উপস্থিত হলাম।যে গ্রামে আসার উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমি কয়েকটি নদী এবং কয়েকটি পাহাড় অতিক্রম করে এসেছি।

ডং সিথুয়ানে গ্রামে উপস্থিত হয়ে আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে শুরু করেছি।সঙ্গে চালক এবং ক্যামেরাটা।গ্রামের মানুষ আমার কোনো কথাই বুঝতে পারছে না।  

চালকটি  দোভাষীর কাজ করছে যদিও সে অরণ্য গ্রাম সম্পর্কে আমি জিজ্ঞেস করা প্রশ্নগুলি গ্রামের মানুষকে বুঝিয়ে বলতে পারে নি।আমি ‘ডিছ-ট্রিক লেভেল ফরেষ্ট কাম ইটি’এবং ফরেষ্ট ম্যানেজমেন্টের কথা জিজ্ঞেস করেছি এবং চালকটি  হয়তো গ্রামবাসীদের অন্য কিছু বলছে।ফলে আমি যা চাইছি সেই ধরনের উত্তরগুলি পাচ্ছি না। তাই আমি যতটা সম্ভব ক্যামেরার ব্যবহার করছি।তাঁরা প্রতিটি গাছকে চিহ্নিত করার জন্য ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করছে।অসমের চা বাগিচায় সেভাবে গাছকে চিহ্নিত করার পদ্ধতি আমি আগেই দেখতে পেয়েছি। আমাদের এখানে সাদা কালোতে লেখা হয় এবং এখানে দেখছি লাল কালিতে লেখা।গ্রামের মধ্যের এক জায়গায় গাছের চারা উৎপাদন কেন্দ্র একটাও দেখতে পেলাম।আমাদের এখানকার সামাজিক বনানীকরণের চারা উৎপাদন কেন্দ্রের মতো।পাহাড়ি গ্রামটির পথ ঘাটের মধ্য দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় আমি প্রতিটি পরিবারে বিভিন্ন ধরনের ছোটো বড়ো গাছ দেখতে পেয়েছি। কিছু পরিবারে দেখতে পেয়েছি  গাছগুলির নিচটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন,তাতে অরণ্যের পরিবেশ নেই। 

সামগ্রিকভাবে পরিবেশ অধ্যয়ন করায় এই গ্রাম যাত্রা আমার জন্য লাভ দায়ক হল।বিশেষ করে থমথন সানটাভোঙ নামের কৃ্ষকটির থেকে যে কথাটা জানতে পারলাম সেটা আমার অনেক উপকার করল।তাঁদের এখানে আমাদের এখানকার মতো জুম খেত করা হয়।ফলে অরণ্যের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সঙ্গে পরিবেশের গাঁথনির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।অরণ্য ধ্বংস প্রতিরোধ করার জন্য অরণ্য গ্রামের ধারণা তাদের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছে।কৃ্ষিজীবী গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের আর্থিক দিকটা অতিশয় দুঃখের।অরণ্য গ্রাম আরম্ভ হওয়ার পরে গ্রামবাসী লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে।লাওচে প্রতিবেশী দেশ সমূহকে কাঠ যোগান ধরে।তাঁদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের জন্য কাঠের ব্যাবসা অন্যতম।সানটাভোঙ আমাকে আন্তরিকতার সঙ্গে বলা কথাগুলি চালকটি দোভাষী হয়ে তর্জমা করে গেছেন।আমি এবার সানটাভোঙের দিকে আর একবার চালকের মুখের দিকে আমার মুখ ফিরিয়ে আমার প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি।

পর্যাপ্ত সময় গ্রামের চারদিকে ঘুরে-ফিরে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম।আমার কথায় চালকটি অসম্মত হওয়ার  কোনো প্রশ্নই উঠে না।

—বড়ো ক্ষুধা পেয়েছে।

আমি চালকটিকে বললাম।

--'খাও নিউ’তে খাব।হবে কি?

আমি বুঝতে না পেরে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম—কোথায়?

--খাও নিউ মানে হল ‘লাও ষ্ট্রীট ফুড’।

আমি চালকের কথায় সম্মতি জানালাম।পর্যটকদের জন্য এখানে কী ধরনের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে আমার জানার প্রয়োজন ছিল।

--সেখানে পাওয়া সমস্ত খাদ্য পরম্পরাগত ভাবে প্রস্তুত করা হয়।

 চালক এভাবে বলায় আমার মন আনন্দে ভরে উঠল।শুনতে পেলাম লাওচে পশ্চিমী খাদ্যের প্রচলন নেই।সেই জন্য হয়তো ছালা থঙ্গোয়নের মেনুতে আমি সাধারণত দেখতে পাওয়া স্যাণ্ডউইচ,বার্গার,টোস্ট ইত্যাদি পশ্চিমী খাদ্যের নাম দেখতে পাইনি।নিজেকে চিনতে পারা এবং নিজের পরিচিতি বহন করে চলার জন্য খাদ্য সম্ভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।দেশটি নিজের খাদ্য সম্ভারকে সুরক্ষা দিতে জানে বলেই লাওচে বিদেশি পর্যটকের সমাহার অন্য এক কারক বলে ভাবার কারণ আছে।ভবিষ্যতের কার্যপন্থার হেতু কথাটা আমার জন্য মনে রাখার দরকার আছে।

চালকটি একটি ‘খাও নিউর’সামনে গাড়ি এনে রাখল।দোকানটা দেখতে আমাদের এখানে এক সময় চলা পিসিও বুথের মতো,সবুজ রঙে আবৃত।দোকানের নিচের ভাগে বিভিন্ন খাদ্য সম্ভারের আলোক ছবি সজ্জিত করে রাখা হয়েছে।

--এখানে সর্বাধিক জনপ্রিয় খাদ্য দ্রব্য কি?

আমি চালককে জিজ্ঞাসা করলাম।

--জ’,চিয়েন চাভান এবং থুম মুক হ্ং। 

চালক কী বলল আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকায় এবার সে ইংরেজিতে বলল।

--ষ্টিকি রাইস,লাও বীফ জার্কি এবং পাপায়া সালাড।

কথাটা বলার সময় চালকের মুখটা লালায় ভরে উঠেছিল বলে মনে হল।

--বীফ?

বড়ো স্বাদের।খাবার পরে বলবে।

--আমি বীফ খাই না।ভারতবর্ষে দুই একটি গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে হিন্দুরা বীফ খায় না।

 চালক এরকম ভাব করল যেন কোথাও সে মারাত্মক একটা ভুল করে ফেলেছে।সে আমার সামনে দুঃখ প্রকাশ করে আমি নিরামিষ খাই নাকি জিজ্ঞেস করল।

 --বীফ ছাড়া সমস্ত মাংস খাই।

 --তাহলে আপনি ‘খাও পিক চেন’খান।হোম মেড চিকেন নুডলস স্যুপ।

 আমি তার কথায় সম্মতি জানিয়ে আঠালো ভাত,পেঁপের সালাড এবং বাড়িতে প্রস্তুত করা মুরগির নুডলস স্যুপ আনতে বললাম।আর চালককে বললাম আপনি বীফ খেলেও আমার কোনো আপত্তি নেই।আমি এই ধরনের শুচিবাইগ্রস্ত মানুষ নই।চালক আমার জন্য খাবার জোগাড় করে নিজে কিছুটা দূরে খেতে গেল।আঠালো ভাতটা আমাদের বরো চালের ভাতের মতো,কিন্তু ধবধবে সাদা।পেঁপের সালাডটা খেতে খুব সুস্বাদু।ছোটো ফুটো থাকা চালনি দিয়ে নুডলসের মতো লম্বা লম্বা করে কাটা।সঙ্গে ঝাল,নুন ইত্যাদি মিশ্রিত করেছে।চিকেন নুডলস খেতে আমাদের এখানকার স্যুপের মতোই,কেবল সসের ব্যবহার নেই বলে মনে হল।আমরা দুজনের দুপুরের আহারে প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ হল।বিভিন্ন বিদেশি লোক ‘খাও নিউ’তে ভিড় করেছে।তাদের দেখে আমার এরকম মনে হল যেন প্রত্যেকেই ‘লাও বীফ জার্কি’র প্রতি আগ্রহান্বিত।এটা লাওচের স্থানীয় খাদ্য।

 আমার ভবিষ্যত কর্মপন্থায় স্থানীয় খাদ্যের গুরুত্ব এক মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।‘খাও নিউ’ থেকে আমরা সেই অনুপ্রেরণা লাভ করলাম।     


  

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...