শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das) এগার (১১) বৈজ্ঞানিক এবং আবিষ্কারক বেঞ্জামিন

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





দশ

(১০)

বৈজ্ঞানিক এবং আবিষ্কারক বেঞ্জামিন

  বেঞ্জামিন তার শৈশব থেকে নানা ধরনের সরঞ্জাম আবিষ্কার করে এবং যন্ত্রপাতির সঙ্গে খেলাধুলা করতে ভালবাসতেন। এই বিশেষ প্রতিভা তিনি পিতার কাছ থেকে জন্মসূত্রে লাভ করেছিলেন ।নানা ধরনের সমাজ সেবার কাজ এবং গভীর অধ্যয়নে নিমগ্ন হয়ে থাকার সময়ও তিনি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম উদ্ভাবন করার চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। উদাহরণস্বরূপ ফিলাডেলফিয়ায় আসার কিছুদিনের মধ্যে তিনি এক ধরনের নতুন যান্ত্রিক উনুন নির্মাণ করেছিলেন। ফিলাডেলফিয়া স্টোভ নামের এই যান্ত্রিক উনুনটি এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে অনেকে তার নকল করে ইউরোপে রপ্তানি করেছিল। বেঞ্জামিন ইচ্ছা করলে তার যান্ত্রিক উনুনটির পেটেন্ট নিয়ে , অর্থাৎ তার বিনা অনুমতিতে অন্যে সেটা নকল করে নির্মাণ করতে না পারার আইনগত ব্যবস্থা করে অনেক টাকা রোজগার করতে পারতেন। কিন্তু বেঞ্জামিনের টাকা রোজগারের কোনো ইচ্ছা ছিল না। তার যান্ত্রিক উনুনটি মানুষের উপকারে আসুক– তিনি শুধু এটাই চেয়েছিলেন।

  ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে গড়ে উঠার পরে বেঞ্জামিন অনুভব করলেন যে এখন তিনি সমাজ জীবন থেকে অবসর নিয়ে জীবনের বাকি থাকা সময়টুকু বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং অধযয়নের জন্য উৎসর্গ করতে পারেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি স্পেন্স নামের একজন ইংরেজ বৈজ্ঞানিকের কাছ থেকে কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কিনে নিয়ে বিদ্যুৎ শক্তির বিষয়ে গবেষণা করতে শুরু করলেন। এটা ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। এভাবে গবেষণা করে থাকার সময় একদিন তিনি বিদ্যুৎ শক্তির সাহায্যে একটি মোরগকে মারতে গিয়ে চেষ্টা করে নিজেই প্রায় মরতে বসেছিলেন। সে যাই হোক না কেন, তাঁর বিদ্যুৎ শক্তির গবেষণা এই ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

 বিদ্যুৎ শক্তির বিষয়ে মানুষ প্রথমে করা প্রায় সমস্ত পরীক্ষা ছিল স্থির বিদ্যুৎ সম্পর্কীয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিকরা বিদ্যুৎ প্রবাহের সম্ভাবনা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে শুরু করেন। এই ক্ষেত্রে অগ্রণীদের ভেতরে একজন ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন।১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি ঘুড়ি উড়িয়ে প্রমাণ করেন যে বিদ্যুৎ শক্তি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় প্রবাহিত হতে পারে। এই পরীক্ষাটির জন্য বেঞ্জামিন একটি সিল্কের ঘুড়ি তৈরি করে তার উপরে একটি সূঁচোলো তার জুড়ে দিলেন। ঘুড়িটি উড়ানোর জন্য ব্যবহার করা লম্বা লিনেন সুতার একটি প্রান্ত তারটির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তিনি অন্য প্রান্তে একটি সিল্কের ফিতা বেঁধে নিলেন। লিলেন সুতাটি পরিবাহী এবং সিল্কের ফিতাটি অপরিবাহী।সিল্কের ফিতাটার সঙ্গে জোড়া দেওয়া জায়গায় একটা চাবি বেঁধে দেওয়া হল। একদিন বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে তুফান চলে থাকার সময় তিনি সিল্কের ফিতাটা হাত দিয়ে ধরে থেকে ঘুড়িটি আকাশে উড়িয়ে দিলেন। তার পরে তিনি চাবিটার কাছে হাতের মুঠিটা আনলে চাবিটা থেকে বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে আসতে দেখতে পেলেন। এভাবে তিনি প্রমাণ করতে পারলেন যে মেঘ থেকে বিদ্যুৎ শক্তি ভিজে থাকা লিলেন সুতো দিয়ে চাবিটা পর্যন্ত বয়ে আসতে পারে। বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন ছিলেন সমস্ত দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারা বহুদর্শী মানুষ। এই পরীক্ষা করার সময় তিনি নিজেকে এবং সিল্কের ফিতাটাকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কারণ ফিতাটা ভিজলে তা বিদ্যুৎ পরিবাহী হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটাতে পারত। তিনি এই পরীক্ষাটি করার কিছুদিন পরে একজন রুশ বিজ্ঞানী একই পরীক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পড়েছিলেন।

  বিদ্যুৎ শক্তির গবেষণার ক্ষেত্রে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের এই চমকপ্রদ সাফল্যের পরে বৈজ্ঞানিক হিসেবে তার খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। তার গবেষণার ভিত্তিতে লেখা একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লন্ডনের বিশ্ব বিখ্যাত রয়েল সোসাইটিতে পাঠ করা হল। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি রয়েল সোসাইটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এটা ছিল একটি অতি দুর্লভ সম্মান। অবস্থা এরকম দাঁড়াল যে আমেরিকার চেয়ে ইউরোপের মানুষ বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার মূল্য অনেক বেশি উপলব্ধি করলেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা ফ্রান্সের সম্রাট পঞ্চদশ লুইয়ের মনোযোগ ও আকর্ষণ করল। সেই সময় জার্মানির শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট জীবিত ছিলেন। কান্ট বেঞ্জামিনকে নতুন প্রমিথিউস বলে আখ্যা দিয়ে অভিনন্দন জানালেন। গ্রিক পুরাণের মতে প্রমিথিউস মানুষকে দেবার জন্য স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন। বেঞ্জমিনও মেঘ থেকে বিদ্যুৎ শক্তি আহরণ করে প্রায় একই কাজ করেছিলেন। সেই জন্যই দার্শনিক কান্টের চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক যুগের প্রমিথিউস।

  আজকের দিনে ‘বাইফোকাল চশমা’ খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। কিন্তু এই বায়ো ফোকাল চশমা যে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন উদ্ভাবন করেছিলেন সে কথা খুব কম মানুষই জানে। মানুষের চোখে দূরের জিনিস দেখার এবং কাছের জিনিস দেখার ব্যবস্থা এক নয়। মানুষের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেলে বা অন্য কোনো প্রকারে তার বিকার ঘটলে মানুষ কখনও দূরের জিনিস ভালো করে দেখতে পারেনা এবং কখনও কাছের জিনিস ভালো করে দেখতে না পারার মতো অবস্থা হয়। কিন্তু কখনও দূরের এবং কাছের জিনিস ভালো করে দেখতে পারার ক্ষমতা একই সঙ্গে হ্রাস পেতে পারে।এরকম অবস্থায় মানুষকে দূরের জিনিস ভালো করে দেখার জন্য এক ধরনের চশমা এবং কাছের জিনিস ভালো করে দেখার জন্য অন্য এক ধরনের চশমা ব্যবহার করতে হয়। ফলে মানুষকে সব সময় দুই জোড়া চশমা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। মানুষের নানাবিধ ব্যবহারিক সমস্যার সমাধান করার জন্য নিজের মস্তিষ্ক খাটিয়ে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করাটা ছিল বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের বৈজ্ঞানিক চিন্তার একটি প্রধান লক্ষ্য।দুই জোড়া চশমা সবসময় সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অসুবিধাটা লক্ষ্য করে সেই সমস্যার সমাধান করার জন্য বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন চেষ্টা করলেন। তার ফলস্বরূপ উদ্ভাবিত হল ‘বায়োফোকাল চশমা’। এটা হল এমন এক ধরনের চশমা– যার দ্বারা মানুষ একইসঙ্গে দূরের এবং কাছের জিনিস ভালো করে দেখতে পারে। চশমা উদ্ভাবন করেছিলেন এমন একটি সময়ে– যে সময়ে তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের কঠিন দায়িত্ব পালন করে সব সময় তাকে ব্যস্ত থাকতে হত।

  বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হয়ে ফ্রান্সে থাকার সময় ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট মানুষ প্রথমবারের জন্য আকাশে বেলুন পাঠায়। সেই দৃশ্য দেখার জন্য সেদিন অন্যান্য মানুষের মধ্যে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনও উপস্থিত ছিলেন। একজন প্রথম শ্রেণির বৈজ্ঞানিক হিসেবে ইতিমধ্যে ইউরোপে তিনি সুপরিচিত হয়ে উঠেছেন। সেই জন্য সমালোচকদের মধ্য থেকে একজন কেউ তাকে জিজ্ঞেস করলেন–’ মানুষ প্রথমবারের জন্য আকাশে বেলুন ওড়াচ্ছে; এর ফলে মানবজাতির কোনো উপকার হবে বলে আপনি মনে করেন কি?’ উত্তরে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন বললেন–’ নতুন করে জন্ম হওয়া একটি শিশুর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা যা ভাবি, ঠিক সেই একই কথা বলা যেতে পারে প্রথমবারের জন্য আজ আকাশে ওড়া এই বেলুনটির বিষয়ে।’ সমস্ত কথায় বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন এতটাই দূরদর্শী ছিলেন যে আকাশে উড়তে পারা বেলুনটি মানুষের ভবিষ্যতের উপরে বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে বলে তিনি সেদিনই অনুমান করেছিলেন। উড়োজাহাজের আবিষ্কার হতে তখনও অনেক দেরি ছিল; কিন্তু যে বেঞ্জামিন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার আগে সেই দেশকে প্রথম শ্রেণীর বিশ্বশক্তি রুপে কল্পনা করেছিলেন, সেই বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন আকাশে বেলুন উড়তে দেখেই অনুমান করতে পেরেছিলেন যে এটা ভবিষ্যতে যুদ্ধবিগ্রহ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে বদলে দেবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...