ভাস্কর ঠাকুরীয়া লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ভাস্কর ঠাকুরীয়া লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

২০৮৪ || ভাস্কর ঠাকুরীয়া || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস

 ২০৮৪

ভাস্কর ঠাকুরীয়া 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস 



‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েই থাকে,তাই আমাদের অতীতের দিকে ঘুরে তাকানোর দরকার।প্রতিটি ক্লাসেই নয় কি?’বিদায় বেলায় প্রফেসর বিপ্লব ফুকন ছাত্র-ছাত্রীদের সে কথাই বললেন।ইউরোপের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে গৃহযুদ্ধ,প্রাকৃ্তিক দুর্যোগ,দুর্ভিক্ষে জর্জরিত স্বদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা তাঁর মতো অবস্থানে থাকা যে কোনো লোকের জন্যই আবেগ চালিত চরম মূর্খামি।কিন্তু প্রফেসার ফুকন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল,কোনো কিছুই তার মনকে টলাতে পারে না। 

‘শহিদ হওয়ার এতই যদি সখ এখানেই বন্দুক তুলে নাও,ইউরোপেতো গণশত্রুর অভাব নেই।’এনী কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল।তাঁর অধীনে গবেষণা করার সময়ই ওদের দুজনের মধ্যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের জলপানিতে দুজন অখ্যাত গণশত্রু লালুকসোলা এবং বদন বরফুকনের বংশগাঁথনি সম্পর্কে এনী গবেষণা করছিল।গত কয়েকদশকের ঘটনারাজি সৃষ্টি করা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সচেতনতা এবং বিপ্লব ফুকনের অহরহ যত্ন এবং জনপ্রিয়তার জন্য আজকাল ইউরোপের ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে পূর্ব হিমালয়ের যে কোনো বিষয়েই অধ্যয়ন করাটা ফ্যাশন হয়ে উঠেছে।হবে নাই বা কেন।ভূবিজ্ঞান,পরিবেশ বিজ্ঞান,গোলকীয় উষ্ণতা,সমাজবিজ্ঞান,চিকিৎসাবিজ্ঞান-প্রতিটি গবেষণার জন্য এই জায়গাটা উর্বরভূমি।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হয়তো শেষবারের জন্য স্বদেশ বলে উড়োজাহাজে বসলেন বিপ্লব ফুকন।আবহাওয়া যদি ঠিক থাকে প্রায় ছয় ঘণ্টার যাত্রাপথ।বসে পড়েই স্বভাবগত ভাবে কম্পিউটারটা খুলে বসলেন বিপ্লব ফুকন।স্মৃতিচারণার জন্য খুলে নিলেন শহিদ নামের ফাইলটা।তিনি ইতিহাসের মানুষ,তার মধ্যে এই অঞ্চল নিয়ে বিশেষজ্ঞ,এই সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় একটি টিভি চ্যানেলের জন্য একটা ছোট ছবি করেছিলেন।তারই প্রারম্ভিক স্থিরচিত্র,ভিডিও-অডিও সাক্ষাৎকার এবং শুটিঙের রাশ ফুটেজগুলো পুনরাবিষ্কার করে তার ভালো লাগল। প্রজেক্টটার অনেক বছর হয়ে গেছে।আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অঞ্চল্টির সমস্যাগুলো তুলে ধরায় বেশ সহায়ক হয়েছিল এই ছোট ছবিটা। প্রথমে তিনি স্থিরচিত্রগুলো খুলে নিলেন—কোনোটা উঁচু,কোনোটা বেঁটে,কোনোটা ভগ্ন-রাজ্যটির চারপাশে কেবল শহিদ বেদী।

নোঙরা বেদী,গোলাকার বেদী,পরিত্যক্ত বেদী-যেদিকেই তাকান না কেন,যেদিকেই না যান না কেন-চারপাশে কেবল শহিদ বেদী।রাজ্যের প্রতিটি অংশেই একটা নয় অন্য একটি বেদী দৃষ্টিগোচর হবেই। মাতৃভূমি যেন শহিদের কারখানা।

তখনই ভেসে উঠল তার আপন শহরের পুরোনো চৌরাস্তাটা।এখন জায়গাটা বসতি এলাকা।তার মাঝখানে আগে বীরদর্পে দাঁড়িয়েছিল সেই সুউচ্চ শহিদ বেদীটা।এখন সেটা ভাঙণের জন্য ভেঙ্গে যাওয়া রিফিউজিদের প্রস্রাবস্থল। হাতে অগ্নিশিখা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া বিপ্লবীর ভাস্কর্যের নিচে লেখা কবিতাগুলো আজকাল প্রস্রাবকারীর লক্ষ্যবিন্দু। যেন কোনো লক্ষ্যভেদী প্রতিযোগিতায় সোনার পদক পাওয়া যাবে কবিতাগুলোতে আঘাত করতে পারলে-এরকম একটি মনোভাব প্রতিজন প্রস্রাবকারীর মুখে।

আপনি জানেন কি আপনি এইমাত্র প্রস্রাব করা খুঁটিটা একটা একশো বছরের স্মৃতিফলক?’

‘ও আপনি আবার কোথা থেকে এসে হাজির হলেন? আমরা তো সে কথা জানতাম না।‘মানুষটা লজ্জা পেয়ে উত্তর দিয়েছিল।

‘১৯৮৩ সনে কী ঘটেছিল সেটা আপনি জানেন কি?’

‘সেটাতো একশো বছর আগের কথা,আমরা কীভাবে জানব?’ 

‘মৃত্যুও তো একটা শিল্প—এই কবিতাটা আপনি কোথায় পড়েছেন?’ 

লোকটি ইতস্তত করল।কিছুক্ষণ আগে তিনি সেই বাক্যের ওপরেই…

লোকটির অবস্থা দেখে ফুকনের রাগও হচ্ছিল,হাসিও পাচ্ছিল।ওদের সমগ্র জেলাটা ভাঙনে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে,তারপরে সাঁতরে-টাঁতরে পথে নানা স্বয়ম্ভু উগ্রপন্থী সরকারের নির্যাতন পার হয়ে এতখানি পথ অতিক্রম করে শরনার্থী হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।ওরা কী জানবে এই শহরের ইতিহাস,এখানে যাদের জন্ম হয়েছে তারাই দেখছি ভুলতে শুরু করেছে।স্থানীয় সরকার শুয়োরের খোঁয়ারের মতো থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ঠিক,কিন্তু অন্য কোনো ব্যবহার্য সুবিধা নেই,কী কদর্য জীবন।আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে যদি কোনো সাহায্যের বন্দোবস্থ না হয় যে কোনো মুহূর্তেই মহামারী আরম্ভ হতে পারে। এই সংস্থাগুলি কী করে বিপ্লব তাই ভাবে। সে ব্যক্তিগতভাবে,সরকারের হয়ে,এমনকি দুটো উগ্রপন্থী দল থেকেও নির্ভয় দান করে কতবার সাহায্যের আবেদন করল,কিন্ত এখনও আবেদনগুলি তাদের লালফিতার মারপ্যাঁচেই আটকে আছে।একসময়ের সবুজ অরণ্যে এখন খরা এবং সংঘর্ষ মরুভূমি সদৃশ করে তুলেছে। গ্লেসিয়ার গলে অঞ্চলটা একটি ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ করে তুলেছে,তার ওপরে এই  গোষ্ঠী সংঘর্ষ,দুর্ভিক্ষ মহামারীর দিনে হাজার হাজার মানুষ মরতে শুরু করেছে।কিন্তু এখনও এখানে কাজ করার জন্য ওদের চাই সরকার এবং উগ্রপন্থী দুদিক থেকেই সুরক্ষার পূর্ব শর্ত।তাহলেই তারা পুনরায় আরম্ভ করবে জনসেবার অভিযান। পাঁচ বছর আগে দুজন ইউক্রেনের চিকিৎসক হত্যারই পরিণাম এটি। অবশ্য এর ফলে লাভবান হয়েছে সরকার এবং অগণন সশস্ত্র দুটি দলই। সমস্ত জনহিতকরতার জন্য আসা সমস্ত টাকা পয়সা এখন খরচ হচ্ছে ওদের উচ্চস্তরের মানুষগুলির হাতে।

আসলে এর বিরুদ্ধে কথা বলার নীতিগত অধিকার বিপ্লবেরও নেই।কারণ এই ধরনের উপার্জিত পয়সায় সে কেমব্রিজের স্নাতক,সুইজারল্যাণ্ডের বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার,অনেক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এই অঞ্চলটির নীতি গঠনের সহায়ক পরামর্শদাতা।সেরকম এক অনুন্নত জায়গা থেকে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এসে পৌছানোর আড়ালে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার চেয়েও বিপ্লব ফুকনের পিতার প্রতিপত্তি এবং অগাধ  সম্পত্তির কর্তৃ্ত্ব হয়তো বেশি। সেকথাটা তিনি স্বীকার করেন। বিপ্লব ফুকনের পিতা বদন ফুকন একজন অভিজাত রাজনীতিবিদ। এত বছর রাজ্যে আসা সমস্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সাহায্য পুঁজি তিনিই তদারক করতেন।অনেকের মতে অন্য ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদকে হাতের মুঠোতে রাখার জন্য তিনিই দুটো উগ্রপন্থী দল সৃষ্টি করেছেন। বড়ফুকন তাই সমগ্র অঞ্চলেই সর্বজনের দ্বারা ঘৃণিত,কিন্তু তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো সাহস কারও নেই।পিতার সাহায্যেই বিপ্লব ফুকন নিজের জীবন বানিয়েছে সেই গ্লানির জন্যই নাকি তিনি এই অঞ্চলটির ইতিহাস,স্থাপত্য এবং সাহিত্যকেই নিজের কেরিয়ার হিসেবে গড়ে তোলেন।এই ছোট ছবিটার আড়ালের উদ্দেশ্য ছিল আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই অঞ্চলটির সমস্যা গুলির ওপরে আলোকপাত করা।

ঠিক তখনই মনিটরে ভেসে ঊঠল দাদুর স্মৃতিসৌধের ছবিটা।আকারে প্রকারে সেটাও একটা শহিদ বেদীই। কোনো সময়েই বাবার সঙ্গে সহজ হতে না পারার জন্য নাকি দাদু শৈশবে তাঁর একজন শ্রেষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল।এই অঞ্চল,তার ইতিহাসের আদিপাঠের প্রথম শিক্ষক ছিলেন দাদু।এই বিপ্লব নামটাও দাদুরই দেওয়া।দাদুর যৌবনের দিনের দুঃসাহসিকতার কাহিনি বিপ্লব ফুকনকে আজও চমকিত করে আসছে।একশো সতেরো বছরের পরিপূর্ণ জীবনের পরে বার্ধক্যজনিত কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর স্মৃতিসৌধটা যেন শহিদ বেদীর আকারে হয়।

‘কিন্তু শহিদ বেদীই কেন ?’বিপ্লব ফুকন জিজ্ঞেস করেছিলেন।

‘কারণ আমরা শহিদের যুগের মানুষ’,দাদু গৌ্রবের সঙ্গে বলেছিলেন—‘আমার জ্যাঠা ১৯৪২ সনের শহিদ,আমার কাকা ১৯৬২ সনের শহিদ এবং আমার বেশ কিছু সহযোগী ১৯৮০ থেকে ২০০০ সনের মধ্যে নানা বিষয়ের শহিদ।এর পরেও অনেক আপনজন শহিদের স্মৃতি আমাকে আজ পর্যন্ত তাড়িত করে। 

‘কিন্তু আপনিও তো অনেককে শহিদ করেছিলেন ?’নিজের যৌবনে দাদু প্রথমে একজন বিখ্যাত উগ্রপন্থী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।কমরেডের হত্যার প্রতিশোধের জন্য তিনি নিঁখুত নিশানায় অনেককে নিহত করেছিলেন।মানুষের মনে আর সরকারি দস্তাবেজে তাঁরাও শহিদ।

‘সমগ্র রাজ্য শহিদে ভরে গেছে ,আপনি যাকে শহিদ বলেন অন্যেরা তাকে দেশদ্রোহী বলে।আপনার সংগঠন যাকে সুবিধাভোগী,বিশ্বাসঘাতক ভেবে হত্যা করেছিলেন,অন্য সংগঠন গুলি তাকে দেশপ্রেমী হিসেবে মরণোত্তর শহিদের সম্মান জানিয়েছিল।আমি এই কথাটাই বুঝতে পারি না—আসলে কে শহিদ?’

সেই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজেই বিপ্লব ফুকন ছোট ছবিটা আরম্ভ করেছিলেন।ফোল্ডারটা অঞ্চলটির ভিন্ন অংশের শহিদ বেদীর ছবি এবং ভিডিওতে পরিপূর্ণ হয়েছিল। বেশিরভাগ বেদীর অবস্থাই অত্যন্ত শোচনীয়।কোনোটা ডাস্টবিন,কোনোটার উপরে এখন মণিহারী দোকান,বেশিরভাগই ক্রিকেট খেলার স্টাম্প হিসেবে ব্যবহার হয় আর রাতের বেলা সুরা পান অথবা যৌন অভিসারের আসর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।১৯৪২,১৯৬২,১৯৭৯,১৯৮৩,১৯৯২…ভিন্ন ভিন্ন পন্থী স্থাপন করা বেদীগুলির আকার প্রায় একই ধরনের।যদিও খসে যেতে শুরু করেছে, কয়েকটিতে এখনও মৃতের নাম পড়ার অবস্থায় রয়েছে।কয়েকটিতে শহিদের এবং শহিদটি যে পন্থীরই হোকনা কেন ,আশ্চর্য জনক ভাবে প্রায় বেশিরভাগ শহিদ বেদীতেই ক্ষোদিত রয়েছে সেই বিখ্যাত কবিতাটা । বিখ্যাত বলেই বলতে হবে,কারণ সেই অর্ধ শতকের বেশিরভাগ ফলকেই ক্ষোদিত আছে  সেই কবিতার স্তবকটা। কিন্তু সেই কবির কোনো চিহ্ন নেই।  

‘আমরা বড় আবেগিক জাতি,ঠিক আছে তাতে কোনো আপত্তি নেই।কিন্তু সমস্যাটা হল আমাদের ভুলে যাবার প্রবণতাটা তার চেয়ে বেশি।’ কবিটির বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় দাদু বলেছিলেন।‘আর তার জন্যই আমরা নাকি একই ভুল বারবার করে থাকি।’

অভিজ্ঞতা পুষ্ট জীবনের অধিকারী দাদু সম্পূর্ণ সত্যি কথা বলেছিলেন।তিনি নিজের জীবনে অনেক পরিবর্তন দেখে এসেছিলেন। একজন বিপ্লবী,সংগ্রামী থেকে উগ্রপন্থীতে,তারপর সফল ব্যবসায়ী এবং নির্বাচিত জননেতায় –সমস্ত অভিজ্ঞতাই তার জীবনে আছে।মৃত্যু তাকে অনেকবার কাছ থেকে ছুঁয়ে গেলেও প্রতিবারই তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।তাঁর অমেক  সহযোগী কিন্তু এত ভাগ্যবান ছিলেন না,এমনকি দাদুর খোঁজে চালানো এক সামরিক অভিযানে তাঁর বৃ্দ্ধ পিতামাতা সহ কবি পরিবারের পাঁচজন মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করেছিল।তারা প্রত্যেকেই আজ শহিদ।অন্যদিকে তিনি নিজের হাতে কখনও জীবন রক্ষার জন্য ,কখনও সময়ভেদে পরিবর্তিত হওয়া আদর্শের জন্য এবং অনেকবার সরকারি গুপ্তনীতির আদেশে অনেক মানুষের ওপরে গুলি চালিয়েছেন,সেই মৃতরাও আজ শহিদ।কিন্ত একজনের নামও আজ জনগণের মনে নেই।পরবর্তীকালে দাদুও বেশিরভাগ নাম,মৃত্যুর কারণ ভুলে গিয়েছিলেন।হয়তো সময়ের গতিতে তাঁদের সেই সমস্যাটির,সেই মৃত্যুর মূল্যও নাই হয়ে গিয়েছিল।সেজন্যই হয়তো কোনো চিহ্নই নেই সেই শহিদের,তাদের কারও মনে নেই।

আর মনে রাখার জন্য সময়ই বা কোথায়?প্রকৃতি প্রলয় সদৃশ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।হিমালয়ের গিরিশৃঙ্গের গ্লেসিয়ার গলে সাগরগুলি ফুলে উঠেছে,এদিকে নদীগুলিতে জল নেই। বারবার ইউরোপীয় প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে হওয়া বড় ধরনের ভূমিকম্প,সাগরের ক্ষয় এবং বনাঞ্চলের ওপরে নির্বিচার আক্রমণের ফলে অঞ্চলটি এখন একটি অনুর্বর গৃহযুদ্ধ চলতে থাকা দ্বীপ। এতদিনে প্রবহমান নদী উপনদী গুলিতে এক ফোঁটাও জল নেই। দুর্ভিক্ষ মহামারীতে মানুষ মরতে শুরু করেছে। তথাপি সরকারি হোক বা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদিই হোক কোনোটারই বিন্দুমাত্র অহংকার কমেনি।এখনও অস্তিত্ব রক্ষা, সাত পুরুষের সংস্কৃতি ইত্যাদি শব্দকে নির্লজ্জ ভাবে ব্যবহার করে নিজের নিজের ব্যভিচার চালিয়ে যাচ্ছে। খোকনের পিতা একজন অন্যতম ব্যভিচারী নেতা। কিন্তু এতদিন তার কোনো বিচার হয়নি। গত বারের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে  বিচারের ভয়ে ইরাবতী উপকূলে স্বেচ্ছাচারী সামরিক নেতার সুরক্ষায় আত্মগোপন করে নিজের সেনাবাহিনী চালিয়ে যাচ্ছে। বিপ্লব হল এই প্রান্তের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি এবং তার পিতা সেই দেশেরই পলাতক অপরাধী। প্রত্যেকেই জানে বিপ্লব দেশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্দি হবে। এবং তিনি যতই যত্ন করুক না কেন তাদের পরিবারের প্রধান শত্রু এই নতুন সামরিক প্রধান তাকে দোষী প্রমাণিত করবে। বিশ্বজুড়ে জনপ্রতিক্রিয়ার জন্য তা যদি সম্ভব না হয় তখন হয়তো কোনো বিচার না করেই অঘটিত সংঘর্ষ একটা ঘটিয়ে বিপ্লবকে শেষ করে দেবে।  তাই প্রত্যেকেই তার স্বদেশের সামরিক আদালতের সাক্ষী হওয়ার জন্য ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছিল। পিতা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে পিতার বিরুদ্ধে থাকা অনেক অভিযোগের সহযোগী হিসেবে বিপ্লব ফুকনেরও নাম ছিল।ইউরোপের সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক সুরক্ষার অধিকারী প্রফেসর অবশেষে দেশের জনগণের আবেদনকেই বেশি গুরুত্ব দিলেন।অন্তত তার আগমনে সংবাদ মাধ্যম সৃষ্টি করা আলোকপাত আন্তরাষ্ট্রীয় সংগঠন গুলিকে এখানে কাজ পুনরায় আরম্ভ করতে বাধ্য করবে। দেশে ফিরে আসার আগে করা সংবাদ মেলে সে সেই অনুরোধই করেছিল। 'এটা আত্মহত্যার বাইরে কিছু নয়' প্রেমিকা এনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিল। 'কি করবে দেশপ্রেম এবং দেশদ্রোহ আমাদের বংশের কোষে কোষে' বিপ্লব বলেছিল। ইতিহাস খুললে  দেখতে পাবে প্রতি ১০০ বছর পর পর একই ধরনের কারণগুলির জন্য বারবার এই অঞ্চলটিতে  ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েই চলেছে, যতই চেষ্টা করনা কেন তুমি তাকে রোধ করতে পারবে না।

  'কিন্তু তোমার  যাবার কী প্রয়োজন?'

  'আমিও বোধহয় ইতিহাসের পাপ এবং প্রায়শ্চিত্তের একটি অঙ্গ হয়ে পড়েছি। এটাই তো তোমার গবেষণার বিষয়।'

  'শহিদ হওয়ার এত সখ?'

  ‘না। শহিদ কে তা বোঝানোর আমার দুর্বার আগ্রহ।’ 

এই প্রশ্নটির উত্তর বিপ্লব ফুকনের জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। তার উত্তরে একজন তাকে উল্টে জিজ্ঞেস করেছিল হাড়ে হিমজুরে আমরা এই মাটিরই মানুষ এবং এখন আমাদেরই অন্নজলের দুরবস্থা।তার বিরুদ্ধে কথা বললে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে  ওদের গুলি করা হয়েছিল। ওরা শহিদ না হলে শহিদ কে হবে? সত্যি কথা।

  একের পর এক ভিডিওগুলি বিপ্লব ফুকন দেখে গেল।

  আমরা পেটের জ্বালায় এখানে এসেছিলাম এবং তোমরা সবাই মিলে আমাদের গ্রাম গুলি জ্বালিয়ে দিলে। আসলে শহিদ বেদী গুলি হল সেই মৃতদেরই স্মৃতি সৌধ।': সেই মানুষের উত্তর বিপ্লবকে হুলের মতো বিঁধেছিল। তথাপি বিপ্লব ফুকন কোনো ধরনের সম্পাদনা না করেই কথাগুলি ডকুমেন্টারিটিতে ব্যবহার করেছিল।

' না হলে কি করব, বন্দুকটার জন্য আজ দুমুঠো খেতে তো পারছি। একজন জীবন্ত শহিদ বলেছিল।

  সাক্ষাৎকারটির কয়েকদিন পরে ছেলেটির অন্তর্দলীয় সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছিল। আর আজ সাক্ষাৎ গ্রহণকারীও একজন জীবন্ত শহিদই।

  যে কয়েকজন তাকে মেরেছে তারা নিশ্চয়ই মারা যাবে এটা নিশ্চিত।আমাদের এই নরককুণ্ডে বেঁচে থাকতে হচ্ছে, আসলে আমরাই শহিদ, যারা মরার তারা তো মরেই গেল। শহিদের মা কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছিল। বিপ্লব সেই অংশটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। মহিলা হয়তো সত্যি কথাই বলছেন।

  উড়োজাহাজটা হিমালয় অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে তার মাতৃভূমিতে ফিরে আসছিল। দূরে কুয়াশার আড়ালে আড়ালে দৃশ্যমান হয়েছিল তার অত্যন্ত আপনজন দ্বীপটা,বিপ্লব ফুকন নিচের দিকে তাকালেন,সাগরের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকা স্নেহের রাজ্যটি  একটা শহিদ বেদীর মতোই মনে হল তার কাছে।


 


রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২০

যাত্রা || ভাস্কর ঠাকুরীয়া || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস

 যাত্রা

ভাস্কর ঠাকুরীয়া 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস 




ভরহীন সমর ফুল,তারা এবং রামধেনুর মধ্য দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল।রেশমি মেঘের কোষগুলি    হয়ে ত্বক এবং পেশীর মধ্য দিয়ে আসা যাওয়া করছিল।অজানা পাখির গান এবং ডানার তালে তালে রামধেনুর ভেতরে থাকা নানা ধরনের পরিচিত অপরিচিত রঙ বিস্ফোরিত হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে যেতে লাগল।মাঝে মধ্যে তারা বুক ভেদ করে হৃদয়ে কুটকুট করছিল।

‘কনভালসন হচ্ছে।’

সিস্টারের রুক্ষ চিৎকার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যেন বিপদের ধ্বনি বাজিয়ে দিল।সেখানে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ তার দিকে দৌড়ে এল।

‘Phenytoin নিয়ে এস তাড়াতাড়ি।’

কার্ডিয়াক মনিটরে পড়তে পড়তে কর্মরত চিকিৎসক সঙ্গের জনকে চিৎকার করে বলল।দুজনে মিলে তাকে চেপে ধরল,একজন সিস্টার জিভ আটকে গিয়ে যাতে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কোনো অসুবিধা নাহয় তারজন্য জিভটা চামচ দিয়ে ধরে রেখেছিল।

কনিষ্ঠ চিকিৎসক তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ফেনাগুলি সাকসন মেশিন দিয়ে বের করে দিচ্ছিল।‘ইনটিউব’এর প্রয়োজন হতে পারে ,তৈরি থেক।’

যুদ্ধকালীন ক্ষিপ্রতায় প্রতিটি মানুষ তার সঙ্গে লড়াই করছিল।প্রায় আধা ঘণ্টা পরে সমরের আস্ফালন গুলি কমে এল।অক্সিজেনের পরিমাণ,হৃদয় স্পন্দন,হৃদ বৈদ্যুতিক রেখাগুলি  সাধারণ অবস্থায় ফিরে এল।ক্ষণিকের জন্য হলেও মানুষগুলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।কিছুক্ষণ আগের স্বর্গীয় পরিভ্রমণের পরিতৃপ্তি এবং এখনকার নাটকীয় পরিস্থিতির মাঝখানের বিভাজনের রেখাটার অবস্থিতি সমরের কাছে অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ছিল। ব্রহ্মমণ্ডলের কোনো অজানা গ্রহের প্রাণী যেন মনে হওয়া সবুজ গাউন,চশমা,মুখের আবরণ ও টুপি পরা চিকিৎসকটি সমরের চোখের মণিতে টর্চের আলো ফেলল।মণির গহ্বরটা আলোতে ছোট-বড় হতে লাগল।কিছুক্ষণ আগে সে কোথায় কীভাবে উড়ে বেড়াচ্ছিল তা ভাবতে ইচ্ছা করছিল।তার মনে হল তার চিন্তার চালিকা শক্তিটা যেন বাইরে থেকে পরিচালিত হচ্ছে। 

স্পেশশিপের মতো দেখতে এই অত্যাধুনিক আই সি ইউ টার পরিচিত অপরিচিত নানারকমের যন্ত্রপাতি,কম্পিউটার এবং প্রায় মহাকাশচারীর মতো কাপড় পরা মানুষগুলি কী করছে,কেন করছে,এই জায়গাটা কোনো পরমানবিক অনুসন্ধান  কেন্দ্র না কোনো মহাকাশযান এইসব প্রশ্ন একবারও মনে আসেনি।আলো-ছায়ায় টিটি শব্দ করতে থাকা যন্ত্রগুলির মধ্যে সে নিশ্চুপ হয়ে পড়েছিল।যে কোনো মুহূর্তে সে অনুভূতির পৃথিবীর মধ্যে দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল।

মাঝে মধ্যে কারও মুখে শুনে ‘সাত দিন হল,অবস্থা একই আছে।’তার কাছে কিন্তু দিন-রাত সময়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না।অবুঝভাবে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে থাকে।মানুষ আসে,মানুষ যায়। পরিচালিকা এসে পাউডারের গুড়িগুলি সমস্ত শরীরে মেখে নেয়।চিকিৎসক এসে পরীক্ষা করে।জমাদার এসে শরীরের আবর্জনা গুলি পরিষ্কার করে যায়।কিন্তু এই সবের সঙ্গে তার কোনো করণীয় থাকে না।এক অজানা শক্তি তাকে পরিচিত-অপরিচিত সময়ের পৃথিবীতে নিয়ে যায়। তার মধ্যে কোনোটি সমরের পরিচিত অতীত,কোনোটা বাস্তব এবং কোনোটা হয়তো অপরিচিত কালহীন সত্তা সঞ্চয়।

এভাবেই সে দেখেছিল শৈশবে মাঠে শুয়ে শুয়ে দেখা জ্বলজ্বল করতে থাকা তারার আকাশটা।সেদিন সে একটা তারা থেকে অন্য তারা পর্যন্ত রেখা টেনে,গাছ,হাতি বানিয়ে আনন্দ লাভ করেছিলেন।নিচে অগণন জোনাকি পোকা নেচে বেড়াচ্ছিল,তার বাইরে সমস্ত কিছুতে অন্ধকার। দাদারা ভেলাঘর তৈরিতে ব্যস্ত থাকায় সে নরার স্তূপে পড়ে সেগুলিতে হারিয়ে যাওয়া ছন্দ মিলিয়ে রাতের ঝিঁ ঝিঁ পোকা এবং পাশের পুকুরের ব্যাঙগুলির সঙ্গীতের তালে তালে নাচতে লাগল।নিজের অজান্তে কখন ঘুমিয়ে পড়ল বলতেই পারে না।

সেই রাতটা থেকে সে সিগারেটের ধোঁয়ার মতো কুন্ডলি পাকিয়ে সেই আই সি ইউ তে ফিরে এসেছিল না অন্য কোনো জগতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল সেটা ভাবার জন্য সমরের চালিকা শক্তির আধুনিক যন্ত্রটিতে তার কোনো অনুমোদিত কার্যক্রমণিকা ছিল না। 

সেই বিছানা  থেকে সে অনেকগুলি জায়গায় গেছে।গ্রামের বাড়ির বকুল ডালের গন্ধের মধ্যে,বনভোজের স্ফুর্তির অন্তহীনতায়,আগে শাসন করতে না পারা,বুকে সঘন কম্পনগুলির মধ্য দিয়ে সে চলে গিয়েছিল। কখনও কখনও তার যাত্রা অসম্পূর্ণ রেখেই সে কুন্ডলী পাকিয়ে তার বিছানায়   ফিরে আসে,চারপাশে উৎকণ্ঠিত টুপি এবং মুখোস পরা মুখগুলি দেখে সমর ভাবতে চেষ্টা করে এসব কী হচ্ছে? সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,ইলেকট্রনিক মনিটরগুলির বিপারগুলি চিৎকার করে উঠে ,ধমনীতে লাগানো ইঞ্জেকশনের মধ্য দিয়ে আরও কিছু ওষুধ যায়-তারপরে ঘটনাগুলি স্থবির হয়ে থাকে।মানুষগুলি অন্য একটি বিছানার রোগির কাছে চলে যায়,নাহলে তারা পাশের টেবিল চেয়ারগুলিতে বসে বিশ্রাম নেয়,ফোনে কথা বলে না হলে সেখানে বসে বসেই ঘুমোতে চেষ্টা করে।

ঘর থেকে বহু হাজার মাইল দূরের তার তিক্ত দৈনন্দিন জীবন যুদ্ধের গণিতগুলিতে কিন্তু সে একবারও যায়নি। সঙ্গীহীন আশ্চর্য শহরটিতে ক্যাশ বুক,লেজার বুক,ভাউচার জমা এবং খরচের অমিল সংখ্যাগুলি,নাহলে পাবগুলিতে দুই হাজার ডেসিবেল সঙ্গীতের তালে তালে আলজিভ ঠেলে টেনে বইয়ের খাওয়া সময়গুলিতেও সে একবারও যায়নি।

সাতদিন হল সে একভাবে পড়ে আছে।বিকেলে একজন এসে তার নাম ধরে ডাকল ‘সমর,সমর!এই’?আওয়াজটা দূর থেকে ভেসে আসার মতো সে অস্পষ্টভাবে শুনতে  পেয়েছিল।কপালে চাপ দিয়ে সে চোখদুটি মেলে তাকাল।সিনেমার Extra Terrestroal  প্রাণীর মতো দেখতে মুখগুলি সে চিনতে পারছিল না।

কোমৰ,বুক,বুকের হাড়্গুলিতে সে এক অসহ্য ব্যথা অনুভব করল।শ্বাস-প্রশ্বাসে ভাঙ্গা হাড়্গুলি একে অপরের সঙ্গে চাপা খেয়ে খট খট করে শব্দ করছে। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সে মুখ দিয়ে ‘ঘোৎ’করে শব্দ করল।তাকে চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষগুলির গুঞ্জন শুনতে পেল।সামনের অস্পষ্ট মুখগুলি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল ঠিক যেভাবে ক্যামেরার জুম লেন্সগুলি ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছবি স্পষ্ট করে তোলে। সবুজ আবরণে শরীরের বেশিরভাগ ঢেকে রাখা মানুষগুলিকে তার পরিচিত বলে মনে হল না,মাত্র একজন ছাড়া। জুমের পেছনে দাঁড়িয়ে একান্ত মনে তার দিকে তাকিয়ে থাকা গোলাপি গালের সজল মেয়েটিকে দেখে তার 

মনে কিছু একটা ভাব আসতে লাগল।‘ও কে?সে ওকে জানে নাকি?সেই চোখদুটি,মাস্কটার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে থাকা মুখটা এবং দেখা না দেখার মাঝখানে নববিবাহিতার সিঁদূরের ফোঁটাটা তার কেমন যেন পরিচিত বলে মনে হল।

‘সা-গ-রি-কা।’

সাগরিকা তার পুরোনো সহকর্মী। এই আজব অপরিচিত শহরে তার প্রথম বন্ধু।

তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা চারটি অক্ষর বাকি কয়েকজন বুঝতে না পারার মতো হলেও ফুটে উঠল।উঃআঃ ছাড়া অন্য কেউ আর কিছু শুনতে পেল না।

কমা স্কেলে কিছুটা ইম্প্রুভমেন্ট দেখাচ্ছে।কিন্তু এখনও বিপদমুক্ত বলা যাবে না। Head Injury র সঙ্গে  Multiple fracture ও রয়েছে।তাই কোনোকিছুই জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।’চিকিৎসকের কথা শেষ হওয়ার আগেই খট খট করে শব্দ করে সাগরিকা বেরিয়ে গেল।

সাগরিকা এখানে কেন এসেছে এবং সেই বা এখানে কীভাবে এল?

এই আন্তর্জাতিক শহরটিতে আসার দুই বছরের মধ্যেও অ্যাকাউন্টেন্সির অফিস,তার হিসেব পত্র বস বেঁধে দেওয়া সময় সীমার বাইরে তার জীবনে কিছুই ছিল না।এলার্ম ঘড়ির চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে মুখ ধুয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে অফিসে পৌছায়,তারপরে কম্পিউটার,ব্যালেন্স সিট এসবই।রাতের বেলা ঘরে ঘুমোতে আসা হয়।বেতন যে বেশি পাচ্ছে,সে যে কাজটাকে খুব ভালোবাসে তা ও নয়।কেবল করতে হয় বলে করে চলেছে।এটা ছেড়ে দিয়ে অন্য চাকরিতে ঢুকলেও তাকে এটাই করতে হবে।তাই আজকাল সে আর এসব নিয়ে ভাবে না। 

আগে সাগরিকার সঙ্গে  কফিবারে কাটানো সময়গুলি সে মুখের মূলধন হিসাবে ঘোষণা না করেই মেনে নিয়েছিল।ওরা মাত্র ফুলের বিষয়ে আলোচনা করত।ড্যাফোডিল,টিউলিপ,সূর্যমুখী,গোলাপ কোনটার কী রঙ ভালো লাগে,কীভাবে রোপণ করতে হয়,কোথায় কীভাবে কলমের চাষ করতে হয়,কোন গাছের বনসাই ওরা করেছে ,কী করতে বাকি থেকে গেল-এক কাপের পরে আরেক কাপ কফি এবং পেস্ট্রি খেয়ে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা ধরে ওরা এইসব বিষয়ে কথা বলছিল।

সমরের প্রিয় ফুলগুলি বকুল,টগর,যেগুলির সঙ্গে সে বড় হয়েছিল সেইসব বিষয়ে সাগরিকার জ্ঞান অবশ্য যথেষ্ট কম,তথাপি দুজনের ফুলের প্রতি কৌতূহল থাকার জন্য ওদের সময়টুকু যেন ভালোভাবে পার হয়ে যেত।আলোচনায় সবসময় ঘুরে ফিরে রজনীগন্ধার কথা আসত।রজনীগন্ধার রূপ, গন্ধ, কোমলতা  ওদের দুজনেরই অত্যন্ত প্রিয়।প্রতিদিনই ওদের কথায় একবার না একবার রজনীগন্ধার প্রসঙ্গ উঠত।ওদের সম্পর্কটা ফুলের ছিল ঠিক প্রেম নয়,বন্ধুত্বও বলা যায় না।কিছুদিন পরে তার বিয়ে হয়ে গেল,ওদেরই এক্সিকিউটিভ প্রভজ্যোতি সিংহের সঙ্গে।আশ্চর্যজনক ভাবে সে ফুল বা সেই ধরনের জিনিস ভালোবাসে না।Fitness Conscious প্রভজ্যোতি তার জিমনেসিয়াম,ডায়েট এবং অফিস ছাড়া অন্য কোনো কিছুই বুঝতে পারত না,আর সাগরিকা এক কথায় তার বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে দিল।

তারপরে সমরের জীবনটা কোনো কারণ ছাড়াই রুটিন হয়ে পড়েছিল।অফিস আসে আর যায়,রাতে রুমে পড়ে থাকে।সপ্তাহান্তে পাব বা ডিস্কে সুরাপান করে,গাড়ি নিয়ে মেডরেস প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।কিন্তু এসবেও কোনো আগ্রহ বা আনন্দ তাঁর ছিল না।কাজগুলি করতে হয় বলে করে যেত। একবার সে বাড়িতেও এসেছিল কিন্তু বাড়িতেও তার জন্য কিছু ছিল না। গ্রাম থেকে তারা উঠে এসে শহরে ঘর বানিয়েছে আর শহরটা তার অপরিচিত।সে তার শৈশবের পরিচিত গ্রামে একবার গিয়েছিল।গ্রামের সঙ্গীরা ইতিমধ্যে জীবিকার তাড়নায় অন্য শহরে চলে গেছে।তার পরিচিত চাষের জমি,গ্রামের নামঘরটা ,বাতাবী লেবু দিয়ে বল খেলার মাঠটা তার অপরিচিত প্রাণহীন বলে মনে হচ্ছিল।

সেখান থেকে ফিরে এসে পুনরায় সে গাণিতিক অফিসের  গণনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।তারপর সে আর বাড়ি ফিরে যায়নি।অফিস পাব,রুম এইগুলির মধ্যে সে পুনরায় ডুবে গেল।সাগরিকার সঙ্গে  মাঝে মধ্যে দেখা হয় কিন্তু ক্রিসেন্থিমাম বা রজনীগন্ধার কথা বলার মতো কারও অবসর থাকে না। অফিসে আসা কাজগুলি সময় সীমার মধ্যে শেষ করার জন্য প্রায়ই তাদের অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়।বহুরাষ্ট্রীয় অফিসটার শাখাটা সম্মুখিন হওয়া প্রতিটি সমস্যাকে সমরদের নিজেদের সমস্যা বলে ভাবতে হত।কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলি ওদের নিজেদের সমস্যা হয়েই থাকে।সপ্তাহান্তে পাওয়া আটচল্লিশ ঘণ্টা ছুটিতে সমর এবং সহকর্মী দুজন অত্যাধুনিক পাবগুলিতে সুরাপান করে নাহলে গাড়ি নিয়ে শহরের বাইরের হাইওয়েগুলিতে অনর্গলভাবে ঘুরে বেড়ায়।সঙ্গীদের এইসবের প্রতি ভীষণ আগ্রহ। সমর কেবল তাদের সঙ্গে থাকে সময় পার করার জন্য।নিশ্বাস নেওয়াটাকেও সে যান্ত্রিক জীবনের রুটিন বলেই ধরে নিয়েছিল।

সেদিনও সপ্তাহান্তে ওরা বেরিয়ে এসেছিল।মন চাইলেও বন্ধ করতে না পারা যান্ত্রিকতার ওপরে হঠাৎ সমরের রাগ উঠে গেল।ডিস্কোটাতে অন্ধকারের মাঝেমধ্যে লাল নীল আলোগুলি সবাইকে ছূঁয়ে যাচ্ছিল।ডিস্ক জকি পুরোনো জনপ্রিয় একটা গানকে খন্ড বিখন্ড করে মাঝে মধ্যে দ্রুত এবং ভাঙ্গরার তালে তালে দুই হাজার ওয়াটের শব্দ বাক্স গুলির মাধ্যমে সবাইকে শোনাচ্ছিল।সমরের সঙ্গী কয়েকজন তার তালে তালে নাচার জন্য নৃ্ত্যের কার্পেটের দিকে এগিয়ে গেল।বারের এক কোণে একটা টুলে বসে হাতে বীয়রের ক্যান নিয়ে থাকার সময় হঠাৎ ধৈর্যচ্যুতি হয়ে সমর ডিস্কোবার থেকে বেরিয়ে এল।

গাড়ির ইঞ্জিনটা চালিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে কথাগুলি ভাবতে লাগল-নিজের গ্রাম,নগরে নতুন করে বানানো তাদের ছোট বাড়িটা,তার অফিস,অট্টালিকা,ডিস্কোথেক কোথাও সে নিজেকে খুঁজে পায়নি।শিখণ্ডীর পৃথিবীতে জীবন নামের যেন অন্য কোথাও।

‘Life is elsewhere’

সে বিড়বিড় করল।গাড়ির এক্সিলেটরে ধীরে ধীরে চাপ দিল,গাড়িটা বোধহয় এগিয়ে যাচ্ছিল।গতির কাঁটাটা ,একশো,একশো কুড়ি,একশো চল্লিশ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার কাঁটা ছুঁয়ে চলল। রাত দুটো বাজে যদিও রাস্তায় কিছু গাড়ি ঘোড়া চলছিল।ঠিক তখনই সামনের একটা বিশালকায় লড়ির হেড লাইটের আলো তার চোখ ধাঁধিয়ে দিল।লড়ির হর্ণটা তার কানে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা বিকট অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের শব্দ হল।

তারপরে…

তারপরে কী হল সমরের মনে নেই।

ফুল তারা এবং রামধেনুর মধ্য দিয়ে ভরহীন যাত্রার মাঝে মধ্যে সে এসে স্পেস শিপ সদৃশ আইসিইউ তে আশ্রয় লাভ করে,মানুষগুলিকে দেখে,ততটাই। বুকের ভাঙ্গা হাড় গুলি থেকে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়া ব্যথায় কাতর হয়ে সে চোখ মেলে তাকাল,সেইসময় তার চারপাশে কেউ ছিল না। অনবরত তার টিউব-লাইটগুলি জ্বলে থাকে বলে তখন দিন ছিল না রাত সে বুঝতে পারেনি।চিকিৎসক এবং একজন নার্স তার থেকে কিছুটা দূরে থাকা একজন রোগীর নাক দিয়ে খাদ্যনালী পর্যন্ত একটা পাইপ ভরানো ছিল।নিশ্বাসে রাস্তাটা বন্ধ হতে চলার জন্য নাক এবং মুখ দিয়ে খোপ খোপ শব্দ হচ্ছিল।তার অন্যপাশের রোগীটির মুখে অক্সিজেন এবং মাস্ক নিয়ে প্রশান্ত ভাবে শুয়ে ছিল।একজন পরিচারিকা রোগীর কেস হিস্ট্রিতে ওষুধ পত্রের হিসেব লিখছে।বাইরে যাবার ইচ্ছায় সে পা টা তুলতে চেয়েছিল।না।পা,হাত,মাথা কোনো অংশই সে চেষ্টা করেও নাড়াতে পারল না।অশেষ কষ্ট করে সে চোখের পাতাটা মেলতে পেরেছিল।সামনের সমস্ত কিছুই কেমন যেন অস্পষ্ট আর ধোঁয়া ধোঁয়া বলে মনে হল।যেন ফোকাশের বাইরের কুয়াশা ঢেকে রাখা লেন্সের মধ্য দিয়ে জিনিসগুলি দেখছে।যন্ত্রগুলি,কাছের রোগীরা,হাতে ওষুধের ট্রে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সিস্টার সবাই ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসতে লাগল।

একটা মায়াবী অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে সে,সমরের দেহ থেকে বেরিয়ে ভরহীনতায় ফুল-তারার আলোর মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। রঙ এবং বর্ণনার বাইরের অনুভূতির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে চোখ মেলে সে অফিসটা দেখল।সেখানে সবাই আগের মতোই কাজ করছে এবং কফিবারে প্রভজ্যোতি এবং সাগরিকা কফি খাচ্ছে।প্রভজ্যোতি তাকে ট্রাইসেপ এবং লেটি-মাছ দর্চি নামের মাসল দুটোর জন্য এবং পাসাটা সেট ব্যায়াম করার সুখবরটা আনন্দ মনে দিচ্ছে,সঙ্গে্র ডিস্কো প্রেমিকরা ডিস্কোথেকে হাতে বীয়রের ক্যান নিয়ে নেচে চলেছে।চোখদুটি বন্ধ করে পুনরায় সে রঙের ঢেউয়ে ভেসে যেতে লাগল। সে পুনরায় তার গ্রামের মাঠ থেকে  আকাশটা দেখতে  পেল,দূরের পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়া ফুটফুটে হলদে সরষের খেতগুলি,গ্রামের বিলনিতে লালুকি,মাছের সঙ্গে ফোঁটা ভেটগুলি। দেহাতীত সমর ভেসে পুনরায় সেই ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের দশ ইঞ্চির বেড়ার মধ্য দিয়ে এসে তার কর্মচারীদের ব্যস্ত অবস্থায় দেখল।প্রত্যেকেই একজন রোগীকে উত্তেজিত ভাবে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে।দুজন চিকিৎসক তাঁর বুকে চেপে ধরে কার্ডিও পাল্মনারি রিসাসসিটেশন  করছিল।রোগীর কার্ডিয়াক মনিটরের রেখাটা প্রায় সমান হয়ে কিছু স্বাভাবিক শব্দ করছিল আর পালস অক্সিমিটারের পরিমাণগুলি অনেকটা এদিক ওদিক হচ্ছিল।

চিকিৎসক এবার ডিফিব্রিলেটরটা হাতে নিয়ে রোগীর বুকে বৈদ্যুতিক সংযোগ করলেন।রোগিটি লাফিয়ে উঠল,সবাই মনিটরের দিকে তাকাল-না,রেখাটা এখনও সমান।একজন পালস দেখল-‘পায় নি’।

চোখের মণিতে আলো ফেলতেই মণির গহ্বরটা বড় হয়েছে।তারপরে আর করার কিছুই নেই।এক এক করে মানুষগুলি চলে গেল। একজন মৃত্যুর প্রমাণ পত্র লিখতে লাগল।সমর রোগীর দিকে তাকাল-গভীর প্রশান্তিতে সে নিশ্চিত মনে চিত হয়ে পড়েছিল।দুচোখে মহাশূন্যের দিকে ভাবহীন দৃষ্টি,সে ভালোভাবে মনে করে দেখল ,কয়েক মুহূর্ত আগে পর্যন্ত সেই দেহটার অধিকারী সে নিজেই ছিল।

কর্কশ শব্দ করে স্ট্রেচারটা তার দেহটাকে ঠেলে আইসিইউ এর বাইরে বের করে নিচ্ছিল।বাইরের কিছু কৌতূহলী মুখ তার পথ ছেড়ে দিল।আর তার সঙ্গে সঙ্গে বের হল,স্ট্রেচারের চাকাগুলির গতি বাড়তে লাগল।

ক্রমশ বেড়ে আসা দূরত্বের সেই ভিড়টার মধ্যে সাগরিকার রঙিণ মুখটা সে দেখতে পেল।তার হাতে রজনীগন্ধার একটা স্তবক ছিল।স্তবকটার মাদকতা ভরা গন্ধটা শীতল সরীসৃ্পের মতো ছড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল…।  

-----------











Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...