সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৫

শোনো কে বাজায় ।। শান্তিময় মুখোপাধ্যায় , Shantimoy Mukhopadhyay

শোনো কে বাজায় 

শান্তিময় মুখোপাধ্যায়  



রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছিলেন "জগতের প্রত্যেক অণু পরমাণু এক মহাপ্রাণের ঐক্যসূত্রে হিল্লোলিত দেখিতে পাই--এক মহাপ্রাণের অনন্তকম্পিত বীণাতন্ত্রী হইতে এই বিপুল বিশ্বসংগীত ঝংকৃত..."। ধ্বনিতে আকৃষ্ট হয়ে আমরা প্রথমে তার উৎস নির্ধারণ করতে পারি না।মন যখন যে স্তরে অবস্থান করে তদনুযায়ী সে এই অনন্তস্পন্দিত বীণাতন্ত্রী থেকে নিঃসৃত ধ্বনি যা আদি থেকে অনাদির ব্যপ্তি নিয়ে রণিত হয়েই চলেছে তাকেই বিচ্ছিন্ন,অমার্জিতভাবে পেতে থাকে।দূরাগত সেই অব্যক্তকে প্রথমে আমরা খুঁজি বাইরে।যা বিশাল, ভূমা যা,তা যে আমারই একান্ত,চিরন্তন অনুভব তা আমরা প্রথমে ধারণা করতে পারি না।মনে হয় এই পৃথিবী, ওই আকাশই বুঝি সব অনুভব, ভাবনা, চিন্তা নিয়ে আমাদের ঘিরে রেখেছে।অতিমানসলোকের কোনো এক স্তরে তাই কখনো শোনা যায় সমুদ্রকল্লোল কখনো ঝিঁ ঝিঁ ডাক কখনো বা রিনরিন নূপুরগুঞ্জন।শব্দ যে নাদে পরিণত হয়ে জ্যোতি রূপে প্রকাশমান হতে পারে একথা ভারতীয় দর্শন স্বীকৃত হলেও আধুনিক পদার্থবিদ্যা বোধহয় তাকে অস্বীকার করতে পারে না।আর বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিটি বস্তু(তা সে জীব বা জড় যাই হোক না কেন)-র মধ্যে গন্ডি বা কাঠামো ভাঙার যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তা-ই তো বন্দিনী অহল্যার আত্মমুক্তির আকাঙ্খা। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের সীমাহীন ব্যাকুলতা।কবি তাই সহজেই বলতে পারেন "মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে" আর জলধিকিনারে পদাবলীকর্তাদের শ্রীমতি উন্মুখ প্রহর গোনেন "হরি গেলা মধুপুর হম কুলবালা"।


জীব আর ব্রহ্মের সম্পর্ককে যদি আমরা প্রকৃতি ও পুরুষের সম্পর্ক ধরি, বৈষ্ণবীয় কল্পনায় তাহলে দেখবো বিশ্বের রাসচক্রের কেন্দ্রে এক নিত্যমিথুনের ছবি। "একাত্মনাবপি দেহভেদং গতৌ"-- অভিন্ন আত্মা হয়েও দুটি দেহে ভিন্ন।আর চক্রের পরিধি জুড়ে সেই অনন্ত মিথুনেরই কায়ব্যুহ। এই রসের লীলা চলেছে সর্বত্রই --- জ্ঞানে,প্রেমে,কর্মে বা শক্তির উল্লাসে।রস যেন প্রেমেরই একান্ত।তা আস্বাদন ভিন্ন প্রেমের নাড়িতে রক্তধারার টান লাগে না।সব রসের ধারা সেখানে হারায়।তৈত্তিরীয় উপনিষদে বিশ্ব তাই " রসো বৈ সঃ"।অনন্ত প্রকৃতি যখন পরমা হয়ে হয়ে ফুটে উঠে পরমের সঙ্গে মিলিত হয়,অনাদিকালের তৃষ্ণা তখন এই মহামিলনে পরিতৃপ্ত হয়।যুগ যুগান্তরে অনন্ত রূপের মধ্যে দিয়ে মিলনাকাঙ্খা এই মহাসম্মিলনেই নিবৃত্ত হয়। এই অবস্থায় প্রকৃতি ক্রমশ পুরুষে ও পুরুষ ক্রমশ প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে মহা সামরস্য সংঘটিত করে।নিকুঞ্জলীলায় রসের এই মহানুষ্ঠানই রাস।  


রাসের প্রসঙ্গে স্বভাবতই এসে পড়েন কৃষ্ণ,তাঁর যাবতীয় ব্যুৎপত্তি নিয়ে।সংস্কৃতে "কৃষ" ধাতুর অর্থ চর্চা করা,অনুসন্ধান করা।অনুশীলনের দ্বারা মনকে সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতম পর্দায় বেঁধে যে সত্ত্বাকে অধিগত করা যায় তাই-ই কৃষ্ণ।আবার "কৃষ" ধাতুর অন্য অর্থ আকর্ষণ করা।এই সৌরমণ্ডলের কেন্দ্রে থাকা সূর্য তার চারপাশে ঘূর্ণায়মান অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহকে ক্রমাগত নিজের দিকে আকর্ষণ করে চলেছে।ফলে নিজের কক্ষপথে তারা অবিরত ভ্রাম্যমাণ। ঠিক এভাবেই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিজের দিকে আকর্ষণ করে চলেছেন বলে তিনি কৃষ্ণ। অন্য দিক দিয়ে দেখলে লাল,হলুদ প্রভৃতি যতো রং তাদের মধ্যে কালো রঙের traction power সবচেয়ে বেশি। কৃষ্ণ শব্দের আর একটি অর্থ তাই বোধহয় কালো।"কৃষ"ধাতুর ভিন্নতম একটি অর্থ "অহম অস্মি" অর্থাৎ আমি আছি।আর ভূ-ধাতু -- হওয়া,থাকা।অতএব কৃষ্ণ মানে আমরা তাই সহজেই বলতে পারি : যিনি আছেন বলে আমি আছি। আমার মধ্যে তার সুমধুর প্রকাশ যখন সব ভোলানো সুরে বাঁশিগ্রস্থ করে তোলে কৃষ্ণাকর্ষণের শুরু বোধহয় তখনই।


অসীমের প্রতি,বৃহতের প্রতি এই আকর্ষণই প্রেম।ভক্তিরসে যা সংপৃক্ত।ভক্তি আর প্রেম তাই একে অন্যের পরিপূরক।দুয়ের মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্য নেই।প্রেম মনের,ভাবের। আর ভাব যখন ভাষায় প্রকাশিত হয়ে মাটিতে নেমে আসে তা হয়ে দাঁড়ায় ভক্তি।শাস্ত্রকারেরা তাই বলেছেন "প্রেম ভক্তি স্বরূপিনী"।প্রেমের সংসিদ্ধিকত্ব,উত্তরতত্ত্বই ভক্তি।আবার ভক্তি বলতে বোঝায় ভজ+ক্তিন।অর্থাৎ মনের সব বৃত্তি যখন স্থূল থেকে,জাগতিকতা থেকে প্রত্যাহত হয়ে পরমের দিকে ধাবিত হয় তাই-ই ভক্তি।বৈষ্ণবতত্ত্বে এটিই হ্লাদিনী শক্তি।পরমের প্রতি তার যে আকর্ষণ তা অন্তর্মুখীনতারই প্রতিভাস।ভয়হীনা,লজ্জাহীনা রাধা তাই প্রেমযমুনায় পাগলিনীর মতো ডুব দেন একান্তে,সহজ অনুরাগে।এ পোড়া বাঁশির জ্বালা তিনিই বোঝেন অন্যে বোঝে না দূর অধরার সুরে যিনি কখনো দংশিত হন নি --- "মুরলী শুনিয়া মোহিত হইবে সহজ কুলের বালা/দ্বিজ চন্ডীদাস কয় তখনি জানিবে পিরিতি কেমন জ্বালা"।

বাঁধন ছেঁড়ার সাধন ।। শান্তিময় মুখোপাধ্যায় ।। Shantimoy Mukhopadhyay

বাঁধন ছেঁড়ার সাধন

শান্তিময় মুখোপাধ্যায় 



"আমায় মুক্তি যদি দাও বাঁধন খুলে" গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের ১৮৬ নং এই গানটির সঙ্গে কমবেশি সকলেই আমরা পরিচিত। যদিও রবীন্দ্রনাথের অনেক গান বা কবিতায় নানাভাবে মুক্তির উপস্থাপন আছে তবু এই বিশেষ গানটি নিয়েই যতো মাথাব্যথা। কেননা ঠিক এর পরের লাইনটিতে আছে মারাত্মক এক বিস্ফোরণ --- "আমি তোমার বাঁধন নেবো তুলে"। কেন মুক্ত হবার পরও কেউ পুনরায় অবরুদ্ধ হতে চান, এটা কি শুধুই লিরিকের খাতিরে নাকি এর পেছনে লুকিয়ে অন্য কোনো দর্শন বা ব্যপ্তি যা একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক(spiritual) ও বস্তুকেন্দ্রিক (material) ! এ যেন অনেকটা শ্রম বিভাজনের মতো বৌদ্ধিক(spiritual) এবং কায়িক(physical বা material)। যা-ই হোক, মুক্তির প্রসঙ্গ তখনই আসে যখন বন্ধনের প্রশ্ন থাকে।এ-বন্ধন নানা ভাবে,নানা কিসিমে।কি শিল্পে,কি সাহিত্যে, কি মানসিকতা, জীবনের সবদিকেই পরিব্যপ্ত।যাকে কেন্দ্র করে শিল্প, সাহিত্য, চিন্তাভাবনা প্রভৃতির মুক্তি ধারণা গড়ে উঠেছে।আর ভারতীয় দর্শনে তো মুক্তি একটা ইজম বা মতবাদ হিসেবেই সুপরিচিত। দুজন কবির দুটো পংক্তি দিয়ে আলোচ্য ওই দু-ধরণের মুক্তির উদাহরণ টানা যেতে পারে। প্রথম উদাহরণ হিসেবে এখানে অবশ্যই " আমার মুক্তি আলোয় আলোয় "--- রবী ঠাকুরের গানের পংক্তিটি যেমন উল্লেখ্য তেমনই দ্বিতীয়টি কাজী নজরুল ইসলামের " আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী ছল করে দেখা অনুক্ষণ"-- কে রাখাই যায়।সর্বোপরি "মুক্ত বেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতর বঙ্গে/আমরা বাঙালী বাস করি সেই তীর্থ বরদ বঙ্গে"--- কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-র আমরা কবিতাটি তো আমাদের এই সমগ্র বাংলাদেশকেই যেন বুকে ধরে আছে।


বাস্তবে আদৌ কি মুক্তি বলে কিছু আছে না তা পাওয়া যায়? এ প্রশ্ন হয়তো সর্বজনীন। তবু যখন একটা শাসন বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে আর একটা ব্যবস্থায় পৌঁছুনো যায় তখন তা কি আদপেই বন্ধনহীনতা! অথবা এক দেশ থেকে অন্য এক দেশে পাড়ি দেওয়া, এমনকি মানসিক এক স্তর থেকে অন্য স্তরে থিতু হওয়া সত্যিই কি একটা গন্ডি অতিক্রান্ত হয়ে আর একটা  ঘেরাটোপে বদ্ধ হওয়া নয়! একটা পাখিকেও যখন খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিই আর দূর আকাশে তার ক্রমাগত মিলিয়ে যাওয়া দেখি আপাত দৃষ্টিতে তখন মুক্তির একটা মানে খুঁজে পেলেও মনে হয় একটা শূন্য অতিক্রম করে আরো বড়ো কোনো শূন্যে সে কি সত্যিই নি:সীম হতে পারবে! কেননা সাধারণ ভাবে পরিচিত যে আকাশ,সে তো আসলে বায়ুমন্ডল।বিভিন্ন গ্যাস ও জলীয় বাষ্পের সমাহার।মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে চারদিক থেকে পৃথিবী নামক এই গ্রহটিকে ঘিরে আছে।সূর্যের সাতটি রঙের মধ্যে একমাত্র নীল রঙ ক্ষুদ্রতর তরঙ্গের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে তাকে নীলাভ দেখায়। আবার এই বায়ুমন্ডলেরও পাঁচটি স্তর।তাদের পরিবেশ ও আয়তনও নির্দিষ্ট। সুতরাং তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া যায় পাখিটি আকাশে বায়ুমন্ডলের কোনো এক স্তরে গিয়ে পৌঁচেছে তাহলেও সে কি মুক্ত নাকি অন্য এক পরিবেশ বা পরিস্থিতির আবর্তে গন্ডিবদ্ধ! আবার ভারতীয় দর্শনে আকাশ হলো জগতের পাঞ্চভৌতিক উপাদানগুলির মধ্যে পঞ্চম(ব্যোম)।তার নিচে চতুর্থ উপাদান বায়ু।ফলে ধরে নেয়াই যায় যে বায়ুমন্ডলের পঞ্চম স্তর অর্থাৎ ট্রাপোস্ফিয়ারের পরের অসীম মাধ্যাকর্ষণহীন সেই শূন্যই আকাশ। ভারতীয় দর্শনানুসারে যা সর্বাপেক্ষা ডেলিকেট বা সুক্ষ্ম। কারণ অন্য উপাদানগুলির বাকি সবগুলিই শারীরিক পরিকাঠামোয় প্রত্যক্ষত অথবা অনুভূত।অথচ এই পাঞ্চভৌতিক দেহ গঠনেও তার আনুপাতিক হার শতকরা ছয়।


স্বভাবতই বিশাল ব্যপ্তি নিয়ে থাকা এই মুক্তি বিষয়টি যদি বন্ধনের বিপরীত হয়ে থাকে তাহলে বন্ধন কি সেই প্রশ্নটিও কিন্তু অনাবশ্যক নয়। উত্তর খুঁজতে আমাদের মহোপনিষদের শরণাপন্ন হতে হবে।"পদার্থভাবনাদার্ঢ্যং বদ্ধ ইত্যাভিধীয়তে"(২।৪১) অর্থাৎ দৃঢ় পদার্থভাবনাই বন্ধন।আর একটু এগিয়ে যোগবশিষ্ঠ রামায়নে এটি উল্লিখিত হলো "পদার্থবাসনাদার্ঢ্যং বদ্ধ ইত্যাভিধীয়তে"(২।৩৫।৩) যার মানে দাঁড়ায় শুধু পদার্থ ভাবনাই নয় তাকে কেন্দ্র করে যে বাসনা বা ইচ্ছা তাও বন্ধনস্বরূপ। 


ফলে আমাদের কবিঠাকুরও বিভাস-বাউলে গান বেঁধে ফেললেন " এই কথাটা ধরে রাখিস মুক্তি তোরে পেতেই হবে / যে পথ গেছে পারের পানে সে পথে তোর যেতেই হবে" (গীতবিতান,পূজা পর্যায়,১৯০)।তা তিনি যখন গান বাঁধলেনই তখন আমাদেরও মুক্তির সুলুকসন্ধানে আর কোনো বাধা রইলোনা। পাণিনির কাছ থেকে আমরা জেনে গেলাম এই মুক্তি শব্দটির উৎপত্তি 'মুচ্' ধাতু থেকে যার অর্থ মোক্ষণ, মোক্ষ বা মুক্তি (অষ্টাধ্যায়ী ৭।৩।৫২)। বেদের দ্রষ্টারা বললেন এ মুক্তি অমৃত থেকে নয় মৃত্যুরূপ বন্ধন থেকে, কামনা-বাসনা থেকে।গীতায় দেখলাম পাপ থেকে মুক্তি ; কর্ম,বন্ধন এবং সর্বোপরি দেহ থেকে। আর মহাভারতে বলা হলো বাসনার নিবৃত্তিই মুক্তি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ে যা মোক্ষ, নির্বাণ, অর্হৎ, অপবর্গ, কৈবল্য, নি:শ্রেয়স প্রভৃতি নানা সমার্থবোধক শব্দে পরিভাষিত। 


মুক্তির প্রকারভেদ নিয়ে দর্শনশাস্ত্রে ইতরবিশেষ প্রায় একই রকম মত থাকলেও 'সুতসংহিতা' কিন্তু একে পরমামুক্তি এবং অবরা মুক্তি এই দুই ভাগে বিভাজিত করেছে।পরমামুক্তি জ্ঞানলব্ধ (মুক্তি), পরমার্থ বা ব্রহ্মে লীন হওয়া। আর অবরা মুক্তি চার প্রকার --- (১) সালোক্য অর্থাৎ ইষ্ট বা অভীষ্টর সঙ্গে একই লোকে থাকা (২) সারূপ্য অর্থাৎ ইষ্টদেবতার রূপ প্রাপ্ত হওয়া (৩)সামীপ্য, অর্জুনের মতো ইষ্টের সান্নিধ্যে থাকা (৪) সাযুজ্য, অনেকটা ঘুমের মতো, গভীর নিদ্রায় যেমন বাহ্যিক কিছুই অনুভূত হয়না নিজের মধ্যে নিজেই মগ্ন থেকে যে সুখ পাওয়া যায় সেরকমই ইষ্টে নিমগ্ন থাকা। যেন রবীন্দ্রগানের গানের সেই কলিদুটি "দেহ মনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে"। আর অবরা মুক্তিতে জীব আপাত মুক্ত হলেও ব্যক্তিত্ব ও অপ্রাকৃত দেহ,মন ইত্যাদি অবলুপ্ত না হবার ফলে শুধু ব্রহ্মসাম্য প্রাপ্ত হন মাত্র।দুর্গাদাস তর্কবাগীশ প্রণীত 'শব্দকল্পদ্রুম'-এ 'মুচ্' ধাতুর ব্যাখ্যায় মুক্তি আবার এরকম মানে পেয়েছে : বন্ধনরহিতীভাবে অকর্ম্মকোহম্ গজ: কর্ত্তারিক্ত: এবং পাপন্মুক্ত ইত্যর্থ:(কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ সংস্করণ, পৃ: ১০৪৩)।


মুক্তির সাতকাহন ঘেঁটে তাহলে কি শেষপর্যন্ত আমরা সংযমের পথ ধরে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সব পথ বন্ধ করে বৈরাগ্য সাধনায় রত হবো নাকি এই পৃথিবীর  রূপ, রস, গন্ধ, সুর, তাল, ছন্দ, লয় ইত্যাদির নানা বাঁধনে নিজেকে বেঁধে কবির মতোই উচ্চকিত হবো --- " মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া, / প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া "(নৈবদ্য-৩০) তা ঠিক করার দায় কিন্তু আমাদেরই।

শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das) এগার (১১) বৈজ্ঞানিক এবং আবিষ্কারক বেঞ্জামিন

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





দশ

(১০)

বৈজ্ঞানিক এবং আবিষ্কারক বেঞ্জামিন

  বেঞ্জামিন তার শৈশব থেকে নানা ধরনের সরঞ্জাম আবিষ্কার করে এবং যন্ত্রপাতির সঙ্গে খেলাধুলা করতে ভালবাসতেন। এই বিশেষ প্রতিভা তিনি পিতার কাছ থেকে জন্মসূত্রে লাভ করেছিলেন ।নানা ধরনের সমাজ সেবার কাজ এবং গভীর অধ্যয়নে নিমগ্ন হয়ে থাকার সময়ও তিনি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম উদ্ভাবন করার চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। উদাহরণস্বরূপ ফিলাডেলফিয়ায় আসার কিছুদিনের মধ্যে তিনি এক ধরনের নতুন যান্ত্রিক উনুন নির্মাণ করেছিলেন। ফিলাডেলফিয়া স্টোভ নামের এই যান্ত্রিক উনুনটি এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে অনেকে তার নকল করে ইউরোপে রপ্তানি করেছিল। বেঞ্জামিন ইচ্ছা করলে তার যান্ত্রিক উনুনটির পেটেন্ট নিয়ে , অর্থাৎ তার বিনা অনুমতিতে অন্যে সেটা নকল করে নির্মাণ করতে না পারার আইনগত ব্যবস্থা করে অনেক টাকা রোজগার করতে পারতেন। কিন্তু বেঞ্জামিনের টাকা রোজগারের কোনো ইচ্ছা ছিল না। তার যান্ত্রিক উনুনটি মানুষের উপকারে আসুক– তিনি শুধু এটাই চেয়েছিলেন।

  ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে গড়ে উঠার পরে বেঞ্জামিন অনুভব করলেন যে এখন তিনি সমাজ জীবন থেকে অবসর নিয়ে জীবনের বাকি থাকা সময়টুকু বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং অধযয়নের জন্য উৎসর্গ করতে পারেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি স্পেন্স নামের একজন ইংরেজ বৈজ্ঞানিকের কাছ থেকে কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কিনে নিয়ে বিদ্যুৎ শক্তির বিষয়ে গবেষণা করতে শুরু করলেন। এটা ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। এভাবে গবেষণা করে থাকার সময় একদিন তিনি বিদ্যুৎ শক্তির সাহায্যে একটি মোরগকে মারতে গিয়ে চেষ্টা করে নিজেই প্রায় মরতে বসেছিলেন। সে যাই হোক না কেন, তাঁর বিদ্যুৎ শক্তির গবেষণা এই ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

 বিদ্যুৎ শক্তির বিষয়ে মানুষ প্রথমে করা প্রায় সমস্ত পরীক্ষা ছিল স্থির বিদ্যুৎ সম্পর্কীয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিকরা বিদ্যুৎ প্রবাহের সম্ভাবনা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে শুরু করেন। এই ক্ষেত্রে অগ্রণীদের ভেতরে একজন ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন।১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি ঘুড়ি উড়িয়ে প্রমাণ করেন যে বিদ্যুৎ শক্তি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় প্রবাহিত হতে পারে। এই পরীক্ষাটির জন্য বেঞ্জামিন একটি সিল্কের ঘুড়ি তৈরি করে তার উপরে একটি সূঁচোলো তার জুড়ে দিলেন। ঘুড়িটি উড়ানোর জন্য ব্যবহার করা লম্বা লিনেন সুতার একটি প্রান্ত তারটির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তিনি অন্য প্রান্তে একটি সিল্কের ফিতা বেঁধে নিলেন। লিলেন সুতাটি পরিবাহী এবং সিল্কের ফিতাটি অপরিবাহী।সিল্কের ফিতাটার সঙ্গে জোড়া দেওয়া জায়গায় একটা চাবি বেঁধে দেওয়া হল। একদিন বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে তুফান চলে থাকার সময় তিনি সিল্কের ফিতাটা হাত দিয়ে ধরে থেকে ঘুড়িটি আকাশে উড়িয়ে দিলেন। তার পরে তিনি চাবিটার কাছে হাতের মুঠিটা আনলে চাবিটা থেকে বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে আসতে দেখতে পেলেন। এভাবে তিনি প্রমাণ করতে পারলেন যে মেঘ থেকে বিদ্যুৎ শক্তি ভিজে থাকা লিলেন সুতো দিয়ে চাবিটা পর্যন্ত বয়ে আসতে পারে। বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন ছিলেন সমস্ত দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারা বহুদর্শী মানুষ। এই পরীক্ষা করার সময় তিনি নিজেকে এবং সিল্কের ফিতাটাকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কারণ ফিতাটা ভিজলে তা বিদ্যুৎ পরিবাহী হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটাতে পারত। তিনি এই পরীক্ষাটি করার কিছুদিন পরে একজন রুশ বিজ্ঞানী একই পরীক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পড়েছিলেন।

  বিদ্যুৎ শক্তির গবেষণার ক্ষেত্রে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের এই চমকপ্রদ সাফল্যের পরে বৈজ্ঞানিক হিসেবে তার খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। তার গবেষণার ভিত্তিতে লেখা একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লন্ডনের বিশ্ব বিখ্যাত রয়েল সোসাইটিতে পাঠ করা হল। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি রয়েল সোসাইটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এটা ছিল একটি অতি দুর্লভ সম্মান। অবস্থা এরকম দাঁড়াল যে আমেরিকার চেয়ে ইউরোপের মানুষ বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার মূল্য অনেক বেশি উপলব্ধি করলেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা ফ্রান্সের সম্রাট পঞ্চদশ লুইয়ের মনোযোগ ও আকর্ষণ করল। সেই সময় জার্মানির শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট জীবিত ছিলেন। কান্ট বেঞ্জামিনকে নতুন প্রমিথিউস বলে আখ্যা দিয়ে অভিনন্দন জানালেন। গ্রিক পুরাণের মতে প্রমিথিউস মানুষকে দেবার জন্য স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন। বেঞ্জমিনও মেঘ থেকে বিদ্যুৎ শক্তি আহরণ করে প্রায় একই কাজ করেছিলেন। সেই জন্যই দার্শনিক কান্টের চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক যুগের প্রমিথিউস।

  আজকের দিনে ‘বাইফোকাল চশমা’ খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। কিন্তু এই বায়ো ফোকাল চশমা যে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন উদ্ভাবন করেছিলেন সে কথা খুব কম মানুষই জানে। মানুষের চোখে দূরের জিনিস দেখার এবং কাছের জিনিস দেখার ব্যবস্থা এক নয়। মানুষের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেলে বা অন্য কোনো প্রকারে তার বিকার ঘটলে মানুষ কখনও দূরের জিনিস ভালো করে দেখতে পারেনা এবং কখনও কাছের জিনিস ভালো করে দেখতে না পারার মতো অবস্থা হয়। কিন্তু কখনও দূরের এবং কাছের জিনিস ভালো করে দেখতে পারার ক্ষমতা একই সঙ্গে হ্রাস পেতে পারে।এরকম অবস্থায় মানুষকে দূরের জিনিস ভালো করে দেখার জন্য এক ধরনের চশমা এবং কাছের জিনিস ভালো করে দেখার জন্য অন্য এক ধরনের চশমা ব্যবহার করতে হয়। ফলে মানুষকে সব সময় দুই জোড়া চশমা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। মানুষের নানাবিধ ব্যবহারিক সমস্যার সমাধান করার জন্য নিজের মস্তিষ্ক খাটিয়ে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করাটা ছিল বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের বৈজ্ঞানিক চিন্তার একটি প্রধান লক্ষ্য।দুই জোড়া চশমা সবসময় সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অসুবিধাটা লক্ষ্য করে সেই সমস্যার সমাধান করার জন্য বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন চেষ্টা করলেন। তার ফলস্বরূপ উদ্ভাবিত হল ‘বায়োফোকাল চশমা’। এটা হল এমন এক ধরনের চশমা– যার দ্বারা মানুষ একইসঙ্গে দূরের এবং কাছের জিনিস ভালো করে দেখতে পারে। চশমা উদ্ভাবন করেছিলেন এমন একটি সময়ে– যে সময়ে তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের কঠিন দায়িত্ব পালন করে সব সময় তাকে ব্যস্ত থাকতে হত।

  বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হয়ে ফ্রান্সে থাকার সময় ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট মানুষ প্রথমবারের জন্য আকাশে বেলুন পাঠায়। সেই দৃশ্য দেখার জন্য সেদিন অন্যান্য মানুষের মধ্যে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনও উপস্থিত ছিলেন। একজন প্রথম শ্রেণির বৈজ্ঞানিক হিসেবে ইতিমধ্যে ইউরোপে তিনি সুপরিচিত হয়ে উঠেছেন। সেই জন্য সমালোচকদের মধ্য থেকে একজন কেউ তাকে জিজ্ঞেস করলেন–’ মানুষ প্রথমবারের জন্য আকাশে বেলুন ওড়াচ্ছে; এর ফলে মানবজাতির কোনো উপকার হবে বলে আপনি মনে করেন কি?’ উত্তরে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন বললেন–’ নতুন করে জন্ম হওয়া একটি শিশুর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা যা ভাবি, ঠিক সেই একই কথা বলা যেতে পারে প্রথমবারের জন্য আজ আকাশে ওড়া এই বেলুনটির বিষয়ে।’ সমস্ত কথায় বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন এতটাই দূরদর্শী ছিলেন যে আকাশে উড়তে পারা বেলুনটি মানুষের ভবিষ্যতের উপরে বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে বলে তিনি সেদিনই অনুমান করেছিলেন। উড়োজাহাজের আবিষ্কার হতে তখনও অনেক দেরি ছিল; কিন্তু যে বেঞ্জামিন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার আগে সেই দেশকে প্রথম শ্রেণীর বিশ্বশক্তি রুপে কল্পনা করেছিলেন, সেই বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন আকাশে বেলুন উড়তে দেখেই অনুমান করতে পেরেছিলেন যে এটা ভবিষ্যতে যুদ্ধবিগ্রহ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে বদলে দেবে।

সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

গোরখ পান্ডের হিন্দি কবিতা ।। অনুবাদ : নীলাঞ্জন কুমার, Gorakh Pandey

গোরখ পান্ডের হিন্দি কবিতা 

অনুবাদ : নীলাঞ্জন কুমার 





( ১৯৪৫ সালে গোরখ পান্ডের জন্ম উত্তর প্রদেশের দেবরিয়া গ্রামে । প্রথমে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পরে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে । পরবর্তীতে স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন। অবশেষে ১৯৮৯ সালে আত্মঘাতী হন। হিন্দি ও ভোজপুরি ভাষায় কবিতা লিখেছেন। তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। )


আপনি কি নিরো


বাঁশি বাজান নিশ্চিন্তে

আনন্দে গান, জ্বলছে জ্বলুক শহর

আপনি কি নিরো নাকি জেগে

আসল মুখটা আপনি একটু দেখান। 


ভয় পায় 


ভয় পায় ওরা

কিন্তু কি জন্যে ওরা ভয় পায় 

সব কিছু অর্থাৎ 

গোলা বারুদ পুলিশ থাকা সত্ত্বেও?


ভয় পায় কারণ কি?

অস্ত্র হীন আর গরীব মানুষ গুলো 

একদিন ওদের ভয় পাওয়াই

চিরতরে বন্ধ করে দেবে।


সমকালীন 


এই মুহূর্তে কোথাও আর্তনাদ 

কোথাও শুরু হল নাচ

কোথাও শিশুর জন্ম হল

আবার কোথাও আরম্ভ হল সেনার চলাচল।

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫

পিসি সরকার ও ম্যাজিক রেমেডিজ । সৌমিত্র রায় । কবিতা, poetry

পিসি সরকার ও ম্যাজিক রেমেডিজ

সৌমিত্র রায়





১) দুর্যোগ ও কার্নিভাল 


মরছে মানুষ বানে জলে

দিদি নাচছেন কার্নিভালে

দিদির নাইকো হুঁশ,

              ।

উদ্ধার আর ত্রাণের কাজে, 

কোথায় শাসক জনতা মাঝে?

দিদি আনন্দে বেহঁশ!


ঘাটাল ডুবলো ছ'বার বানে,

নাই সমাধান 'দেব' দর্শনে,

'মাস্টার প্ল্যান' আশা।

              ।

ভোট কিনবেন ছলে বলে,

দৃষ্টি ঘোরান কার্নিভালে

ঔষধ তাই খাসা!

অরহ্যান ভেলি কানিকের কবিতা ।। ভাবানুবাদ: নীলাঞ্জন কুমার , Niranjan Kumar

অরহ্যান ভেলি কানিকের কবিতা 

ভাবানুবাদ: নীলাঞ্জন কুমার 



(অরহ্যান ভেলি কানিক। জন্ম ( ১৯১৪ ) ও পড়াশোনা তুরস্কের ইস্তাম্বুল।  বাবা ছিলেন তুরস্কের সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার প্রতিষ্ঠাতা। ভেলি,মিনিস্ট্রি অব এডুকেশনে বছর খানেক চাকরি করার পরে তা ছেড়ে দেন ও কবিতায়

নিজেকে নিয়োজিত করেন। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্যে মাত্র ৩৬ বৎসর বছরে ( ১৯৫০ ) তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। তাঁর কবিতা সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫১ ও ১৯৭৫ সালে। ) 


আহা, দিনগুলো 


আহা কি সব সুন্দর দিন আমায়

শেষ করে দিয়েছিল - 

এই রকম একটি দিনে আমি কাজ ছেড়েছিলাম 

তারপর পড়ে গেলাম মাদকের খপ্পরে 

আবার একদিন সে এলে তাকে নিয়ে 

প্রেমে ডুবলাম, আর

তারপর একদিন বাড়ির জন্য 

খাবার নিতে ভুলে গেলাম।

সত্যি বলতে এসব আহা আহা দিন 

বারবার আমার সঙ্গে খেলা করে 

আসলে কবিতা লেখার পাগলামি 

আর এইসব বেয়াক্কেলে দিনগুলো 

আমায় সত্যিকারের শেষ করে দিল।


স্যুইসাইড


কাউকে না জানিয়ে ঝুপ করে মরে গেলে

আর আমার মুখের কোণে রক্ত লেগে থাকলে 

যারা আমায় কোনদিনও দেখেনি বা জানেনা

তারা বলবে বেচারা নিশ্চয়ই কাউকে 

ভালোবেসে দাগা খেয়েছে ;

আর যারা চিনতো কিংবা জানতো তারা 

বলে উঠতো , লোকটা বেঁচে গেল কষ্ট থেকে।

অবশ্য কেবল আমিই জানতাম 

আসল কারণ এর কোনটাই নয়।

মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শক্ত পোক্ত ।। নীলাঞ্জন কুমার ।। কবিতা, Nilanjan Kumar

শক্ত পোক্ত 

নীলাঞ্জন কুমার 



টক শো তে হাজারো তরজা

ব্রেকিং নিউজের জোয়ার 

বুদ্ধিজীবীর চুলচেরা বিশ্লেষণ 

 সাংবাদিকের অবিরাম ছোটাছুটি 

কোন শক্তপোক্ত সুসময় এনে দিলো না।


 হাওয়া বাতাসের এখন মনখারাপ 

ঝরে পড়ছে কান্না হয়ে

লুম্পেনের বাজানো লারেলাপ্পা গানেও

 কোন জোশ আসছে না

মড়া পোড়া গন্ধতে গা গোলাচ্ছে

আর ছুঁয়ে থাকছে হিসেবী কুচক্রী।


এসব ঝেড়ে ফেলতে চাইলে

চাই শক্তপোক্ত জনস্রোত...

রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

হে মহাজীবন ।। অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় ।। কবিতা, Arindam Chattopadhyay

হে মহাজীবন

অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় 



হে মহাজীবন, তোমার ভেতর দেখি 

সমুদ্র জলের মতন ওঠা নামা-

নোনা হাওয়ায় ভেতর ঢেউয়ের গর্জন

চোখের ভেতর রূপোলী ফেনা 

অযাচিত ভাবে ছিটকে এসে লাগে

 অনুভূত হয় শীতল জলকণা

এভাবেই,

 যে বালির ওপর জমা হয় পায়ের ছাপ 

তা নতুন দূরন্ত ঢেউয়ের দাপটে

কেমন অদৃশ্য হয়ে যায়

এরকম ভাবেই

একটা জীবন যায়, অন্য জীবন আসে।


হে মহাজীবন, তোমার ভেতর ঘনায়

আঁধার ঘন রাত-

চারিদিকে নিস্তব্ধতার গল্প শুনি

দূরতম প্রান্ত থেকে আসে ঝিঁঝি পোকার ডাক

বাতাসে কেমন যেন  মাদকতা

তবুও আকাশ জুড়ে ছড়ানো নক্ষত্র আলো

যেন কোন মেহফিল

একটা চক্রকারের ভেতর পৃথিবী 

 পরক্ষণেই এসে দাঁড়ায় রৌদ্র আলো।


হে মহাজীবন, তোমার ভেতর দিয়েই

যুদ্ধক্ষেত্রে জেগে উঠি-

মাটির ধুলোর ভেতর বারুদ গন্ধ

কানে আসে মিছিল গর্জন

পায়ের কাছে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্ত চিৎকার 

ঘামে ভেজা শিক্ত শরীর 

পরাজয়কে দূরে সরিয়ে রেখে জয়ী হয়ে উঠি।


হে মহাজীবন, তোমার ভেতর জেগে ওঠে স্বপ্ন

হতাশার ধুলো সরিয়ে দিই

দূরে অরণ্য থেকে আসে অরণ্যশব্দ

আকশের ওপর দিয়ে রঙিন পাখির উড়ান

যেন শিশুর হাসির মতন

তুমি এভাবেই 

নিয়ে আসো একটা নতুন পৃথিবী

তার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠি।



১০ টি আটপৌরে কবিতা ।। এ কে সরকার শাওন ।। বাংলাদেশ, Atpoure

১০ টি আটপৌরে কবিতা

এ কে সরকার শাওন




১. বিকেল

চা, বৃষ্টি, বারান্দা

দু'জনে 

নরম আলোয় ছুঁয়েছে  মন।


২. জীবন

আয়েশি  ঘুম   ভাঙ্গা

এলার্ম

অন্তহীন  ছুটে চলে অবিরাম! 


৩. মা

ভাত, ডাল, ভাজি

ঘ্রাণ

স্মৃতি ফিরিয়ে আনে শৈশব। 


৪. একলা

চেয়ার, বই, বাতি

নিঃশব্দ

সময় ধীরে   হাঁটে চুপিচুপি।


৫. প্রেম

তীর্যক চোখ, হাসি, 

তাঁর 

অকথিত ভাষায় ভিজে মন।


৬. কাপুরষ 

ইচ্ছে  হবো হবো

দুঃসময়ে 

আজ হতে হলো কাপুরষ!


৭. দুপুর

ঘাম, ছায়া, জানালা

নীরবতা

শরীর নুইয়ে পড়ে অলসতায়।


৮. বৃষ্টি

ছাতা, জল, পথ

ভিজে

ফুটপাথে জমাট নোংরা জল।


৯. গ্রাম

ধান, গরু, গোপাট

সবুজবীথি 

কলকাকলীতে মম ছুঁয়ে যায়।


১০. বন্ধু

হাসি, গল্প, সন্ধ্যে

চিরকাল

ভাঙা বেঞ্চেও থাকে আনন্দ!

রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫

মায়ের স্কুলটা ।। প্রণয় ফুকন ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস , কবিতা, Pranay Phukan

মায়ের স্কুলটা

প্রণয় ফুকন 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস 



হঠাৎ জানি কী হল সেদিন!

প্রয়াত মা শিক্ষকতা করা 

গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেখতে ইচ্ছা হল। 

হয়তো মায়ের সুবাস পাব কোথাও!

স্কুলটি তালা বন্ধ।

মরচে ধরা গেটের ওপারে 

পরিত্যক্ত সীমানায় গাছ লতা জঞ্জালের স্তূপ।

জানালা দিয়ে দেখলাম, 

মেঝেতে ভাঙ্গা-চোরা  ডেক্স বেঞ্চ চেয়ার টেবিল গুলি 

মায়ের বসা চেয়ারটা চিনতে পারলাম না।


গ্রামের মানুষকে জিজ্ঞাসা করলাম, 

–কী হয়েছে?

–কয়েক বছর হল 

ছেলে মেয়ে নেই 

স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেছে। 

–গ্রামের ছেলে মেয়েরা কোথায় পড়ে? 

–শহরের ইংরেজি স্কুলে ।

–এত দূরে? 

–স্কুল ভ্যানে করে সকালে যায়, সন্ধ্যেবেলা ফিরে 

–মাঠে ফুটবল,নদীর তীরে দৌড়াদৌড়ি?

–সেই সব আজকাল আর নেই।


কোনোমতে চোখের জল সামলে

ফিরে আসতে লাগলাম। 

পেছন থেকে বিবর্ণ স্কুলটি বলতে লাগল,

‘দুঃখ করে লাভ নেই বাবা, কাঁদিস না।

তোরা নিজেরাই খুলে দিয়েছিস পশ্চিমের জানালা। 

বাতাসকে দোষ দিয়ে লাভ কি?’


থতমত খেয়ে গেলাম

এটাই তো সত্যি, আমরা একটি আত্মঘাতী জাতি। 

কোনো গ্লানি নেই, অনুতাপ নেই 

শিলাময় কঠিনতায়,

বিচ্ছিন্ন করেছি ভাষা, 

বিচ্ছিন্ন করেছি সংস্কৃতি। 


মনে পড়ল স্বর্গগামী মাকে।

আজীবন শিখিয়েছেন যিনি 

দুঃখিনী বর্ণমালা।

ক্ষমা কর মা,

আমরা তোমার ব্যর্থ অক্ষম সন্তান। 

আমরা হারিয়ে ফেলেছি আত্মসম্মান 

আমরা ক্ষমার অযোগ্য। 


আমাদের শক্তি দাও মা 

কোনো এক সর্বনাশ ঘটার আগেই 

আমরা ফিরিয়ে আনি আমাদের মর্যাদা 

আমাদের সন্তানের মুখে বন্দিত হোক 

তোমার মুখের ভাষা। 

আমাদের শক্তি দাও। 


(সত্য অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে)

রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন-১০ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





দশ

(১০)

বেঞ্জামিনের কর্মময় জীবন


 ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন পেনসিলভেনিয়ার বিধানসভার সচিবের পদ লাভ করেন। বিধানসভার সচিবের পদে নিযুক্তি মাত্র এক বছরের জন্য দেওয়া হয়। অর্থাৎ প্রতিবছরই সচিব পদের নিযুক্তির জন্য নতুন নতুন প্রস্তাব বিবেচনা করা হয়। বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন প্রথমবার সচিবের পদে নিযুক্ত হওয়ার সময় তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন তার নাম প্রস্তাব করা হয় বিধানসভার একজন নতুন সদস্য সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কিন্তু তার বিরোধিতা সত্বেও বেঞ্জামিন পুনরায় সচিব পদে নিযুক্ত হন। দ্বিতীয়বার নিযুক্তি পেলেও সদস্যটির বিরোধিতার কথা বেঞ্জামিন সহজভাবে মেনে নিতে পারলেন না। তিনি অনুভব করলেন যে, কোনো প্রকারে যদি সদস্যটির অন্তর জয় করতে পারা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতেও সদস্যটি তার জন্য নানা অসুবিধার সৃষ্টি করবে। কিন্তু সদস্যটিকে তোষামোদ করে বা প্রভাবিত করে তার প্রীতি অর্জন করতে বেঞ্জামিনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। বেঞ্জামিন তার স্বভাবের বৈশিষ্ট্য অনুসারে সদস্যটির মন জয় করার একটি অভিনব পন্থা গ্রহণ করলেন। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে উক্ত সদস্যটি একজন উচ্চশিক্ষিত এবং অধ্যয়নশীল মানুষ। ভালোভাবে খবর নিয়ে বেঞ্জামিন এই কথাও জানতে পারলেন যে সদস্যটির গ্রন্থাগারে কিছু অতি মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য বইপত্র আছে। বই ধার চেয়ে বেঞ্জামিন তার কাছে অত্যন্ত নম্রভাবে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠি পড়ে সদস্যটি অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন এবং বেঞ্জামিন চাওয়া বইটি তিনি তৎক্ষণাৎ বেঞ্জামিনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর থেকেই সদস্যটি বেঞ্জামিনের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করতে শুরু করলেন এবং দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে বেঞ্জামিন একই গুলিতে দুটি পাখি শিকার করার কৌশল খুব ভালোভাবে আয়ত্ব করেছিলেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তিনি যদি তোষামদের আশ্রয় গ্রহণ করতেন, তাহলে তিনি কখনও সদস্যটির শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারতেন না। কিন্তু বেঞ্জামিন যে কৌশল অবলম্বন করলেন তার ফলে একদিকে একটি মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য বই পড়ে তিনি নিজের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করতে সমর্থ হলেন, অন্যদিকে তিনি একজন শিক্ষিত এবং প্রভাবশালী মানুষের বন্ধুত্ব অর্জন করতে পারলেন।

 বেঞ্জামিনের সারা জীবনের মূলনীতি ছিল অবিরাম ভাবে নিজের এবং সঙ্গে অন্যের উৎকর্ষ সাধনার জন্য চেষ্টা করে যাওয়া। আলস্যের সঙ্গে শুয়ে বসে থেকে তিনি জীবনের একটি মুহূর্তও নষ্ট করতেন না।ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি মাতৃভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষা শিখতে আরম্ভ করেন। প্রথমত ফরাসি ভাষা শিখতে শুরু করে তিনি মাত্র এক বছরের মধ্যে ফরাসি ভাষার বইপত্র ভালোভাবে পড়তে সক্ষম হলেন। এরপরে তিনি ইটালি ভাষা শিখতে শুরু করলেন। একই সময়ে তার একজন বন্ধুও ইটালিয়ান ভাষা শিখতে শুরু করেছিলেন।বন্ধুটি দাবা খেলতে খুব ভালোবাসতেন এবং তাঁর সঙ্গে দাবা খেলার জন্য প্রায়ই বেঞ্জামিনকে খুব জোর করতেন। কিন্তু বেঞ্জামিন নিজের উৎকর্ষের সাধনাকে অবহেলা করে খেলাধুলায় মশগুল হয়ে থাকা মানুষ ছিলেন না। অন্যদিকে বন্ধুটির অনুরোধ উপেক্ষা করাও তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেই জন্য ভাষার অধ্যয়ন এবং দাবা খেলা দুটো কাজ সমানে চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি একটা বুদ্ধি বের করলেন। তিনি বন্ধুটিকে বললেন যে মাত্র একটি শর্তে তিনি তার সঙ্গে দাবা খেলতে রাজি হতে পারেন। শর্তটি হল এই খেলায় যে জিতবে তিনি হেরে যাওয়া মানুষটিকে ইতালিয়ান ভাষার ব্যাকরণ মুখস্ত করা বা ইতালিয়ান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ দেবেন, সেই কাজ সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত খেলায় হেরে যাওয়া ব্যক্তি দ্বিতীয় বার খেলার প্রস্তাব দিতে পারবেন না। বেঞ্জামিনের এই শর্তটির ফলে দুই বন্ধু যে কেবল দাবা খেলায় জেতার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করলেনন তাই নয়, ইটালিয়ান ভাষায় একে অপরের চেয়ে অধিক পারদর্শিতা অর্জন করার জন্য দুজনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হল। বলা বাহুল্য যে এর ফলে দুই বন্ধুই ইটালিয়ান ভাষা খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করতে সক্ষম হলেন। ফরাসি এবং ইটালিয়ান ভাষা শিখে শেষ করার পরে বেঞ্জামিন স্পেনিস ভাষাও শিখে অত্যন্ত কম সময়ের ভেতরে সেই ভাষার বইপত্র ভালোভাবে পড়তে সক্ষম হলেন। 

 ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন পেনসিলভেনিয়ার পোস্টমাস্টারের পদ লাভ করলেন। নিজেই রাজ্যটির পোস্টমাস্টার হওয়ার ফলে ডাকযোগে গ্রাহকের মধ্যে নিজের খবরের কাগজ এবং বর্ষপঞ্জি বিতরণ করতে বেঞ্জামিন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা লাভ করলেন।সেইসব থেকে উপার্জিত ধনে তিনি নিজের দোকানটিকে ক্রমশ বড়ো করতে শুরু করলেন।সমস্ত দিক দিয়ে এভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে বেঞ্জামিন সমাজ-সেবার কাজে মনোনিবেশ করতে লাগলেন। 

 বেঞ্জামিনের কাজ করার একটা নিজস্ব ধরণ ছিল।সমাজের উন্নতির জন্য তিনি করতে চাওয়া প্রতিটি কাজের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে সেই কাজটির যুক্তি-যৌক্তিকতা ব্যখ্যা করে নিজের খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখতেন বা প্রবন্ধ লিখে জুন্টো ক্লাবের আলোচনা-চক্রে পাঠ করেছিলেন।নিজের চারপাশের প্রতিটি কথার প্রতি তিনি সতত দৃষ্টি রাখতেন।সমাজ-সেবার কাজ আরম্ভ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন যে ফিলাডেলফিয়া শহরে রাতে পাহাড়া দেবার জন্য যে সমস্ত চৌকিদারকে নিযুক্ত করা হয়েছিল,তারা কখনও ভালো করে নিজেদের কর্তব্য পালন করত না।অনেক চৌকিদার মদ খেয়ে নিজের কর্তব্যে অবহেলা করত।অন্য অনেকে নিজে পাহাড়া না দিয়ে সেই কাজ করার জন্য নিজের বেতন থেকে কিছু টাকা দিয়ে অন্য মানুষকে নিযুক্ত করেছিল-যারা সবসময় কাজে ফাঁকি দিত। বেঞ্জামিন এই কথাও লক্ষ্য করলেন যে চৌকিদারকে বেতন দেবার জন্য যে টাকা খরচ করতে হয় সেই ধন সংগ্রহ করার জন্য দুঃখী ধনী সবাইকে সমপরিমাণ কর দিতে হয়।বেঞ্জামিন ফিলাডেলফিয়ার চৌকিদারি ব্যবস্থার আমূল সংশোধন করার জন্য প্রস্তাব করে প্রথমে নিজের খবরের কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখলেন।তার যুক্তিতে শহরের সমস্ত মানুষ ভরসা করল।এর ফলে ফিলাডেলফিয়ার চৌকিদারি ব্যবস্থার সংশোধন ঘটানোটা সম্ভব হল।মানুষের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী কর ধার্য করার ব্যবস্থা হল;দক্ষ এবং সৎ্লোককে চৌকিদার হিসেবে নিয়োগ করা হল;তারা যাতে কাজে ফাঁকি না দেয় ,সেই উদ্দেশ্যে চৌকিদারদের বেতনও বৃদ্ধি করা হল।

 এর পরে বেঞ্জামিনের চোখ পড়ল শহরের রাস্তা-ঘাটের দিকে।রাস্তা পরিষ্কার করার কোনো মানুষ ছিল না।শহরের অধিবাসীরা বাড়ির ময়লা এবং আবর্জনা ঝেড়েপুছে রাস্তায় জমা করে রাখত।ফলে সমগ্র শহরটা হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর। বেঞ্জামিন শহরের অধিবাসীদের সামনে এই ভাবে প্রস্তাব তুলে ধরলেন যে তাঁরা যদি প্রতিটি বাড়ি থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা দিতে রাজি হয় তাহলে সেভাবে সঞ্চিত ধনে পথঘাট পরিষ্কার করে রাখার জন্য কিছু মানুষকে নিযুক্ত করা যেতে পারে।বেঞ্জামিনের প্রস্তাবে শহরের অধিবাসীরা সম্মত হলেন।ফলে কিছুদিনের মধ্যে ফিলাডেলফিয়ার পথ ঘাট ময়লা এবং আবর্জনা থেকে মুক্ত হল।এই কাজের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে বেঞ্জামিন এবার শহরের রাস্তাঘাট গুলিকে পাকা করার প্রস্তাব দিলেন।তাঁর সেই প্রস্তাবেও ফিলাডেলফিয়ার মানুষ বিপুলভাবে সমর্থন জানালেন।

 এই সমস্ত কাজ করার সময় বেঞ্জামিন আরও একটি জিনিস লক্ষ্য করলেন যে শহরটিতে প্রায়ই ঘটতে থাকা অগ্নিকাণ্ডের ফলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।কিন্তু সেই সময় ফিলাডেলফিয়া বা আমেরিকার কোনো জায়গাতেই অগ্নি নির্বাপনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া লোকেরাও ক্ষতিপূরণ পাবার জন্য বা নতুন করে ঘর দুয়ার তৈ্রি করার জন্য আর্থিক সাহায্য পাওয়ার কোনো রকম আশা করতে পারত না। বেঞ্জামিন ফিলাডেলফিয়াতে একটা অগ্নি নির্বাপক বাহিনী গড়ে তুললেন।তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা যাতে আর্থিক সাহায্য পেতে পারে সেই উদ্দেশ্যে তিনি আমেরিকার সর্বপ্রথম অগ্নি নির্বাপক কোম্পানি স্থাপন করলেন।

 বেঞ্জামিনের এই সমস্ত সমাজ সেবার কাজ তাঁর জনপ্রিয়তার প্রভাব আগের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি করল।এখন তিনি ফিলাডেলফিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত এবং প্রভাবশালী নাগরিকে পরিণত হলেন।ফিলাডেলফিয়ার বৈষয়িক উন্নতির জন্য ওপরে উল্লেখ করা ধরনের অনেক জনহিতকর কাজ করার পরে বেঞ্জামিন এবার আমেরিকার বৌদ্ধিক উৎকর্ষ সাধনার কথা চিন্তা করতে শুরু করলেন।সেই উদ্দেশ্যে ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আমেরিকান দার্শনিক সমাজ(American Philosophical Society )প্রতিষ্ঠা করলেন।আমেরিকান দার্শনিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার সপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন-‘নতুন উপনিবেশ স্থাপন করার কষ্ট এবং অবসাদের এখন সমাপ্তি ঘটেছে।প্রতিটি উপনিবেশে এখন এই ধরনের অনেক মানুষ আছে –যারা জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করে সমাজের সামগ্রিক জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে।’এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সেই সময়ে আমেরিকার তেরোটি ব্রিটিশ উপনিবেশই একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল;উপনিবেশগুলির মধ্যে কোনো সাধারণ যোগসূত্র ছিল না।নিজের রাজ্যের সীমা অতিক্রম করে তেরোটি উপনিবেশের মধ্যে বৌদ্ধিক যোগসূত্র স্থাপন করা প্রথম মানুষটি ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন।কেবল তাই নয় –আমেরিকা যে একদিন বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হবে সেই কথা ভবিষ্যৎবাণী করা প্রথম মানুষটিও ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন।

 ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ‘আমেরিকান দার্শনিক সমাজ’ স্থাপন করার পরে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফিলাডেলফিয়া আকাডেমি নামের একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।এই আকাডেমিই পরবর্তীকালে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের জীবনকালে ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন নিজে একজন প্রধান কর্মকর্তা রূপে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানায় আজ তাই বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের একটি বিশাল প্রস্তর মুর্তি বিরাজ করছে।

শনিবার, ৯ আগস্ট, ২০২৫

তোমাকে ।। দীপালি মাইতি, কবিতা , Dipali Maity

তোমাকে 

দীপালি মাইতি


তোমার কবিতা

নাটক ও উপন‍্যাস

প্রতিটি আত্মার খেলাঘর


তোমাকে মনে পড়ে 

  ফুল ফল বীজে

পাতার শিশিরে

কোকিলের ডাকে

উঠোনে শালিকের গানে


বৃষ্টি জানলায়

ভোর আকাশের বাঁকা চাঁদেও


পাহাড়ি ঝরনায়

শিউলির গন্ধে আজও তুমি 

অমর


ফাঁকা মাঠে

বাতাসের নৃত‍্যে

তুমিই আমার লুকোনো প্রেম

রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন-৯ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





নয়

(৯)

বেচারা রিচার্ডের বর্ষপুঞ্জী

(Poor Richards Almanac)


(Poor richards Almanac) বেঞ্জামিন  ফ্রেঙ্কলিন ইতিমধ্যে ফিলাডেলফিয়ার একজন নেতৃস্থানীয় ধনী মানুষ বলে  পরিচিতি লাভ করেছেন।

১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে  ফ্রেঙ্কলিন  তার ছাপা ছাড়া থেকে প্রতিবছর একটি বর্ষপঞ্জী প্রকাশ করতে শুরু করেন। তিনি বর্ষপঞ্জিটার নাম দেন–Poor richards Almanac–অর্থাৎ বেচারা রিচার্ডের বর্ষপঞ্জী। রিচার্জ ছিলেন একটি কাল্পনিক চরিত্র। মানুষটা ছিলেন অতি সৎ, কিন্তু অতি দরিদ্র।স্ত্রীর কাছ থেকে গালিগালাজ খেয়েই  তাঁর দিন কাটে। প্রকাশ ফ্রাঙ্কলিন প্রতিবছর প্রকাশ করা বর্ষপঞ্জিটা ছিল রিচার্ড নামে এই কাল্পনিক মানুষটির স্বীকারোক্তি।। নিজের জীবনের কথা বলার ছলে রিচার্ড নানা বিষয়ে তার মন্তব্য এবং  নীতি উপদেশ দিতেন।  সেই প্রতিটি কথা তিনি লিখেছিলেন তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। বেচারার রিচার্ডের বর্ষপঞ্জি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, ফ্রেঙ্কলিনকে  প্রতিবছর বর্ষপঞ্জীটার দশ হাজার কপি প্রকাশ করতে হয়েছিল। সুদীর্ঘ 25 বছর কাল বর্ষপঞ্জীটি প্রকাশ হয়েছিল। এই বর্ষপঞ্জটি একইসঙ্গে তিনটা কাজ করেছে। প্রথমত, এটি আমেরিকার মানুষের স্বভাব চরিত্র উন্নত করা এবং জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করায় সাহায্য করেছে। দ্বিতীয়ত,বর্ষপঞ্জীটি  বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের  চেয়ারটি এবং জনপ্রিয়তা আমেরিকার চারদিকে  ছড়িয়ে দিয়েছিল। তৃতীয়তঃ, বর্ষপঞ্জী থেকে ফ্রেঙ্কলিন এত ধন উপার্জন করলেন যে তিনি সেই সময়ের আমেরিকার প্রথম সারির ধনীদের মধ্যে একজন বলে পরিচিতি লাভ করলেন।

 বেচারা রিচার্ডের  বর্ষপঞ্জীর কিছু যোজনা পাঠান্তরের পরিচিতি নিচে দেওয়া হল–

নিজের নিকটতম  প্রতিবেশীকে ভালোবাসবে, কিন্তু দুটি বাড়ির মধ্যে সীমানাটা ভেঙ্গে ফেল না।

 তোমার নিজের ভাই তোমার বন্ধু না হতে পারে, কিন্তু তোমার বন্ধু সবসময় তোমার ভাই হয়ে থাকবে।

 মানুষ মাত্রই ভুল করে; ক্ষমা করাটা স্বর্গীয় গুণ; কিন্তু একই ভুলকে বারবার করে থাকাটা শয়তানের লক্ষণ।

‘ কর্কশ’ শব্দ প্রয়োগ করে কেউ কারও বন্ধু হতে পারে না। এক গ্যালন ভিনেগারের চেয়ে  এক চামচ মধু দিলে বেশি মাছি ধরা পড়বে।

 যে মানুষ সুখ শান্তিতে বেঁচে থাকতে চায়, তিনি নিজে  সমস্ত কথা মুখ খুলে বলেন জানা সমস্ত কথা মুখ খুলে বলেন না, আর নিজে দেখা সমস্ত কথার উপরে মন্তব্য করেন না।

 একজন সহজ সরল গ্রামের মানুষ যদি উকিলের পাল্লায় পড়ে; তাহলে তার অবস্থা হয় দুটি বিড়ালের মধ্যে পড়া মাছের মতো।

পচা আপেল  একটি টুকরিতে  থাকলে  বাকি  আপেলগুলি  পচতে আরম্ভ করে।

 কোনো  মানুষ এত খারাপ হতে পারেন না যে তিনি অন্যের ভালো গুণগুলিকে শ্রদ্ধা না করে থাকতে পারেন।

 সহজ উদাহরণই হল সর্বোত্তম উপদেশ।

 নিজের বিবেক সব সময় নির্মল করে রাখবে; তাহলে তুমি অন্যকে ভয় করে চলার প্রয়োজন নেই।

যে মানুষ আদেশ পালন করতে পারে না, তিনি অন্যকে আদেশ দিতে পারেন না।

 মিথ্যা কথা আর একটি, সত্যের পা দুটি।

 সমস্ত মানুষকে খুব সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি পর্যবেক্ষণ করবে নিজেকে।

 জীবন দীর্ঘ হলেও সে ভালো জীবন নাও হতে পারে; কিন্তু ভালো জীবন সব সময় দীর্ঘ বলে প্রমাণিত হয়।

জীবন ধারণের জন্য খাবে,? খাবার জন্য জীবন ধারণ করবে না।

  যে মানুষ কারও কাছ থেকে কিছু আশা করে না , তিনিই সুখী এবং ভাগ্যবান মানুষ। তাকে জীবনে কখনও বিরাশ হতে হয় না।

 তুমি সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে চাও কি? যদি চাও, তাহলে যে কাজ করা উচিত, কেবল সেই কাজই করবে, যে কাজ করে খুশি হও, সেরকম কাজ করবে না।

 যদি দীর্ঘ জীবন লাভ করতে চাও, তাহলে আহারের পরিমাণ পরিমাণ কম করবে।

 পিঁপড়ার চেয়ে ভালো নীতি শিক্ষা অন্য কেউ দিতে পারে না; পিঁপড়া  কিন্তু মুখে  কিছু বলে না।

কষ্ট না করে কেউ কিছু জিনিস লাভ করতে পারে না।

দোকানটা ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে;তখন দোকানটাও তোমাকে সুখে-সন্তোষে রাখবে।

যে মানুষ পরিশ্রম করে না,সে কখনও খ্যাতিমান হতে পারে না।

আগামীকাল কিছু কাজ করার মতো আছে কি?যদি থাকে তাহলে সেই কাজ আজই করে ফেল।

একজন যুবক ব্যবসায়ীর প্রতি উপদেশ

তোমার চাহিদা অনুসারে আমি নিচে কয়েকটি সংকেত দিলাম।আমি নিজে এই কয়েকটি নীতি অনুসরণ করে জীবনে অনেক সুফল পেয়েছি।আমি আশা করি যে তুমিও আমার মতোই সুফল পাবে।

মনে রাখবে যে সময়ই হল ধন।ধরে নাও,তুমি সারাদিন কাজ করে দশ শিলিং রোজগার করতে পার।কিন্তু তুমি মাত্র অর্ধেক দিন কাজ করে দিনটির বাকি সময় শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলে।সেই সময়ে তুমি যেন আমোদ-প্রমোদের জন্য ছয় শিলিং খরচ করলে।তুমি ভাবলে যে তুমি মাত্র ছয় শিলিংই খরচ করেছ।কিন্তু আসলে খরচের তালিকায় তোমাকে আরও পাঁচ শিলিং যোগ দিতে হবে।কারণ দিনের অর্ধেক ভাগ সময় তুমি শুয়ে বসে বা রং তামাসা করে না কাটালে তুমি পাঁচ শিলিং অর্জন করতে পারতে।

 মনে রাখবে যে ধনের নিজের সংখ্যা-বৃদ্ধি করার ক্ষমতা আছে।ধন সন্তানের জন্ম দান করে;ধনের সন্তান নতুন করে সন্তানের জন্ম দান করে।এভাবে ধনের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে।পাঁচ শিলিং ভালোভাবে ব্যাবসায় বিনিয়োগ করতে জানলে তা একদিন ছয় শিলিং হবে।ছয় শিলিং অতি দ্রুত সাত শিলিং তিন পেন্স হবে।এভাবে বাড়তে বাড়তে তা একদিন গিয়ে একশো পাউণ্ড হবে।ব্যাবসায় ভালো হতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে লাভও দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করবে।কেউ যদি বাচ্চা দিতে থাকা অবস্থায় একটি শূকরীকে মেরে ফেলে ,তাহলে সে ভবিষ্যতে হাজারটা পুরুষের জন্য শূকরীটির সবগুলি বংশধরকে হত্যা করে।ঠিক সেভাবে কেউ যদি একটি শিলিং নষ্ট করে তিনি আসলে সেই শিলিংটা থেকে হতে পারা শত শত পাউণ্ড নষ্ট করেন।

মনে রাখবে যে, যে মানুষ অন্যের কাছ থেকে ধন ধারে নিয়ে সেই ধার সময়মতো পরিশোধ করেন তিনি আসলে অন্যের ধনের থলেগুলির মালিক হন।যখন মানুষ দেখে একজন মানুষ অন্যের কাছ থেকে ধার নেওয়া সমস্ত টাকা নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করে,অর্থাৎ তিনি নিজের শপথ রক্ষা করেন,তখন তাঁর প্রয়োজন হলেই অন্যে তাকে     ধন ধার দিতে সঙ্কোচ করে না।ব্যাবসায়ী মানুষকে এই কথাটা খুব সাহায্য করে।ব্যাবসায় উন্নতি করতে চাওয়া যে কোনো যুবকের জন্য অধ্যবসায় এবং মিতব্যয়িতার পরেই সবচেয়ে বড়োগুণ হল আর্থিক লেন-দেনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা।সেইজন্য কারও কাছ থেকে ধন ধারে নিলে ধার পরিশোধ করা নির্দিষ্ট সম্যের চে্য়ে মাত্র একঘণ্টা সময়ও বেশি সেই ধন নিজের হাতে রাখবে না,কারণ তাহলে তুমি পুনরায় কখনও বন্ধুদের কাছ থেকে ধন ধারে পাওয়ার আশা করতে পারবে না।

তুমি যার কাছ থেকে ধন ধারে নাও তাঁর মনে তোমার সম্বন্ধে সন্দেহ বা অবিশ্বাস জন্মাতে পারা ছোটো ছোটো কথাগুলি সযত্নে পরিহার করে চলতে চেষ্টা করবে।তোমার কারখানায় যদি সকালবেলা পাঁচটার সময় বা রাত নয়টার সময় হাতুড়ির কাজ চলতে থাকে এবং তোমাকে টাকা ধার দেওয়া মানুষটি সেই হাতুড়ির শব্দ শুনতে পায়,তাহলে তিনি তোমার হাতে তার ধনটুকু আরও ছয়মাস বেশিদিনের জন্য ছেড়ে দিতে দ্বিধা করবে না।কিন্তু অন্যদিকে তুমি যে সময়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকা উচিত ছিল সেই সময়ে যদি তিনি তোমাকে তাস খেলায় মত্ত থাকতে বা মদের দোকানে দেখতে পায়,তাহলে ঠিক তার পরদিনই তিনি তোমার কাছ থেকে ধনটুকু ফিরে পাবার দাবি জানাবে।

সবসময় আয় দেখে ব্যয় করবে।তা না করলে নিজের অজান্তেই তুমি একদিন ঋণী হয়ে পড়বে এবং ধারের বোঝা ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকবে।

সেরকম যাতে না হয় তার জন্য তুমি কিছুদিনের জন্য তোমার উপার্জন এবং খরচের হিসেব লিখে রাখার হিসেব করবে।তুমি যদি একটু কষ্ট করে খরচের খুঁটিনাটিগুলি লিখে রাখ,তাহলে খুচরো খরচগুলি কীভাবে একদিন গিয়ে একটা মোটা অঙ্কে পরিণত হয় সেকথা তুমি নিজেই আবিষ্কার করবে।তখন তুমি নিজের জন্য বিশেষ অসুবিধা সৃষ্টি না করে ধন সঞ্চয় করতে শিখবে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে ধনী হওয়ার পথটা বাজারে যাওয়া পথের মতোই সোজা।এটা প্রধানত নির্ভর করে মাত্র দুটি শব্দের ওপরে।অধ্যবসায় এবং মিতব্যয়িতা।অর্থাৎ সময় এবং ধন এই দুটির একটিরও অপচয় করবে না;বরং দুটিরই পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে।অধ্যবসায় এবং মিতব্যয়িতার অবিহনে তুমি কখনও ব্যাবসায়ে সফল হতে পারবে না।অন্যদিকে এই দুটি একত্রিত হলে তুমি ব্যাবসায় সফল না হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।যে মানুষ সৎভাবে পেতে পারা সমস্ত ধন পায় এবং পাওয়া ধনটুকু (অত্যাবশ্যকীয় খরচটা বাদ দিয়ে)সঞ্চয় করে তিনি নিশ্চয় একদিন ধনী মানুষ হবেই হবে।

যে মানুষ ভাবে যে নিজের জোরে তিনি সমস্ত কাজ করিয়ে নিতে পারেন,তাহলে সেরকম মানুষকে এই বলে সন্দেহ করার জন্য জায়গা থাকে যে তিনি প্রত্যেকটা কাজ ধনের জন্য করেন।

কুঠারের একটু একটু আঘাতে একটি বিরাট গাছ গড়িয়ে ফেলতে পারে।

তুমি যত অর্জন কর,তারচেয়ে কম খরচ করার জন্য যদি শেখ,তাহলে নিশ্চয় জানবে যে সমস্ত জিনিসকে সোনায় পরিণত করতে পারা প্রশ-পাথর তুমি পেয়ে গেছ।

তাড়াতাড়ি বিছানায় যাওয়া এবং দ্রুত উঠার অভ্যাস করবে;তখন তুমি স্বাস্থ্যবান,ধনী এবং জ্ঞানী হতে পারবে।

গাড়ির সবচেয়ে খারাপ চাকাটা সবচেয়ে বেশি শব্দ করে।

কৃ্তকার্যতা অনেক মানুষের সর্বনাশ করেছে।

নিজের জ্ঞান গোপন করতে না পারা মানুষের চেয়ে বড়ো মূর্খ অন্য কেউ নেই। 

ছোটো ছোটো দষ-ত্রুটিগুলি সময় মতো শুধরে না নিলে শেষে এটাই গিয়ে বিরাট আকার ধারণ করে।

কাঁচের বাসন,চিনা মাটির বাসন এবং মানুষের খ্যাতি অতি সহজে ভাঙে;সেইসব কখনও সম্পূর্ণভাবে জোড়া লাগে না।

যে নিজেকে সহায় করে,তাকে ঈশ্বরও সহায় করে।

ক্ষুধাই হল সবচেয়ে ভালো তরকারি।

অভিজ্ঞতার পাঠশালা অতিমাত্রায় খরচে 

কিন্তু মূর্খ তার বাইরে অন্য কিছু পাঠশালায় শিখতে পারে না।

যে মানুষের কাঁটা ছড়ানো অভ্যাস,তার কখনও খালি পায়ে হাঁটা উচিত নয়।

তিনজন মানুষের পক্ষে একটা গোপনীয় কথা গোপন করে রাখা সম্ভব-যদি সেই তিনজন মানুষের ভেতরে দুজন মানুষের ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়।

কুয়ো শুকিয়ে তলা বেরিয়ে গেলে তবেই আমরা জলের মূল্য বুঝি।

সময় হল এমন একটি মহৌষধের ,যা সমস্ত ধরনের রোগ নিরাময় করতে পারে।

কেবল জ্ঞানী এবং সাহসী মানুষ নিজের ভুলটা স্বীকার করতে পারে।

খারাপ ইস্পাত দিয়ে কখনও ভালো দা তৈরই করা যায় না।

তুমি যদি তোমার শত্রুর কোনো অপকার কর,তাহলে তুমি তোমার শত্রুর চেয়ে নিচু স্তরের মানুষ বলে পরিগণিত হবে।

তুমি যদি শত্রু তোমার করা অপকারের প্রতিশোধ নিতে চাও,তাহলে তুমি তোমার শত্রুর একই সারির মানুষ বলে গণ্য হবে।কিন্তু যদি শত্রু তোমার প্রতি করা অপকারের জন্য তুমি তাকে ক্ষমা করে দিতে পার,তাহলে প্রমাণ করা হবে যে তুমি তোমার শত্রুর চেয়ে উঁচু স্তরের মানুষ।

রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন -৮ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





আট

(৮)

বেঞ্জামিনের বহুমুখী সাধনা

বেঞ্জমিন কর্মজীবন আরম্ভ করেছিলেন মুদ্রক এবং সাংবাদিক হিসেবে।একজন সফল সাংবাদিক হওয়াটা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ছাপাখানার ব্যবসা কৃতকার্যতার মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি খবরের কাগজ আরম্ভ করলেন।। নাম দা ‘পেনসিলভেনিয়া গেজেট’।

বেঞ্জামিন এখন ফিলাডেলফিয়ার একজন বিশিষ্ট এবং সম্মানিত নাগরিক। তিনি নিজে একটি বড়ো ছাপাখানার মালিক। তাছাড়া তিনি একটি খবরের কাগজের সম্পাদক। কিন্তু বেঞ্জামিন কেবল ব্যক্তিগত কৃতকার্যতায় সন্তুষ্ট হয়ে থাকার মানুষ ছিলেন না। তিনি সবসময় নিজের স্বাস্থ্য স্বভাব চরিত্র এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নত করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার সমান্তরাল ভাবে তিনি আরও একটি ব্রত গ্রহণ করেছিলেন– তিনি যে পরিবেশ এবং যে সমাজে বাস করেন সেই পরিবেশ এবং সেই সমাজের উন্নতি সাধন করার জন্য কাজ করা। নিজের উন্নতি সঙ্গে অন্যেরও উন্নতি– এই সংকল্প তিনি সারা জীবন চোখের সামনে রেখে ছিলেন এবং সেই অনুসারে কাজ করে গেছেন।

  ফিলাডেলফিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে তার বিশিষ্ট এবং বিদগ্ধ বন্ধুদের নিয়ে একটি ক্লাব খুললেন। ক্লাবটির নাম দিলেন জুন্টো (Junto)।অহরহ উন্নতির কথা চিন্তা করা বেঞ্জামিনের এই ক্লাবটি খোলার মূল উদ্দেশ্য ছিল আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে ক্লাবের প্রতিটি সদস্যের মানসিক উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করা। ক্লাবের বৈঠক বসত প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা বেলা। ক্লাবের নিয়মাবলী তৈরি করেছিলেন বেঞ্জামিন নিজে। সেই নিয়ম অনুসারে ক্লাবের প্রতিটি সদস্যই পর্যায়ক্রমে রাজনীতি, দর্শন, নীতিশাস্ত্র এবং অন্যান্য যে কোনো বিষয়ে একটি বা ততোধিক প্রশ্ন উত্থাপন করবে এবং বাকি সদস্যরা সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে। তিন মাস পরে পরে ক্লাবের প্রতিটি সদস্য নিজের পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো বিষয়ের উপরে একটি পাঠ করবে এবং বাকি সদস্যরা তার উপরে তর্ক করবে। কিন্তু তর্ক যুদ্ধে জয়লাভ করাটা কারও উদ্দেশ্য হবে না। তর্কের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে সত্যের সন্ধান।

যে সময়ের কথা লিখছি সেই সময় আমেরিকা স্বাধীন ছিল না বা এখনকার মতো একটি বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্রও ছিল না।ব্রিটেন থেকে যাওয়া শরণার্থীরা তখন পর্যন্ত উত্তর আমেরিকায় তেরোটি উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।প্রতিটি উপনিবেশই ছিল ব্রিটিশ রাজ শক্তির অধীন।বেঞ্জামিন ক্লাব খুলে বন্ধুদের সঙ্গে নানা বিষয়ে তর্ক এবং আলোচনা করে থাকার সময় তেরোটি উপনিবেশে মুদ্রার অভাব জনসাধারণের জন্য জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।ক্লাবের বৈঠকে সেই বিষয়েও একদিন আলোচনা হল।সেই আলোচনার ভিত্তিতে বেঞ্জামিনের নিজের নাম না দিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে বিতরণ করলেন।প্রবন্ধটিতে মাটির মূল্যের ওপর ভিত্তি করে কাগজের নোট ছাপার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।সরল ভাষায় লেখা বেঞ্জামিনের অকাট্য যুক্তিতে বিশ্বাস করে পেনসিলভেনিয়ার বিধান সভা কাগজের নোট প্রচলন করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং নোট ছাপার দায়িত্বটাও দিলেন বেঞ্জামিনের ছাপাখানাকে।ফলে একই সময়ে বেঞ্জামিনের হাতে অনেক টাকা এল।যা অল্প কিছু ঋণ পরিশোধ করার জন্য বাকি ছিল সেটা পরিশোধ করে তিনি এখন একজন ধনী মানুষ হলেন।বেঞ্জামিন নিজে স্বীকার করা মতে তাঁর জীবনে উন্নতি এবং কৃ্তকার্যতা লাভ করার একটি প্রধান সম্বল ছিল তাঁর ভালো গদ্য লেখার ক্ষমতা।কাগজের নোট ছাপিয়ে ধনী হওয়াটাও তার একটি প্রমাণ বলে তিনি নিজে লিখে রেখে গেছেন।

ঠিক প্রায় এই সময়ে জনগণের জন্য একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করার চিন্তাও বেঞ্জামিনের মনে এল।এর আগে পর্যন্ত আমেরিকায় গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব ছিল না।জুন্টো ক্লাবে পাঠ করা রচনাগুলিতে প্রায় নানা ধরনের বইয়ের উল্লেখ থাকে। সেই প্রতিটি বই ক্লাবের সদস্যদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা বই। বেঞ্জামিন একদিন ক্লাবের বৈঠকে প্রস্তাব করলেন যে সদস্যরা যদি তাদের বইগুলি বাড়ি থেকে এনে ক্লাবে বসার ঘরে একসঙ্গে করে রাখে, তাহলে রচনাগুলোর বিষয়ে আলোচনা করার সময় সদস্যরা প্রয়োজন হলে বই গুলির পাতা উল্টিয়ে দেখতে পারবে; তাছাড়া তারা একে অপরের বই পড়ার জন্য বাড়িতেও নিতে পারবে। বেঞ্জামিনের প্রস্তাবে জুন্টো ক্লাবের সদস্যরা সম্মত হলেন। তারা প্রত্যেকেই নিজের নিজের বইগুলি ক্লাবে জমা দিলেন। কিন্তু এই ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হল না। যত্ন নেওয়া মানুষের অভাবে বইগুলি নষ্ট হয়ে যেতে লাগল। প্রায় এক বছর পরে সদস্যরা বইগুলি ফিরিয়ে নিয়ে গেল। ঠিক এই সময়ে বেঞ্জামিন একটি সরকারি গ্রন্থাগার স্থাপন করার কথা চিন্তা করতে শুরু করলেন।

বেঞ্জামিনের পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তাবিত গ্রন্থাগারের জন্য প্রথমে পঞ্চাশজন সদস্য খুঁজে বের করা হল। সদস্য হওয়ার জন্য তাদের প্রত্যেককেই চল্লিশ সিলিং করে ভর্তি মাশুল দিতে হল। তাছাড়া ঠিক হল যে পঞ্চাশ বছরের জন্য তাদের বছরে দশ শিলিং করে দান করতে হবে। এই টাকা দিয়ে বই কিনে আমেরিকার সর্বপ্রথম সরকারি গ্রন্থাগার স্থাপন করা হল। বেঞ্জামিন স্থাপন করা গ্রন্থাগার গড়ে তোলার আদর্শে পরবর্তীকালে সমগ্র আমেরিকায় এই ধরনের অসংখ্য গ্রন্থাগার (Subscription Library) স্থাপন করা হল। পরবর্তীকালে এই আদর্শ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ল।বেঞ্জামিন নিজের জীবনকালে তাঁর সৎ কর্মের সুফল দেখে গিয়েছিলেন। তিনি নিজে লিখে রেখে গেছেন–’ এই গ্রন্থাগার গুলি আমেরিকানদের সাধারণ কথাবার্তা মান অনেকখানি উন্নত করল, এবং সাধারণ কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের বুদ্ধিমান করে তুলল। তাছাড়া এই গ্রন্থাগার গুলি সাধারণ মানুষকে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলে সেই সমস্ত রক্ষা করার জন্য তাদেরকে প্রেরণা দান করল।’

এই গ্রন্থাগার বেঞ্জামিনের নিজের কতটা উপকার করেছে সেই কথা তিনি লিখে যেতে ভুলেন নি। বেঞ্জামিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন–’ নিয়মিত ভাবে বই পড়ে নিজের উৎকর্ষ সাধন করার জন্য এই গ্রন্থাগার আমাকে অনেকখানি সাহায্য করেছে। বাবার ইছা অনুসারে উচ্চশিক্ষা আহরণ করতে না পারার ফলে আমার যে ক্ষতি হয়েছিল সেই ক্ষতি আমি অনেক পরিমাণে পূরণ করতে পেরেছি এই গ্রন্থাগারের সাহায্যে। আমি প্রতিদিন একঘণ্টা বা দুইঘন্টা সময় আলাদাভাবে রেখেছিলাম। বই পড়াটাই ছিল আমার একমাত্র আমোদ প্রমোদ। তাস খেলে বা মজা করে আমি একটি মুহূর্তও নষ্ট করিনি।’

 সবসময় আত্মোৎকর্ষের সাধনা করা বেঞ্জামিন ঠিক এই সময় নিজের নৈতিক উৎকর্ষের জন্য আরও একটি অভিনব পরিকল্পনা হাতে নিলেন। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি নিচে উল্লেখ করা বারোটি বিশেষ গুণ আয়ত্ত করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং সেই গুণগুলি একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করে নিলেন।–

১) মিতাচার –শরীর ভারী হওয়ার মতো খাবার না খাওয়া, মস্তিষ্ক উত্তেজিত হওয়ার মতো মদ্যপান না করা।

২) নীরবতা– যে কথা বললে তোমার নিজের বা অন্যের কোনো উপকার হয় না, সেরকম কথা বলবে না, তুচ্ছ অর্থহীন কথা বলে সময় নষ্ট করবে না।

৩) পরিপাটিতা – যে জিনিস যেখানে রাখা উচিত ঠিক সেখানে রাখবে, যে কাজ যখন করা উচিত ঠিক তখনই করবে।

৪) সংকল্প– যে কাজ উচিত সেরকম কাজ করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করবে; যে কাজ করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করবে, সেই কাজ কখনও না করে থাকবে না।

৫) মিতব্যয়িতা– নিজের বা অন্যের উপকারে না আসা কোনো কাজে টাকা পয়সা খরচ করবে না, কোনো ধরনের অপচয় করবে না।

৬) অধ্যবসায়– সময় নষ্ট করবে না; সব সময় কিছু না কিছু একটা কাজে লেগে থাকবে; অপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম সমূলে বাদ দেবে।

৭) আন্তরিকতা– অন্যের অপকার করতে পারা কোনো ধরনের ছলনা বা প্রতারণার আশ্রয় নেবে না, সৎ ভাবে চিন্তা করবে; কথাও বলবে সৎভাবে চিন্তা করা অনুসারে।

৮) ন্যায়পরায়ণতা– অন্যে আঘাত পেতে পারে সেরকম কোনো কাজ করে অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ করবে না; ঠিক সেভাবে অন্যের উপকার করাটা যদি তোমার কর্তব্য, সেটাও না করে থাকবে না।

৯) আত্ম-সংযম– সমস্ত কথায় আতিশয্য পরিহার করে চলবে; প্রাপ্য শাস্তি বা আঘাত পেলে তার জন্য ক্রোধ বা অসন্তোষ প্রকাশ করবে না।

১০) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা– নিজের শরীর, পরা কাপড়-চোপড়, বিছানা পত্র এবং বাসস্থান সমস্ত সময়ে নিখুঁতভাবে পরিষ্কার করে রাখবে।

১১) মানসিক প্রশান্তি– ছোটো ছোটো কথায় বিরক্ত হবে না; সচরাচর হয়ে থাকা বা এড়াতে না পারা বিপদ-আপদে বিচলিত হয়ে মনের শান্তি হারাবে না।

১২) নম্রতা– যিশুখ্রিষ্ট এবং সক্রেটিসের আদর্শ অনুসরণ করে চলবে।

অনুশীলন করার জন্য বারোটি গুণের তালিকা করে নেবার পরে বেঞ্জামিন প্রতিটি গুণের অনুশীলন করার জন্য এক একটি সপ্তাহ উৎসর্গ করা ঠিক করলেন। অর্থাৎ সম্পূর্ণ একটি সপ্তাহ তিনি একটি মাত্র গুণের অনুসরণ করায় নিয়োগ করার কথা ভাবলেন। প্রথম সপ্তাহের জন্য তিনি বেছে নিলেন মিতাচার। প্রথম সপ্তাহের জন্য মিতাচার বেছে নেওয়ার কারণ এই যে, বেঞ্জামিনের মতে পান ভোজনের ক্ষেত্রে সংযম রক্ষা করে চললে মানুষের মগজ শীতল এবং পরিষ্কার হয়ে থাকে। মগজের এরকম অবস্থায় সমস্ত কথা ভালোভাবে চিন্তা করে শুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।

 এক সপ্তাহ মিতাচারের অনুশীলন করে বেঞ্জামিন দ্বিতীয় সপ্তাহের জন্য বেছে নিলেন নীরবতার অনুশীলনী। যে মানুষ মুখে কম কথা বলে, কিন্তু কান সবসময় খোলা রাখে, সেই মানুষ অন্যের কথা শুনে বেশি করে জ্ঞান আহরণ করতে পারে। অন্যদিকে যে মানুষের অনবরত কথা বলে থাকার অভ্যাস, সে অন্যের কাছ থেকে কোনো কথাই শিখতে পারেনা। সেই জন্যই বেঞ্জামিন নীরবতা তথা কম কথা বলার উপরে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন এবং তার গুণের তালিকায় তাকে দ্বিতীয় স্থান দিয়েছিলেন।

 তৃতীয় সপ্তাহে অনুশীলন করার জন্য তিনি বেছে নিলেন পরিপাটিতা। যে মানুষের সমস্ত জিনিস পরিপাটি করে রাখার এবং সমস্ত কাজ পরিপাটি করে করার অভ্যাস, তিনি কাজ করার জন্য এবং পড়াশোনা করার জন্য বেশি সময় বের করে নিতে পারেন।

 চতুর্থ সপ্তাহে তিনি অনুশীলন করতে শুরু করলেন সংকল্পের। এর অর্থ এটাই যে, সেই সপ্তাহের প্রতিটি দিনে তিনি যে যে কাজ করার জন্য সংকল্প নিয়েছিলেন, সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত তিনি কখনও ক্ষান্ত হতেন না।সংকল্পের দৃঢ়তা তার তালিকাটিতে থাকা বাকি গুলগুলি সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করার জন্য তার মনে সাহস জুগিয়ে ছিল।

 মিতব্যয়িতা এবং অধ্যবসায়ের অনুশীলন তাকে সমস্ত ধারের বোঝা থেকে মুক্ত করে আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল এবং স্বাধীন করে তুলেছিল। তার ফলেই বাকি দুটি গুণ, আন্তরিকতা এবং ন্যায়পরায়ণতার অনুশীলন করাটা তার পক্ষে বেশি সহজ হয়েছিল।

 অবিরাম সাধনার দ্বারা নিজের স্বভাব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করার জন্য চেষ্টা করা মানুষ বেঞ্জামিন ছাড়াও অন্য অনেকে নিশ্চয় আছে। কিন্তু তার মতো পরিকল্পিত এবং প্রণালীবদ্ধ ভাবে এই কাজ করার উদাহরণ বড়ো বেশি নেই। নিজের চরিত্র গঠনের জন্য বেঞ্জামিন উদ্ভাবন করা এই পদ্ধতি পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথ দেখিয়েছে এবং অনুপ্রেরণা দান করেছে।


বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০২৫

আকাশের বুক চিরে ।। অনিক ইসলাম ।। কবিতা, বাংলাদেশ, Anik Islam

আকাশের বুক চিরে

অনিক ইসলাম




নীল আকাশের বুক চিরে

রক্তাক্ত জামা পড়া ক্রন্দনরত 

শিশুর মতো ভালোবাসার আকুতি

তোমার দিনগুলো ফিরে ফিরে

তোমার পথ দেখে।

কেনো জানি আকাশ বলে

ভালোবাসা-- আমি মিথ্যা বলেছি

তোমার মৃত্যু হয়েছে!

তবুও আমি তোমাকে 

হ্যাঁ, তোমাকেই ভালোবেসেছি,

একটু সময়ের অপেক্ষা 

একদিন তোমার বুকেই ফিরবো

ঠিক যেমন দুজনে বাঁচতে চেয়েছি।

শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫

আটপৌরে কবিতা, Atpoure সৌমিত্র রায়

 আটপৌরে কবিতা, Atpoure

সৌমিত্র রায়



১১) আমাদের রাজপথ


    জ্যাম। ঘাম। দুপুর। 

           কলকাতা

পথচারীর পথ এই রাজপথ


১২) মেট্রো রেল, যাত্রাপথে 


     মেট্রো। সিট। ঠাণ্ডা।

            বাতানুকূল

এই আরাম। আনন্দের পথ।


১৩) জীবন, সময়ের কোলাজ 


    অতীত। বর্তমান। স্মৃতি।

                 জীবন 

টুকরো টুকরো সময়ের কোলাজ


১৪) যোগ শৃঙ্খল হোন 

শান্ত হোন। আত্মা।

       পরমাত্মা

যুক্ত হয়েছেন। আনন্দ নাও।


১৫) স্মরণে 

  স্মরণে। জাগে শক্তি।

            আত্মা

তুমি নিজেকে স্মরণ করো

সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫

ঐতিহাসিক ভাষা-শহিদ দিবস, 19 May ।।

 ঐতিহাসিক ভাষা-শহিদ দিবস



আজ ঐতিহাসিক ভাষা-শহিদ দিবস। ১৯৬১ সালে ১৯-এ মে আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরে বাংলা ভাষা রক্ষা করার আন্দোলনে ১১ জন শহিদ হয়েছিলেন । কমলা ভট্টাচার্য শহিদ হয়েছিলেন ৷ বিশ্বের প্রথম মহিলা ভাষাশহিদ তিনি । শহিদ হয়েছিলেন হিতেশ বিশ্বাস কানাইলাল নিয়োগী সুনীল সরকার সুকোমল পুরকায়স্থ তরণী দেবনাথ শচীন্দ্র পাল কুমুদরঞ্জন দাস সত্যেন্দ্র দেব বীরেন্দ্র সূত্রধর চণ্ডীচরণ সূত্রধর । এই অমর শহিদদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ৷ ৷৷ শান্তি ৷৷

সোমবার, ১২ মে, ২০২৫

আটপৌরে কবিতা, Atpoure সৌমিত্র রায়

 আটপৌরে কবিতা, Atpoure

সৌমিত্র রায়



৬) আকাশের দৃশ্য 


জানালা। দৃশ্য। অনুভুতি।

           আকাশ 

পৃথিবীর চিরন্তন ছন্দময় সম্পর্ক


৭) বৈশাখী সম্পর্ক 


হাওয়ায় দুলছে গাছ

          বৈশাখ 

কখনও মৃদুমন্দ, কখনও ঝোড়ো।


৮) দুঃখিত !


   দুঃখ সৃজন করেছো

             নিজেই 

কারণ: হয়তো কিছু চেয়েছিলে


৯) জীবনালেখ্য


শূন্যের ভেতর। শক্তি।

           শক্তিই

দৃশ্যের প্রাণ। জীবন। আলেখ্য। 


১০) প্রকৃতি পূজা


তুলসীমণ্ডপ। ঝারা। পূজা।

           জীববৈচিত্র্য 

ছোলা-গুড়। জল। উপাসনা। প্রাণের।

রবিবার, ১১ মে, ২০২৫

আটপৌরে কবিতা ।। সৌমিত্র রায়, Atpoure

 আটপৌরে কবিতা, Atpoure

সৌমিত্র রায়



১) ওড়াউড়ি, আনন্দে


  মেঘ। পাখি। পতঙ্গ

         ) কবিমন (

যে যার উচ্চতায় ওড়ে



২) জীবন; অনন্ত; চৈতন্য 


ময়ূরপুচ্ছ। ইশারা। ক্লোনিং

          > জনন >

অযৌন। চৈতন্য প্রেম- অনন্ত।



৩) ছন্দ; রস; আটপৌরে 


  প্রেসার কুকার। সিটি।

       # ছান্দসিক #

ডাইনিং টেবিল। অফিস। ট্রেন।


৪) আত্মকথনে মাতি


ফিসফাস। খুনসুটি। আলাপন

             < স্ব-চ্যাট >

নিজে। প্রকৃতির সাথে। আনন্দধ্বনি।



৫) অদৃশ্য সংযোগ 


গ্রহ। নক্ষত্র। পদার্থ

       <প্রাণ>

আসল # সংযোগ # সব # অদৃশ্য

রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

বসন্ত ।। দীপালি মাইতি ।। কবিতা, Dipali Maity

বসন্ত

দীপালি মাইতি



শরীরে ফুটেছে 

আগুন রঙের 

পলাশ শিমুল 


বসন্ত এলে দুলিয়ে 

দিয়ে যায় হৃদয়

আনমনে


সংসারে হারিয়ে যায় 

সুখ দুঃখ 

কপূর্রের মতো ঝুলে

থাকি বাতাসে

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...