বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০

একজন বুড়ো মানুষ || নিরুপমা বরগোহাঞি || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ~বাসুদেব দাস

 

একজন বুড়ো মানুষ

নিরুপমা বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ~বাসুদেব দাস



(৫)

ভূতে ইলার যত ভয়,ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিও ছিল ঠিক ততটাই। রান্নাঘরের এক কোণে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে একটা কাঠের বাক্সে ফুলতোলা নতুন গামছা পেতে দিয়ে কৃষ্ণের মুর্তি বসিয়ে প্রতিদিন বিকেলে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ধূপ ধুনো দিয়ে ইলাকে ভক্তিভরে পুজো করতে দেখা যেত। এই দৃশ্য বিজয়ের মনকে এক ধরনের পুলক আর আবেগ পরিপূর্ণ করে তুলেছিল। তার বিবর্ণ শ্রীহীন ঘরটা এক নারীর কল্যাণ স্পর্শে কী পবিত্র ,কী সুন্দর শান্ত হয়ে পড়েছে। জীবনটা যে এত সুন্দর,বেঁচে থাকার মধ্যে যে এত সুখ,এর আগে বিজয় কখনো অনুভব করে নি।

ইলার এই ঈশ্বর ভক্তি দেখে কিন্তু বিজয় ভূতের কথা নিয়ে ঠাট্টা করতে ভুলে যায় নি।‘ইলা তোমার যদি ঈশ্বরে এতই বিশ্বাস তাহলে ভূতে ভয় কর কেন?’

‘ঈশ্বরে আমি যতটা বিশ্বাস করি ভূতেও ঠিক ততটাই বিশ্বাস করি।‘

‘তোমার ঈশ্বর কি তোমাকে ভূতের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না?’

‘এই সমস্ত ছোটখাট ব্যাপারে মাথা ঘামানোর মতো ঈশ্বরের কাছে সময় নেই।'বিজয় হেসে ফেলল--তাই নাকি? আমি আরও ভেবেছিলাম ঈশ্বরের সময় অনস্ত। আচ্ছা,ঈশ্বর যদি ছোটখাট ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে বড় বড় ব্যাপারে থাকেন,তাহলে সেই বড় ব্যাপারের দুই একটি উদাহরণ দাও দেখি ইলা।'

বিন্দুমাত্র না হেসে সেদিন কিছুক্ষণের জন্য ইলা গন্তীর হয়ে পড়েছিল। তারপর গভীর কণ্ঠে বলেছিল –‘আমাদের বিয়ে।'

বিজয় আবার হাসল-‘আমাদের বিয়েতে ঈশ্বর উপস্থিত ছিলেন নাকি ইলা?’

“ছিলেন তো। নিশ্চয় ছিলেন।‘

পুনরায় হালকা কিছু বলতে গিয়ে এবার থমকে গেল বিজয়। ইলার মুখের দিকে তাকিয়ে সে দেখল জগতের সমস্ত বিশ্বাস এবং ঐকান্তিকতা যেন সেই সরল মুখটিতে এসে জমা হয়েছে | বিজয় কিছুক্ষণ কিছুই বলতে পারল নাতারপর বলল--ইলা,তোমার বাবা ভয় পেয়েছিল যে আমাদের পরিবারের আশীর্বাদ না হলে আমাদের বিবাহিত জীবন মঙ্গলময় না ও হতে রে। কিন্তু ঈশ্বর স্বয়ং যে বিয়েতে উপস্থিত থেকে আশীর্বাদ করে ,সেই বিয়ে কখনও অশুভ হতে পারে না,নয় কি ইলা? 

উত্তরে ইলা কেবল মাথা নাড়িয়েছিল,আর বিজয় দেখল কী এক অপূর্ব জ্যোতিতে ইলার মুখটা যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছ।

কিন্তু আজ মনে পড়ে যাওয়ায় এই ভেবে নিজেকে একজন পাষণ্ড বলে ভাবতে ইচ্ছা করে যে এত কিছুর পরেও ইলাকে পরীক্ষা করার জন্য তার মনে এক কুৎসিত কৌতুক জেগেছিল।

সেদিন কিছুক্ষণ ইলার মুখের দিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থেকে বিজয় হঠাৎ জিজ্ঞেস করল –‘আচ্ছা,ইলা তুমিতো আমাকে বিশ্বাস করে খুব নিশ্চিন্ত ছিলে ? যদি আমি শেষ পর্যন্ত তোমাকে বিয়ে না করতাম ,যদি তোমাকে ঠকাতাম ? বিজয়ের মাথায় সেদিন কী যে ভূত চেপেছিল,ইলা তার কথার কী জবাব দেয় তা জানার জন্য দুষ্টুমিভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

ইলার গহীন মুখটা করুণ হয়ে গেল,তারপরেই বিজয় দেখতে পেল ইলার চোখদুটো জলে ভরে এসেছে। কিন্তু সে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে দিল না। নিজেকে সংযত করে ধীরকণ্ঠে বলল --বাবা বলেন,সংসারে আসলে কেউ কাউকে ঠকাতে পারে না,অন্যকে ঠকাতে গিয়ে নিজেই ঠক খেয়ে যায়। যাকে ঠকানো হয় তার যতটুকু লোকসান হয়,যে ঠকায় তার লোকসান আরও বেশি হয়। বাবা বলেন যে, যে ঠকায় সে তার নিজের বিবেককে বিসর্জন দেয়। সেটা কি মানুষের জীবনে সামান্য ক্ষতি?

এতটুকু বলতেই ইলার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে ছিল। -‘আপনি কেন আমার সঙ্গে এই ধরনের বাজে ঠাট্টা করছেন? আমার মনে হয় না আপনার মতো মহৎ মানুষ জীবনে খুব বড় শক্রকেও ঠকাতে পারে?

ইলাকে প্রশ্নটা করেই ইলার করুণ মুখ এবং সজল চোখ দেখে বিজয় সঙ্গে সঙ্গে অনুতপ্ত হয়ে পড়েছিল । মনটা আত্মধিক্কারে ভরে গিয়েছিল। এখন ইলার কথাগুলো যেন তাকে চাবুক কষাল। সে কেবল বলল –‘তোমাকে না ঠকানোর মধ্যে আমার কোনো মহত্ত্ব নেই ইলা । আসল কথা হল -তোমাকে ঠকানোর জন্য খুব বড় ধরনের পাষণ্ডের প্রয়োজন। আর আমি পাষণ্ড হলেও খুব বড় ধরনের পাষণ্ড নই বোধহয়’।

বিয়ের পনেরো দিন যাবার পরে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিজয় একটা দৃশ্য দেখতে পেলঃ ওদের বসবাস করা বাড়ির পেছন দিকটার জমিতে বাদল মাটি কুপিয়ে চলেছে,আর ইলা সামনে দীড়িয়ে তাকে কীসব নির্দেশ দিয়ে চলেছে।

দাঁত ব্রাশ করতে করতে বিজয় বাইরে চলে এসেছিল। সে এই দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণের জন্য ব্রাশ করতে ভূলে গেল।

‘বাদল মাটি কুপিয়ে চলেছে কেন ইলা?’

‘কী যে বলেন,কেন আবার ,খেত করার জন্য ৷’

জানা কথা,খেত করার জন্যই জমি কুপিয়ে চাষের উপযোগী করা হয়। কিন্তু এত সহজ,সবার জানা কথাটিও যেন বিজয়ের জানা ছিল না। সে যেদিন শহরে বসবাস করতে গেছে সেদিন থেকে এইসবের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই।

গ্রামে থাকার সময়েও যে খুব একটা যোগাযোগ ছিল সে কথাও খুব জোর দিয়ে বলতে পারছে না। শৈশব থেকেই তার স্বভাবটা অন্য ধরনের । বাইরের কাজকর্মে তার কোনোরকম আগ্রহ নেই,কেবল পড়াশোনা করতেই ভালোবাসে । বাড়িতে অনেক লোকজন,তাই গ্রামের বাড়ি হলেও তাকে সেই সমস্ত কাজকর্মে যোগ দেবার জন্য কেউ বলত না। সে পড়াশোনা করছে,পড়াশোনা ভালোবাসে,তা নিয়েই থাকুক--বাড়ির সবার এটাই ছিল সাধারণ মত। শুধুমাত্র মা কখনও কাউকে হাতের কাছে না পেলে তাকে দাটা দিয়ে বলত ,যা তো বাবা  গাছ থেকে বড় লাউটা কেটে নিয়ে আয় গিয়ে। আমি মাছটা কেটে নিচ্ছি। এভাবেই হয়তো কোনোদিন লাউ কেটে এনেছে বা কপি খেত থেকে কপি নিয়ে এসেছে। ব্যস তার বেশি কিছু নয়। এরপরে তো হোস্টেলেই চলে গিয়েছিল। তারপর এক বছর কেটেছে চাকরি করে। এই বাড়িটা নেবার আগে সে যে বাড়িতে ছিল ,সেই বাড়িটা ছোট এবং ভাঙা ছিল যদিও কম্পাউগুটা ছিল বিশাল। সেখানে ভবিষ্যতে নাকি মালিকের বড় বড় ঘর তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। তাই তিনি বর্তমানের ঘরটা ভালোভাবে মেরামতও করছিলেন না। খুবই কম টাকায় ভাড়া দিয়ে রেখেছিলেন। সেই ঘরের সামনে জমি,পেছনেও জমি--সেই জমি মরুভূমিতুল্য হয়ে পড়েছিল। সে বসবাস করার সময় সেই জমিতে সামনের দিকে যেমন একটা ফুলের গাছও জন্মায় নি ,পেছনেও তেমনি লাউ গাছের চারা বা কিছুই জন্মায় নি। সেই সবই তার কাছে একেবারে অকল্পনীয় ছিল। আজ তাই এই সাধারণ কথাতেও বিজয় একেবারে অবাক হয়ে গেল। এই বাড়িতে তো আগের তুলনায় জমি প্রায় নেই বললেই চলে।

‘কোদালটা কোথায় পেলে?’ বিজয় দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল।

‘কোথায় পাব আর। বাজার থেকে কিনে এনেছি। আপনি যে অন্য কথা জিজ্ঞেস না করে প্রথমে কোদালের কথা জিজ্ঞেস করলেন -কোদালটা দেখে আপনার ভয় হচ্ছে নাকি আপনার- কোদাল মারতে হবে বলে? ভয় করলেও কিন্তু উপায় নেই,আপনাকেও কোদাল চালাতে হবে। বাদল একা পারবে না। তাছাড়া চাষের দিনও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে--অন্যের বাড়ির লাইশাক,পালংশাক খেয়ে বিরক্তি ধরে গেল,আমরা এখন চাষ শুরু করেছি,তাই জোর কদমে কোদাল না চালালে হবে না।'

বিজয় দাঁত ব্রাশ করতে ভূলে গেল--হাতের ব্রাশ হাতেই থেকে গেল--তুমি পাগল হয়েছ ইলা? আমার জীবনের অর্ধেক দিন গেল এই সমস্ত কাজ না করে,এখন তুমি আমাকে দিয়ে নতুন করে কোদাল ধরাবে? এখন এসব ছেড়ে আমাকে চা দাও’--অনেকটা বিরক্তির সঙ্গেই যেন এবার জোরে জোরে বিজয় দাঁতে ব্রাশ ঘষতে লাগল বিজয়।

ইলা আর তখন কিছুই বলল না-নীরবে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুক্ল।কিন্তু সেদিনই বিকেলে অফিস থেকে এসে বিজয় একটা দৃশ্য দেখতে পেল।ইলাকে ঘরের ভেতরে কোথাও  দেখতে না পেয়ে রান্নাঘরে খোঁজ করতে গিয়ে বিজয় বারান্দার সামনে থমকে দাঁড়াল। 

‘তুমি পাগল হয়েছ ইলা?’ বিজয় চিৎকার করে উঠল। সে চিৎকার না করে পারল না। কারণ সে দেখল কোদালটা হাতে নিয়ে কিছুটা ঝুঁকে ইলা সকালে বাদল কুপিয়ে রাখা মাটিতে পুনরায় কুপিয়ে চলেছে। ইলা যেন খুব লজ্জা পেয়েছে । কোদালটা সেখানেই রেখে দিয়ে ইলা প্রায় দৌড়ে চলে এল।

‘বাদল বাজারে গেল,তাড়াতাড়ি না পাঠালে চলে না,শীতের ছোট রাত,একটু পরেই বিকেল হয়ে যাবে। এদিকে চাষের দিনও প্রায় অতিক্রান্ত,দ্রুত না কোবালে কীভাবে হবে। আর এই মুহূর্তে আমার হাতে তো সেরকম কোনো কাজও ছিল না।একেবারে বসে থাকার চেয়ে কিছুটা শারীরিক পরিশ্রমও করা গেল। প্রামের মেয়েরা তো নিজেরাই চাষবাস করে ।’ স্বামীর কাছে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ইলা যেন কৈফিয়তের বন্যা বইয়ে দিল।

‘তুমি সত্যিই পাগল হয়েছ ইলা । বাজারে শাক-সব্জির এত আকাল হয় নি,যে তোমাকে সব্জি ফলানোর জন্য কোদাল চালাতে হবে-’

বিজয় আরও অনেক কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু ইলা মাঝপথে বাধা দিয়ে বলে উঠল –‘কেবল খাবার জন্যই মানুষ শাক-সব্জির চাষ করে নাকি-?’

‘তাহলে কিসের জন্য ?’ বিজয় কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল।

‘দেখার জন্যও --, ইলা হেসে ফেলেছিল-‘বাড়ির সামনে আর পেছনে জঙ্গল হয়ে থাকলে ভালো দেখায় কি? গৃহস্থ বাড়ির বাগানে দুই একটা শাক সব্জি না থাকলে ভালো দেখায় না। সকালে ঘুম থেকে ওঠে বাইরে বেরিয়ে এসেই বাগানটা ঘাস জঙ্গলে ভরা দেখলে আমার মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে যায়।'

এরপরে বিজয় আর কোনো উচ্চ-বাচ্য করল না। অফিস থেকে এসে কিছু মুখে না দিয়ে এই সব কথা নিয়ে সময় নষ্ট করার মতো ইচ্ছেও তার ছিল না। তাই দ্রুততার সঙ্গে পোশাক ছেড়ে এসে ইলার রাখা গরম চা-জলখাবারে মুখ দিল।

খাবার পরে বিজয় এমন একটা কাজে হাত দিল যার কথা ভেবে সে নিজেই অবাক হয়ে গেল। জীবনে প্রায় প্রথমবারের জন্য সে কোদালে হাত লাগাল। কেন তার এদিকে হঠাৎ মন গেল সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।

সেই যে শুরু । এর পরে বিজয়ের নিত্য-নৈমত্তিক কাজই হল সকাল বিকেল বাগানের গাছপালার যত্ন নেওয়া । একমাস পরে তাদের বাড়ির সামনে এবং পেছনে কারও যত্নের স্পর্শে সবুজ চারাগাছগুলো যেন হাসতে লাগল।

সেদিকে তাকিয়ে ইলা একদিন বিজয়কে জিজ্ঞেস করল-‘নিজের হাতে লাগান বাগানের এই চারাগাছগুলো দেখে আপনার এখন কেমন লাগছে?’

‘কেমন লাগবে আবার। ভালো লাগছে। বিজয় সেদিন ইলাকে সাধারণভাবে উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু ইলার ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিল একটু অন্যরকম। বিজয়ের মতো তা ঠিক আরোপিত ছিল না। গাছ-পালা লাগিয়ে,বীজ ছড়িয়ে অস্কুরের জন্ম দিয়ে ইলা যেন সৃষ্টির অপূর্ব আনন্দ লাভ করছিল। ইলার হাতে কোদাল দেখে একদিন উত্তেজনার বশে বিজয় হাতে কোদাল তুলে নিল,চাষ করল,এবং এই চাষ করা একদিন তার নেশায় পরিণত হল। পড়ার নেশার সঙ্গে দ্বিতীয় নেশা যোগ হল চাষ করা। কিন্তু ইলার ক্ষেত্রে বিষয়টা কেবল নেশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নেশার চেয়েও গভীর কিছু ছিল। বাগানটাকে যেন ইলা রক্তমাংসের সন্তানের মতোই ভালোবাসত। যখনই শাকসব্জি বা ফুলের মধ্যে যায় ইলা,একবার না একবার সে গাছের পাতা বা ফুলের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করবেই।

কতদিনই বা তারা এই বাড়িতে ছিল,মাত্র একবছর । কিন্তু সেই এক বছরেই ওরা দুজন বাড়িটার সামনে এবং পেছনে দুটো চিরস্থায়ী বাগান করে রেখে গেল। সামনের বাগানে গোলাপ এবং জবাফুলের গাছগুলো হয়তো এখনও রয়েছে। পেছনের বাগানে কুল,জলপাই,আমলকি,আম,কাঁঠাল ইত্যাদি ফলের গাছগুলোর ফল বোধহয় আজও সেই বাড়ির বংশধরেরা ভোগ করছে। বিজয় ভরালী কল্পনার চোখে একটা সমৃদ্ধ বাগানের রূপ দেখার চেষ্টা করল --যেখানে ফুলের গাছগুলি সুগন্ধি দেশি ফুলে,আর ফলের গাছগুলি নানা সুমিষ্ট ফলের ভারে  ঝুঁকে রয়েছে।কিন্তু সেই কল্পনা সঙ্গে সঙ্গে বিজয় ভরালীর থেমে গেল। গুয়াহাটি শহরে এখনও কি কেউ আর এতটা জমি ফুল আর ফলের গাছের জন্য অপচয় করতে পারে? একটা ফলের বাগানের বদলে একটা ঘর বানিয়ে ভাড়া দিলে মাসে কত টাকা আয় হবে-কমলা বোধহয় খুব ভালো বলতে পারবে। হঠাৎ কমলার কথা মনে পড়ে গেল কথাটা ভেবে ঠিক শেষ করার সঙ্গে,যেন অন্য কেউ বলা কথার সঙ্গে বিজয় ভরালী কমলার কথাটা যোগ করে দিল।তাঁর ঠোঁটে একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল।হ্যাঁ,কমলা বোধ হয় হিসেবটা ভালো করেই জানবে।কিন্তু ইলা বোধহয় জানত না।কেবল সেই যুগের মেয়ে বলেই নয়,আজকের যুগেও ইলা এই হিসেব জানত না।লাভের হিসেবে কাজ করতে তো ইলা কোনোদিন শিখল না।যে বাড়িতে এক বছরের বেশিদিন থাকে নি,সেই বাড়িতে এত ফুলের গাছ,ফলের গাছ লাগানোর কী প্রয়োজন ছিল ইলার। কত জায়গা থেকে যে চারা আর বীজ সংগ্রহ করেছিল ইলা। বাপের বাড়িতে থাকা গোলাপ,জবা ইত্যাদি ফুলের গাছের ডাল এনে লাগানো ছাড়াও বন্ধু বান্ধব যার বাড়িতে যত ধরনের গাছ দেখেছিল,সম্ভব হলে সেই সবের ডাল,চারা,বীজ না এনে ছাড়ত না ইলা। ইলার বিয়ের পরেই মামাতো বোনের বিয়েও হয়েছিল,গুয়াহাটি থেকে অনেক দূরে বিয়ে বলে ইলা যাবার আশা করায় বিজয় ইলার মা-বাবার সঙ্গে ইলাকেও যাবার অনুমতি দিয়েছিল। নিজে যেতে না পারল না। ছুটি নেই। নিজের বিয়েতে অফিস থেকে প্রাপ্য ছুটি গুলি খরচ হয়ে গিয়েছিল। বিয়ে বাড়ি থেকে চার পাঁচ দিনের মধ্যে ইলারা ফিরে এসেছিল,বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিজয়ের সঙ্গে একটা দুটো কথাবার্তা বলে ইলা বাদলকে নির্দেশ দিয়েছিল –‘বাদল ব্যাগ থেকে জিনিসগুলি বের করার সময় কাগজের পুঁটলাটা সাবধানে বের করবি,কয়েকটা গাছের চারা আছে।'তারপর বিজয়ের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তিভরা হাসিতে ইলা বলেছিল—‘আমার মামার ফুল বাগানের প্রতি এত সখ,এমন কোনো ফুলগাছ নেই যা তার বাগানে নেই।| আমিও মামার অনুমতি নিয়ে কয়েকটি ফুল গাছের চারা নিয়ে এসেছি।'

এতদিন ইলার বাগানের কোনো কাজে বিজয় কথা বলে নি,কত জনের কত রকমের ‘হবি’ থাকে,বোঝা গেল ইলার ‘হবি'বাগানে,তাতে বিজয়ের বলার কী আছে। কিন্তু সেদিন বিজয় আর চুপ করে থাকতে পারল না। সব কিছুরই একটা সীমা থাকে-এত দূরের একটা শহরে বোনের বিয়ে উপলক্ষে গিয়ে একগাদা গাছপালা বহন করে নিয়ে আসা দৃশ্যে সেখানে যে সমস্ত আত্মীয় রয়েছে তারা ইলার সম্পর্কে কী ভাবছে?

‘আচ্ছা ইলা,তুমি যে এই বাড়ির চারপাশে এত গাছপালা লাগিয়েছ,বাগান করেছ,কার জন্য? জানই তো,আমার বদলির চাকরি,দুদিন পরেই এই বাড়ি ছেড়ে আমাদের অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে,তখন এই ফুলের শোভা কে দেখবে,এই গাছের ফলই বা কে খাবে?’

‘কী যে বলেন আপনি?’--ইলা যেন বিজয়ের কথায় খুব অবাক হয়ে গেছে -মানুষ কোনো কাজ করার সময় কেবল নিজের কথা ভেবেই করে কি?আমার বাবা সব সময় বলেন –‘সুবিধা পেলেই আমাদের পরোপকার করা উচিত।'আপনারা স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে একজন বুড়োর বীজ বপন করার গল্প পড়েছিলেন না? বুড়ো বীজ বপন করেছিল--নিজে না খেতে পেলেও একদিন নাতি নাতনিরা খেতে পাবে । আমরা এখান থেকে চলে গেলেও সেই একইভাবে আমাদের পরে আসা মানুষেরা আমাদের বপন করা গাছপালা গুলির ফল ভোগ করতে পারবে ।

ইলার এই কথার পরে বিজয় আর কোনো কিছু বলেনি। এখন সেই স্মৃতিগুলি রোমন্থন করতে করতে বিজয় ভরালী ভাবল-ইলাতো বেশি পড়াশোনা করে নি।কিন্ত কথা-বার্তার মাঝখানে যখনই সুবিধা পায় তখনই সে পড়ার বইয়ের থেকে উদাহরণ তুলে দিত। যে অল্পকিছু পড়াশোনা করেছিল,তাকেই বোধহয় ইলা তার সমগ্র সত্ত্বা  দিয়ে আপন করে নিয়েছিল। আজ জীবনের প্রায় শেষ সীমায় উপনীত হয়ে বিজয় ভরালীর মনে প্রশ্ন জাগে-শিক্ষার প্রকৃত অর্থ কিঃ জীবনের সঙ্গে নয়—কেবল জীবিকার সঙ্গে সম্বন্ধ যে শিক্ষার, সেই শিক্ষা মানুষের জীবনকে কতটুকু দিতে পারে? ইলার চেয়ে কমলা কত বেশি শিক্ষিতা—কিন্তু ইলা নিজের সামান্য শিক্ষায় জীবনটাকে যেভাবে গড়ে তুলেছিল,তারচেয়ে হাজার গুণে বেশি শিক্ষা পেয়েও কমলা কেন জীবনের কোনো একটি কথায় সেই শিক্ষার আদর্শ না দেখিয়ে কেবল জীবিকার সংকীর্ণ গণ্ডিতে শিক্ষার মহত্ত্বকে বন্দি করে রাখলকিন্তু কমলা কি কখনও সেকথা বুঝতে পারবে?কমলার দৃঢ় ধারণা যে চাকরি না করলে এত লেখাপড়া সব বিফলে যাবে,অথচ অবাক হওয়ার কথা এই যে এত পড়াশোনা করা কমলাকে তিনি কোনোদিন ভালো কোনো বই পড়তে বা পড়াশোনার মাধ্যমে শিক্ষার চর্চাকে অব্যাহত রাখতে দেখেননি ।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...