রবিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২১

পূরবী- ৭১ ।। অভিজিৎ চৌধুরী ।। Purabi- 71

পূরবী- ৭১

অভিজিৎ চৌধুরী 



অনেক বছর আগে একটু অপরিচিত এক কাকুর বিয়ে হচ্ছে।যিনি বর তিনিই দেখিয়ে দিচ্ছেন কলাপাতা কেমন করে টেবিলে সাজাতে হবে।তীর্থ একটু অবাক হয়েছিল,বউকে ফেলে বিশেষ করে যখন নতুন এরকম কেউ খাওয়ার টেবিলের তদারকি করতে পারেন! পরে জেনেছে একে বলে কাল রাত্রি।

বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের প্রতি তরুণ প্রজন্মের বিশ্বাস চলে যাচ্ছে।কেউ কেউ ভাবছে, উটকো ঝামেলা।দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটিং যেমন অচল,সম্পর্কও তাই।অস্থায়ী।

রবীন্দ্রনাথের জন্য পাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না।শেষমেশ হল।তিনি নিজেই বিয়ের চিঠি লিখলেন।একজন চলে গেলেন পরে পরেই।নতুন বৌঠান।কেন গেলেন চিরঘুমের দেশে।হয়তো ভোলেননি কখনও তাঁর সেই সাহিত্য সঙ্গীর কথা,যাঁকে কিছুতেই লিখে চমকে দেওয়া যেত না।

পাখিদের পাড়া পড়শী - ৪।। পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi

পাখিদের পাড়া পড়শী - ৪

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস 

Pankaj Gobinda Medhi 


(চার)

সকালবেলা খাওয়া দাওয়া করার পরে সৌম‍্যদা আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকা জায়গাটিতে জয়ন্ত দত্ত আমাকে নিয়ে এল।

বুড়িদিহিং নদীটির ওপর দিয়ে পার হয়ে কিছুদূর আঁকাবাঁকা পথে এসে আমরা জয়পুরে উপস্থিত হলাম। জয়পুর শহর নয়, একটি উন্নত গ্রামের বাজার-টাজার থাকা কেন্দ্রীয় অঞ্চল। নাহারকাটিয়া থেকে ছয় কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। জয়ন্ত আমাকে জয়পুর থেকে আরও পূব দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাঁর মোটরসাইকেলে মহা আরামে বসে চারপাশটা দেখতে দেখতে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে আমরা অরণ্য অঞ্চলে প্রবেশ করলাম।

দুজনেই মৌন।

সৌম‍্যদার কাছে গিয়ে না বসলে জয়ন্ত হয়তো আমাকে অরণ্যের বিষয়ে কিছুটা সম্যক জ্ঞান দিত। অরণ‍্যটির বিষয়ে আমার যে কথা জানার প্রয়োজন তা সৌম‍্যদাই জানাবে বলে জয়ন্ত ধরে নিয়েছে। তার মধ্যে আমি আবার সৌম‍্যদার অতিথি।

কিছুদুর যাবার পরে দূর থেকে দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে কোনো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম তিনি আর কেউ নন– আমার শ্রদ্ধার সৌম‍্যদা। যার জন্য আমার জীবনের এই পট পরিবর্তন।

সৌম‍্যদার  কাছে আমাকে রেখে জয়ন্ত ফিরে গেল।

– আসার সময় রাস্তাঘাটে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি?

– না সৌম‍্যদা, কোনো অসুবিধা হয়নি ।

– খাওয়া-দাওয়ায়?

– না ,না। এই ধরনের সুস্বাদু খাদ্য আগে কোথাও খেয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না।

এটা নিশ্চয় ভালো নেতৃত্বের, ভালো লিডারের চিহ্ন। যে অন‍্যের খবর নেয়, অন্যেরাও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ।

সৌম‍্যদা এবং আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার পিঠে একটা রুকসেক। রুকসেকের ভেতরে আমার দৈনন্দিন ব্যবহার্য সমস্ত জিনিস নিয়ে এসেছি। সবকিছু। তাবলে রুট সেকের ভার বইতে পারব না তেমন কিছু নয়। কিছুটা কষ্ট হচ্ছে তবে চলে যাচ্ছে।

– অরণ্যে আসতে হলে যতটা সম্ভব কম জিনিস সঙ্গে আনা উচিত।

– না সৌম্যদা । বিশেষ কিছু নেই। না হলে চলে না এমন দুই একটি জিনিস আছে ।

– অরণ্যে তুমি কতদিন একনাগাড়ে থাকতে পারবে?

কথা বলতে বলতে গেলে পথ সংক্ষিপ্ত হয়, বহন করে আনা জিনিসের ওজন কমে।সৌম‍্যদা এই বুদ্ধিটাকেই কাজে লাগাচ্ছেন বলে মনে হল।

– আপনি যতদিন আমার সঙ্গে থাকবেন।

– টের পাবে চল, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। দেখতে না জানলে প্রতিদিন এখানে দেখতে পাওয়া সমস্ত কর্মকাণ্ডই একরকম বলে মনে হবে।

– আপনি তো দাদা দেখাবেন বলেই ডেকে–

আসা যাওয়ার রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের একটা শুকনো ডালে হোঁচট খেয়ে আমি ছিটকে পড়ে যাচ্ছিলাম।

– দেখে। দেখে। একটু সতর্ক হয়ে পথ চল।।

আমার অসচেতনতার জন্য আমি একটু লজ্জিত বোধ করলাম।সৌম‍্যদা কোনোরকম পরোয়া না করেই এগিয়ে যাচ্ছে। আমার মনের ভাবের পরিবর্তন করার জন্য সৌম‍্যদা বক্তব্য বিষয়ের পরিবর্তন ঘটালেন।

– এগুলি প্রাকৃতিক রাস্তা নয়, লগিং অপারেশনের রাস্তা। অতীতে ব্রিটিশ অরণ্যের অভ্যন্তরে কাটা গাছ আনা-নেওয়া করার জন্য ব্যবহার করা পথ। বহুদিন- বহু বছর ব্যবহার না করার ফলে পথ গুলি আগাছায় ঢেকে ফেলেছে যদিও আসা-যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

কিছুদূর হাঁটার  পরে আমরা একটি নদীর তীরে উপস্থিত হলাম। নদীটা খুব বেশী বড় নয়। বর্ষার সময়েও জল কম থাকে। পাহাড় থেকে বয়ে আসা বলে নদীটি খুবই খরস্রোতা। নদীর বুকে থাকা পাথরে ধাক্কা খেয়ে জল কুলু কুলু সুরধ্বনি তুলেছে। এক উতলা সঙ্গীত।

সৌম্যদা বললেন–' এই নদীটির নাম নামচাং।

নতুন করে পরিচয় হওয়া কোনো লোকের চোখের সঙ্গে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে করমর্দন করার মতোই আমি দেখতে পাওয়া দূরত্ব পর্যন্ত নদীটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত আমার দৃষ্টি প্রসারিত করলাম।

আমি বললাম– সুন্দর নাম।

সৌম‍্যদা নদীতীরের একটু খোলামেলা জায়গায় ' 'টু মেন টেন্ট' লাগিয়েছে। এই তাঁবুর ভেতরে দুজন মানুষ অনায়াসে রাত কাটাতে পারে। সবুজ রঙের তাঁবুটা দেখতে অনেকটা একটি বসে থাকা কাছিমের মতো। আমি ত়াঁবুটার দিকে এগিয়ে গিয়ে আমার পিঠ থেকে রুকসেকটা নামিয়ে রাখলাম।

পিঠ থেকে পৃথিবীটা  নামিয়ে রাখলাম বলে মনে হল।

সৌম্যদাকে  ছেড়ে আমি নদীর ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। ছোট একটি পাথরের ওপরে বসে ডান হাতের অঞ্জলিতে নেওয়া জল চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলাম। জলটা বেশ ঠান্ডা। জলবিন্দু লেগে মুখটা  কুঁচকে যাওয়ার মতো হল। তা সত্বেও হাত মুখ ধুয়ে সতেজ বলে মনে হল এবং অবসাদ দূর হয়ে গেছে বলে মনে হল।

পকেটে থাকা গামছাটা বের করে মুখ মুছতে মুছতে আমি সৌম‍্যদার কাছে পৌঁছে গেলাম।

– কী করবে? চল অরণ্যের ভেতরে যাই।

আমি অরণ্যের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। সৌম‍্যদার কথা শুনে আমার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল।

আমরা নদীর তীরে তীরে পাথরের অরণ্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলাম। কিছুদূর সেভাবে যেতে যেতে পাথরের অরণ্য ছেড়ে আমরা সবুজ অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করলাম ।

অরণ্যের মধ্যে নাহর ফুটেছে। নাহরের ফুলের গন্ধ আমার নাসিকা গহ্বরকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।

চোখের সামনে সবুজের মহাসমারোহ। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই ভিন্ন প্রজাতির গাছপালা- তরু-তৃণ -বৃক্ষ । উঁচু উঁচু ঢেঁকিয়া, বন্য কলা, নানা রঙের কচু, দুই হাত প্রসারিত করে গোড়ার অর্ধেক পর্যন্ত হাত না পৌঁছানো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষ, শূন্যে ঝুলে থাকা– মায়াময় স্বর্গীয় পরিবেশ।

সৌম‍্যদার পেছনে পেছনে বোকার মতো আমি এগিয়ে চলেছি । জানিনা এই স্বপ্নপুরীর শেষ কোথায় ! কোথায় বাসর পেতে অপেক্ষা করে রয়েছে স্বপ্নের সবুজ রাজকুমারী । প্রতিটি গাছপালাতেই  হয়তো রাজকুমারীর রাজপ্রাসাদ, তা না হলে প্রকৃতি এত অপূর্বভাবে প্রতিটি গাছপালাকে এত নিপুণতার সঙ্গে সাজাবে কেন ?

– বর্ষারণ‍্যের  মধ্য দিয়ে হাটার মজাই আলাদা। বর্ষারণ‍্যে বছরে আশি ইঞ্চি বা তার চেয়ে অধিক পরিমাণে বৃষ্টি হয়। এখানে চারটি স্তরের উদ্ভিদ দেখা যায়। প্রথম স্তরটি হল 'হার্ব লেয়ার' বা ভূমি সংলগ্ন স্তর। তার ওপরের স্তর কয়টি যথাক্রমে ' 'আন্ডারস্টোরি লেয়ার' বা নিম্ন স্তর; 'কেনোপি লেয়ার' বা 'মধ্যস্তর ' এবং' ইমাজেন্ট লেয়ার বা 'শীর্ষ স্তর'।

আমি একান্ত মনে শুনে চলেছি।

দেখে! জোঁক আছে কিন্তু। একেবারে সাবধান হবে।

আমি পায়ের মাসলে  অনেকক্ষণ থেকেই চুলকানি অনুভব করছিলাম। এতক্ষণে আমার চেতনা ফিরে এল। প্যান্টটা গুটিয়ে নিতেই একটা জোঁককে  মহা-আনন্দে আমার শরীর থেকে রক্ত খেতে থাকা দেখতে পেয়েই একটানে জোঁকটা ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললাম। থেমে থাকার জন্য চারপাশ থেকে এক ঝাঁক জোঁক আমার দিকে তেড়ে এল।জোঁকের ঝাঁকটা দেখে আমার মনে হল, সেগুলি যেন জোঁক নয়, অজস্র লিলিপুট।

– বেরিয়ে এসো,বেরিয়ে এসো।

সৌম‍্যদা প্রায় দৌড়ে এসে যত দ্রুত সম্ভব অরণ্য অঞ্চল থেকে একটু  খোলা জায়গায় আসার চেষ্টা করলেন। ফিরে এসে আমরা আবার নদীর তীর পেলাম। সৌম্যদা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় খুলতে লাগলেন।সৌম‍্যদার শরীরে কয়েকটি জোঁক।শরীরের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত একটা একটা করে জোঁকগুলি ছাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

–' তোমার শরীরেও আছে, দেখ।’

তখনই আমি পরে থাকা জামা এমনকি লংপ্যান্টটাও খুলে ফেললাম। আমার শরীরে সৌম্যদার শরীরে লেগে থাকার মতো অনেকগুলো জোঁক নেই । শুধু একটা লেগে আছে। সেটা ছাড়িয়ে দেওয়ার পরে ক্ষতস্থান থেকে প্রবল ধারায় রক্ত বের হতে লাগল। আমি সৌম‍্যদার দিকে তাকালাম।তাঁর দেহের কয়েক জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে ।সৌম‍্যদা মানিব্যাগ থেকে পেপার সাবান বের  করে তখনই নদীর জলে নেমে গেলেন এবং সাবান দিয়ে ক্ষতস্থান গুলি ধুয়ে  দিতে চেষ্টা করলেন।

আমি নদীর খাড়াইয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।

 –জোঁক রক্ত খাবার পরে এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ ঢেলে দেয় ।

সৌম‍্যদা বললেন । প্রত্যুত্তরে আমি সৌম‍্যদাকে বললাম – সেটা হিপারিন বা হিরুডিন। এটা রক্তের জমাট বাঁধা বন্ধ করে দেয়।

– সেই জন্য সাবান দিয়ে ধুয়ে দিয়েছি। কিন্তু শরীর থেকে সাবান ধুয়ে দিতে অসুবিধা হবে।

– কেন সৌম‍্যদা?

– এই নদীর জল কঠিন, হার্ড ওয়াটার।জোঁকে খাওয়া  স্থান থেকে হওয়া রক্তক্ষরণ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য আমি সাবান ঘষেছি। সাবান থেকে পরিত্রান পাবার জন্য আমাকে লালমাটি গায়ে ঘষতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

সৌম‍্যদার এই ধরনের যন্ত্রণা দেখে অরণ্যের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র মোহভঙ্গ ঘটল না। ঠান্ডা জলে শিহরিত হয়ে থাকা সৌম‍্যদা , অরণ্যকে নতুন রূপে দেখার জন্য আমার সহায়ক হল। আমিও জলে নেমে গেলাম। পাহাড়িয়া খরস্রোতা নদীর সঙ্গে আমার পুরোনো পরিচয় নেই। সেই জন্য জলে বেশিক্ষণ না থেকে দ্রুত উঠে এলাম।

গা- মাথা- চুল শুকোনোর জন্য আমি আর সৌম‍্যদা মুখোমুখি ভাবে দুটো পাথরে বসলাম । পড়ন্ত বেলার সূর্যের আলো দুজনকেই ভাসিয়ে নিল।

– একটা কাজ করি চল। নদীর তীর ধরে হাটতে থাকি!

আমার আপত্তি করার মতো কিছু ছিল না। বরঞ্চ আমি খুশিই হলাম ।

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে হাঁটার পরে আমরা নামচাং নদী এবং বুড়ি দিহিং নদীর সংযোগস্থলে পৌঁছে গেলাম। সেখানে একটি পাকা সেতু ।

এই সেতুটা পার হয়ে অরুণাচল যাওয়া যায় । দেওমালি নামে জায়গায় ।

আমি এবং সৌম‍্যদা সেতুর ওপরে উঠে দাঁড়ালাম। জায়গাটা সুন্দর। দেওমালি বোধ হয় আরও সুন্দর হবে। দেওমালি যাবার ইচ্ছা হল ।

সৌম‍্যদা  কম সময়ের মধ্যে আমার মন বুঝতে পেরে গেলেন ।

– আমরা দেওমালি যাব।যদি তুমি তোমার ছুটি বাড়াতে পার।

– এখানে থাকার সুযোগ পেলে চাকরিটাই ছেড়ে দেব।

– না, চাকরি ছাড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে মাঝেমধ্যে এসো আর চাকরি করতে থাক।

ফিরে আসার পরে সৌম‍্যদা গতকাল জেলেদের নৌকায় করা নৌকা বিহারের কাহিনি বলতে শুরু করলেন।

– একটা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে তিনজন মাঝি বুড়িদিহিং  নদীতে নৌকা বেয়ে যাচ্ছিল । আমি হাতের ইশারায় ডাকায় তারা কাছে চলে এল এবং আমাকে তাদের নৌকায় উঠিয়ে নিল। মাঝির নাম গেনিয়া। সঙ্গের একজন ধরিচান্দ এবং অন্যজন শংকর। শংকর গেনিয়ার ছেলে। বয়সে ছোট, তেরো বছর। ধরিচান্দের বয়স তিন কুড়ির কাছাকাছি। গেনিয়ার বয়স দুই কুড়ির বেশি।

সৌম‍্যদা কথাগুলি এভাবে বললেন আমার ভ্রমণ-কাহিনি পড়ে নিজেই ভ্রমণ করার মতো বলে মনে হল। সৌম‍্যদার বর্ণনারীতি  অত্যন্ত মনোরম।সরল এবং প্রাঞ্জল।

– ওদের নৌকায় মাছ ধরা এবং একটি ছোট সংসারের সমস্ত উপকরণ রয়েছে। কটারি,দা,কড়াই,জাল,টাকুরি, দুটি থালা, সরষের তেলের টিন কেটে  মাটি ভরে নিয়ে তৈরি করা উনুন,জলে ভেসে থাকা খড়ির টুকরো, তামাক, পুরোনো খবরের কাগজ– মাঝির নৌকায় গৃহস্থালির এই ক্ষুদ্র সংস্করণের মধ্যে আমরা চারটি প্রাণী। নৌকাটি থেকে মাছ এবং মাছ ডুবিয়ে রাখা জলের কাঁচা মাছের গন্ধ ভেসে আসছে। তাঁদের বুড়িদিহিং নদীতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা এবং ছোট ছোট জালে মাছ ধরতে দেখলাম। নৌকা তীরে লাগিয়ে অরণ্য থেকে বণ‍্য তেলাকচু,কৌপাত সংগ্রহ করতে দেখলাম। তেলা কচু দিয়ে রান্না করা মাছের তরকারি দিয়ে দুপুরের আহার ওদের সঙ্গেই উদরস্থ  করে খুবই তৃপ্তি পেলাম।

সৌম‍্যদার মনে গতকালের তরকারির স্বাদ এতটাই ভালো  লেগেছিল যে তিনি পুনরায় সে কথা স্মরণ করে তালুতে জিভ ঠেকিয়ে তৃপ্তির আওয়াজ তুললেন। তারপরে সৌম‍্যদা আরম্ভ করলেন গেনিয়া তাকে বলা একজন পিশাচিনীর কথা।

– গেনিয়া আমাকে বলে চলেছে পিশাচিনী মেয়েটির কথা– পেছন থেকে মেয়েটিকে দেখতে নাকি খুব সুন্দর, দীর্ঘ চুল, শরীরের গড়ন আঠারো উনিশ বছরের যুবতির মতো। মেয়েটিকে কেউ অনুসরণ করলে নামচাঙের কাদামাটিতে পুঁতে মেরে ফেলে। আর যদি মেয়েটিকে আপনি ডাকেন তাহলে আপনি তার বীভৎস মুখটা দেখতে পাবেন। কুচকুচে কালো, ঠোঁট নেই বলে বেরিয়ে আসা দুই পাটি দাঁত, ধবধবে দুটি সাদা চোখ, চোখের মনি নেই। তার মুখটা দেখার পরে আপনার জ্বর আসবে এবং আপনার মৃত্যু হবে। আমি এই সমস্ত বিশ্বাস করিনা। তবু আমার কেমন যেন একটা ভয় হতে লাগল। গত রাতে তাঁবুতে একাই ছিলাম। মেয়েটিকে দেখার আগ্রহে ঘুম এল না। মাঝেমধ্যে মাথা বের করে নদীর দিকে তাকাই।নেই, কোথাও নেই। কেবল ঝিল্লি এবং উচ্চিংড়ের শব্দ । হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভোর হয়ে এল।

– তার মানে সৌম‍্যদা গতরাতে আপনি পিশাচিনী মেয়েটির প্রেমে পড়লেন। 

সৌম‍্যদা ঈষৎ এসে আমার দিকে তাকালেন।সৌম‍্যদা হয়তো আমার মুখটা পিশাচিনীর মতো দেখলেন।সৌম‍্যদা মুখটা কুঁচকে নেওয়ায় আমার সেরকমই মনে হল।

গেনিয়া এবং পিশাচিনী মেয়েটির কাহিনি সৌম‍্যদা আমার সামনে প্রায় এক ঘণ্টা সময় ধরে বর্ণনা করে থাকার জন্য আমাদের পথ অনেকটা সংক্ষিপ্ত হয়ে এল। আমরা নদীটি নির্দিষ্ট জায়গায় তৈরি করা তাঁবুটার কাছে পৌঁছে গেলাম। ক্লান্তি দূর করার জন্য দুজন দুটো পাথরের ওপরে বসলাম। পাথর দুটি ইতিমধ্যে আমাদের কাছে দুটো  পিঁড়ি  হয়ে উঠেছিল।

আমাদের ক্লান্ত লাগছিল। আকাশের চাঁদ রাতটা আমাদের পাহারা দেবার জন্য সেজেগুজে তৈরি হয়ে এসেছে। রাতের আহারের জন্য আমি কিছু খাবার পুঁটলি করে এনেছিলাম। আমার রুকসেকটা থেকে রাতের জন্য প্রয়োজনীয় দুই একটি জিনিসের সঙ্গে খাবার জিনিসটুকু বের করে নিলাম। সিদ্ধ করে আনা চাওমিনের একটি পুঁটলি সৌম‍্যদার দিকে এগিয়ে দিয়ে আমিও আমার পু়টলিটা খুলে চাওমিনটুকু বের করে নিলাম। দুই ঘন্টা ধরে একনাগারে হাঁটায় আমার বেশ ক্ষুধা পেয়েছিল। তাই চাওমিনটুকু গোগ্রাসে গিলে  ফেলতে বেশি সময় লাগল না।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সৌম‍্যদা এবং আমি তাঁবুটিতে অনায়াসে ঢুকে পড়লাম। অরণ‍্যে এই প্রথম আমার রাত্রি যাপন। রাতের বেলা বেশি কথা না বলাই মঙ্গল জনক‌। সেই জন্য আমরা দু একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া কথা বললাম না।

– গুড নাইট।

– গুড নাইট।

দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

রাত কত হয়েছে আমি জানিনা। কোনো একটি বন‍্য  জন্তুর আকুল চিৎকারে আমি জেগে গেলাম। হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালাম। রাত তিনটে বেজে পঞ্চাশ মিনিট ।সৌম‍্যদার দিকে উৎসুক ভরা দৃষ্টিতে তাকালাম।সৌম‍্যদা ও জেগে উঠেছেন। বন্যপ্রাণীটা তখনও  থেমে থেমে চিৎকার করছিল। রাতের গভীরতার মধ্যে সেই চিৎকার অরণ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ।

– সম্বর

সৌম‍্যদা বলেছিলেন।

সম্বর হরিণ জাতীয় প্রাণী। আমার ভয় হচ্ছিল না। এরমধ্যে পাশে আবার সৌম‍্যদা রয়েছে। আমার চোখে পুনরায় ঘুম নেমে এল।

জানিনা কতটা বেলা হয়েছে।সৌম‍্যদা আমাকে ডাকতে লাগলেন। ঘুমের জড়তা কাটিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম সৌম‍্যদার চা বানানো শেষ। দুটো কাপে তিনি চা ঢালতে লাগলেন।আমি তখনই মুখ হাত ধুয়ে আমার নিত্যকর্মাদি শেষ করলাম।সৌম‍্যদা আমার চায়ের কাপটা বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে রেখেছে।দুটি বিস্কুট দিয়ে চা খেয়ে আমি সৌম‍্যদার সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলাম।

সৌম‍্যদার কাঁধে একটা ক‍্যামেরা এবং গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে একটা বাইনোকুলার।

আমি আমার ক্যামেরাটা এবং তিনশো মিমি জুম লেন্সটা নিয়েছি ।পাখির আলোকচিত্র সংগ্রহ করার জন্য আমার তিনশ মিমি জুম লেন্সের প্রয়োজন হবে। লেন্সটিতে স্টেবিলাইজার সংযোজিত  হয়ে থাকার জন্য ট্রাইপড না নিলেও চলবে। আমার হাত খুব একটা কাঁপে না ।

সৌম‍্যদার পেছন পেছন এসে আমরা দুজনেই একটা পাকা রাস্তায় উঠলাম।

– এই রাস্তাটা জয়পুর থেকে এসেছে। কঁঠালগুড়িতে রাস্তাটা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ভাগ গিয়েছে অরুণাচলের খুনচা পর্যন্ত এবং অন্য ভাগটি  গিয়েছে দেওমালি পর্যন্ত। আমরা এখন গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে জয়পুরের দিকে যাব।

ভোরবেলার মুখ ফুলিয়ে রাখা অরণ্য। ঝিল্লি এবং নানারকম পতঙ্গের তীব্র আওয়াজ। ওদের আওয়াজগুলি এমন ভাবে কানে এসে লাগছে যে অন্য কথা শোনার উপায় নেই।

– এই ঝিল্লি এবং পোকামাকড়ের শব্দের জন্য বর্ষারণ‍্যে পাখিদের পর্যবেক্ষণ করা একটি কঠিন কাজ। পাখির কণ্ঠস্বর না শুনলে চট করে পাখিকে সঠিকভাবে চিনতে পারা কঠিন । তাছাড়া ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাখিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তার কণ্ঠস্বর শোনা প্রয়োজন ।

আমি সৌম‍্যদার কাছ থেকে একান্ত মনে দীক্ষা গ্রহণ করে চলেছি । এক ঝাঁক পাখি আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে এসে আমাদের সামনে থাকা অশ্বত্থ গাছে বসল ।আমি পাখিটাকে চিনতে পারলাম না ।

– স্কারলেট মিনিভেট বা রূপসী পাখি। অশ্বত্থ গাছের ডালে কিছু ছোট ছোট পতঙ্গ বাসা বেঁধেছে।এরা বাসা ভেঙ্গে পতঙ্গের সংসার ভক্ষণ করবে।

সৌম‍্যদা বাইনোকুলারটা আমার হাতে তুলে দিলেন।

আমি একান্তমনে পাখিদের ঝাঁকটা এবং ওদের কাজকর্ম নিখুঁতভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম ।সৌম‍্যদা খালি চোখেই পাখিদের ঝাঁকটাকে লক্ষ্য করছিলেন ।

সৌম‍্যদাকে  বাইনোকুলারটা ফিরিয়ে দিয়ে আমি এবার ক্যামেরার লেন্স দিয়ে পাখির ঝাঁকটাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম এবং রেঞ্জ মিলিয়ে দুই  একটি পাখির আলোকচিত্র নিতে সক্ষম হলাম।সৌম‍্যদা এবার বাইনোকুলারটা দুই চোখে লাগিয়ে নিয়ে একান্ত মনে পাখির ঝাঁকটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। আগেও নিশ্চয় সৌম‍্যদা স্কারলেট মিনিভেট পাখি দেখেছেন, কিন্তু প্রতিবারই যেন পাখিগুলি নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হয়।সৌম‍্যদা সেই সুধা একান্তমনে পান করছেন।

আমরা এগিয়ে গেলাম। কিছুদূর এগিয়ে এসে আমরা একটা কাঁচা রাস্তা পেলাম। রাস্তার দু'পাশে ফুলের সমাহার।

–সৌম‍্যদা এসব কী ফুল?

– দোপাটি ফুলের মতো নয় কি? ইংরেজিতে বলে ওয়েস্টার্ন হিল বলচাম। 

আমরা দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তা দিয়ে মানুষ অরণ্যে যাওয়া আসা করে। রাস্তাটা বেশ বড় সড়।সৌম‍্যদা এবং আমি রাস্তাটা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলাম। কিছুদূর এগিয়ে গিয়েই আমরা একটি ঝর্ণা দেখতে পেলাম। সুন্দর ছোট একটি ঝর্ণা। অতিশয় চঞ্চল।এ কি! ঝর্ণার তীরে প্রজাপতির বাগান। ফুটফুটে প্রজাপতি গুলি সেই বাগানে একান্ত মনে উড়ে বেড়াচ্ছে। একঝাঁক যদি মাটির এক ফুট দেড় ফুট উঁচুতে উড়ছে, অন্য ঝাঁক ঝর্ণার জলে ভেজা পাথরের ওপরে বসে পান স্পৃহা নিরসন করছে। পরিবেশটা আমার রূপকথার পরীর মনোরম বাগানের মতো মনে হল।

প্রজাপতির বাগানের পাশ দিয়ে  আমরা দুজনেই উঁচু উঁচু হোলোং গাছের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম। যুগ যুগ ধরে এই গাছগুলি অরণ‍্যের  শোভাবর্ধন করেছে তাই নয় অরণ্যকে অভয়ও প্রদান করে আসছে।

 রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটা প্রকাণ্ড পাথরে আমরা দুজনেই বসলাম ।সৌম‍্যদা উঁকি দিয়ে কী দেখছে । এবার বাইনোকুলারটা চোখে লাগিয়ে নিয়েছে।আরেকবার নামিয়ে নিয়ে দেখছে ।

– ভেলভেট ফ্ৰন্টেড নাথোস ।

– মনে থাকবে না সৌম্যদা।

– তুমি আমার পাখি পর্যবেক্ষণের  বইটা হাতের কাছে রাখবে ।

তখনই আমার মনে পড়ল রুকসেকে বইটা যেভাবে ঢুকিয়ে রাখা ছিল সেভাবেই থেকে গেছে।আনতে ভুলে গেছি ।

– বইটা আছে। রুকসেকেই থেকে গেল।

– কোনো অসুবিধা নেই। পাখি গুলির পরিচয় সেখানে দেওয়া আছে।  

নীল রঙের ছোট পাখি। সেই পাখিটির দিকে আমরা স্থির ভাবে তাকিয়ে থাকায় এক জোড়া পাখি এসে গাছের গুড়িতে পড়ে চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। আমি আবার উৎসুক ভাবে সৌম‍্যদার দিকে তাকালাম।

– কাঠঠোকরা। এত ছোট কাঠঠোকরা আমি এর আগে দেখিনি। ইংরেজিতে বলা হয় হার্টস্পটেড উডকিপার।

পাখি দুটি ঘন অরণ‍্যের দিকে উড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা দুজনেই নিজের নিজের ধরনে পাখিগুলির সান্নিধ্যে প্রায় দশ মিনিট সময় অতিবাহিত করতে সক্ষম হলাম।

তারপরে আমরা পুনরায় সেই পথ দিয়ে এগিয়ে গেলাম।

কিছুদূর এগিয়ে এসে আমরা পুনরায় নামচাং নদীর তীরে উপস্থিত হলাম। নদীর তীরে আমরা একটি ঝুপড়ি ঘর দেখতে পেলাম। ঘরটা দেখে মনে হয় তাতে মানুষ রয়েছে।সৌম‍্যদা উৎসুক ভাবে এগিয়ে গেলেন। ঘরটার সামনে এগিয়ে গিয়ে সৌম‍্যদা আওয়াজ দিতেই ভেতর থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে এল। মানুষটার সঙ্গে সৌম‍্যদা কী কথা বললেন আমি শুনতে পেলাম না। আমি কেবল নদীটি দিয়ে বয়ে যাওয়া জলরাশিতে চোখ রেখে ভাবে বিভোর হয়ে ছিলাম।সৌম‍্যদা যে কী সাহসে একা একা এই নদীর তীরে তীরে অরণ্যের মধ্যে বন্য প্রাণীকে বিন্দুমাত্র ভয় না করে ঘুরে বেড়াতে পারেন। তিনি কেন বিন্দুমাত্র নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন না। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়।সৌম‍্যদা ও বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। তিনি নিঃসঙ্গতার কাঁটা উপড়ে ফেলার জন্য হয়তো অরণ্যের এই নিঃসঙ্গতার মধ্যে ছুটে আসেন।

 – মানুষটার নাম অনিল গগৈ। বন বিভাগের অস্থায়ী কর্মচারী।জায়গাটির নাম সুগরী পথার ।

মানুষটাকে বললাম একদিন পরে আমি এখানে আসব। তুমি যাওয়ার পরে আমি একা থাকার চেয়ে এখানেই থাকব বলে ভাবলাম। মানুষটাও আপত্তি করলেন না।

আমার এবং সৌম‍্যদার প্রত্যাবর্তন শুরু হল।পুনরায় একই পথে ফিরে এসে আমরা পাকা রাস্তাটা পেলাম। তখনই অরুণাচলের দিক থেকে একটা ট্রাক আসায় সৌম‍্যদা ট্রাকটাকে থামালেন। আমরা দুজনেই ট্রাকের পেছনে উঠে পড়লাম। কিছুদুর গিয়ে আমরা ট্রাক থেকে নেমে পুনরায় নামচাং নদীর তীরের টেন্ট হাউসে ফিরে এলাম।

আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল। সারাদিন এভাবে হাঁটার আমার অভ্যাস নেই । তাতে আবার পাহাড়িয়া নদীপথ । দৌড়াদৌড়ি করে গিয়ে আমি নদীতে একটা ডুব মেরে এলাম । আমার সমস্ত শরীর ঠান্ডা জলে কেটে নেওয়ার মত মনে হল।

সৌম‍্যদা রাতের বেলা খাবার জন্য মেগি রান্না করছে ।

খেয়েদেয়ে তাঁবুর মনোরম অস্থায়ী বিছানায় শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রা দেবী আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ।

সকালে যখন আমি এবং সৌম‍্যদা জেগে উঠলাম তখন সাতটা বেজে গেছে । সূর্য দেবতা মহা আয়াসে বাসর পেতেছে । আজ বেশি দূরে যাব না বলে আমরা রাতেই  স্থির করে রেখেছিলাম।সৌম‍্যদা বুঝতে পেরেছেন এই মহাজনের শরীর একদিনের হাঁটাতেই  অবশ ।

দৈনন্দিন কাজ করে চা-বিস্কুট সেবন করতে করতে ন'টা বাজল। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন কথার চর্চা ও চলতে থাকল।

– আজ আমরা বেশিদূর যাব না। কাছেই  পাখি থাকার জায়গায় একটু ঘোরাফেরা করব।

আমি খুশি হলাম।শরীর কিছুটা অসহযোগ করছে বলে মনে হল।

ঘরোয়া জিনিসপত্রগুলি গুছিয়ে আমরা  পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রস্তুত হয়ে বের হলাম। নামচাং নদীর তীর ধরে কিছু দুরে গিয়ে একটা কাশবন পেলাম।কাশবনের মধ্যে চরতে থাকা একটা নেউলের পরিবার দেখে ভালো লাগল। ওরা মনের আনন্দে গাছ থেকে খসে পড়া পাতার  মধ্যে পোকা জাতীয় প্রাণীগুলি খুঁজে বেড়াচ্ছে। নেউলের দলকে দেখে কাছে থাকা কাঠবিড়ালি একটা চিৎকার করছে। নেউলের দলের সঙ্গে তার কোনো সহমর্মিতা নেই। কাঠবিড়ালির তীব্র চিৎকার শুনেই যেন সেখানে দুটি পাখি উপস্থিত হল।

– এই দুটি কী পাখি সৌম‍্যদা?

– এক ধরনের পেঁচা,হেয়ার ক্রেচটেড ড্রংগো।

পাখি দুটি নিজস্ব ভঙ্গিমায় বেশি শব্দ করে নেউলের দলকে অপমান করতে লাগল। ঠিক সেই সময়ে সেখানে উপস্থিত হল অন্য একটি  পাখি।

-এটা?

এই পাখিটাও গাছের ডালে পরে অশান্তিকর ভাবে চিৎকার চেঁচামিচি করতে লাগল।  তিনটির সম্মিলিত বাহিনীর হাতে নেউল বাহিনী রণে ভঙ্গ দিল এবং অরণ্যের মধ্যে কোথায় যেন চলে গেল ।

সৌম‍্যদা একান্ত ভাবে বিভোর হয়ে আছে। চিন্তায় নিমগ্ন। আমি তাকে অসুবিধা দিতে চাইলাম না ।

কিছুক্ষণ এভাবেই ভাবমগ্ন   হয়ে থাকার পরে হঠাৎ দূরে সরে এসে সৌম‍্যদা আমাকে বললেন–চল।

–কী ভাবছিলেন সৌম‍্যদা।

– আর বল না। প্রকৃতির মধ্যে থাকলে  আমি কখনও কখনও নিজেকে হারিয়ে ফেলি। কখনও নিজেকে হারিয়ে দেখ। নিযুত নিযুত বছর পুরোনো এই পৃথিবীতে আমরা কত তুচ্ছ বাসিন্দা। আমরা মরে যাব, গাছপালাগুলি থেকে যাবে। থেকে যাবে এই মনোমুগ্ধকর সুবিশাল অরণ্যভূমি। নিজেকে দুর্বল ভাবতে কার বা ইচ্ছে হয়। একদিন যে মরে যাব সে কথাও কেউ চট করে ভাবেনা । ভাবলে  দেখতো কেমন লাগে।তবে আমি মরার কথা ভাবছি না। ভাবছি এই অরণ‍্য  সমূহের সঙ্গে যাতে সারাজীবন নিবিড় ভাবে কাটাতে পারি।

– আপনি আমাকে অরণ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।সুন্দর পাখপাখালি, জীবজন্তু, গাছপালার সঙ্গে।সত্যি কথা বলতে গেলে আমি নতুন জীবন লাভ করেছি। কয়েক বছর আগে যদি আপনার সঙ্গে দেখা হত।

কোনো কথা নেই ‌। এখনও তুমি সময় পেলে অরণ্যের কাছে চলে এসো । সবুজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে দেখ।

সৌম‍্যদা থামলেন। হাতের বাইনোকুলারটা দু চোখের সামনে তুলে ধরলেন ।

– ওটা রাজধনেশ,গ্ৰেইট হর্ণবিল।

সৌম‍্যদা বাইনোকুলারটা আমার হাতে তুলে দিয়ে পাখি দুটি দেখার জন্য সুবিধা করে দিলেন। 

–ঐ যে পাখির ঝাঁকটা  গাছের ডালে এসে বসেছে– সেগুলি পাহাড়ি ময়না। ধনেশ এবং ময়না পাখির ঝাঁক গাছের গুটি খেতে এসেছে।

পাখি দেখতে দেখতে কিছুদূর এগিয়ে যাবার পরে ঝোপের মধ্যে গুমগুম শব্দ শুনে আমরা দুজনেই থমকে দাঁড়ালাম। আমার কাছে একেবারে অপরিচিত শব্দ। সৌম‍্যদাও হয়তো শব্দটির উৎস বুঝতে পারছে না।

– এক ধরনের কবুতর,ইমারেল্ড ড'ভ।পুরুষ পাখিটা গুম গুম করে ডাকছে।

অরণ্যের মধ্যে সন্ধ‍্যে হওয়া  পর্যন্ত আমরা দুজনেই এভাবে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ালাম ।সৌম‍্যদা চোখের সামনে পড়া সমস্ত পাখির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি একটা কথা ভেবে অবাক হই মানুষটা কীভাবে এতগুলি পাখির স্থানীয় নাম, ইংরেজি নাম এবং বৈজ্ঞানিক নাম মুখস্থ রেখেছেন।এই দুই দিনে আমি কেবল কয়েকটি পাখির ইংরেজি নাম মুখস্ত করতে সমর্থ হয়েছি।

ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে দিনটা কীভাবে অতিক্রান্ত হয়ে গেল আমি বুঝতেই পারলাম না। মাঝেমধ্যে ক্ষুধার ভাবটা  জেগে উঠেছিল যদিও সামনের প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাকে এভাবে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল যে আমি পেটের ক্ষুধার প্রতি কোনোরকম গুরুত্ব আরোপ করিনি। আমার হাঁটার অনভ্যাসের জন্য পা দুটিও মাঝেমধ্যে অসহযোগ করছিল। আমি পা-দুটির অনাকাঙ্ক্ষিত আবদারকেও অবহেলা করলাম। তবে এখন নদীর তীরের পাথর দুটিতে বসে পা দুটি ঠান্ডা জলে ভিজিয়ে দেওয়ায় পাদুটি ব্যথায় ভেঙ্গে পড়ছে বলে মনে হল। চোখেমুখে জল ছিটিয়ে নিজেকে সতেজ করে তোলার চেষ্টা করলাম।সৌম‍্যদা ইতিমধ্যে অস্থায়ী উনুনে মেগি সিদ্ধ করতে শুরু করেছে।এ ধরনের যাত্রাকালে সহজলভ্য খাদ্য সম্ভার হল মেগি চাও চাও জাতীয় খাদ্য সমূহ। তৈরি করতেও সময় লাগে কম এবং ক্ষুধার সময় তা হয়ে উঠে পরমান্ন ।

সৌম‍্যদাকে বিদায় বিদায় জানাতে খুব মনোকষ্ট হচ্ছে। খাবারটা হাতে নিয়ে দেখতে পেলাম জয়ন্ত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দুলিয়াজান স্টেশনে সে আমাকে নামিয়ে দেওয়ার কথা। জয়ন্তকে  দেখার পর থেকেই আমার মনোকষ্ট আরম্ভ হয়ে গেল। গত দুটিদিন সৌম‍্যদার সঙ্গে একসঙ্গে ঘুরেছি-বেড়িয়েছি, খেয়েছি- ঘুমিয়েছি।

সৌম‍্যদা জয়ন্তের দিকেও কিছুটা মেগি এগিয়ে দিলেন। সে খাবে না বলল।

আমাকে বিদায় জানিয়ে সৌম‍্যদা সুগরি পথারের অনিল গগৈ থাকা ঝুপড়িটিতে যাবে। রাতের অন্ধকার পৃথিবীতে নেমে আসতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি। আমি জানি না সৌম‍্যদা সেখানে কতদিন সবুজ এবং অরণ‍্যের সঙ্গে একসঙ্গে থাকবেন। তাকে জিজ্ঞেস করায়  বললেন– আমিও জানিনা। 









আটপৌরে ৪৮ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 48, by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৪৮ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 48, by Sudip Biswas





আটপৌরে কবিতা

৪৮.
নাকাষষ্ঠী

স্কুপভেলভেট।  হাইহিলহেট। নজরানাভেট।

কলাবউ-কেউকেটা

বোচকা নরুন নাখারা নয়নফোঁটা।

আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৮/৫ || "আই-যুগ"-এর কবিতা দেবযানী বসু || Atpoure poems 28/5 Debjani Basu

 আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৮/৫ || "আই-যুগ"-এর কবিতা

দেবযানী বসু || Atpoure poems 28/5 Debjani Basu





 আটপৌরে ২৮/৫


১. তোমার আবেগপথ আমার না

সাড়ে-সকাল।সাড়ে-বিকেল। সার্ধকামার্থ।
                    ছায়ার
ওজন মেপে ভুল করিনি।

২. দাপুটে জননী

বিতর্ক। হ্যাশিস-তরণী। মাতৃগ্ৰাম।
             ক্ষমতা
নদী নারী খুন করে।

৩. হলুদ পাখিশার্ট

বাঁশ-সাঁকো। নৌকোবিহার। স্কেচপেন।
                   দাঁড়িয়ে
যাবে সহচরী নৌকায় ক্যামেরায়।

 

নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৪১০-৪১২ নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 410-412,

 নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৪১০-৪১২

নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 410-412,





 নীলিমা সাহার আটপৌরে

৩১০)
নিত্যসংগ্রাম>গোপন  রক্তপাত
        অব্যাহতঅশ্বারোহন
ক্ষতচিহ্ন  জন্ম দেয় নতুনঅক্ষর

৩১১)
অক্ষর আলোকচ্ছটা অনুদ্ধারণীয়
          শিলনোড়া
ভাঙে শব্দ ,আলুথালুভুষায় অক্ষর!!

৩১২)অক্ষরের আর্তি ছাপাঅফসেটে
            জীবন-সময়-উত্থান পতন
        উদ্ভিন্ন রৌদ্রধারা,তবু সর্বাধুনিক 

আনন্দমঙ্গল, Anandamangal

 আনন্দমঙ্গল, Anandamangal 



শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১

নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৪০৭-৪০৯ নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 407-409,

 নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৪০৭-৪০৯

নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 407-409,





 নীলিমা সাহার আটপৌরে

৪০৭)
মনকেমনিয়া জানালায় উদাস-রুমাল
       অজ্ঞেয়অতিক্রম
অথচ দরজায় অব্যাহত নূতনডাক

৪০৮)
নির্জন ডার্করুমে আয়না
     নিরাময় 
ভাবলেও সাদাপাতায় ভাঙনের স্বগতোক্তি 

৪০৯)অন্ধকার । জন্মান্ধ।তৃতীয় নয়ন
                     মনালোয়
         ডুবসাঁতার  স্রোত অতিক্রমণ শুশ্রূষা 

শব্দব্রাউজ ৩০৮ ৷। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-308, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৩০৮ ৷। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-308, Nilanjan Kumar






শব্দব্রাউজ ৩০৮ || নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়া মেন রোড ।  ২৮ অক্টোবর ২০২১। সকাল নয়টা।


শব্দসূত্র:  তুই আয় বাঁচি

১। তুই আমায় দে দীর্ঘশ্বাস
      তুই আমায় দে পাগলামি
       তুই আমায় দে প্রহর
         জীবন কথা আমার এভাবে কাটুক ।

২। হুশ করে সময়ের সঙ্গে বাঁচি,
     কে বাঁচায় ? শুধু জ্বলি আর
      ফুরোই ।

আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৮/৪ || "আই-যুগ"-এর কবিতা দেবযানী বসু || Atpoure poems 28/4 Debjani Basu

 আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৮/৪ || "আই-যুগ"-এর কবিতা

দেবযানী বসু || Atpoure poems 28/4 Debjani Basu





 আটপৌরে ২৮/৪


১. খাদজাত কন্দের কষ্ট

পাহাড়। টিলা। সিঁড়ি।
            ওঠানামা
দুধারে খাদ হাত জানে।

২. নজর রাখুন 'গরম ভাতের' উপর

ভূতের। কাকের। চূড়ৈলের।
           পরিকল্পনা
লালবাজার অব্দি গড়াচ্ছে কিনা।

৩. একদিন নেটওয়ার্কও ধসবে

সুন্দরবন। বরফগলন। এসিঘর।
               অতি
পয়দায় ময় ময় দানব-মানব।

আটপৌরে ৪৭ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 47, by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৪৭ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 47, by Sudip Biswas





আটপৌরে কবিতা


৪৭.
পাকাপঞ্চমী

নথিবদ্ধ।  নাকানিচুবানি। নয়ছয়।

নয়নজুলি

পরাগফুলে পচনরোধক বিকারক মোহময়। 

Anandamangal, আনন্দমঙ্গল ।। সৌমিত্র রায়

 আনন্দমঙ্গল ।। সৌমিত্র রায় 



শুক্রবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২১

আটপৌরে ৪৬ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 46, by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৪৬ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 46, by Sudip Biswas





আটপৌরে কবিতা


৪৬.
গতজন

বহমানা।  আবহমান। নদীভব।

পিতৃগণ

তর্পিত তিলেক সময় ভাবগঙ্গাজল।

নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৪০৩-৪০৫ নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 403-405,

 নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৪০৩-৪০৫

নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 403-405,





 নীলিমা সাহার আটপৌরে

৪০৫)
যখন তখন বৃষ্টিসফর
      যদিও 
হেমন্তর ঘরে আসন্ন  নবান্ন

৪০৬)
 আঙুলস্পর্শেই বিশ্বস্ত কিবোর্ড 
         সূচি
পাল্টে বুনছে মাকড়সার জাল 

৪০৬)
অতীত-ভবিষ্যত-বিহীন নিঃসঙ্গ  বর্তমান 
            ছিটোচ্ছে
হাইকু, বোধিপাঠ্যে সেই ধর্মেরখই

আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৮/৩ || "আই-যুগ"-এর কবিতা দেবযানী বসু || Atpoure poems 28/3 Debjani Basu

 আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৮/৩ || "আই-যুগ"-এর কবিতা

দেবযানী বসু || Atpoure poems 28/3 Debjani Basu





 আটপৌরে ২৮/৩

১. ফুরোবার আগে হারালো

সুড়সুড়িপাতা। মোটাপাতা। কথাপাতা।
                    বর্ষালিলিপ্রেম
কতো কতো নামে ডাকি।

২. আলেখা টলটলে

সূর্য-নমস্কার। গঙ্গোত্রী-নাড়িধৌতি। ব্যথা-মার্গী ।
                     জরায়ু-জবা
শল্যচিকিৎসায় পাবে সামুদ্রিক শক্তফেনা।

৩. উথলায় হায়না সুখ

লেজেন্ডারি-লেজ। কমাবাড়া। হোক্কাহাসি।
                       তাড়না
আধমরা বডি আগলাচ্ছে হায়না।

 

টনি মরিসনের স্বর্গ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das

 টনি মরিসনের স্বর্গ

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস



কয়েক বছর আগে টনি মরিসন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত একমাত্র তিনিই আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ লেখিকা যিনি নোবেল পুরস্কারের দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৯৮ সনের ১৯  জানুয়ারির ' টাইম' ম্যাগাজিনে টনি মরিসনের বিষয়ে একটি বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল । সেই প্রবন্ধের মাধ্যমে তাকে সমসাময়িক আমেরিকান লেখকদের ভেতরে অতি উচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে তাঁর Beloved নামের উপন্যাসটি। এখানে একটি কথা বলতে পেরে খুব ভালো লাগছে যে বিদূষী  অসমিয়া মহিলা এবং আমার বন্ধু ডঃ লক্ষ্মী গোস্বামী তাঁর বাৎসরিক আমেরিকা ভ্রমণে গিয়ে ফিরে আসার সময় আমার জন্য উপহার হিসেবে এনেছিলেন টনি মরিসনের Beloved নামের উপন্যাসটি। টনি মরিসনের একমাত্র এই উপন্যাসটি ছাড়া তাঁর বিষয়ে আমার জ্ঞানের একমাত্র উৎস হল ওপরে উল্লেখ করা ' টাইম' ম্যাগাজিনের প্রবন্ধটি।

সেই প্রবন্ধটি পড়েই আমি জানতে পারলাম যে ১৯৬৪ সনে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা তিনি মাঝে মাঝে চিন্তা করছিলেন। কিন্তু প্রধানত দুটি কারণে তিনি পুনর্বার বিবাহ করবেন না বলে ঠিক করলেন । প্রথম কারণটি ছিল তাঁর সন্তান দুটি । তাঁর জীবনে একজন নতুন মানুষ স্বামী হয়ে এলে সন্তান দুটির প্রতিক্রিয়া কী হবে তিনি সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিলেন না। তার চেয়ে বড় কারনটা এই ছিল যে তিনি নিজের নিঃসঙ্গতা এবং স্বাধীনতার প্রেমে পড়েছিলেন।I did not want to give up the delight of not having to answer to another person.

কিন্তু আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে টনি মরিসনের একটি সরল এবং অকপট স্বীকারোক্তি। একবার কোনো সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন–' আপনার মতে স্বর্গের সংজ্ঞা কী? জীবনের কী ধরনের অবস্থায় আপনি স্বর্গ সুখ পাওয়া যেন অনুভব করেন ?'... আমার জন্য স্বর্গ হবে একনাগাড়ে নয় দিন কারও মুখ না দেখে কারোর সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে একা থাকার সুযোগ পাওয়া। সম্পূর্ণ একা। কারও প্রতি আমার কোনো দায়িত্ব নেই, আমার ওপরে কারও কোনো দাবি নেই, আমার যখন যা ইচ্ছা করে তাই পাব... এর চেয়ে অধিক স্বর্গসুখ আর  কি আছে? একনাগাড়ে এভাবে চারদিন আমি এর আগেই পেয়েছি, কিন্তু নয়টি দিন কখনও পাইনি। আজ পর্যন্ত পাইনি।

ওপরে যদিও আমি বললাম যে টনি মরিসনের সংজ্ঞা আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে, কিন্তু তার সঙ্গে এই কথাটাও যোগ দেওয়া উচিৎ হবে মনে হয় যে এরকম একটি স্বর্গের জন্য আমাকে কিন্তু কখনও হা–হুতাশ করতে হয়নি। তার কারণ হল এই যে এইরকম একটি স্বর্গ আমি অনেক আগেই নিজের জন্য সৃষ্টি করে নিয়েছি। টনি মরিসন বলেছেন যে তিনি একনাগাড়ে চারদিন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেছেন, কিন্তু সেই জীবনকে তিনি স্বর্গ বলে  মানতে চাননি । একনাগাড়ে এই ধরনের নয়টি  দিন পেলেই তিনি স্বর্গসুখ পাওয়া বলে অনুভব করবেন। আমি কিন্তু নিজের জীবন যাপনের এরকম একটি প্রণালী উদ্ভাবন করে নিয়েছি যে মাসের ত্রিশ  দিনের মধ্যে পঁচিশ দিনই বা দিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তেইশ ঘণ্টাই আমি কেবল নিজেকে নিয়ে বেঁচে থাকি বা অধিক শুদ্ধ করে বলতে গেলে নিজের কাজকে নিয়েই বেঁচে থাকি । আর যেহেতু আমার সমস্ত কর্ম এবং চিন্তার কেন্দ্রে বিরাজ করছে মানুষ – সেই জন্য আমি কখনও নিজেকে মানব বিদ্বেষী নিঃসঙ্গতা বিলাসী মানুষ বলে ভাবি না। আমি মানুষের সঙ্গও খুব ভালোবাসি। মানুষের সঙ্গ আমি কতটা প্রাণভরে উপভোগ করি সে কথা আমাকে খুব কাছ থেকে দেখা প্রতিটি মানুষই জানে। কিন্তু তা বলে কৃত্রিম ভদ্রতার দাবিতে আমি আমার কাজের সময়টুকু কোনো মানুষকে আড্ডার জন্য দিতে রাজি নই । চিন্তাশীল পন্ডিত জেকব  ব্রনৌস্কি মানুষের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন যে মানুষ হল এক ধরনের সামাজিক নিঃসঙ্গ প্রাণী। মানুষের এই সংজ্ঞাটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি সামাজিক নিঃসঙ্গ প্রাণী হওয়ার জন্য সব সময় চেষ্টা করে থাকি। আমার সমাজ লাগবেই, কিন্তু সেই সমাজের মধ্যেও আমার যখন ইচ্ছে যায় তখনই আমি হতে পারব নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন । কেবল তখনই চিন্তা  করা এবং কাজ করাটা আমার পক্ষে সম্ভব হবে ।

কিন্তু সমস্ত মানুষই আমার মতো ' অভদ্র', কঠোর এবং ভাগ্যবান নয়; হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ আমি আমার ঘনিষ্ঠ এবং বিশেষ স্নেহ ভাজন একজোড়া স্বামী-স্ত্রীর কথা বলি। সম্প্রতি গুয়াহাটির অনেক জায়গায় গড়ে ওঠা অ্যাপার্টমেন্ট কলোনিগুলির কোনো একটিতে তারা থাকে। দুজনেই চাকরিজীবী, মহিলাটি আবার ভালো লেখিকা। চাকরির জন্য দিনের আট ঘণ্টা সময় দেওয়া ছাড়াও লেখার জন্য তাকে দিনে কম করে তিন ঘন্টা সময় দিতে হয়। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য এই যে যে কলোনিতে তারা থাকে সেই কলোনির বেশিরভাগ বাসিন্দা হল অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার, কর্মচারী । চাকরি থেকে অবসর নেওয়া অসমিয়া মানুষ ঘরে ঘরে আড্ডা দেওয়া ছাড়া করার অন্য কোনো কাজ খুঁজে পায় না । তাদেরই আড্ডা প্রীতি  এবং অন‍্যের সুবিধা অসুবিধার প্রতি চরম উদাসীনতার বলি হয়েছেন এই প্রতিভাবান স্বামী স্ত্রী। লেখাপড়া করার জন্য সময় পাওয়া দূরের কথা, অনাহুত এবং অবাঞ্ছিত অতিথির উৎপাতে তারা ক্ষণিকের জন্য অবসর গ্রহণেরও সময় পায়না। সময় নেই,অসময় নেই,সবসময়ই অতিথির উৎপাত। সারাদিন  হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ঘরে পা রেখেছেন মাত্র আড্ডা দেবার জন্য ওত পেতে থাকা অতিথি  এসে হাজির। চাকরি করা সমস্ত দম্পতি অন্তত রবিবারের দিনটি  নিজেদের জন্য আলাদা করে পেতে চায়। ফ্রী একটিমাত্র দিনে কিছু ভালোমন্দ খেয়ে বিশ্রাম নিতে পারলে সপ্তাহের বাকি দিনগুলি কঠোর পরিশ্রম করার জন্য দেহ আর মনে শক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের অসমিয়া সমাজের নিয়ম-কানুন অদ্ভুত । চাকরিজীবী দম্পতিকে রবিবারেও ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম না দিতে তাঁরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। রবিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অতিথি– যেন অন্যের জীবনের কাজ করার সময় এবং সুখ-শান্তি হরণ করা ছাড়া অসমিয়া মানুষের অন্য কোনো কাজ নেই। বোধহয় অসমিয়া মানুষের এই নিষ্ঠুর স্বভাবের কথা কোনো ভাবে জানতে পেরে জাঁ পল সাত্রে তার একটি রচনায় লিখেছিলেন–The hell is other people!

আমার মনে এরকম একটি ধারণা বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে যে প্রভাবশালী অসমিয়ারাও নিজের প্রতিভার অনুপাতে কাজ করতে না পারার একটি প্রধান কারণ হল অনাহূত এবং অবাঞ্ছিত অতিথির উৎপাত এবং অন্যের সুবিধা অসুবিধার প্রতি চরম উদাসীনতা। 

---------



লেখক পরিচিতি- ১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।










Anandamangal আনন্দমঙ্গল ।। সৌমিত্র রায়

 Anandamangal আনন্দমঙ্গল 



বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২১

বিদেহ নন্দিনী~ ৩৩ ।। ডঃমালিনী ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস , Bideha Nandini- 33

বিদেহ নন্দিনী~ ৩৩

ডঃমালিনী 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস 

(তেত্রিশ)
  এই কয়েকদিন আমার মনে মাত্র একটাই চিন্তা। রাম এবং তার সৈন্য বাহিনী মহাসমুদ্র কীভাবে পার হবে? হনুমান এবং কিস্কিন্ধার রাজা সুগ্রীবের জন্য চিন্তা নেই। কিন্তু বাকিরা ? আমাকে পাহারা দেওয়া রাক্ষসদের কথাবার্তা থেকে কিছুই বুঝতে পারছিনা। রামচন্দ্রের বাহিনী সাগর পার হতে পেরেছে কিনা, নাকি এখন ও ওপারে। এদিকে ত্রিজটা কিছুদিন ধরে আমার খবরা খবর নিতে আসছে না। আমি বড় দুশ্চিন্তায় ভুগছিলাম ।মনের মধ্যে কথাগুলি আলোচনা করার সময় একদিন বিভীষণের কন্যা কলা এসে উপস্থিত হল। তার মুখমন্ডল নিরানন্দ। কলা ফ‍্যাকাশে হাসি হেসে   আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল-' সীতাদেবী, আপনি এখন ও জানতে না পারা একটা সংবাদ দিতে এসেছি। 
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম।
কলা বলতে আরম্ভ করল। জ্যাঠা রাজা রাবণের একজন গুপ্তচর সংবাদ এনেছে যে  আপনার স্বামী রামচন্দ্র,ভ্রাতা  লক্ষ্মণ এবং বড় বড় বাঁদর বীরের  সঙ্গে সাগর পার হয়ে এসে লঙ্কার সীমানায় ছাউনি পেতেছে। কলার বহুমূল্য কথা গুলি শুনে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। কলা পুনরায় বলল-''জ্যাঠা রাজা রাবণ শুক নামের একজন রাক্ষসকে শত্রু পক্ষের শক্তির পরিমাণ জেনে আসার জন্য পাঠিয়েছিল। তাকে এর সঙ্গে এটাও  দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যাতে যেভাবেই হোক কিস্কিন্ধার রাজা সুগ্রীবকে কিস্কিন্ধায় ফেরৎ  পাঠিয়ে দিতে পারে। শুক টিয়া পাখির রূপ ধরে রামের ছাউনিতে গিয়েছিল। যদিও বাঁদর সেনারা তাকে রাক্ষস বলে বুঝতে পেরে কিল-লাথি মেরে তার অবস্থা কাহিল করে তুলেছিল। আপনার স্বামী নাকি শুককে প্রাণে না মেরে বন্দি করার আদেশ দিয়েছিল। শুককে বেশকিছুদিন রামচন্দ্রের ছাউনিতে বন্দি হয়ে থাকতে হয়েছিল। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি  সম্পূর্ণ করে এখন শুককে  ছেড়ে দিয়েছে রাজা রাবণকে যুদ্ধের সংবাদ দেওয়ার জন্য। সেই শুক শত্রুপক্ষের বল বিক্রম দেখে শুনে রাজাকে একটা কথাই বলেছে যে রামচন্দ্রের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ অসম্ভব। তাই সীতাদেবীকে সসম্মানে ফিরিয়ে দেওয়াই ভালো হবে। কিন্তু জ্যাঠা আর কোথায় ভালো কথা শুনবে। শুকের মুখে শত্রু পক্ষের শক্তির কথা শুনে আজ তিনি নড়েচড়ে বসেন। কারণ শুক কেবল গুপ্তচরই নয়, একজন বড় বীরও । তাই রাবন বীর, সেনাপতি সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছে। কথাটা কলা দ্রুত বলে গেল ।
কলার কাছ থেকে খবরটা পাওয়ার পরে আমার মনে কিছুটা আশার আলো জ্বলে উঠল। সেদিন প্রথমবারের জন্য আমার রাক্ষস পুরীতে কিছুটা ঘুমের ভাব এসেছিল। পরেরদিন সকালে আমি আলুথালু মনে ত্রিজটা, সরমা এবং কলার  জন্য পথ চেয়ে বসে ছিলাম। কে জানে হয়তো ভালো খবর আসবে। তবে আমার আশায় ঠান্ডা জল ঢেলে মুখে উপহাসের হাসি নিয়ে রাবণ এসে উপস্থিত হল। এসেই বলতে শুরু করল-' সীতা, রামকে কেউ বধ করতে পারবেনা বলে বড় গর্ব করছিলে না। রামচন্দ্রের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারবেনা বলে অহংকার করেছিলে কিন্তু তোমার পতি রাম নিহত হয়েছে। সাগর পারের ছাউনিতে রাত্রিবেলা শুয়ে থাকার সময় আমার সৈন্যবাহিনী গিয়ে রামের শিবির লন্ডভন্ড করে ফেলার সঙ্গে তার শিরচ্ছেদ করেছে। তোমার দেবর লক্ষ্মণ, লঙ্কায় উৎপাত করে যাওয়া বাঁদর হনুমান, সুগ্রীব ,নীল,অঙ্গদ,নল সমস্ত বীর নিহত হয়েছে। তুমি দেখলে রাবণের  পরাক্রম ?এখন তুমি আমার কাছে আত্মসমর্পণ করার বাইরে আর কোনো রাস্তা নেই। তাই এখন আমাকে পতি হিসেবে গ্রহণ করে লঙ্কার মহারানী হয়ে জীবন উপভোগ কর। রাবণের কথা শুনে আমি বজ্রাহত  হয়ে গেলাম ।রাবণ পুনরায় বলতে শুরু করল -'কী হল বিশ্বাস হচ্ছে না? এই বলে দশানন একজনকে ডেকে আদেশ দিল -'মুহুর্তের মধ্যে রামের শির এখানে নিয়ে আয়। জানকী নিজ চোখে একবার দেখে নিক।'
কয়েক মুহুর্ত পরেই একজন অনুচর তার এক হাতে স্বামী রামের কাটা শির অন্যহাতে রামের সেই বৃহৎ ধেনু নিয়ে হাজির হল। আমি স্বামীর মুখ  স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তারপরে একটা বিকট চিৎকার করে মাটিতে ঢলে পড়লাম।
  যখন আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল তখন বিভীষণের পত্নী সরমাকে আমার কাছে দেখতে পেলাম ।আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। সরমা আমার চোখের জল মুছে দিল। তারপর সান্ত্বনা দিয়ে বলল-' বৈদেহী,তুমি শোকে ভেঙ্গে পড়ার কোনো কারণ নেই । রামচন্দ্রের মৃত্যু হয়নি। তুমি যা দেখলে তা রাক্ষসের মায়া মাত্র । তুমি যাতে লঙ্কেশ্বরের কাছে আত্মসমর্পন কর তার জন্য পাপীষ্ঠ এই চেষ্টা চালিয়েছে। আমাদের লঙ্কা নগরে বিদ্যুৎজিহ্ব নামে একজন রাক্ষস মায়া বিদ্যায় বড় দক্ষ। তাকে অবিকল রামের মতো একটা মাথা এবং ধনু মায়া বিদ্যার সাহায্যে তৈরি করে দিতে বলতে আমি নিজের কানে শুনে ছিলাম। যদি রামকে বধ করেছে তাহলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি কেন? আর রাবণ তোমাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যেত না। অন্য সময় তোমার কাছে অনেকক্ষণ ধরে প্রেম নিবেদন করে থাকে।আজ তার সময় নেই। যুদ্ধের প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে। তাই হে কৌশল বধূ, ভেঙে না পড়ে মন শক্ত কর।তুমি একটু মন দিয়ে শোনো ,লঙ্কার পথে-ঘাটে রাক্ষস সেনার যুদ্ধের প্রস্তুতি শব্দ শুনতে পাবে ।যদি রাম এবং সমস্ত বীর নিহত হত তাহলে যুদ্ধযাত্রা কার জন্য?'
সরমা আমাকে আশ্বাস দিয়ে পুনরায় বলল-' তুমি মনের দুঃখে কোনো অঘটন ঘটাবে বলে আমি দ্রুত তোমাকে কথাগুলো বলতে এলাম। রাবণ যদি জানতে পারে যে আমি তোমার কাছে এসেছি তাহলে আমাকে জীবন্ত রাখবে না। অবশ্য আমি তার মতো পাপিষ্ট একটাকে ভয় করি না। কথাটা বলে সরমা  চলে গেল। আমি ও স্বামী রামচন্দ্রের চরণ চিন্তা করে সুদিনের জন্য পথ চেয়ে রইলাম। সেদিন বিকেলে ত্রিজটা  প্রায় দৌড়ে এল। ত্রিজটার চেহারা দেখেই আমার বুক কাঁপতে লাগল। ত্রিজটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে একনাগাড়ে বলতে লাগল, রাঘব ঘরনী মুহূর্তের মধ্যে যে বড় ঘটনা ঘটল তা দেখে শুনে পেটের মধ্যে আমার হাত-পা ঢুকে যাচ্ছে।শত্রুপক্ষের বীর এসে রাবণের সঙ্গে রঙ চরায় মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে । কথাটা শুনে আমি অবাক হয়ে ত্রিজটাকে জিজ্ঞাসা করলাম –‘কে সেই বীর? আমাকে একটু খুলে বলুন?’
হনুমানের মতোই একজন বাঁদর। নিজেকে কিষ্কিন্ধার রাজা এবং রামচন্দ্রের সেনাপতি সুগ্রীব বলে পরিচয় দিয়েছিল। তারপর ত্রিজটা ইস ইস করে বলল-‘ আমি বলেছিলাম না আমার স্বপ্নের কথা? কীভাবে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে দেখেছ? রাজাকে একটা সাধারণ বাঁদর দিন দুপুরে চাকর-বাকরের সামনে এভাবে খড়কুটোর মতো প্রহার করল। তারপর ত্রিজটা  ঘটনাটা নিজের চোখে দেখার মতো করে বর্ণনা করে গেল। লঙ্কেশ্বর রঙচরায় বসে শত্রুপক্ষের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিরীক্ষণ করছিল। রংচরা  রাবণের আকাশচুম্বী অট্টালিকার একেবারে শীর্ষে। সেখান থেকে চারপাশটা অনেক দূর পর্যন্ত একেবারে স্পষ্ট দেখা যায়। বোধহয় রামচন্দ্রের বাহিনী পর্বতের উপরে উঠে লঙ্কা নিরীক্ষণ করছিল। রাবনের দুই পাশে পরিচারিকা সুন্দর পাখা দিয়ে হাওয়া করছিল। মাথায় ছিল রাজমুকুট এবং বিজয় ছত্র। বোধহয়  শত্রুপক্ষ দেখেই চিনতে পারল যে ইনি হলেন রাজা রাবণ। রামচন্দ্রের সেনাপতি সুগ্রীব রাবণকে দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না।সুবেল পর্বত থেকে এক লাফে রাবণের রংচরায় এসে পৌঁছাল। তারপর রাজাকে সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করার মতো ঘুসি, লাথি, চর মেরে গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলল। মাথার মুকুট খসিয়ে রাজাকে মাটিতে ছিটকে ফেলল। তারপর সুগ্রীব তর্জন গর্জন করে বলল –‘পাপিষ্ঠ,আমি রামচন্দ্রের মিত্রও,ভৃত্যও। তুই প্রভু রামচন্দ্রকে যত দুঃখ দিয়েছিস ,তোকে আমি আজ এমনিতে ছেড়ে দেব না।আমার হাতে আজ তোর প্রাণ যাবে।’ 
হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে রাবণ কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তিনি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলেন না। পরের মুহূর্তে রাবণ নিজেকে সামলে নিলেন। তখন দুজনের মধ্যে মল্লযুদ্ধ আরম্ভ হল।দুজনেই সমান শক্তিশালী।তাই চর,ঘুসি,লাথি,কিল সমান তালে চলতে লাগল। দশানন বুঝতে  পারল যে মল্ল যুদ্ধে বশ করা যাবে না। তাই তিনি মায়া যুদ্ধ করতে যেতেই সুগ্রীব পুনরায় এক লাফে সুবেক পর্বতে পৌঁছে গেল।
ত্রিজটার কাছ থেকে কথাগুলি শুনে আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম।মনে মনে ভেবেছিলাম স্বামী রামচন্দ্রের সেনাপতি যদি এই ধরনের চঞ্চল মনের হয় তাহলে বিপদ হবে। হনুমানের মতো সুগ্রীব শক্তিশালী মহাবীর সাহসী হলেও বাঁদর বাঁদরই। তাদের চরিত্রে মাঝেমধ্যে বাঁদরের নিজস্ব প্রকৃতি প্রকট হয়ে ওঠে। তাই সুগ্রীবকে মুখ্য করে সমস্ত বানর সেনাকে স্থিরচিত্ত প্রদান করার জন্য আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানালাম।

শব্দব্রাউজ ৩০৭ ৷। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-307, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৩০৭ ৷। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-307, Nilanjan Kumar



শব্দব্রাউজ ৩০৭ || নীলাঞ্জন কুমার

নিজেকে নিঃস্ব করে আবার সাজাই । আবার বৈভবে মিলেমিশে যাই। তখন নিজের কোন দুঃখ নেই । আছে ভালোবাসা সার ।

বড় অদ্ভুত আমি আমাকে খুঁজে পাই ।জীবনের হিসেব নিয়ে তুচ্ছ তর্ক বিতর্ক আমায় মাতিয়ে রাখে ।মাতিয়ে রাখে। তালে বেতালে। সবসময় ।

আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৮/২ || "আই-যুগ"-এর কবিতা দেবযানী বসু || Atpoure poems 28/2 Debjani Basu

 আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৮/২ || "আই-যুগ"-এর কবিতা

দেবযানী বসু || Atpoure poems 28/2 Debjani Basu





 আটপৌরে ২৮/২

১. পুকুরটার নাম কাটাপুকুর

চিনচিনব্যথা। চিচিংযোগ। ফাঁকাপ্রীতি।
                   কন্যাযুবতী
পঞ্চসায়রে ডুবে আর ফেরেনি।

২. অনেক কষ্টে ভাবনা কিনি

মুসাফির। ঘর-হাসপাতাল। নয়াচর।
                ভ্রমণে-রমণে
দেখা অদেখার মাঝে ত্রিশঙ্কু।

৩. ফড়িংয়ের কেরামতি

কপাল। মেডুলা । পিটুইটারি।
            শয্যাশায়ী
মাথা চালিত হৃদয় বকে যায়।

 

নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৪০২-৪০৪ নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 402-404,

 নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৪০২-৪০৪

নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 402-404,





 নীলিমা সাহার আটপৌরে

৪০২)
যতিচিহ্নের কাছেই আনত
     অবসর...!
অবকাশ খোঁজে যুদ্ধবিরতির গান

৪০৩)
ঘুড়ি  বিশ্বকর্মারআকাশ  উড়ানস্পর্ধা
         সুতোও
জানে না পতনকথার অদৃশ্যইচ্ছে

৪০৪)
   সকালের ঠোঁটে ঘুঘুডাক
           পুরনোছলাৎ
উঁকিঝুঁকি মারে কাঠঠোকরার জীবন 

আটপৌরে ৪৫ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 45, by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৪৫ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 45, by Sudip Biswas





আটপৌরে কবিতা

৪৫.
প্রেসক্রিপশন

ক্লিনিক। কেয়ার। অপেক্ষক।

যত্নঘর

নিদান বিশ্বাসমতে সেবনীয় আয়ুষ্কর

Anandamangal, আনন্দমঙ্গল ।। সৌমিত্র রায়

 Anandamangal, আনন্দমঙ্গল 



বুধবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২১

নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৩৯৯-৪০১ নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 399-401,

 নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৩৯৯-৪০১

নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 399-401,





 নীলিমা সাহার আটপৌরে

৩৯৯)
বাঘসুমারি সুন্দরীগরান সাগরসঙ্গম
               বিপথগামী 
নবকুমার...কুমারী-বিস্ময়ের ঘোরে কপালকুণ্ডলা

৪০০)ঝমঝমাঝম রেলগাড়ি...বৃষ্টিশব্দে
                বুকেরমাঝ
     তাপবিহীন দেহাতি-আগুন ধোঁয়া  পোহায়

৪০১)
    নাম না জানা 
   ফুলেরাও
  ফুল,রংবাহারি সফরে আনন্দ-সংবাদ 


আটপৌরে ৪৪ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 44, by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৪৪ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 44, by Sudip Biswas





আটপৌরে কবিতা

৪৪. 

মহালয়া 


ভগবতী। মহামায়া। ত্রিগুণাত্মিকা।


অপারমহিমময়ী


বছরপরে মা এলেন পিতৃগৃহে।

আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৮/১ || "আই-যুগ"-এর কবিতা দেবযানী বসু || Atpoure poems 28/1 Debjani Basu

 আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৮/১ || "আই-যুগ"-এর কবিতা

দেবযানী বসু || Atpoure poems 28/1 Debjani Basu





 আটপৌরে ২৮/১


১. সাদা পায়রার শয্যা ছেড়ে

মোরামনুড়ি। স্ফটিকপাথর। টাইলস্ - পাটা।
                  অপেক্ষায়
জীবন্ত আরশির দেশে ফেরার।

২. ব্যামোর অকারণ সাদাকালো

মিউজিয়াম। অন্দরবাহির। মোনোক্রোম্যাটিক।
                    হাঁটতেহাঁটতে
শেষে ঢ্যাঙা হওয়াই নিয়ম।

৩. লাফিয়ে এল ছবি চরাচরে

হাল-গরু। হাল-চাষী। হনুমান।
                শস্যধারা
চিচিংফাঁকের সাধনা করি দিবারাত্রি।

Anandamangal, Soumitra Roy ।। আনন্দমঙ্গল, সৌমিত্র রায়

 আনন্দমঙ্গল, সৌমিত্র রায় 



মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২১

নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৩৯৬-৩৯৮ নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 396-398,

 নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৩৯৬-৩৯৮

নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 396-398,





 নীলিমা সাহার আটপৌরে

৩৯৬)
 পারদে পারদে নিঝুম 
         আয়না 
আয়-না আর বলে না

৩৯৭)
 মুখোশের  মুখোমুখি মুখ
       দৃশ্যমান 
দু-দশটি দৃশ্য ---লজ্জারাঙা ভুলচুখ

৩৯৮)
দ্রুত রং বদলায় 
    আলো 
অতিরিক্ত হলেই দিগন্তভেদী প্রতিধ্বনি 

আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৭/৭ || "আই-যুগ"-এর কবিতা দেবযানী বসু || Atpoure poems 27/7 Debjani Basu

 আটপৌরে কবিতাগুচ্ছ ~ ২৭/৭ || "আই-যুগ"-এর কবিতা

দেবযানী বসু || Atpoure poems 27/7 Debjani Basu





 আটপৌরে ২৭/৭

১. মশারি সাক্ষী

মরুভূমি। ফণীমনসা। মশক ।
              অচিরস্থায়ী
বন্দোব্যস্ত সোনাব্যাঙ ভোজনের পরে।

২. বিপরীত শব্দর যাদু

নিবাতনিষ্কম্প। নিরুদ্দেশ। নিমমধু।
              ভালোবাসানিতে
ঘোর কাটা ঘুড়ির ভাদ্রকলঙ্ক।

৩. মরণমাপা থার্মোমিটার

ট্রেসিংপেপার। ফুজিয়ামা। শিরিস।
                  রোদমাথারোদ
ঘুমোতে গেলাম তাসের দেশে।

 

আটপৌরে ৪৩ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 43, by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৪৩ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 43, by Sudip Biswas





আটপৌরে কবিতা


৪৩.

কমলাসন


ধন্দায়ৈ। নিধিপদ্মে। প্রসন্নময়ী।


বিধিবদ্ধ


 হৃদয়ের আয়োজনে বিরাজিত শ্রীলক্ষ্মীময়ী।

Anandamangal, Soumitra Roy।। আনন্দমঙ্গল ।। সৌমিত্র রায়

আনন্দমঙ্গল ।। সৌমিত্র রায় 





সোমবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২১

নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৩৯৩-৩৯৫ নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 393-395,

 নীলিমা সাহা-র আটপৌরে ৩৯৩-৩৯৫

নীলিমা সাহা //Nilima Saha, Atpoure Poems 393-395,





 নীলিমা সাহার আটপৌরে

৩৯৩)
বাংলাবাতাসের এখন হেমন্তযাপন
      কাকভোরের 
প্রথম কাকডাক...রাখ-ঢাকে লাফ-দড়ি-জীবন 

৩৯৪)
খেলনাবাটির  স্বপ্ন  বাস্তবতা
      দুধসাদাপথ
ঠিকানা খুঁজতেই হরপ্পার আঁধারময়তা

৩৯৫)
উড়ন্ত ঘুড়ির সঙ্গমানন্দ
     জানতো
নুয়ে পড়বে অতৃপ্ত বন্ধন!!!

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...