শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

একজন বুড়ো মানুষ-১১, নিরুপমা বরগোহাঞি, অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস,

 

একজন বুড়ো মানুষ-১১,

নিরুপমা বরগোহাঞি,

অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস,




(১১)

এখন তিনি ভাত খেয়ে উঠলেন। ভাবিত গিয়ে কিছুক্ষণ পরে ওদের দুজনকে ভাত খেতে ডেকে আনবে।বিজয় ভরালীর দেখতে ইচ্ছা করল কমলাও  তার মতো থালায় ভাত ফেলে যায় কিনা। আজ তার জন্যই কমলাকে সঞ্জয়ের কথা শুনতে হয়েছে। মন খারাপ করে কমলা সম্পূর্ণ ভাত খেতে পারবে কিনা কে জানে? নাকি অভিমানে ভাতের কাছে আসবেনা। তার সঞ্জয়কে একবার দেখতে ইচ্ছে করল।  ক্লান্তিতে তার  মূর্তিটা কেমন রূপ ধারণ করেছে একবার দেখতে ইচ্ছে করল। বাড়িটা এত নির্জন বলে মনে হচ্ছে। সঞ্জয় সঞ্জয় বা কমলা কারও কোনো কথাই তার কানে আসছে না আর তিনি তো ভালো করেই জানেন এই স্তব্ধতার মূলে রয়েছেন  তিনি। অর্থাৎ কমলা এবং সঞ্জয় দুজনের মধ্যে অশান্তির জন্য তিনি দায়ী।  তিনি বিজয় ভরালী। একজোড়া দম্পতির সুখের ঘর তার জন্যই গড়ে উঠতে পারল না। পরদিন বিকেলে কিছু এরকম ঘটনা ঘটল যার জন্য বিজয়   ভরালীকে আবার ভাবতে হল যে তিনি আগের দিন বোধহয় সমস্ত কথা তিলকে তাল করে ফেলেছেন না হলে আগের দিন এত অসুখী বলে ভাবা দম্পতিকে আজ আবার কীভাবে এত আনন্দ করে বাড়ি তৈরি করার কাজ দেখার জন্য বেরিয়ে পড়তে দেখা যেতে পারে। 

সেদিন ছিল শনিবার।বিকেল চারটের পরে কমলা প্রায় হাসিমুখে শ্বশুরের কাছে এসে বলল-‘বাবা, বাড়ি তৈরি করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আপনি তো একবারও দেখতে যাননি। একবার দেখে আসি চলুন।  এতটুকু কথা। কিন্তু তাতেই হঠাৎ অত্যন্ত বেশি খুশি হয়ে গেলেন বিজয় ভরালী। ‘আমি গিয়ে আর কী করব? তোমরাই গিয়ে দেখে আস।’ মুখে খুব মোলায়েম হাসি ছড়িয়ে বিজয় ভরালী বললেন-‘না,বাবা আপনিও নিজে একবার দেখে আসা ভালো। আপনার ছেলে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে আপনাকে যেন তেন ভাবে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য।’

ও, তাহলে বাড়ি তৈরি দেখতে নিয়ে যাবার আসল গরজটা পোনার, কমলার নয়। তবু সন্তুষ্টির ভাবটা অক্ষুন্ন থেকে গেল তার এবং তার পরে দ্বিতীয়বার আর কোনো আপত্তি না করে বৌমার কথা মতো বাড়ি তৈরীর কাজ দেখার জন্য বিজয় প্রস্তুত হল। গাড়িতে উঠে বসার পরে ছেলে গাড়ি চালাতে আরম্ভ করার পরে কিন্তু হঠাৎ এক গভীর বিষাদের অনুভূতি  তার সমস্ত সত্তাকে গ্রাস করে ফেলল। পুরো রাস্তাটা বিজয় ভরালী অন্যমনস্ক হয়ে রইলেন। বাড়ি ? ইলার মাটিতে তৈরি হতে চলা বাড়ি দেখতে চলেছেন তিনি। আজ বহু বছর পরে বিজয় ভরালী নিজের জমিতে পা রাখলেন। প্রথমে তিনি জমিটা চিনতে পারেননি। আর চিনতে পারেননি তার জমির কাছাকাছি ঘরগুলি। প্রথম যখন তিনি এই জমিটা কিনেছিলেন তখন তার পশ্চিমদিকে মাত্র একজন মানুষের একটি বাড়ি ছিল। বাকিটা ছিল জার্মান বনের জঙ্গল। এখন বিজয় ভরালী  দেখলেন তার চারপাশে বাড়ি আর বাড়ি। পশ্চিম দিকে আগে যে বাড়িটি ছিল, তার সামনে ছিল সবজি বাগান এবং গাছপালার বাগান।  সুপুরি, নারকেল,আমলকি  এবং কাঁঠাল এই কয়েকটি গাছ বিজয় ভরালী সেই বাগানে চিনতে পেরেছিল কিন্তু ইলা তার মধ্যে আরও কয়েকটি গাছ তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল। ‘ওই যে গাছটা দেখছেন, আমলকি গাছের কাছে সেটি হল বক ফুলের গাছ। বকের মতো সাদা এবং বক পাখির মতো মিহি এবং চ্যাপ্টা ফুল গাছটিতে   হয় বলে ওটা বক ফুলের গাছ। ফুলগুলি ভেজে খাওয়া যায় জানেন? এখন অবশ্য আমি গাছে একটাও ফুল দেখছি না। ওই যে কাঁঠাল গাছের ওপাশে, সেটা হল কাঁঠাল চাঁপা ফুলের গাছ। তবে ফুলগুলি পুষ্ট হয়ে ওঠার পরে আমি কাঁঠালের গন্ধের চেয়ে  তাতে পাকা মালভোগ কলার গন্ধ বেশি করে পাই।… তবে জমির মালিক কেন যে ফুল-ফল সমস্ত গাছগুলি এভাবে মিশিয়ে রোপন করেছেন- আমি এখানে বাড়ি তৈরি করলে তাদের কাছ থেকে বকফুল এবং চাঁপা ফুলের ডাল এনে আমাদের জমিতে লাগাব-’ ইলা সেদিন বলেছিল। কমলা হয়তো ইলার  মতো সেভাবে বকফুল,চাঁপা ফুলের গাছ রোপন করার কথা একবারও ভাবত না, আর যদি ভাবত কোথাও কোন কোণে একটু জমি বের করে রোপন করার কথা, তার জন্য কিন্তু তখন কমলার চোখের সামনে পশ্চিম দিকের বাড়িটিতে কোনো ফল বা ফুলের গাছের অস্তিত্বই ছিল না।বিজয় ভরালী যখন নিজের এই জমিতে এসেছিলেন তখন পশ্চিম দিকের বাড়িটিতে এই বাগানটা ছিল কিন্তু আজ তিনি দেখলেন যে সেই বাগানটা নেই। তারই জায়গায় একটি নতুন কংক্রিটের ঘর তৈরি হয়েছে। তাই বিজয় ভরালীর মনে হতে লাগল যে কোনো জাদুকরের জাদু দন্ডের স্পর্শে একটি বাগান এক রাতের মধ্যে দালানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। নিজের জমিতে এতদিন না আসাটা সম্ভব হয়েছিল বিজয় ভরালীর, আর যখন সঞ্জয়দের জমি দেখানোর প্রয়োজন হয়েছিল সেই কাজটা করে দিয়েছিল সঞ্জয়ের মামা। দুকাঠা জমি কিনে দিয়েছিল সঞ্জয়ের দাদু বা তার ছেলেদের পরিচিতি বেশি ছিল। অবশ্য তিনি আর জীবিত নেই, সঞ্জয়ের দিদিমারও মৃত্যু হয়েছে। মামাদের সঙ্গে সঞ্জয়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তারপর একদিন একজন মামা তাকে নিয়ে গিয়ে জমিটা দেখিয়ে দিয়েছিল তার সঙ্গে এও বুঝিয়েছিল যে সঞ্জয়ের এখন আর জমিটা ফেলে রাখা উচিত হবে না। তাড়াতাড়ি বাড়ি করা ঠিক হবে।

অনেক ক্ষণ অবাক হয়ে বিজয় ভরালী পশ্চিম দিকের বাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেবল তো সামনের দিকেই নয়,পেছনেও নতুন একটা ঘর উঠিয়েছেন বাড়ির লোকেরা। বাড়ি আর বাড়ি, যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই চোখজোড়া নতুন নতুন বাড়িতে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে বিজয় ভরালীর। অনেকদিন আগে যখন ইলা এবং সে এভাবে এই জমিতে দাঁড়িয়ে ছিল তখন জায়গাটা চারপাশের শ্যামলিমা তাদের দুচোখে শান্তির প্রলেপ মেখে  দিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে আজকের এই আশ্চর্য প্রস্তর নগরটি দেখার জন্য সে বেঁচে রইল না। ইলা বোধহয় আর্তনাদ করে উঠত। ইলার মত গাছপালাকে নিয়ে কোনো ভাব বিলাস না থাকলেও আজ চারপাশের এই অগনন বাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে বিজয় ভরালীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। মানুষ সভ্য শিক্ষিত হয়েছে, মানুষ প্রগতির সিঁড়িতে ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে আর সেই প্রগতির একটি প্রতীক যেন এই সুন্দর নতুন নতুন ডিজাইনের বাড়িগুলি। অরণ্য- যেখানে হয়তো এখনো মিশ্রিত হয়ে আছে আদিম বর্বরতার গন্ধ,তাকে মানুষের প্রগতি কামী মন বিনা দ্বিধায় নিষ্ঠুরভাবে একদিক থেকে ধ্বংস করে চলেছে।

‘বাবা, আপনি দেখছি কিছু দেখছেন না। এদিকে আসুন তো, আমি ভাবার তুলনায়  কাজ কিন্তু বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে।’ কমলার কথায় যেন বিজয় ভরালীর চেতনা ফিরে এল কিন্তু কমলার কথা তো সত্য নয়। তিনি তো দেখেননি এমন নয়। নিজের না হলেও এতক্ষণ পর্যন্ত অন্যের বাড়িগুলি তিনি দেখছিলেন।

কমলার নির্দেশ অনুসারে কমলারা যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখানে এগিয়ে যেতে গিয়ে বিজয় ভরালীর চোখ কমলার দিকে গেল-এত সুন্দর লাগছে বৌমাকে‌! আজ যেন বৌমাকে প্রথমবারের জন্য তিনি দেখলেন। অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মি-যার অপূর্ব সোনালী আভা অনেক অসুন্দরীকেও  কয়েক মুহূর্তের জন্য সুন্দরী করে তুলে-সেই সময়ে এসে পূর্ণ ভাবে  কমলার গালে মুখে সমস্ত শরীরে পরে ছিল। সেই মনোহর মূর্তির দিকে এক পলক অবাক হয়ে তাকিয়ে হঠাৎ বিজয় ভরালী অনুভব করলেন বৌমাকে এত সুন্দর লাগলেও যেন তার মনটা ঠিক তৃপ্ত হতে পারছেনা। কমলার সমস্ত দেহের কী এক অসৌন্দর্য্য যেন তার চোখ দুটিকে পীড়া দিচ্ছে, মনটা পবিত্র, আনন্দ এবং স্নেহে ভরে উঠার পরিবর্তে যেন এক ধরনের অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করছে-- আর সেভাবে আরেক মূহূর্ত তাকিয়ে থাকার পরে যেন বিজয় ভরালীর মনে বিদ্যুৎ চমকের মতো তার কারণটা স্পষ্ট হয়ে গেল। এত রুচি বিহর্গিত পোশাক কমলা পরেছে, একটা পাতলা কাপড় এমন ভাবে টেনেটুনে শরীরে মুড়ে নিয়েছে যে তার ফলে কমলার সমস্ত দেহ প্রকট হয়ে উঠেছে- এমন একটি ব্লাউজ পরেছে যে কাঁধের অর্ধেক থেকে তার শুভ্র বাহু অনাবৃত হয়ে সূর্যের আলোতে ঝলসে উঠেছে। এতদিন পর্যন্ত শীতের দিন ছিল তাই বৌমার এই ধরনের পোশাক বিজয় ভরালী আগে কখনও দেখেননি। এখন হয়তো গরম পড়তে শুরু করায় স্কুলেও এই পোশাক পরে কমলা যেতে শুরু করেছে। কিন্তু স্কুলে যাবার সময় তো তিনি কমলাকে কখনও সেভাবে দেখেননি। 

আজ বউমার মূর্তি দেখে ভাবলেন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-‘আমার এই দেহখানি তুলে ধর, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ কর’ কিন্তু আজকের মেয়েরা এসব কী করতে শুরু করেছে? নিজের দেহখনি দেবালয়ের প্রদীপ না করে তারা নিজেদের প্রদর্শনীর বস্তু করে চলেছে। ওরা ভুলে গেছে যে অতি বেশি প্রকট করা দেহ পুরুষের মনে কামনা জায়গাতে পারে মাত্র কিন্তু সেই দেহকে নিয়ে কোনোদিন কোনো রোমাঞ্চ জাগাতে পারে না। কোনো অজানা রহস্যের আকর্ষনে পুরুষকে আকর্ষিত করা যায়না। আর সেই অস্ত্র নিয়ে কোনো কবি কখনও সৌন্দর্যের মধুর বন্দনা গান রচনা করার কোনো প্রেরণাই খুঁজে পেতে পারে না। 

আরও কিছু ভাবতেই হঠাৎ বিজয় ভরালীর মনে পড়ে গেল যে তিনি বৌমার শরীর নিয়ে এসব কী রুচি বিহর্গিত কথা ভাবছেন- তিনি বিপত্নীক, বৃদ্ধ, কমলার শ্বশুর। ছিঃ ছিঃছিঃ- মুহূর্তের মধ্যে আত্মধিক্কারে বিজয় ভরালীর মনটা ভরে গেল-ছিঃ ছিঃছিঃ-বুড়ো বয়সে সত্যিই তার প্রকৃতির ভালোভাবেই অধঃপতন ঘটেছে।ছিঃ ছিঃছিঃ-





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...